#মুক্ত_পিঞ্জিরার_পাখি
#পর্বঃ১৮
#Ipshita_Shikdar
৪৮।
লাল টকটকে বেনারসি পড়ে, বধূবেশে সাদা চাদরের উপর হাটুতে মাথা গুঁজে বসে আছে প্রিয়া। স্তব্ধ মুখশ্রী, অথচ চোখজোড়া হতে অবিরাম ধারায় অশ্রু ঝড়ছে। বুঝতে পারছে না অপরূপা সাজে সজ্জিত রমণী প্রিয় মানুষকে হারানোর ব্যথায় নোনা জল ঝরাবে সে নাকি এই বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার শোকে। এ এক অন্যরকম নরকতুল্য যন্ত্রণা ভোগ করছে সে।
অতীত,
বাড়িতে প্রবেশ লাগেজ হাতে প্রবেশ করে বাড়ির নিঃশ্চুপ পরিবেশ দেখে ভেবেই বসেছিল কোনো অঘটন ঘটেছে। তাকে খেয়াল করতেই বাকিরা খাণিক নড়েচড়ে বসে। এর মাঝেই তার ভাই এগিয়ে আসে।
“এসেছিস তুই? দে, ব্যাগটা দে!”
বলে যেই লাগেজটা নিতে যাবে তখনই প্রিয়া সরে যেয়ে হাত দেখিয়ে থামা ইঙ্গিত দেয়। মৃদু থমথমে গলায় জুঁই খালাকে জিজ্ঞেস করে,
“খালা, মা কই? আর বাবাই বা কোথায়!”
“ভাই আর আপায় তো নিজ নিজ ঘরেই। ভাইরে এই মাত্র হাসপাতালের থেকা বাড়ি আনলো।”
এই কথা শুনে প্রিয়া আর দাঁড়ায় না, কোনোদিকে না তাকিয়ে চলে যায় প্রিয়া চলে যায় বাবা-মায়ের ঘরে। ডানপাশের ছোট্ট ঘরটাতেই তার বাবার ঠিকানা। ঘরে যেয়ে মাকে আর ঘরে খুঁজে পায় না। আর বাবা বিছানায় শুয়ে, ঘুমিয়েই আছে বোধহয়। মুখটা কেমন শুকিয়ে আছে বাবার, চোখের নিচে কালো দাগ ছেয়ে।
“তবে কি বাবা ভালো নেই!”
বিড়বিড় করে বলে উঠে সে। এদিকে তার ঘরে আসার টুকটাক আওয়াজে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে তার বাবার। কিন্তু ঔষধের কারণে চোখ খুলতে পারছে না। অনেকটা গলা উঁচিয়েই সে চোখজোড়া বদ্ধ রেখেই বলে উঠে,
“কে? পালকের মা…? জানালাটা খুলে দাও তো কেমন দম বন্ধ বন্ধ লাগে।”
বাবার কথায় দ্রুত জানালার কাছে যেয়ে পর্দা সরিয়ে খুলে দেয়। তারপর নিচু গলায় বলে,
“বাবা, আমি প্রিয়া।”
কথাটা কানে আসতেই বয়সের ছাপ পড়া চোখেমুখে খুশির ঝলক দেখা দেয়।জোর করেই চোখজোড়া খুলে তিনি বলে উঠেন,
“প্রিয় তুই এসেছিস? তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম আমি। তুই এসেছিস তো , এখন আমি আমার সব দায়িত্ব শেষ করে শান্তিতে…”
তাকে শেষ করতে না দিয়েই পরিচিত নারী কণ্ঠে কেউ শক্ত গলায় বলে উঠে,
“প্রিয়, তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে। ”
“হুম, বলো মা। কিন্তু তার আগে বলো বাবার কী হয়েছে?”
স্ত্রীকে উত্তর না দিতে দিয়েই প্রিয়ার বাবা বলে উঠেন,
“সে কিছু না। এই বয়সে এমন একটু-আধটু শরীর খারাপ হয়েই থাকে।”
প্রিয়ার মা রাগী গলায় বলেন,
“মিথ্যে বলছো কেন? বলো সন্তানের চিন্তায় হার্ট এ্যাটাক করে মরতে বসেছিলে! যাকগে শোন প্রিয়া, তোর বাবার অবস্থা ভালো না সে চাচ্ছে আজকের মধ্যে তোর বিয়ে করিয়ে দিতে।”
বিস্মিত হয় যুবতী। বেশ জোর গলাতেই বলে,
“হোয়াট! কী বলছো তুমি! আমি কোনো বিয়ে-টিয়ে করছি না।”
এ কথা কানে পৌঁছানো মাত্রই উত্তেজিত হয়ে উঠেন তার বাবা। রাগের বশে “কেনো করবি না?” বলে চেঁচিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করতেই বুকের ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠে পুনরায় বিছানায় হেলে পড়েন তিনি।
শুরু হয় প্রিয়ার মায়ের চাঁপা হুংকার, অকথ্য গালিগালাজ এবং কান্নাকাটি। কিন্তু প্রিয়ার কানে এই বিলাপ জ্বলন্ত সীসার মতো বিঁধছে, তবুও সে স্তব্ধ ও নিঃশ্চুপ।
মধ্যবয়স্ক নারীটি যেন মেনে নিতে পারলেন না তার মেয়ের এত কষ্টের মাঝে পাষাণের মতো বসে থাকা। দুই বাহুতে ধরে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে হুমকি দেওয়ার নয় বললেন,
“আজ তুই হয় বিয়ে করবি নাহয় বাপ-মায়ের মরণের দিন উদযাপন করবি। ”
