মুক্ত_পিঞ্জিরার_পাখি পর্ব ১৭

#মুক্ত_পিঞ্জিরার_পাখি
#Ipshita_Shikdar
#পর্বঃ১৭
৪৬।
“প্রিয়া রে তুই এখনই বাসায় আয়। তোর বাবার অবস্থা ভালো না।”

কলটা রিসিভ করতেই মায়ের অস্বাভাবিক গলায় এমন কথা শুনে বুক কেঁপে উঠে প্রিয়ার। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে হতবাক কণ্ঠে বলে উঠে,

“কী বলছো এসব! বাবা কোথায়? ফোন দাও বাবাকে।”

“এত কথা বলার সময় নাই রে মা, তুই যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি ফিরে আয়।”

বলেই কলটা কেটে দেয়। অথচ, অপর প্রান্তের নারীটির দিশেহারা দশা, বাবা যে আস্ত এক ভালোবাসার পক্ষী, যাকে হৃদমাঝারে আটকে রাখে সে সর্বদা। এই পিঞ্জিরার পক্ষী কী করে মুক্ত হয়ে যেতে পারে! তাকে হারালে যে এই নারীটির অনেকটাই ধ্বংস হয়ে যাবে।

চাপা কান্নায় নিমজ্জিত হয় সে। কী করবে, কী হচ্ছে, কাকে বলবে কিছুই যেন তার মাথায় ঢুকছে না। আজ সকালেই ঢাকায় ফিরেছে সে, আর একটু বেলা হতেই মায়ের কল।

হঠাৎই কী ভেবে কে জানে, কেমন যেন শক্ত হয়ে উঠে সে। অশ্রু মুছে দাঁড়িয়ে যায় সে, টেবিল থেকে পার্স আর ট্রিপের লাগেজটা নিয়েই বেরিয়ে যায় সে। গন্তব্যস্থল নিজের সেই ছোট্ট শহর, যেখানে বেড়ে উঠে তার। এই শহরের অলিগলিতেই তো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছেলেবেলার নানা সুখময় স্মৃতি।

বাবার বিশ্বস্ত আঙুল আঁকড়ে ধরে মেলা, রাস্তা, সারা শহরময় ঘুরে বেরানোর দিনগুলো। মায়ের সাথে রাগ দেখিয়ে গলির মোড়ে রাগ করে দাঁড়িয়ে থাকা বা ভাইয়ের রাগ ভাঙিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে আনা সবকিছুর সুখময় স্মৃতিই সেখানে জুড়ে।

ভাইয়ের কথা মনে পড়তেই মনটা বিষিয়ে যায় তার। ততক্ষণে গুলিস্তানের কাঙ্ক্ষিত বাস স্ট্যান্ডের সামনে এসে থেমেছে সিএনজি। ভাড়া মিটিয়ে বাসের টিকেট কেটে উঠে পড়ে সে, বাসটা তেমন মানব পূর্ণ হয়নি তখনও। বসে সিটে গা এলিয়ে দেয় মলিন মুখে। ব্যথিত গলায় আনমনেই বলে উঠে,

“আমার হৃদয়ের অতি ভালোবাসা, ভরসার আশ্রয়স্থল ছিল তিনটি পুরুষই। ভাই তো কবেই পর হয়েছে, আরিজ আমার হবে বা আছেই কিনা তারও নির্দিষ্টতা নেই, আমার বাবাও… আমার নিয়তিটা এমন কেন হলো আল্লাহ! কেন প্রিয় মানুষগুলো দূরে চলে যাচ্ছে এক এক করে?”

তখনই এক কালো খিমার পরিহিতা নারী তার পাশে এসে ধপ করে বসে। যুবতীর ভাবনার ঘোর ভাঙে এবং চোখ তুলে পাশে তাকায়। নারীটি বেশ শীতল গলায় বলেন,

“মা রে, জীবনটা আমাদের হাতে না। আমরা তা সাজাই না, ঐ যে উপরে একজন বসে আছে তার হাতে সব। আমরা শুধু আমাদের কাঙ্ক্ষিত ইচ্ছে পূরণের ফরমাইশই করতে পারি, তার কাছে চাইতে পারি। সে দেয়নি বলে ভাবিস না, সে তোর ভালো চায়নি। মা-বাবা তো শুধু আমাদের এই পৃথিবীতে আনে তাতেই তারা আমাদের ভালোর জন্য সব করতে প্রস্তুত থাকে, আর আল্লাহ… তার তো শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি আমরা, তাহলে ভাব কতোটা প্রিয়! নিরাশ হবি না, পরিকল্পনার বাইরে অনেক কিছুই হবে, হয়তো সাময়িকভাবে তার ফলাফলটা খারাপও দেখাবে, কিন্তু একটু ধৈর্য্য ও বিশ্বাস নিয়ে সময়টা কাটিয়ে ফেললেই দেখবি তোর ভালোটা সেখানেই ছিল।”

