মুখ ও মুখোশ পর্ব ৩

#ধারাবাহিক_রহস্য_গল্প
#মুখ_ও_মুখোশ
#পর্ব_৩

আক্ষেপে, হতাশায় মাথা নাড়ল প্রবাল | অনামিকাকে খুঁজে বের করতে হবে কিন্তু পুলিশকে ইনফর্ম করলে চলবে না ! কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরোতে কতক্ষণ ? সবচেয়ে বড় কথা, এই ঘটনার সঙ্গে ওর রেপুটেশনের প্রশ্ন জড়িত | একবার থানা-পুলিশ হলে বিজনেস ওয়ার্ল্ডে ওর মারাত্মক বদনাম হবে, অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দাঁড় করানো কেরিয়ারের ক্ষতি কিছুতেই মানতে পারবে না প্রবাল দত্ত | তাছাড়া‌ অনামিকা ছিল ওর কাছে ডানা ছাঁটা পাখি, সেই ডানা ছাঁটা পাখির নতুন করে ডানা গজিয়ে খাঁচা ছেড়ে আকাশে উড়ে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না প্রচন্ড আত্ম অহঙ্কারী প্রবাল‌ দত্ত | ওর মেল ইগো ভীষণভাবে হার্ট হচ্ছিল | হঠাৎ ওর মনে পড়ল ছোট্ট মোমের কথা | মোম কোথায় ? মোমকেও কি অনামিকা নিজের সঙ্গে নিয়ে গেল ? মোমকে ছাড়া প্রবাল থাকবে কি করে ? কিন্তু কাউন্টারে তো বলল, অনামিকা একাই গেছে | তরুণ গাড়ি ঘোরাও, জলদি আমার ফ্ল্যাটে চলো | বুকের ভেতর চোরাবালির টান, একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছে প্রবাল ! ফ্ল্যাটের কমপ্লেক্সে গাড়ি পৌঁছতেই তাড়াহুড়ো করে নেমে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে ওপরে উঠতে লাগল প্রবাল | লিফট ব্যবহারের কথা ও তখন ভুলেই গেছে | হাঁপাতে হাঁপাতে নিজের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডুপলিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ফেলল প্রবাল | ওর পা কাঁপছে, চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে আসছে | মোম, মোম কোথায় ? বলতেই দেখে ছোট্ট মোম দৌড়ে আসছে, পেছনে ওর আয়া ঝিমলি | মোমকে কোলে তুলে আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে লাগল প্রবাল, কিন্তু এই অসময় বাবাকে বাড়িতে দেখে চমকে গেছে ছোট্ট মোম | ছোট্ট ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, মাম্মা কই ? কখন স্কুল থেকে এসেছি আমায় কোলেই নেয় নি ? আমার সঙ্গে দেখাও করে নি !
কি বলবে বুঝতে না পেরে প্রবাল বলল, মাম্মার ভাই তোমার আঙ্কেলের তো শরীর খারাপ, তাই মাম্মাম ভাইকে দেখতে গেছে |
মোম বলল, আমি তো কোনদিন মামবাড়ি যাইনি | আমায় নিয়ে চল | আমিও আমার স্কুলের বন্ধুদের মতো মামবাড়ি যাব |
হ্যাঁ সোনা আমরা যাব তো ! এখন তো আঙ্কেল অসুস্থ | আঙ্কেল একটু সুস্থ হলেই আমরা মামবাড়ি ঘুরতে যাব |
প্রমিস ?