প্রিয়া ভাঙা গলায় বলল,
“মা, কী বলছো এসব? আমাকেও তো একটু বুঝো।”
আরও কিছু বলার ছিল যুবতীর কিন্তু তার মা কোনো কিছুই কানে নিলো না। শুধু আদেশ করার ন্যায় বললেন,
“ঘণ্টা খাণেক পরই তোর বিয়ে হবে। নিজের ঘরে যা চুপচাপ যদি ভালো চাস। আমি আয়শা আর রাণীকে পাঠাচ্ছি, কোনো ঝামেলা ছাড়া তৈরি হয়ে বিয়েটা হতে দিবি।”
নিজের কথা শেষ করেই তিনি গটগট করে বের হয়ে গেলেন। অতঃপর মায়ের কঠোর বচন ও আদেশের কাছে হার মানে প্রিয়ার ভালোবাসা। পুরোটা সময় স্তব্ধ ছিল, তবে কাঁদতে তার বারণ ছিল। তাই বিয়ের পুরোটা সময় সে এক ফোঁটাও কাঁদেনি, মায়ের কোনো কথা সে আজ অমান্য করতে চায় না।
বলা বাহুল্য, বিয়েটা হয়েছে প্রিয়ার বাবার বন্ধুর ছেলের সাথে, যার নাম ‘মাহদি’। এছাড়া কিছুই জানা নেই প্রিয়ার, এটুকুও শুনেছে কবুল বলার মুহূর্তে কাজির বদৌলতে। তবে যুবতী মোটেই এই বিয়ে মেনে নিতে প্রস্তুত নয়, কোনো কারণ ছাড়াই সে মনে মনে বেশ ক্ষিপ্ত লোকটির প্রতি।
প্রিয়ার শ্বশুরবাড়ি ঢাকাতে হওয়ায় আজ রাতটা এখানেই থাকতে হবে, তাই বাসরের আয়োজনটা পাত্রীর বাড়িতেই করা হয়েছে। বাসর ঘরে নিয়ে যাচ্ছে প্রিয়াকে তার কাজিনরা। ঘোমটার আড়ালে মলিন মুখে সে ভাবছে অন্য এক কথা।
” বিয়ের এই রাত্রিতেই লোকটিকে বলে দিব এই বিয়ে আমি মানি না। খুব শিঘ্রই তালাক দিয়ে দিবো।”
সে বাসর ঘরে প্রবেশ করার পরপরই তার মা আসে। হাতে দুধের কাপ ধরিয়ে খুব শান্ত গলায় বলেন,
“সংসারটা খুব আদর, যত্ন, ভালোবাসা ও মায়ার ধন। প্রথমে মনে হয় এ আর কী, শূণ্য এক থলি, কিন্তু সময়ের ব্যয়ে কখন যে শূণ্য থলি সাত রাজার ধন হয়ে দাঁড়ায় বুঝাও যায় না।”
একটু থেমে মেয়ের হাত ধরে বিনীত গলায় বলেন,
“এই সংসারটা আগলে রাখবি, কখনো মানুষকে সুযোগ দিবি না তোর ভুল ধরার, কারণ মনে রাখবি তোর একটা ভুলে তোর গোটা পরিবারকে দোষী করা হবে না। ছেলেটা ভালো, স্বামীর মনে জায়গা করে নিবি। জানিস, পাড়াপড়শিরা বলাবলি করে তোকে দিয়ে নাকি সংসার হবে না, তুই নাকি কাজে যোগ দিয়ে তাতেই মজে গিয়েছিস পুরো, আবার কেউ বলে চরিত্র সমস্যা তাই বিয়ে হয় না। আজ তাদের সবার মুখে আমি চড় মেরেছি এই বিয়ের দ্বারা, নিজের মান রেখেছি, দেখিয়ে দিয়েছি আমার মেয়ে কোনো দিক দিয়ে কম না। ব্যাপারটা সেভাবেই রাখিস। আর ছেলেটার উপর ঝাঁঝ তুলবি না, সে কিছুই জানে না।”
মা আরও নানান কথা বলে প্রিয়াকে বিছানায় বসিয়ে রেখে চলে গেলেন। প্রিয়া ঘোমটার আড়ালে নানান দ্বিধায় জর্জরিত হয়ে বসে আছে, মায়ের কথাগুলো শুনার পর তার বিন্দুমাত্র সাহস নেই ছেলেটাকে নিজের চিন্তা করা কথাগুলো বলার। তার ভাবনার মাঝেই দরজা খুলে প্রবেশ করে কেউ। লাল বেনারসির আড়াল থেকে সে শুধু একজোড়া পুরুষালি পা ঘরে ঢুকছে দেখতে পায়। সে ভয়ে মনে মনে ভাবছে,
“লোকটা যদি আজ নিজের প্রাপ্য অধিকার চেয়ে বসে…!”
এদিকে অচেনা লোকটা খুটখুট আওয়াজে কিছু একটা করে সে বিছানার যে পাশে বসেছে সে পাশে। এবার ভয়া প্রিয়ার হাত-পা কাঁপার দশা। সে কয়েক ঢোক গিলে কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে, কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে বিছানার পাশের সাইড টেবিলে বিদ্যমান দুধের গ্লাসটি তুলে নিয়ে তা ঢকঢক করে পান করে নেয়। তারপর কিছু না বলেই ধপ করে তার পাশে শুয়ে পড়ে।
প্রিয়া কিছুক্ষণ আগের সব ভয়, রাগ, কান্না, বেদনা ভুলে গিয়ে ভাবছে,
“হে আল্লাহ! এ কেমন ছেলে!”
পরক্ষণেই ভাবে,
“মনে হয় ছেলেটারও আমার মতো জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাহলে তো ভালোই, কিন্তু আমি আগে আগে কিছু বলবো না।”
চলবে…