#মুক্ত_পিঞ্জিরার_পাখি
#পর্বঃ২
#Ipshita_Shikdar
গতকাল, দুপুর বারোটাতেই বাচ্চাদের কলরব ও ঢাকঢোলের সুরে মুখরিত সারা দেওয়ান বাড়ি। আসলাম দেওয়ান বেশ ছুটাছুটির মাঝে ব্যস্ত, তবুও একফোঁটা ক্লান্তি নেই তার দেহে। বরং, চোখেমুখে ফুটে আছে অন্যরকম এক আনন্দ, সন্তানের সুখে সুখী হওয়ার আনন্দ। হাতে কাচের ট্রে থাকা অবস্থায় কল আসে তার ফোনে। একহাতে কোনোরকম ট্রেটি ধরে কলটা রিসিভ করে ফোন কানে উপর রাখে।
অপরপাশের ব্যক্তিট থেকে কিছু একটা শুনতেই ধপ হাত জোড়া অসাড় হয়ে আসে তার, ছনছন শব্দে ট্রে ভেঙে কাঁচ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। মিসেস দেওয়ান এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করতেই তিনি স্তব্ধ গলায় বলে উঠেন,
“প্রথমের গাড়ির এক্সিডেন্ট হয়েছে। আমাকে যেতে হবে, আমি যাচ্ছি।”
এটুকু বলেই ঘর থেকে বের কোনোদিকে না তাকিয়ে তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে পড়েন তিনি। হাসপাতালে পৌঁছেই দেখে অপারেশন থিয়াটারের সামনে তার খুব কাছের ভাই তুল্য বন্ধু দাঁড়িয়ে। তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন,
“আজমল ভাই, তুই এখানে…?”
এর মাঝেই তার হবু বিয়াই এসে কান্না ভেজা গলায় বলে উঠেন,
“উনাকে কী বলছেন, বিয়াই! উনার ছেলেই তো আমাদের সুখে আগুন দিল, তার জন্যই তো এক্সিডেন্ট হল।”
তাকে আর বলতে না দিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ বলল,
“দেখেন, এটাতে মি. আরিজ জামানের কোনো দোষ নেই। আপনার ছেলে যে গাড়িতে ছিল সেটারই ব্রেক খারাপ ছিল। আমরা রাস্তার সিসিটিভি ফুটেজ দেখেছি অফিসার আরিজ যদি শ্যুট ক্রিমনালের গাড়ির দিকেই করেছিল, কিন্তু আপনাদের গাড়ি ব্রেক ফেল হওয়ায় ড্রাইভার প্রথম থেকেই উল্টাপাল্টা চলছিল, এট দ্য ইন্ড গাড়িটিই হঠাৎ করে মাঝে চলে আসে। আর তাই এই দুর্ঘটনা ঘটে। চিন্তা করবেন না, যেখান থেকে আপনারা গাড়ি ভাড়া নিয়েছেন সেখানের বিরুদ্ধে আমরা একশন নিয়েছি।”
পুলিশ অফিসারের কথায় আসলাম দেওয়ানের আর বুঝতে বাকি রইলো না কী হয়েছে। কারণ তার বন্ধুর ছেলে আরিজ জামান যে স্পেশাল অফিসার এবং ইতিমধ্যে একটি কেসে জুড়ে ছিল তা তারও জানা। তবুও তার অবচেতন মন আরিজকেই দোষী মানছে। কারণ ব্রেক ফেল থাকলেও দুর্ঘটনার মূল কারণ তো আরিজের শ্যুট করাই ছিল।
সে এ নিয়ে মৌন ভাবে থাকলেও প্রথমের বাবা বেশ রেগে পুলিশের উদ্দেশ্যে বলেন,
“আমরা কিছু বুঝি না ভেবেছেন নাকি? শোনেন, এক্সিডেন্টটা ব্রেক ফেল থাকার কারণে হয়নি শ্যুট করার কারণে হয়েছে। আমার ছেলেটার যদি কিছু হয় না…!”