পাক্কা প্রমিস | যাও তুমি এখন ঝিমলির সঙ্গে খেলা কর |

মোম ঠিক আছে একটা সমস্যা মিটল | এবার অনামিকা ফিরিয়ে আনতে হবে | এমন শিক্ষা দিতে হবে জীবনে যেন পালানোর দুঃসাহস না করে | কিন্তু কি করা যায় ? নিজের ঘরে এসে চিন্তায় পড়ে গেল প্রবাল | এমন একটা রাস্তা বার করতে হবে যাতে সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না | হঠাৎ ওর মনে পড়ল অরণ্যর কথা | ছেলেটা বেশ কয়েকটা বিজনেস পার্টি কভার করতে এসেছিল ওদের ম্যাগাজিনের তরফ থেকে | সেখান থেকেই ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব, মাঝেসাঝে ক্লাবে আড্ডাও হয় | অরণ্য কথায় কথায় বলেছিল, ওর এক বন্ধু আছে ইন্দ্রজিৎ সরকার | ছেলেটা নাকি প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর | আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব মনে হওয়া কাজও নাকি খুব সহজেই করে ফেলে ! ওদের কাগজে নাকি ইন্দ্রজিতের কীর্তিকলাপের বেশ কয়েকটা ঘটনা বেরিয়েছিল | প্রবাল শুধু মাথা নেড়েছিল, আজকাল বাংলা কাগজ কেই বা পড়ে ? আচ্ছা একবার অরণ্যকে ফোন করলে হয় না ? ওর সুপারিশে ইন্দ্রজিৎ যদি কেসটা নিতে রাজি হয় তাহলে হয়ত অনামিকাকে খুঁজে বার করা সম্ভব হবে ! মনে মনে ভাবল, একবার খুঁজে পেলে প্রবাল দত্তকে ঠকানোর মজা অনামিকাকে দেখিয়ে দেবে | কন্টাক্টস লিস্ট থেকে অরণ্যর নাম্বার খুঁজে বের করে ডায়াল করল প্রবাল | চারবারের বার রিং হতেই অরণ্য ফোনটা ধরল :
বলুন ? আপনি হঠাৎ ফোন করলেন ? কোন সিরিয়াস খবর কি ?
খবর সিরিয়াস | তুমি কি একবার তোমার ওই ডিটেকটিভ বন্ধুকে নিয়ে আমার বাড়িতে আসতে পারবে ?
কেন বলুন তো দাদা ? আপনার আবার ডিকেটটিভ কি হবে ? বিজনেসে কারুর কোনো জালিয়াতি ধরতে হবে নাকি ?
কেসটা অফিসের নয়, বাড়ির | একটা ডেলিকেট ম্যাটার | তুমি বাড়িতে এসো সব বলছি | প্লিজ দেরি করো না ভাই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসতে পারলে ভালো হয়…খুব খুব আর্জেন্ট ম্যাটার |
ফোনটা কেটে অরণ্য ইন্দ্রজিৎকে ফোন করল | কয়েকদিন বেকার কাটছে, তা ইন্দ্রজিতের সময় নষ্ট করা ধাতে নেই ! দুদিন বসে বসে শব্দছক মেলালো, তারপর নানা বিষয়ে বই পড়তে শুরু করল | আজকে ইন্দ্রজিৎ সোফায় বসে জুলে ভার্নের লেখা ‘ অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইট্টি ডেজ ‘ বইটা পড়ছিল | এটা ওর অন্যতম প্রিয় বই, ফাঁক পেলেই পড়ে ফেলে | ওঘরে মোবাইল বাজছে, বই রেখে ইন্দ্র ঘরে গিয়ে দেখল অরণ্য ফোন করেছে |
ভাই তোকে একটু ডিসটার্ব করবো | তুই কি আমার সঙ্গে একবার সল্টলেক যাবি ?
হঠাৎ সল্টলেক কি ব্যাপার ?
ব্যাপারটা না আমিও ঠিক জানি না | আমার এক বন্ধু আছে প্রবাল, প্রবাল দত্ত , বিজনেস পার্টিতে আলাপ হয়েছিল, এখন মাঝেমধ্যে ক্লাবে গেলে গল্প টল্প হয় | উনি ফোন করেছিলেন উনি নাকি হঠাৎই একটা ব্যাপারে ফেঁসে গেছেন !
তুই কি বিখ্যাত বিজনেস ম্যান প্রবাল দত্তর কথা বলছিস ?
