মুহুর্তে পর্ব -৪৩+৪৪

#মুহূর্তে
পর্ব-৪৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

একটি হোটেলে ছিলো রূপা ও ধ্রুব। সেখানে বিশেষ কিছু মুহূর্ত কাটাচ্ছিলো দু’জন। কিন্তু কলিংবেল শুনে না চাওয়া সত্ত্বেও উঠতে হলো তার। পোশাক পরতে পরতে দরজা খুলে সে। দরজা খুলেই স্থির হয়ে যায় সে।অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার সামনে দাঁড়ানো তাহিরার দিকে।

তাহিরা কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি আমি জানতে পারি এত রাতে এই হোটেলে কি করছো?”
ধ্রুবর ভয়ে জান শুকিয়ে যায়। সে এক ঢোক গিলে। কিন্তু স্বাভাবিক হয়ে বলে, “আমি… আমি তো একটা ক্লায়েন্টের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম নিচের রেস্টুরেন্টে। একটু মাথা ব্যথা করছিলো দেখে উপরে রেস্ট নিতে আসলাম। তুই এখানে কীভাবে?”
“বাসায় না যেয়ে তুই এখানে রেস্ট নেবার জন্য এসেছিস?”
“তাহু তুই কি আমাকে সন্দেহ করছো?”

তাহিরা ধ্রুবকে একপাশে সরিয়ে নিজের ভিতরে যায়। হোটেল রুমে ঢুকে দেখে ভেতরে কেউ নেই। ধ্রুব শান্তির নিশ্বাস ফেলে সম্ভবত রুপা তার কথা শুনে কোথাও লুকিয়ে পড়েছে। ধ্রুব নিজে দোষীভাব স্বীকার করবার পরিবর্তে উল্টো অপরাধবোধ করানোর চেষ্টা করে তাহিরাকে, “তাহিরা তুই ভেবেছিলি আমি কোনো মেয়ের সাথে এখানে….ছিঃ! তুই এটা ভাবতেও কীভাবে পারিস? কবিতা সামনে সেদিন তো তুই এমন দেখালি যেন আমায় বিশ্বাস করিস। এই তোর বিশ্বাসের নমুনা?”

তাহিরা কিছু সময় তাকিয়ে থাকে ধ্রুবর দিকে। তারপর আশেপাশে খুঁজতে শুরু করে সে। তাহিরাকে এভাবে খুঁজতে দেখে আসলেই ভীষণ ভয় পেয়ে যায় ধ্রুব। সে দ্রুত যেয়ে হাত ধরে নেয় তাহিরার, “আমি কিছু বলছি তাহু।”

তাহিরা হাত ঝেড়ে নেয়। তার দৃষ্টি শীতল। তার মুখ দিয়ে একটি শব্দও বের হয় না। সে বাথরুম এবং আলমারিতে খোঁজার পর খাটের নিচে দেখে। খাটের নিচে পায় সে রুপাকে। রুমা কোনোমতে তার ওড়না দিয়ে নিজেকে ঢাকার চেষ্টা করছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে শীতল দৃষ্টিতে তাকায় ধ্রুবর দিকে।

কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে ধ্রুব ভাবলো তাহিরা এখনো খুঁজে পায় নি রুপাকে। এই কারণে সে বলল, “দেখলে তো আমি বলেছিলাম এখানে কেউ নেই। তুমি আমার কথা বিশ্বাসই করলে না।”
তাহিরা চোখ ফিরিয়ে নেয়। কিছু না বলেই চলে যায় সেখান থেকে। তাহিরা যেতেই দেখে রুপা বের হয়েছে বিছানার নিচ থেকে। তাকে দেখেই ধ্রুবর চক্ষু কপালে উঠে যায়, “তুমি এখানে… তাহিরা তোমাকে দেখে নিয়েছে?”
মাথা নাড়ায় রুপা।
“ওহ সীট!” ধ্রুব দৌড়ে যায় তাহিরার পিছনে। বাহিরে করিডরে কোথাও পায়না সে তাহিরাকে। লিফটও অন্য তালায় আটকে আছে। সে জলদি করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে। সে দেখে তাহিরা দরজা দিয়ে বের হচ্ছে। সে পিছু গেল তাহিরার। সে বেরিয়ে দেখে তাহিরা রাস্তা পাড় হচ্ছিলো। একটি গাড়ি দ্রুত এগিয়ে আসছিলো তার দিকে। তাহিরা এক’পাও নড়লো না। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয় সেখানে। ধ্রুব ডাক দিলো তাহিরাকে, যা বোধহয় কানেই গেল না তাহিরার। সে এক ইঞ্চিও সরলো না। হঠাৎ ধ্রুবর মনে পড়লো তাহিরার কথা, ‘তুই আমার সাথে এমন করলে তো আমি নিশ্চিত মরে যেতাম।’
কথাটা মন করতেই বুকের ভেতর কামড়ে উঠে ধ্রুবর। সে ছুটে যায় তাহিরার কাছে। এর পূর্বেই গাড়িটি এসে থামে তাহিরার সামনে। ড্রাইভার গাড়ির জানালা থেকে মুখ বের করে উঁচু গলায় বলে, “মেডাম আপনার কী মরার শখ হইসে? এত শখ থাকলে অন্যকোথাও যেয়ে মরেন, আমার গাড়ির সামনের থেকে সরেন তো।”

ধ্রুব এতক্ষণে এসে পড়েছে। সে ড্রাইভারের কথা শুনে তাকে ভালো শিক্ষা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে তার তাহিরাকে আগে বোঝানোটা উচিত মনে হলো। সে তাহিরার হাত ধরে আলাদা নিয়ে আসে। নিজের কর্মের জবাবদিহি দিতে তৈরি হয় সে। সে বলতে নেয়, “তাহু আমার কথা একটু শুন। আই ক্যান এক্সপ্লেইন।”
“আমি বাসায় যাব।” তাহিরা অনুভূতিহীন ভাব নিয়ে বলে ধ্রুবকে।
ধ্রুব অনেকটা চমকে উঠে তাহিরার এমন প্রতিক্রিয়ায়। তার এক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল সে কল্পনা করছে। তাহিরা সবকিছু জানার পর এমন প্রতিক্রিয়া দিতেই পারে না। সে বিস্মিত গলায় বলল, “কী?”
তাহিরা চোখ তুলে তাকায় ধ্রুবর দিকে। অনুভূতিহীন দৃষ্টি। শীতল গলায় বলে, “আমি বলেছি বাসায় যাব। গাড়ি বের কর।”
ধ্রুব কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। কি হচ্ছিল সে বুঝতে পারছিল না। তাহিরার এমন সহজপাচ্য ব্যবহার তার হজম হচ্ছিলো না। সে জানে তাহিরা কবিতার মতো মারমুখো না, ভীষণ শান্ত। তবুও এই ব্যাপারে সে কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখাবে না এমনটা ভাবে নি সে। সে দ্রুত যেয়ে গাড়ি গ্যারেজ থেকে নিয়ে এলো। গ্যারেজে সে রুপাকে ফোনও করে দিয়েছিলো। গাড়িতে বসেও তাহিরা কোনো কথা বলল না।
.
.
“তোমার পরিবারকে জানিয়েছ তোমার এবং তীর্থের আলাদা হবার কথা?” কথন জিজ্ঞেস করল কবিতাকে। কবিতা ঠিক তার সামনের চেয়ারে বসা। মাথা নিচু করে বসে আছে সে। কথনের প্রশ্নের উত্তরে সে মাথা নাড়ায়। কথন আবারও জিজ্ঞেস করে, “তোমার মনে হয় না তাদের জানানো উচিত?”
“না।”
“তোমার এখন তাদের সাপোর্ট সবচেয়ে বেশি দরকার কবিতা।”
“আমার তাদের সাপোর্টের প্রয়োজন নেই। আমার সাথে তাদের সম্পর্ক অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। তাদের অর্থাৎ বড় ভাই এবং মায়ের কথা বলছি।”
কবিতার কথাটা ধরতে পারলো না কথন। কিছুই বুঝতে পারছেনা সে, “সম্পর্ক শেষ মানে? কি বলছো তুমি?”