এ কথায় সায় জানিয়ে পক্ষীর বাবাও বলে উঠেন,
“ঠিকই বলেছে বিয়াই। সব তোর ছেলের জন্যই হয়েছে আজমল ভাই। একদিন তোর ছেলের জীবন বাঁচাতে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলাম, ভাবিনি যে এর ফল মেয়ের সুখশান্তি বিসর্জন দিয়ে পাবো।”
আজমল জামান আজ যেন মৌনব্রত পালন করছে। কাকে কী বলবে সে, স্বজন হারালে তো কেউই বোঝার অবস্থায় থাকে না। তাছাড়া এই ব্যক্তিগুলোর যুক্তিও ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
অপরদিকে তিনি বের হতেই শুরু হয় মিসেস দেওয়ানের মেয়েকে বঞ্চনা করা। আত্মিয়-স্বজন সবাই তাকে থামিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালালেও তিনি থামতে মোটেও ইচ্ছুক নয়।
পক্ষী তো সবটা শুনে অঝোর নয়নে কাঁদছে। তার মায়ের সাথে তার ছোটবোনও বঞ্চনা করে বলে,
“শুধু তোর জন্য বাবা-মার চিন্তার কোনো শেষ হয় না। আচ্ছা, তোর কী লজ্জা বলতে কিছু নেই!”
অথচ যাকে এত অপদস্থ করছে তার পরিস্থিতি কেউ একবার বুঝারও চেষ্টা করল না। কাঁদতে কাঁদতে সে যেখানে রীতিমতো মরার দশা, সেখানে মা-বোন পারে না নিজ হাতেই মেরে ফেলে। হাসপাতাল থেকে খবর আসে, প্রথমের অবস্থা খুব ক্রিটিকাল।
কথাটা জানা মাত্রই পক্ষী বধূবেশেই বাড়ি থেকে বের হয়ে অটোরিকশা নিয়ে চলে হাসপাতাল। সেখানে যেয়ে বাবার বুকে মাথা রেখে শব্দ করে কেঁদে উঠে। আসলাম দেওয়ানে নিরব থেকেই মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মেয়েকে কী বলে সান্ত্বনা দিবে তার জানা নেই। আজ পক্ষীর কান্নার শব্দের ঝংকারে আজ হাসপাতালে উপস্থিত প্রতিটি মানুষের হৃদয় কেঁপে উঠছে। এত কান্নার একটাই কারণ, তার প্রথম যে আর নেই। একসময় কান্না করতে অজ্ঞানই হয়ে পড়ে সে।
মেয়ের কান্নার কারণের একমাত্র দোষী তার কাছে আরিজকেই লাগছে। সে জানে আজ থেকে তার মেয়ের সব সুখ শেষ হতে চলেছে, অপয়া নামটি অলিখিত ভাবে জুড়তে চলেছে তার মাথায় আজীবনের জন্য। এসব ভেবেই নিজের ক্রোধানলের পোড়ন কিছুটা কমাতে চলে যায় আজমল জামানের কাছে।
ক্ষিপ্ত গলায় বলে উঠেন,
“দেখ, তোর ছেলের জন্য আজ আমার মেয়ের মরণদশা এসেছে। আর বেঁচে থাকলেও মানুষের কথা শুনে শুনে মরতে হবে। এখন তো মনে হচ্ছে তোর ছেলেকে বাঁচানোর আগে আমি কেন মরিনি!”
আজমল জামান করুণ গলায় বললেন,
“এভাবে বলিস না, ভাই। আমার ছেলেটারে মাফ করে দে, দয়া করেই মাফ করে দে!”
