মুহুর্তে পর্ব -২১+২২

#মুহূর্তে
পর্ব-২১
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

প্রণয় হেসে একবারের জন্য আকাশে তাকায়। তারপর বলে, “ভালোবাসা, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শব্দ অথচ অসুন্দর অনুভূতি দিয়ে যায়। তুমি ভালোবাসার মতো সুন্দর অনুভূতি অনুভব করবে অথচ সাথে কষ্ট অনুভব করতে চাইবে না। তা তো হয় না।”
কথন তার কফির মগে একটি চুমুক দিয়ে বলে, “ভালোবাসায় কষ্ট মানানসই, কিন্তু যে অপেক্ষার কোনো অন্ত নেই তা তো মানানসই নয়। যদি আমি ওকে পেতাম তাহলে কষ্টের কোনো আফসোস থাকতো না। কিন্তু আমি জানি, আমি ওকে কখনো পাব না। এইটাই তো আফসোসের ব্যাপার। না ওকে ভুলতে পারি, আর না ওকে পেতে পারি।”
প্রণয়ের মন খারাপ হয় কথনের এমন কথায়। সে ভালোমতোই জানে কথনের মনের ব্যাথা। সে-ও তার ভালোবাসার মানুষ থেকে দূরে এসেছে। কিন্তু সে জানে, ফিরে গেলেই তার ভালোবাসার মানুষটিকে পাবে সে। কিন্তু কথনের পক্ষে তা সম্ভব নয়। প্রণয়ের মাথায় হঠাৎ বুদ্ধি এলো। সে ডাইরির এক পাতা খুলে কিছু বাক্য পড়ে শুনালো কথনকে, “আমার হৃদয়ের স্পন্দন বন্ধ হয়ে আসে। কবিতা আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো গাঢ় লাল রঙের শাড়ি পড়ে। আমার দমটা বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। এতটা সুন্দর লাগছিলো তাকে। এমন না যে কবিতা আমার সামনে আগে লাল রঙ পড়ে নি অথবা আগে শাড়ি পরেনি। পরেছে। আমি মুগ্ধ হয়েছি কিন্তু কখনও এমন মনে হয়নি যে আমার সকল স্বপ্ন জুড়ে একটি মেয়ে রাজত্ব করতে পারে।”

কথন হাসে। প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ভাই তুই কি আমার মন ভালো করার জন্য এই মুহূর্ত মনে করালি, না আঘাত পূণরায় অনুভব করার জন্য।”
” কথন শুন, ভালোবাসায় অনেক বাঁধা আসে। এর মানে এই নয় যে আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষকে ভুলে যাব। আমি যাকে ভালোবাসি তার জন্যও আমার অনেক সাধনা করতে হয়েছে। দুইদিন পর তাকে আমি দেখতে পারব, তোকে আমি বুঝাতে পারবোনা আমার কতটা ভালো লাগছে। আল্লাহর কাছে দোয়া কর, ইনশাল্লাহ তুইও একদিন ভালবাসার মানুষকে পেয়ে যাবি।”
“আমারটা সম্ভব না’রে। সম্ভব না। সে এখন অন্যকারও। আর আমি চাই না তার জীবনে কোন কষ্ট হোক। আমি তাকে পাওয়ার জন্য না, তার খুশির জন্য দোয়া করব। ও যেন খুশি থাকুক, ওর ভালবাসার মানুষটার সাথে।”
“অন্যকাওকে পাবি যাকে তুই ‘আরও ভালোবাসতে পারিস।”
“তুই থাক, আমি আরেক কাপ কফি বানিয়ে আনি।”

কথন উঠে যায় কফি বানানোর উদ্দেশ্যে। কিচেনে যেয়ে কফি মেকার অন করে তার মানিব্যাগ থেকে একটি ছবি বের করে। ছবিটি তার ও কবিতার। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বাহারে সে এবং কবিতা শুভ্র রঙে লেপ্টে ছিলো। দুইজন তাকিয়ে ছিলো একে অপরের দিকে। সে প্রথম তাদের চোখে চোখ রেখে কিছু শুভ দৃষ্টি বন্ধন করা। সে দিনটি ভোলার মতো নয়। সে দৃষ্টি ভোলার মতো নয়। এমন মায়াভরা চোখে কোনো হৃদয়হীন ব্যক্তির ভোলার সাধ্য থাকে। কথনের মাঝেমধ্যে আফসোস হয় সে হৃদয়হীনা কেন নয়?

