#মুহূর্তে
পর্ব-১৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
শুভ্র সকাল। রোদ্দুরের প্রথম রশ্মি মুখে এসে লাগতেই মৃণা লাফিয়ে উঠে পড়ে। পাশের থেকে ফোন বের করে সময় দেখে নেয়। সকাল আটটা বাজে। তাদের সকাল নয়টার মাঝে বাসস্টেশনে থাকার কথা। মৃণার মা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি পর্দা ঠিক করতে করতে বললেন, “তোর না আজ রূপার গ্রামে যাওয়ার কথা? রূপা কল দিয়েছিলো বলেছে জলদি তৈরি হয়ে নিতে।”
মৃণা বিরক্তির স্বরে বলল, “তোমাকে তো বলেছিলাম সকাল সাতটায় উঠাতে।”
“আমাকে বলেছিস? কবে?”
“গতকাল রাতেই।”
“তাহলে ভুলে গেছি। আজকাল কেমন যেন সব ভুলে যাচ্ছি। বয়স হচ্ছে তো।”
“উফফ মা তুমিও না। আমার তো দেরি হয়ে গেল তাই না?”
মৃণা উঠে জলদি করে নিজের জামা-কাপড় বের করে দিলো। বাথরুমে ব্রাশ করার জন্য যাবে আর তার মা বলল, “তোর ঘুরাঘুরির জন্য তোর বাবা দুইহাজার টাকা দিয়েছে। টেবিলের উপর রাখলাম।”
“দুইহাজার টাকা তো রাস্তা ভাড়া এবং খাওয়াতেই শেষ হবে। উনাদের বাসায় গেলে কিছু নিয়ে যাওয়া লাগবে না?”
“এই মাসে টান আছে অনেক। আমার হাস্পাতালে যাওয়া লাগলো আর… ” মৃণা তার মা’য়ের কথা কেটে বলল, “মা আপাতত দেরি হয়ে গেছে। আমি রূপার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে নিব।”
“আচ্ছা তাহলে আমি তোর জন্য নাস্তা দিচ্ছি।”
“নাস্তা লাগবে না। এখনই বের হতে হবে। তুমি নিজের আর আব্বুর খেয়াল রেখ এই কয়দিন।”
মা রুম থেকে বের হওয়ার পর মৃণা গভীর নিশ্বাস ফেলে। তার জান কলিজায় আটকে ছিলো। মা’য়ের কাছে এত বড় মিথ্যা কথা সে আর কখনো বলে নি। সে রূপার সাথে তার গ্রামের বাড়িতে না, সাজেক যাচ্ছে। ধ্রুব তাদের আমন্ত্রণ করেছে। প্রথমে তার বিষয়টা অকপটে লাগলেও প্রিয়া, তার স্বামী, পলাশ এবং ধ্রুবর আরও বন্ধুরা আসবে শুনে বিষয়টা এত খারাপ দেখাল না। আর সবচেয়ে বড় কথা তীর্থ আসছে। তীর্থের সাথে কোনো সময়ই কাটাতে পারে নি সে। কাজের থেকে মনই সরে না তীর্থের। হয়তো এইবার ঘুরতে গেলে তার সাথে একটু কথা বলবে তীর্থ। মনে মনে এই প্রার্থনা করতে থাকে মৃণা।
তীর্থ দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির সামনে। তাদের যাওয়ার কথা সাজেকে। ধ্রুব এবং তাহিরার বিয়ে আগামী মাসে। তাই ধ্রুব চায় এর পূর্বে তার কলেজ এবং ভার্সিটির বন্ধুরা একটু ঘুরে আসবে তারা। প্রথমে না করলেও ধ্রুবর জোর দেখে সে কিছুই বলতে পারলো না। কিন্তু এত বড় মাইক্রো কার দেখে সে বুঝতে পারছে না ঠিক কয়জন যাবে। কারণ লিমন সোজা চট্টগ্রাম থেকে আসবে দুইদিন পর। তীর্থ গাড়িতে হেলান দিয়ে মোবাইল চালাচ্ছিল এমন সময় সে এক মেয়েলী কন্ঠ শুনে, “হাই।”
সে চোখ তুলে তাকাতেই দেখতে পায় মৃণা, রূপা এবং প্রিয়াকে। সাথে প্রিয়ার স্বামীও রয়েছে। তাদের দেখেই কপাল কুঁচকে যায় তীর্থের। এরা এখানে কী করছে?
সাজেকে না কেবল তাদের বন্ধুদের যাওয়ার কথা?
রূপা আবারও উৎসুকভাবে জিজ্ঞেস করে, “কেমন আছেন?”
“ভালো।” গম্ভীর গলায় উওর দেয় তীর্থ। রূপার পর সে একে একে প্রিয়া ও মৃণাকে দেখে। হঠাৎ করেই তার মনে হলো একরাশ বিরক্তি তার চারপাশের হাওয়ায় মিশে গেছে।
এতোক্ষণে ধ্রুব এসে হাজির। তার হাতে কিছু কোকের বোতল এবং চিপ্সের প্যাকেট। সে মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে, “যাক তোমরা এসে পড়েছ। এত দেরি হলো যে?”
“এই মৃণা দেরি করেছে।” রূপা কথাটা বলার সাথে সাথেই মৃণা নিজের পক্ষ রাখে, “আমার এলার্ম বাজে নি তাই ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে।”
“আরে কোনো সমস্যা নেই। গাড়িতে উঠে বসো।”
তীর্থ কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় ধ্রুবর দিকে। সবার সামনেই প্রশ্ন করে, “সাজেকে না কেবল আমরা যেতাম? ওরা এখানে কী করে?”
এমন প্রশ্ন সমস্যা মনে করায় সবাই একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। ধ্রুব ভাবেনি তীর্থ এমন ভাবে সবার সামনে প্রশ্নটা করবে। সে একটু জোর করে হেসে বলল, “আমি ডেকেছি। আয় তোর সাথে একটু কথা আছে।”
ধ্রুব তীর্থকে একপাশে নিয়ে যেয়ে বলে, “সবার সামনে এভাবে কেউ বলে?”
“তুইও তো ডেকেছিস কেন?”
