মুহুর্তে পর্ব -৩৯+৪০

#মুহূর্তে
পর্ব-৩৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

“আমার এখানে আসার সাহস কিভাবে হলো?” কবিতা তীর্থকে দৃঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করে। তীর্থ উত্তর দেয় না। চুপচাপ দরজা বন্ধ করে দিব কবিতার সামনে এসে দাঁড়িয়ে উল্টো প্রশ্ন করে, “তুমি বাসায় কবে আসছো? সবকিছুর একটা সীমানা থাকে। তুমি আমার কল ধরছো না, নাম্বার ব্লক করে রেখেছ, কতবার গাড়ি পাঠিয়েছে তোমাকে না নেওয়ার জন্য? এই নাটকের শেষ করবে তুমি। এক সপ্তাহ হয়ে গেছে।”
কবিতার মেজাজ খারাপ হয়ে যায় তীর্থের এমন কথায়। কিন্তু সে শান্ত গলায় বলে, “এক সপ্তাহ হোক, একমাস হোক অথবা এক বছর আমি তোমাকে কাছে আর আসছি না।”
“তুমি আসবেনা? ঠিক আছে, তাহলে আমার বাচ্চাদের আমি নিয়ে যাব। তোমার ফিরে আসা লাগবে না।”
“তোমার বাচ্চাদের প্রতি এত ভালোবাসা কবে থেকে হয়ে গেল? তুমি এখন থাকতে পাড়ছো না তাদের ছাড়া? অথচ আগে তো ওদের সাথে একদিন খেলার মতো তোমার কাছে সময় হতো না। কাব্যের অসুস্থ হবার পূর্বে কবে তুমি ওদের সাথে সময় ব্যয় করেছে আমাকে একটু বলতো। আর তোমার সন্তানদের প্রতি তোমার মায়া লাগছে তাই না? তাহলে তুমি এসে নিষ্পাপ প্রাণ কে কিভাবে মারার চিন্তাও করতে পারো? একবার বুক কাঁপেনি তোমার?”

তীর্থ কবিতার কাছে তার দুই বাহু ধরে বলে, “কারণ আমি তোমার কথা ভেবেছি। বাচ্চাদের কথা ভেবেছি। আমাদের কথা ভেবেছি।”
“মিথ্যা কথা। তুমি কেবল নিজের কথা ভেবেছ। আমাদের কথা ভাবলে তুমি কখনো অন্য মেয়ের সাথে এমন সম্পর্ক রাখতে না।”
“ঠিকাছে, আমি স্বার্থপর। আমি খারাপ। আমি জঘন্য। তুমিতো ভালো। তাহলে ফিরে আসো না আমার জন্য না হোক, আমাদের বাচ্চাদের জন্য। তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করো। তোমার জেদের জন্য ওদের জীবন নষ্ট হতে পারে। ভবিষ্যতে যখন তারা নিজের বাবার কথা জিজ্ঞেস করবে কী উওর দিবে তুমি? কি বলবে? যদি তুমি নিজের জেদের কারণে তাদেরকে নিজের বাবার কাছ থেকে দূর করেছ?”
তীর্থ কবিতার দুই গালে হাত রেখে কথাগুলো বলে। কবিতা তাকায় তীর্থে চোখের দিকে। সে চোখে চোখ রাখলেই আজও তার বুকে কম্পন উঠে। আগে সে কম্পন ছিলো ভালোবাসার। কিন্তু আজ তা বেদনার। তার চোখ নম্র হয় সে দৃষ্টির দর্শনে। সে তাচ্ছিল্য হেসে বলে, “এই নাটক ধ্রুব শিখিয়ে পাঠিয়েছে তোমায় তাই না?”