ছবিটা দেখতে দেখতেই কথা ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠল। সে একটি দেয়ালে হেলান দিয়ে ছবিটির পিছনে লেখাটি পড়ে,
“মেয়েটির সাজ ভীষণ পছন্দের। তবে সে জানে না, তার মায়াভরা দৃষ্টির সামনে এই পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য তুচ্ছ।”
.
.
কলিংবেল বাজে। কবিতা একদিকে রান্না করছিলো অন্যদিকে পড়াচ্ছিলো কাব্যকে। এই শেষ সন্ধ্যায় কে এলো তা বুঝতে পারে না সে। বিশেষ কারও আসার কথা ছিলো না। তীর্থের মা’ও কিছুক্ষণ বাহিরে গিয়েছো তার বান্ধবীদের সাথে গল্প করতে। তার এত তাড়াতাড়ি আসার কথা নয়।

কবিতা দরজা খুলে তীর্থকে দেখতেই চমকে উঠে। বিস্ময় নিয়ে বলে, “তুমি না একদিন পর আসতে?”
তীর্থ কোনো উওর দেয় না। কবিতার হাত ধরে একটানে তাকে বুকে জড়িয়ে। জড়িয়ে ধরে এক গভীর নিশ্বাস ফেলে। এতক্ষণ তার জান যায় যায় অবস্থা। সারারাস্তা অশান্তি এবং ভয়ে কেটেছে তার। কবিতা যদি ভুলেও গতরাতের ঘটনা জানে তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। সে তো কবিতাকে ছাড়া থাকতে পারবে না।

কবিতা হতভম্ব হয়ে যায় তীর্থের হঠাৎ তাকে জড়িয়ে ধরায় সে ভয়ার্ত গলা জিজ্ঞেস করে, “সব ঠিক আছে তো?”
“হুম, কেবল তোমার কথা মনে পড়ছিল খুব। তাই চলে এলাম তোমার কাছে।”
কথাটা শোনার পর কবিতার মন ফুরফুরে হয়ে গেল। সে একগাল হেসে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে তীর্থের বুকে নিজের মুখে লুকিয়ে আলতো সুরে বলে, “তুমি কেবল আমার জন্য এসেছ?”
তীর্থের মাথায় এলো যে তারা এখনো দরজায় দাঁড়ানো। তীর্থ কবিতাকে ছেড়ে বলল, “ভিতরে যেয়ে কথা বলি আসো। সিঁড়ি থেকে উঠানামা করার সময় কেউ দেখে নিলে আবার লজ্জা পেতে হবে।”
কথাটা অপ্রভাবিত হয় কবিতা। সে তীর্থের হাতদুটো আবার তার কোমরে আবদ্ধ করে বলে, “উফফ তারা দেখলে তারাই লজ্জায় ফুরফুর করে নিচে নেমে যাবে। তুমি আমাকে ছেড়ো না তো।”
তীর্থ হাসে কবিতার এমন পাগলামি দেখে। সে কবিতাকে আবারও জড়িয়ে ধরে।