একদম, বস্ একদম | ওনার নাকি ফ্যামিলিতে কি একটা প্রবলেম হয়েছে | মালটাকে বললাম ঝেড়ে কাশতে অমনি বললেন, ফোনে নাকি সবটা বলা যাবে না, সামনাসামনি বলবেন | ওনার নাকি তোর সাহায্য ভীষণ দরকার |
ওকে তুই এখুনি গাড়ি নিয়ে আমার ফ্ল্যাটে চলে আয় | আমি ততক্ষণে রেডি হয়ে নিচ্ছি |
সল্টলেকে প্রবাল দত্তের ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট দেখে অরণ্যর চক্ষু ছানাবড়া | ক্লাবে আড্ডা দিলেও এই প্রথমবার ও প্রবালের বাড়ি এল | দামী দামী জিনিসপত্রের ছড়াছড়ি | মেঝেতে অরিজিনাল ইটালিয়ান মার্বেল | বসার ঘরের দেওয়ালে ৫৫” এলইডি, সঙ্গে বোটের ডলবি ডিজিট্যাল স্পিকার | দুটো বড় এল শেপের সোফা, মাঝখানে দুটো রিক্লানার | ঘরের মাঝখানে নরম কার্পেটের উপর মেহগনি কাঠের রাউন্ড টি-টেবিল | দেওয়ালে দেওয়ালে দামী দামী পেন্টিং | বড় বড় জানলায় ঝুলছে ডিজাইনের পর্দা | টেবিলের সুদৃশ্য শো-পিস ঘরের সৌন্দর্য অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে | ইতস্ততঃ ছড়িয়ে রয়েছে রকমারি শো-পিস | পুরো ফ্ল্যাটেকে ঠান্ডা রাখার জন্য সেন্ট্রালাইজ এসির ব্যবস্থা রয়েছে | ইন্দ্র বরাবরের মতই নির্বিকার | অরণ্য ইন্দ্রের কানে কানে বলল, শালা লাইফ হো তো অ্যায়সা |

একটা‌ সোফায় বসে ইন্দ্র বলল এবার আপনার সমস্যাটা বললে ভালো হয়….
এক মিনিট | শান্তি অতিথিদের জন্য একটু শরবত নিয়ে এসো | আপনার সিগারেট চলে ? বলে একটা প্যাকেট খুলে এগিয়ে ধরল |
ইন্দ্র একটা কিং সাইজ তুলে নিল ! তারপর বলল, বলুন আপনার সমস্যাটা কি ?
দেখুন আমার ওয়াইফ অনামিকা আমার উপর রাগ করে আজ দুপুরে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে | আমি তো বুঝতেই পারছি না ও কিভাবে আমার সঙ্গে এমনটা করতে পারে ? জানেন আমাদের একটা ছ’বছরের ছোট্ট মেয়ে আছে |
হঠাৎ আপনার স্ত্রী আপনার উপর রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন কেন ? আপনাদের মধ্যে এমন কি ঝামেলা হয়েছিল ?
বুঝতেই তো পারছেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে লড়াই ঝগড়া কোন বাড়িতেই না হয় ! তার মানে তো এমনটা নয় যে একেবারে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে ! বাড়ি ছেড়ে একটা ট্রলি নিয়ে ক্যাবে উঠে সোজা এয়ারপোর্ট, তারপর সেখান থেকে ফ্লাইটে চেপে মুম্বই চলে গেছেন |
আপনি কি করে জানলেন উনি মুম্বইয়ের ফ্লাইটে উঠেছেন ?
আমি এয়ারপোর্টে কাউন্টারে খোঁজ নিয়েছিলাম | একজন কাউন্টার গার্ল আমার উদভ্রান্ত চেহারা দেখে আমায় অনামিকার খবরটা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন, সেখান থেকেই জানতে পারি |
দেখুন কিছু মনে করবেন না, এমন কি সমস্যা হল যে আপনাকে লুকিয়ে আপনার স্ত্রী একেবারে মুম্বই চলে গেলেন ? ওনার বাবার বাড়ি কি মুম্বই ? তাছাড়া আর একটা ব্যপার আছে প্লেনে তো আর ইনস্ট্যান্ট টিকিট পাওয়া যায় না …. যে ঝগড়া হল আর চলে গেল !
দেখুন আমার স্ত্রীর সঙ্গে ওর বাপের বাড়ির সম্পর্ক তেমন নেই বললেই চলে | আমিই রাখতে দিইনি |বর্ধমানের এক প্রত্যন্ত গ্রামে ওর বাপের বাড়ি, একেবারে লো মিডল ক্লাস ফ্যামিলি | ওদের সঙ্গে আমাদের খাপ খায় বলুন ! তাই বিয়ের পর ওকে আর ওখানে যেতে দিই নি | আর ঝগড়াটা আজ হয়নি, বেশ কয়েকদিন আগে হয়েছিল, তখন থেকেই আমাদের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই চলছিল |
আচ্ছা, আপনাদের বিয়েটা কি ভাবে হয় ?
