মুহুর্তে পর্ব -৪১+৪২

#মুহূর্তে
পর্ব-৪১
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

সন্ধ্যায় অনু আইদের কিছু বন্ধুর সাথে মৃণার বাড়িতে গেল। মহলটা থমথমে। একটা রুম থেকে কান্নাকাটির শব্দ আসছিল। কোন খানিকটা অস্বস্তিবোধ করল। এমন মহলে কি করতে হয় সে জানে না। আইদের অন্যান্য বন্ধুরা তার পরিবারকে চেনার কারণে তাদের সাথে কথা বলতে গেল। মৃণার সাথেও। কিন্তু মৃণাকে দেখার মত অন্য কোন ইচ্ছা ছিলো না। মেয়েটার উপর তার যতই রাগ থাকুক না কেন, তার বাবার মৃত্যুর পরপরই সে মৃণাকে কিছু বলতে পারে না। এতটুকু বিবেক তার আছে। হোক মেয়েটা অনেক খাবার, তবুও তার বাবার মারা গেছে। অনুর বাবা মারা গেছে পাঁচবছর হবে। সে জানে এর কষ্ট। এছাড়া কারও মরা বাড়িতে তামাশা করাটা বিবেকহীনতার কাজ মনে হলো অনুর কাছে।

অনু আইদকে আশেপাশে খুঁজে পেল না। একটি বাচ্চা মেয়েকে জিজ্ঞেস করায় জানে সে ছাদে আছে। বিকেল থেকে সেখানেই বসা। মেয়েটি অনুকে নিয়ে গেল ছাদে। দরজা পর্যন্ত দিয়েই সে দৌড়ে চলে গেল।

আইদ দাঁড়িয়ে আছে ছাদের এক কোণে। চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। সে আনমনে তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। হঠাৎ কেউ তার পিছনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি ঠিক আছো?”
হঠাৎ এক মেয়েলী কন্ঠে আইদ চমকে উঠে। সে পিছনে তাকিয়ে অনুকে দেখতে পায়। জোরপূর্বক হেসে জিজ্ঞেস করে, “আমি ভেবেছিলাম তোমাদের আসতে আরও দেরি হবে। অফিস ছুটিতে সময় আছে তো তাই।”
“বড় ম্যাডামকে বলে জলদি এসেছি। নিচে আরও কয়েকজন এসেছে। তোমার পরিবারের সাথে কথা বলছে। তুমি এখানে কী করছ?”
“এমনিতেই দাঁড়িয়ে আছি।”
অনু যেয়ে পাশে দাঁড়ায় আইদের। সে নিচে তাকাল। বাড়ির পিছনের রাস্তার দিকে আইদ কি দেখছিলো সে বুঝতে পাড়লো না।তাই সরাসরি জিজ্ঞেস করে নিলো, “এই চিপা রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছ কেন?”
“আমি একবার ছোট বেলায় রাগ করে এখানে চলে এসেছিলাম। সাইকেলের জন্য। সবাই খুঁজছিলো আমায়, পায় নি, তখন রাশেদ আংকেল আমাকে এখানে খুঁজে পায়। আমি কিছুতেই বাসায় ফিরে যেতে চাইছিলাম না। জেদ ধরেছিলাম। আংকেল বাসায় ফোন করে জানায় আমি তার সাথে, তাই চিন্তা করতে না। সেদিন মধ্যরাত পর্যন্ত আংকেল আমার সাথে এখানে বসে ছিলেন।”
অনুর চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো, “তুমি রাগ করতে পারো?”
“পারি না?”
“দেখে একটুও মনে হয় না। তোমায় দেখে মনে হয় জীবনে রাগ করোই নি। একদম শান্ত তুমি”
অনুর প্রতিক্রিয়া দেখে আইদ না হেসে পারে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে, “সেদিন রাতে আংকেল কি বলেছিলো জানো? রাগ এসব তোমার শক্র। অন্যের উপর যখন আমরা রাগ করি তখন একপ্রকার নিজের উপর অত্যাচার করি। আর তা আপন কারও উপর হলে তাদের থেকে বেশি আমরা কষ্ট পাই। তারপর সে আমায় বুঝালো বাবার আর্থিক অবস্থার কথা। আমাদের পরিস্থিতি তখন এত ভালো ছিলো না। কিন্তু বাবা সবসময় আমাকে সবচেয়ে ভালো শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। সব কথা বর্ণনা দিয়ে আমাকে মধ্যরাত পর্যন্ত বুঝালেন সে। আমি বুঝলামও। এরপর কখনো আর জেদ করি নি। ঠিক একমাস পর আংকেল নিজে আমার জন্য সাইকেল কিনে নিয়ে আসলেন। আংকেল আন্টি দুইজনে আমাকে ছেলের থেকে কম আদর দেয় নি। অথচ আমি…আমি তাদের জন্য কিছু করতে পাড়লাম না। কিছু না।”
শেষ বাক্যটা বলার সময় গলা কেঁপে উঠে আইদের৷

