#মুখোশের_আড়ালে
#পর্ব_১৪
#Saji_Afroz
.
.
সারাদিন বাইরে ঘুরাঘুরি করে সন্ধ্যায় বাসায় এলো ফাহাদ ও পৌষী । বাসায় আসতেই ফাহাদের ফোন বেজে উঠলো । পৌষীর বাবার ফোন দেখে তাকে ধরিয়ে দিয়ে বললো ফাহাদ-
কথা বলো তোমার বাবার সাথে ।
.
পৌষী ফোন রিসিভ করে বললো-
আসসালামুআলাইকুম বাবা ।
-ওয়া আলাইকুমুস সালাম । শুভ জন্মদিন ।
-তোমার মনে আছে!
-এখন ক্যালেন্ডারে চোখ পড়তেই মনে পড়লো । ইশ দেরী হয়ে গেলো ।
-সমস্যা নেই ।
-হ্যাঁরে মা! জামাই জানে তো তোর জন্মদিনের কথা?
-হ্যাঁ জানে । আজ আমরা সারাদিন ঘুরেছি । এই মাত্র বাসায় এলাম । বাইরে খেয়েছি দুপুরের খাবার । আর জানো? তোমাদের জামাই আমার জন্য কেকও কেটেছে ।
.
সোফায় বসে পৌষীর কথা শুনছে ফাহাদ । আজ অনেকটায় খুশি সে । এতোটা খুশি হবার মতো কিছু করেছে কি ফাহাদ?
আসলেই মেয়েটি সরল মনের । অল্পতেই খুশি হয়!
.
বাবার সাথে ফোনে কথা শেষ করতেই কলিং বেলের শব্দ শুনতে পেলো পৌষী ও ফাহাদ ।
ফাহাদ বসে ছিলো বিধায় পৌষী বললো-
আপনি বসুন , আমি দেখছি।
.
দূরবিনের দিকে তাকিয়ে পৌষী দেখলো কেউ নেই ।
ফাহাদের উদ্দেশ্যে বললো-
কাউকে দেখছি না!
-তবে খোলার প্রয়োজন নেই ।
.
পৌষী এগিয়ে আসতে চায়লে আবারো কলিংবেলের শব্দ শুনতে পেলো তারা ।
এবার উঠে এলো ফাহাদ । তখনের মতোই দেখতে পেলোনা কাউকে । ফাহাদ চেঁচিয়ে বললো-
কেউ কি আছেন?
.
ওপাশ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বললো সে-
ফাজলামো হচ্ছে নাকি!
.
সে দরজা খুলতে চায়লে পৌষী বারণ করলো তাকে । ফাহাদ বললো-
দেখা তো প্রয়োজন কে করছে এসব!
.
দরজা খুলে কাউকে দেখলোনা তারা । তবে ফুলের তোড়া ও বড় একটি কার্ড দেখতে পেলো ।
নিচ থেকে এসব হাতে নিয়ে পৌষীর দিকে এগিয়ে দিয়ে ফাহাদ বললো-
এসব ধরো । আমি চেক করে আসি আশেপাশে কেউ আছে কিনা ।
.
হরেক রকমের ফুল দিয়ে সাজানো তোড়াটি । ভেতরে এসে টেবিলের উপরে তোড়াটি রাখলো সে । কার্ডটি খুলে পড়তে থাকলো————
ভোরের স্নিগ্ধ আলোর মতো
আলোকিত হোক জীবন,
শিশিরে শিশিরে সিক্ত হয়ে
উদ্ভাসিত হোক তব মন ।
পাখি আর ভ্রমরের গানে
আসুক জীবনে নব ছন্দ,
দক্ষিণা হাওয়া ভেঙ্গে দিক
যত জীবনে আছে দ্বন্দ্ব ।
চাঁদের আলোয় পূর্ণ হোক
তব আঁধার কালো রাত, চিরবসন্ত জীবনে আনুক
অনাবিল খুশির প্রপাত ।
প্রেমও দানে করিবো অমর
ভালবাসার সকল ঋণ,
আমার শুধুই এই কামনা
শুভ হোক তোমার জন্মদিন ।
.
লেখাটি পড়ে মুগ্ধ হলো পৌষী । হাতের লেখাটাও দারুণ! কে এসব পাঠাতে পারে ভাবতে লাগলো সে । ঠিক তখনি ফাহাদ এসে দরজা আটকে বললো-
কাউকে পেলাম না ।
.
পৌষী তাকে কার্ডটি দেখিয়ে বললো-
দেখুন কতো সুন্দর ছন্দের কবিতা লিখে শুভেচ্ছা জানিয়েছে আমাকে!
-কে?
-তা জানিনা । নাম লেখা নেই ।
.