তীর্থ চমকালো। কবিতা আবারও বলল, “সে তোমায় এটাও বলেছে যে আমার দুর্বলতা আমার সন্তানরা। তাই তুমি এখন আমার সন্তানদের কথা তুলছ তাই না?” কবিতা একটু পিছিয়ে যায়। তার শরীর কাঁপছিলো। অবশ অবশ লাগছিলো তার। সে পিছনের টেবিল ধরে দাঁড়ালো। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নরমসুরে বলল, “তুমি জানো আমি যে তীর্থকে ভালোবেসেছিলাম সে কেমন ছিলো? তার চোখে তাকালে মনে হতো আমার থেকে সুন্দর নারী সে এই জীবনে আর দেখে নি, আমাকে ছাড়া অন্যকোনো নারীর দিকে চোখ তুলে তাকানোর ইচ্ছাও হয় না তার, আমার দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা অপলক তাকিয়ে থাকলেও তার দৃষ্টি ক্লান্ত হবে না। তুমি জানো…তুমি জানো আমি যখন জানতে পেরেছি তুমি অন্য মেয়ের সাথে….” দম আটকে আসতে চাইলো কবিতার। সে তবুও সামনে বলল, “আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিছুতেই না। আমি বারবার ভাবছিলাম যে মানুষ ছোটবেলা থেকে তার বাবাকে ঘৃণা করে এসেছে কারণ তার বাবা পরকীয়া করেছে। তার মা’কে ধোঁকা দিয়েছে। তাদের একা ফেলে ফেলে চলে গিয়েছে। সে মানুষ এমনটা করতে পারে? এটা আদৌও সম্ভব? তার কাছে সম্পর্কের মর্যাদা সবচেয়ে বেশি হওয়া উচিত।”

কবিতা তীর্থকে বিস্মিত হতে দেখে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “কী হলো? এই কথা তোমার মাথায় আসে নি? তুমি একবারও ভাবো নি একসময় যেভাবে তোমার বাবা তার সংসার নিজ হাতে শেষ করেছিলো আজ ঠিক তেমনি তুমিও আমাদের সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছ। একবার ভাবো কাব্য এবং কুহু যখন জানবে তাদের বাবা কি করেছে তাহলে তোমাকেও তারা সেভাবে ঘৃণা করবে যেভাবে তুমি তোমার বাবাকে….” সামনে বলতে পারলো না কবিতা। তীর্থ এসে কবিতার মুখ চেপে ধরলো। তার চোখে ভয়। সে ভয়ার্ত গলায় বলল, “প্লিজ কবিতা। এমন করো না। তুমি ওদের এসব জানাতে পারো না।”
“কেন? তোমার মতে তো তোমার ছোট এক ভুল হয়েছে। ভুল জানাতে কীসের ভয়? ভুল তো মাফ করা যায় তাই না? আজ না হোক, দশ বছর পর হলেও তো তারা জানবে। তখন কী করবে তুমি?”
“কবিতা প্লিজ ক্ষমা করো আমায়। আমি ভুল করে ফেলেছি। আই প্রমিজ আর করবো না। আরেকটা সুযোগ দেও।”
“তাহিরা আপুও তো ধ্রুবকে সুযোগ দিয়েছিলো। সে কী করেছে সে সুযোগের?”
“ধ্রুব আর আমি কি এক না’কি?” উচ্চস্বরে বলে তীর্থ। কিন্তু কবিতা এবারও শান্ত গলায় উওর দিলো, “আমি তোমার জায়গায় হলে তুমি আমায় ক্ষমা করতে? সেদিন কথনের সাথে আমায় দেখে তোমার মেজাজ আকাশ চড়ে গিয়েছিলো। আমি যদি অন্য পুরুষের সাথে শুয়ে আসতাম তাহলে তুমি আমায় মেনে নিতে?”

কথাটুকু তীর্থের মাথা খারাপ করার জন্য যথেষ্ট ছিলো। তবুও সে নিজেকে শান্ত রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করল। সে জানে এই মুহূর্তে মাথা নষ্ট করলে কবিতাকে ফিরে পেতে আরও কষ্ট হবে তার। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “হুম, ভু…ভুল হলে আরেকটা সুযোগ দিতাম।”

“তাহলে এক কাজ করি চলো। তুমি যতদিন ঐ মেয়ের সাথে নাম কি যেন? ওহ মৃণা। ওই মৃণার সাথে যতটুকু অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটিয়ে এসেছ আমিও অন্য পুরুষের সাথে ঠিক ততটুকু কাটিয়ে আসি। তোমার যেমন শান্তির প্রয়োজন ছিলো, আমারও তেমন শান্তির প্রয়োজন। তখন তোমার আর আমার হিসাব বরাবর…..” কথা শেষ না হতেই তীর্থ হাত তুললো কবিতার উপর। গালে এত জোরে চড় মারলো যে তার ফর্সা গালে আঙুলের দাগ বসে গেছে। তীর্থ কবিতার বাহু শক্ত করে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “খবরদার আরেকটা শব্দ মুখ থেকে বের করবা না। এই মুহূর্তেই আমি মেরে ফেলবো তোমাকে। তোমার সাহস কীভাবে হয় অন্য পুরুষের কথা ভাবো তুমি? তুমি আমার স্ত্রী। সে মর্যাদায় থাকো।”

