মুহুর্তে পর্ব -২৭+২৮

#মুহূর্তে
পর্ব-২৭
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

জানালার ফাঁক থেকে তীব্র রশ্মি চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় তীর্থের। সে চোখ খুলে সর্বপ্রথম তার বুকে দেখতে পায় মৃণাকে। তার মনে পড়ে যায় গতরাতের ঘটনা। মৃণার সে আবদারের দৃষ্টি দেখে সে নিজেকে আটকাতে পারে নি। যখন সে বলেছিলো, “আপনি আমার চোখে তাকান। আপনি এই চোখে আপনার প্রতি ভালোবাসা দেখতে পান না। আমি আপনার জন্য যেকোনো সীমানা লঙ্ঘন করব। সারা পৃথিবী ছেড়ে দিব। তবুও আপনি আমাকে নিজের থেকে দূরে পাঠাবেন না।”
তখন এক তীব্র আকর্ষণ তাকে কাবু করল। সে হারিয়ে গেল মৃণার মাঝে। কেন যেন আগের সব ভয় হাওয়ায় মিশে গেল। তার সংসারের সব অশান্তি মৃণার মাঝে হারিয়ে ফেলে সে।

ধ্রুবর কথাটা ঠিকই মনে হলো, কবিতা যেহেতু সংসারেই ব্যস্ত তাহলে কীভাবে জানবে মৃণার কথা। আর জানলেও, কবিতা চাইলেই তো তাকে ছেড়ে যেতে পারে না। অর্থনৈতিক দিক থেকে হলেও কবিতা তার উপর নির্ভরশীল। এবং অনুভূতির দিক থেকেও। তীর্থ জানে কবিতার মতো স্বাধীন চেতনার মেয়ে একবার হলেও তার ছেড়ে যাবার কথা চিন্তা করতে পারে কিন্তু কাব্য এবং কুহুর মা কখনো তাকে ছেড়ে যেতে পারবে না। তাই আপাতত কবিতার চিন্তা সে আনতে চাইছে না। ভবিষ্যতে কিছু হলে ভবিষ্যতে দেখা যাবে। এখন বর্তমানে তার এই শান্তিটা ভালো লাগছে। মৃণার কাছে তার শান্তি পাবার বিশেষ এক কারণ আছে। সে তার প্রতিটি কথা মানে। সে কবিতাকে যতই ভালোবাসুক না কেন তার সবসময়ই আফসোস ছিলো যে কবিতার নিজের মতামতই তার কাছে সঠিক মনে হয়। মৃণার গুণটা কবিতার মাঝে থাকলে হয়তো আজ তার সংসারে এত অশান্তি হতো না।

সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মৃণাকে। ঘুম ভেঙে যায় মৃণার। সে নড়ে-চড়ে উঠে। নিভু নিভু চোখে তাকায় তীর্থের দিকে তাকায়। একগাল হাসে এবং বলে, “আজ আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সকাল।”
তীর্থ এর উওর দেয় না। মৃদু হেসে চুমু খায় মৃণার কপালে। মৃণা আবারও বলে, “আচ্ছা আমরা আরও দুইদিন এখানে থাকতে পারি না? শহরে গেলেই তো আপনাকে আমি আর সম্পূর্ণ নিজের করে পেতে পারব না। প্লিজ আরও দুইদিন থাকি এখানে?”
“তোমার পরিবারে সমস্যা হবে না?”
“আমি মানিয়ে নিব। আপনার কোনো সমস্যা হবে? মানে কবিতা কিছু বলবে?”
তীর্থ কবিতার নাম শুনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকে। তার বলে, “উঁহু, আমি কোনো বাহানা করে নিব।”
উওরটা শুনে একগাল হাসে মৃণা। অবশেষে সে যা চাইলো তাই পেয়ে গেল। আজ তার খুশির সীমানা নেই।
.
.
দেখতে দেখতে দেড় বছর কেটে যায়। সবার সম্পর্ক আগের মতোই চলতে থাকে। কেবল বিগড়ে যায় তো কবিতা ও তীর্থের সম্পর্ক। আগের মতো কিছুই থাকে না। কবিতা এই সম্পর্কের দুর্বলতা ভালোভাবেই টের পাচ্ছে। সে একসময় তার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করছিলো সম্পর্কটা ঠিক করার কিন্তু পারে নি। একতরফা তো আর সম্পর্ক হয় না।
কেবল তীর্থ বদলে গেছে। তার কাছে আগেও কম সময় ছিলো কবিতা এবং তার পরিবারের জন্য। এখন তা নেই বললেই চলে। রাতে দেরিতে আসে বাসায় এবং সকাল হতেই রওনা দেয়। ছুটির দিনেও তেমন বাসায় থাকে না। ভালোভাবে কোনদিন যে সে তীর্থের সাথে ভালোভাবে সময় ব্যয় করেছিলো তার মনেও নেই। এই বিষয় নিয়েই কথা হচ্ছিলো কবিতা এবং অনুর। অনুর আজ মাথা ব্যাথা থাকায় অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চলে এসেছে কবিতার বাসায়। তার শাশুড়ীও গ্রামের বাড়িতে ঘুরতে গেছে। তাই অনেকদিন পর দুই বান্ধবী একসাথে মন মতো গল্প করছে। কবিতা চা বানাচ্ছিলো অনুর জন্য। আর অনু একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। সে বলল, “তুই তীর্থ ভাইয়ার সাথে সরাসরি এই বিষয়ে কথা বললেই পারিস। এভাবে চুপ থাকলে তো হবে না। তোকে সময় দেওয়া তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।”
কবিতা মলিন গলায় উওর দেয়, “আমি চাই না ও দায়িত্ব ভেবে আমাকে ভালোবাসুক অনু। আমি জানি কিছু সম্পর্কের ভালোবাসা সময়ের সাথে সাথে বদলে যায়। তাই বলে এতটা? আর আমি নাহয় বাদ, আমার সাথে তো তাও ওর কথাবার্তা হয়। আমাদের বাচ্চার জন্য যদি ওর কাছে একটু সময় হতো। ওদের তো সম্ভবত মনেও নেই ওরা শেষ কবে ওদের বাবার সাথে খেলেছিলো। আমি নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করি ওদের মা বাবা দুইজনের ভালোবাসা দেবার কিন্তু বাবার জায়গা তো আলাদা তাই না? ওকে কিছু বুঝালেই ও ঝগড়া মনে করে। কি করব আমি?”
“তুই এইসব নিয়ে ভেবে নিজেকে আর কষ্ট দিস না তো। মানসিক চাপ পড়বে। এমনিতেই মুখের কি অবস্থা হয়েছে চিন্তা করতে করতে। এর উপর এতটা শান্ত হয়ে পড়েছিস। তুই এতটা শান্ত হয়ে যাবি আমি কল্পনাও করি নি। তোকে এভাবে ভালো লাগে না কবিতা। একটুও ভালো লাগে না।”
কবিতা উওর দেয় না অনুর কথায়। সে চা বানিয়ে এনে দেয় অনুকে।

