মুহুর্তে পর্ব -২৯+৩০

#মুহূর্তে
পর্ব-২৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

“খবরদার আমাকে স্পর্শ করার সাহসও তুমি করবে না। আমি এই মুহূর্তে তোমার চেহেরাও দেখতে চাই না।”
কবিতায় কথাটি বলে উঠে গেল। আলমারির সামনে নিচে পড়ে থাকা ফাইলটি উঠিয়ে চলে গেল সেখান থেকে।

কবিতা চোখ মুখ মুছে গেল বাহিরে। গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছিলো কথন। কবিতাকে গাড়িতে উঠে বসতে দেখে সে বলল, “তোমার বাসা থেকে বোধহয় কিছু শব্দ শোনা যাচ্ছিল।”
“ওহ, ওই টিভি চালু ছিলো। খেয়াল করি নি।”
কথন খেয়াল করলো কবিতা চেহারাটা। কেমন মলিন হয়ে আছে। মনে হচ্ছে এখনই কান্না করেছে সে।
“কবিতা, তুমি কান্না করেছ?”
“আমি? না তো আমি কাঁদবো কেন?”
“তোমার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।”
কিছুক্ষণ চুপ রইল কবিতা। তারপর বলল, “কাব্য অসুস্থ তো ওই জন্য একটু চিন্তা হচ্ছিল।”
কথন হেসে কবিতাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “ডোন্ট ওয়ারি। ওর কিছু হবে না।”
কবিতা জোরপূর্বক হাসলো।

কথন দ্রুত গাড়ি চালিয়ে হাস্পাতালের দিকে রওনা দিলো। মাঝরাস্তায় সে জিজ্ঞেস করে, “তীর্থ কোথায়? ওকে দেখলাম না।”
“উনি…উনি একটা সমস্যায় ফেঁসে গেছে। এসে পড়বে।”
মিথ্যা বলল কবিতা। তার আর তীর্থের মাঝে যত বড়ই সমস্যা হোক না কেন, তীর্থ তার স্বামী। তার স্বামীর সম্মানের মান রাখাটা তার দায়িত্ব। আর যাই হোক, সে অন্যকারো সামনে তার স্বামীকে ছোট করতে পারে না।

জানালা দিয়ে হিম শীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে। আকাশে মেঘ ডাকছে। বজ্রধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এই মুহূর্তও খুবই সুন্দর হতে পাড়তো।
কিন্তু আফসোস!
কবিতার সাথে এমন মুহূর্ত নিয়ে কল্পনা করবার অধিকার তার নেই। তবুও ছোট একটি স্মৃতির পৃষ্ঠা থেকে একটি মিষ্টি মুহূর্ত উঁকি দিলো কথনের মনে। ঘটনাটা সাড়ে সাত বছর পূর্বের…….

একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলো দুইজন। কথনের বান্ধবীর বিয়ে। অনুষ্ঠানে কবিতার সাথে একটি ঘটনার পর সে আর সেখানে থাকতে চাইলো না, রাগে সেখান থেকে বের হয়ে গেল। কথনও তার পিছু নেয়। সে এসেই হাত ধরে কবিতার, “আরে বাবা এত রাগ করছ কেন? আর এভাবে রাগ করে কেউ চলে আসে? কি মনে করবে তারা? ভেতরে চলো।”
“আপনার বন্ধুর বিয়ে আপনি যান। এতকিছুর পর আমি কেন যাব? আমি এখন বাসায় যাব।”
“তোমাকে আমি একা যেতে দিব না’কি?”
“হাত ছাড়েন তো। মেজাজ খারাপ করবেন না।”
“ছাড়ব না। ভেতরে চলো।”
কবিতা নিজের জুতা খুলে তা হাতে নিতেই কথন তার হাত ছেড়ে পিছিয়ে গেল। ভীত গলায় বলল, “দে..দেখ যাই হোক না কেন আমি বয়সে তোমার বড়। তুমি যা চিন্তা করছ তা একদম ঠিক না।”
কবিতা মুখ বানিয়ে বলল, “ভাই হিল পরে আমার পা’য়ের সাথে সাথে আমিও শেষ। মানুষ কচুর বিয়ে করে। তাদের বিয়েতে এসে আমার অবস্থা খারাপ। একতো এই ফালতু হিল, এর উপর এই শাড়ি। সামলাতে সামলাতে আমি মরে যাচ্ছি। অসহ্য! পা ব্যাথা হয়ে গিয়েছিলো, তাই হাতে নিলাম। আপনি কী ভেবে ভয় পেলেন?” উওরের অপেক্ষা না করেই কবিতা হাঁটতে লাগলো। তার হাঁটারও অন্যরকম ভঙ্গি ছিলো। সে অনেকটা লাফিয়ে হাঁটতো। একদম বাচ্চাদের মতো।

কথন আবারও তার পিছনে গেল, “আচ্ছা কবিতা চলো তোমায় বাসায় দিয়ে আসি। বৃষ্টি পড়বে মনে হচ্ছে।”
“উঁহু, আপনার বন্ধুর বিয়ে না থাকলে খারাপ দেখা যায়। আপনি ভেতরে যান, আমি এখানেই আছি।”
“আমি তোমাকে এখানে একা ছেড়ে যাব?”
“আমি অপেক্ষা করতে পাড়ব।”
“আচ্ছা তুমি দুইমিনিট দাঁড়াও আমি ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসি।”
উত্তর শোনার আগেই কথন চলে গেল। ভেতরে যেয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে এসে দেখে কবিতা এখনো একই জায়গায় হাঁটাহাঁটি করছে। কবিতা তাকে দেখেই দৌড়ে ছুটে এসে চোখ দুটো বড় বড় করে জিজ্ঞেস করে, “আমি যখন জুতা খুলেছিলাম তখন কী আপনি ভেবেছিলেন আমি জুতা দিয়ে আপনাকে পিটাব?”