কবিতা ছোট করে তার বিয়ের কাহিনী শোনায় কথনকে। এসব শুনে কথন কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। কবিতার সাথে এত কিছু হয়ে গেছে অথচ সে কিছুই জানে না। তার এই মুহূর্তে নিজের উপর রাগ উঠছে। সে স্বার্থপরের মতো নিজের কথা ভেবে কবিতার সাথে যোগাযোগ রাখেনি। সে নিজে কবিতাকে অন্য কারো সাথে দেখলে কষ্ট পেত এই কারণে। অথচ কবিতা এত বছর ধরে, এত কষ্ট বুকে লুকিয়ে রেখেছে।

কবিতার ভাইয়ের কান্ড শুনে রাগ আরও বাড়ে কথনের। মানুষ এতটা নিচু কীভাবে নামতে পারে? নিজের বোনের ব্যাপারেও একবার ভাবে নি সে? অথচ সে লোকটাই একসময় বলেছিলো, কবিতাকে সে নিজের মেয়ের মতো লালন-পালন করেছে।
কবিতার সামনে সে নিজের এই অনুভূতিগুলো বর্ণনা করে কবিতাকে আরও দুর্বল হতে দেখতে চায় না। তাই তার পরিবারের কথা বাদ দিয়ে সে বলল, “আমি তোমার সাথে আছি। কোনো প্রয়োজন হলে বলো।”

কবিতা মাথা নাড়ায়। তারপর নিজেক স্বাভাবিক করে কথনকে জিজ্ঞেস করে, “আপনার কী খবর? আপনার জন্য তো মেয়ে দেখছিলো। আপনি এবং মেয়েটা কি বিয়ের জন্য রাজি হয়েছেন?”
কথনের হঠাৎ করে মনে পড়লো জান্নাতের কথা। তার এতক্ষণ ধরে মেয়েটার কথা মাথায়ও আসে নি। আর না এটা এসেছে যেহেতু কবিতা এখন আর তীর্থের সাথে নেই সেহেতু কথন তার জীবনের অংশ হতে পারে। কথাটা মাথায় আসতেই কথনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। এ কি করল সে? এত বছর ধরে সে কবিতার জন্য অহেতুক অপেক্ষা করছিলো। অথচ আজ যখন তার কবিতাকে ফিরে পাওয়ার সুযোগ ছিলো, সে সুযোগ নিজেই বিসর্জন দিলো? কথাটা ভাবতেই প্রচন্ড মাথা ধরে গেল তার।

কবিতা আবারও জিজ্ঞেস করে, “কি হলো উওর দিচ্ছেন না যে?”
“হুম মেনে গেছে। সব ঠিক থাকলে এই শুক্রবারে এনগেজমেন্ট হবে।”
“কনগ্রেটস।”
“কবিতা তুমি একটু বাহিরে যেতে পারবে। আমার একটু কাজ ছিলো। আমি আসছি কিছুক্ষণের মধ্যে।”
“আচ্ছা আমি কাব্যের কাছে যাই।”
কবিতা উঠে যাবার সময় কথন তাকে একবার ডাকে, “কবিতা শুনো।”
“জ্বি?”
“তোমার এবং তীর্থের ঘটনাটা কবে ঘটেছে?”
কিছুক্ষণ চুপ থাকে কবিতা। তাকে দ্বিধাগ্রস্ত মনে হচ্ছে।
“শেষবার যখন আপনার সাথে দেখা হয়েছিল, ঠিক তার আগের দিন।”
“ওহ।”
কবিতা চলে যায়। কথন বসে থাকে সেখানেই। অর্থাৎ তার বিয়ের কথা হবার আগেই কবিতার সাথে তীর্থের ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিলো? কবিতা তাহলে সেদিন কথাটা জানায় নি কেন কথনকে? লুকাল কেন সে? আজ হয়তো কবিতার কথা জানলে সে জান্নাতের সাথে বিয়েতে রাজি হতো না।
এখন?
সে এমন মানুষ না যে কোনো মেয়ের জীবন নষ্ট করবে, তার স্বপ্ন, তার অনুভূতির সাথে খেলা করবে। আর জান্নাত তো কবিতার কথা জানা সত্ত্বেও রাজি হয়েছে তাকে বিয়ে করার জন্য। এছাড়া তার একটি ভুল সিদ্ধান্ত দুই পরিবারের সম্মানে প্রশ্ন তুলবে।
কী হচ্ছে কথনের সাথে? কেন হচ্ছে?
কথনের মাথায় কিছুই ঢুকছে না। সে কপালে হাত রেখে এত জলদি বিয়ের জন্য রাজি হওয়ায় নিজের বোকামির বিরক্তি প্রকাশ করলো। রাগে তার মাথা ঠিক থাকলো না আর। রাগের চোটে নিজের সামনে রাখা চেয়ারে সজোরে এক লাথি মারলো।