অনু চা’য়ের কাপটা হাতে নিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “তোর ভাই যত যাই করুক না কেন কিন্তু তোর জন্য একটা ছেলে ভালো চুজ করেছিলো। কথনকেই শুধু আমার আগের থেকে তোর জন্য পছন্দ ছিলো। তুই ওর সাথে আজ বিয়ে করলে কিছুই হারাতে হতো না তোকে। আজ তুই যে মানুষটার জন্য সব ছেড়ে এসেছিস সে মানুষটাই তোকে অবহেলা করছে।”
“হঠাৎ এ-কথা বলছিস কেন?”
কবিতা ড্রইংরুমের দিকে রওনা দিলো। তার বাচ্চারা সেখানে টিভিতে কার্টুন দেখছে। তার সাথে এলো অনুও। কবিতা প্রশ্নের উওর দিলো, “জানি না। কিন্তু আমার সবসময় মনে হতো কথন তোর জন্য পার্ফেক্ট চয়েস। তীর্থ ভাইয়ার চোখে আমি তোর জন্য অনেক ভালোবাসা দেখেছি কিন্তু তবুও আমার কথনকেই তোর জন্য সঠিক মনে হয়েছে। যেভাবে সে তোকে তোর স্বপ্নের জন্য উৎসাহ দিতো, তুই ভুল করলে বোঝাত, কোনো ভুল বুঝাবুঝি হলে সরাসরি কথা বলতো, তোর সম্মান রক্ষা করতো, সবটাই। আমার মনে হয় কি জানিস? শুধু ভালোবাসলেই হয় না, জীবন কাটানোর জন্য ভালোবাসার থেকেও বেশি কিছু প্রয়োজন। জীবনে আবেগ প্রয়োজন, ভালোবাসা প্রয়োজন কিন্তু এই দুটো জিনিস দিয়েই না জীবন চলে আর না সংসার। সময়, সম্মান, একে অপরের মধ্যে বুঝাবুঝি, বিশ্বাস করা এসবও প্রয়োজন, নাহলে ভালোবাসায় ফাঁটল ধরতে সময় লাগে না। কেবল ভালোবাসলেই হয় না। ভালোবাসা ধরেও রাখতে হয়।”
“যা হয় নি তা নিয়ে তর্ক করে লাভ কি? কথনের সাথে বিয়ে হলেই যে আমি সুখে থাকতাম এরও তো গ্যারান্টি নেই। আর কেবল তীর্থের দোষ দিয়েও লাভ নেই, আমি নিজেও তো ওকে সময় দিতে পারি না। বাচ্চারা বড় হয়ে যাচ্ছে, ওদেরও খেয়াল রাখতে হয়।”
কথাটা শুনে অনু কবিতার সামনে এসে দাঁড়ায়, “এক কাজ কর, আজ আগের মতো সেজেগুজে যা তীর্থের অফিসে। তোকে দেখেই আবার পাগল হয়ে যাবে।”
“আরও কিছু? বাচ্চারা আছে না?”
“ওদের আমি দেখছি।”
“কিন্তু তোর মাথা ব্যাথা তো।”
“তোর হাতের চা খেয়ে আমার মাথা ব্যাথা ছুঁ মন্তর হয়ে যাবে। তুই যা।”
“কিন্তু… ”
“আমি বলছি তো যা। আমি সব সামলে নিব।”
কবিতাও এই ব্যাপারে চিন্তা করে রাজি হয়ে যায়।
.
.
মৃণা হাওয়ার বেগে ঢুকে তীর্থের কেবিনে, “আপনি জানেন কী হয়েছে আজ?”
তীর্থ কাজ করছিলো। মৃণার কথা শুনে আড়চোখে একবার তার দিকে তাকিয়ে আবার কাছে ধ্যান দিলো। জিজ্ঞেস করল, “না বললে কীভাবে জানব?”
“আব্বা আমার বিয়ে দেবার জন্য পাগল হয়ে গেছে। বলেছে অনার্সের এক্সাম শেষ হতেই বিয়েটা দিয়ে দিবে।”
এইবার তীর্থ ধ্যান দিলো মৃণার কথায়। ভ্রু কুঁচকে বলল, “এক্সাম তো শুরু হলো কয়দিন আগে। হঠাৎ বিয়ের কথা তুলছে কেন?”
“জানি না। তারা সবাই পাগল হয়ে গেছে। এখন আপনারই কিছু করতে হবে। আসুন না আমরা বিয়ে করে ফেলি।”
“বিয়ে? তুমি পাগল? আমি অলরেডি বিবাহিত। আমার বউ বাচ্চা আছে।”
“আমি কি বলেছি না’কি তাদের ছেড়ে দিন? আমি বলছি আমাকে বিয়ে করুন। আমি আলাদা থাকব। সমস্যা কোথায়? আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি। আপনাকে না পেলে আমি মরে যাব কিন্তু।”
গভীর নিশ্বাস ফেলে তীর্থ। একটা ডেবিট কার্ড বের করে মৃণার সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল, “যেয়ে কিছুক্ষণ শপিং করো। মাথা ঠান্ডা হবে, ঠান্ডা হলে কথা বলব।”
“ফাইজলামি করছি আমি? আমি সিরিয়াস। সত্যিই আমার বিয়ের কথা চলছে।”
তীর্থ উঠে দাঁড়ায়। মৃণার দিকে এগিয়ে যেয়ে বলল, “বললাম তো, আগে মাথা ঠান্ডা করো। তারপর কথা বলব।”
“আমি এখনই কথা বলব। এখন বলতে এখন।”

এমন সময় দরজা থেকে শব্দ এলো, “আসবো?”
তীর্থ কবিতাকে দেখে চমকে উঠে। কবিতা এখানে কী করছে? সে তো কবিতাকে আগেই অফিসে আসতে মানা করেছিলো। এখনই সে মৃণার কাছে যেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতো। ভাগ্যিস! কিছু সময়ের জন্য বেঁচে গেল। সে একপলক তাকাল মৃণার দিকে। মৃণা সাথে সাথে তার চোখ মুছে একটি ফাইল হাতে নিলো।

কবিতা রুমের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বলল, “তোমরা কী কাজ করছিলে? ডিস্টার্ব করলাম কী?”
তীর্থ রুক্ষ স্বরে বলে, “তুমি নক করে আসতে পারলে না?”
কবিতার হাসিমুখটা মলিন হয়ে আসে, “আগে তো কখনো নক করে আসতাম না তাই….”
কবিতা সম্পূর্ণ কথা শেষ হবার অপেক্ষাও করে না তীর্থ। আবারও প্রশ্ন করে, “হঠাৎ কেন এলে?”
“খাবার নিয়ে এসেছি। ভাবলাম তোমার পছন্দের খাবার রান্না করেছি। তোমার জন্য নিয়ে আসি।”
“এখনো লাঞ্চ ব্রেক তো অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে কবিতা। আচ্ছা তুমি একটু বাহিরে যেয়ে বসো আমি একটু কাজ শেষ করে ডাকছি তোমাকে।”
কবিতার বুকের ভেতর তীব্র যন্ত্রণা হলো। তীর্থের এমন ব্যবহারে সে যতটা না অপমানবোধ করল, তার থেকে বেশি কষ্ট পেল। তার হঠাৎ করে প্রচুর কাঁদতে মন চাইছে। তার চোখে এসে জমেছে পানি। কিন্তু সে কিছু বলল না। মাথা নামিয়ে একরাশ অভিমান নিয়ে চলে গেল।

কবিতার যাওয়া দেখে মৃণার হৃদয়ে অদ্ভুত এক আনন্দ হলো। দেড় বছর আগে কবিতার জন্য তীর্থ এমন কটু ভাবে মৃণার সাথ্ব কথা বলেছিলো। এখন সময় বদলেছে। মৃণাও এখন তীর্থের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভাবলেই এই বিষয়টা তাকে অদ্ভুত আনন্দ দিলো। তার মন খারাপটাই একটু ভালো হলো। সন্তুষ্ট হলো সে।

সে উঠে সাথে সাথে জড়িয়ে ধরে তীর্থকে, “আমি জানি আপনি আমাকে ভালোবাসেন। তাহলে আমাকে আপন করতে সমস্যা কোথায়?”
“কী করছ তুমি? কবিতা মাত্র এখানে এসেছে। ও এভাবে আমাদের দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।” তীর্থ মৃণার কাছ থেকে নিজেকে সরালো।
“আপনি শুধু আমাকে বলেন। আপনি আমাকে বিয়ে করবেন কি’না?”
“আমার অলরেডি বিয়ে হয়ে গেছে।”
“তো কি? আমি যদি আপনাকে ভালোবেসে কবিতাকে মেনে নিতে পারি তাহলে সে কেন পারবে না?”
তীর্থ মৃণার গালে হাত রেখে শান্ত গলায় বলল, “এই বিষয়ে নিয়ে আমি ভাববো। পরে কথা বলব। তুমি আজ যাও। নেও এই কার্ডটা নিয়ে যাও। কিছুক্ষণ শপিং করো, মন ভালো হয়ে যাবে।”
“আপনি সত্যি এই বিষয় নিয়ে ভাববেন তো?”
“হুম।” তীর্থ মাথায় নাড়ায়।
মৃণা ডেবিট কার্ডটা তীর্থের হাত থেকে নিয়ে যায়। যাবার পর তীর্থ মাথায় হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। একগ্লাস পানি খেয়ে ডাকে পিওনকে। পিওন আসলে বলে, “শুনো তোমার মেডাম এসেছিলো না? তাকে ডাকো।”
“মেডাম? সে তো আসার পর পরই চলে গেছে। যাওয়ার আগে বলল ধ্রুব স্যারের কাছে আপনার জন্য কিছু রেখেছে। সময় পেলে নিতে যেতে।”
“ওহ আচ্ছা তুমি যাও।”