“আম্মি আম্মি এতা মেদাম কি লিখে দিয়েছে?” কাব্যের কণ্ঠ শুনে তাড়াহুড়ো করে কবিতা সরে যায় তীর্থের বুক থেকে। কাব্য রুম থেকে দৌড়ে এসে তার বাবাকে দেখে উৎসুক গলায় বলে, “আব্বু তুমি ককন এসেছ?”
“এইমাত্র।”
“আব্বু আব্বু আমার সাতে তেলবে?”
কবিতা বলে, “খেলা পরে। আগে হোমওয়ার্ক। হোমওয়ার্ক শেষ হলে বাবা তোমার সাথে খেলবে। এইবার জলদি করে রুমে যাও, আম্মি আসছে।”
কাব্য বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়িয়ে তার মা’য়ের আদেশ পালন করল। কবিতা তীর্থের দিকে তাকিয়ে বিরক্তির সুরে বলল, “তোমার লজ্জা শরম বলতে কিছু আছে? এভাবে খোলামেলা জায়গায় কেউ জড়িয়ে ধরে? কেউ দেখলে কি ভাবতো?” কবিতা মুখ ফুলিয়ে তীর্থের পিঠ করে রুমের দিকে যেতে নিলেই আবার ফিরে এসে তীর্থের গালে একটা চুমু খেয়ে বলল, “আচ্ছা এখন জলদি যেয়ে হাতমুখ ধুঁয়ে নেও। এতবড় জার্নি করে এসেছ, নিশ্চয়ই খুদা লেগেছে। আমি ছটফট করে নাস্তা বানিয়ে দিচ্ছি।”
তারপর কবিতা আবারও হাওয়ার বেগে চলে গেল। তীর্থ কবিতার এমন কান্ড দেখে হেসে মাথা নাড়িয়ে বলে, “পাগল একটা।”

শাওয়ার নিচ্ছিল তীর্থ। এর মাঝে তার মনে পড়ে গতরাতের কথা। এরমাঝে সে আবার ভাবে মৃণার সাথে সব কথা ক্লিয়ার না করে তার আসাটা উচিত হয় নি। একদিকে তো মৃণা বলেছিলো যে তীর্থ গতরাতে কোনো জোর করে নি তাকে, তাহলে এমন ব্যবহার কেন করছিল সে? মাথায় ডুকছে না, কিছুই মাথায় ঢুকছে না তার। মৃণার সাথে কথা বলতে হবে কিন্তু সে একটা জিনিস ভালো করে জানে কিছুতেই গতরাতের কথা কবিতাকে জানতে দেওয়া যাবে না। কবিতাকে এমন কিছু সন্দেহও করতে দেওয়া যাবে না। যদি কবিতা ভুলেও জেনে যায় এবং তাকে ছেড়ে যেতে চায় তাহলে? ভাবতে বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠে তীর্থের। সে কবিতাকে ছাড়া বাঁচতে পারার কথা ভাবতেও পারে না।

তীর্থ দেখল সে তোয়ালে নিয়ে আসে নি তাই ডাক দেয় সে কবিতাকে। কবিতা বাথরুমের দরজার বাহির থেকে জিজ্ঞেস করে, “ডাকছ কেন?”
“একটা তোয়ালে দিয়ে যাও।”
কিছুক্ষণ পর তোয়ালে নিয়ে হাজির হয় কবিতা। দরজায় টোকা দিয়ে বলে, “এই নেও।”
তীর্থ দরজা খুলতেই দরজার ফাঁক দিয়ে কবিতা তোয়ালেটা দেয়।
হঠাৎ তীর্থের মাথায় দুষ্টুমি বুদ্ধি আসে। সে কবিতার হাত ধরে টান দিয়ে ভেতরে নিয়ে আসে তাকে। দরজা বন্ধ করে দেয়। কবিতাকে ঝর্ণার নিচে এনে দাঁড় করায়।