একটা বিয়েবাড়িতে আমার মায়ের অনামিকাকে দেখে ভীষণ পছন্দ হয় | আমি তখন সদ্য সদ্য ব্যবসা শুরু করেছি | মা জোর করায় গ্রামে গিয়ে পঁচিশ বছরের অপূর্ব সুন্দরী অনামিকাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই | আর অপেক্ষা করি নি মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই বিয়েটা সেরে ফেলে ওকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসি |
তখন আপনারা কোথায় থাকতেন ?
আমরা তখন বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের কাছে একটা ফ্ল্যাটে ভাড়া হিসেবে থাকতাম |
আমরা মানে ?
আমি, মা আর অনামিকা | আমার বিয়ের বছর সাতেক পরে মা মারা যান | মোম তখন একবছরের |দেখুন পুলিশ আর গোয়েন্দার কাছে কিন্তু কোন কথা লুকোতে নেই ! আপনি সত্যি করে বলুন, আপনাদের মধ্যে কি এমন ঝামেলা হল যে উনি ছোট্ট মেয়েটার কথাও না ভেবে সোজা মুম্বই পাড়ি দিলেন ?
সত্যি বলতে কি আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না | বেশ কয়েকদিন আগে শপিং যাওয়ার কথা বলেছিল, আমার নতুন ক্রেডিট কার্ডটা চাইছিল আমি আপত্তি করেছিলাম | আসলে কি বলুন তো এক একটা ডিজাইনার ড্রেসগুলোর এত দাম হয়না, কিনতে গায়ে লাগে ! তাই আপত্তি করেছিলাম | হয়ত সেই জন্যই ও আমায় ছেড়ে…. দেখুন চাইলে আমি পুলিশে যেতেই পারি কিন্তু বুঝতেই পারছেন এটা করলে বিজনেস ওয়ার্ল্ডে কি আমার ভীষণ বদনাম হবে ! সোসাইটিতে আমার একটা রেসপেক্ট আছে, সেটাতেও এফেক্ট পড়বে | পুলিশি ঝামেলায় আমি মেতে চাই না, আমি শুধু আমার স্ত্রী অনামিকার খোঁজটা এনে দিন…. বিশ্বাস করুন আমি ওকে ভীষণ ভালোবাসি | আমি ওকে ছাড়া বাঁচব না ! অন্ততঃ আমার সন্তান মোমের কথা ভেবে আপনি প্লিজ অনামিকাকে খুঁজে বার করুন |আপনার ওকে কিছু বলার দরকার নেই | আপনি অনামিকাকে খুঁজে পেলে আমায় শুধু খবরটা জানাবেন, আমি ওর হাতে পায়ে ধরে ওকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনব | আর কখনো ওর শপিংয়ে বাঁধা দেব না |
আপনার মেয়ের সঙ্গে কি একবার কথা বলা যাবে ?
দেখুন আমার মেয়ে তো খুবই ছোট | আমি তাই ওকে এই ব্যাপারে ওকে ইনভলব করতে চাই না | আমি ওকে বলেছি আঙ্কেলের শরীর খারাপ, তাই আঙ্কেলকে দেখতে মাম্মা মামাবাড়ি গেছে |
আপাতত যেটুকু তথ্য পেলাম ঠিক আছে | এটা দিয়েই আমি কাজ শুরু করছি | কিন্তু পরিস্থিতি সিরিয়াস হলে আমাকে হয়ত আপনার মেয়ের সঙ্গেও কথা বলতে হতে পারে |
দেখুন আমার মনে হয়, অনামিকা নিছক রাগের বশেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে | আপনি শুধু খোঁজ এনে দিন ও মুম্বইয়ের কোথায় আছে…. আমি ঠিক ওকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনব | ও যে মোমকে ভীষণ ভালোবাসে |
আচ্ছা ! কিন্তু তার জন্য তো আমাকে মুম্বই যেতে হবে !
আপনি রাজী হলে অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল আমার ম্যানেজারকে টিকিট আর হোটেলের বন্দোবস্ত করতে বলে দেবো | অরণ্যর খরচখরচাও আমার | ভাগ্যিস ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, ওর সঙ্গে আলাপ না হলে এই বিপদের সময় আপনাকে কোথায় পেতাম !
অনেক ধন্যবাদ | আপনি আপনার ম্যানেজারকে টিকিটের বন্দোবস্ত করতে বলে দিন |
~ ( চলবে )

©️ অনিন্দিতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here