“এমনিতেই ঘুরাঘুরি করার জন্য।”
“তোমার ঘুরাঘুরির আইডিয়া সম্পর্কে তাহিরা জানে? তুই ওকে নিয়ে আসলি না অথচ অন্য মেয়েরা আমাদের সাথে যাবে?”
“ভাই নেগেটিভ ভাবিস কেন? প্রিয়াও তো এসেছে। প্রিয়ার ভাই, স্বামী সবাই এইখানে। প্রিয়ার বান্ধবী হিসেবে এখানে এসেছে ওরা।”
“তোর এইসব কাহিনী জানলে আমি আসতামই না।” তীর্থ বিরক্তি নিয়ে আবার গাড়ির সামনে যায়। রূপা ও মৃণাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমাদের পরিবার জানে যে তোমরা আমাদের সাথে সাজেক যাচ্ছ?”
মৃণা ও রূপা একে অপরের দিকে তাকায়। মৃণা তো তীর্থের কথার ধরণেই ভয় পেয়ে যায়। কিন্তু রূপা আত্নবিশ্বাসের সাথে মিথ্যা কথাটা বলে, “জানে, জানবে না কেন? আমরা কি না বলে আসব?”
তীর্থ সরু চোখে একবার দুইজনের দিকে তাকিয়ে গাড়িতে উঠে বসে।
তীর্থ বসে ছিলো ড্রাইভারের পাশের সিটে। মৃণা ঠিক তার পিছনে বসে আছে। গাড়ির পাশের ছোট আয়নাটিতে বারবার দেখে যাচ্ছে তীর্থকে। তীর্থকে তার ভীষণ আজব লাগে। গত পনেরোদিন ধরে মৃণা তীর্থের অফিসে যাচ্ছে। তার এসাইনমেন্টের জন্য ধ্রুবর সাহায্য নিচ্ছে, কারখানায় যেয়ে কাজের ধরণ দেখে আসছে অথচ এই পনেরো দিনের মাঝে তীর্থ একটিবার কথা বলে নি তার সাথে। সারাক্ষণ কাজ ছাড়া কিছুই বুঝে না তীর্থ। সে কথা বলার চেষ্টা করলেও তীর্থ তার দিকে একটিবারের জন্য তাকায়ও না। এই কারণে তার মেজাজও খারাপ হয় ভীষণ। এমন কেউ করে? কিন্তু তার মনে হয় তীর্থের এই স্বভাবটার প্রতিই আরও আকর্ষিত হয় মৃণা।
যেতে যেতে রাত হয় তাদের। খাগড়াছড়ি থেকে নামার পর একটি রিসোর্টে কিছু সময় আরাম করেই তারা সাজেকের জন্য রওনা দেয়। সাজেকে তাদের দুইদিন থাকার কথা। প্রথম রাতে এসেই সবাই ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। রূপা তো রুমে ঢুকতেই না খেয়ে গা ছড়িয়ে ঘুমের রাজ্যে চলে যায়। কিন্তু মৃণা এমন করে না। এসে সবার আগে সে লম্বা শাওয়ার নেয়। তারপর রুমে বসে ফোনে মা’য়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে নেয়। তারপর বের হয় একটু আশেপাশে ঘুরে দেখার জন্য। ধ্রুবকে আজ বলতে শুনেছে সে এই রিসোর্টে লম্বা এক ব্যালকনি আছে। সেখান থেকে মেঘের বুক থেকে সূর্য উদয় হয়। দৃশ্যটা না’কি ভয়ানক সুন্দর। সে সিদ্ধান্ত নিলো। একটিবার হলেও দৃশ্যটা দেখবে সে।
সে আরও শুনেছে এই ব্যালকনি থেকে সাজেকের সৌন্দর্যটাও বেশ ভালো দেখায়। চারপাশে দুরন্ত সবুজ এবং মেঘে ঢাকা আকাশ।
মৃণা ব্যালকনিতে যেয়ে দেখে সেখানে বাতি জ্বালানো। ব্যালকনির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে তীর্থ। তাকে দেখেই মৃণার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। যেখানে তীর্থ দাঁড়ানো সেখানে এক প্রকার দৌড়ে যায় সে তার। তীর্থের পাশে দাঁড়িয়ে বলে, “এত রাতে চা খাচ্ছেন, ঘুম হবে না তো। ”
হঠাৎ কারও কন্ঠ শুনে চমকে উঠে তীর্থ। মৃণাকে দেখে তার চোখে-মুখে ছেয়ে পরে একরাশ বিরক্তি। সে আবারও সামনে তাকিয়ে শীতল কন্ঠে বলে, “রাতে চা না খেলে আমার ঘুম আসেনা। ছোটবেলার অভ্যাস।”
তীর্থের উত্তর পেয়ে মৃণার উৎসুকতা আরও বেড়ে গেল। সে কথা আরও বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বলল, “ওহ আপনিও কী রাতে সাজেকের সৌন্দর্য দেখতে এসেছেন? রাতেও কি সুন্দর দেখায় তাই না? আমার তো মন ভরে গেল।”
তীর্থ কোন উত্তর দিল না। আয়েশে আরেক চুমুক নিলো চায়ের। মৃণা একটু হতাশ হয়। জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি কোন কারনে আমার থেকে রাগ?”
“তোমাকে তো আমি চিনি না রাগ করবো কেন?”
উত্তরটা বোধহয় ভাললাগেনা মৃণার। কিন্তু সে কিছু বলে না। কথা ঘুরানোর চেষ্টা করে কেবল, “ধ্রুব ভাইয়া বলেছে আপনার স্ট্রাগলের কথা শুনে ভালো লাগলো। আপনি খুব কষ্ট করে এই পজিশনে এসেছেন। যা সবাই পারেনা।”
এবারও তীর্থ কোন উত্তর দেয় না। মৃণা একটু কেশে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা ধ্রুব ভাইয়া বলেছিল আমার চেহারা না’কি আপনার একজন পরিচিত মানুষের সাথে মিলে? ব্যাপারটা কি সত্যি?”