নারীটির কণ্ঠে বেশ বুঝতে পারলো তিনি প্রিয়ার মায়ের বয়সী। কিন্তু কথাগুলোর আবেশে শীতলতা বয়ে যায় সে সারা হৃদয়ে। এই সময় খুব করে দরকার ছিল কাউকে একটু ভরসা, সাহস যোগানোর জন্য।

অনেক কঠিন সময় বা পরিস্থিতিতে অপরিচতও এমন কিছু করে ফেলে আমাদের জন্য, যার জন্য আপন মানুষদের কাউকেও পাওয়া যায় না।

সময়ের ব্যবধানে যাত্রা শেষ করে বাড়ির প্রাঙ্গণে পা রাখা পক্ষী। দরজার বেল বাজাতেই ছুটা কাজের লোক জুঁই খালা দরজা খুলে দেয়। মলিন মুখে বাড়িতে প্রবেশ করতেই দেখে সারা ঘরে মেহমান গিজগিজ করছে। অবশ্য মেহমান নয়, সবাই-ই নিকটাত্মীয়। কিন্তু তাদের সবার মুখশ্রী কেমন গম্ভীর, সারা বাড়িময় যেন কেমন একটা ভার ভার ভাব। এর অর্থ খুব একটা অস্পষ্ট নয়, পরিচিত শঙ্কায় কেপে উঠে প্রিয়া।

মনে মনে বলে উঠে,

“তবে কী…!”

৪৭।
আজকাল আরিজের পাগল পাগল দশা, তার ঠিক কী করা উচিত ভেবেই পাচ্ছে না সে। জীবনের এমন এক মোড়ে সে এসে দাঁড়িয়েছে সে, যেখানে সে যেটাই করবে, যে পথেই চলবে নিজের কাছে নিজেই লজ্জিত হয়ে যাবেই। অপরাধ না করেও আজ অপরাধবোধে দিন কাটছে তার। পক্ষীর থেকেও দূরত্ব বজায় রেখে চলে সে।

সেদিনের পর থেকে আজ দুটো দিন ধরে পক্ষীর সাথে দূরত্ব বজায় রেখেই চলে সে, কথোপকথন বন্ধ বললেই চলে। মেয়েটার দিকে তাকালে যেমন মায়ার বাধন আঁকড়ে ধরে তাকে তেমনই অপরাধবোধও হয়। কারণ তার নিকট সত্যি তো এটাই যে সে সেই মেয়েটাকে ধোঁকা দিয়েছে যে তার জন্য নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করেছে।

আবার প্রিয়ার কল বা ম্যাসেজ কিছুতেই প্রতিক্রিয়া দেখায় না, এতেও বড় অপরাধবোধ হয়। কারণ সেদিন পক্ষীর প্রশ্ন বা মৃণ্ময়ের কথাগুলো সবকিছুর দ্বারাই একটা বিষয় ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছে। তা হলো পূর্বে সে কারো প্রেমিক হলেও এখন একজন নারীর স্বামী, তার সর্বস্বই সেই নারীটির হক। সেখানে পূর্বের প্রেমিকাও যে পরনারী।

এখন তার হৃদয়ে অনুতাপের আগুনে দগ্ধ হয় প্রতি ক্ষণে ক্ষণে, এ থেকে পরিত্রাণের যেন কোনো উপায়ই পাচ্ছে না সে। প্রতি ওয়াক্তের সালাতে সে আল্লাহর নিকট হাত পেতে বলে,

“আল্লাহ এ অনুতাপের আগুন যে বড় কষ্টকর, মৃত্যুসমই হয়তো। আমি আর পারছি না আল্লাহ, আমাকে বের করে আনো এই পরিস্থিতি থেকে।”

তার এখন প্রায়শয়ই মন চায় পক্ষী, প্রিয়া, সবকিছু ছেড়েছুড়ে বহুদূরে যেয়ে পাড়ি জমাতে। যেখানে এমন কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন না হতে হয়। কিন্তু চাইলেই কী যাওয়া যায়! ঐ যে একরাশ পিছুটান আঁকড়ে ধরে আছে।