অনু দ্বিধায় পড়ে যায়। এমন সময় কী বলে সান্ত্বনা দিতে হয় সে জানেনা। আর আইদকে তেমনভাবে জানেও না। সে সংকোচ নিয়ে বলল, “তোমাকে কি বলে সান্ত্বনা দিব আমি জানি না। তবে হ্যাঁ, এতটুকু বলব তুমি তার শিক্ষার মান রেখেছ। আর আমি নিশ্চিত, এই সে অনেক খুশি হবে।”
আইদ তাকায় অনুর দিকে, “অনু, আমার চেনার মাঝে কেবল তুমি জানো মৃণার সত্যটা। তোমার কি মনে হয় আমার কারণ এর রাশেদ আংকেল আজ আমাদের মাঝে নেই।”
“এসব কি বলছ তুমি? কে বলল তোমাকে এই ফালতু কথা?” অনু মৃদু হাসি ঠোঁটের কোণে এঁকে আইদের হাতের উপর হাত রাখে এবং বলে, “তোমার জন্য কিছু হয় নি। অকারণে নিজেকে দোষারোপ করো না।”

আইদের বন্ধুরা তার সাথে কথা বলতে চায়। কিন্তু আইদকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোনও লাগছে না তার। তাই মৃণার আইদকে খুঁজতে বের হতে হলো। সারা ঘর খুঁজে না পেয়ে সে রওনা দিলো ছাদের দিকে। ছাদে যেয়ে আইদকে আরেকটি মেয়ের সাথে দেখতে পেল সে। মেয়েটি তার হাত ধরা। দৃশ্যটা দেখতেই কেন যেন রাগে তার শরীর জ্বলে উঠলো। সে উচ্চস্বরে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যায়, “আমার বাবাকে মারার করার পরে তুমি এখন এখানে পিরিত করছো?”

অনু এবং আইদ পিছনে ফিরে তাকায়। মৃণাকে দেখে অনু ভ্রু কুঁচকে নেয়। সে মৃণাকে আগে দেখে নি। কিন্তু কথা শুনে সে নিশ্চিত এই মেয়েটাই মৃণা। সে একপলক তাকায় আইদের দিকে। আইদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মৃণার কথা উওর দিচ্ছে না।

মৃণা আবারও বলল, “আমার নাম নিয়ে তুমি আমাদের সম্পর্ক ভাঙতে চাইতে তাই না? যেন এই মেয়ের সাথে থাকতে পারো। আর সবাই আমাকে দোষারোপ করে। তোমার সাহস কত বড় হল আমার সাথে এমন করার? তোমার জন্য আজ আমার বাবা আমার সাথে নেই। শুধু তোমার জন্য। তুমি এই মেয়ের জন্য আমাকে প্রেশার দিয়েছিলে তাই না? তোমার সাহস কত বড়….”
মৃণা আইদের কাছে যেয়ে তার কলার ধরতে নিলেই মাঝখানে অনু এসে পড়ে। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় মৃণার দিকে, “আমি তোমাকে মনে করিয়ে দিতে চাই তোমার বাবা কেবল আজ এই পৃথিবীতে নেই এর কারণ কেবল তুমি।”
“হাউ ডেয়ার ইউ। তুই কে আমার স্বামীর সাথে কথা বলার সময় মাঝখানে আসার।”
“স্বামী? কে? আইদ তোমাকে বলে নি গর্ভবতী মহিলার বিয়ে জায়েজ হয় না?”
মৃণা খানিকটা চমকে গেলেও অনুর কথায়।

অনু আবারো বলে, “কবিতা আছে না, যার জামাইয়ের সাথে বেহায়াপণা করে পেটে বাচ্চা নিয়ে ঢ্যাঙঢ্যাঙ করে ঘুরে বেড়াচ্ছ তার বান্ধবী আমি। আর সাহস কি করে হয় তোমার না সরি, তুমি বলে সম্মান দেওয়ার যোগ্য না তুই। শালী নিজে টাকার জন্য শালীনতা বেঁচে খাইছিস বলে কি সবাইকে তোর মতো ভেবে রেখেছিস? তোর বাবার মৃত্যুর পর তার উপর ভালোবাসা উতলে পড়ছে তোর। তখন সে ভালোবাসা কই ছিলো যখন তার সম্মান বিসর্জন দিয়ে তুই একজন বিবাহিত পুরুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে চেয়েছিস?”
আইদ অনুকে থামাতে চাইলো সামনের কথাগুলো বলতে। এখন এ কথাগুলো বলা উচিত হবে না। কিন্তু অনু থামে না। সে বলেই যায়, “এই’যে তুই এখন আইদকে দোষ দিচ্ছিস যে ও না প্রেশার দিলে তোর বাবা মরতো না। এই কথা তো একবারও মাথায় আসে নি যে তীর্থের সাথে সম্পর্কে না জড়ালে আজ তোর বাবা তোর সাথে থাকতো। তুই তোর জীবনে সুখে থাকতি। কবিতা নিজের জীবনে সুখে থাকতো। তোর জন্য কতগুলো জীবন নষ্ট হয়ে গেল। আচ্ছা তুই তো তীর্থকে বিয়ে করার জন্য প্রেশার দিয়েছিলে তাই না? তখন তোর বাবা জানতো না তোর এই নষ্টামির কথা? প্রেগন্যান্ট হবার সত্বেও তুই তীর্থের কাছে যেতে চেয়েছিলি, তখনও জানতো না তোর এই জঘন্য রূপ? তুই কেবল এখন অন্যকাওকে দোষারোপ করে নিজের মনের অপরাধী ভাব কমাতে চাইছিস, আর কিছু না। তোর বাবার মৃত্যুর একমাত্র অপরাধী তুই। তোর কারণে তোর বাপ মরেছে। তাও একরাশ অপমান, কষ্ট এবং ঘৃণা বুকে নিয়ে। আমি নিশ্চিত, সে মৃত্যুর মুহূর্ত আফসোস করছিলো তার তোর মত একটা মেয়ে আছে।”