একথা শুনে মৃণার দিকে তাকায় তীর্থ। ধ্রুব তাকেও বলেছিল ব্যাপারটা। মৃণার চেহারা না’কি কবিতার সাথে মিলে। কথাটা তোর মাথায় ছিলো না। আজ শোনার পর তীর্থ আগ্রহ নিয়ে তাকালো মৃণার দিকে। কথাটা কিছুটা সত্য। কিন্তু সম্পূর্ণ নয়। কবিতার সাথে মৃণার চেহারার কিছুটা মিল রয়েছে। মৃণার চেহেরার গঠন কবিতার থেকে কিছুটা সুন্দর কিন্তু সে চোখের মায়া এবং হাসিতে মন ভালো করার জাদুটা নেই। কিন্তু মৃণা কিছুটা তেমন দেখা যায় যেমনটা সে প্রথমবার কবিতাকে দেখেছিলো। কিন্তু তার মৃণার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা হলো না। সে চোখ ফিরিয়ে নিলো।
মৃণার বুকের ভিতর খুশির ঢেউ উথাল-পাতাল খেতে লাগলো। তীর্থের দৃষ্টি তার ভেতরটা কেমন শান্তিতে ভরিয়ে দিলো। তার গালদুটো লজ্জায় ভারী মনে হচ্ছে। কিন্তু যখন তীর্থ বলল, “ধ্রুব তোমাকে যার কথা বলেছে তুমি দেখতে তার মতো মিষ্টি না।” তখনই মনটা খারাপ হয়ে গেল মৃণার। অপমানে মুখ থমথমে হয়ে এলো। আজ পর্যন্ত কেউ তাকে এমন কথা বলে নি। কিশোরী বয়স থেকে ছেলেরা তার আগে পিছনে ঘুরে। আজ পর্যন্ত কেউ তার সৌন্দর্যের উপর প্রশ্ন তুলে নি। লম্বা, চেহারা, শারীরিক গঠন সবকিছু নিয়েই প্রশংসা শুনেছে সে। অথচ যাকে তার ভালো লাগে তার মুখ থেকেই এমন কথা শুনে তার অহং এ আঘাত পড়ে। তবুও সে কিছু বলে না। তাকিয়ে রয় আঁধারে ঢাকা সাজেকের সৌন্দর্যের দিকে।
কিছু সময় কাটে, তীর্থ তার চা শেষ করে যেতে নিলে একবার থেকে যায়। তারপর মৃণার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি না’কি কবিতা লিখতে জানো?”
উৎসুক হয়ে মৃণা তার দিকে তাকায় এবং বলে, “হ্যাঁ পারি, শুনবেন?”
“এখন না। তুমি একটু কষ্ট করে আমাকে একটি প্রেমের কবিতা লিখে দিবে? তুমি চাইলে এর পরিবর্তে আমি তোমাকে আমার পক্ষ থেকে ইন্টারভিউ দিতে পারি তোমার এসাইনমেন্টের এর জন্য।”
“অবশ্যই।” আগ্রহ নিয়ে বলল মৃণা। সে তীর্থর সাথে সময় কাটাতে পারবে এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে?”
তীর্থ চলে গেল কিন্তু মৃণা মধ্যরাত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইলো সে ব্যালকনিতে। আঁধারে ঢাকা মেঘের রাজ্যটা দেখল। সে আজ অনেক খুশি, তার ইচ্ছা করছিলো এই মেঘের রাজ্যে পক্ষীর মতো পাখা মেলে উড়ে বেড়াতে।
পরের দিন সকালে হেলিপ্যাডে যেয়ে সূর্যোদয় দেখার কথা ছিলো। কিন্তু ঘুম থেকে উঠতে সবার দেরি হয়ে গেল। হেলিপ্যাড যেয়েও সূর্যোদয় দেখা গেল না, তবে অসম্ভব সুন্দর মেঘেদের খেলা মন মোহে নিলো সবার। সকালেও মৃণা তীর্থের সাথে কথা বলতে চাইল, কিন্তু তার সাথে কোন কথাই বলল না। সারাদিন মৃণার একাই কাটে। রূপা ব্যস্ত ছিলো ধ্রুবর সাথে এবং প্রিয়া তো তার স্বামীর সাথে আলাদা ঘোরাঘুরি করতেই ব্যস্ত। এর মধ্যে যদিও পলাশ সাথে কথা বলার অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু তার সাথে কথা বলার কোন ইচ্ছাই মৃণার ছিল না।
রাতে খাবার খেয়ে ঘৃণা এবং রূপা রুমে এসে পড়ে। যদিও তারা আরও পরে আসতো। কিন্তু পলাশ তাদের জলদি পাঠিয়ে দিলো। রুপা নাকি দেখেছিল রতনের হাতে কতগুলো বিয়ারের বোতল। রুমে এসে রুপা কতক্ষণ তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে গল্পগুজব করল। ফোন রাখার পর পরই মৃণা বলে উঠে, “তুই যা করছিস তা কী ঠিক?”