তীর্থ ধ্রুবর কেবিনে ঢুকে দেখে সে সোফায় হেলান দিয়ে খাবার খাচ্ছে। তীর্থকে দেখে সে দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল, “দোস্ত জোস ঘ্রাণ আসছিলো তাই তাই লোভ সামলাতে পারি নি।”
“কবিতা কখন গেল?”
“আসলো, এসে টিফিনবাক্স দিয়ে হাওয়ার বেগে চলে গেল। মুখ দেখে মনে হলো এখনই কান্না করে দিবে। কিছু হয়েছে?”
কবিতার কান্নার কথা শুনতেই তীর্থ অশান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “বলিস কী? কান্না করছিলো? আমি তো তেমন কিছু বলি নি। শুধু বলেছিলাম অপেক্ষা করতে কিছুক্ষণ।”
তীর্থ সাথে সাথে ফোন বের করে কবিতাকে ফোন দেবার জন্য। সে কয়েকবার কবিতাকে কল দিলো কিন্তু কবিতা কলই ধরে না। ধ্রুব একটি মিনি কেক এগিয়ে দিয়ে বলে “খাবারের সাথে এটাও নিয়ে এসেছিল। এখানে মেবি একটা চিরকুট আছে। ওহ আর আমি তোর কেক অর্ধেক শেষ করে দিয়েছি।

তীর্থ ধ্রুব দিকে ধ্যান না দিয়ে চিরকুটটা নিলো। সেখানে লেখা, “তীর্থ তুমি জানো আমার বাচ্চামি স্বভাবটা একটু বেশি। যা তোমার মাঝেমধ্যে অসহ্য লাগে। আমি বুঝি তাই আমি নিজেকে পরিবর্তন করছি কিন্তু আমি যত নিজেকে তোমার জন্য পরিবর্তন করছি আমার মনে হচ্ছে তুমি আরও আমার কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছ। আমি হয়তো তোমাকে খুব জ্বালাই, কিন্তু তোমার অবহেলা আমার সহ্য হয় না। একদিন আমি সম্পূর্ণ নিজেকে তোমার মন মতো করে নিব শুধু তুমি আমার আগের তীর্থ হয়ে যাও। আমার এই তীর্থ ভালো লাগে না। তার উপর কেন যেন আগের মতো ভালোবাসা আসে না। আমি আমার আগের তীর্থকে ফিরে পেতে চাই। দয়া করে ফিরিয়ে দিবে তাকে?”
তীর্থের বুক চিরে এক কাঁপা নিশ্বাস বের হলো। সে বসে পড়ে ধ্রুবর সামনের সোফাতে। মাথায় হাত রেখে কতক্ষণ বসে থাকে। তাকে দেখে ধ্রুব বলে, “আমি না ভুলে একটু তোর চিরকুট পড়ে নিয়েছি।”
তীর্থ এক পলক বিরক্তির দৃষ্টিতে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নিচে নামাল।
ধ্রুব বলল, “ভাই আমি তোকে বলেছিলাম ঘরের অশান্তি দূর করতে বাহিরে কোথাও মন দিতে। এর মানে এই না যে তুই সম্পূর্ণ মন বাহিরেই দিয়ে রাখবি। আমি বলছি,
এই অবস্থা থাকলে তোর সংসার টিকবে না।”
“তুই আমাকে বলেছিলি যে মৃণার সাথে সম্পর্কে জড়ালে ক্ষতি নাই। আর আজ দেড় বছর পর এই কথা বলছিস তুই?”
“তো আমি কি বলছি তোর সংসারে একটু সময় না দিতে। যাস্ট বলছি অন্যকোথাও টাইমপাস করতে।”
মেজাজটা প্রচন্ড বিগড়ে যায় তীর্থের, “তোর কথায় আমি মৃণার সাথে এই সম্পর্কে জড়ালাম, আমার জীবনে ভেজাল তৈরি করলাম আর তুই…”
“তুমি কি দুই বছরের বাচ্চা যে আমি যা বলব তাই করবা? নিজের ভুলের দায় নিজে নেওয়া শিখ। আমি তোকে উপদেশ দিয়েছিলাম কিন্তু যা করেছিস তুই নিজে করেছিস। তুই একজনের সম্পর্ক সামলাতে পারলি না, আর আমি চার পাঁচজনের সাথে কথা বলেও তাহিরাকে নিজের সম্পূর্ণ সময় দেই। তুই নিজের জীবনে ব্যালেন্স না করতে পারলে আমাকে দোষ দিবি না। তোকে সম্পর্কে জড়িয়ে নিজের জীবনে শান্তি আনতে বলেছি, অশান্তি বাড়াতে না।”
“শান্তি আনব? আজ মৃণা বিয়ের কথা বলছিলো।”
ধ্রুবর কাছে যেন এই বিষয়টা ভীষণ স্বাভাবিক মনে হলো। তীর্থের এত চিন্তা দেখেও তার বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সে হেসেই বলল, “তো ছেড়ে দে। তোকে কে বলেছে ওর সাথে এত লম্বা সময় ধরে সম্পর্ক রাখতে। এমন মেয়ে একটা যাবে দশটা আসবে। কিন্তু তোর বউয়ের কথা তো ভিন্ন তাই না?”
“আমি মৃণার সাথে গভীর সম্পর্কে গেছি। শারীরিক সম্পর্কেও। তারপরও বলছিস ওকে ছেড়ে দিতে।”
“ইট’স নট আ বিগ ডিল ম্যান। আর তোর এতই খারাপ লাগলে কবিতাকে ছেড়ে দে, নাহলে এমন চলতে থাকলে ও নিজেই তোকে ছেড়ে দিবে। তুই যদি ওকে আর বাচ্চাদের সময় না দিতে পারিস তাহলে ওরা কেন তোর সাথে থাকবে ভাই?”
তীর্থ কিছুক্ষণ কঠিন দৃষ্টিতে ধ্রুবর দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সেখান থেকে উঠে গেল। বাহিরে যেয়ে আবারও কয়েকবার কল দিলো কবিতাকে। না পেয়ে ড্রাইভারকে কল দেয় সে।
“স্যার মেডামের কী আরও দেরি হইব?”
“দেরি হবে মানে? ও বাসার জন্য যায় নি?”
“মেডামে? কই স্যার আমি তো গাড়িতেই মেডাম আসে নাই।”
বুকের ভেতর মুচড়ে উঠে তীর্থের। সে আতঙ্কিত সুরে বলে, “ও আরও পনেরো মিনিট আগে বের হয়েছে। আসে নি মানে কী?”
“স্যার আশেপাশে খুঁজুম?”
“খুঁজো। আমিও আসছি।”
নিচে যেয়ে চারপাশে কবিতাকে খোঁজা হলো। পাওয়া গেল না কবিতাকে। না কবিতা ফোন ধরছে আর না কেউ বাসায় কল ধরছে।

.
অফিস থেকে বের হতেই তার চোখ দিয়ে পানি ঝরতে শুরু করে। সে যত তার চোখ মুছে ততই চোখের অবাধ্য জল বইতে শুরু করে। সে আর গ্যারেজে যায় না গাড়ি নিয়ে আসতে। একটি রিক্সা নিয়ে রওনা দেয় বাসার জন্য। অনু বাচ্চাদের বাহিরে ঘুরাতে নিয়ে গেছে এই কারণে বাসাটা খালি। সে বাসায় এসেই তার শাড়িটি খুলল। আজ তীর্থের পছন্দের সাদা শাড়িটি পরে গিয়েছিলো সে, তীর্থের ভালো লাগবে বলে। অথচ সে ফিরে এলো একরাশ বেদনা নিয়ে। তীর্থ বদলে গেছে তার ধারণা ছিলো, তবে এতটা!