কথাগুলো শুনে মৃণা নিজের হুঁশে আর থাকলো না। তার কান্না আসলো। সে রাগে, কষ্টের থাপ্পর মারতে নিলো অনুকে। আইদ সাথে সাথে তার হাত ধরে নিলো। সে গম্ভীর গলায় বলে, “মৃণা বাসায় যাও। আমি এখানে কোন তামাশা চাইনা।”

মৃণা কাঁপছিলো রাগে। সে কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে আইদকে বলল, “তুমি…তুমি ওর জন্য আমাকে এভাবে বলছো? এই মেয়ে তামাশা করেছে আমি না।”
“শুরু তুমি করেছ। এছাড়া আমি কার সাথে কথা বলি, কার সাথে নাএটা তোমার দেখার বিষয় না। আমার ওপর তোমার কোনো রকমের অধিকার নেই।”
“আমার অধিকার নেই, তাহলে কি এই মেয়ের আছে?”
“হ্যাঁ, ও আমার বন্ধু হয়। কিন্তু তুমি আমার কেউ হও না।”

অনু শান্ত গলায় বলে, “দেখো আমি আর তামাশা করতে হলে আমি এখনো করতে পারি। এখনই সবাইকে এখানে ডেকে তোমার সব সত্য সামনে আনতে পারি। বিশ্বাস করো, আমার বলতে এক মুহূর্ত লাগবেনা। আমি আইদ বা কবিতার মতো না যে অন্যকারো কথা ভাববো। কিন্তু একজন মৃত মানুষকে সম্মান দেখিয়ে কোন কিছু করছি না আমি। কিন্তু আমার মাথা নষ্ট করবে না, আমি সে সম্মান দেখানো ভুলে যাব।”
মৃণা ভয় পায় খানিকটা। সে এক পলক অগ্নিদৃষ্টিতে অনুর দিকে তাকিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।

মৃণা যাবার পর আইদ অনুকে বলে, “সরি অকারণে তোমাকে এসব শুনতে হলো।”
“সরি? ভাই তুমি বুঝতে পারবে না আমার মনটা এখন কত হালকা লাগছে। শুধু পাড়ছি না বলে, নাহলে ওকে বটগাছে উল্টো লটকিয়ে কিছু পোকা-মাকড় ওর উপর ছেড়ে দিলে আমার মনটা আরেকটু শান্ত হতো।”
রাগে দুইহাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল অনু। আইদ এমন মন খারাপের মধ্যেও অনুর কথা শুনে হেসে দেয়।

অনু তার দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমার সব সময় হাসতে থাকো উচিত। হাসিতে তোমাকে মানায়।”
.
.
কবিতা বাসায় আসো। একটা ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল সে। সে প্রায় সেলেক্টও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এমন একটা ঘটনা ঘটলো যার কারণে সে নিজেই চাকরিটা ছাড়তে বাধ্য হয়। একটি মধ্যবয়স্ক লোক ইন্টারভিউ নিচ্ছিল। অন্তিম সময়ে সে অফিসের নিয়ম বলার সময় উঠে এসে তার পাশে দাঁড়ায়। বাজে ভাবে হাত দেওয়ার চেষ্টা করে তার শরীরে। এখনো সেই মুহূর্তটা ভাবলে শরীর ঘিনঘিন করে ওঠে কবিতার।

এত বছর কোন দুনিয়াতে বাস করতো সে? এমন মুহূর্তে সাথে আর কখনো মুখোমুখি হয়নি সে। এই জগৎটা কি এতই খারাপ? এই ক’দিন এই সমাজের যে জঘন্য রূপ দেখেছে সে এত বছরেও দেখতে পাইনি।