“কী করছি?” রূপা অবুঝের মতো জিজ্ঞেস করল।
“এই’যে তোর বয়ফ্রেন্ড থাকা সত্ত্বেও ধ্রুবর সাথে মিলামেশা করছিস। সারাদিন তো ওর ওর গা ঘেঁষেই বসে ছিলি।”
তাচ্ছিল্য হাসলে রুপা, “মানে তুই আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলছিস? সো মেডাম আপনি আমাকে এটা বলেন আপনার বাগদত্তা থাকা সত্ত্বেও আপনি যে তীর্থের পিছনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এইটা কোন চরিত্রবানের কাজ? তোকে জানিয়ে দেই ধ্রুব আমার তুষার সম্পর্কে সব জানে এবং তুষারও জানে ধ্রুব আমার ভালো বন্ধু। ওর এতে কোনো আপত্তি নেই।”
“দেখ রূপা আমি তোর মতো তীর্থের সাথে ঘেঁষে বসে থাকি না। ঠিকাছে আমি তাকে পছন্দ করি, হয়তো ভালোও বাসি কিন্তু তোর মতো কান্ড করি না।”
“কারণ তুমি ভালো সেজে নাড়ু খেতে চাও। আর আমি ভালো সাজার মুখোশ মুখে পরে থাকে না। একটা কথা বল, তুই একজন অচেনা মানুষকে কীভাবে পছন্দ করলি? তাও এক মুহুর্তেই? আজ পর্যন্ত তুই তার এমন কোনো কোয়ালিটিও দেখিস নি যা তোকে তীর্থের প্রেমে পড়তে বাধ্য করে। ও না আছে, সে দেখতে সুন্দর এবং তার কাছে টাকা আছে।”
“আজেবাজে বকবি না রূপা।”
“আজেবাজে বকছি না। সত্যি বলছি। তুই প্রথম দেখাতেই তার প্রতি আকর্ষণবোধ করেছিস কারণ তোর ফিয়োন্সে দেখতে কোনোকালেই তোর মন মতো ছিলো না। আর দ্বিতীয় কারণ হলো তার টাকা, ছোটবেলা থেকেই তোর বিলাসবহুল জীবনের শখ অথচ তোর বাবার কখনো সে সামর্থ্য ছিলো না। এরপর তোর রাগ উঠে তখন যখন তোর জন্য এমন এক ছেলে বাছাই করে যার অর্থনৈতিক অবস্থাও তোদের মতো। সে-ও মধ্যবিত্ত। এটাতে তোর দোষ নেই। মানুষের স্বভাবই এমন। যার যে জিনিস থাকে না, সে জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণবোধ বেশি থাকে। যেমন আমাকে দেখ, তুষার আমাকে অনেক ভালোবাসার তা ঠিক কিন্তু আমাকে সময় দিতে পারে না। আমার যতটুকু সময় দরকার তা ওর কাজের জন্য হয় না। তাই আমি সে সময়টা অন্যকারো কাছ থেকে আদায় করার চেষ্টা করি। দিস ইজ হিউম্যান নেচার বেবি, আমরা মানুষরা কখনোই সন্তুষ্ট না। আমরা যা পাই তাই কম মনে হয়। আর যার কমতি থাকে তা অন্যকোথাও থেকে আদায় করার চেষ্টা করি।”
মৃণার রাগে শরীর কাঁপছিলো। সে তার ওড়না নিয়ে উঠে চলে গেল রুম থেকে। রূপা নিজেকে ভাবেটা কী? তার মুখে যা আসবে তাই বলবে না’কি? রূপার মতে সে লোভী? তীর্থের চেহেরা এবং টাকা দেখে তার পিছনে ঘুরছে সে? তাকে এমনটা বলার সাহস কোথায় পেল রূপা?
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সে যেয়ে ব্যালকনিতে যেয়ে দাঁড়ায়। গভীর নিশ্বাস ফেলে সে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে কিন্তু তার রাগ কমে না। হঠাৎ সে কিছু শব্দ পায়। বুকের ভেতর কামড়ে উঠে তার। হঠাৎ এই শব্দ কোথা থেকে আসছে? সে পাশে তাকিয়ে দেখে ব্যালকনির লাইটের আলোয় ভেসে আসছে এক লম্বা ছায়া। বুকের ভেতর কু ডাকছে তার। হঠাৎ ভয় করছে। এতরাতে বাহিরে সে একা। তার সামনে এক ছায়ামূর্তি। ভয়ে জান বেরিয়ে যায় যেন মৃণার। ভয়ে ভয়ে সে উঁকি মেরে দেখে তার ছায়ামূর্তিটা আর কেউ নয় তীর্থ। তাকে একটু অস্বাভাবিক লাগছে। হেলেদুলে হাঁটছে সে। চাবিটা দিয়ে দরজার লকটাও খুলতে পারছে না সে। মৃণা দৌড়ে যেয়ে তীর্থকে ধরে। বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “আপনার কী হলো?”
তীর্থ বুজো বুজো চোখে তাকায় মৃণার দিকে। চোখ দুটো বড় বড় করে বলে, “আরে কবিতা তুমি এখানে কবে এলে?”
তীর্থ কথা বলতেই মদের গন্ধ পেল মৃণা। মুখ ফিরিয়ে নেয় সে। সে সাথে মনে মনে এটাও ভাবল, “কবিতা? কবিতা কী তীর্থের প্রাক্তন? সে কী আমাকে কবিতা ভাবছে?” মৃণা তীর্থের ভুল ভাঙে না। সে উল্টো জিজ্ঞেস করে, “এক মিনিট আপনি কী মদ খেয়েছেন?”
মুখের উপর হাত রাখে তীর্থ। বাচ্চাদের মত মুখ করে বলে, “প্লিজ রাগ করো না কবিতা, আমি ইচ্ছা করে খাই নি। ধ্রুব জোর করেছে আমায়।”
তীর্থ আবার দুই কান ধরে বলে, ” সরি।”
মৃণ হতবাক। তীর্থের এমন রূপ সে দেখতে পাবে কল্পনাও করেনি। তার হঠাৎ জানতে ইচ্ছা করছে কবিতা কেমন ছিল? কি স্থান ছিল তার তীর্থের জীবনে? যার কারণে তীর্থ সারা পৃথিবীর কাছে যেমন কঠিন হোক না কেন, কিন্তু কবিতার কাছে কত নরম! আর এমন মেয়েকে কেনইবা এত ভালোবাসে তীর্থ? যে মেয়ে তাকে একলা এভাবে ছেড়ে চলে গেছে। আচ্ছা তীর্থের ভালোবাসার গভীরতা কত হলে সে এই সাড়ে পাঁচ বছর ধরে এখনো কেবল ওই একটি মেয়েকে ভালোবাসে? হঠাৎ তার কবিতা নামক মেয়েটির সাথে দেখা করতে ইচ্ছা হলো। জানতে ইচ্ছা হলো, কবিতা কী দেখতে তার থেকেও বেশি মিষ্টি? তার থেকেও বেশি সুন্দর?
মৃণা তীর্থের হাত থেকে চাবি নিয়ে দরজা খুলে তীর্থকে ভিতর নিয়ে গেল। তাকে বিছানায় বসিয়ে বলল, “আপনি বসেন আমি আপনার জন্য পানি নিয়ে আসছি।”
মৃণা উঠতে নিলেই তীর্থ তার হাত ধরে নেয়। নিজে দাঁড়িয়ে মৃণা হাত ধরে তার গালে হাত রাখে। নেশাধরা গলায় বলে, “কবিতা তুমি কী আমার উপর রাগ করেছ?”
