মুখ এবং মুখোশ পর্ব ১

#ধারাবাহিক_রহস্য_গল্প
#মুখ_ও_মুখোশ
#পর্ব_১

দরজাটা বন্ধ করে এসি চালিয়ে লেদারের নরম গদিতে গাটা এলিয়ে দিল অনামিকা | এটা ওর মি-টাইম | মেয়ে স্কুলে, বর অফিসে নিজেকে প্যাম্পার করার এর চেয়ে ভালো সময় আর হয় না | তবে আজ ওর হাতে বেশি সময় নেই, কয়েকটা মিনিট বিশ্রাম নিয়েই ব্যস্ত পায়ে অনামিকা বেডরুমে ঢুকল | মেহগনি রঙের দেওয়ালজোড়া ওয়ার্ডোবের আয়নায় একবার নিজের চেহারাটা দেখল, একটা বাঁকা হাসি ঠোঁটের কোণায় ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল | ওয়ার্ডোব খুলে আমেরিকান টুরিস্ট্যারের কেবিন ট্রলিটা বার করল…. চটপট কয়েকটা ব্র্যান্ডেড দামী ড্রেস, হ্যান্ডব্যাগ, জুতো, পারফিউম ট্রলিতে ভরে নিল, নিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল | এই সবকিছু ছেড়ে ওকে জলদি পালাতে হবে | উইকেন্ডের একঘেয়ে বিজনেস পার্টি, বিজনেস ম্যাগনেটদের সঙ্গে শিফনের শাড়ি বা শর্ট ড্রেসে কোমর দুলিয়ে নাচ, পার্টি শেষে মদের ঘোরে প্রবালের নোংরা স্ল্যাং, তারপর মাঝেমধ্যেই নামীদামী গেস্টদের এন্টারটেন করা….এসব করতে ওর আর ভালো লাগছে না… তবে অনামিকাকে সংসারের কোন কাজ করতে হয় না | পার্লার আর জিমে ঘুরে ফিগার মেনটেন করাটাই ওর একমাত্র কাজ, যাতে প্রবালের কোটি কোটি টাকার ডিলগুলো স্মুথলি সাইন হয়ে যায় | সংসারের যাবতীয় কাজের লোক আছে, বাচ্চার জন্য দিনরাতের আয়াও রেখে দিয়েছে ওর স্বামী প্রবাল দত্ত …. কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই অনামিকার মনে হচ্ছে এসব থেকে ও মুক্তি চায়….ও ফ্রি বার্ডের মতো নির্মল আকাশে ভেসে বেড়াতে চায় | প্রবালকে নিজের মনের কথা জানিয়ে অনামিকা ডির্ভোসও চেয়েছিল | কিন্তু প্রবাল সেকথা শুনেই এমনভাবে কেঁদে পায়ে পড়ে গেল, ‘ আমায় ছেড়ে যেও না গো ‘ বলে এমন বাংলা বোকা বোকা সিনেমার নায়কের মতো ওভার অ্যাকটিং করতে শুরু করল যে, সিন ক্রিয়েটের ভয়ে ওকে চুপ করে যেতেই হল | সো ডিসগাস্টিং….