বর্তমানে, লেখক আরিফ আজাদের বেলা ফুরাবার আগে বইটি পড়ছে সে। তখনই পক্ষী ঘরে এসে উপস্থিত হয়। যুবক ইচ্ছে করেই কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে একই ভাবে বই পড়ায় মেতে থাকে, যদিও তা এক প্রচেষ্টা মাত্র, সত্যিকার অর্থে তো সে চায় নারীটিকে সারাক্ষণ বিচরণ করতেই।

যুবতীর মোটেই পছন্দ হয় না লোকটার এমন উদাসীন আচার-আচারণ। এই দুদিনেই যেন হাপিয়ে উঠেছে, সে যে এক সপ্তাহে অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল এই লোকটার ঐ রূপের সাথে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই আনমনেই ভেবে উঠে সে,

“এই লোকটার কী হয়েছে? এমন আচারণ করছে কেন? সেদিনের জন্য… কিন্তু আমার কথায় কী আদৌ কোনো ভুল ছিল না।”

এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে এক পা আরেক পায়ের স্কার্ট প্লাজোর উপর দিয়ে দিয়েছে টেরই পায়নি, ফলাফল স্বরূপ ধপ করেও পড়ে যায় সে।

ব্যথায় আর্তনাদ বেরিয়ে আসে তার অধরজোড়ার ফাঁক দিয়ে। আরিজ দ্রুতো উঠে পক্ষীকে কোলে উঠিয়ে বিছানায় বসায়। ডান পা দেখতে দেখতে রাগের সুরেই বলতে লাগে,

“চোখ কোন দিকে রেখে হাঁটো, হ্যাঁ! তুমি কি বাচ্চা যে ঘরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে পড়ে যাও।”

পক্ষী অবাক হয়ে এই যুবককে দেখতে থাকে। সে যেন চিনতেই পারছে না এই ছেলেকে। এই ছেলে কেন তার প্রতি এত যত্নশীলতার পরিচয় দিচ্ছে সেটাই তার ভাবনার বাহিরে। আপনমনেই এসব ভাবতে ভাবতে বিড়বিড় করে বলে উঠে,

“আমি কে হই উনার? অবশ্যই কেউ না, এক দুঃস্বপ্ন ব্যতিত, যার অতি শিঘ্রই সমাপ্তি ঘটতে চলেছে। তাহলে আমার জন্য কেন এতোটা চিন্তিত হচ্ছেন উনি?”

আরিজ তার কথার কিছুটা শুনতে পেলেও খুব অস্পষ্ট শুনায় বুঝতে পারেনি। তাই ডান পায়ের পাতা টিপে দিতে দিতেই ভ্রুজোড়া কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

“কী বললে?”

যুবতী হচকচিয়ে উঠে বলে উঠে,

“আমি… না মানে আমি বলছিলাম আমি তো ডান পায়ে না বাম পায়ে ব্যথা পেয়েছি।”

এবার যেন যুবক নিজেই বোকা বোনে যায়, দুশ্চিন্তায় বোধহয় চিন্তাশক্তি হ্রাস পেয়েছে তার। বোকা হেসে বলে,

“ওহ, আসলে বুঝতে পারিনি আমি। ”

তারপর তার পায়ের গোড়ালিটা ভালোভাবে দেখে বলে,

“মাংসে লেগেছে, ঠিক হয়ে যাবে। মুভ দিয়ে দিচ্ছি আমি।”

“হুম।”

অতঃপর পক্ষীর পায়ে মুভ স্প্রে করে, একটা ব্যথানাশক ঔষধ খায়িয়ে দেয় আরিজ।

৪৮।
লাল টকটকে বেনারসি পড়ে, বধূবেশে সাদা চাদরের উপর হাটুতে মাথা গুঁজে বসে আছে প্রিয়া। স্তব্ধ মুখশ্রী, অথচ চোখজোড়া হতে অবিরাম ধারায় অশ্রু ঝড়ছে। বুঝতে পারছে না অপরূপা সাজে সজ্জিত রমণী প্রিয় মানুষকে হারানোর ব্যথায় নোনা জল ঝরাবে সে নাকি এই বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার শোকে। এ এক অন্যরকম নরকতুল্য যন্ত্রণা ভোগ করছে সে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here