বাহু এত শক্ত করে ধরায় ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে কবিতা। সে কাঁপানো গলায় বলল, “তুমি করতে না। তুমি কখনোই আমাকে মাফ করতে না। আমাকে মেরে ফেলতে তুমি। তাহলে তুমি কীভাবে বলো যেন আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেই? কীভাবে? তুমি বারবার আমাকে কষ্ট দিয়েছ, আর আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি। তোমার মনে হচ্ছে এটা তোমার প্রথম ভুল। না, এটা তোমার প্রথম ভুল না। তুমি এবং তোমার মা গত ছ’বছর ধরে আমার উপর মানসিক অত্যাচার করেছ। আর আজ তো শারীরিক আঘাত করতেও পিছ’পা হলে না তুমি।”

তীর্থ ছেড়ে দেয় কবিতার বাহু। সে নিজের উপরই অবাক হয়। সে কবিতার উপর হাত তুলেছে? মাথা ঠিক ছিলো না তার। সে কি করছিলো তাও বুঝতে পাড়ছিলো না। তার দৃষ্টি যায় কবিতার গালের দিকে। তার ফর্সা গাল লালচে হয়ে গেল। যেন রক্ত জমে গেছে। তা দেখে বুক কেঁপে উঠলো তীর্থের। সে কাঁপা-কাঁপা হাতে কবিতার গাল ছুঁয়ে দেখল। তারপর তাকাল কবিতার দিকে। তার চোখের জল দেখে আগের মতোই অস্থির হয়ে পড়ে তীর্থ। কবিতার গালে আলতো করে হাত রেখে তার কপালে কপাল ঠেকায় তীর্থ। চোখ বন্ধ করে বলে, “কবিতা আমি জানি তোমার এই রাগের পিছনে আজও আমার জন্য ভালোবাসা আছে। আর আমি যে তোমার উপর হাত তুলেছি এর পিছনেও আমার ভালোবাসা আছে। আমি তোমার মুখে এসব কথা কীভাবে সহ্য করি বলো? তোমাকে ছাড়া আমার জীবন শূন্য হয়ে গেছে। আমি এলোমেলো হয়ে গেছি তোমাকে ছাড়া। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি নি। আমার কিছুতেই শান্তি লাগছে না। আমাদের ভালোবাসার দোহাই দিলাম, ফিরে আসো আমার কাছে।”

কবিতা তীর্থের বুকের হাত রেখে আলতো হাতেই তাকে দূরে সরায়, “তোমার মনে আছে আমি বিয়ের আগে একবার বলেছিলাম। তোমার সব আঘাত আমি সহ্য করতে পারবো তোমার ভালোবাসার খাতিরে, কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা না। যেখানে তুমি আমার বিশ্বাস ভাঙতে এক মুহূর্তও লাগালে না সেখানে ভালোবাসা কীসের? আর তোমার এখন আমাকে কেন প্রয়োজন? অন্য মেয়ের বাহুতে তোমার শান্তি ছিলো। তার কাছে যাও। তুমি আমায় ভালোবাসলে অন্যমেয়ের কাছে শান্তি খুঁজতে যেতে না। ভালোবাসলে, সে শান্তির জন্য আমার প্রয়োজন হতো তোমার। তীর্থ দয়া করে তুমি যাও এইখান থেকে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না প্লিজ। তোমাকে আমি যত দেখছি ততই আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”
“কবিতা…” তীর্থ আবারও কবিতাকে ছুঁতে নিলেই কবিতা তার দুই কানে হাত ধরে হাহাকার করে উঠে, “প্লিজ যাও। যাও এখান থেকে। আমার জীবন থেকে চলে যাও।”

কবিতা সে অবস্থাতেই মেঝেতে বসে পড়ে। কানে হাত রেখে, চোখ বন্ধ করে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। তীর্থ একটু এগিয়ে ছুঁতে যায় কবিতাকে। কিন্তু কেন যেন স্পর্শ করতে পারে না। সেখানেই স্থির হয়ে সে দাঁড়িয়ে রয় কিন্তু মুহূর্ত। বুকের ভেতর চিনচিন ব্যাথা উঠে তার। তারপর চলে যায়।