একটা হোবো ব্যাগে ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, পাশবই, লাখ দশেক ক্যাশ, পাসপোর্ট, ভোটার, আধার, প্যান কার্ড, গোল্ড-ডায়মন্ডের রকমারি জুয়েলারি ভরে নিল অনামিকা | ও জানে অজানা পথে পা বাড়াতে পয়সার চেয়ে ভালো বন্ধু আর কেউ নেই ! হোটেল হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাশানালে‌ রবিবার রাতে একটা বড় ডিল সাকসেসের পার্টি আছে, সঙ্গে গালা ডিনারের ব্যবস্থা, এই পার্টিটা প্রবালই দিচ্ছে আর সেই জন্যই গতকাল প্রবাল ব্যাঙ্ক থেকে এই অঙ্কের অ্যামাউন্ট তুলেছে | অনামিকা জানে প্রবাল ওকে সমস্ত কিছু দিয়ে ধরে রাখতে চায় | অনামিকার মোম পিচ্ছিল ত্বক, নিখুঁত ফর্সা রঙ, সুডৌল স্তন, পাতলা কোমর, উন্মুক্ত মেদহীন পিঠ ….. সবটা…সবটাই প্রবালকে কোটি টাকার ডিলগুলো সাইনে সাহায্য করে | বর্তমানে অনামিকার সাঁইত্রিশ চলছে, যদিও ওর নিখুঁত মেক-আপে ঢাকা রূপ একঝলক দেখলে পঁচিশের কম বলেই মনে হয় ! অনামিকা একটা ফুটফুটে সন্তান চাইত কিন্তু প্রবাল কিছুতেই রাজি হত না, যদি অনামিকার আগুনঝরা যৌবনে ভাঁটার টান আসে | অনামিকার ফিগার নষ্টের ভয়ে ওদের একমাত্র সন্তান মোমকে পর্যন্ত পৃথিবীতে আনতে চায় নি প্রবাল | কিন্তু কথায় আছে অতি বড় সাবধানীদেরও কোনো একদিন ভুল হয় ! প্রবালের হয়েছিল | অনামিকা নিজের শরীরের অনাগত সন্তানের পদধ্বনি শুনতে পেলেও প্রবালকে ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দেই নি | প্রবাল ব্যাপারটা জানতে পেরে ওর ওপর প্রচন্ড শারীরিক অত্যাচার শুরু করে তারপর জোর করে অ্যাবরেশনের জন্য ওর চেনা ক্লিনিকে নিয়ে যায় | ডাক্তার ভাগ্যিস বলেছিল অ্যাবরেশন করালে অনামিকার প্রাণ সংশয় হতে পারে তাই …… তাই মোম এ পৃথিবীতে আসতে পেরেছিল | আর মোম জন্মানোর পর নিজের প্রাণপণ চেষ্টায় অনামিকা এক বছরের মধ্যে নিজের পুরোনো ফিগারে ফিরে এসেছিল | নিয়মিত পার্লার আর রূপচর্চায় ওর পেটে তেমন কোন স্ট্রেচ মার্ক‌ পড়ে নি | সেসময়টা ওর জীবনের অন্যতম কঠিন সময় ছিল, ও প্রবালকে ভীষণ ভয় পেত | প্রবালের অ্যারোগেন্ট ইমেজ, কথায় কথায় অনামিকাকে ছেড়ে যাওয়ার হুমকি, ওর বাবা-মায়ের দারিদ্র্যের কথা তুলে খোঁটা, মারধর, অকথ্য স্ল্যাং …. এসবের কাছে বারবার অনামিকা অসহায় ভাবে আত্মসমর্পণ করত | মাঝে মাঝে নামীদামী বিজনেস ম্যানদের এন্টারটেনমেন্টের নামে ওকে দিয়ে ওসব ….. যাক সেসব কথা, কিন্তু এখন পাশা পাল্টে গেছে | যেদিন থেকে এই হাই সোসাইটির ইউনিসেক্স স্টার স্যাঁলোতে যেতে শুরু করেছে অনামিকা, সেদিন থেকেই ওর রেশমী কোমল চুল, মসৃণ দেহত্বক, পাতলা কোমর ওখানে আসা উচ্চবিত্ত মানুষজনের আলোচনায় বিষয় | ওখান থেকেই ও বেশ কয়েকটা প্রোডাক্ট মডেলিংয়ের অফার পেয়েছে | এখানেই শেষ নয়, ওর রূপমুগ্ধ মিঃ মানসুখানি ওকে স্টার সেলিব্রিটি দেবজিতের সঙ্গে একটা অ্যাড ফিল্মের অফারও দিয়েছে ….. আর তারপর থেকেই শুরু হয়েছে প্রবালের আসল খেলা | ওকে ছেড়ে যেতে চাওয়া প্রবাল এখন অনামিকার ডির্ভোসের হুমকি শুনে আত্মহত্যা করার ভয় দেখায়, পায়ে পড়ে ছোট্ট মোমের দোহাই দিয়ে নাটক করে ……. একদিন অনামিকা প্রবালের এসব ট্র্যাশ না শুনে ট্রলি নিয়ে সোজা সোসাইটির করিডর অবধি চলে এসেছিল, ওপেন জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রবাল এমনভাবে সিন ক্রিয়েট করল, যে লোক জড়ো হয়ে গেল | পরের দিন সোসাইটির সেক্রেটারি ফ্ল্যাটে ঢুকে হুমকি দিয়ে গেলেন এবার থেকে নিজেদের সমস্যা ঘরের ভেতর মেটানোর চেষ্টা করবেন | নয়ত সোসাইটির সেক্রেটারি হিসেবে আমি স্টেপ নিতে বাধ্য হব | সেদিনই অনামিকা বুঝে গেছে প্রবাল ওকে কিছুতেই ডির্ভোস দেবে না ! তারপর থেকেই অনামিকা পালানোর প্ল্যান করছে কিন্তু হাতে ক্যাশের অভাব ছিল …. অন্য শহরে ডেরা বাঁধতে হলে হাতে বেশ‌ মোটা অঙ্কের টাকা প্রয়োজন |

