#মুক্ত_পিঞ্জিরার_পাখি
#Ipshita_Shikdar
#পর্বঃ৮
২৫।
দিনটি ছিল শুক্রুবার,বর্ষণের সময় তখন। সদ্য চৌদ্দ বছরের কিশোরী পক্ষী টিনের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করছে। বাবা ঢাকা গিয়েছে কাঁচামাল আনতে আর মা বোনকে মেলায় ঘুরতে নিয়ে গিয়েছে, অগত্যা একাই বাসায় যাওয়ার নির্দেশ তার উপর। যদিও তার মনের সুপ্ত এক ইচ্ছে মা এই তীব্র বর্ষণ দেখে চিন্তিত মুখে তাকে নিতে আসুক, কিন্তু সে জানে মা আসবে না। প্রায় সব মেয়েরাই বাবা-মায়ের সাথে চলে গিয়েছে বাড়িতে, সে সহ আর দু’জন দাঁড়িয়ে।
টিনের চালের উপর বৃষ্টি পড়ার ঝংকার এবং বকুল ফুল ও ভেজা মাটির সুঘ্রাণে এক অদ্ভুৎ মাদকতা সৃষ্টি হয় তার হৃদমাঝে। আনমনেই নিচু গলায় গাইতে শুরু করে,
‘যাও বলো তারে শ্রাবণ আষাঢ়ে,
মেঘের শত দোলে ছুঁয়েছে ভেজা জল।
মাতাল হাওয়ার ধ্বনি বৃষ্টি কি শুনে না?
ময়ূর পেখম তোলে ধিম তা না দে রে না
ধিম তানা, বাজে ধিম তানা,
বাজে ধিম তানা, দে রে না।’
(ধিম তানা- কনা)
এটুকু বলেই তীব্র অস্বস্তিতে চোখজোড়া হুট করে খুলে ফেলে সে। আর মুহূর্তেই ভারী পুরুষ কণ্ঠে শুনে,
“মনোমুগ্ধকর! একদম বুকের মধ্যখানটায় তীর লাগার মতো।”
কথাটির উৎস খুঁজে নিজের বাম পাশে তাকাতেই দেখে অর্ধভেজা পোশাকে দাঁড়ানো এক যুবক তাকে একদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে। বুঝলো এই ছেলের এমন চাহনির কারণেই তার অস্বস্তিবোধ হচ্ছিলো। খেয়াল করলো বৃষ্টিটা থেমেছে, কিছু না ভেবেই ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বাড়ির পথে চলে সে। একবার পিছনে তাকালেই হয়তো বুঝতো এক পুরুষের প্রেমের তৃষ্ণা জেগেছে তাকে দেখে।
এই ঘটনার পর ছেলেটাকে প্রায়শয়ই দেখা যেত সেই ছাউনির পাশে থাকা টং দোকানে চায়ের কাপ হাতে বসে থাকতে। পক্ষী যাওয়া-আসার পথে তাকে চোরা চোখে দেখতে। কিন্তু দুই মাস পরে হঠাৎ কী হলো ছেলেটা আর আসে না। বলা হয় গুটিকয়েক দিনই মানুষের মনে অন্যের জন্য মায়া জন্ম নিতে যথেষ্ট। কিন্তু শ্যামাঙ্গিনী তা মিথ্যেই প্রমাণ করেছিল ছেলেটিকে নিজের স্মৃতি থেকে ভাসমান মেঘের মতো সরিয়ে দিয়ে।
কিন্তু ভাগ্যের লিখন হয়তো অন্যকিছুই ছিল! ঢাকায় আসার পর পুনরায় দেখা হয় ছেলেটির সাথে, নাম তার প্রথম। নাটকীয় কোনো দেখা নয়, ফেসবুকে নক দিয়েছিল সে। প্রথমে তো চিনতেই পারেনি পক্ষী। পরে মনে করিয়ে দিলে লজ্জায় ফোনের অপরপাশে লাল হয় পক্ষী। কলেজের সেকেন্ড ইয়ার থেকে ভার্সিটি প্রথম বর্ষে যোগ দেওয়া পর্যন্ত শুধু সুখ-দুঃখের সাথী পর্যন্তই সমাপ্ত ছিল সে। তারপর হলো প্রেম নিবেদন, সূচনা হলো প্রণয়ের। পক্ষী ঠিক জানে না প্রথমকে সে ভালোবাসে কিনা, কিন্তু ছেলেটার চোখে নিজের জন্য যে মর্যাদা ও একরাশ মুগ্ধতা দেখতে পেতে তাতেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিল সে। কারণ এর জন্যই যে বড্ড তৃষ্ণার্ত ছিল সে।
নিজের অতিতটা আনমনে ভাবতে ভাবতে স্মিত হাসি ফুটে উঠে শ্যামাঙ্গিনীর ঠোঁটের কোণে। তখনই দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দ কানে আসে, পক্ষীও অতিত ফেলে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে জর্জরিত করে নেয় বেদনাময় বর্তমানের সাথে।
ধীরপায়ে গেট খুলতে বেডরুমের দিকে এগিয়ে যায় সে। বেডরুমে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। আনমনেই ভেবে উঠে,
“আরিজ তো ঘরেই ছিল। আমিও না! হয়তো গিয়েছে কোথাও, হয়তো প্রেমিকার সাথে প্রেমের সাক্ষাৎ করতেই গিয়েছে।”
দরজা খুলে দিতেই দেখে তার বিয়ের পরদিন আসা মেহমানদের করা কটূক্তির যোগ্য উত্তর দেওয়া বৃদ্ধা তথা তার দাদী শাশুড়ি। তিনি হাসিমুখে বলেন,
“ঘরে আসবো, বউ?”