কবিতা কথনের কেবিন থেকে বের হয়ে দেখে তার ফোনে তীর্থের অনেকগুলো মিসকল। ফোন সাইলেন্ট থাকায় তা খেয়াল করে নি কবিতা। দেখতে দেখতে আবারো কল আসলো তীর্থের। এবার কবিতা কল ধরলো, “কী চাই?”
“তুমি আমার ফোন এভাবে কেটে দিলে কেন? এর উপর কল ধরছো না। সমস্যা কি তোমার? আছে এবার বলো কখন আমার কাছে ফিরে আসছো?”
“আপনার কাছে আমি কোনমতেই ফিরে আসবো না।”
“তুমি…” তীর্থ কঠিন কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়, “আচ্ছা বুঝেছি। তুমি কোন হাস্পাতাল আছো কাব্যকে নিয়ে? আমি টাকা নিয়ে আসছি।”
“আপনার টাকার এখন আর আমার প্রয়োজন নেই। আমি টাকার ব্যবস্থা করে ফেলেছি। আর আপনাকে আসতে হবে না। যখন আপনার সন্তানের জীবনের প্রশ্ন উঠেছিলো তখন আপনি ওর পরিবর্তে শর্ত রেখেছিলেন। আমি বুঝেছিলাম কি আপনি কেবল স্বামী হিসেবে অনুত্তীর্ণ। আপনি আমার ধারণা ভুল করে দিলেন, আপনি পিতা হিসেবে জঘন্য। আর আমি আমার বাচ্চাদের উপর আপনাদের ছায়াও পরতে দিব না।”
“তোমার কি মনে হয়, তুমি মানা করলে টাকা দিতাম না? অবশ্যই দিতাম। আমার ছেলের জীবন আমার কাছে মূল্যবান। আমি কেবল সুযোগটা হাতছাড়া….”
কবিতা কল কেটে দিলো। তার তীর্থের অহেতুক কোনো কথা শোনার ইচ্ছা নেই।
.
.
তাহিরা গাড়ি থেকে নেমে কিছু না বলেই বাসার ভেতরে ঢুকে যায়। ধ্রুবও গাড়ি পার্ক করে ছুটে যায় তাহিরার পিছনে। ভয় হয় তার। ভীষণ ভয়। তাহিরার কিছু না বলাটা তার বুকের জ্বালা আরও বাড়িয়ে দেয়। তাহিরা উল্টাপাল্টা কিছু না করে বসুক আবার। সে রুমে যেয়ে দেখে তাহেরা বিছানার পর ব্যাগ রেখে পানি খাচ্ছে। তার বুকের ভিতর ধুকপুক করছিলো। ভয়ে যেন তার প্রাণ আসে যায়। সে এগিয়ে যেয়ে তাহিরার হাত ধরে অস্থির হয়ে বলে, “তাহু আমার ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা করে দে প্লিজ। আর হবে না, আই প্রমিজ।”
তাহিরা আবারও একই দৃষ্টিতে তাকায় ধ্রুবর দিকে। প্রশ্ন করে, “ক্ষমা করার একটি কারণ দে।”
ধ্রুব একটু দেবে গেল। অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তাহিরার দিকে। বলল, “কারণ তুই আমাকে ভালোবাসিস।”
তাহিরা উঠে যায় বিছানা থেকে। ড্রেসিংটেবিলের সামনে যেয়ে কানেরদুল খুলতে খুলতে বলল,”ভালো তো তুইও বেসেছিস। তাও তো এমন করলি। তাহলে আমি ভালোবেসে তোকে ক্ষমা করবো কেন?”
ধ্রুব কি করবে বুঝতে পারছে না। তাহিরা ঝগড়া করল একভাবে তাকে জোর করে বোঝানো যেত। কিন্তু তাহিরার এমন ভাব দেখে তার নিজেরই বিদঘুটে লাগছে।