এ কথা যেন রাগে ঘি হয়ে পড়লো,
“কীভাবে ক্ষমা করব তোর ছেলেকে? বল, কীভাবে! তুই পারবি আমার মেয়েকে আবার স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে? আমার মেয়েকে যে সমাজ অপয়া বলে সম্বোধন করবে তা থেকে বের করে আনতে? পারবি আমার মেয়ের…”
উনাকে শেষ করতে না দিয়েই আজমল জামান বলে উঠেন,
“পক্ষী মায়ের স্বাভাবিক জীবনই থাকবে আজকের পরও। তাকে কেউই অপয়া বলবে না, যার জন্য তার এই অবস্থা সেই সবকিছুর দায় নিবে। আমার ছেলে বিয়ে করবে তোর পক্ষীকে।
আরিজের তেমন একটা ব্যথা লাগেনি, শুধু আচমকা ভুল গাড়ির এক্সিডেন্ট দেখে তার বাইক ইমব্যালেন্স হয়ে মাথায় ব্যথা পায়, সেটার চিকিৎসার জন্যই তাকে অজ্ঞান করা হয়। জ্ঞান ফিরার দশেক মিনিট পরেই আজমল জামান দৃঢ়ভাবে বলেন,
“তোমার আজ বিয়ে এই পোশাক পড়ে তৈরি হয়ে নেও, এখান থেকে সোজা মেয়ের বাড়িতে যাবো।”
সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কী অদ্ভুত কথা বলছো বাবা! বিয়ে মানে কীসের বিয়ে…”
“যার জীবন গিয়েছে তোমার জন্য সে আমার বন্ধুর মেয়ের হবু জামাই ছিল। এই ঘটনার পর কে বিয়ে করবে তাকে? যেহেতু ক্ষতিটা তুমি করেছো, ক্ষতিপূরণও তুমিই দিবে।”
কিছুটা থেমে তাকে আদেশ করার ন্যায় বলে উঠেন,
“যদি বাবার শেষ বয়সে লজ্জিত মুখ না দেখতে চাও, মরা মুখটা দেখতে চাও চুপচাপ বিয়েটা করে ফেলো।”
বাবার শেষ কথায় তার আর কিছু বলার থাকে না। কেবিনের বাইরে পক্ষীর পরিবারের অনেকেই দাঁড়িয়েছিল, তারাও সায় জানায় কথায় যে, যে ক্ষতি করেছে সেই দায় নিবে। একপ্রকার বাধ্য হয়েই নিজের প্রেম পাথর চাপা দিয়ে বিয়ের পিঁঢ়িতে বসতে হয়।
পক্ষীকে হুশ আসতেই তার মা রাগী গলায় বলে উঠেন,
“তৈরি হয়েনে নবাবজাদি, যে ছেলের জন্য এক্সিডেন্ট সে রাজি হয়েছে তোকে গলায় ঝুলাতে। এবার যদি কোনো ঝামেলা হয় গলায় কলসি বেধে পাশের বড় নদীতে ডুব দিস।”
কথাটুকু শেষ করেই তিনি হনহন করে বের হয়ে চলে যায়। ছোটবোনও বেশ কথা শুনায়, সেখানে আত্মীয়দের কথা আর কীই বা বলার থাকে! তারাও তাদের কথার আগুনে জ্বলিয়ে যায় পক্ষীকে, শেষ মুহূর্তে বাবাও তার হাত ছেড়ে দেয়। সুতরাং, তাকেও সম্পূর্ণ বাধ্য হয়ে বিয়েটা করতে হয়।
সবাই জোর করে এই বিয়ে তো করিয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু এর পরিণম কী আদৌ পূর্ণতা হবে!
ফজর নামেজের বিছানা শুয়ে আনমনেই গতকালের বিষাদময় অতিতের স্মৃতির পাতায় ডুব দেয় পক্ষী। আর ভাবনাত ঘোর ভাঙতেই চোখের কোণায় একবিন্দু জল চলে আসে তার। সবকিছু ভাবতে ভাবতেই কখন যে চোখ লেগে যায় টেরই পায় না।
৪।
সাধারণত সকালবেলাটা উজ্জ্বল হয়, কিন্তু আজকের আকাশটা কেমন অন্ধকার মেঘাচ্ছন্ন। মনে হচ্ছে আজ সেও বেশ রেগে আছে, খাণিক বাদেই বিজলি বর্ষণ শুরু করবে রাগে নাকি পৃথিবীর কিছু মানুষের করুণ পরিণতিতে সেও দুঃখিত হয়ে ভারমুখো হয়ে আছে। কে জানে আর জানে আকাশ মহারাজের অভ্যন্তরীণ খবর!