কবিতা বসে রয় সেখানে। সএ আর নিজেকে সামলাতে পাড়ছে না কেন? আজই কেন তার নরম পড়তে হলো তীর্থের সামনে। সে যত অতীত থেকে দূরে যেতে যায়, তার অতীত ঘুরেফিরে তার সামনে এসে দাঁড়ায়।
কেন?
.
.
অফিস থেকে বের হতেই আজ আইদ কল দিলো মৃণাকে। মৃণা বারবার তার থেকে সময় চাইছে। আজ একসাপ্তাহ। দুইদিন বলে একসাপ্তাহ পাড় করলো সে। আর সময় কীভাবে দেয় সে?
মৃণা কল ধরতেই আইদ জিজ্ঞেস করে, “আর কত সময় লাগবে তোমার?”
ফোনের ওপাশ থেকে কিছু সময় নীরবতা পালন হলো। তারপর মৃণা আমতা-আমতা করে বলল, “আরও দুইদিন সময় দেও। আমি মা বাবাকে সব বল দিব।”
“দুইদিন দুইদিন করে আটদিন হলো। আর কত? ”
“তুমি কি ভাবছো বলাটা এত সহজ? আমি আমার মা বাবাকে কীভাবে বলি যে আমি বিয়ের আগের থেকে প্রেগন্যান্ট। আর যার বাচ্চার মা হতে চলছি সে আমাক আপন করে নিতে রাজি না।”
“যে মেয়ের এসব করতে লজ্জা লাগে নি তার বলতে লজ্জা লাগছে?” তাচ্ছিল্য হাসে আইদ। আবার বলে৷ “তুমি না বললে আমি আগামীকাল আসছি। আমি তাদের সব সত্য বলব। সাথে তোমার নষ্টামির প্রমাণও দেখাব।”
“আইদ আমার কথা তো শুনো…” আইদ ফোন কেটে দিলো। মৃণার কথা শোনার তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই। আজ এমনিতেও অফিসে অনেক কাহিনী হয়েছে। তার চাকরি হাতছাড়া করতে করতে বাঁচল সে। তার সন্দেহ এই সকল কাজ তীর্থের। সম্ভবত তীর্থ প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তার চাকরিটা থেকে তাকে বের করতে চাচ্ছে। ভাগ্যিস তা হলো না।

আইদ তার বন্ধুদের সাথে একটু ঘুরতে গেল। শান্তির জন্য। মৃণার কারণে আজকাল সবকিছুই অসহ্য লাগে তার। এর মধ্যেই কয়বার ফোন বাজলো। সে দেখে মৃণা কল করছে। মৃণার কল দেখে ফোন সাইলেন্ট করে রাখে সে। রাতে একটু দেরি করেই আইদ বাসায় ফেরে। দরজায় তালা লাগানো। বাসায় কাওকে না পেয়ে ফোন বের করে দেখে তার মা’য়ের সাথে মৃণা এবং ওর মা’য়েরও কতগুলো মিসকল। একটু ঘাবড়ে যায় আইদ। সে সাথে সাথে কল ব্যাক করে তার মা’কে।

“তুই…তুই কোথায় ছিলি? কতক্ষণ ধরে তোকে কল করছি আমি?” রাগান্বিত স্বরে বলে আইদের মা।
আইদের ভয় বাড়ে, “মা সব ঠিক আছে তো? আর তোমরা কোথায়?”
“আমরা হাস্পাতালে। মৃণার বাবা হার্ট অ্যাটাক করেছে। জলদি আয় তুই।”
#মুহূর্তে
পর্ব-৪০
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

আইদ দ্রুত যেয়ে হাসপাতালে পৌঁছায়। সেখানে যেয়ে দেখে সবাই একটি কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কান্না করছে সবাই। আইদ তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে মৃণার বাবার অবস্থা ক্রিটিকাল। তার মা রাগান্বিত স্বরে আইদকে বলে, “তুই ছিলি কোথায়? কতক্ষণ ধরে তোকে কল দিয়ে যাচ্ছিলাম। এই দুই ঘরের তুই একমাত্র ছেলে। এত দায়িত্বহীন হলে কেমনে চলবে?”