ফাহাদের মনে এক মুহুর্তের জন্য উষ্ণের নামটা এলো । কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে পড়লো, উষ্ণ এখানে নেই ।
পৌষীর হাত থেকে কার্ডটি নিয়ে কবিতাটি পড়লো সে । এই লেখাটি ফাহাদের অচেনা নয় । পৌষীকে সে এমনভাবেই লিখতে দেখেছে । যদিও পৌষীর লেখা এতো সুন্দর না এটা তার জানা ছিলো ।
পৌষী বললো-
কেউ আমার জন্মদিনে এই প্রথম কবিতা লিখেছে! আমি সত্যি অবাক হয়েছি । কিন্তু কে লিখেছে!
.
ফাহাদ বললো-
সেটাই ভাবছি । আমাদের সাথে অনেকদিন ধরেই অস্বাভাবিক কিছু ঘটনা ঘটছে । তাইনা?
.
কথাটি ঘুরানোর জন্য পৌষী বললো-
আমি শাড়িটা পাল্টে আসছি । রাতের জন্য রান্না করতে হবে ।
.
নিজের রুমে এসে পৌষী আপনমনে বললো-
হ্যাঁ ঘটছে ৷ আর কেনো ঘটছে তা জানার অপেক্ষায় আছি ।
.
.
মিয়াজ শেখের কাছ থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে উষ্ণ ডায়াল করলো ফাহাদের নাম্বারে ।
-হ্যালো কে বলছেন?
-আমি উষ্ণ মাহমুদ ।
-ওহ! কেমন আছেন?
-ভালো, আপনি?
-আছি ভালো ।
-পৌষীর ফোন বন্ধ পাচ্ছি ৷ সে ভালো আছে তো?
-আমার নাম্বার কার কাছ থেকে নিয়েছেন?
-মিয়াজ আঙ্কেল ।
-তার কাছেই নিশ্চয় জানতে পারতেন সে কেমন আছে?
.
ফাহাদের এমন কথায় কিছুটা কষ্ট পেলো উষ্ণ । ফাহাদের এমন কড়া কথা বলার কারণ টাও সে জানে । হয়তো ফাহাদের জন্যই পৌষী ফোন বন্ধ রেখেছে ।
উষ্ণ কিছু বলার আগেই ফাহাদ বললো-
পৌষী এখন ভালোই আছে ।
-ঠিক আছে । রাখছি আমি ।
.
ফোন রাখতেই ফাহাদ বিড়বিড়িয়ে বললো-
উষ্ণ মাহমুদের সাথে এরূপ ব্যবহার করা টা কি ঠিক হলো? আর কেনোই বা করবোনা! তার কি দরকার পৌষীর খবর নেয়ার?
.
.
ফাহাদ মুখের উপরে ফোনটা কেটে দিলো মনেহলো উষ্ণের । তার এমন ব্যবহারে কষ্ট পাওয়া উচিত নয় । তবুও উষ্ণ পাচ্ছে । ঠিক তেমনি কষ্ট পাচ্ছে, যেমনটা প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে পেয়েছিলো । পৌষীর সাথে কি আর কখনো কথা বলতে পারবে না সে!
.
.
রান্নাঘর থেকে এসে ফাহাদের পাশে বসলো পৌষী । ফাহাদ বললো-
পৌষী? ভালোবাসো তো আমায়?
-হঠাৎ এই প্রশ্ন?
.
পৌষীর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে ফাহাদ বললো-
কখনো ছেড়ে যাবেনা বলো ।
-উহু যাবোনা! কি হলো টা কি আপনার?
.
পৌষীর কাঁধে মাথা রেখে ফাহাদ বললো-
কিছুনা ।
.
ফাহাদের আচরণে অবাক হলো পৌষী । তাকে ছেড়ে যাবে এমন ভয়টা পায় পৌষী । কেননা সে নিজেকে ফাহাদের যোগ্য মনেই করেনা । আর এই ফাহাদই তাকে হারনোর ভয় করবে, এমনটা কখনো ভাবেনি পৌষী । সব কিছু কেমনটা হুটহাট হচ্ছেনা?
.
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে পৌষীর হাতে বানানো নাস্তা খেয়ে, অফিসের উদ্দেশ্যে বেরুচ্ছে ফাহাদ । দরজা খুলে পেছনে ফিরে পৌষীকে জড়িয়ে ধরলো সে । আলতো করে কপালে চুমু এঁকে বললো-
যেতে ইচ্ছে করছেনা ।
.
ফাহাদের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে পৌষী বললো-
আমারো ইচ্ছে করছেনা যেতে দিতে । কিন্তু আপনারই সমস্যা হবে ।
-হু । কোনো অসুবিধে হলেই ফোন করবে । চার্জে দিয়ে রেখেছি ফোন তোমার ।
-ঠিক আছে ।
-আসি তাহলে ।
.
ফাহাদ বেরিয়ে গেলো । এখনো দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে পৌষী । অফিসে যাবার সময় ফাহাদ তাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিবে, এমনটা সে এতোদিন কল্পনাতেই ভেবেছে । আজ তা বাস্তবে রুপান্তরিত হলো ।
.
.