এসব অহেতুক ভাবনাতেই ডুবেছিল পক্ষী সদ্য জলসিক্ত চুলের পানি গামছা দিয়ে ঝাড়ছিল। ঘুম ভাঙতেই সকাল সকালই গোসল করে ফেলে সে, কারণ জানে এ বাড়িতে তার অনেক কিছুই নিরবে সহ্য করতে হবে। যেই কারণগুলো আগে থেকেই আছে তা-ই অনেক। নতুন করে কারণ বাড়ানোর কোনো ইচ্ছেই নেই শ্যামাঙ্গা যুবতীর। তার ভাবনাতেই সে এত ডুবেছিল যে বারান্দার আরেক কোণে যে একজন তন্দ্রাচ্ছন্ন ব্যক্তি শায়িত দেখতেই পায়নি।
বিন্দু বিন্দু পানির ছিটে মুখে আসায় ঘুম ভেঙে যায় আরিজের। তার এক অদ্ভুত স্বভাব হল, সে ঘুম থেকে উঠার কয়েক মিনিট আগের কিছুই মনে করতে পারে না। আজও হলে তো ঘুম ভেঙে নিজের সামনে সদ্য স্নাত এক ছোট্ট রমণীকে দেখে নিজেই হতবাক হয়ে যায়। তবে, কিছুটা মুগ্ধও হয়। নারীটির গোটা মুখশ্রীই দেখা যাচ্ছে না, তবে তীক্ষ্ম নাকের মাঝে সুন্দরভাবে এঁটে থাকা নাকফুলটা চুলের ফাঁকেফাঁকে ঝিলিক দিচ্ছে।
আনমনেই ভেবে উঠে,
“ইশ! এমন এক বাঙালি বধূ যদি আমার থাকতো…”
তখনই নারীটির মুখশ্রী দৃশ্যমান হয়ে বাহিরে চলে যায়, এরপরই মনে পড়ে যায় গতকালের সকল তিক্ত স্মৃতি। সাথে সাথেই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে তার রাগে। কিছু একটা মনে পড়তেই কাউচে হাতড়ে ফোনটা হাতে নেয়। অনেক্ষণ ঘাটাঘাটি করেও ফোনে প্রিয়ার কোন ম্যাসেজ বা কলের হদিস না পাওয়ায়, হতাশ ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তখনই ফোনটার কলরিংটোন বেজে উঠে।
প্রিয়া কল করেছে দেখতেই চটজলদি কল রিসিভ করে উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগে,
“প্রিয়, তুমি আমার কল রিসিভ করছিলে না কেন? তুমি জানো, আমি কতোটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!”