আইদের অপরাধবোধ হলো খানিকটা। তার আসলেই ফোন সাইলেন্ট রাখা উচিত হয় নি। তার মনে ভাবনা আসে এমনটা মৃণার সত্য জানার পর হয়নি তো? ভাবতেই বুকের ভেতর কামড়ে উঠে তার। সে মৃণার মা’য়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আন্টি এমনটা কীভাবে হলো?”

মৃণার মা খুব কাঁদছিলেন। কান্নায় ঠিকমতো কথাও বলতে পারে না সে। কোনোমতো বলে, “জানি না বাবা, জানি না। আমি তো রান্না করতাছিলাম। মৃণার বাবার যেয়ে ওর পছন্দের দই নিয়ে আসছিলো। মৃণাকে দিতে যেয়ে মাঝপথে এমনটা হইলো। আল্লাহ জানে এখন কী হইবো? সে না থাকলে আমাদের কী হইবো? আমি বাঁচুম কেমনে? আল্লাহ আমগো লগে এমন কেন করলো।”
মৃণার মা নিজের কপালে মারছিলেন। অধৈর্য্য হয়ে গেলেন সে। পাগলামি শুরু করলেন। আইদ এবং তার মা যেমন-তেমন করে সামলে নিলেন মৃণার মা’কে।

মৃণা কাঁদছিলো। কান্না করতে করতে তার চোখের আশেপাশে লালচে হয়ে গেছে। আইদ আসতেই সে দৃষ্টিতে ক্রোধ স্পষ্ট হয়ে এলো। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো আইদের দিকে। আইদ তার মা’কে সামলাচ্ছিল। এই দেখে তার রাগ আরো বেড়ে যায়। সে সেখান থেকে আইদের হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে যায় করিডরের অন্যপাশে। আইদ বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “সবার সামনে থেকে এমন টেনে আনার মানে কী? তোমার মা….”
মৃণা সম্পূর্ণ কথা শেষ হতে দিলো না আইদের। সে বলে, “আমার মা বাবা? তোমার আমার মা বাবার চিন্তা আছে? আজ তোমার জন্য আমার বাবা এই অবস্থায়। কেবল তোমার জন্য। না তুমি আমাকে ফোন করে প্রেশার দিতে, আর না আব্বু আমার কথাগুলো শুনতো, আর না আব্বু আজ এই অবস্থায়….” কান্নায় দম বন্ধ হয়ে আসে মৃণা। সে এক ঢোক গিলা আবার বলে, “আমার আব্বুর কিছু হলে আমি তোমাকে ছাড়বো না। ছাড়বো না আমি তোমাকে।”
আইদ এই কথার পরিবর্তে কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু মৃণা কান্না দেখে কিছু বলতে পাড়লো না। মৃণার কান্না দেখে তারা অশান্তি লাগছে। এই অশান্তি লাগানো উচিত নয়।

ডাক্তারকে আসতে দেখে আইদ দ্রুত দৌড়ে গেল আবারও কেবিনের সামনে। পিছনে মৃণাও গেল। ডাক্তার বলে সামনের চিকিৎসার জন্য বড় অঙ্কের টাকা জমা দিতে হবে। এরপরও বাঁচার সম্ভাবনা খুব বেশি একটা নেই।

মৃণা চিন্তায় পড়ে যায়। তাদের জমানো টাকা তার বিয়েতেই খরচ করতে হয়েছে। তাই এত টাকা আপাতত তাদের কাছে নেই। সাহায্যের জন্য প্রথম নামটা তার মাথায় আসে তীর্থের। সে আলাদা যেয়ে প্রথমেই তীর্থকে কল দেয়। কল কেটে দেওয়া হয়। তার আত্নীয়-স্বজনদের কল দিতে থাকে। কেউ তাদের সাহায্যের জন্য রাজি হয় না। আর কোন উপায় না পেয়ে সে হাস্পাতালের ফোন থেকে কল তার তীর্থকে।