কথন বিরক্তি নিয়ে তাকায় কবিতার দিকে, “প্রায় দশ মিনিট পর তুমি এটা বুঝেছ? বাহ কী জিনিয়াস তুমি! আর এমন পেঁচার মতো চোখ করে তাকাবা না, ভয় করে।”
কথন গাড়ি দিকে হাঁটতে শুরু করে। কবিতাও আসে তার পিছনে, “আমার চোখ পেঁচার মতো দেখতে? কীভাবে বলতে পাড়লেন এটা আপনি? জানেন কত ছেলে আমার চোখ দেখে আমার প্রেমে পড়েছে?”
কথন ভ্রু কপালে তুলে তাকায় কবিতার দিকে তার শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুঁজে রাখা, খোলা চুলগুলো অগুছালোভাবে খোঁপা করে রেখেছে, জুতাগুলো হাতে নিয়ে লাফাচ্ছে। তাকে দেখে কথন হেসে বলে, “তোমার প্রেমে পড়েছে? নিশ্চয়ই তার মাথায় সমস্যা আছে। তুমি তো স্বাভাবিক মানুষের মতো হাঁটতেও জানো না। সে কখন থেকে বান্দরের মতো লাফাচ্ছো।”
কবিতার তার সামনে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে নিলো।

কথন তার দুই পকেটে হাত রেখে হাঁটছিলো। কবিতার বলে, “আমি বান্দরের মতো লাফাই? আপনারা কি শেষমেশ বানরের সাথে তুলনা করছেন? আপনার সাহস কত বড় একথা বলার।?
কবিতা পিছনে দিকে হাঁটতে হাঁটতে কথাটি বলে। সে কথনের মুখোমুখি ছিলো। কথন হেসে দিলো কবিতার কথায়। তার এই খুনসুটিটা মজারই লাগছিল। তাই সে খুনসুটিটা আগানোর উদ্দেশ্যে বলল, “ছিঃ ছিঃ আমার এত বড় ভুল করতে পারি না’কি? বানরও তোমায় দেখে লজ্জায় লুকিয়ে পড়বে।”
“দেখেন আপনি….” কবিতা কথনের মুখের সামনে আঙ্গুল তুলে ধমক দিতে চাইল কিন্তু এর পূর্বেই পিছনের একটি পাথরের সাথে পা লেগে পড়ে যেতে নেয় সে। সাথে সাথে কথন তার হাত ধরে নেয়।

কবিতা এক বড় নিশ্বাস ফেলে। এক মুহূর্তের জন্য তার নিশ্বাস আটকে গিয়েছিলো। কথন এক টানে তাকে উঠাতে নিলেই কবিতা তার বুকে এসে পড়ে। সে হতবাক, হতদ্ম্ব। তার মুখের রঙও উঠে গেল। অথচ কথন ঠিকই ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে মশকরা করে, “দেখাও, কী দেখাবে?”

কৃষ্ণবর্ণ আকাশের মাঝে বজ্রধ্বনির গর্জন শুরু হয়। বাতাসের ছড়াছড়ি চারপাশে। ঝুম বৃষ্টি নামে। কথন এক পলক আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার কবিতার দিকে তাকায়। কবিতার চোখ নিচে নামানো। সে কী লজ্জা পাচ্ছে? তার কবিতার এই লাজুকতার ভাব ভালোই লাগলো তার কাছে। সে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো কবিতার দিকে। কবিতা চোখজোড়া তুলতেই হলো নয়নবন্ধন। হঠাৎ সে দৃষ্টিতে তার স্পন্দন বেড়ে গেল। নিজের এমন অবস্থাতে অবাক না হয়ে পারে না। কবিতা চোখ উঠানোর পরের মুহূর্তেই চোখ নামিয়ে নেয়। সরে যায় তার কাছ থেকে। কথন নিজের উপরই অবাক, এমন মুহূর্তখানিকের দৃষ্টি বন্ধনে কারও এত করুণ অবস্থা হতে পারে?

কথন একটু কাশলো। আমতা-আমতা করে বলল, “আচ্ছা চলো বাসায় যাওয়া যাক।”
কথন এগোল। কিন্তু তার পিছু এলো না কবিতা। কথন থেমে পিছনে তাকাতেই কবিতা দুইহাত দুইপাশে ছড়িয়ে উঁচু স্বরে বলে, “আমরা তো আগের থেকেই ভিজে গিছি। আরেকটু নাহয় এই বৃষ্টিতে ঘুরে বেড়াই।”
“তোমার ঠান্ডা লাগবে।”
কবিতা হাতের তালুতে একটু পানি জমিয়ে কথনে দিকে ছিটিয়ে দিলো, “হলে দুইজনে একসাথে হবো। আর ডাক্তারবাবু অসুস্থ হলে তো আপনি আছেনই ফ্রী চিকিৎসার জন্য।”
“কবিতা বাসায় চলো।” কথন ধমকের সুরে বলল। কে শোনে কার কথা? কবিতা নিজের মতই ঘুরে বেড়ায় ঝুম বৃষ্টিতে। প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াল ঝুম বৃষ্টির মাঝে।

কবিতা যখন তার কথা অগ্রাহ্য করে তখন কথন নিজেই তাকে ধরে নিয়ে আসতে যায়। কিন্তু পূর্বের কবিতা তো তার কথা মানার মানুষ না। সে দিলো এক দৌড়। কথনও তার পিছনে দৌড় দেয়। দুইজনে ছুটে বেড়ায়। অবশেষে হাঁপিয়ে যেয়ে কবিতা বসে পড়লো উঠানেই। হাঁপিয়ে ওঠে বলে, “টাইম প্লিজ।”
কথন দাঁড়িয়ে পড়ে। কবিতাকে উঠানে বসতে দেখা তার দিকে ঝুঁকে মাথায় টোকা মেরে বলে, “তোমার সাথে কী আমি কানামাছি খেলছি? আসছে টাইম প্লিজ। আর এভাবে উঠানে কে বসে?”
“অস্থির লাগছে। আপনিও আসেন তো।”
কবিতা টেনে ধরে কথন কে নিজের পাশে বসালো। তারপর জিজ্ঞেস করল, “ডাক্তারবাবু কতক্ষণ আপনার ডাক্তারগিরি ছেড়ে এই মুহূর্ত ইনজয় করুন। এসব মুহূর্ত বারবার আসে না। এইসব মুহূর্তও স্মৃতির ডায়েরিতে থেকে যায়।”
“তুমি এমন কেন বলো তো।”
“কেমন?”
“এলিয়েনদের মতো।”
কবিতা ভ্রু কুঁচকে, মুখ ফুলিয়ে তাকায় কথনের দিকে। তাকে দেখে কথনের হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাবার অবস্থা, “একদম….একদম এলিয়েনদের মতো লাগছে।”
“হ্যাঁ এলিয়েন তো আপনার বন্ধু হয়, তাই বেশ জানেন এলিয়েন দেখতে কেমন।”
কবিতা ভেংচি কেটে সামনে তাকাল। বৃষ্টি ঝরা আকাশে মেয়েটা কি দেখল কে জানে? কথন সোজা হয়ে বসে মুগ্ধ নয়নে তাকাল কবিতার দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে একগাল হাসি নিয়ে সেও তাকাল সে মেঘলা আকাশের দিকে। সত্যি বলেছিলো কবিতা, কিছু মুহূর্ত স্মৃতির ডায়েরিতে থেকে যায় এবং সে মুহূর্তটা তার স্মৃতির ডায়েরির সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তের মাঝে একটি।