তীর্থের স্পর্শে কেঁপে উঠে মৃণা। সে মাথা নামিয়ে বলে, “না রাগ করি নি।”
তীর্থ হাত বুলাতে শুরু করে মৃণার গালে। আলতো সুরে জিজ্ঞেস করে, “তুমি এতটা মায়াবী কেন কবিতা?”
মৃণার এই মুহূর্ত যতটা ভালো লাগছিলো ততটাই বিরক্ত লাগছিলো তীর্থের মুখ থেকে ‘কবিতা’ নাম শুনতে।
তীর্থ মৃণার দিকে এগোল। তার ঠোঁটের কাছে নিজের ঠোঁটটা নিলো। তার প্রচন্ড মাথা ঘুরাচ্ছে। নেশা ধরেছে খুব। এই মুহূর্তে কবিতাকে কাছে পাওয়াটা এক স্বপ্নের মতো।
.
.
আধবোজা চোখে তীর্থ উঠে বসে। সে মাথায় হাত দিয়ে উঠে বসে। সকালের আলো কাঠের ঘরে প্রবেশ করছে। তীর্থ হেলান দিলো পিছনের দেয়ালে। তার মাথাটা ভারী হয়ে আছে। সম্ভবত গতকালের নেশায় এই অবস্থা। গতকাল সে কত মানা করলো অথচ ধ্রুব শুনেই না। জোর করে তাই মদ খাওয়াতে থাকে। আড়মোড়া ভেঙে সে সামনে তাকাতেই চমকে উঠে। মৃণা তার বাথরুম থেকে বের হচ্ছে। তার চুল ভেজা। সে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বের হচ্ছে বাথরুম থেকে। মৃণাকে তার রুমের ভেতর দেখে আকাশ ভেঙে পড়ে তীর্থের মাথায়। তার হঠাৎ মনে পড়ে সে নেশার ঘোরে মৃণাকে কবিতা ভেবে নিয়েছিলো। এমনকি তাকে কাছে টেনে চুমুও খেতে নেয়। তখনই তার মাথা ঘুরানি দিয়ে উঠে এবং এরপর তার কিছু মনে নেয়। এরপর তাদের মাঝে কি কিছু হয়েছে? কোনো অঘটন ঘটায় নি তো সে? ভাবতেই বুকের ভেতর কাঁপতে শুরু করে তীর্থের। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো।
হঠাৎ করেই ফোনের রিং বেজে উঠে। সে তার বিছানার পাশের সাইড বক্সের উপর ফোনটার দিকে তাকায়। ফোনের স্ক্রিনে নামটা দেখে বুক কেঁপে উঠে তীর্থের। এই হাল্কা শীতের মাঝেও তার ঘাম ছুটে যায়। সে কাঁপা-কাঁপা হাতে ফোনটা হাতে তুলে। এক ঢোক গিলে। ফোনের স্ক্রিনে কবিতার নাম লেখা।
#মুহূর্তে
পর্ব-২০
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
মৃণা তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছিল। তীর্থকে সজাগ দেখে থমকে যায়। গতরাতের কথা মনে পড়ে তার। তীর্থ তার হাত ধরে তাকে কাছে টেনে নেয়, তার গালে স্পর্শ করে, তার কাছে আসে। হয়তো গতকাল তীর্থ তাকে চুমুও খেত। একটি সুন্দর মুহূর্ত কাটতো দুইজনের মাঝে। কিন্তু এর পূর্বেই তীর্থ হেলে পড়ে যায় তার উপর। বেহুঁশ হয়ে যায়। মৃণা যেমন তেমন করে তীর্থকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তার পাশে বসে কিছুক্ষণ দেখতে থাকে তীর্থকে। তারপর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সারারাত কাটায়। সকালে মেঘের বুক থেকে উঁকি দেওয়া সূর্যের দর্শনও করে। এর মাঝেও অনেকবার সে তীর্থকে দেখে যায়। আচ্ছা তীর্থের কি তার এই যত্নের কথা মনে থাকবে?
তীর্থ এখন সজাগ হওয়ায় ভীষণ নিরাশ হয় মৃণা। সকাল সকাল যেয়ে সে তার ব্যাগ থেকে শাড়ি এবং কিছু সাজগোজের জিনিস নিয়ে এসেছিলো। রূপার সাথে রাগ করে সে এই রুমেই সব নিয়ে এলো। ভেবেছিলো সকাল সকাল এমনভাবে তীর্থের সামনে প্রস্তুত হবে যে বাকি সব মেয়েদের কথা তার মাথা থেকে চলে যাবে। তার সামনে কবিতা অথবা অন্যকোনো মেয়ের চিন্তাও আসবে না তীর্থের মাথায়। কিন্তু আফসোস তার সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। এর থেকে ভালো নিজের রুম থেকেই সেজে আসতো।
তীর্থের চোখেমুখে ভয়ের ছাপ। দূর থেকেই তার চোখেমুখে ভয়ে ছাপ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তীর্থ অশান্ত হয়ে দৌড়ে আসে তার কাছে। এক বাহুতে হাত রেখে অশান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে, “মৃণা… মৃণা আমি গত…গতকাল নেশায় ছিলাম। মাথা কাজ করছিলো না। তুমি বলোতো… বলো প্লিজ গতরাতে কোনো অঘটন ঘটে নি তো?”
“অঘটন!” অবাক হয়ে বলে মৃণা। তীর্থ ঠিক কি বুঝাতে চাইলো সে মোটেও বুঝে না।
তীর্থ আমতা-আমতা করে জিজ্ঞেস করে, “মানে আমি তোমার সাথে এমন কিছু করি নি তো যা করা উচিত হয় নি?”
“আপনি নেশায় আমাকে আপনার প্রাক্তন ভেবে অনেক কথা বলেছিলেন। তারপর… ” মৃণা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। সে লজ্জামাখা গলায় বলে, “কাছেও এসেছিলেন।”
“আমি কী তোমার সাথে কোনো জোর-জবরদস্তি করেছি?” আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করে তীর্থ। কাছে আসার কথা শুনে তার বুকের ভেতর ধুকপুক শুরু হয়।
মৃণা এতক্ষণে বুঝতে পারে তীর্থের ইশারা কোন দিকে। মানে কি তীর্থের মনে নেই যে সে মৃণার কাছে আসতেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো? তীর্থের চিন্তা ভেবে মৃণার নিজেরই লজ্জায় ডুবে যেতে মন চাইছে।
মৃণা দ্রুত মাথা নাড়িয়ে বলে, “না আপনি কোনোপ্রকার জোর করেন নি।”
তীর্থের জানে যেন জান এলো। সে তার চুলটা আঁকড়ে ধরে গভীর নিশ্বাস ফেলে। এতক্ষণে সে শান্তির নিশ্বাস ফেলল। বুকের বাম পাশে হাত রেখে বলল, “ভয়ে এখন আমার জান চলে যেত। কিন্তু তুমি এখানে কি করছ?”