বাসায় এসে দেখে কাব্যের আবারো জ্বর এসেছে। জ্বরে কাঁপচ্ছিলো সে। অথচ অনুর ভাবি বসে বসে টিভি দেখছে। তাকে একবার ফোন করে জানানোর প্রয়োজনওবোধ করে নি সে। ভীষণ রাগ করছিল তার অনুর ভাবির উপর। ইচ্ছা করছিলো কতগুলো কথা শুনাতে। কিন্তু এখনই সময় নেই। সে জলদি করে কাব্যকে নিয়ে গেল হাস্পাতালে। কুহুকেও সাথে নিয়ে গেল। সে কোনোমতে আর অনুর ভাবিকে ভরসা করতে পারবে না।

হাস্পাতালে এসে পড়লো আরে চিন্তায়। কাব্যকে কেবিনে ভর্তি করানো হয়েছে। ঔষধ এবং স্যালাইনের টাকা লাগবে। যা তার কাছে নেই। সে অনু এবং তাহিরাকে কল দিলো কিন্তু কাউকে পেল না। তারপর ঔষুধের দোকানে যেয়ে বাকি স্যালাইন দেওয়ার অনুরোধ করলো কিছুই হলো না। অবশেষে না পেরে কল দিলেও তীর্থকে।

“হ্যালো।”
“শেষমেষ তুমি কল দিলে। তোমার জেদ কী অবশেষে হলো?”
কবিতা কাঁপানো গলায় বলে, “কাব্য হাস্পাতালে ভর্তি। চিকিৎসার জন্য কিছু টাকা লাগবে। ইমার্জেন্সি আছে।”
“কাব্য, ওর কী হয়েছে? তোমার গাফিলতি পরিণাম। তোমাকে আমি বলেছিলাম তুমি আমার ছেলেমেয়ে খেয়াল রাখতে পারবে না, তোমার জেদের কারণে আজ কাব্যের এই অবস্থা। আমি জানতাম তোমার পক্ষে কোন কিছু করা সম্ভব না। তাই মানা করেছিলাম। আমার কথা তোমার মানো নি। এখন পরিণাম দেখলে? কবিতা এখনো সময় আছে, আমার কাছে ফিরে আসো। আজ জেদ করো না।”
“কাব্য হাস্পাতালে ভর্তি, মাঝেও তুমি কথা বলছো। কিছুটা তো বিবেক রাখো।”
ফোনের ওপাশ থেকে তীর্থ শান্ত গলায় বলল, “তোমার টাকা লাগবে তাই না?”
কবিতা কাঁপছিল। দুই চোখ দিয়ে বয়ে যাচ্ছিলো জল। সে ভেবেছিলো এই জনমে আর তীর্থের টাকা সে ব্যবহার করব না। তার অর্থের অহংকার ভেঙে ছাড়বে সে। এ ধারণা ভেঙ্গে ছাড়বে যে, তাকে ছাড়া সে অসহায়। কিন্তু ভাগ্য তা হতে দিলো না। অবশেষে তাদের সামনে হাত পাততে হলো। কারণ তার নিজের থেকেও তাঁর সন্তান তার কাছে বেশি।
তাই সে কান্না ভেজা গলায় উত্তর দিলো, “হঁ”
“তাহলে আমার কাছে ফিরে আসো।”
কথাটা শুনে যেন কবিতার পায়ের নিচের থেকে জমিন সরে গেল। সে বিস্ময়ের চরম সীমানায়, “কাব্য তোমারও ছেলে তীর্থ। তুমি ওর এই অবস্থায় আমার কাছে শর্ত রাখছো?”
“তুমি আমার কাছে অন্য কোন রাস্তা রাখো নি।”

কল কেটে দেয় কবিতা। সে বিশ্বাস করতে পাড়ছে না নিজের কানকে। হতে পারে সে অনেক খারাপ করেছে কবিতার সাথে। কিন্তু কাব্য তো তার ছেলে। তার আপন রক্ত। কাব্য চিকিৎসার জন্য রাখছে সে? নিজেকে খুবই অসহায় মনে হলো কবিতা। সে কাঁদতে কাঁদতে মুখ হাত দিয়ে ঢেকে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। তার মনে হলো এই মুহূর্তে তার জন্য তার ছেলের প্রাণ সবার আগে। সে স্বার্থপর হতে পারে না। সে কাব্যের জন্য তীর্থের দেওয়া শর্ততেও রাজি।

হঠাৎ কারও কন্ঠ শুনতে পেয়েছে, “কবিতা… কবিতা তুমি ঠিক আছো তো?”
একটি হাত তার কাঁধে সান্ত্বনার ভঙ্গিতে রাখা হলো। সে চোখ তুলে তাকালো। দেখতে পেল কথনকে। কথন তার এই অবস্থা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সে অশান্ত বলে জিজ্ঞেস করে, “তুমি এভাবে কাঁদছো কেন? কি হয়েছে আমায় বলো।”
#মুহূর্তে
পর্ব-৪২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

কথন তার এই অবস্থা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সে অশান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি এভাবে কাঁদছো কেন? কি হয়েছে আমায় বলো।”

