মুখ ও মুখোশ শেষ পর্ব

#ধারাবাহিক_রহস্য_গল্প
#মুখ_ও_মুখোশ
#শেষ_পর্ব

হোটেলে ফিরে ইন্দ্র বলল, শোন পরশু দিনই তো প্রবাল মুম্বই পৌঁছে যাবে … কালকে বরং একটু মুম্বই শহরটা ঘুরে দেখা যাক ! তুই কি বলিস !
একবার জলসায় যাব ভাই ! বিগ বি’র বাড়ি বলে কথা ! অরণ্য দাঁতগুলো বেরিয়ে গেল |
আমি দেখব গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া… সেই কোন ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে এসেছিলাম | ইন্দ্রের গলা স্মৃতিমেদুর !
সকালবেলা উঠে ব্রেকফাস্ট সেরে বসেছিল ইন্দ্র | অরণ্য তখনও কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমোচ্ছে ! কিরে মুম্বই দেখবি না ঘুমোবি ?
দেখব দেখব ! বলে লাফিয়ে উঠে দশ মিনিটের মধ্যে স্নান টান সেরে অরণ্য রেডি !
তুই ব্রেকফাস্ট করবি না ? লেট ডিনার করেছিলাম এখনো হজম হয় নি ভাই !
তাহলে আর কি ! চল দেরি না করে বেরিয়ে পড়া যাক….. ওরা হোটেল ম্যানজারকে গিয়ে মুম্বইয়ের দ্রষ্টব্যগুলো দেখব বলতেই উনি ওদের জন্য একটা গাড়ি ঠিক করে দিলেন !
প্রথমেই ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল অরণ্য, অস্ফুটে বলল কি সুন্দর ! তারপর ফ্লোরা ফাউন্টেন দেখে ওরা চলে গেল প্রিন্স অফ ওয়েলস মিউজিয়াম দেখতে !
মিউজিয়াম দেখে অরণ্য বলল আমার বেশ খিদে খিদে পাচ্ছে রে…
ড্রাইভারকে বলতেই সে কাছাকাছির মধ্যে একটা ভালো রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল….. ফ্রায়েড রাইস, গার্লিক চিকেন, রুমালি রুটি খেয়ে অরণ্য বলল, সবই তো হল মধুরেণ সমাপয়েত হবে না ! একটা আইসক্রিম হয়ে যাক ! ওয়েটারকে বলল, দুটো ব্রাউনি উইথ ভ্যানিলা আইসক্রিম ! আইসক্রিম খেয়ে মুখ টুখ মুছে ওরা দেখতে গেল ‘ গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া ‘…… ইন্দ্র বলল স্মৃতির ঝাঁপিগুলো খুলে যাচ্ছে রে …. বাবার হাত ধরে ছোট্ট আমি ‘ গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া ‘র দিকে হাঁ করে চেয়ে আছি…. আর আজ বাবা নেই, ছোট ছেলেটাও আজ আর বিস্মিত হয় না !
অরণ্য ইন্দ্রের মনটা একটু ভালো করে দেওয়ার জন্য বলল কিরে এত কাছে এসে তাজ হোটেলটা একটুখানি ঘুরে দেখব না !
চ ! তাহলে একবার লবি থেকে ঘুরে আসি |
তাজ হোটেলে ঢুকলে চোখ ধাঁধিয়ে যায় ! ওরা অবাক হয়ে দেখল নানা জাতি, নানা ধর্মের, নানা পোশাকের মানুষের মেলবন্ধন ঘটেছে এই হোটেলে….একেবারে রবীন্দ্রনাথের ” এসো আর্য, এসো অনার্য, এসো হে দ্রাবিড়, চীন “…. কবিতা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে তাজের লবিতে ! হোটেলে ফিরতে ফিরতে ওদের সন্ধ্যে হয়ে গেল | আজ নির্ভেজাল ঘুম ! কাল দুপুরেই তো প্রবাল দত্ত এসে পড়বেন |