পক্ষী কিছুটা অপ্রস্তুতই হয়ে কথাটা শুনে।
“হ্যাঁ! হ্যাঁ, আসেন!”
বলেই ঢুকার পথ থেকে সরে যেয়ে বিছানার চাদরটা টানটান করতে লাগে। আজমিরি বেগম হেসে বলেন,
“থাক! থাক! আমাকে নিয়ে এত ব্যস্ত হওয়া লাগবে না। এই আজমিরি এই বাড়ির মেহমান নাকি! এই বাড়ির মালকিন আলোম জামানের প্রিয় স্ত্রী আজমিরি বেগম, বুঝলে বউ?”
শ্যামাঙ্গিনীও মুচকি হেসে ফেলে এমন আন্তরিক আচারণ করার মতো মানুষ পেতে, তার যে এমন মানুষের বড্ড অভাব। মুচকি হাসি ফুটে উঠে তার ঠোঁট জুড়ে।
মৃদু গলায় বলে,
“হুম।”
“তুমি বসো আমার পাশে। তোমার সাথে গল্প করার জন্যই আসছি, তবে তসবিহ পড়াটা শেষ করে নেই।”
পক্ষী আজমিরি বেগমের পাশে বসে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগে।
নারীটির গায়ের রং তার চেয়ে আরেকটু মলিন, তবে চেহাদায় আলাদা রকমের এক স্নিগ্ধতা আছে যা সুরমা রেখা টানা নয়নযুগলে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে নূর ছেয়ে আছে মুখশ্রীতে, যাকে বলে নূরানি চেহারা। আর তীক্ষ্ম নাকে বড় একটা স্বর্ণের নাকফুল, কানে স্বর্ণের ছোটছোট দুল আর দু’হাতে বিদ্যমান চুড়ি দুটো যেন নারীটির আভিজাত্যের প্রতীক।
হঠাৎই আজমিরি বেগম ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠে,
“এভাবে কী দেখো গো, বউ? বুড়া বয়সে আজমিরির রূপ জ্বালালো নাকি? ”
বলে নিজেই হেসে উঠেন, যদিও তা বেশ শব্দহীন। পক্ষীও অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে উনার সাথে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
“না, দেখছি আপনাকে দেখছি দাদাজান। এখনো কী জৌলুস আপনার রূপের! দাদাজান নিশ্চয়ই অনেক ভালোবাসতো…”
“হুহ! ছাই ভালোবাসতো। ফুলশয্যা রাত্রিতে বড় বড় চোখ করে কী ধমকটাই না দিয়েছিল! সারাটা রাত মেঝেতে কাটাতে হয়েছিল আমার। তোর দাদাজানকে একপ্রকার বাধ্য করেই আমার সাথে বিয়ে করিয়েছিল আমার শাশুড়ি। উনি কম জ্বালান জ্বালায়নি কখনো সারাটা রাত ঘরের বাহিরে রাখতো, তো কখনো যাচ্ছে তাই বলে অপমান! কত রাত কাঁদতে কাঁদতে শেষ হয়েছে, তবুও তার অযত্ন করতাম না সবকিছুর খেয়াল রাখতাম, পছন্দ-অপছন্দ হোক কিংবা প্রতিদিনের পড়ার কাপড় বের করে রাখা। এভাবেই বিয়ের একটা বছর কেটে গেল, কিন্তু কোনো পরিবর্তন হলো না। আমি ছিলাম সেই জামানার অনার্স পাশ মেয়ে যেহেতু কামাই করার জোর ছিল এরপর আর সহ্য করতে পারছিলাম না। ভেবে নিলাম আর করবো না সংসার।”
পক্ষী আচমকাই বলে উঠলো,
“বলো কী!”