অন্যকারো সামনে তার সাথে এমন রুক্ষভাবে কথা বলার আগে একবারও ভাবলো না সে? এত শখ করে আজ তীর্থের কাছে সে গিয়েছিলো আর তীর্থ এভাবে তাকে বের করে দিলো। তার থেকেও তীর্থের অন্যান্য কাজ গুরুত্বপূর্ণ? আগে তো এমন ছিলো না। আগে সে গেলে যেকোনো কাজ ছেড়ে দিতো সে কবিতার জন্য।

সে শাড়িটি খুলে বাথরুমে গেল। ঝর্ণা ছেড়ে কতক্ষণ শব্দ করে কাঁদলো। কতবছর পর এভাবে কান্না করেছে সে তার ধারণাই নেই। তার এত কষ্ট, এত যন্ত্রণা আজ বহুবছর পর জলের সাথে ভাসিয়ে দিলো সে। সে তার কষ্টগুলো অন্যকারো সামনে দেখাতে চায় না। বিশেষ করে তার বাচ্চাদের সামনে । তাদের জন্য এই পরিবারটি সুখী থাকা প্রয়োজন।

কলিংবেল বাজায় কবিতা ভাবলো অনু বাচ্চাদের নিয়ে ফিরে এসেছে। সে জলদি তার চোখ মুছে ড্রেস চেঞ্জ করে বেরিয়ে এলো। একের পর এক কলিংবেল বেজেই যাচ্ছে। কবিতা যেয়ে দরজা খুলে দেখতে যায় তীর্থকে।
তীর্থকে এই মুহূর্তে বাড়িতে দেখে সে খানিকটা অবাক হয়। কিন্তু কিছু বলে না। দরজা খুলে ফিরে যেতে নেয় তার রুমে। তখনই তীর্থ ভিতরে ঢুকে বলে, “তুমি কি পাগল? এভাবে কেউ না বলে আসে? আর ফোন কোথায় তোমার?”
কবিতা উত্তর দিল না। চুপচাপ নিজের রুমের দিকে যেতে নিল। তীর্থ কবিতার হাত ধরে নেয়, “আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি কবিতা।”
রাগে, কষ্টে, অভিমানে কবিতা চোখে পানি এসে পড়লো। তবে ফিরে চাইল না তীর্থের দিকে। কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল, “তুমি কাজ করছিলে তাই ফিরে এসেছি। আর ফোন ব্যাগে ছিলো দেখি নি।”
তীর্থ কবিতার পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে, “রাগ করেছ তুমি?”
কবিতা উত্তর দেয় না।
“সরি জান আর হবে না।” তীর্থ আবারো বলে।

কবিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “কত কিছুর জন্য সরি বলবে তুমি? জানো মানুষ যা সুখময় স্মৃতি দিয়ে যায় তা একসময় ঘোলাটে হয়ে আসে কিন্তু কষ্টগুলো….কষ্টগুলো চিরতর বুকের এককোণে থেকে যায়। আর তুমি আমাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছ তীর্থ। আমার কেন যেন তোমার কাছে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে।”
কবিতা তীর্থের দিকে ফিরে তাকায়। কবিতার চোখ লালচে হয়ে আছে। সাংঘাতিক ফোলা তার চোখ দুটো। তার ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গেছে। কবিতা এই অবস্থা দেখতেই তীর্থের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠে। সে অস্থির হয়ে কবিতার দুইগালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কাঁদছ কেন? প্লিজ কান্না করো না।”
কবিতা তার হাতদুটো সরিয়ে বলে, “একটা কথা বলো তো, তোমাকে ভালোবেসে কী আমি ভুল করেছি?”
তীর্থ যেন বড়সড় ধাক্কা খেল কবিতার কথাটা শুনে, “এসব কী বলছ তুমি? এই কথা তুমি কীভাবে বলতে পারলে?”
কবিতা দৃঢ় কন্ঠে বলল, “তুমি এতবছর আমার সাথে যা করেছ তা একবার ভেবে দেখ তারপর নিজে বিবেচনা করো আমি কি ভুল বলছি না’কি? আমার এখন তোমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে না।”
বলেই কবিতা রুমে যেতে নিলো। তীর্থ আবারও আটকায় কবিতাকে। তার মনে পড়ে ধ্রুবর কথা। না, কবিতাকে সে কিছুতেই হারাতে পারবে না। সে তার জীবন কল্পনাও করতে পারে না কবিতাকে ছাড়া। হাত ধরে টান দিয়ে সে কবিতাকে কাছে টেনে নেয়। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কবিতাকে। কবিতা তীর্থেকে ধরেও না, ছাড়েও না। সে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রয়।

তীর্থ কিছু বলতে চায়। কবিতাকে বিশ্বাস দেওয়াতে চায় তার উপর কিন্তু পারে না। সে নিজে তো জানে, সে কত বড় অন্যায় করেছে কবিতার সাথে। এরপর কীভাবে সে কবিতাকে কিছু বলতে পারে। তবুও বহু কষ্টে সে বলে, “আমি সব ঠিক করে দিব কবিতা।”
কবিতা এই কথাটা বিশ্বাস করতে চেয়েও পারে না।

সেদিন তীর্থ আর অফিসে যায় না। সারাদিন আগে পিছে ঘুরে কবিতার। বাচ্চাদের সাথে খেলে। পরেরদিনও অফিস থেকে জলদি এসে বাচ্চাদের সময় দেয়। কবিতা অবাকই হয় হঠাৎ তীর্থের এমন পরিবর্তন দেখে। তাই সেও স্বাভাবিক হয়ে যায় তীর্থের সাথে। দুইদিন পর হঠাৎ করে জ্বর আসে কাব্যের। প্রচন্ড জ্বর। কাব্য ছোট থেকেই একটু রোগা ধরনের। খুব জলদিই জ্বর আসে। এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু এইবার জ্বরটা একটু বেশিই আসে। কাব্যকে হাস্পাতালে নিয়ে যাবার কথা ছিলো সন্ধ্যায়। তীর্থ সকাল থেকে বাসায় থাকলেও দুপুরে একট কাজে তাকে অফিসে যেতে হয়। হঠাৎ করে গায়েব হয়ে যায় সে। এদিকে কাব্যর জ্বর বাড়তে থাকে। কাব্য স্বভাবতই শান্ত। কিন্তু সেদিন ব্যাথায় চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। ভাইয়ের এমন অবস্থায় ছোট কুহুও কান্না করতে থাকে। কবিতা কাকে ছেড়ে কাকে সামলাবে কিছুই বুঝতে পারেনা। তীর্থকে বারবার ফোন দেয় সে। কিন্তু তীর্থের কোনো খবর নেই। আজ তীর্থ তার সব সীমানা পাড় করে দিয়েছে। নিজের ছেলেকে এমন যন্ত্রণায় ছেড়ে কেউ হারিয়ে যায়?
কবিতার রাগে শরীর জ্বলছিলো। ড্রাইভারও আসে নি। তাহিরাকে ফোন দিবে সে সুযোগও নেই। ধ্রুব ও তাহিরা কক্সবাজারে ক’দিনের জন্য ঘুরতে গেছে। এমন অবস্থায় সে একাই বের হলো কাব্যকে হাস্পাতালে নিয়ে। মাঝ রাস্তায় অনুকে কল দিলো।

কাব্যকে হাস্পাতালে নিয়ে যাবার পর পরই তাকে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু এত তাড়াহুড়ার চক্করে সে কুহুর খাবার আনতেই ভুলে যায়। তাই ক্যান্টিন থেকে পানির এবং কেক কিনে সে কুহুকে খাওয়ানোর জন্য। মাঝরাস্তায় গলা শুকিয়ে যাবার কারণে সে পানির বোতল খুলে নিজেও একটু পানি পান করল। না দেখে হাঁটার কারণে কারও সাথে ধাক্কা লাগে তার। হাত হাতের পানির বোতল ও কেক সব নিচে পড়ে যায়। এমনিতেই আজ তার মেজাজ বিগড়ে আছে। এর উপর এমনটা তার মাথায় রক্ত উঠে যায়। সে চেঁচিয়ে উঠে, “চোখ নেই আপনার? দেখে হাঁটতে পারেন না? না’কি এখানে আসার সময় চোখ বাসায় রেখে আসছেন?”
কবিতা সামনে লোকটাকে না দেখেই মেঝের থেকে কেকের প্যাকেট এবং পানির বোতল উঠাতে শুরু করে। আবারও মেজাজ খারাপ করে বলে, “আপনার জন্য এখন আবার আমার বাহিরে যে জিনিস আনতে হবে। উফফ…. আজকের দিনটাতেই ঠাডা পরসে।”