স্মৃতির নগর হতে বর্তমানে ফিরে আসে কথন। সে তাকাল কবিতার দিকে। কবিতা জানালার বাহিরে তাকিয়ে ছিলো। সে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা তোমার মনে আছে ক
নিগারের বিয়েতে এমন বৃষ্টির মুহূর্তটা?”
কবিতা খানিকটা অপ্রস্তুত দেখা গেল। সে মাথা নাড়িয়ে বলল, “আমার ঠিক মনে নেই।”
কথনের মনটা একটু খারাপ হলেও, সে নিজেকে বুঝিয়ে নিলো। কেননা সে একজীবন এই স্মৃতি দ্বারা কাটিয়েছে, কবিতা না। এই সাত বছরে হাজারো স্মৃতি বানিয়েছে সে। তার পরিবারের সাথে। তার ভালোবাসার মানুষটির সাথে।
.
.
তীর্থ অনেকসময় সেখানেই বসে রইলো। সে কি করবে, না করবে কিছুই বুঝতে পারলো না। অস্থির হয়ে যায় সে। কবিতা আসলে যদি তাকে ছেড়ে চলে যায় তখন কী করবে সে?
তার ফোন বেজে উঠে। ফোন বের করতেই সে দেখতে পায় মৃণা কল করছে। ভীষণ বিরক্ত হয় সে। কল কেটে সে কল দিলো ধ্রুবকে। প্রথমে ধ্রুব না ধরলেও দুই তিনবার কল দেওয়ার পর ধরে।
“কোথায় ছিলি তুই? কতক্ষণ ধরে কল করছি।”
” এতবার কল করার কী আছে? শালা তাহিরার সাথে একটু ঘুরতে আসছি। রোমেন্স তো করতে দিবি। কে মরসে যে ফোন দিতেই আছিস?”
ধ্রুবর কথাগুলো শুনে তার উপর ভীষণ রাগ হয় তীর্থের। তবে সে তা বুঝতে দেয় না। এই মুহূর্তে ধ্রুবকে প্রয়োজন। সে বলে, “আমি অনেক বড় একটা ঝামেলা বেঁধে ফেলেছি।”
“কী হলো? সব খুলে বল।”

তীর্থ আজকের সকল ব্যাপার খুলে বলে ধ্রুবকে। ধ্রুব সব শুনতেই ধমক দিয়ে উঠে তীর্থকে, “তোর মাথা খারাপ? নিজের ছেলেকে অসুস্থ ফেলে কোন বালের কাজে গেছিস তুই? একটা কাজে লস খেলে কোন তুফান আসতো শুনি? আবার ওই মেয়ের সাথে ঘুরতেও গেছিস তাও নিজের ছেলেকে ছেড়ে। তুই তো দেখি আমার থেকে বড় হারামি।”
“মৃণা হাত কেটেছিলো।”
“তো? এটা কোনো বড় ব্যাপার না। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। একটু ব্যাথা করে আবার পরে ঠিক হয়ে যায়। এর উপর তুই কবিতার চরিত্রে প্রশ্ন তুলেছিস?” শব্দ করে হাসে ধ্রুব। আবার বলে, “ভাই তুই জানিস তো, তুই নিজে ওকে ধোঁকা দিচ্ছিস? তোর কলিজা এত বড় যে নিজের চরিত্র ভালো করে জানা সত্ত্বেও তুই ওর চরিত্রে প্রশ্ন তুলেছিস। লাইক সিরিয়াসলি? তোর একবারও তখন নিজের আর মৃণার কথা মাথায় আসে নি। তুই জানিস তো তাই না কবিতার অন্যায় জিনিস সহ্য হয় না। মিদুলের বাবার কথা ভুলে গেছিস?”
উওরে তীর্থ কিছু বলতে পারেনা। অপ্রস্তুত হয়ে যায়। শরমে মাথা ঝুঁকিয়ে নেয়। তারপর মৃদুস্বরে বলে,”কথনের সাথে দেখে মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিলো। আনমনে বলে ফেলেছি। এখন কী করব?”
“আর কী করবি? মৃণাকে নিজের জীবন থেকে বাহির করে দিবি।”
“কিন্তু আমার ওর সাথে শারীরিক সম্পর্ক ছিলো। আমি এভাবে নিজের দায়িত্ব থেকে কীভাবে পিছাতে পারি?”
“তো তোর কবিতার প্রতিও তো কত দায়িত্ব ছিলো ভাই। কোনটা পালন করছিস? তোর আর মৃণার কোন স্বভাব মিলে জানিস? তোরা নিজেকে উদাহরণ দিয়ে সঠিক প্রমাণ করতে চাস। আমি এই ভুল করেছি কিন্তু আমার এই কারণ আছে। কেন ভাই? তুই ভুল করেছিস, তুই তা ভালো করে জানিস, তাহলে নিজের কাছে নিজেকে সঠিক প্রমাণ করতে হবে কেন? তোর আর আমার মাঝে একটাই পার্থক্য কী জানিস? তুই পাপ কাজ করছিস, আমিও করছি। আমি জানি আমি অনেক খারাপ। তা সরাসরি মেনে নেই। কিন্তু তুই নিজেকে নিজের কাছে সঠিক প্রমাণ করতে করতেই শেষ।”