দুপুর দুটো নাগাদ ইন্দ্রজিতের ফোন‌ বেজে উঠল | নীচে নেমে ইন্দ্র দেখল হোটেলের ওয়েটিংয়ে প্রবাল পায়চারি করছে | ইন্দ্রকে দেখে এগিয়ে এসে প্রবাল বলল, আর দেরি না করে চলুন তাহলে অনামিকার ফ্ল্যাটে যাওয়া যাক |
দাঁড়ান মশাই এখন কোথায় যাবেন ? আপনার মিসেস এখন অ্যাড ফিল্মের শ্যুটিংয়ে ব্যস্ত | রাত আটটার আগে ওনাকে ফ্ল্যাটে পাওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই |
শ্যুটিং ? অনামিকা আবার শ্যুটিং করছে নাকি ! প্রবালের গলায় রাগ জমা হচ্ছে |
সে কি এটা আপনি জানেন না ? একটা অ্যাড ফিল্মের শ্যুটিংয়ের জন্যই তো আপনার মিসেস কলকাতা ছেড়ে মুম্বই পাড়ি দিয়েছে | আফটার অল হিরোইন হতে কে চায় না বলুন ?
অরণ্য দেখল প্রবাল ক্রমশই উত্তেজিত হচ্ছে | আর ইন্দ্র ইচ্ছে করে ওকে উত্তেজিত করছে |
দেখুন প্রবালবাবু, একটা কথা আগে থেকেই বলে দি, আমি অনামিকার ফ্ল্যাটটা আপনাকে দূর থেকে দেখিয়ে দেব ! বাকি বোঝাপড়া আপনারা নিজেরাই মিটিয়ে নেবেন | আমরা কিন্তু আর এসবের মধ্যে নেই |
একদম একদম, প্রবাল খুব খুশি হয়ে বলে উঠল | অনেক ধন্যবাদ আপনাকে | ইন্দ্র যে অনামিকার সঙ্গে কোন কথা বলে নি তাতে প্রবাল যে কতটা শান্তি পেয়েছে তা ওর গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছে !
অনামিকাকে মেসেজ করল ইন্দ্র ! আপনি প্রস্তুত তো ম্যাডাম |
মোবাইলের দিকে তাকিয়ে ইন্দ্রর চোখে একটা চকিত হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল |
রাত আটটা নাগাদ বান্দ্রার ‘ স্কাই হাই কমপ্লেক্সে ‘র সামনে পৌঁছে গেল ইন্দ্ররা | প্রবালকে অনামিকার সাততলার ফ্ল্যাটটা দেখিয়ে দিয়ে বলল, আজকাল এই ফ্ল্যাটে আপনার মিসেস রয়েছেন | আচ্ছা তাহলে এবার আমরা আসি | আপনার জন্য আমরা হোটেলে অপেক্ষা করব | লিফ্ট চেপে নিচে নেমে গেল ইন্দ্র ও অরণ্য |

ইন্দ্রদের চলে যাওয়া পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করল প্রবাল ! এবার অনামিকাকে দেখিয়ে দেবে কত ধানে কত চাল ! প্রবাল বেল টিপল, কেউ খুলল না, দ্বিতীয়বার বেল টিপল…. প্রবালের মনে হল ও অনন্তকাল ধরে এই দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে | ইন্দ্র কি ওকে মিথ্যে কথা বলল ? অনামিকা সত্যি এখানে আছে তো‌ !… আবার বেল বাজাল প্রবাল ! কে যেন দরজা নবটা ঘোরালো, দরজা খুলতেই প্রবাল তাকিয়ে দেখল একটা অফ হোয়াইট শিফন পড়ে পরী সেজে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে …… কে ? অনামিকা ! রাগে জ্বলে গেল প্রবালের সর্বাঙ্গ ! ওকে বাঁদর নাচ নাচিয়ে অনামিকা সেজেগুজে শ্যুটিং করে বেরাচ্ছে ! তীব্র রাগের আতিশয্যে প্রবাল লক্ষ্যও করল না অনামিকা দরজাটা পুরোপুরি বন্ধ করে নি !
তোর খুব বাড় বেড়েছে না শালী ! নিজেকে হিরোইন বানানোর খুব শখ না ! শ্যুটিং হচ্ছে শ্যুটিং | ঠাস ঠাস করে দুটো চড় আছড়ে পরল অনামিকার ফর্সা গালে | হিসহিসে গলায় প্রবাল বলল, শোন শালী মিঃ মানসুখানিও তোর শরীরটাই চায় | বুঝেছিস ! কাল ফ্লাইটে সোজা আমার সঙ্গে কলকাতা ফিরবি | নেক্সট উইকে আমার একটা বিগ ডিল আছে | মিঃ মুখার্জির তোকে চাই, তুই না হলে মুখার্জি ডিলটা সাইন করবেন না বুঝেছিস ! তোর ওসব নখরা আমার কাছে চলবে না !