“আমাদের দেখা হবার রীতিটা ভঙ্গ করলে না তুমি।”
কন্ঠটা শুনে একটু চমকে যায় কবিতা। আচমকায় মুখ তুলে তাকায় তার সামনের লোকটার দিকে। লোকটা ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি নিয়ে তার সামনে বসে আছে।
#মুহূর্তে
পর্ব-২৮
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

তীর্থ দ্রুত অফিসে এলো তার কাজ শেষ করার জন্য। কাব্য অসুস্থ থাকায় সে ভেবেছিলো আজ অফিসে আসবে না। কিন্তু শেষ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ পড়ে গেল। সে কাজটা করতেই হবে। তাই কাব্যকে ছেড়ে তার আসতে হলো অফিসে। সে যত দ্রুত সম্ভব কাজটা সেরে নিলো। আজ বাসায় যাওয়ার তাড়া আছে। কেবিন থেকে বের হবার পূর্বেই ফোন বেজে উঠে তীর্থের। মৃণা কল করছে। মেয়েটা অসময় কল করার অভ্যাস আছে। অকারণেই। তাই তীর্থ কল ধরে না৷ কিন্তু অফিস থেকে বের হয়ে গাড়িতে যাওয়া পথ পর্যন্ত সম্পূর্ণ রাস্তায় এক মুহূর্তের জন্যও তার ফোন বাজা বন্ধ হয় নি। গাড়িতে উঠে অবশেষে না পেরে তার কলটি ধরতেই হলো।

“কী হয়েছে মৃণা? এতবার কল কেন করছ?”
ওপাশ থেকে মৃণার কান্নাভেজা কন্ঠ ভেসে এলো, “তুমি আমার কল কেন ধরছিলে না তা বলো। আমি গতকাল রাত থেকে তোমাকে কল দিচ্ছি। তুমি জানো না আমার লাইফে কী চলছে? আমি যদি মরে টরে যাই তাও তো খবর পাবে না।”
“এসব কথা বলতে নেই। ওই কাব্য অনেক অসুস্থ তাই বাসায় ছিলাম। অফিসে একটু কাজের জন্য এসেছিলাম তাই ধরতে পারলাম। তুমি বলো কি হয়েছে?”
“তুমি আমার সাথে দেখা করতে আসো মিরপুরে। দেখা করে বলছি।”
“এইমাত্র বললাম কাব্য অসুস্থ, ওকে হাস্পাতালে নিয়ে যেতে হবে।”
“পরে নিয়ে যাবে। কিছুক্ষণ দেরি হলে তো তুফান আসবে না। তুমি এখনই আমার সাথে দেখা করো, নাহয় আমি কি করব জানি না।”
“আমি কাল পুরশু দেখা করছি তোমার সাথে।” বলে কল কেটে দিলো তীর্থ। গাড়ি চালিয়ে রওনা দিলো নিজের বাসার দিকে। মাঝরাস্তায় আবার তার ফোন বেজে উঠে। তীর্থ আবারও বিরক্ত হয়ে কলটা ধরে মৃণার।
“কী সমস্যা মৃণা বলেছি তো আগামীকাল দেখা করব।”
“হোয়াটসঅ্যাপে ক’টা ছবি দিয়েছি। দেখ।”
তীর্থের কথা বাড়াতে মন চাইলো না। সে রাস্তার একপাশে গাড়ি পার্ক করে হোয়াটসঅ্যাপ খুলে দেখল ছবিগুলো। সাথে সাথে নিজের চোখ ফিরিয়ে নিলো সে। মৃণার হাতে ব্লেড নিয়ে কাটা চিহ্ন। কাটা স্থানে রক্ত ভেসে আছে। সাথে হাত কাটার একটি ভিডিও দিয়েছে সে। এসব দেখে তার শরীর কেমন শিউরে উঠে। সে ফোন কানের কাছে নিয়ে চিল্লিয়ে বলে, “তোমার মাথা খারাপ? এসব কী করেছ তুমি?”
“তুমি যদি না চাও আমি হাতের রগ কেটে ফেলি, তাহলে এখনই দেখা করো।”
“তুমি….” দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে তীর্থ, “ঠিকাছে কিন্তু আমার জলদি এসে পড়তে হবে।”
তীর্থ গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো মিরপুরের দিকে।

মৃণাকে সর্বপ্রথম ফার্মেসিতে নিয়ে হাতে ব্যান্ডেজ করাল তীর্থ। তারপর এক রেস্টুরেন্টে বসে বলল, “এইবার বলো। এত কী জরুরী তলব আছে তোমার?”
“এই শুক্রবার আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। বিয়ের শাড়িও কেনা শেষ। আমি কি করব বুঝতে পারছি না। তুমি আমাকে কবে বিয়ে করছ?”
তীর্থ ভীষণ বিরক্ত। কিন্তু সে তার বিরক্তি প্রকাশ করল না। শান্ত গলায় বলল, “আমি বলেছি ভাববো। আমাকে সময় দেও একটু।”
“সময়-ই তো নেই। এই শুক্রবার মানে বুঝতে পারছ? মানে আর চারদিন বাকি। তীর্থ সত্যি করে বলো তো। তুমি আমাকে ভালোবাসো না? ভালোবাসলে বিয়ে করতে সমস্যা কোথায়?”
প্রশ্নটা শুনে একটু হকচকিয়ে যায় তীর্থ। আজ পর্যন্ত সে মৃণাকে বলে নি সে তাকে ভালোবাসে। কিন্তু তাদের সম্পর্ক জড়ানোর পর মৃণার এই ধারণা করাটা স্বাভাবিক।
তীর্থ একটু কেশে উঠে দাঁড়াল। বলল, “আমি ওয়াশরুম থেকে একটু আসছি।” বলেই চলে গেল।

মৃণা মেজাজ গরম করে সেখানে বসে রইল। রাগে ফুলছিল সে। এমন সময় তীর্থের ফোন বেজে ওঠে। ফোনটা তীর্থ টেবিলে রেখে গেছে। মৃণা ফোন হাতে নেয়। কবিতার নাম ফোনের স্কিনে দেখে ভীষণ বিরক্ত হয় সে। তার মেজাজ আরও গরম হয়। সে সাথে সাথে ফোনটা কেটে ফোন ফ্লাইট মোডে রেখে দেয়।

কিছুক্ষণ পর তীর্থ এসে মৃণাকে বলে, “মৃণা আমরা আগামী কাল কথা বলি? আজ আমার যেতে হবে।”
“আচ্ছা তোমার কাছে কি আমার কোন মূল্য নেই? এদিকে আমার জীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আর তোমার যেতে হবে?”
“কাব্য অসুস্থ।”
“কবিতা আছে তো ওর কাছে। আমার কাছে তো তুমি ছাড়া কেউ নেই।”
মৃণা তীর্থের হাত ধরে নিলো। আবদারের সুরে বলল, “প্লিজ তুমি এভাবে আমাকে একা ছেড়ে দিও না। আমি কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার আইদের সাথে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছা নেই। আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কারো সাথে সংসার করার কথা চিন্তাও করতে পারিনা।”
“তুমি চাও আমি তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাই?”
“হ্যাঁ।”
“তোমার মনে হয় তারা একজন বিবাহিত পুরুষের সাথে তোর বিয়ে দিবে।”
“ওসব আমি সামলে নিব।”
“আর কবিতা এসব জানলে কী হবে তা বলো”