দুপুরের কাজ সেরে ঘুমোচ্ছে পৌষী । এমন সময় এলো ফাহাদের ফোন । ফোন রিসিভ করে ভাঙা গলায় বললো-
হ্যালো?
-এইরে! আমার বউ এর ঘুম ভেঙে দিয়েছি বুঝি?
-হু ।
-আচ্ছা ঘুমাও । আমি রাখছি ।
-খেয়েছেন কিনা বলে রাখুন ।
-হ্যাঁ । তুমি খেয়েছো?
-হুম ।
-উঠে ফোন দিও ।
-হুম ।
.
ফাহাদ হেসে ফোনটা রেখে দিলো । বাড়িতে পৌষী একা বলে চিন্তা হচ্ছে তার জন্য । আগে অবশ্য এমন চিন্তা করার কারণ ছিলোনা । সে কি সব কিছু খুব হালকাভাবেই নিয়ে ফেলেছে! এসব ঘটনা তো এমনিতে ঘটতে পারেনা । এসবের পেছনে কোন রহস্য লুকিয়ে রয়েছে?
.
.
কাল সারাদিন ঘুরাঘুরি করার কারণে পৌষীর শরীরটা ক্লান্ত লাগছে । তাই ঘুমটা নষ্ট করতে ইচ্ছে করছেনা তার । কিন্তু কারো কান্নার শব্দে এক লাফে বসে পড়লো সে । মনেহচ্ছে তার খুব কাছে থেকেই কেউ কাঁদছে । পৌষী বলে উঠলো-
কে এখানে! কে?
.
কোনো জবাব নেই! কিন্তু শব্দটাও থামছেনা । কান্নার মাত্রা যেনো তীব্রভাবে বেড়ে গেলো । বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো পৌষী । বারান্দা থেকে শব্দটা আসছে মনেহলো তার । ধীরপায়ে সেদিকে এগিয়ে যেতেই দেখা পেলো তিশানীর ।
তিশানী মেঝেতে বসে বাচ্চাদের মতো কেঁদে চলেছে । কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো, তাকে দেখে পৌষীর বিন্দুমাত্র ভয় করছেনা । উল্টো পৌষী তার ঠিক সামনে বসে বললো-
কাঁদছেন কেনো?
.
কান্না থামিয়ে তিশানী বললো-
সাহায্য চাই । করবে?
.
পৌষী বললো-
করবো । বলুন?
.
পৌষীর কথা শুনে হাসতে লাগলো তিশানী । এভাবে হাসার অপেক্ষায় যেনো ছিলো সে!
.
.
সকালেই কুমিল্লায় পৌঁছালো উষ্ণ । বাড়িতে সে এখনো যায়নি । তবে তার এখানে আরেকটি বাসা রয়েছে । যে বাড়িটা তার প্রিয়সীকে উপহার দিয়েছিলো । এই বাড়িটা এখন ফাঁকা থাকে । অনেকদিন পরেই সে পা দিলো এখানে । অবশ্য আজকের দিনে এখানে না এসে পারতোই না সে!
বেশ কয়েক প্যাকেট সিগারেট খেয়ে শেষ করেছে উষ্ণ । অনেকদিন পরে সিগারেটের ধোঁয়া উড়ালো সে । ওয়াদা করেছিলো, আর কখনো সিগারেটে হাতও দেবেনা । প্রিয়সীকে দেয়া কথা সে ভেঙেছে । তার প্রিয়সীও কি তার কথা রেখেছে? রাখেনি । বরং….
আর ভাবলোনা উষ্ণ । সে আরো খাবে । খেতেই থাকবে । যতোক্ষণ না বাংলাদেশে সিগারেটের প্যাকেট শেষ হচ্ছে ততোক্ষণই খেতে থাকবে । এতো এতো সিগারেটের প্যাকেট কেনার মতো টাকা নিশ্চয় তার কাছে আছে! এমনটা ভেবে নিজেরমনে হেসে ফেললো উষ্ণ । সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে! এসব কি যা তা ভাবছে সে! চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লো উষ্ণ । ভাবা কম কাজ বেশি হওয়া প্রয়োজন । আরেকটি সিগারেট ধরালো সে।
ঠিক তখনি পেছন থেকে কোনো মেয়েলী কন্ঠস্বর শুনতে পেলো সে-
ওয়াদা ভুলে গেলে এতো তাড়াতাড়ি?
.
পেছনে ফিরে পৌষীকে দেখে অবাক হলো উষ্ণ । এসট্রেতে সিগারেট টা রেখে বললো-
পৌষী!
-আজকের দিনে না এসে পারলাম না ।
.
পৌষীকে দেখে উষ্ণের অশান্ত মনটা অনেকটায় শান্ত হয়েছে । সে যেনো তারই অপেক্ষা করছিলো! পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে সে পৌষীর দিকে ।
উষ্ণের কাছে এসে তার লাল চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে পৌষী বললো-
কি দেখছো?
.
উষ্ণ শান্ত স্বরে বললো-
তুমি পৌষী নও ।
.
চলবে
.