কান্নার কারণে কবিতা কথা বলতে পারছিলো না। কথনকে দেখে সে কিছু বলতে যেয়েও পারে না। তার নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। কথন একজন সিকিউরিটির লোককে বলে, “জলদি পানি নিয়ে আসো।”
কথন কবিতার গালের জল মুছে দেয়। তখনই তার চোখ পড়ে কবিতার গালের থাপ্পড়ের চিহ্নের। সে চমকে উঠে। কিন্তু কবিতার এ অবস্থা দেখে তাকে কোন প্রশ্ন করা উচিত মনে করে না।

তাকে পানির বোতল এনে দেবার পর সে জলদি করে পানি খাওয়ায় কবিতাকে। কথন হাত দিয়ে তার চুল ঠিক করে তার হাত ধরে বলে,”গভীর নিশ্বাস ফেলো।”
কবিতা বড় বড় নিশ্বাস ফেলে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “কাব্য…”
“কি হয়েছে কাব্যের? ও ঠিক আছে তো?”
“ও অনেক অসুস্থ। স্যালাইন… আর ঔষধ লাগবে কিন্তু অনু আর তাহিরা ফোন ধরছে না। উনারা আমাকে তা দিচ্ছেও না। আমি বলেছি যে পরে টা..টাকা দিয়ে দিব তাও দিচ্ছে না।”

কথাটা শুনে রক্ত উঠে যায় কথনের মাথায়। সে দাঁড়িয়ে পাশের ঔষধ কাউন্টারের ছেলেকে জিজ্ঞেস করে, “কি বলছে ও?”
“স্যার আমি জানতাম না উনি আপনার পরিচিত, সরি।”
“সরি? কারও অবস্থা এত খারাপ হলে তুমি টাকার জন্য তাকে ঔষধ দিবে না? পরিস্থিতি দেখে তো একটু মনুষ্যত্ব দেখাবে তাই না? তোমরা দেখি হাস্পাতালকে সেবা নামে ব্যবসা বানিয়ে রেখেছ। উনি যে যে ঔষধ বলেছে জলদি আমাকে দেও। টাকা আমি পরে দিয়ে দিব।”
“এখনো দিচ্ছি স্যার।” ছেলেটা কথনকে ঔষধের প্যাকেট দিতে বলল, “আবারও সরি স্যার।”

কবিতা কথনের পিছনে একটি মধ্যবয়স্ক নার্স দাঁড়ানো। তার কোলে কুহু। কাব্যের চিকিৎসা জন্য এখানে প্রায়ই আসার কারণে তাকে একটু চেনা হয়েছে কবিতার। কব্যের ঔষধ নিতে আসার সময় কুহুকে তার কাছে দিয়ে এসেছিলো কবিতা। সম্ভবত এই নার্সই কথনকে তার কথা বলে এনেছে। ভাগ্যিস এনেছে, নাহলে কী হতো আজ তার সাথে? ভাবতে ভাবতেই তার ফোন বাজলো। তীর্থের কল। তীর্থের কল দেখেই তার গা জ্বলে উঠে। সে সাথে সাথে কেটে দেয় তার কল।
কথন বলে, “কেবিন নং কত?”
“৩০২”
“আসো।”

কথন নিজেই কাব্যের চিকিৎসা করে। কাব্যের অবস্থাও আগের থেকে ভালো হয়। সে একটু ভালো অনুভব করতেই কবিতাকে ডাকে, “আম্মু…”
কবিতা তার পাশে দাঁড়িয়েছিলো। কাব্যের ডাক শুনে সে তো চোখ মুখ মুছে কাব্যের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “এই যে বাবা আম্মু পাশে আছি।”
কাব্য আশেপাশে চোখ বুলায়। মুখ মলিন করে জিজ্ঞেস করে, “আব্বু কি আজও আমাকে দেখতে আসবে না?”
কবিতা কি উত্তর দিবে বুঝতে পারে না। সে তীর্থকে স্বামী হিসেবে না মানলেও সে কখনো চাইনি তোর ছেলে মেয়েরা বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হোক। যে কখনো তোর ছেলে মেয়েকে তীর্থের সাথে দেখা করার জন্য মানাও করতো না। কিন্তু একটু আগে তীর্থের কথা শোনার পরে কিভাবে দেখা করা সে কাব্যকে এমন এক ব্যক্তির সাথে যে তার অসুস্থতার মধ্যেও লেনদেন করার চিন্তা রাখে। সে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলে, “আব্বু তো ঢাকার বাহিরে। আসলে সবার পূর্বে কাব্যের সাথে দেখা করবে।”
কবিতা আড়চোখে তাকায় কথনের দিকে। কথন তার দিকে কেমন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু কবিতাকে সে কিছু জিজ্ঞেস করল না। সে যেয়ে কথা বলতে শুরু করল কাব্যের সাথে। কথন এর মাঝে এমন একটা কিছু আছে যার কারণে কেউ-ই তার সাথে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করে না। আর কাব্য তো কথনকে পেয়ে মহাখুশি। এত জ্বরের মাঝেও সে কথনের সাথে কথা বলা থামাতেই চাইছে না। কিন্তু একসময় ঔষধের কারণে সে গভীর ঘুমে চলে যায়। কুহুকেও খাবারের পর সে ঘুমের রাজ্যে চলে যায়। কথন কুহুকে নার্সের কাছে রেখ কবিতাকে নিজের সাথে নিয়ে যায় তার কেবিনে। কবিতাও কিছু বলে না। সে ভাবে কথন ঔষধের টাকার কথা অথবা তার এভাবে বাহিরে সিন ক্রিয়েট করা নিয়ে কিছু বলবে। কিন্তু কেবিনে ঢুকতেই তার প্রথম প্রশ্ন ছিলো, “কে তোমার উপর হাত তুলেছে?”
কথনের কন্ঠ দৃঢ়, শক্ত।
কবিতা হকচকিয়ে যায় এই প্রশ্নে। সে আমতা-আমতা করে বলে, “কী? কী বলছেন আপনি? আমাকে কে মারবে। ”
কথন সামনে যেয়ে দাঁড়ায় কবিতার। তার বামগালে আলতো করে আঙুল ছোঁয়ায়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় কবিতার দিকে, “স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।”