কবিতার নাম শুনতেই মৃণার বিরক্ত লাগল। সে মনে মনে ভাবল, “হ্যাঁ আমি কত চাই ও তোমার জীবনে থাকুক। একবার বিয়ে হতে দেও তারপর ওকে কীভাবে তোমার জীবন থেকে বের করব তা দেখ। তীর্থ এবং ওর সবকিছু কেবল আমার হবে।”
কিন্তু মুখে আর এ কথা সে বলল না। সে আরও শক্ত করে তীর্থের হাত ধরে বলল, “আমি সব সামলে নিব তীর্থ। আই প্রমিজ। প্রয়োজনে আমি সবাইকে ছেড়ে তোমার কাছে চলে আসব। তুমি শুধু আমাকে আপন করে নেও।”
তীর্থ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মৃণাকে সে কি বলবে, সে নিজে কি চায় তাই সে জানে না। কিছুতেই সে বুঝতে পারছে না। তার মাথা কাজ করছে না। এই কোন সংকটে ফেঁসে গেল সে!
.
.
“আমাদের দেখা হবার রীতিটা ভঙ্গ করলে না তুমি।”
কন্ঠটা শুনে একটু চমকে যায় কবিতা। আচমকায় মুখ তুলে তাকায় তার সামনের লোকটার দিকে। লোকটা ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি নিয়ে তার সামনে বসে আছে।

কথন!
কথন কবে এলো বাংলাদেশে? কবিতা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কথনের দিকে। কবিতার এমন চাহনি দেখে হেসে দেয় কথন। কবিতার মাথায় টোকা মেরে বলে, “ভূত দেখার মতো তাকিয়ে আছ কেন?”
কবিতা মৃদু হেসে বলে, “আপনাকে হঠাৎ এত বছর পর দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।”

দুইজনে উঠে দাঁড়ায়। কথন তার ভেজা শার্টটার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি আর ভালো হলে না। তারপর বলো এইখানে কীভাবে? আর মেডামের এত মেজাজ খারাপ কেন?”
“আমার ছেলের খুব জ্বর। ওকে মাত্র এনে ভর্তি করলাম। চিন্তায় ছিলাম তাই মেজাজ খারাপ করে যা তা বলে ফেললাম। সরি।”
কথন চমকানোর ভান করে কবিতাকে জিজ্ঞেস করে, “জ্বর কী ওর না’কি তোমার? তুমি এত সহজে মানুষকে সরি বলতে কবে শিখলে?”
“সময় শিখিয়ে দিয়েছে।”
“তোমার বাচ্চা হয়ে গেছে কেন যেন বিশ্বাস করতে পারছি না। তোমার ছেলেকে দেখব।”
“আমার মেয়েও আছে। ওর ক্ষুধা লেগেছে, কিছু খাবার নিয়ে এসে যাই?”
“কেবিন নং কত?”
“৩০৪ সম্ভবত।”
কথন এক নার্সকে ডেকে ৩০৪ নং কেবিনে কিছু খাবার নিয়ে যেতে বলল। তারপর সে গেল কবিতার সাথে। লিফটের থেকে বের হয়েই কবিতা জিজ্ঞেস করে, “আপনি বাংলাদেশে কবে এলেন?”
“এই দুইমাস হবে। আসার ইচ্ছা ছিলো না। কিন্তু মা’য়ের ইমোশনাল ব্লাকমেইলের সাথে কে জিতে? মা’য়েদের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার।”
“শেষ দেখার পর আর যোগাযোগ রাখলেন না আমার সাথে।”
কথাটা শুনেই কথনের ঠোঁটের হাসি মলিন হয়ে যায়। তার বুক চিরে বেরিয়ে আসে বেদনার নিশ্বাস, “বিদেশে যেয়ে কারও সাথেই যোগাযোগ ছিলো না। শুধু নিজের ক্যারিয়ার উপর ধ্যান দিয়েছি। ভাগ্য ভালো ধ্যান দিয়েছিলাম, নাহয় আজ তোমার সাথে এখানে দেখা হতো কীভাবে?”
“আপনি এখানে….”
“ইয়াপ আমি এখানের ডাক্তার। যদিও আমার শিফট আরও দুইঘন্টা পর। আমার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে এলাম। ওর শিফট একটু পরই শেষ।”
“ওয়াও, ঢাকার সবচেয়ে বড় হাস্পাতালে ডাক্তার। আপনি আপনার স্বপ্ন পূরণ করলেন।”
“আর তুমি?”
“আমি কী?”
“তুমি নিজের স্বপ্ন পূরণ করেছ? কোথা থেকে ফ্যাশন ডিজাইনিং কোর্স করলে? আর এখন কী করছ?”
প্রশ্নটা শুনতেই কবিতার চোখে মুখে উদাসীনতার ছায়া পড়লো। ভাগ্যিস তাদের গন্তব্য এসে পড়েছিলো। তাই তার প্রশ্নটার উওর দিতে হলো না। সে জোরপূর্বক হেসে বলল, “কেবিন এসে পড়লো।”

কথন কেবিনে ঢুকে দেখে একটি বাচ্চা ছেলে বেডে শুয়ে আছে এবং অনুর কোলে আরেকটি বাচ্চা ঘুমাচ্ছে। কথনকে দেখে অনু যেন আকাশ থেকে পড়ে। সে হা করে কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে দাঁড়ায় এবং বলে, “কবিতা, আমার সামনে কী সত্যিই কথন দাঁড়িয়ে আছে না আমি স্বপ্ন দেখছি।”
“যদিও আমি এতই হ্যান্ডসাম যে সবাই স্বপ্নের রাজকুমার ভাবতে পারে কিন্তু এই মুহূর্তে তুমি আমাকে সত্যিই দেখছ।”
কথাটা বলে কথন হেসে কবিতার দিকে তাকালো। আগে যখনই সে এই কথা বলতো, তখনই কবিতা নাক ছিটকে এর বিপরীতে তাকে কথা শুনাতো। ঝগড়া হতো দুইজনের মাঝে। কিন্তু আজ কবিতা কিছুই বলল না। সে কেবল মৃদু হাসলো। কথনের বিষয়টা একটু অবাকই লাগে।

কাব্য জিজ্ঞেস করে, “মা এই আঙ্কেলটা কে?”
কবিতা কাব্যের কাছে যেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এখন একটু ভালো লাগছে?”
কাব্য মাথা নাড়া দিয়ে জানায়।
কাব্য ছোট হলেও তার বুদ্ধিমত্তা অনেক। কেবল পড়ালেখায় না। আসল জীবনেও। সে কাওকে সহজে কষ্ট দিতে চায় না। বিশেষ করে তার মা’কে। তাই মা যেন চিন্তা না করে এই কারণে সে মাঝেমধ্যে খারাপ লাগলেও চুপ থাকে। আজও তার খুব কষ্ট হচ্ছিলো কিন্তু সে মা’কে তা বলতে চাইলো না।
কিন্তু কবিতা তো তার মা। ছেলে মুখে না বললেও তার কষ্ট বুঝে নিল কবিতা। সে কাব্যের কপালে চুমু খেয়ে বলল, “চিন্তা করে না বাবু, ডাক্তার আংকেল ঔষধ দিয়েছে। একটু পর আরও ভালো লাগবে।”
কাব্য হাসে কবিতার দিকে তাকিয়ে।