মৃণা কিছু বলতে যাবে এর পূর্বেই আবারও ফোন বেজে উঠে তীর্থের। সে বলে, “একমিনিট।”
ফোনটা ধরে তীর্থ। ফোনের ওপাশ থেকে মিষ্টি কন্ঠ ভেসে এলো, “এতক্ষণ লাগে কল ধরতে। গতকাল থেকে তোমাকে পাচ্ছিনা, আমার তো ভয় লাগছিলো।”
“আমি ঠিক আছি, কবিতা। ভয় পাবার কিছু নেই।”
“তোমার কন্ঠ এমন শুনাচ্ছে কেন?”
তীর্থ আড়চোখে তাকায় মৃণার দিকে। সে বলল, “বিশেষ কিছু না। গতকাল ধ্রুব ওদের সাথে একটু পার্টি করেছিলাম। তাই একটু মাথা ব্যাথা।”
কবিতা শাসানি গলায় বলে, “ওয়েট, পার্টি করেছ মানে কী তোমরা মদ খেয়েছ? ধ্রুব ভাইয়া আবার তোমাকে জোর করিয়ে মদ খাইয়েছে তাই না? আমি প্রথমে ধ্রুব ভাইয়ার খবর নিব। তারপর তোমার। তুমি আমার মানা করা সত্ত্বেও কীভাবে… ” তীর্থ কবিতার কথা কেটে ছোট একটি মিথ্যা বলে, “আহা, বাবা এমন কিছু না এমনিতেই বারবিকিউ পার্টি করলাম।”
“এত টাকা খচর করে সাজেকে গিয়েছ তোমরা বারবিকিউ পার্টি করতে? আমাদের ছাদে কী ঠাডা পরসে?”
এইবার তীর্থ বিরক্ত হয়। সে বিরক্তির সুরে বলে, “তোমার কী সব কিছুতেই সমস্যা? একটা সাইড নেও তো। আচ্ছা শুনো, পরে কল দিচ্ছি তোমাকে। আপাতত রাখি।”
“এই দাঁড়াও, আগে বলো না কবে আসবে তুমি? খুব মনে পড়ছে তোমাকে।”
“এইখানে আসলাম একদিনও তো হলো না।”
“একদিন? একদিনের বেশি হলো আমাকে ছেড়ে গেল তুমি, জানো প্রায় তেত্রিশ ঘন্টা হলো আমার থেকে দূরে গিয়েছিলে তুমি।”
মুহূর্তে তীর্থের সব খারাপ লাগাটা হাওয়ার সাথে মিশে গেল। তার ঠোঁটের কোণে এঁকে এলো একগাল হাসি। সে বলল, “এতটা সময় গুনেছ তুমি?”
“তো কি? আগে তো তোমার প্রথম প্রেমিকা অর্থাৎ তোমার কাজের জন্য সারাদিন শেষে রাতে তোমার একটু দেখা পেতাম, ধ্রুব ভাইয়া তারও বারোটা বাজিয়ে দিলো। এই ধ্রুব ভাইয়া আমার ভাই থেকে বেশি সতিনগিরি করছে। তাহিরা আপুকে জানাতে হবে বুঝলে?” বলে কবিতায় নিজেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। সে আবারও বলে, “তোমার ছেলে দোষারোপ করলো যে তুমি ওর সাথে খেলার সময় পাও না কিন্তু ওর ধ্রুব মামার সাথে ঘুরতে গিয়েছ। বলেছে এই সাপ্তাহে আসার পর শুধু তার সাথে খেলা লাগবে।”
“আচ্ছা।”
“কী আচ্ছা? তাহলে আমার সাথে প্রেম করবে কখন? কী আনরোমেন্টিক বর বাছাই করলাম ভাই!”
“আমি তোমাকে একটুপর কল দিচ্ছি কবিতা।”
“আগে আই লাভ ইউ বলে শব্দ করে একটা চুমু দেও। তারপর ফোন কাটব।”
“বাচ্চামিটা কমাও। এখন দুইটা বাচ্চার মা তুমি।”
বলেই কল কেটে দেয় তীর্থ।
হঠাৎ এভাবে কল কেটে দেওয়ায় মনটা খারাপ হয়ে যায় কবিতার। সে ফোনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সময়ের সাথে সাথে সম্পর্ক কতটা পালটে যায়। একসময় যে বাচ্চামি দেখে তীর্থের ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে আসতো সে বাচ্চামি থেকেই এখন বিরক্ত লাগে তীর্থের।
কবিতা আফসোসের নিশ্বাস মিশিয়ে দেয় সকালের উষ্ণ হাওয়ায়। ফোনের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভাবে, তারপর একটা কল দেয় নিজের বাবাকে। কয়েকটা রিং বাজে, তারপর কলের ওপার থেকে ভেসে উঠে এক নারীর
কন্ঠ, “হ্যালো…”
কবিতা তার মা’য়ের কন্ঠ শুনে চমকে উঠে। তার বুকের ভেতর চিনচিন ব্যাথা শুরু হয়। কান্না আসে খুব, কিন্তু সে কাঁদে না। এক ঢোক গিলে। ফোনের ওপাশ থেকে আবারও প্রশ্ন আসে, “কে বলছেন?”