সে যেয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল তাহিরাকে, “তুই আমাকে ছেড়ে যাবি না তো? আমিও ওয়াদা করছি তাহু, আমি আর কখনো এমন করব না। শেষবারের মতো ক্ষমা করে দে আমাকে।”
উত্তর দিতে তাহিরা এক মুহূর্তও লাগালো না, “করলাম।”
এই উত্তর শুনে আরও চমকে উঠে ধ্রুব। তার কাছে তাহিরার ব্যবহার ভীষণ আজব লাগছে। প্রথম যখন তাহিরা তার অন্যকারো সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে জেনেছিলো, তখন তার রাগ দেখে সে নিজেই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তাকে ছেড়ে পর্যন্ত চলে গিয়েছিল সে। অথচ আজ, তার স্বামী হবার পর এত বড় অপরাধ এভাবেই ক্ষমা করে দিলো সে?

তাহিরা পিছনে ফিরে কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে ধ্রুবর দিকে। হঠাৎ করে তাকে জড়িয়ে ধরে। শক্ত করে আঁকড়ে ধরে তার শার্ট।

ধ্রুব হতদম্ব। এবার আসলে তার মাথায় কিছু ঢুকছিলো না। সে না পেরে জিজ্ঞেস করেই নিলো, “তাহু তুই আসলে ঠিক আছিস? আমি এতকিছু করার পরও তুমি আমাকে কিছু বলবি না?”
“উঁহু, আমি এই মুহূর্তে কেবল তোর বুকে মাথা রাখতে চাই। এই মুহূর্তে আমি কেবল আমার প্রতি তোর ভালোবাসা টা মনে করাতে চাই তোকে।”
“আমি এক মুহূর্তের জন্যও তোকে ভালোবাসা ছাড়িনি।”
“তাহলে আমি যে তুই আমাকে আরও বেশি ভালবাসতে শুরু করিস।”

ধ্রুব একবার জিজ্ঞেস করতে চাইলো, তাহিরা কীভাবে জেনেছে সে হোটেলে ওই রুমে ছিলো? তাও একটি মেয়ের সাথে। কিন্তু তোর সাহস হলো না।

তাহিরা জিজ্ঞেস করে, “তোর কি মনে আছে এই শুক্রবারে কী?”
তাহিরার কথা ঘোর ভাঙে ধ্রুবর। সেও জড়িয়ে ধরে তাহিরাকে। উওর দেয়, “কী?”
“এই শুক্রবারে আট বছর হবে। ঠিক আট বছর আগে তুই সেদিনেই প্রথমবার নিজের অনুভূতি আমার কাছে প্রকাশ করেছিলি। দিনটা আমার জন্য খুব বিশেষ। তাই আমি চাই সব ভুলে আমাদের জীবন নতুন করে শুরু করতে। সেদিন তোর সন্ধ্যা কেবল আমার নামে হবে। আমি ঘর সাজাব, তোর পছন্দের রান্না করবো, কেক বানাব। তোর জন্য একটা উপহারও আছে আমার কাছে। বিশেষ উপহার।”
ধ্রুব শান্তির নিশ্বাস ফেলল। তাহিরা তাহলে সব ভুলে নতুন জীবন শুরু করতে বলছে তাকে। তাহলে তাহিরা তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে?
হয়তো, ভালোবাসার খাতিরে সে সব আবার নতুন করে শুরু করতে চাইছে।
এটা অস্বাভাবিক কিছুই নয়। সে জানে, তাহিরা তাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। তাহিরার প্রয়োজন সে। তার পরিবার বলতে সে ছাড়া আর কেউ নেই। তাকে ছাড়া কিভাবে যাবে তাহিরা?
এসব ভাবতেই ধ্রুব ঠোঁটের কোণে প্রশস্ত এক হাসি এসে বিরাজ করল।