কবিতা এরপর কথনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, “এটা কথন আংকেল। তুমি আংকেলের সাথে গল্প করো, মা আসছি একটু। ঠিকাছে?”
কবিতা আবার কথনের দিকে তাকিয়ে বলল,” আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসছি। আপনি বসুন।”
কবিতার বেরিয়ে যাবার পর কথন কাব্যের পাশে এসে বসে। কাব্য এবং কুহু দুইজনই অনেকটা দেখতে কবিতার মতো। মুখে মায়া ভরা। কথন কাব্যকে দেখে অনেক খুশি হয় কিন্তু তার বুকের যন্ত্রণাটাও বাড়ে। বুকের ভেতরটা জোরে মুচড়ে উঠে। কবিতার দুটো প্রতিচ্ছবি দেখে সে যতটা খুশি ততটাই তার দুঃখ হলো এই ভেবে যে ভাগ্যে হলে আজ কাব্য এবং কুহুর মতো বাচ্চা আজ তার ও কবিতার হতো। তার বুকে জমে থাকা কষ্টটা সে মুখে প্রকাশ করে না। কাব্যের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “হাই চ্যাম্প। তুমি দেখি অনেক স্ট্রং। হাতে নিডেল লাগানো তাও কাঁদছ না, আমি আগে তোমার মতো স্ট্রং বয় তো দেখি নি।”
কথাটা শুনে একগাল হাসে কাব্য। তার চোখদুটো ঝলমলে হয়ে উঠে, “সত্যি?”
“একদম সত্যি।”
কথন কিছুক্ষণ কাব্য এবং অনুর সাথে গল্প করে। এরই মাঝে কবিতা আসে নার্স এবং প্রণয়ের সাথে। প্রণয়কে দেখেই কথন বলে, “আমার মনেই হচ্ছিলো ওর চিকিৎসা তুই করছিস।”
“তুই এখানে!” প্রণয় অবাক কন্ঠে বলে।
“তোকে কবিতার কথা বলেছিলাম, মনে আছে? ওই কবিতা।”
প্রণয় তাকায় কবিতার দিকে। হেসে কথনকে আলাদা কেবিনের বাহিরে নিয়ে যেয়ে বলে, “তুই ঠিক আছিস?”
“বেঠিক থাকব কেন?”
“না ওর সাথে এতবছর পর আবার দেখা হলো তাই।”
“আরে আমি পুরনো কথাগুলো পিছনে ছেড়ে এসেছি। ওসব বলে লাভ নেই। দেখ মেয়ে টা আজও সেই তাড়াহুড়োয় কাজ করে। আজও জলদি হাঁটতে যেয়ে পানি ফালিয়ে দিলো আমার উপর। আমি শার্ট চেঞ্জ করে আসছি, তুই ভালো করে কাব্যকে দেখবি। ও কবিতার ছেলে, ওর যেন কোনো কষ্ট না হয়।”
প্রণয় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তা কথনের যাওয়ার দিকে। সে জানে ঠোঁটের কোণে যত বড়ই হাসি এঁকে রাখুক না কেন তার বুকে পীড়ন হচ্ছে। সে পীড়া সে কিছুতেই মুখে ভেসে উঠতে দিবে না। সবটা লুকিয়ে রাখবে নিজের মনের সিন্দুকে।

কথন নিজের কেবিনে যেয়ে টেবিলের ড্রয়ের থেকে তার শার্ট বের করে। শার্টের বোতামগুলো খুলে পরিবর্তন করতে যাবে এমন সময় তার চোখের সামনে ভেসে উঠে কবিতার মুখ। কাঁপানো নিশ্বাস ফেলে সে। তার মনে হচ্ছে তার চোখে জল এসে জমেছে। যেকোনো মুহূর্তে সে জল গাল বেয়ে পড়বে। সে টেবিলে হাত রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কতক্ষণ।
এতবছর পর কেন আবার সামনে আসতে হলো কবিতার?
কেন তার পুরনো ক্ষতগুলো আবার তাজা করতে হলো?
ভাগ্য তাদের এক করতে নারাজ, তাহলে কেন তাদের আবার দেখা করাল?
কষ্ট দিতে? সে কী এতই খারাপ যে বারবার তাকে এই যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে? কবিতাকে এখন পাওয়াটা তার পক্ষে অসম্ভব। সে অন্যকারো বউ, কারও মা। তার কথাটা ভাবাটাও তো অনুচিত। তাহলে ভাগ্য কেন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে যে তার এই ভুল কাজটি করতে হয়।

কথন তার পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে বসে চেয়ারে। ওয়ালেটে কবিতার ছবি দেখে সে ছবিতে আঙুল বুলিয়ে বলে, “তোমাকে দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে কবিতা কিন্তু খুশিও হচ্ছে তোমার এখন একটা সুখী পরিবার আছে। আমি তোমাকে পেতে পারি নি কিন্তু তুমি যাকে ভালোবাসো তাকে তুমি পেয়েছ। এত মিষ্টি দেখতে সন্তানের মা তুমি। আর কী চাই আমার? তোমাকে দেখে কষ্ট হলেও এতটুকুতে আমি সন্তুষ্ট যে তুমি সুখী।”
কথনের চোখের পানি গাল গড়িয়ে পড়ে সে ছবিতে।
.
.
প্রণয় কাব্যের চেকাপ করছিলো। এমন সময় অনু কবিতার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে, “দোস্ত শুন আমি বুঝে গেছি এই হাস্পাতাল এত বড় কীভাবে হলো।”
“ভালো চিকিৎসা দিয়ে।”
“আরে ধ্যুর না। কথন এবং ডক্টর প্রণয়ের মতো হট হট ডাক্তার রাখলে তো মাইয়ারা অসুস্থ না অসুস্থতার বাহানা দিয়ে আইবো। আইলেই তাদের টাকা।”
কবিতা চোখ ঘুরিয়ে বিরক্তি নিয়ে তাকায় অনুর দিকে।
অনু তো ভীষণ সিরিয়াস। সে চোখদুটো বড় বড় করে বলে, “মজা করতেছি না। একদম সত্যি।”
কবিতা বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে চোখ ফিরিয়ে নেয়।

প্রণয় কবিতাকে কেবিনের বাহিরে নিয়ে বলে, “জ্বরের ঔষধ দেওয়া হয়েছে কিন্তু আমি কিছু পরীক্ষা করতে চাই।”
“হ্যাঁ, ডাক্তার অবশ্যই করুন।”
“আপনি বললেন ওর প্রায়ই এমন জ্বর আসে। তাই আমার ওর আগের মেডিক্যাল হিস্ট্রিও লাগবে।”
“আমি এখনই বাসায় যেয়ে আগের রিপোর্ট আনছি।”

“আমিও সাথে আসছি তোমার।” কবিতা দেখতে পায় কথন এগিয়ে আসছে তার দিকে। কথন এসেই বলল, “আমি নিয়ে যায় তোমায়। আমি গাড়ি এনেছি তাই তোমার সুবিধাও হবে।”
কবিতা রাজি হলো। রাত হয়ে এসেছে। তার একা যাওয়াটা ঠিক হবে না। আর সে জানে, এই মুহূর্তে কথনের উপর সে ভরসা করতে পারে। এতবছর পর হলেও সে কথনের উপর ভরসা রাখতে পারে।
.
.
মৃণাকে বুঝাতে বুঝাতে তীর্থের রাত হয়ে এলো। যেমন তেমন করে সে মৃণাকে বুঝিয়ে বাসায় পাঠায়। মেয়েটা বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গেছে। আগে পরে কিছু ভাবছে না। এর মধ্যে তীর্থ পড়ে আরেক দ্বিধায়। সে কি করবে বুঝতে পারছে না। মাথায় কিছুই ঢুকছে না তার। সে ভেবেছিল ধ্রুব আসলে এ বিষয়ে তার সাথে কথা বলবে কিন্তু মৃণা তো এর সময়-ই দিচ্ছে না। সে বলেছে আজ রাতেই তাকে শেষ সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। এত জলদি এত বড় সিদ্ধান্ত কীভাবে নেয় সে? এর উপর এত জটিল সিদ্ধান্ত। কোন ফাঁদে নিজেকে ফাঁসিয়ে দিলো সে? এখন নিজের উপরই জেদ উঠছে।

তীর্থ বাসায় এসে দেখে বাসায় তালা দেওয়া। কবিতা এ অসময়ে কোথায় গেল? ফোন বের করে সে দেখতে পায় তাই ফোন ফ্লাইট মোডে করা। ফ্লাইট মোডে কীভাবে গেল সে বুঝতে পারে না। ফোন ঠিক করার পর দেখে দেখে কবিতার আঠারোটা মেসেজ। সকল মেসেজেই লেখা, ‘কাব্যের অবস্থা ভালো নয়, তুমি কোথায়?”
” জলদি আসো।”
“তুমি কল ধরছো না কেন?”
“তোমার কোন কাজ তোমার ছেলের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই উওরটা তুমি এসে দিবে আমাকে।”

মেসেজগুলো দেখে এক মুহূর্তের জন্য তীর্থের হৃদস্পন্দন থেমে গেল। তার মনের ভেতর কু ডাকছে। কাব্য ঠিক আছে তো? এখন কোথায় তারা?
সে সাথে সাথে কবিতাকে কল দিলো কবিতা কল কেটে দেয়। এরপর যতবারই কল দিলো সে ধরলোই না। আতঙ্কে তার জান বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা। সে তার বাসার সামনেই কবিতাকে কল করার সাথে সাথে পায়চারি করছে।

তার বাসার সামনে একটি গাড়ি এসে থামে। গাড়ি থেকে নামে কবিতা। কবিতাকে দেখে তীর্থ তার দিকে ছুটে যেতে নিলেও থেমে যায়। গাড়ির থেকে অন্য একটি মানুষও বের হবে। কথন? সে কবিতার সাথে কী করছে?

