মুক্ত_পিঞ্জিরার_পাখি পর্ব ৯

#মুক্ত_পিঞ্জিরার_পাখি
#পর্বঃ৯খ
#Ipshita_Shikdar
২৮।
আজ ভুলবশত টাওয়াল নিতে ভুলে গিয়েছিল পক্ষী। আসলে শরীরের ঘাম শরীরে শুকিয়ে কেমন একটা আঠালোভাব চলে এসেছিল, তাই তীব্র অস্বস্তিতে তাড়াহুড়োয় ভুল করে ফেলে সে।

পক্ষীর গায়ের কুর্তিটা দেহের জলে বেশ ভেজা হয়ে গিয়েছে। তার উপর চুলের জল তো আছেই। ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে চুলগুলো গামছা দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে বিরক্ত মুখে আয়নার দিকে তাকাতেই থমকে যায় সে। কারণ স্বামী নামক পুরুষটির ঘোরলাগা দৃষ্টি যে পড়েছে তার উপর।

বলা বাহুল্য, আরিজ খাটে ফোনে মনোনিবেশ করেছিল। কিন্তু হঠাৎ পক্ষীকে আধভেজা পোশাকে এসে গামছা দিয়ে চুলের পানি ঝাড়ার মধুময় মুহূর্ত দেখে একপ্রকার ঘোরেই পড়ে যায় সে।

পক্ষী আরিজের দিকে ঘুরে একটু অস্বস্তি নিয়ে বলে উঠে,

“এই যে শুনছেন! এই যে!”

আরিজের ভাবনার সুতো কাটায় সে খাণিকটা হচকচিয়ে বলে,

“হ্যাঁ! হ্যাঁ! বলো।”

“না মানে নিচে তো খাবার দিয়েছি খেতে যাবেন না?”

যুবক তো এই পরিস্থিতি থেকে পালাতেই চাচ্ছিলো, যুবতী যেন আরও সুযোগ করে দিল। তাই চটজলদি বলে ফেললো,

“হুম, এখনই যাচ্ছি। আসলে খুব ক্ষুধা লেগেছে বুঝলে পক্ষী…?”

বলে পক্ষীর কিছু বলার অপেক্ষা না করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। বেডরুমের দরজা পেড়িয়েই বলল,

“হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন মেয়েদের মাথায় টাওয়াল লাগানো অবস্থাতে কতোটা সুন্দর লাগে তা জানলে মেয়েরা বিয়ে বাড়িতেও টাওয়াল লাগিয়ে চলে আসবে।”

কথাটা বলতে বলতেই আনমনে হেসে ফেলে। পরমুহূর্তেই বিড়বিড় করে বলল,

“মেয়েদের চুল ঝাড়ার সময়টা যে কতোটা আকর্ষণীয়, মধুময় ও নজরকাড়া তা যদি নারীরা জানতে পারে তাহলে কখনো কোনো পুরুষের সামনে এই মনোরমা দৃশ্যের সূচনাই করতো না।”

স্মিত হাসি সাজানো মুখেই সেখান থেকে ডাইনিং রুমের দিকে যেতে লাগলো।

অপরদিকে পক্ষী পেটে হাত দিয়ে হাহা শব্দ তুলে হাসছে, মুখের হাড় ব্যথা হয়ে গেলেও তার হাসি থামার নাম নেই। মনে মনে বলতে থাকে,

“ইশ! কী লাল টুকটুকে হয়ে গিয়েছিল উনার গাল দুটো লজ্জায়। ইচ্ছে করছিল একদম জোরে জোরে টেনে দেই! ছেলেরাও যে এমন লজ্জাবতী লতিকার মতো লজ্জা পায়, আমার স্বামীকে না দেখলে জানতামই না।”

নিজের বলা কথায় নিজেই অবাক হয় পক্ষী। গম্ভীর গলায় বলে উঠে,

“আমার স্বামী…? আদৌ সে আমার তো? আমি কী অজান্তেই… না! না! এ সম্ভব নয়। যতোই হোক ঘটনাটা এক্সিডেন্ট আমার কাছে উনিই প্রথমের খুনি। যতদিন এখানে আছি ভালোভাবে থাকবো, সঠিক সময় ও সুযোগ এলে চলে যাবো। কোনো মায়া মোটেও বাড়িয়ো না, সারাজীবন মায়ার বোঝা টানা কিন্তু চারখানি কথা নয়!”