“হ্যালো।”
“তীর্থ…তীর্থ আমি মৃণা বলছি। প্লিজ ফোন কাটবে না। আমার জরুরী কথা আছে। খুব বড় সমস্যায় পড়ে গেছি। আমার কিছু টাকার প্রয়োজন।”
ফোনের ওপাশ থেকে রুক্ষ গলা শোনা গেল তীর্থের, “সমস্যায় আছো? কি সমস্যা আছো? শপিং করতে পারছ না এই সমস্যা।”
“তীর্থ আমার আব্বু হাস্পাতালে ভর্তি। অবস্থা ক্রিটিকাল। তার চিকিৎসার জন্য টাকা লাগবে।”
“ওহ প্লিজ, তোমাকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনে গেছি। তোমার এখন নিজের বিলাসিতা পূরণ করা লাগবে বলে এখন তুমি তোমার বাবার মিথ্যা অসুখ দেখিয়ে আমার কাছে টাকা নিতে চাও?”
“আমার কথা বিশ্বাস করো তীর্থ। আমি সত্যি বলছি।”
“তুমি টাকার জন্য নিজের গর্ভের সন্তানকে এককথায় মারার জন্য রাজি হয়ে গিয়েছিলে, তুমি তোমার বাবার মিথ্যা অসুখের কথা বলবে না। তোমার এই কথা বিশ্বাস করাতে চাও আমায়? খবরদার আর কল করবে না আমাকে। আমার মাথা এমনিতেই খারাপ। আমি কখন কি করব নিজেই জানি না।”
কল কেটে দেয় তীর্থ। মৃণা অস্থির হয়ে আর কতবার কল করে তাকে। লাভ হয় না। মৃণার কান্না বাড়ে। অসহায় লাগে নিজেকে। এতটা অসহায় তার আর কখনো লাগে নি।

মৃণা মা’য়ের কাছে দ্রুত যায়। সে তার বিয়ের গহনা বিক্রি করে টাকা জোগাড় করার চিন্তা করে। কথাটা সে তার মা’কে বলতেই আইদের মা বলে উঠে, “পাগলি তুই এতক্ষণ এই ব্যাপারে চিন্তিত ছিলি? আইদ টাকা এনে হাস্পাতালে জমা দিতে গেছে।”
মৃণা অনেকটা অবাক হয়। আইদ এতকিছুর পরও কেন তাকে সাহায্য করবে?
আইদের মা বুকে জড়িয়ে নেয় মৃণাকে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “থাক কাঁদে না। আল্লাহর কাছে দোয়া কর। সে রাশেদ ভাইকে জলদি সুস্থ করে দিবে।”

মৃণা চুপচাপ জড়িয়ে ছিলো আইদের মা’য়ের বুকে। ঠিক তার মা যেমন তাকে সান্ত্বনা দিয়ে আদর করে ঠিক তেমনটা আইদের মা করছে। অথচ সে কখনো আইদের মা’কে মা’য়ের মর্যাদা দেয় নি। কেবল শেষের দিকে নাটক করেছিলো কিছু সময়ের জন্য। অথচ তিনি এত যত্ন করছে তার?

আইদ টাকা জমা দিয়ে করিডরে আসে। আসতেই তার চোখ যায় মৃণার উপর। মৃণার দৃষ্টিও তার উপর আটকায়। মৃণা তাকিয়ে থাকে তার দিকে। এক দৃষ্টিতে। প্রথমে তার জন্য একটুখানি খারাও লাগলেও পরক্ষণেই সব খারাপ লাগা মিটে যায়। তার মনে পড়ে মৃণার কর্মকান্ড। বুকের ভেতর মুচড়ে উঠে তার। সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নেয় সে।
.
.
“তোর গালে এটা কী হলো? এমন লাল দেখাচ্ছে কেন?” অনু অফিস থেক আসতেই প্রশ্ন করল।
কবিতা বাচ্চাদের জন্য নুডলস রান্না করছিলো। অনুর কথা শুনে সে নির্দ্বিধায় বলল, “তীর্থ এসেছিলো আজ।”
“কী? তুই তাকে ঢুকতে কেন দিলি বাসায়?”
“জোর করে ঢুকেছে।”
“ভাবি কোথায় ছিলো তখন? তুই তাকে ডাকবি না? আর তোর তো আজ ইন্টারভিউ ছিলো। সেখানে না যে বাসায় কি করছিলি তুই?”
“ভাবি জরুরি কাজে বাহিরে যেত। তাই আমি বাসায় একা ছিলাম।”
কথাটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ রইল অনু।তারপর মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “সে তোকে মেরেছে?”
“হুম।”
রাগে ফেটে পড়ল অনু, “উনার সমস্যা কি? নিজের লজ্জা শরমের সাথে কি মনুষ্যত্বও বেঁচে খেয়ে ফেলেছে? উনার সাহস কি করে হয় তোর গায়ে হাত তোলার?”
“অনু শুন, আমি ভাবছি আমার হাতের বালা বেঁচে দিয়ে এক নতুন বাসায় উঠবো। আর কতদিন থাকবে এখানে? আমি জানি তো কোন সমস্যা হচ্ছে না, কিন্তু এটা তো তোর ভাই ভাবি বাড়ি তাই না?”
“ঠিক বলেছিস। তাই আমি ভেবেছি আমরা এই বাসা ছেড়ে চলে যাব।”
“আমরা মানে? তুই পাগল? তুই আমার জন্য নিজে কেন বাসা ছেড়ে যাবে।”