কবিতা কথনকে কিছু বলে ছুটে এলো বাসার দিকে। বাসার সামনে এসে তীর্থকে দেখে থমকে যায় সে। রাগে তার শরীর জ্বলে উঠে। মুখ ফিরিয়ে নেয় সে। যেয়ে দরজা তালা খুলতে নিলেই তীর্থ তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, “এই কথন এখানে কেন? এত রাতে সে তোমার সাথে কি করছে? আর তুমি আমার কল ধরছ না কেন?”
কবিতা কোন উত্তরই দিলো না তীর্থের প্রশ্নের। সে দরজা খুলে চলে গেল। ভিতরে যেয়ে সোজা বেডরুমে যেয়ে আলমারিতে কাব্যের আগের ফাইল খুঁজতে থাকে।

তীর্থও যায় তার পিছনে। কথনকে কবিতার সাথে দেখে তার মাথায় রক্ত উঠে গেছে। সে কবিতার হাত ধরে তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে, “আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি তোমাকে।”
কবিতা তীর্থের হাত ধরে নিজের হাত থেকে সরিয়ে দেয়।তারপর বলে, “আর আমি আপনার প্রশ্নের উওর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছি না।”
কবিতা নিজের কাজে আবারও জুড়ে গেল।
কিন্তু উওরটা তীর্থের ইগোতে লাগে। সে জেদের চোটে বলে, “প্রয়োজন মনে করছ না? এত রাতে পর পুরুষের সাথে ঘুরে বেড়ানোর মেয়েদের কী বলে জানো?”

কবিতা স্তব্ধ যায়। সে কিছু রিপোর্ট খুঁজছিলো। তীর্থের কথা শুনে সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পাড়লো না। তীর্থ তার চরিত্রের উপর প্রশ্ন তুলছে? তাদের মাঝে যতই দূরত্ব আসুক না কেন, সে কখনো ভাবতেও পারে না তীর্থ তার চরিত্রের উপর প্রশ্ন তুলতে পারে।

তীর্থ আবারও বলল, “আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি কবিতা। এতরাতে তুমি কি করছিলে ওই ছেলের সাথে?”
কবিতা পিছনে ফিরেই গালে চড় মারে তীর্থের। আর্তনাদ করে উঠে, “তোর সাহস কী করে হয় আমার চরিত্রে প্রশ্ন করার?”
তীর্থ এমন কিছুর জন্য অপ্রস্তুত ছিলো। কবিতা কখনো তার উপর হাত তুলতে পারে সে কল্পনাও করে নি। তার এই মুহূর্তে প্রচুর রাগ হবার কথা কিন্তু কবিতার এমন অগ্নিমূর্তি দেখে সে কিছুই বলতে পারলো না। সাথে সে এটাও বুঝতে পারছে তার কথার ধরণটা ভুল ছিলো। সে রাগের বশে কী বলে ফেলল এটা?

তীর্থ এক ঢোক গিলে কবিতার বাহুতে হাত রেখে বলে, “কবিতা আমার কথা শুনো, আমি ভুলে….”
তীর্থকে ধাক্কা দিয়ে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দেয় কবিতা, “খবরদার আমার কাছে আসবি না। আমি কথনের সাথে কি করছি শুনতে চাস? তোর জন্য যে তোর বাচ্চার জান থেকে কাজ বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাই আমি কথনের সাথে। আমার ছেলেটা আজ এত অসুস্থ ছিলো আর তুই তোর কাজ থেকে সময় পাচ্ছিলি না? কী কাজ ছিলো তোর এমন? তোর কী মনে হয় আমার ছেলের কিছু হলে আমি তোকে ছেড়ে দিতাম? আমার বাচ্চাদের কিছু হলে আমি প্রথমে তোদের মারতাম, তারপর নিজে মরে যেতাম। তোর বুক কাঁপে নি নিজের ছেলেকে….ছেলেকে এই অবস্থায় ছেড়ে…. ” কবিতার কথা বলতে দম বন্ধ হয়ে আসে। নিশ্বাস আটকে আসে। মাথা ঘুরিয়ে উঠে। সে পড়ে যেতে নিলেই আলমারি ধরে সামলে দাঁড়ায়।

তীর্থ ছুটে এসে তাকে ধরতে নিলেই সে তাকে দূরে সরিয়ে দেয়। তবুও তীর্থ তাকে ছাড়ে না কোলে তুলে বিছানায় বসিয়ে যেয়ে একগ্লাস পানি নিয়ে আসে। কবিতাকে একটু পানি খাইয়ে তাকে বুকে ভরে নেয়। অস্থির হয়ে বলে, “সরি জান। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি তোমাকে ওর সাথে সহ্য করতে পারি না। রাগের মাথায় কি বলে ফেললাম সরি, সরি, সরি।”
কবিতা তীর্থের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। কান্নাভেজা গলায় বলে, “আমাকে কী ভেবে রেখেছ তুমি? আমি নিজের সারাটা জীবন তোমার পিছনে নষ্ট করে দিলাম আর তুমি আজ আমার চরিত্রে প্রশ্ন তুলছ? তুমি যে মাঝেমধ্যে এত রাত করে বাসায় ফিরে আছিস আমি কখনো তোমাকে সন্দেহ করেছি। কারণ আমি জানি আমাদের মাঝে যতই দূরত্ব হয়ে যাক না কেন তুমি আমাকে আগের মতোই ভালোবাসো। কখনো আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।”
তীর্থ কবিতার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। কবিতার শেষ কথাটা শুনতেই সে চোখ সরিয়ে নিলো। ভয়ে শরীর শিউরে ওঠে তার। এক অজানা ভয় তার চারপাশের হাওয়ায় মিশে গেল। সাথে অপরাধবোধ তাকে আঁকড়ে ধরে। কবিতা তাকে এতটা বিশ্বাস করে?
যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে কবিতা কখনো তার সাথে মৃণার সম্পর্ক জেনে যায় তখন?

কবিতার অবাধ্য চোখদুটো অনবরত পানি ঝরাচ্ছিল। তার বুকের ভেতর এতটা যন্ত্রণা আর কখনো হয় নি। তীর্থ কীভাবে পারে তার চরিত্রে প্রশ্ন তুলতে? যে লোকটার কারণে সে তার সব ছেড়ে দিয়েছে আজ সে লোকটা তার চরিত্রের উপর প্রশ্ন তুলছে?
সে দৃঢ় কন্ঠে বলল, “তোমার যদি আমার উপর বিশ্বাস না থাকে তাহলে আমাকে ছেড়ে দিও। আমি কিছু বলব না। কিন্তু আমার চরিত্রের উপর প্রশ্ন তোলার সাহস করবে না। আমি জানি, আমার আল্লাহ জানে আমার চরিত্র কেমন। আমার যদি তোমাকে নিজের চরিত্রের প্রমাণ দিতে হয় তাহলে এমন সম্পর্কে রেখে লাভ কী?”

কেঁপে উঠে তীর্থের বুকের ভেতর। কবিতা তাকে ছেড়ে দেবার কথা বলছে? অসম্ভব। তাদের মাঝে যত সমস্যা থাকুক, অশান্তি থাকুক না কেন, কবিতা তার সব। কবিতাকে ছাড়া সে তার জীবন কল্পনাও করতে পারে না।

কবিতা উঠে যেতে নিলেই তীর্থ তার হাত ধরে নেয়। বলে, “আমার ভুল হয়ে গেছে কবিতা।”
কবিতা এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়, “খবরদার আমাকে স্পর্শ করার সাহসও তুমি করবে না। আমি এই মুহূর্তে তোমার চেহেরাও দেখতে চাই না।”

চলবে…

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here