কবিতা চোখ সরিয়ে নেয়। উওর দেয় না। এই ব্যাপারে রাগ উঠে যায় কথনের। সে উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কতদিন আগেও আমায় বলেছ তীর্থ ঢাকার বাহিরে গেছে, এখনো আসে নি? তার ছেলেরে অসুখেও না? এর উপর দিয়ে তোমার গালে থাপ্পড়ের দাগ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে কিন্তু তুমি তা মানতে রাজি না। এমন কেন করছো তুমি? নিশ্চয়ই কোনো বড় কারণ আছে। আমার উওর লাগবে আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি কবিতা।”
কথনের এই কথার আন্দাজে তার তীর্থের কথা বলার ধরণ ভেসে উঠে কানে। তার বুকে ব্যাথা হয়। মাথা ধরে যায়। এলোমেলো হয়ে যায় সে। মেজাজ খারাপ হয়ে যায় তার। সে কথনের হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বলে, “আপনাকে কেন আমার বলতে হবে? আপনি কে হন আমার?” বলে নিজেই বেকুব হয়ে গেল। সে বুঝতে পারলো এই কথাটা তার বলাটা উচিত হয় নি।

কথনের বুকের ভেতর কামড়ে উঠে কবিতার কথায়। সত্যিই তো কে হয় সে কবিতার? কেউ না। কোনো সম্পর্ক নেই তাদের। সে এক ঢোক গিলে। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় কবিতার কথায়, “সত্যিই আমি তোমার কেউ না। আমার এই প্রশ্ন করাটাও অনুচিত।”
কবিতা প্রভাবিতভাবে বলে, “ক্ষমা করবেন। আমি ইচ্ছা করে বলি নি। আমার মাথা ঠিক ….”
কথন তার কথা সম্পূর্ণ হতে দেয় না। সে পিছনে ফিরে নিজের চেয়ারের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে, “তুমি যা বলেছ ভুল বলো নি। তাই তোমার ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই আসে না।”

কবিতা কিছুই বুঝতে পারছে না। এমন ভাবে কেন কথা বলল সে কথনের সাথে? সে নিজেও ভালোমতো জানে কথন প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে তার অনেক সাহায্য করেছে। তাই উনার সাথে এমন ভাবে কথা বলায় কবিতার নিজের উপরই রাগ উঠছে। সে লজ্জার কারণে কথনকে তার এবং তীর্থের ব্যাপারটা বলতে চাইছিলো না। কিন্তু এই মুহূর্তে তার বলাটাই উচিত মনে হলো, “আমি তীর্থকে ছেড়ে এসেছি।”

থেমে গেল কথন। নিথর হয়ে দাঁড়ালো সে। নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলো না। সে ফিরে তাকালো কবিতার দিকে, “কী…কী বললে তুমি?”
“যা শুনেছেন। আমি তীর্থকে ছেড়ে দিয়েছি। সত্যি বলত্র ও ঢাকাতেই আছে।”
“কিন্তু কেন?”
উত্তর দেওয়ার পূর্বে কিছুক্ষণ সময় নিলো কবিতা। কাঁপানো গলায় বলল, “ও অন্য একটা মেয়ের সাথে…” এতটুকুতেই দম বন্ধ হয়ে এলো তার। সে গভীর নিঃশ্বাস ফেলে, “তার অন্য এক মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিলো।”
“হোয়াট? ওয়েট, তোমাদের লাভ ম্যারেজ। তোমাকে ভালবাসতো তাই না?”
“হয়তো। এখনো তো বলো ভালোবাসে। ভালোবাসলে মানুষ তার ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট দিতে ভালোবাসে একথা তো আমার জানা ছিলো না। সত্যি বলতে, এখন আমার সন্দেহ হয় সে কি কখনো আমাকে ভালবেসেছিলো? হয়তো বেসেছিলো। সময়ের সাথে সাথে ভালোবাসা শেষ হয় কি’না আমি জানি না।”
কবিতার চোখ নম্র হয়ে এলো। সে বহু কষ্টে নিজের চোখের জল আটকাচ্ছে।