“আরে শুন তো বউ আগে। তোর দাদাকে রাতে বাড়ি আসলে জানালাম, সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না, মিথ্যে হুমকি ভেবেছিল কিনা… তা যাই হোক আমি পরদিনই বাড়ি ফিরে যায়। বলিস না গিয়ে তো ছিলাম, কিন্তু মন আর টিকে না। ভাত খেতে গেলে মনে পড়ে তাকেও ভাত দিতে হবে, শুতে গেলে মনে পড়ে পাশে সে নেই, ঘুমালে হাতড়ে তাকে খুঁজি। মায়ায় পড়ে গিয়েছিলাম তার, বুঝলি? ”
বলেই একপলক উৎসুক চোখে বসে থাকা শ্যামাঙ্গিনীর দিকে তাকায় সে। পুনরায় বলতে লাগলেন,
“কিন্তু তারপরও ফিরে যাইনি, একপ্রকার জেদ হয়েছিল। তিনদিন পর শ্বশুরবাড়ি থেকে লোক আসে নিতে, উনার নাকি জ্বর। কারণ তারা এসব বিষয়ে জানতো না। আমি তো পাগলপ্রায় হয়ে ফিরে আসি। লোকটার সে কী বেহাল দশা! ফর্সা মুখটা কালো হয়ে গেছে, চোখের নিচে কালি জমে… আমি সেদিন সারাদিন তার সেবায় কাটিয়ে দেই রাত হলেই তার জ্ঞান ফিরে। সে আমকে দেখে খুশি হয়ে বলে,
‘তুমি এসেছো? আমি জানতাম তুমি আসবেই। আর কোথাও যেতে দিবো না তোমায়। তুমি জানো আমি কতোটা কষ্ট পাচ্ছিলাম তোমাকে ছাড়া, এত পাষাণ কেন তুমি?’
আমার কেন যেন পূর্বের অভিমান জেগে উঠে মনে। আমিও বলি,
‘আমাকে তো আপনার পছন্দ না, আমি কালা আরও কত কী! তাই আমি চলে গেলেই তো ভালো, চলেই যাবো।’
তুমি বিশ্বাস করবে না জামান বাড়ির মজবুত ছেলে সেদিন আমার কাছে কেঁদে কেঁদে ক্ষমা চেয়েছিল। তার সাথে অভিমানের টানাপোড়ন চলেছিল অনেকদিন কিন্তু ছেড়ে যেতে পারিনি। না আমি তাকে, না সে আমাকে। বড্ড মায়ায় পড়ে গিয়েছিলাম শুধু তার নয়, তার পরিবারেরও। তাই তার অপরাধও ক্ষমা করেছিলাম, অবশ্য সে অনুতপ্ত ছিল বলেই সম্ভব হয়েছে সবটা।”
নিজের কথা শেষ করতেই স্মিত হাসি ফুটে আজমিরি বেগমের ঠোঁটের কোণে। পক্ষী মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার প্রশান্তি ছেয়ে থাকা মুখশ্রী দেখে।
আচমকাই বৃদ্ধা তার হাত জোড়া নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বলে,
“আমি জানি তুমিও অপেক্ষা করছো এই পিঞ্জিরা থেকে বের হওয়ার, এই সংসার থেকে দূর হওয়ার। আমি বলবো না তোমাকে ধৈর্য্য ধরো বা থাকো এমনকিছু। কারণ আমি জানি এটা যে সে পিঞ্জিরা নয়, মায়ার পিঞ্জিরা। এ পিঞ্জিরা বদ্ধ হলে যতোটা আটকে রাখে, মুক্ত হলে তার চেয়েও বেশি ওতপ্রোতভাবে… এমন এক সময় আসবে যখন না তুমি এই মানুষগুলোর মায়া ত্যাগ করতে পারবে, না তারা তোমার। যাকগে অনেক বললাম এখন যাই বাপু, কাপড়গুলো আলমারিতে রাখতে হবে।”
নিজের কথা শেষ করে তিনি তো চলে গেলেন কিন্তু এক করুণ অবস্থায় রেখে গেলেন যুবতী পক্ষীকে। অজান্তেই দাদীজানের কথাটা ভাবতে লাগে সে এবং সত্যি মানতে শুরু করে তার মন।
পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
“না, পক্ষী মোটেও দুর্বল হবি না। সংসারের মায়ায় ধরলে যে সারাজীবন যেমন মর্যাদাহীন থেকেছিস তেমনই থাকবি। উনারা মেনে নিলেও সমাজ পদেপদে দেখাবে উনার চাইতে আমি কতোটা নিচুতে। তাছাড়া প্রথমের খুনি আরিজ। আমি থাকবো না মুক্ত পিঞ্জিরার পাখি হয়ে, কখনোই না!”
চলবে…
কী মনে হয় কী হবে সামনে?
আমি সরি! সরি! আমার কোনো দোষ নেই, সব রওনকের দোষ। আমার বজ্জাত বেস্টু সবসময় আমার পর্ব লেখার টাইমে এমন একটা টেক্সট দিবে আমার সব এটেনশনই চলে যায় গল্প থেকে, গসিপ করতে বসে পড়ি। দেন আর কী রাতের আড়াইটা পর্যন্ত চলে। এরপর সকালে এগারোটার দিকে উঠে নাস্তা, সেই সাথে সারাদিন ম্যাসম্যাস লাগে, সো আমি লিখতে পারি না। বিকালে স্যারের ঝাড়িটাড়ি খেয়ে ম্যাথম্যাটিকস করে ঝিমানো ছুটে এরপর গল্প লিখি। আজকে এই জন্য ফ্লাইট মুডে দিয়ে লিখসি।