তীর্থের রাগ উঠল ভীষণ। সে ক্রোধিত কন্ঠে বলল, “এসব কথা বাদ দিয়ে আসল কথায় আসবি? মৃণা আমাকে হুমকি দিয়েছে, ওকে বিয়ে না করলে ও সুসাইড করবে।”
“আর তুই ওর কথা বিশ্বাস করে নিলি? ওর মতো স্বার্থপর মেয়ে তোর জন্য নিজেকে শেষ করবে? এটা কী জোক ছিলো?”
“যদি আসলে কিছু করে ফেলে?”
“শুন তুই একটা গাঁধা। তুই গত দেড় বছরেও ওকে চিনতে পারিস নি। আমি ওর সাথে একসাপ্তাহ কথা বলেই বুঝে গেছি এই মেয়ে নিজের স্বার্থের জন্য নিজের মা বাবাকেও ফেলে দিতে দ্বিধাবোধ করবে না। তোর কী মনে হয় ও কেন তোর সাথে আছে? তোকে ভালোবাসে এ-কারণে? এতদিন পরেও তুই এটা ভাবিস? ও যাস্ট তোর টাকার জন্য তোর সাথে আছে। রূপা আমাকে বলেছিল ও তোর বিজনেসের কথা শোনার পরই তোর প্রতি ইন্টারেস্ট দেখিয়েছে।”
“তুই ভুল ভাবছিস। এমন কিছু না।”
“ওর আগেও একটা ছেলের সাথে শারীরিক সম্পর্ক ছিলো তা জানিস? ওর এক্স বয়ফ্রেন্ড।”
“তুই মিথ্যা বলছিস, তাই না?”
“আমি তোকে মিথ্যা বলে কী পাব ভাই? তুই কী তোর সব সম্পত্তি আমার নামে করে দিবি? শুন অভিজ্ঞতা নিয়ে বলছি, বেশি গম্ভীর হবার প্রয়োজন নাই সম্পর্কের মধ্যে। এমন মেয়ে একটা যাবে দশটা আসবে। ওকে ফোন করে শক্ত করে কথা বলবি। ওকে জানিয়ে দিবি যেন তোর সাথে কোনো যোগাযোগ না রাখে। ইমোশনাল ব্লাকমেইল করতে চাইলে গলে পড়বি না। বলবি জাহান্নামে যেতে।”
“দোস্ত আমার মনে হয় রূপা তোকে ভুল বলছে। তুই ভুল ভাবছিস। আর আমি এমন কীভাবে করতে পারি? দেড় বছর ধরে সম্পর্ক আমাদের, ও এখন আমার জীবনের অংশ।”
“ভাই আমার এত সময় নাই তোকে বুঝানোর। হয়তো মৃণাকে চুজ কর, নাহলে কবিতাকে। আমি বলে রাখি মৃণার সাথে বিয়ে করলে তোর কবিতাকে হারাতে হবে। এটা লিখে দিতে পারব। আজকে যেভাবে রিয়েক্ট করল এরপর আমার মনে হয় না সত্যি জানার পর তোর সাথে স্বাভাবিক ভাবে থাকব। বাচ্চাদের জন্য একসাথে থাকতে পারে কিন্তু তোকে আর কখনো ভালোবাসবে না। আর মৃণা তোর সাথে বিয়ে করার পর কবিতাকে তোর জীবনে থাকতেও দিবে না। লিখে নে আমার কথা। এবার তুই সিদ্ধান্ত নে, তোর কবিতাকে চাই না মৃণাকে? আমি যাই। রুমে তাহিরা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
“আমার কথা তো শুন…” ধ্রুব ফোন কেটে দেয় তীর্থের কথা না শুনেই। তীর্থ এরপর বারবার কল দেয় ধ্রুবকে তার ফোন বন্ধ। খুব বিরক্ত হয় সে। এর মাঝেই আসে মৃণার কল। সে কলটা ধরল না। তার মাথায় ভাবনাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে।

ধ্রুব কী যা বলেছে তা সত্য?
মৃণার তার আগে অন্যকারো সাথে সম্পর্ক ছিলো?
তাহলে মৃণা আসলে তাকে ভালোবাসে না?
কিন্তু যদি ধ্রুব মিথ্যা বলে? মৃণা খারাপ কিছু করে নেয় নিজের সাথে তখন?

আর কবিতা, তার রাগ কীভাবে ভাঙাবে সে? যদি আসলেই কবিতা তার আর মৃণার সম্পর্কে জানে তখন? ভাবতেই বুকের ভেতর কামড়ে উঠে তার। ভয়ে তার জান যেন গলায় আটকে এলো। আজ তার রাগে এককথায় তাকে ছাড়ার হুমকি দিয়ে গেল কবিতা। সত্যিটা জানলে সে কী করবে?

আবারও বেজে উঠে ফোনটা। আবারও মৃণার কল। তীর্থ কী বলবে তাকে? বিয়ের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নিবে? কিছুই ঢুকছে না মাথায়। কিন্তু যা সিদ্ধান্ত হোক না কেন তার আজই নিতে হবে। এই মুহূর্তেই।
#মুহূর্তে
পর্ব-৩০
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

আবারও বেজে উঠে ফোনটা। আবারও মৃণার কল। তীর্থ কী বলবে তাকে? বিয়ের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নিবে? কিছুই ঢুকছে না মাথায়। কিন্তু যা সিদ্ধান্ত হোক না কেন তার আজই নিতে হবে। এই মুহূর্তেই।

এবার ফোন বাজতেই তীর্থ কল রিসিভ করলো। রিসিভ করেই ধমক দিয়ে উঠল মৃণাকে, “সমস্যা কি তোমার যখন দেখি কল কল কল। আর কোনো কাজ নেই তোমার?”
মৃণা হতবাক, হতদম্ব। সে শঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করে, “হঠাৎ কী হলো তোমার? সব ঠিক আছে?”
“তুমি আমাকে ঠিক থাকতে দিয়েছ? যখন সময় পাও তখনই জ্বালাও। সারাক্ষণ কল দেওয়া লাগে? এত কল তো আমার বউও মনে হয় সারাজীবনে দেয় নি।”
“তুমি আমার সাথে এমন বিহেভ করছ কেন তীর্থ?” কান্নামাখা গলায় বলে মৃণা।

তীর্থের কিছুক্ষণের জন্য খারাপ লাগে, মৃণা কান্নাভেজা গলা শুনে তার মন খারাপ করে দেয়। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে পড়ে কবিতার আজকের কথা। চোখের সামনে ভেসে উঠে কথনের সাথে তার দৃশ্য। বুকে কম্পন উঠে তার। কবিতা তাকে ভালোবাসবে না এই কথা কল্পনা করতেও তার বুক কাঁপে। সে মুহূর্ত না গড়াতেই কড়া ভাবে বলে, “দেখ মৃণা আমার মনে হয় আমাদের সম্পর্কটা এখানেই শেষ করে দেওয়া উচিত।”
যেন আকাশ ভেঙে পড়ে মৃণার মাথার উপর। সে আতঙ্কিত গলায় বলে, “কী বলছো তুমি এসব? তুমি কীভাবে এমনটা করতে পারো? আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না তীর্থ। আমি তোমাকে আমার সব দিয়েছি। মন, শরীর, সময়, সব। তুমি আমার সাথে এভাবে করতে পারো না। আমাদের বিয়ের কী?”
“আমি আগের থেকেই বিবাহিত। আমার পরিবার আছে, সন্তান আছে। তুমি এটা জানো। জেনেই আমার সাথে সম্পর্কে এসেছ। হ্যাঁ না’কি না?”
“কিন্তু আমি তোমাকে…”
তীর্থ মৃণার কথা সম্পূর্ণ হতে দেয় না। কথা কেটে বলে, “হ্যাঁ অথবা না তে উওর দিবে।”
“হ্যাঁ।”
“তুমি এই সম্পর্কের পরিণতি আগের থেকেই জানতে। জেনেই এই সম্পর্কে এসেছ। ইনফ্যাক্ট তুমি আমার কাছে এসেছিলে, আমি তোমার কাছে নয়।”
“আমি মরে যাব তীর্থ।”
“আই ডোন্ট ইভেন কেয়ার। যা করার করো, আমার কিছু আসে যায় না। কিন্তু হ্যাঁ আমার পরিবারে তোমার জন্য কোনো সমস্যা হলে আমি তোমার এবং তোমার পরিবারকে ধ্বংস করতে এক মুহূর্তও লাগাব না। তুমি জানো, এটা আমার পক্ষে কোন বড় ব্যাপার না। না তোমার সম্মান থাকবে, আর না অর্থনৈতিক দিক থেকে কোনো উৎস। তোমার বিয়ে হচ্ছে শান্তিমতো করে নেও। তোমার বিয়ের উপহার পাঠিয়ে দিব আমি।”
বলেই কল কেটে দেয় তীর্থ। এক গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। ধ্রুবর কথা মেনে সে মৃণাকে এসব বলে তো দিলো এখন কেবল মৃণা উল্টাপাল্টা কোনো কান্ড না ঘটালেই হলো।