নিজেকে কতক্ষণ শাসিয়ে চুল মুছে সেও কোনোরকম তৈরি হয়ে নেয় সে। পরক্ষণেই ভাবে,

“আচ্ছা রাগী ছেলেদের কি এত লজ্জায় মানায়? লজ্জা নাকি মেয়েদের অলংকার। তাহলে উনাকে এত মনোমুগ্ধকর লাগছিল কেন! নাকি আমার দৃষ্টির…”

এসব ভেবেই ডায়নিং রুমে যাওয়ার জন্য ডাক পড়ে তার।

২৯।
ভীতু মুখে নয়না বেগমের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে পক্ষী। নয়না বেগম একটু একটু করে তার রান্না করা সব খাবার তথা ডাল ভুনা, পোলাও, মুরগির চুইঝাল ও পায়েস খাচ্ছে। মধ্যবয়স্ক নারীটির চেহারা দেখে বুঝার উপায় নেই সে সন্তুষ্ট নাকি অসন্তুষ্ট। একদল দর্শকও উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে নয়না বেগমের থেকে ফলাফল জানার জন্য। এই একদল জনতা আর কেউ নয় নয়ন্তিনী বেগম, আজমিরি বেগম, আমিনা, আমির ও আরিজ। তারা খাওয়া বাদ দিয়ে অপেক্ষা করছেন জানার।

নয়না বেগম মুখটা গম্ভীর করে বললেন,

“তুমি কী আজ প্রথম রান্না করলে?”

পক্ষী ভয়ে পেয়ে যায় খাবার মন্দ হয়েছে নাকি ভেবে। ভীতিগ্রস্ত বলে,

“না, আন্টি। খারাপ হয়েছে নাকি?”

নয়না বেগম আচমকাই তেঁতে উঠেন। ধমক দিয়ে বলেন,

“এই মেয়ে, এসব আন্টি-ফান্টি কী বলো? ইংরেজ নাকি! খালা বলবা, বুঝছো? আর খাবার খারাপ না ভালোই হয়েছে।”

শ্যামাঙ্গিনীর কলিজায় যেন এখন পানি আসে। স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলে,

“যাক বাবা বেঁচেছি উনার হাত থেকে।”

কথাটা একটু জোরেই বলে ফেলে, যার কারণে সামনে বসে থাকা ণাড়ীটীও কিছুটা অস্পষ্ট ভাবে শুনে। তিনি তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন,

“কিছু বললে নাকি।”

যুবতীও নাকোচ করে মাথা ঝাঁকায়। সবাই খাওয়াদাওয়া শুরু করে, খাবারের স্বাদ অসাধারণ বা রেস্টুরেন্টের মতো নাহলেও ঘরের রান্না হিসেবে বেশ মজাদার। তাই সবাই হাত চেটে খেতে খেতে পক্ষীর প্রসংসা করতে লাগলো।

পক্ষীকে না খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবার ধমকে উঠেন নয়না।

“এই মেয়ে, এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছো? খেতে বসো…”

পক্ষী খাণিক মিনমিনে গলায় বলল,

“তাহলে সার্ভ…”

এবার বড় বোনকে উপেক্ষা করে তার শ্বাশুরিই তাকে শক্ত গলায় উত্তর দেয়।

“এখানে তো কেউ মেহমান নয় যে যার মতো নিয়ে খেয়ে নিবে। এত আদিক্ষেতে করার কিছু নেই।”

কথা বলার ধরনটা কঠোর হলেও কেন যেন পক্ষীর ভালো লাগলো। যেন শক্ত বরফের মতো একপরশ যত্নশীলতার ছোঁয়া। মনে পড়ে গেল বাবার বলা একটি কথা। তা হলো,

‘ভালো-মন্দ মিলিয়েই মানুষ। একটি মানুষের মাঝে সাধারণত পুরোটা ভালো কিংবা পুরোটা মন্দপ থাকতে পারে না, আর একদম ভালো বা একদম মন্দ মানুষ থাকলেও তাদের সংখ্যা খুবই ক্ষুদ্র।’