কবিতা ফোন কেটে দেয়। শক্ত হয়ে বসে রয় কিছুক্ষণ। পাঁচটা বছর কেটে গেল কিন্তু আজ পর্যন্ত সে তার মা এবং বড় ভাইকে ক্ষমা করতে পারে নি। এমন না যে তারা কবিতার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করেছে। কবিতার আজও মনে আছে সে পাঁচবছর আগের কথা, নিজের বুকের উপর পাথর রেখে সে তীর্থকে বলেছিলো সে অন্যকারো সাথে বিয়ে করছে। ফোন রাখার পর কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়ে। আবির ছিলো তার সাথে। তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাতে থাকে সে। সান্ত্বনা দেয়। এমন সময় আসে কবিতার বাবা। সে কবিতার হাত ধরে অনুরোধের সুরে বলে, “মা তুই পালিয়ে যা এইখান থেকে। আমি তো। এই ভেবে কবিরকে সব দায়িত্ব দিয়েছিলাম যে আমি দূরে থাকায় ও এই পরিবার সামলাবে। কিন্তু আমি কি জানতাম কবির এমন ছেলের সাথে তোর বিয়ে দিয়ে তোর জীবন নষ্ট করে দিবে।” কবিতার বাবা আবার আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, “শুন…শুন আবির তুই জলদি করে কবিতাকে নিয়ে এইখান থেকে চলে যা। প্রয়োজনে ঢাকা থেকে আসা ওই ছেলের খোঁজ নিবি। ওই ছেলে ভালো হলে নিজ দায়িত্বে ওকে বিয়ে করিয়ে দিবি। তোরা যা এইখান থেকে।”
কবিতা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল নিজের বাবার দিকে। এর আগে সে তার বাবাকে তার মা এবং বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে যেতে দেখে নি। এমনকি সেদিন তার আবির ভাইয়াও সেই প্রথম কবিরের বিরুদ্ধে গেল। বহু কষ্টে সে রিসোর্ট থেকে বের হয়। আবির ভাইয়ার বন্ধুরাও সাহায্য করে এতে। বাসে উঠে সবটা জানানো হয় তীর্থকে। সে খুশিতে আত্মহারা। মাঝ রাস্তায় দেখা হয় তাদের। আবির কবিতা এবং তীর্থকে নিয়ে দুইদিন এক বন্ধুর বাসায় লুকিয়ে থাকে। এর মাঝে আবির তীর্থকে বোঝার চেষ্টা করে এবং বন্ধুদের দিয়ে তার খোঁজ নেওয়ায়। দুইদিন পরেই তাদের বিয়ে দেওয়া হয়। বড় ভাইয়াকে জানানোর পর সে কবিতা এবং আবিরের চেহারাও দেখতে চায় না। তাদের ঘরে ঢুকতে দেওয়া তো দূরের কথা। আবিরেরও সেই ঘরে থাকার আর কোন ইচ্ছা ছিল না। তাদের সম্পত্তি ভাগ করা হয়। আবির তার সম্পত্তি বিক্রি করে বিদেশে চলে যায়।
অতীত ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কবিতা। সে কখনোই ভাবেনি যে মা এবং ভাইয়ের আদরের পুতুল ছিলো সে, তাদের সাথে পাঁচ বছর না কথা বলেও থাকতে পারবে। মানুষ বলে, সময়ের সাথে সাথে সকল আঘাত মিটে যায়। কথাটা ভুল। আপন মানুষদের আঘাত বেদনাদায়ক। মানুষ যত কাছের, আঘাত ততই গাঢ়।
.
.
মৃণা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তীর্থের দিকে। কবিতা? কবিতা তার প্রাক্তন না? তাহলে তার সাথে কথা বলছে কেন তীর্থ? এবং তাদের কথা এমন স্বাভাবিক কেন?
হঠাৎ করেই মৃণার মনের ভেতর কু ডাকতে শুরু করলো। সে খারাপ আভাস পাচ্ছে। তীর্থের কথা শেষে যখন সে মৃণার দিকে তাকে জিজ্ঞেস করল, “এখন উত্তরটা দেও। তুমি আমার রুমে কি করছ?”
মৃণা মাথা নামিয়ে নেয়। চিন্তিত দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকাতে থাকে। উত্তর দেয়, “আপনি নেশায় ছিলেন তাই নিয়ে এসেছিলাম।”
তীর্থের হঠাৎ করে চোখের সামনে ভেসে উঠে গত কিছু মুহূর্ত। তার মনে আছে সে মৃণার কাছে গিয়েছিলো কিন্তু এরপরের কিছুই সে মনে করতে পারে না। চিন্তিত হয়ে পড়ে সে। জিজ্ঞেস করে, “আমাদের মাঝে সত্যিই কিছু হয় নি তো? আমি নেশায় ছিলাম। ভুল কিছু করলে আমি ক্ষমা চাচ্ছি।”
“কবিতা আপনার কী হয়?” মৃণা প্রশ্ন করে তীর্থকে। তার চোখে হঠাৎ জল ভেসে উঠে। সে ভেবেছিল তীর্থের সাথে এখনো কবিতার মাঝে মধ্যে কথা হয়। এই কারণেই এখনো সে ভুলতে পারে নি কবিতাকে। কিন্তু তীর্থ যা উত্তর দিলো তার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। তীর্থ বলল, “কবিতা আমার ওয়াইফ।”
মৃণা চমকে তাকায় তীর্থের দিকে। তীর্থ যেন অবিশ্বাস্য একটি কথা শোনাল তাকে। এইটা কীভাবে সম্ভব? ধ্রুব না বলেছিলো কবিতা তাকে ছেড়ে গিয়েছে? তাহলে ধ্রুব মিথ্যা বলেছ? কিন্তু কেন? তার সাথে মিথ্যা বলে ধ্রুবর কি লাভ? কিছুই মাথায় ঢুকছে না মৃণার। সে খেয়াল করলো রাগে, জেদে শরীর কাঁপছে তার। কার উপর এই রাগ সে নিজেও বুঝতে পারছে না। তীর্থের উপর, না কবিতার উপর, ধ্রুবর উপর? না তার নিজের উপর? সে কেন এমন এক মানুষকে সে ভালোবেসে ফেলল যাকে সে চিনেও না?