অপরপাশের অপরূপা নারীটি তখনো বিছানায় লেপ্টানো কাজল চোখে বসে, যা তার নির্ঘুম রাত্রিযাপন ও অশ্রুঝরা হওয়ার প্রতীক। ছেলেটার আবেগি কথায় একসময় সে নিজের সর্বস্ব ও আনন্দ খুঁজে পেতো, কিন্তু আজ কেন যেন হাসি পাচ্ছে। খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো সে, এই হাসি সুখের নয় কিংবা আনন্দেরও নয়। অজস্র বেদনা বুকের মাঝে দাফন করার বিদ্রূপাত্মক হাসি।
আরিজ বেশ অবাক মেয়েটির আচমকা হেসে উঠায়, সাথে ভয়ও হচ্ছে বেশ। নারীটি যে বড় বেশি ভালোবাসে তাকে, তার তো এখন পাগলের মতো কেঁদে প্রেমিককে নিজের করে পেতে চাওয়ার কথা।
ভীতু গলায় যুবক জিজ্ঞেস করে,
“এই প্রিয়, তুমি এভাবে হাসছো কেন? আমার কিন্তু ভয় হচ্ছে। তুমি আবার কিছু করে বসেছো নাকি? ”
প্রিয়া বেশ তাচ্ছিল্যের সুরেই বলে,
“না গো, আমার এত সাহস নেই একবারে মৃত্যুর স্বাদ নেওয়ার। তবে বাঁচার উদ্দীপনা তো হারিয়েই ফেলেছি, সুতরাং খুব বেশি সময় নেই হাতে ভেবেই রাখো।”
প্রিয়ার কথার সুর বুঝছে আরিজ। তবুও কথা কাটানোর জন্য স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
“ধুর! এসব উদ্ভট কথা বাদ দাও তো প্রিয়। এটা বলো তুমি আমার কল কেন ধরোনি? কতোটা টেন্সড ছিলাম আমি সারারাত জানা আছে তোমার।”
আবারও হাসি খেলে যায় প্রিয়ার ঠোঁটের কোণে, অবশ্য তা শব্দহীন। তীক্ষ্ম গলায় বলে,
“সারারাত নববধূর সাথে থেকে আমার চিন্তায় ডুবার সময় ছিল আপনার, ব্যাপারটা কেমন রসিকতা হয়ে যায় না আরিজ সাহেব?”
নিঃশ্চুপ হয়ে যায় আরিজ, যদিও তার আর পক্ষীর মাঝে কোনো কিছুই হয়নি। তবুও তো তাদের গায়ে সিলমোহর লাগানো স্বামী-স্ত্রীর। এই সিলমোহর নিয়ে কি আদৌ তার হক আছে অন্যের কাছে যেয়ে দাঁড়ানোর! বিষয়টা ভেবেই নিরব সে।
কিন্তু এই নিরবতাই তীর হয়ে বিঁধে প্রিয়ার গায়ে। পরিচিত ভয়েই পুনরায় তার ভীতিগ্রস্ত হয় তার মন।
“তাহলে আরিজ কি মেনে নিয়েছে পক্ষীকে স্ত্রী রূপে? এমন হলে সে যে সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে উঠবে। না! না! এ তো কিছুতেই হতে পারে না। আমার এতকালের অপেক্ষা বিফলে যেতে পারে না।”
ভেবেই কাতর গলায় বলে উঠে,
“তোমার নিরবতা প্রমাণ করছে আমার সন্দেহই ঠিক। তোমার সর্বাঙ্গে এখন অন্যের বিচরণ।”
যুবক উত্তেজিত হয়ে বলে,
“না! না! এমন কিছুই না, প্রিয়। তুমি আমার কথা শুনো।”
“আর কীই বা বাকি আছে শোনার, প্রিয়তম। এতোটা চেয়েও তো হতে পারলাম না। শেষ কথা রাখো প্রিয়তম, আমার সাথে কয়েক মুহূর্তের জন্য সেই পরিচিত লেকটায় আসবে? আমি অপেক্ষা করছি তোমার, হয়তো এটাই আমাদের শেষ দেখা।”
কান্না মিশানো গলায় কথাগুলো বলেই অপরজনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল ডিসকানেক্ট করে দেয়। যুবক চিন্তিত হয়ে বারবার কল করে দেখে ফোন সুইচ অফ। আর কিছু না ভেবেই দ্রুতপায়ে হেঁটে বেডরুমে যায়। বারান্দার দরজার পাশে থাকা কেবিনেট থেকে চাবি নিয়ে দৌড়ে বের হতে নেয় তখনই মৃদু ধাক্কা লাগে পক্ষীর সাথে।
পক্ষীর শ্যামাঙ্গ মুখশ্রী চোখে পড়ার মুহূর্তেই দুশ্চিন্তাগুলো রাগে রূপান্তরিত হয়। তাকে পিছন করে তার হাতটি মুচড়ে ধরে।