এরপরই তীর্থ অনুর কাছে কল দিয়ে জেনে নেয় হাস্পাতালের এড্রেস। সে রওনা দেয় হাস্পাতালের উদ্দেশ্যে।

কাব্যকে চেকাপ করে ঔষধ দেওয়া হয়েছে। কথন এবং কাব্যের অনেক ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। সে কাব্যকে মোবাইলে কার্টুন ছেড়ে দিয়ে সে আসে কবিতা এবং অনুর কাছে। এসে জিজ্ঞেস করে, “রাত তো হয়েছে, কী খাবে?”
অনু বলে, “এসব পরে ভাইয়া। আগে রহস্য বলেন তো।”
“কীসের রহস্য?”
“আপনি বাচ্চাদের সাথে এত ফ্রেন্ডলি কীভাবে? কাব্য কিন্তু সহজে কারও সাথে মিশে না।”
“আই এম স্পেশাল।”
চোখ টিপ মেরে বলে কথন। অনু একগাল হেসে কুহুকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “তাহলে ওর উপরও নিজের স্পেশালিটি কাজে লাগিয়ে দেখান তো। তাহলে মেনে যাব।”
কুহুকে একটু আগে কোলে নিয়েছিলো কথন। সে কথনের চুল টেনে, খামচি দেওয়ার পর অবশেষে কান্না করে যায় অনুর কোলে। কথন কুহুকে দেখতেই দুই’পা পিছিয়ে যায়। ভীত গলায় বলে, “একদম না। কাব্য তো তাও শান্ত, কুহু একদম হয়েছে নিজের মা’য়ের মতো। জংলী। একচুয়ালি না, কুহু ওর মা’য়ের থেকে হাজারোগুণ বেশি শান্ত।”
কবিতা কাব্যের রিপোর্ট দেখছিলো। কথনের কথাটা শুনে সে একপলক তাকায় তার দিকে। তারপর চোখ সরিয়ে নেয়।

কথন কবিতাকে শুনিয়েই কথাটা বলেছিলো। দেখা হবার পর থেকে ঝগড়া হলো না তার কবিতার সাথে। দেখা হয়ছে বলে মনেই হয় না। তাকে কেমন যেন ঔদাস্য দেখাচ্ছে। তাকে আগের কবিতার মতো মনেই হয় না। যে সারাটাক্ষন হাসিতে মেতে থাকতো, মজা করতো, লাফালাফি করতো, অকারণে ঝগড়া করতো, রাগ হতো, অভিমান করতো। নানান অভিযোগ বলে বেড়াতো।
আজ এত বছর পর কবিতার সাথে দেখা হবার পরও তাকে ভীষণ অচেনা লাগছে। কথন অনুর পাশে বসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, “সিস্টা, তোমার বান্ধবীর কী এই কয়েক বছরে কোনো এক্সিডেন্ট হয়েছে?”
কথন আগের থেকেই অনুকে সিস্টা বলে ডাকে। সিস্টারের সংক্ষিপ্ত আকার করে।
কবিতার কানে কথাটি গেল। সে আবারও চমকে তাকায় কথনের দিকে।

“হঠাৎ এ-কথা কেন জিজ্ঞেস করছেন?” অনুও বিস্ময়ে বলল।
“আরে উওর দেও তো।”
“না। আল্লাহ না করুক ভবিষ্যতেও এমন হোক।”
“তাহলে আমি নিশ্চিত কেউ আসল কবিতাকে লুকিয়ে নিজে এসে পড়েছে। এটা কবিতা হতেই পারে না। ওর তো মাথায় সারাক্ষণ কখন কাকে কীভাবে কার মাথা খাব তাই ঘুরতো।”
“আমি মোটেও কাওকে জ্বালাতাম না।” কবিতা প্রতিবাদ করে বলে। তার কথা শুনে হাসে কথন। আজ দেখা হবার পর প্রথমবার কবিতা নিজ থেকে তার সাথে কথা বলল। তার চুপচাপ কবিতাটি ভারী অপছন্দ হলো। সে যেন এই কবিতাকে চিনেই না। এই উদাসীনতা তার চেনা কবিতার আশেপাশেও ছিলো না। সে সারাক্ষণ হাসতো, খেলতো, সবার মন জুড়িয়ে রাখতো। তার সে কবিতার এই অবস্থা হতে পারে সে কল্পনাও করে নি।

কথন বলে, “একদম জ্বালাতে। বিশেষ করে আমাকে জ্বলাতন করতে তুমি পৈশাচিক আনন্দ পেতে।”
“এমন কিছু না। আমি নিতান্তই শান্তশিষ্ট মেয়ে ছিলাম।”
“শান্তশিষ্ট! ওহ মাই আল্লাহ, এত বড় মিথ্যা বলার আগে একটুও বুক কাঁপে নি তোমার?”
কবিতা কিছু মুহূর্ত সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কথনের দিকে। তারপর ফিক করে হেসে দিলো। শব্দ করে হেসে উঠে সে।
অনু হতদম্ব। কবিতাকে সে কত বছর পর এমন মন খুলে হাসতে দেখছে তার মনে নেই। কবিতাকে এভাবে হাসতে দেখে অনুর ঠোঁটের কোণেও হাসি ফুটে উঠে, সাথে চোখে জমে যায় খুশির জল।