কিন্তু মোম, ওর অস্থিমজ্জা দিয়ে গড়া ছ-বছরের মিষ্টি মোমের কি হবে ? ওইটুকু মেয়েটা মাকে ছাড়া থাকবে কি করে ? অনামিকার ভরসা একটাই প্রবাল নিজের মেয়েটাকে ভীষণ ভালোবাসে | যে মেয়েকে প্রবাল একদিন পৃথিবীর আলো দেখাতে চায় নি সেই মেয়েকে প্রবাল আজ চোখে হারায় | তাই মেয়ের কোন অনিষ্ট প্রবাল করবে না …..সময় বোধহয় একদিন সব হিসেবই উল্টেপাল্টে দেয় | দুঘন্টা পরেই মুম্বইয়ের ফ্লাইট….আর নয়, কোনভাবেই আর পিছুটান নিয়ে অনামিকা ভাববে না | এবার ওকে আকাশে পাড়ি দিতেই হবে, একবার মেঘের উপর দিয়ে উড়ে যেতে পারলেই প্রবালের নাগালের বাইরে | মিঃ মানসুখানি জানিয়েছেন ইতিমধ্যেই ওর জন্য একটা ফ্ল্যাট বুক করে রেখেছে | অনামিকা খুব ভালো করেই বুঝতে পারে মানসুখানির এত গরজের কারণ, সবই ওই পঞ্চভূতে বিলীন হওয়া মানবদেহের হাড়-মাংস-মেদ-মজ্জার জন্য | মাঝে মাঝে এইসব স্থুলরুচির মানুষজনের উপর অনামিকার ভীষণ করুণা হয় | নিজের অজান্তেই ওর একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল, মনে মনে ভাবল এসব ফিলোজফির কথা পড়ে ভাবলেও চলবে …… আপাতত এই ফ্ল্যাট, এই কমপ্লেক্স, এই শহর ছেড়ে পালাতে হবে | প্রবালের থেকে মুক্তি পেলে বাকিটা অনামিকা ঠিক ম্যানেজ করে নিতে পারবে |

লিফট থেকে নেমে ভূত দেখার মতোই চমকে উঠল অনামিকা | প্রবালের গাড়ির ড্রাইভার ওর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে …. তবে কি প্রবাল ওর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে গেল ! এই ড্রাইভার ছেলেটা প্রবালের গুপ্তচর | ওকে যদি ক্যাবে করে কোথাও যেতে দেখে তাও আবার ট্রলি সমেত নির্ঘাত ফোন করে প্রবালকে খবর দিয়ে দেবে | ম্যাডাম আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন ? তরুণের চোখেমুখে জিজ্ঞাসা… ওর সামনে একদম ভয় পেলে চলবে না, মাথা ঠান্ডা রেখে কাজটা উদ্ধার করতে হবে | অনামিকা হাসিমুখে উত্তর দিল, তরুণ তুমি এসে গেছো ভালো হয়েছে | আমি তোমাকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম….. আমি এয়ারপোর্টের কাছে লা ভ্যানিলা হোটেলে যাব | ম্যাডাম ট্রলি নিয়ে যাবেন ? হ্যাঁ, ওখানে সাহেবের একজন ক্লায়েন্ট আসবে | তরুণের আর সন্দেহ হল না, সে জানে সাহেবের আদেশে ম্যাডামকে মাঝেমধ্যেই ক্লায়েন্ট মিট হোটেলে যেতে হয় | তরুণ হোটেলের দিকে গাড়ি চালিয়ে দিল | গাড়িতে তরুণ বসে আছে, অনামিকা রিশেপসনে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখিয়ে হোটেলের একটা রুম নিজের নামেই বুক করল | চাবি নিয়ে রুমের ভিতর ঢুকে ও মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করল …. তারপর রুমের দরজায় ডু নট ডিসটার্বের বোর্ড লাগিয়ে ট্রলি সমেত হোটেলের পিছনে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল ….ও আনন্দের সঙ্গে দেখল ওকে কেউ লক্ষ্য করল না, পিছনের রাস্তায় ক্যাব অপেক্ষা করছিল… অনামিকা উঠে বসতেই ছুটল এয়ারপোর্টের দিকে |
( চলবে )

©️ অনিন্দিতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here