আচমকায় এমনটা হওয়ায় কবিতা কিছু বুঝে উঠতে পারে না। সে একবার মুখ তুলে ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে আবার তাকায় তীর্থের দিকে। বিরক্তির ভাব নিয়ে বলে, “আমি পুরো ভিজে গেলাম তো।”
তীর্থ কবিতাকে কাছে যেয়ে তার কোমরে হাত রেখে তাকে কাছে টেনে আছে। তারপর কবিতার দিকে ঝুঁকে বলে, “আজ সকালে কি বলছিলে আমি রোমেন্টিক না, তাই না?”
কবিতা লজ্জায় মুখ নামিয়ে নেয়, “ভুল বলেছি না’কি?”
“তাহলে এখন রোমেন্টিক হচ্ছি তো। একবার তাকাও।আমার দিকে।”
কবিতা লজ্জায় মিইয়ে গেল। সে চোখ উঠালোই না। তীর্থ তার থুতনিতে আঙুল রেখে মুখ তুলে বলে, “মরে যাব এমনভাবে লজ্জা পেতে দেখলে। লজ্জা পেলে এত সুন্দর লাগে কেন তোমায়?”
তীর্থ ঝুঁকে কবিতার কানের পাতায় একটা চুমু খেল। সাথে সাথে কেঁপে উঠে সে। চোখ দুটো চেপে বন্ধ করে নেয়। তীর্থ কবিতার কপাল ছোঁয়া ভেজা চুলগুলো আলতো আঙুলে সরায়। কবিতার কোমরে থাকা হাতটা বুলিয়ে তার পিঠের কাছে নিয়ে আসে। একটানে মিশিয়ে নেয় তাকে নিজের সাথে। আবারও তার কাছে যেতে নেয়।
কবিতার তো হৃদয়ের স্পন্দন বাঁধনহারা।
তীর্থের এই মাতাল স্পর্শে ধ্ক করে উঠে তার হৃদয়। দিশেহারা হয়ে যায় নিশ্বাস।

ডাক পড়ে জাহানারা বেগমের, “বউ….এই বউ আমার পানের ডিব্বা কই রাখসো তুমি?”
ভয়ে কবিতা লাফিয়ে উঠে। সে হতদম্ব হয়ে আশেপাশে তাকাতে থাকে। ঝর্ণাটা বন্ধ করে তীর্থকে জিজ্ঞেস করে, “মা ডাকছে তো। এখন আমি কীভাবে যাব? কী করলে তুমি বলো তো।”
তীর্থ কবিতার হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে মাথায় রাখতেই কবিতা বলে, “তুমি ভেজা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছবে?”
“উঁহু, আদর করব।”
তীর্থ তোয়ালে দিয়ে কবিতার মাথা ঢেকে দুইহাত দিয়ে তার গাল ধরে বলে,”একমুহূর্তে অন্যকোনো কথা শুনবে না, কেবল আমার স্পর্শ অনুভব করো।”
তীর্থ মুহূর্ত না ব্যয় করে কবিতার ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে দিলো। কবিতার ঠোঁট দুটো নিজের দখলে নিয়ে খেলতে থাকে তার সাথে।

ওদিকে তীর্থের মা ডেকেই যাচ্ছিল কবিতাকে। কবিতা জানে এখন না গেলে অনেক কথা শুনতে হবে তাকে। কিন্তু তীর্থের স্পর্শকে অনুভব না করার সাধ্য তার নেই।
#মুহূর্তে
পর্ব-২২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