অনু পাকঘরের তাকে এসে বসলো, “ভাই তুই আমার ভাবিক কি বলতি ভুলে গেছোস? ওই মহিলা এক ডাইনী। ডাইনীর রাণী বলতি তুই তাকে। তার সাথে এতবছর ধরে কীভাবে আছি কেবল আমি জানি। একা থাকার সাহস ছিলো না বলে এতবছর সহ্য করলাম তাকে। আমি ভাবির ব্যবহার খেয়াল করছি তোর উপর। বাচ্চাদের সাথেও জঘন্য ব্যবহার করছে। আমি বাসা দেখছিলাম এক রুমের যেহেতু আমার বেতন দিয়ে এক ফ্লাটের ভাড়া, খাবার, তারপর বাচ্চাদের বেতন কিছুই হবে না।”
“তোকে আমি বলেছিলাম না এসব নিয়ে তুই চিন্তা করিস না। আমি নিজেরটা দেখে নিব।”
“আর আমি তোকে লাথি দিব। দেখ খালা মানে মানে মায়ের মতো। তো আমি আমার বাচ্চাদের জন্য কিছু করলে তোর জ্বলে কেন? বাই দ্যা ওয়ে, জানিস আজ সেই এক ড্রামা হয়েছে।”
“কী?”
“কে যেন আমাদের চাকরি থেকে বের করতে চেয়েছে।”

কবিতা চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকায় অনুর দিকে, “চাকরি থেকে বের করতে চেয়েছে? সব ঠিক আছে তো? আর আমাদের মানে?”
“আরে ভাই শান্তি মতো একটু কথাতো শুনবি আগে। আগেই হাইপার হয়ে যাস। হয়েছে কি আমি কাজ করছিলাম। হঠাৎ পিয়ন কাকে এসে বলে বড় ম্যাডাম ডাকছে। আমি অবাক হলাম। কারণ বড় ম্যাডাম শুধু উচ্চপদস্থ কর্মীদের সাথে কথা বলে। যারা সকল বিভাগ সামলায় তারাই ম্যাডামকে কাজের সব কিছু জানায়। অফিসের এত কর্মীদের সাথে তাঁর কথা বলার সুযোগও যে নেই। এর উপর তার সংসার ও বাচ্চাগাচ্চা সামলানো। আচমকায় ডাকায় তো আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এর উপর সেখানে যেয়ে দেখি আইদও আছে। তাহিরা আপু ও আমার সিনিয়রও উপস্থিত ছিলো। আমার সিনিউর আগেই বলে দিয়েছিল যে ব্যাপারটা একটি জটিল। আমাকে চাকরি থেকে বের করার জন্য সম্ভবত ডেকেছে ম্যাডাম। কেউ একজন কথা বলতে এসেছিলো আমাদের চাকরি থেকে বের করার কথা বলার জন্য।”
“নিশ্চয়ই তীর্থ কাওকে পাঠিয়েছে। আমার জন্য আজ তোদের সাথে এমনটা হচ্ছে। আমার উচিত হয়নি তোর সাথে আসা। আজ আমার জন্য তোর চাকরি….” অনু তাক থেকে লাফ দিয়ে নেমে কবিতার ঠোঁটের উপর হাত রেখে বলে, “তোর রেডিও বন্ধ করে আমার কথা শুনবি একটু? তুই আমার জন্য কত লাকি জানিস?”