কথন কিছু সময় নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। তারপর এগিয়ে রলো কবিতার কাছে। কবিতা সামনে দাঁড়িয়ে আলতো করে ছুঁল তার গাল। বুক কেঁপে উঠল তার। সে প্রশ্ন করল, “এটাও কি সে করেছে?”
কবিতা একপলক চোখ তুলে তাকায় কথনের দিকে। মাথা নাড়ায়।

কথনের মাথায় ছিলো রক্ত ঝরে যায়। সে গর্জে উঠে, “ও তোমাকে হার্ট করলো কোন সাহসে? আমি ওকে ছাড়ব না। খুন করে ফেলব ওর।”
কবিতা চমকে উঠে কথনের এমন বাক্যে। কথনের এই প্রতিক্রিয়া সে আশা করেনি।
কথনকে এভাবে ক্রোধে কক্ষ থেকে বের হতে দেখে ঘাবড়ে যায় কবিতা । ছুটে যেয়ে কথনকে আটকায়, “কি করার চিন্তা করছেন আপনি?”
“ওই লোকের সাহস কী করে হলো তোমাকে কষ্ট দেওয়ার? আমি ওকে ছাড়বো না।”
কথন দরজা খুলতে যাওয়ার পূর্বে কবিতা যেয়ে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায়। কথন দরজার লকে হাত রেখে কঠিন গলায় বলে, “কবিতা সরো এখান থেকে।”
“আপনি প্লিজ শান্ত হন। এখানে আপনার এমন ব্যবহার করার কোনো প্রয়োজন নেই।”

কথন ঝুঁকে কবিতার মুখোমুখি হয়। কথন তার চোখে চোখ রেখে বলে, “আমার এমন ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই? ওর কারণে তুমি কষ্ট পেয়েছে, ও তোমার উপর হাত তুলেছে, আমি নিশ্চিত আজ ওর কারণে তুমি এভাবে কাঁদছিলে। আমি ভাবতেও পারছি না তুমি তাহলে সে ধোঁকার পর কত কেঁদেছ। তোমার প্রতিটি অশ্রুর হিসাব ওকে দিতে হবে। আমি ওর উপর ভরসা করে তোমাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম, নাহলে আমি কখনো….” এতটুকু বলেই থেমে গেল কথন। সামনে বলাটা উচিত মনে হলো না তার। সে রাগে গভীর নিশ্বাস ফেলতে থাকে। ঠোঁট কাঁপতে থাকে তার।

কবিতা একটুখানি কেঁপে উঠে কথনের শীতল দৃষ্টির দর্শনে। সাথে অস্বস্তিও লাগে তার কথনের এমন কাছে থাকায়। এমন না যে কথন তাকে কোনো খারাপ নজরে দেখছে, তবুও বিয়ের এত বছরে তীর্থ ছাড়া কোনো পুরুষের স্পর্শও সে লাগতে দেয় নি। এত কাছে আসা তো দূরের কথা। চোখ নামিয়ে কাঁচুমাচু হয়ে মৃদুস্বরে বলে, “আপনি শান্ত হন। আপনার কিছু করতে হবে না। উনাকে যে শাস্তি দেবার তা আল্লাহ দিবে। উনি আমার সাথে যা করেছে তার পরিণতি উনি পাবেই।”
“তুমি সব ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিতে বলছো?” কথন গর্জে উঠে। কবিতার কাঁধের পাশে জোরে এক ঘুষি মেরে আবারও বলে, “ওর সাহস কী করে হয়েছে তোমাকে কান্না করানোর? তোমার বিশ্বাস ভাঙার? তোমাকে কষ্ট দেওয়ার?”
কথাগুলো বলার সময় কথনের গলা কেঁপে উঠে। অবাক হয় কবিতা। কিন্তু ব্যাপারটাকে শুধু কল্পনায় ভেবে নেয় সে। সে চোখ তুলে তাকে কথনের দিকে, “আমি নিজেকে প্রমাণ করে দেখাব। আমার সাফল্য ওর পরাজয় হবে এবং আমাকে না পাওয়া ওর শাস্তি। কিন্তু আমি চাইনা আপনি আমার জন্য কিছু করেন।”

কথন কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কবিতা দিকে। সরে গেল তার কাছ থেকে। সোজাসাপটা জিজ্ঞেস করল,
“তালাক নিয়েছ?”
তালাকের কথা শুনে কেমন কেঁপে উঠে কবিতা। সে জানে তার এবং তীর্থের মাঝে এখন আর কোনো কিছু সঠিক হওয়া সম্ভব নয়। তবুও তালাক অনেক বড় একটি শব্দ। ইহকালের জন্য যাকে আপন মেনে নিয়েছিলো তাকে ছেড়ে দেওয়াটা কষ্টকর। এমন না যে কবিতা এ ব্যাপারে আগে চিন্তা করেনি। করেছে, কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস হয়নি তার।