“আজ শুধুমাত্র তোমার জন্য আমার জীবনটা নরকে পরিণত হয়েছে। একমুহূর্ত স্বস্তিতে শ্বাস ফেলার নেই।”
বলেই সে নারীটির হাত ছেড়ে বেরিয়ে যায়। আর নারীটি অসহায়ত্বের ছাপ তুলে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে। কারণ কী বলবে সে, আর বলে যাবেই বা কোথায়? বাবাও যে সারাটা জীবনের জন্য বিদায় দিল।
৬।
প্রায় পনেরো মিনিটের মাথায় আরিজ পৌঁছে যায় ধানমণ্ডি লেক। লেকের সামনেই গাড়িটি পার্ক করে পরিচিত জায়গাটিতে চলে যায়।
ধানমণ্ডি লেক সাধারণত কোলাহলময় থাকলেও তখনো তেমন কেউ আসেনি। বিশেষ করে লেকের যেই কোণে প্রিয়া বসে আছে সেখানে কোনো মানুষের আনাগোনা নেই, তবে একটু বাদে বাদেই চড়ুইপাখির কলরব শোনা যাচ্ছে। লেকের খাণিকটা দূরে থাকা অবস্থাতেই আরিজের কানে ভেসে আসে অতিপরিচিত মধুর নারী কণ্ঠ।
“এই ভরা জোছনায় তুই কার পাশে,
কার বুকেতে মাথা রাখিস, কারে ভালোবেসে,
তোর মনের পিঞ্জিরার তুই কারে দিলি ঠাঁই,
কারে এত করলি আপন পর করে আমায়,
তুই ভালো থাকিস বন্ধু, আমার সুখে থাকিস রোজ। (জিসান খান শুভ)”
গানের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে আরিজ। এই কণ্ঠেরই তো প্রেমে পড়েছিল সে। দিনটি আজও তার কাছে সুখময় অতিত।
তখন ভার্সিটি শেষবর্ষে পড়ে সে, মাথায় নবীন বরণের অনুষ্ঠানের ভার নিয়ে তপ্ত রোদে মাঠে স্টেজের কাজ করছে। এই উষ্ণ দেহে শীতলতার ছোঁয়া বয়ে যায় কারো কণ্ঠে “চোখের নেশা” গানটি শুনে। কোন এক অদৃশ্য শক্তি তাকে টেনে নিয়ে যায় এই কণ্ঠের উৎসের কাছে।
অডিটোরিয়ামে রিয়েলসেলে ব্যস্ত থাকা সবার মাঝে তার চোখজোড়া আটকে যায় স্টেজে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে। একবাটি দুধে এক চিমটি হলুদ দিলে যেমন রঙ হবে তেমনই নারীটির দেহের গড়ন, হরিণীর মতো টানা নয়নযুগল, ঠোঁটের কিনারা ঘেঁষে কুচকুচে কালো একটি তিল যেন নারীটির সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
পাশ থেকে এক বন্ধুকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“স্টেজে থেকে মেয়েটি কেরে?”
“প্রিয়া দেওয়ান, ফাস্ট ইয়ার।”
দৃঢ় গলায় নাকোচ করে বলেছিল সেদিন,
“উঁহু, প্রিয়া জামান নয় আরিজের প্রিয়তমা। আরিজের প্রিয়া।”
সত্যি বলতে, সেদিন থেকেই মেয়েটির রূপের নেশায় মত্ত হয় সে। এই নারীটির রূপই এমন, অপরূপা।
” এমন অনন্য নারীই মানায় আরিজ জামানের পাশে। ”
ভেবেই সামনে এগিয়ে যায় আরিজ। এই মেয়েটিকে যে নিজের করতেই হবে যেকোনো ভাবে, বড্ড আসক্ত সে নারীটির প্রতি।
আচমকা পিঠে পুরুষালি হাতের স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠে গান বন্ধ করে দেয় প্রিয়া। কিছু না ভেবেই একপলকে পিছন ঘুরে জড়িয়ে ধরে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটিকে। সেই সাথে তার নিরবে ঝরা অশ্রুগুলো সিক্ত করতে থাকে আরিজের টিশার্ট।
৭।
“কী গো! কী গো! এ কেমন অবস্থা? দুধের গ্লাস এমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে কেন?”