অরণ্য দেখল ইন্দ্র একবার কমপ্লেক্সে কম্পাউন্ডে পাক খেয়ে আবার লিফ্টের সাততলার বাটন টিপল ! অরণ্য অবাক হয়ে বলল তুই কি বেরোবার রাস্তা ভুলে গেলি নাকি !
আগে আগে দেখে যা তু কি হোতা হ্যায় কেয়া !
ওরা লিফটে উঠছে আরেকজন ভদ্রলোক বললেন, রোককে, রোককে ! তারপর সাততলার বাটন টিপে লিফট চলতে শুরু করতেই ইন্দ্র বলল, আচ্ছা মিঃ খান্না আপ কে পাস গান তো হ্যায় না !
আপ টেনশন মত লিজিয়ে ইন্দর সাব | আপ প্যাহলে চলিয়ে তো সহি !
দরজার বাইরে থেকে তখনও প্রবালের চিৎকার শোনা যাচ্ছে, শালি উড়তে শিখেছ ! একবার খাঁচায় ঢোকাই তারপর এমন লোহার শিকলে তোমার পা বাঁধব যে পা নাড়তে গেলে পা একেবারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে ! প্রবালের অনামিকার চুল টেনে ধরলো !
এক লাথিতে দরজা খুলে ইন্দ্র গম্ভীর গলায় বলে উঠল সে সুযোগ হয়ত আর এ জন্মে পাবেন না মিঃ প্রবাল দত্ত |
আপনারা এখানে ? আপনারা তো হোটেলে চলে গেছিলেন ?
আমাদের তো এখানে আসতেই হত | নইলে আপনার আসল রূপটা দুনিয়া কি করে দেখত বলুন তো ! জানেন আমার পাশে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন ইনি কে ? ইনি হলেন মুম্বই পুলিশ কমিশনার মিঃ খান্না |
স্ত্রীর উপর অকারণে অত্যাচার করার জন্য ৪৯৮ এ ধারা অনুসারে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হল, মিঃ খান্না বলে উঠলেন | এতক্ষণে কয়েকজন পুলিশ সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছে…. একজন কনস্টেবল এসে প্রবালের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল |
স্যার প্রবালের সমস্ত কথা এই পেন রেকর্ডারে রেকর্ড করা আছে | আপনি উইটনেস হিসাবে ব্যবহার করতে পারেন, মিঃ খান্নার দিকে পেনটা এগিয়ে দিয়ে অনামিকা বলল | অনামিকার ফর্সা গালে প্রবালের পাঁচ আঙুলের দাগ এখনো প্রবালের পাশবিক অত্যাচারের সাক্ষ্য বহন করছে |
হাতকড়া পড়া অবস্থায় প্রবাল তখনো গজরাচ্ছে, একবার জেল থেকে ছাড়া পাই, তারপর তোকে ঠিক দেখে নেব শালী |
আপনার খেলা শেষ প্রবাল | বিজনেস ওয়ার্ল্ডে রেপুটেশন খতম | আপাতত জেলে থেকে ডিভোর্সের মামলা লড়ার জন্য প্রস্তুত হোন, ইন্দ্র গলায় নির্মম শীতলতা |
পুলিশের গাড়ি প্রবালকে নিয়ে চলে গেল |
আপনি আমার দাদা, আপনি‌ না থাকলে আমি কোনদিনই আর নিজেকে ফিরে পেতাম না, মুম্বইয়ের কোন অন্ধকারে হারিয়ে যেতাম কে জানে ! ইন্দ্রকে পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করল অনামিকা |
আপনি কি এখানে থাকবেন নাকি আমাদের সঙ্গে কলকাতা ফিরবেন ?
কি যে বলেন দাদা ! আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কলকাতা ফিরতে চাই | আপনি টিকিটের ব্যবস্থা করুন | আমার মেয়ে ….. আমার ছোট্ট মোম মায়ের জন্য অপেক্ষা করছে যে………
( সমাপ্ত )

©️ অনিন্দিতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here