কথাটা ভাবতেই মনটাও খারাপ হয়ে যায় তার। আসলাম দেওয়ানের কথা যে মনে পড়ে গিয়েছে, তিনি অবশ্য মেয়েকে মনে করে প্রতিদিন দুই-তিন বার কল দেয়। তবে মনের বোঝায় হাতজোড়া জমে যায় পক্ষীর, বাজতে বাজতেই কেটে যায় কল। তা দেখে শ্যামাঙ্গিনী মনে মনে ভাবে,

“এবার সুখী তো তুমি, আমার বোঝা নেমে গিয়েছে যে এখন মাথা থেকে।”

এসব ভাবতে ভাবতেই খাওয়াদাওয়া শেষ হয় পক্ষীর।

৩০।
আরিজ উপরে চলে গিয়েছে কিন্তু পক্ষী যায়নি। কারণ নিজের এঁটো খাবার ও থালা অন্যকেউ পরিষ্কার করবে, তা তার কাছে মেনে নেওয়ার মতো নয়। নিজের প্লেট ও বাটি ধুয়ে-মুছে বেডরুমের দিকে যাবে তখনই কেউ একজন ডাকু দিয়ে উঠে।

“এই মেয়ে, কোথায় যাচ্ছো?”

পক্ষী পিছনে ঘুরে জিজ্ঞেস করে,

“আন্টি… না মানে খালা আমাকে ডাকছেন?”

“না ভুতকে ডাকছি, এদিকে আসো! ”

রাগী গলায় কথাটুকু বলে থামেন নয়না বেগম। আবার বিড়বিড় করে বলেন,

“এখনু মেয়েলোক এত বেশি বেখায়ালিপনা করে! কখন সতিন এসে সংসারে ঢুকবে বুঝবেও না। ”

পক্ষী এসবকিছুর মাঝে তার কাছে চলে এসেছে। মিনমিন করে সে জিজ্ঞেস করে,

“কিছু বলবেন, খালা?”

ভ্রজোড়া কুঁচকে কড়া গলায় নারীটি বলেন,

“কিছু না অনেক কিছু বলতে ডেকেছি। বলি দায়িত্ববোধ বলতেও একটা কিছু থাকা উচিত বিবাহিত মেয়েদের, বিয়ে হয়েছে এখন। তাই অনেকদিক ভাবতে হবে, খেয়াল রাখতে হবে। বুঝলে, মেয়ে? এই দুধের গ্লাস আরিজকে দিবে। ও দুধ ছাড়া ঘুমোয় না, সকালে ঠিক ফজরের ওয়াক্তে ডাক দিবে, ও নামাজ পড়ে হাঁটতে বেরোবে। আর হ্যাঁ, আজকে সকালে চা কীভাবে খেয়েছে তা জানি না, তবে ভাগিনা আমার মোটেও চা প্রিয় ব্যক্তি নয়। কফি পছন্দ করে খুব, সুতরাং তা-ই করবে ওর জন্য। সব বুঝলে তো, মেয়ে?”

এভাবে স্ত্রীর দায়িত্ব হাতে পাওয়ায় শ্যামাঙ্গিনীর কেমন একটা অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। তবে এর মাঝে কোনো এক ফাঁকফোকরে কাজ করছে তীব্র ভালো লাগা। আমতা আমতা করে সে উত্তর দেয়,

“আচ্ছা। ”

তারপর দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে পুনরায় বেডরুমের দিকে যেতে লাগলো। পিছন থেকে নয়না বলে উঠেন,

“স্বামী-সংসার সামলে রাখতে হয় যতদিন তাদের উভয়ের অস্তিত্ব নিজে না হওয়া যায়। তা না হলে ঝড়ের মাঝে সংসার ভাঙতে সেকেন্ডও নেয় না। আর যদি থাকে তৃতীপক্ষ তাহলে তো আর কথাই নাই। তাই যতদ্রুত সম্ভব আগলে নেও। কারণ কথাটা তিক্ত হলেও সত্য যে, মায়ের বাধনে প্রথমে মেয়েরাই আটকা যায়।”

এই কথাগুলোর মানে পক্ষীর কাছে খুব একটা পরিষ্কার নাহলেও অস্পষ্ট নয়। কিন্তু সে চায় না এর মুখোমুখি হতে, বড্ড ভীতু যে। তাই কিছু শুনেনি এমন একটা ভাব নিয়েই চলে যায়।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here