কবিতা উঠে দাঁড়ায়। কথনকে বলে, “আপনারা বসে গল্প করেন। বাচ্চাদের খাবার সময় হয়ে গেছে। আমি কিছু খাবার নিয়ে আসছি।”
কবিতা উঠে যাওয়ার পরে কথনও তার পিছনে ছুটে যায়। তার সাথে হেঁটে যায় এবং বলে, “তুমি অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছ।”
“এখন দুই বাচ্চার মা হয়ে গেছি। এখনো বাচ্চামি করবো বলছেন?”
“স্বভাবের সাথে বয়সের কী সম্পর্ক? বয়সের জন্য জোর করে নিজেকে পরিবর্তন হয়ে যেতে হবে একথা কে বলল তোমায়?”
কবিতা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। উত্তর দিল না কথনের প্রশ্নের। কথন আবারও জিজ্ঞেস করে, “তোমার পরিবার কেমন আছে? আংকেল, আন্টি, কবির ভাইয়া, আবির ভাইয়া সবাই? তোমার ভাইদের বিয়ে হয়ে গেছে।”
পরিবারের কথা শুনে বুকে কম্পন উঠে যায় কবিতার। আজ কতবছর তাদের দেখে না। তার বাবা এবং আবির ভাইয়ার সাথে ভিডিও কলে মাঝেমধ্যে দেখা হলেও তার বড় ভাই ও মা’কে দেখাই হয় না। তারা শত তার বুকে আঘাত দিক। সব শেষে তার পরিবার হয় তারা। তার একজীবন যাদের সাথে কেটেছে আজ তারাই অচেনা হয়ে গেল।

কবিতা ব্যাপারটা জানাতে চাইলো না কথনকে। তাই কথা ঘোরানোর উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল, “আপনি বিয়ে করেছেন? আপনার তো স্বপ্ন পূরণ হলো। এখন নিশ্চিত কাওকে জীবন সাথী বানিয়েছেন। নাম কী তার?”
কথন গভীর দৃষ্টিতে তাকায় কবিতার দিকে। মনে মনে ভাবলো, “তোমাকে জীবন সাথী বানাতে চেয়েছিলাম তো কিন্তু তুমি আমাকে চাও নি, আমার এখন অন্যকাওকে চাওয়ার মতো সাধ্য নেই।”
“উওর দিলেন না যে।” কবিতার কথায় ঘোর ভাঙে কথনের। সে হেসে বলে, “হয় নি। এই কাজেই ব্যস্ত ছিলাম।”
“বলেন কী? এত বছরেও কাওকে মনে ধরে নি?”
“ধরেছিলো তো। কিন্তু সে এখন অন্যকারো জীবনসাথী। তারপর আর কাওকে মন দিতে পারি নি, আমার মনটা ওর কাছেই বন্দী রাখা।”
“এমন তো না যে আপনার আগে সম্পর্ক ছিলো না। সে সম্পর্ক থাকার পর যেহেতু অন্যকাওকে মনে ধরেছে তাহলে আবার চেষ্টা করুন। পারবেন। যে নেই, তার অপেক্ষা করে কি লাভ?”
“ভালোবাসা লাভ ক্ষতি দেখে হয় না’কি? আর রইলো অপেক্ষার কথা, আমি তার জন্য অপেক্ষা করছি না। সে এখন অন্যকারো। তাই ঠিকই অহেতুক অপেক্ষা করার মানে হয় না, কিন্তু আমার কি মনে হয় জানো? আমি অন্যকাওকে আর ভালোবাসতে পারব না। পারব না বললেও ভুল হবে, অন্যকাওকে ভালোবাসার ইচ্ছা নেই। আমাদের জীবনে এমন এক মানুষ আসে, যাকে ভালোবাসার পর আর কাওকে ভালোবাসতে ইচ্ছা করে না।”

কবিতা বিস্ময় নিয়ে তাকাল কথনের দিকে। কথাটা নিয়ে সে আগে ভাবে নি। সত্যি, জীবনে এমন এক মানুষ আসে, যাকে ভালোবাসার পর অন্য কাউকে ভালোবাসতে ইচ্ছা করে না। এই’যে সে তার সংসারে অখুশি। তীর্থের অবহেলা তাকে প্রতিদিন পীড়ার অনুভব করায়। তার হৃদয় জ্বলে, পুড়ে, যন্ত্রণায় ভরে যায়। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে মরে যেতে। তবুও তীর্থকে ছাড়া অন্যকাওকে ভালোবাসতে ইচ্ছা হয় না তার। কবিতা মৃদু হাসে কথনের দিকে তাকিয়ে। আর বলে, “সত্যি বললেন, হাজারো দুঃখ বুকে ভরে হলেও তাকেই এই বেহায়া মন ভালোবাসবে।”

কথন এবার জিজ্ঞেস করে, “তোমার স্বপ্নের কথায় মনে পড়লো, তোমার পড়াশোনা তো আগেই শেষ হয়ে গেছে তাই না? না’কি এখনো চলছে? বাই দ্যা ওয়ে বাচ্চাদের সামলে কিভাবে নিজের পড়াশোনা অথবা কাজ সামলাও? আমিও কি ভাবছি, নিশ্চয়ই তীর্থ এবং তার পরিবার সাহায্য করে। বাই দ্যা ওয়ে আপাতত কী করছ?”
খুবই ইতঃস্তত বোধ করলো কবিতা। মাথা নিচু করে উত্তর দিলো, “আসলে কাব্য হওয়ায় আমি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছি।”
কথন চমকে উঠে। সেখানে দাঁড়িয়ে পড়লো সে।
“হোয়াট! তুমি কী করেছ? মানে তুমি অনার্স ছেড়ে ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়েছ তাই তো?”
কবিতাও দাঁড়িয়ে পড়ে তার সাথে। সে মাথা নাড়িয়ে মৃদু স্বরে বলে, “আমি আসলে পড়া ছেড়ে দিয়েছি।”
“তোমার মাথা ঠিক আছে কবিতা? পড়াশোনা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তুমি জানো? অন্যকারো জন্য নয়, তোমার জন্য। আর তোমার স্বপ্নের কী?”
কবিতার অস্বস্তি লাগছিলো এই বিষয়ে কথা বলতে। সে ভালো করেই জানে পড়াশোনা তার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার স্বপ্ন তার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। কিন্তু তা অতীত। এখন তার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার পরিবার, তার সংসার। কিন্তু কেন যেন কথাটা কথনকে বলতেও তার লজ্জা লাগছে।