রাগী গলায় বলেই রক্তচক্ষু নিয়ে থাকায় সামনের নারীটির দিকে। পক্ষী মাথা নত করে তাকিয়ে আছে। বলা বাহুল্য, আরিজ ও পক্ষী ধাক্কা খাওয়ার সময় পক্ষীর গ্লাস থেকে দুধ ফালাতে যাচ্ছিলো। ধাক্কা খেতেই তাদের থেকে একটু দূরে যেয়ে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে পড়ে। পক্ষী টের পেলেও আরিজের ধ্যান যায়নি রাগে এবং তাড়াহুড়োয়। সে ঘর থেকে বের হলে পক্ষীর পরিস্কার করার জিনিসপত্র খুঁজতে খুঁজতেই বড় জা আমিনা ঘরে ঢুকে পড়ে এসব দেখে চেঁচিয়ে উঠে।
পক্ষী মৃদু গলায় বলতে নেয়,
“আসলে ভাবি…”
কিন্তু তাকে বলতে না দিয়েই আমিনা কঠোরভাবে বলল,
“হয়েছে! হয়েছে! আমি তো আর হাওয়ায় হাওয়ায় চারটা বছর সংসার করিনি, সবই বুঝি। নিশ্চিত দেবর আমার রাতে দুধ খায়নি নাহলে তুমিই দেওনি। আর এখন ঘর গুছাতে যেয়ে ভেঙে ফেলেছো। বলি মেয়ে, শ্বশুরবাড়িতে এসে প্রথমদিন এমন অলুক্ষে কাজ করে বসেছে কোন অনুতাপ আছে ভিতরে! নাকি অলক্ষীর মতো কাজ করতে ভালো লাগে!”
গলার স্বর স্বাভাবিকের চাইতেও কম রেখে পক্ষী পুনরায় বলে উঠে,
“ভাবি কুফা, অলুক্ষণে কাজ মানা কিংবা কাউকে লক্ষী অথবা অলক্ষী বলা তো ইসলামের বিপরীত। তাই মুসলিম হিসেবে এসব মানা আমাদের ঠিক নয়।”
এই কথাটিই যেন কাল হয় নারীটির জন্য। আমিনা রাগে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগে,
“কত বড় স্পর্ধা তোমার মেয়ে! দু’দিন ধরে এ বাড়ি এসে আমাকে ঠিক-বেঠিক শিখাতে যাও। এজন্যই এমন বেটে মেয়ে আনতে নেই, গুরুজনই বলে গেছেন এরা কুটনি আর অপয়া ধরনের হয়।”
কথাগুলো বলেই থেমে একবার শক্ত চোখজোড়ায় তাকিয়ে বিড়বিড় করে বকতে বকতে বের হয়ে যায়। পক্ষী তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হতাশা ও অসহায়ত্ব জর্জরিত শ্বাস ফেলে।
“জীবনটা তিক্ত নয় অতি বিষাক্ত হয়ে উঠেছে, বাঁচার উপায় কোনো! বেঁচে থাকার ইচ্ছেশক্তিই আছে নাকি বেঁচে!”
কথাটা ভাবতাই চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলে সে।
“জীবনটা এক আস্ত খেলাঘর,
কেউ একবার হেরেই দমে যায়,
কেউ বা বারবার হেরেও জিতে যায়।
~ঈপ্সিতা শিকদার”
চলবে…