কবিতা আজ জলদিই বাচ্চাদের খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। কবিতা, তীর্থ এবং তার মা খাবার খাচ্ছিলো। এমন সময় রাগী কন্ঠে জাহানারা বেগম বললেন, “বউ তোমার কী আজকাল কাজে মন বসে না না’কি আমার কাজ করতে ভালো লাগে না?”কবিতা বুঝতে পাড়লো আবারও জাহানারা বেগম তখন তার ডাকে সাড়া না দেওয়ার কথা শোনাবে। এমন না যে সে একটু আগে তাকে কিছু বলেনি। বলেছে। কিন্তু তীর্থ সামনে কথাগুলো আবার তাকে বলতে হবে। কবিতা ভালোমতো জানে সে কোন উত্তর দিলে তার কথাগুলোকে ঘুরিয়ে তাকে আরও বেশি খোঁটা দেওয়া হবে তাই সে চুপ রইল।
তার চুপি দেখে শাশুড়ি আরও হৈ-হুল্লোড় শুরু করলো, “বাহ এখন আমার কথার উত্তর দেওয়াতেও তোমার কষ্ট লাগে? অন্যের ঘরের বউকে দেখ শাশুড়ির কথা মতো উঠা বসা করে। আর তুমি? সারাক্ষণ চিল্লানোর পর একটু উঠে কাজ করো। অন্যের ঘরের বউরা সবার খাওয়া শেষে তার পরে খাওয়াতে বসে। আর এইখানে তুমি আমাদের সাথে বসে খাও, তাও আমি কিছু বলি না। এমন শাশুড়ি কোথায় পাবে তুমি?”
তীর্থ খেতে খেতে বিরক্তি সুরে তার মাকে বলে, “মা এখন এইসব কথা বলার দরকার আছে? আর তখন কবিতাকে আমি কিছু কাজ দিয়েছিলাম তা করছিলো ও।”
“বাহ বাহ এখন আমার ছেলেও এই মেয়ের জন্য আমার মুখে মুখে তর্ক করবে। এই দিন দেখার জন্যই তো আমি মানুষের কাছে হাত পেতে পেতে তোকে খাওয়াইছি, পড়াইছি, পড়াশোনা করাইসি তাই না? কয়দিন পর তো এই মেয়ের কথায় আমাকে রাস্তাতেও ফালায়া আসতে দ্বিধাবোধ করবি না।”
“মা, তুমি এভাবে বলছ কেন? কবিতা কখনো এমন কিছু বলে নি তোমাকে নিয়ে। আমি কেবল একটু মহলটা শান্ত করার জন্য তখন কথাটা বলেছি।”
“এই মেয়ে যে পাকনা। তোকে কি সরাসরি বলবে না’কি? এভাবে বুঝাবে যেন তুই নিজ থেকে আমাকে ঘর থেকে বাইর করে দিস। আমি তোকে বলছিলাম আমার ভাইয়ের মেয়েটাকে বিয়ে করে নে। মেয়েটা কত সরল সোজা ছিলো। আরও সুন্দরও বেশি ছিলো। এর উপর কোনো ছেলেও ছিলো না তার। অর্ধেক জায়গা সম্পত্তি তোরই হতো। কিন্তু না, তুই এই মেয়েকে এনে নিজের মাথায় বসিয়ে নিলি।”
কবিতার শান্ত গলায় বলে, “মা আগে নাহয় অভাব ছিলো, এখন তো আপনার ছেলের কাছে সব আছে। কোনো অভাব নেই তাও এমন কথা কেন বলছেন?”
“এইত্তো দেখলি আবার মুখ খুলছে। তোর সামনে আমাকে এভাবে বলে তাহলে ভাব তুই বাসায় না থাকলে কত কি বলতে পারে? এখন ওকে কি বলব মা বাপ কোনো শিক্ষা তো দেয় নাই। যে মেয়ে বিয়ের দিন ঘর থেকে পালিয়ে আসতে পারে সে মেয়ের কাছে আবার আমি ভদ্রতার আশা করব? মা বাপেরও শিক্ষা বলতে কিছু নাই, মেয়েরে বেশরমের মতো পাঠায় দিসে। এই না যে শশুড়বাড়িতে কিছু দিবে। একটা টাকাও দেয়…..”

জাহানারা বেগমের কথা শেষ হবার পূর্বেই কবিতা খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। রাগে তার শরীর জ্বলছিলো কিন্তু সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো। নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টায় জুটে গেল। সে উঠে যেতে নিলেই তীর্থ বলে, “কবিতা খাবার ছেড়ে উঠতে নেই। বসো।”
“এইসব কথাতেই আমার পেট ভরে গেছে।”
কবিতা বেসিনে হাত ধুঁয়ে রুমে যেতে নিলেই জাহানারা বেগম আবারও বলে, “এই’যে এই শিক্ষার আরেক প্রমাণ। আমি কথা বলতেছি তার শোনার ভদ্রতা নেই। আবার আমার সামনে তেজ দেখিয়ে উঠে যায়।”
কবিতা পিছনে ফিরে কঠিন গলায় বলে, “সরি মা আমার আপনার মতো এই ভদ্রতা নেই যে খাবার খেতে বসে চিল্লাচিল্লি করব। আমার মা বাবা আমাকে এই শিক্ষা তো দিয়েছে যে অন্যের দেওয়ার জন্য বসে থাকি না। আমি যদি পালিয়ে এসে আপনার ছেলের সাথে বিয়ে করি তাহলে সেক্ষেত্রে আপনার ছেলেও বরাবরই দায়ী। আপনি আপনার ছেলেকে কিছু বলছেন না কেন? আর আমি এতটুকু জানি আমি সেদিন পালিয়ে এসে কোনো ভুল করি নি। আর আপনার মতো শাশুড়ি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার, প্রতিদিন এই কথা বলেন তাই না? আপনার মতো শাশুড়ি ভাগ্যে আছে জানলে আপনার ছেলেকে আমি যতই ভালোবাসি না কেন ওকে কখনোই বিয়ে করতাম না। আপনি আমার জীবনটা জাহান্নাম থেকে কম করে তুলেন নি।”
কবিতা রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে নিলো। কিন্তু সে তীর্থের মা’য়ের কন্ঠ স্পষ্ট শুনতে পারছিলো, “এই মেয়ে তোর সাহস কীভাবে হয়া আমার সাথে এভাবে কথা বলার? তুই কথা দিয়ে আমাকে অভদ্র বুঝাতে চাইলি? নিজে কী? কী অস্তিত্ব আছে তোর? আমার ছেলের টাকা দিয়ে খেয়ে, পরে আমাকে কথা শুনাতে আসে।”
আরও আজেবাজে কথা শুনাতে থাকে সে কবিতাকে। কবিতা দরজা বন্ধ করে মেঝেতে বসে পড়ে। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দুই কান হাত দিয়ে চেপে ধরে। ঠোঁট কামড়ে কাঁদতে থাকে সে।