কথন কবিতা দ্বিধায় স্পষ্ট তার মুখের দেখতে পারছিলো। সে তার উত্তর পেল। কবিতা এখনো তীর্থকে দেয় নি। সে শান্ত গলায় বলল, “যে সম্পর্ক নেই সে সম্পর্কের নাম রাখার মানে হয় না কবিতা। এই সম্পর্ক না ভাঙলে, সম্পর্কটা তোমার কাছে দায় হয়ে থেকে যাবে সারাজীবন।”
.
.
“জানো আমি যাকে প্রথম ভালোবেসেছিলাম সে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম আমি। আমার হুঁশ ছিল না কি করছিলাম। না ঠিকমতো খেতাম, না পড়াশোনা করতাম। জীবনটা কেমন যেন শূন্য হয়ে গেছিলো। তার কাছে বারবার ফিরে যাওয়ার দোহাই চেয়েছিলাম আমি।” কথাগুলো বলতে বলতে রুপার দম বন্ধ হয়ে আসলো। কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে আবারো বলল, “সে আমায় ফিরিয়ে নেয় নি। আর আমার উপর ইন্টারেস্ট শেষ হয়ে গিয়েছিলো। অন্যমেয়ের উপর তার ভালবাসার বর্ষণ হচ্ছিল। এরপর আমি ভাবলাম, ভালোবাসা বলতে পৃথিবীতে কিছু নেই। যদি ভালোবাসা ছাড়াই সম্পর্ক করা যায় তাহলে অযথা নিজেকে এই কষ্ট দেবার মানে হয় না। এরপর বিভিন্ন ছেলের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলি আমি। একসাথে অনেকগুলো ছেলের সাথে কথা বলতাম, টাইমপাস করতাম। যাদের ভালো লাগতো তাদের সাথে কিছু অন্তরঙ্গ মুহূর্তও কাটাতাম। ভালোই ছিলো দিনগুলো। না কোন দুঃখ, আর না কোন দুঃখে মেশানো অনুভূতি। তারপর আমার জীবনে তুষার এলো। সে কেবল আমার বন্ধু ছিলো। সে কখনো আমার উপর লাইন মারার চেষ্টা করে নি। এই কারণের ওপর মন দিয়ে দিলাম আমি। কিন্তু কখনো বলি নি। সে সবসময়ই ছিলো নিখাদ চরিত্রের। কখনো কোন মেয়ের দিকে খারাপ নজরে তাকাতে দেখে নি আমি ওকে। আর আমি বিপরীত। ছয় বছরের বন্ধুত্ব কাটে আমাদের। আমাদের গ্রাজুয়েশনের দিন ও আমাকে সোজা বিয়ের দিনের জন্যও প্রপোজ করে বসে। এমন না যে আমার চরিত্রের সম্পর্কে অবগত ছিলো না। ভার্সিটির সকালেই জানতো। আর ও তো সব গভীরভাবে জানতো। সেদিন আমার কাছে একটাই ওয়াদা চেয়েছিল, আমি এসব খারাপ কাজ বন্ধ করে কেবল তার হয়ে থাকব। আশ্চর্যজনক ব্যাপার জানো কী? ও না এর পরও আমাকে কখনো সন্দেহ করে নি। আমার অতীত জানা সত্ত্বেও।”

তাচ্ছিল্য হাসে ধ্রুব। তার নিরাভরণ দেহে হাত বুলিয়ে গালে চুমু খেয়ে বলল, “অথচ এই’যে তুমি আমার সাথে।”
“কি করবো অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। অনেক ছাড়ার চেষ্টা করেছে পারি নি। আর আজই তো শেষ দিন, এই শুক্রবার আমার বিয়ে। এই আমাদের শেষ দেখা।”
“আমাকে ভুলে যাবে না কিন্তু।”
“তোমাকে ভুলে যাব? তোমার মত মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। তোমাকে ভুলে যাওয়া তো অসম্ভব।”
ধ্রুব আবার ডুব দেয় রূপার মাঝে। বলে, “যখনই প্রয়োজন হবে একবার মনে করবে আমি হাজির হয়ে যাব।”
কলিংবেল বাজলো এরমধ্যেই। ধ্রুব বিরক্ত হয়ে বলল, “এইসময় কে আসতে পারে?”
“খাবার অর্ডার দিয়েছিলে না? হয়তো তাই এসেছে।”
একটি হোটেলে ছিলো রূপা ও ধ্রুব। সেখানে বিশেষ কিছু মুহূর্ত কাটাচ্ছিলো দু’জন। কিন্তু কলিংবেল শুনে না চাওয়া সত্ত্বেও উঠতে হলো তার। পোশাক পরতে পরতে দরজা খুলে সে। দরজা খুলেই স্থির হয়ে যায় সে।অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তারা সামনে দাঁড়ানো তাহিরার দিকে।

চলবে…

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here