কথন আবারও জিজ্ঞেস করে, “তুমি আমাকে ওয়াদা করেছিলে তার কী? আমি কেবল আমাদের বিয়ে এই শর্তে ভেঙেছি যে তুমি নিজের স্বপ্ন পূরণ করবে।”
কবিতা কোন উত্তর দিলো না। কথন ধারণা করতে পাড়লো কবিতা এই প্রশ্ন উওরে স্বস্তিবোধ করছে না। এটা স্বাভাবিকও। কথনের কোনো অধিকার নেই কবিতার থেকে উওর চাওয়ার। তার এমনভাবে প্রশ্ন করারও কোনো অধিকার নেই। আর তার এমন রুক্ষভাবে কথা বলারও অধিকার নেই। তবুও সে আরেকটি প্রশ্ন করে। তবে এবার শান্ত কণ্ঠে, “কারণটা কি শুধু কাব্য ছিলো?”
কবিতার মাথা ঝুঁকানো। সে মুখে উওর দিলো না। কেবল মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ উওর দিলো।
উওর পেয়ে কথন বলে, “তুমি জানো আমার ছোট বোন ডিলেভারি হবার ঠিক আগে তার পরীক্ষাগুলো দিয়েছিলো। তার শেষ পরীক্ষা হবার ঠিক একদিন পর ওর ডিলেভারি হয়। তুমি প্রয়োজনে একবছরের গ্যাপ নিতে পারতে। তোমার সাথে তোমার পরিবার ছিলো, তীর্থ ছিলো। তারা খেয়াল রাখতে পারতো কাব্যের।”

কবিতার বুক চিরে বের হয় আফসোসের নিশ্বাস। তার কথন কেউ বলতে ইচ্ছে করছিল, “কেউ ছিল না আমার সাথে। অবশ্যই তীর্থ ছাড়া। কিন্তু সেও একসময় আমাদের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তার কাছেও সময় থাকে না। আমার পরিবার তো আগের থেকেই ছিলো না। যে পরিবারে এসেছিলাম সে পরিবারের জন্যই হয়তো আমার স্বপ্ন বিসর্জনে গেল। আমি এ কয়েকবছর কীভাবে কাটিয়েছি কেবল আমিই জানি এবং আমার আল্লাহ জানে। আর কেউ দেখে নি, বুঝে নি, সহ্য করে নি। আপনার বোন ভাগ্যবান হতে পারে, আমি না।”
কথাগুলো সে বলল না। সে হাসলো। উদাসীন হাসি। কথনের দিকে তাকিয়ে বলল, “হয়তো আমি আপনার বোনের মতো সাহসী না। আমি একটা জিনিস বুঝেছি, কী জানেন? স্বপ্ন কখনও এক থাকেনা। আপনি যা জানতেন তা এক যুবতীর স্বপ্ন ছিলো। এখন আমি নতুন স্বপ্ন দেখছি। আমার স্বপ্ন হলো আমার বাচ্চারা অনেক ভালো মানুষ হবে। তারা তাদের সকল স্বপ্ন পূরণ করার যোগ্যতা রাখবে। যা আমি পাই নি আমার সন্তানরা তা সব পাবে। এটা একটি মা’য়ের স্বপ্ন।”
কথন কিছু মুহূর্ত গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কবিতার দিকে।

“কবিতা…” শীতল, গম্ভীর গলা শোনা গেল। সে পুরুষালী কন্ঠটি শুনে দুইজনে তাকাল সামনে। তীর্থ দাঁড়ানো। তীর্থ তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করে কবিতাকে, “কাব্য এখন কেমন আছে?”
কবিতা বাসার বাহিরে কোনো তামাশা করতে চাইলো না। তাই স্বাভাবিক গলাতেই উওর দিলো, “আগের থেকে ভালো।”
“যাক ভালো।” তীর্থ কথনের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসে। জিজ্ঞেস করে, “অনেকবছর পর দেখা হলো। কেমন আছেন?”
“ভালো, আপনি?”
“আমিও ভালো। এতবছর কোথায় ছিলেন?”
“বাহিরের দেশে ছিলাম। দুইমাস হলো এই হাস্পাতালে জয়েন হলাম।”
“ওহ কবিতার সাথে আজ আপনার হাস্পাতালে দেখা হয়েছে?” তীর্থ কবিতার কাঁধে হাত রেখে তাকে নিজের দিকে টেনে জিজ্ঞেস করে কথনকে। কথন দুইজনকে এতটা কাছে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মুখটা উদাসীন হয়ে আসে তার। বুকের ভেতর চিনচিন ব্যাথা করতে শুরু করে। দেহের অঙ্গে অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে বিষন্নতা। সে সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নেয়। এ ঢোক গিলে বলে, “হুম, ভাগ্যক্রমে দেখা হয়ে গেলো। আচ্ছা আপনি যেহেতু এসেছেন কবিতার সাথে যেয়ে কাব্যকে দেখে আসেন। কবিতা, আমি তোমাদের জন্য খাবার পাঠাচ্ছি। আর এখন আমার ডিউটি আছে কিন্তু ফাঁকে ফাঁকে দেখে যাব কাব্যকে। আসি।”
কথন আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়ালো না। চলে গেল।

কথন যাওয়ার পরে কবিতার সাথে সাথে তীর্থের কাছ থেকে সরে যায়। সে যেতে নিলেই তীর্থ তার হাত ধরে নেয়, “কবিতা আমার কথা তো শোনো…”
কবিতা তীর্থের কথা শুনেনা। এক ঝাড়ন মেরে তার হাত সরিয়ে দেয়। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “আমি এখানে কোনো তামাশা করতে চাই না। আমি আগেও বলেছি, আমাকে ছোঁয়ারও প্রয়োজন নেই। আমি অনেক সহ্য করেছি তোমার এসব কাহিনী। আর না। তুমি তোমার কাজ নিয়ে থাকো। তোমার যা ইচ্ছা তা করো। আমার কিছু আসে যায় না। আজ থেকে তুমি তোমার মতো থাকবে, আমি আমার মতো।”
বলেই সে চলে গেল। তীর্থ তার পিছনে যেয়ে কিছু কথা বলতে চাইলো। বিশেষ লাভ হলো না। কবিতা তার কোনো কথাই শুনে না।

কাব্যকে পরেরদিনই বাসায় আনা হয়। তার শরীর আগের থেকে ভালো। কবিতা এখন পর্যন্ত তীর্থের সাথে ভালোভাবে কথা বলে নি, ক্ষমা করা তো দূরের কথা।
এই ক’দিন ধরে তীর্থ সব থেকে বেশি তার পরিবারকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তার মনে হচ্ছে তার পরিবার ছুটে যাচ্ছে তার হাত থেকে। এ কারণে সে তার মামাকে বলে নিজের মা’কেও গ্রামে আরও ক’দিন রাখতে বলল। আগে কবিতা মেনে যাক তারপর আসতে বলবে তাকে। কেননা তীর্থ ভালো করেই জানে। তার মা আসলে তাদের মাঝে ভেজাল ছাড়া কিছু বাড়বে না।