কিছুক্ষণ পর তার মেয়ে কুহু ঘুমের থেকে উঠে কাঁদতে শুরু করে। কবিতা উঠে দৌড়ে যায়। মা’য়ের মন তো। হাজার কষ্ট বুকে ভরে তার সন্তানের কান্না থামাতে ব্যাকুল হয়ে পড়ে।
.
.
তীর্থ অনেকক্ষণ ধরে তার মা’কে বুঝিয়ে রাতে আসে রুমে। রুমে এসে দেখে তার বাচ্চারা ঘুমাচ্ছে এবং কবিতা তাদের পাশে বসা। তীর্থ কবিতার হাত ধরে রুম থেকে টেনে বাহিরে নিয়ে যায়। ড্রইংরুমে নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে, “আমার মা’য়ের সাথে এত বাজে ভাবে কথা বলছিলে কেন তুমি?”
“উনি আমার মা-বাবাকে কি বলেছে তা তুমি শুনো নি?”
“তুমি এত বছর কি তাকে চিনো নি? মা’য়ের ভাষা একটু কটু কিন্তু মন অনেক ভালো। আমি জানি সে মাঝমধ্যে এমন কিছু কথা বলে যা বলা উচিত না। কিন্তু এর মানে এই না যে তুমি খারাপ কিছু বলবে। তোমাকে আমি প্রথমেই বলেছি আমার মা আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সে তার জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করেছে আমি চাইনা আর তার সামনে জীবন নিয়ে কোনো প্রকার কষ্ট আসুক।” তীর্থ কবিতার দুই বাহুতে হাত রেখে আকুতির সুরে বলল, “প্লিজ কবিতা উনাকে কিছু বলো না। তার মন মতো থাকো। আমি চাই না এই ঘরে আর কোনো অশান্তি হোক। আমার ভালো লাগে না এইসব।”
“আমিও চাই না আমাদের সংসারে কোনো অশান্তি হোক। আমি এত বছর ধরে উনার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি, আর পারছি না। আমিও চাই উনি আমাকে আদর করুক, ভালোবাসুক। কিন্তু সহ্যের এক সীমানা থাকে। উনি নিজে জীবনে কষ্ট পেলে তো তার অন্যদের জ্বালানো মানায় না। কারণ উনি বুঝে কষ্ট কি তাই না? কেবলমাত্র তোমার জন্য আমি উনার সব কথা সহ্য করে নেই, উনি অকারণে যে সারাক্ষণ গাঁধার মতো খাটায় তাও সহ্য করি কিছু বলি না। কিন্তু উনি আমার পরিবারকে নিয়ে কেন বলবে? তোমার মা’কে আমি একটা কথা বলায় তুমি এত রেগে গেছ অথচ উনি যখন আমার মা, বাবাকে অভদ্র, বেশরম বলছিলো তখন কেন মুখ বন্ধ করে রেখেছিলে তুমি? তোমার জন্য আমি এতকিছু সহ্য করতে পারি কিন্তু তুমি আমার জন্য স্টান্ডও নিতে পারো না? আমার মাঝেমধ্যে কি ফিল হয় জানো?”
“কোন পরিবারের কথা বলছ? যারা তোমাকে ওই নেশাখোর, চরিত্রহীন ছেলের সাথে বিয়ে দিতে অস্থির হয়ে গিয়েছিল। কেবল নিজের স্বার্থের জন্য?”
“তো তোমার মা’ও তো যৌতুকের বিনিময়ে তোমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য পাগল হয় গেছে তার কী?”
“চুপ কবিতা, একদম চুপ। অতিরিক্ত করছ তুমি। আমি শুধু তোমায় ভালোবাসি বলে কিছু বলি না, নাহয়…..”