কবিতা অবাক দৃষ্টিতে তাকায় অনুর দিকে। অনুর হাত মুখ থেকে সরিয়ে বলে, “আমি?”
“তুই তো জানিস গত তিন বছর ধরে আমি প্রমোশনের জন্য কত পরিশ্রম করছি। কিন্তু কিছুতেই আমার প্রমোশন হচ্ছিল না। আজ ম্যাডাম যখন ডাকলো, তখন আমি তাকে ক্লিয়ার করলাম তীর্থের ব্যাপারটা। তীর্থ কোম্পানিতে ইনভেস্ট করার অফার পাঠিয়েছে মেডামকে। এর জন্য আমাকে ও আইদকে কেবল কাজ থেকে বের করতে হতো। ম্যাডাম সবটা শোনার পর সাথে সাথে মানা করে দিলো তীর্থের কর্মীকে। আর গেস হোয়াট? ম্যাডামের সাথে কথা হয় আমার। আমাকে না’কি প্রমোট করার জন্য মেডাম আগেই সিনিয়রকে বলেছিলো কিন্তু সে আমার জায়গায় তাই ভাইকে প্রমোট দিয়েছে। এইসব জানার পর মেডাম আমার সিনিয়র এবং তার ভাই দু’জনকেই গেট আউট করে দিয়েছে। আর ডাবল প্রমোশন পেয়েছি। আমার সিনিয়ের জায়গায়। বিশ্বাস হয় তোর?” অনু লাফিয়ে কবিতাকে জড়িয়ে ধরে। আবার বলে, “আমি এত্তগুলা খুশি। এখন আমরা ফুল ফ্ল্যাট বাসা নিয়ে থাকতে পারব। তোকে আমি কোথাও যেতে দিব না।”

অনেকদিন পর কবিতা ঠোঁটের কোণে সত্যিকারের হাসি এঁকে উঠে। অনুর খুশিতে সে অনেক খুশি হয়েছে। নিত্য যতই দৃঢ় হোক না কেন, সত্যের জয় একসময় হয়।

কবিতা জানে, অনু কখনও তাকে একা ছাড়বে না। কিন্তু সে অনুর উপর বোঝা হতে চাচ্ছে না। তাকে নিজ থেকে কিছু একটা করতেই হবে। তাও অতি শীঘ্রই।
.
.
ভোর সকাল পাঁচটায় ইন্তেকাল করে মৃণার বাবা। পরেরদিন কবর দেওয়া হয় তাকে। ঘরে কেবল হাহাকার চলছে। মৃণার মা’য়ের কান্না থামার নাম নেই। কান্নার চোটে সে নিজেও অসুস্থ হয়ে গেছে। কয়েকবার হুঁশও হারিয়েছে সে।

অন্যদিকে মৃণার অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। সে খাবার খাচ্ছে না অনেক সময় হলো। আইদের মৃণার থেকে বেশি তার বাচ্চাকে নিয়ে চিন্তা হলো। এই অবস্থায় রাখা থাকাটা উচিত নয়। সে একজন কে পাঠালো খাবার নিয়ে মৃণার রুমে। কিন্তু সে চিৎকার চেঁচামেচি করে তাকে বাহির করে দেয়। খাবারের প্লেটও মেঝেতে ফেলে দেয় না’কি!

টানা দুই দিন কেটে গেল। আইদ অফিসে এলো না কবিতার বলার পর থেকে অনু প্রায়ই খবর নেয় আইদের। তাদের মাঝে বন্ধুত্বও হয়ে গেছে এই কয়দিনে। আইদকে অফিসে না দেখে অনু তার এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে আইদের শশুড় মারা গেছে। অর্থাৎ মৃণার বাবা।

সে এই কয়দিনে বুঝে গেছে আইদ নরম মনের একজন মানুষ। মৃণার বাবা না’কি তার খুব কাছের মানুষও ছিলো। মৃণা তার সাথে যেমনি করুক না কেন কিন্তু মৃণার মা বাবার প্রতি মায়া তো সে ছাড়তে পারবে না। অনু কল দেওয়া সত্ত্বেও আইদকে কল দিয়ে ঠিকানা নেয়। আজ সন্ধ্যায় সে মৃণার বাসায় যাবে। অনু কেবল দোয়া চাইলো যেন মৃণার সামনে নিজেকে শান্ত রাখতে পারে। তার উপর ভীষণ ক্ষেপে আছে অনু। কখন কি করে ফেলে নিজেও জানে না। মেয়েটাকে ধরে অনেকক্ষণ পিটালেও মনে হয় না তার মন শান্ত হবে। কিন্তু মরা বাড়িতে এমন তামাশা করা যাবে না। সে নিজেকে শান্ত রাখতে পাড়লেই হলো। তবে মেয়েটা উল্টাপাল্টা কিছু করলে বা বললে সে নিজেকে শান্ত রাখতে পারবে বলে সন্দেহ।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here