মৃণা এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ায় না। দ্রুত বেরিয়ে যায় রুমটা থেকে।
মৃণার চোখে জল দেখে তীর্থের ভয় লেগে গেল। সে কী ভুল কিছু করেছে? তীর্থের ভয়ে জান বের হওয়ার মতো অবস্থা। সে যে করেই হোক মৃণার সামনে আর যাইতে চাইছে না। ব্যপারটা অস্বস্তির। তীর্থ জলদি করে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে তার ব্যাগ গুছাতে শুরু করে। আজই সে ঢাকায় যাবে। ভীষণ অশান্তি লাগছে তার। কবিতাকে একবার বুকের মাঝে ভরে নিতে হবে তার এই অশান্তি মেটানোর জন্য।
মৃণা দ্রুত যায় ধ্রুবকে খুঁজতে। তার কাছে কিছু প্রশ্নের উওর লাগবে তার। সে মিথ্যা বলে তাকে এই যন্ত্রণায় কেন ফালিয়েছে? ধ্রুবকে সে পায় নিজের রুমেই। রুপার সাথে বসে গল্প করছে সে। ধ্রুবকে দেখে সে হাওয়ার বেগে যেয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আর্তনাদ করে উঠে, “আপনি নিজেকে কী ভাবেন বলুন তো। আপনার সাহস কী করে হলো আমার ফিলিংস এর সাথে এভাবে খেলা করার?”
রুপা অবাক হয় মৃণার এমন ব্যবহার দেখে। সে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, “এভাবে কথা বলছিস কেন তুই? উনার সাথে এমন বেয়াদবি করছিস কেন?”
“আর উনি যা করেছে তার কি?”
“কি করেছে ?”
“তোর মনে আছে, উনি আমাদের বলেছিল তীর্থ একটি কবিতা নামক মেয়েকে ভালবাসত। যে তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করেছিল।”
“হ্যাঁ, আমার সামনেই তো বলেছে।”
“মিথ্যা বলেছ উনি। কবিতা তীর্থের বউ। আমার সামনে আজ কবিতার সাথে কথা বলেছে তীর্থ। উনাকে তুই জিজ্ঞেস কর উনি কেন আমাদের মিথ্যা বলল? উনার মিথ্যার কারণে আমি তীর্থের প্রতি নিজের ফিলিংস কখনো আটকানোর চেষ্টা করি নি। আমি যদি জানতাম সে বিবাহিত তাহলে কী নিজের মনের অনুভূতি বাড়তে দিতাম?”
রুপা অবাক হয়ে তাকায় ধ্রুবর দিকে, “মৃণা কী সত্যি বলছে? আমি আপনাকে তো প্রথমদিনই বলেছিলাম সম্ভবত মৃণা আপনার বন্ধুকে পছন্দ করে। তাও মিথ্যা কেন বললেন আপনি?”
ধ্রুব গভীর নিশ্বাস ফেলে তাকায় মৃণার দিকে। খুব স্বাভাবিকভাবে উওর দেয়, “দেখো আমি কথা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলতে চাই না। আমি জানতাম তীর্থকে তুমি পছন্দ করো এর কারণেই মিথ্যা বলেছি।”
“যা বলার পরিষ্কারভাবে বলুন।”
“দেখো তীর্থ নিজের সংসারে সুখী না। আমি এইটা জানি যে ও কবিতা এবং তার সন্তানদেরকে অনেক ভালোবাসে কিন্তু পারিবারিক অশান্তিতে ওর মানসিক চাপ পড়ছে তা আমি জানি। একদিকে কাজের এত চাপ, অন্যদিকে পারিবারিক ঝামেলা। ঘরে থাকলে এক মুহূর্তও শান্তিতে কাটাতে পারে না সে। আমার ওকে নিয়ে অনেক চিন্তা হচ্ছিলো তাই আমি অন্যদিকে যেন ওর মন বসে তাই তোমাকে….”
মৃণা এইবার চেঁচিয়ে উঠে, “আমি কী কোনো জিনিস যে আপনার বন্ধুর মন ভালো নেই তাই আমাকে তার মন ভোলানোর জন্য ধরিয়ে দিবেন?”
রুপা বলল, “আস্তে কথা বল, এইখানে আরও অনেক মানুষ আছে। সাধ সকালে এমন চিল্লাচিল্লি শুনলে মানুষ কি ভাববে?”
মৃণা ক্রোধিত দৃষ্টি নিয়ে তাকায় রুপার দিকে। তারপর রাগে হনহনিয়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে।
.
.
বাংলাদেশে যখন শুভ্র সকাল, আমেরিকায় রাত তখন। কথন বসে আছে ব্যালকনিতে। সামনে বসা তার ফ্লাটমেট প্রণয়। প্রণয়ের হাতে একটি কালো ডায়েরি। ডায়েরিটি কথনের। আজ আমেরিকায় শেষ দিন প্রণয়ের। প্রণয় এবং কথন পাঁচ বছর ধরে একসাথে থাকছে। একই হাস্পাতালে কাজ করছে। আগামীকাল প্রণয়ের বাংলাদেশের জন্য রওনা দেওয়ার কথা। প্রণয় যাওয়ার আগে শেষ উপহার চাইলো কথনের কাছে, তার ডায়েরিটি পড়তে চাইলো সে। এই পাঁচবছরে একটিবারও কথন সে ডায়েরিটি কাওকে পড়তে দেয় নি। তাই সে ডায়েরির ভেতরের লেখা পড়ার জন্য ভীষণ আগ্রহ হয় প্রণয়ের। প্রণয় ডায়েরি পরার মাঝে একটিবার তাকায় কথনের দিকে, “তুই আসলে মেয়েটার জন্য সম্পূর্ণ ডায়েরি লিখেছিস? আমার তো বিশ্বাস-ই হচ্ছে না। প্রথম পৃষ্ঠাগুলো পড়ে মনে হলো তুই কাওকে ভালোবাসতে পারিস না অথচ এখন…. ”
কথন প্রণয়ের কথা কেটে বলে, “যে মানুষ ভালোবাসায় পড়তে চায় না, তারাই গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলে। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি ঝোঁকটা যে বেশি থাকে এইকারণে।”
প্রণয় হেসে একবারের জন্য আকাশে তাকায়। তারপর বলে, “ভালোবাসা, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শব্দ অথচ অসুন্দর অনুভূতি দিয়ে যায়। তুমি ভালোবাসার মতো সুন্দর অনুভূতি অনুভব করবে অথচ সাথে কষ্ট অনুভব করতে চাইবে না। তা তো হয় না।”
চলবে….
[