কবিতা তীর্থের বুকে হাত রেখে ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে দেয়, “নাহয়, নাহয় কী? আমাকে মারবে না ছেড়ে দিবে? আমার আর ভালো লাগে না এইখানে। দম বন্ধ হয়ে। তোমার মা আমাকে শান্তি মতো নিশ্বাসও ফেলতে দেয় না। আমি যে কোথাও যেয়ে একটুখানি শান্তি পাব সে সুযোগ আমি অনেক আগেই হারিয়ে এসেছি। হয়তো আমি একটা শান্তির জীবন পেতে পারতাম তাও আমি ছেড়ে দিয়েছি। তাও তোমার জন্য। কিন্তু তোমার তো এতে কিছু আসে যায় না। জানো তোমার মা’য়ের দোষ না। দোষ সবচেয়ে বেশি তোমার। তুমি শুধু আমাকে চুপ থাকতে বলো, তোমার মা’কে বুঝেলেই কিন্তু অনেককিছু ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু না। তোমার তো অশান্তি লাগে এইসব। তুমি শুধু পালাতে চাও অশান্তিতে। এই অশান্তির আগুনে আমি একা জ্বললেও তোমার কিছু আসে যায় না। তোমার এই বিরক্তি আর রাগ দেখে আমি কিছু বলিও না তোমাকে। তুমি আরও চিন্তা করবে এইজন্য আর তুমি….। হয়তো আমি একটা শান্তির জীবন পেতে পাড়তাম তাও আমি ছেড়ে দিয়েছি। তাও তোমার জন্য। আমার মাঝেমধ্যে আফসোস হয় যে….” চুপ হয়ে গেল কবিতা। সে বুঝতে পারে সে রাগের মাথায় এমন কিছু বলতে নিয়েছিল তা বলাটা অনুচিত হবে। কিন্তু তীর্থ ঠিকই কথাটা ধরে নেয়। সে ভ্রু কুঁচকে তাকায় কবিতার দিকে, “কী আফসোস হয় তোমার? আমাকে ভালোবাসা? আমাকে বিয়ে করা নাওই জয় বা কথনের সাথে বিয়ে না করতে পারা? কোনটা নিয়ে তোমার আফসোস হচ্ছে বলো আমাকে।”
কবিতা উওর দেয় না। চোখ নামিয়ে নেয়।
তীর্থের গলার আরও উঁচু হয়, “টেল মি ড্যাম ইট। কী নিয়ে তোমার আফসোস হয়? আজকে ওই দুইজন থেকে সব দিক থেকে অবস্থায় আমি বেশি ভালো। তাদের থেকে দশগুণ বেশি টাকা আছে আমার কাছে।”
কবিতা বিরাগ দৃষ্টিতে তাকায় তীর্থের দিকে। বলে, “আমি তোমাকে টাকার জন্য বিয়ে করেছিলাম? আমি যখন তোমাকে বিয়ে করেছি তখন তোমার কাছে কিছু ছিলো না। আর তুমি জানো কী? তখনই মনে হয় আমার জীবনটা বেশি ভালো ছিলো। অন্তত আমার জন্য তোমার কাছে সময় হতো। টাকা এসে তোমার অহংকার চরম সীমানায় চলে গেছে। আর তুমি কার সাথে অহংকার দেখাচ্ছ? যে তোমার সাথে তোমার সাফল্যের পথ চলেছে। তোমার জন্য আমি আমার পড়াশোনাও ছেড়ে দিয়েছি। আর তুমি আমার সাথে আজ এই ব্যবহার করছ? বিয়ের আগে তো হাজারো ওয়াদা করেছিলে তুমি, আমাকে পৃথিবীর সকল সুখ দেওয়ার। এখন সে ওয়াদার মান কোথায় গেল? আমার তোমার এত টাকা পয়সা চাই না তীর্থ। শুধু আমাদের প্রয়োজন মেটানোর মতো হলেই হবে। টাকা পয়সা দিয়েই সব হয় না তীর্থ, একসময় তোমার কাছে অনেক টাকা পয়সা থাকবে কিন্তু মনে সুখ থাকবে না। তুমি এখন নিজের পরিবারের সাথে যে সুন্দর মুহূর্তগুলো মিস করছ তা ফিরে আসবে না কখনো।”
কবিতা কথাগুলো বলে একমুহূর্তও আর দাঁড়ালো না। সেখান থেকে চলে গেল।