অন্যদিকে বিয়ে হয়ে গেছে মৃণা এবং আইদের। একমাস হয়ে এলো তাদের বিয়ের। আইদের কাছে বিয়েটা স্বাভাবিক মনে হলেও মাঝেমধ্যে তার মৃণার ব্যবহার অন্যরকম লাগে। এমন না যে মৃণা আগে তার সাথে ভালো ব্যবহার করতো। কিন্তু যত সময় যাচ্ছে তার সাথে মৃণার ব্যবহারটা বাজে হয়ে যাচ্ছে। এখন তো তার পরিবারের সাথেও ভালোভাবে কথা বলছে না মৃণা। আজ বাসায় আসতেই তার মা নালিশ জানাল, মৃণা তার রুম থেকে বের হয় না। কাজ তো দূরের কথা, একটু এসে কথা বার্তাও বলে না। এতে আইদের মা ভীষণ নারাজ। আইদ তাকে বুঝাল, মেয়েটা নতুন ঘর সংসারে এসেছে। এডজাস্ট হতেও সময় লাগে। এখনো এই নতুনত্ব মেনে নিতে পারি নি। তুমি আদর করো, ও ঠিকই তোমার সব কথা মানবে। মা’কে বুঝিয়ে রুমে যায় আইদ। মৃণাকেও বিষয়টা বুঝাতে হবে। সে একপক্ষে কথা বলতে পারবে না। তার নিজের মা’য়ের এবং মৃণার দুইজনের মাঝেই ভারসাম্যতা বজায় রাখতে হবে।

আইদ রুমে এসে দেখে মৃণা মোবাইলে কিছু একটা দেখছে। আইদ হাসি মুখেই ঢুকে রুমে। সে মৃণার জন্য একটি বেলি ফুলের মালা এনেছিলো। রুমে ঢুকেই সে যেয়ে বসলো মৃণার পাশে। বলল, “বলতো তোমার জন্য কী এনেছি?”
মৃণা বিরক্ত নিয়ে একপলক তাকায় আইদের দিকে। তারপর চোখ নামিয়ে বলে, “স্বর্ণ রূপা আনার তো তোমার সামর্থ্য নেই। প্রতিদিনের মতো ফুল বা চকোলেট এনেছ।”
আইদ কষ্ট পেল মৃণার কথায় কিন্তু মুখে তা বুঝতে দিলো না। সে বুঝে মৃণা মুখে যতই কটুকথা বলুক না কেন, তার মনটা পরিষ্কার। সে তার পিছন থেকে একটি বেলিফুলের মালা বের করে বলল, “তোমার জন্য।”
মৃণা আইদের হাতের থেকে ফুলে মালাটি নিয়ে পাশে রেখে দিলো। আবারও মনোযোগ দিলো নিজের ফোনে।

তার উপহারটা এমন অযত্নে রেখে দিতে দেখে আইদের মন খারাপ করে কিন্তু অবাক হয় না। মৃণা আজকাল প্রায় এমনই করে। সে নরমসুরে বলে, “মৃণা কথা ছিলো।”
“বলো, শুনছি।”
“আসলে মা বলছিলো তুমি না’কি রুম থেকে বাহিরে বের হও না। এমন করা তো ঠিক না।”
মৃণা যেন ঝগড়া করার জন্য প্রস্তত ছিলো। আইদ কথাটি বলতে না বলতেই সে তার গলা চড়িয়ে বলে, “তো তোমার কী ইচ্ছা আমি চাকরানীর মতো সারাক্ষণ তোমার ঘরের কাজ করে বেড়াব?”
এবার আইদের দৃষ্টি সরু হলো, “এভাবে বলছো কেন মৃণা? একতো আমি বলছিলাম যেন তুমি মায়ের সাথে যে টুকিটাকি কথা বলো। আর তোমার বাসা তুমি একটু কাজ করলে চাকরানী হয়ে যাবে না। আর চাকরানী তো খারাপ কিছু না। তাদের নিজে এমন অসম্মান নিয়ে কথা বলো না। এছাড়া আমি নিজেও অফিসে যাবার আগে এবং আসার পর টুকটাক কাজ করি বাসার, এতে কী আমার অসম্মান হয়?”
মৃণা ভারী বিরক্ত হয় আইদের কথায়। সে উঠে যেতে নেয় সেখান থেকে। কিন্তু উঠে দাঁড়াতেই তাই মাথা ঘুরানি দেয়। সাথে সাথে সে বসে পড়ে বিছানায়।

আইদ আতঙ্কিত হয়ে যায়। সে মৃণার সামনে বসে বলে, “তুমি… তুমি ঠিক আছো মৃণা? কী হয়েছে তোমার? তুমি ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করো নি আজ? আমি এখনই পানি নিয়ে আসছি।”
আইদ ছুটে যায় পানি আনতে। মৃণার হঠাৎ বুক জ্বলতে শুরু করে। সেও উঠে দৌড় দেয় বাথরুমে। খুব বমি বমি ভাব আসে তার কিন্তু বমি হয় না। সে না পেরে বেসিন ধরেই দাঁড়িয়ে থাকে কিছু মুহূর্ত। একটু আগেও সে ভালো ছিলো, হঠাৎ কী হলো সে বুঝলো না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে যেতে নিলেই তাই মনে পড়ে তার গত দুইমাস ধরে পিরিয়ড হয় নি। বুকের ভেতর কিছু একটা যেন কামড়ে ধরে। সে আশ্চর্য হয়ে নিজের পেটের উপর হাত রাখে। সে কী প্রেগন্যান্ট? তীর্থের অংশ তার গর্ভে? আইদ আজ পর্যন্ত তার কাছে আসে নি, তাই যদি সে প্রেগন্যান্ট হয় তাহলে নিশ্চিত এই সন্তান তীর্থের।

ব্যাপারটা মাথায় আসতেই নিজের উপর রাগ উঠে মৃণার। এই ব্যাপারটা সে একমাস আগে জানলেও আজ আইদের সাথে এই ছোট ঘরে তার সংসার করতে হতো না। আচ্ছা যা হয়ে গেছে তা তো পাল্টানো সম্ভব না। কিন্তু তীর্থ এই সন্তানের কথা জানলে কী তার কাছে ফিরে আসবে?

চলবে…

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here