তীর্থও আর দাঁড়িয়ে থাকে না সেখানে। আজকাল এই ঘরে থাকতেই তার বিরক্তি লাগে। সে সোজা গেল ছাদে। রাগে তার মাথা ব্যাথা করছে। সে বুঝতে পারে সব কিভাবে সামলাবে? একদিকে তার মা, অন্যদিকে কবিতা। দুইজনের মাঝে ফেঁসে আছে সে। এই অশান্তি তার আর ভালো লাগে না।

তীর্থ তার ফোন বের করে রাহাতকে কল দেবার জন্য। কালই আবার অফিসে যাবে সে। এই বাসায় সে শান্তিতে এক মুহূর্তও কাটাতে পারবে না। ফোন বের করে দেখে ধ্রুবর মিসকল কতগুলো। ফোন সাইলেন্টে থাকায় সে খেয়াল করে নি। তাই সে কল দেয় ধ্রুবকে।
“হ্যালো, কী’রে ভাই কতবার কল দিলাম তোকে? ঢাকায় পৌঁছে তো জানাবি তাই না?”
“ভুলে গেছিলাম।”
“তোর কন্ঠ এমন শুনাচ্ছে কেন?”
তীর্থ বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিল, “বাসার যত্তসব ঝামেলা। জানিসই তো।”
“ভালো কথা। তুই বললি না যে হঠাৎ চলে গেলি কেন? সবার মন অনেক খারাপ ছিলো সারাদিন। বিশেষ করে মৃণার। সারাদিন মুখ লটকে রেখে ঘুরছিল।”
তীর্থের হঠাৎ করে মনে পড়ে মৃণার কথা। এত ঝামেলার মাঝে তার কথা মাথা থেকে চলে গিয়েছিল। সে ধ্রুবকে বলে, “ওর নাম্বারটা হবে তোর কাছে?”
“তুই কোনো মেয়ের নাম্বার চাচ্ছিস?” ধ্রুবর কন্ঠ বিস্মিত শোনাল, “যদিও তোর দোষ নেই। মেয়েটা আসলেই সুন্দর।”
“আজেবাজে বকিস না তো। কাজে চাইছি।”
“আচ্ছা বাবা মেসেজ করে দিচ্ছে। তোকে যে বললাম মেয়েটা কবিতার মতো দেখতে তা খেয়াল করেছিস? কাছে গেলে ভালোভাবে বুঝা যায়।”
“এত বুঝা লাগবে না। নাম্বার দে।”
তীর্থ ধ্রুবকে বলে না গতরাতে কথা। তাকে জানানো উচিত হবে কি’না সে জানে না। কিন্তু তার মৃণার সাথে কথা বলাটা জরুরি। ভীষন জরুরি। গতরাতে ঠিক কি হয়েছিলো তার জানতে হবে।

চলবে….

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here