এই ঘটনার পর ধ্রুব ভেবেছিলো কয়দিন মেয়েদের থেকে দূরে থাকবে। কিন্তু তাহিরার প্রতিক্রিয়া দেখে তার সাহস আরও বেড়ে যায়। সে ভাবে, এরপর যাই হোক না কেন তাহিরা তাকে ছেড়ে যাবে না। এ-কারণে সে মেয়েদের সাথে দেখা করতে থাকে। শুক্রবারে তার রুপার বিয়েতে যাবার কথা ছিলো। এর পরিবর্তে সে আরেকটি মেয়ের সাথে দেখা করতে গেল। সেখানে যেয়েও রুপার কল পেল সে। সে আলাদা যেয়ে কল ধরলো, “বাহ তুমি দেখি বিয়ের দিনেও আমাকে মনে করছো। আমি জানি আমার উপর থেকে কারও ধ্যান সরে না কিন্তু আজ তো একটু নিজের স্বামীর উপর ধ্যান দেও।”

“ধ্রুব…ধ্রুব সর্বনাশ হয়ে গেছে। তোমার ওয়াইফ সর্বনাশ করে দিয়েছে আমার।” হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল রূপা।
ধ্রুব বড়সড় এক ঝটকা খেল রূপার কথা শুনে। সে রূপাকে শান্ত করার চেষ্টা করল, “শান্ত হও রূপা। কি হয়েছে আমায় বলো। আর তাহিরা, ও কি করেছে? ওকে তো আমি আজ বাসায় দেখেই আসলাম। আমার জন্য স্পেশাল ডিনার প্লান করছে।”
“আমি শান্ত হবো? কীভাবে শান্ত হবো আমি? তোমার ওয়াইফ আজকে ঠিক আমার বিয়ের মুহূর্তে তুষারকে তোমার এবং আমার ইনটেমেট মুহূর্তের ছবি দিয়েছে। তুমি বুঝতে পারছো ব্যাপারটা? আমি বউ সেজে স্টেজে ছিলাম। সেখান থেকে আমার বিয়ে ভেঙে গেছে। তুষার আমাকে ঘৃণা করছে। আমার মা বাবা আমার চেহেরাও দেখতে চাইছে না। আমি কি করবো কিছু বুঝতে পারছি না। সব তোমার ওয়াইফের জন্য। ও আমার জীবন নষ্ট করে দিয়েছে।”
কথাগুলো শুনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ধ্রুব। হতবাক হয়ে বলল, “তুমি মজা করছ তাই না?”
রূপা চিৎকার করে বলে, “তোমার মনে হয় আমি এই বিষয় নিয়ে মজা করবো?”
“আমি নিশ্চিত এটা তাহিরা করে নি। সেদিন হোটেলে আমাদের একসাথে সেভাবে দেখে নি তাহিরা।”
“সেদিনের হোটেলের ছবি না। তোমার বাসার ছবি। আর তাহিরা ছাড়া এমনটা কে করবে? তাহিরা ছাড়া কেউ আমার সাথে এমন করবে না।”
#মুহূর্তে
পর্ব-৪৪
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

কথন আজ হাস্পাতালে যায়নি। আজ তার জান্নাতের সাথে এনগেজমেন্ট। নিজের উপর রাগ উঠছে তার। সে কি করছে, নিজেও জানে না। কিন্তু সে এভাবে দুই পরিবার এবং জান্নাতের সম্মানের সাথে খেলা করতে পারে না। যেখানে জান্নাত সব জানা সত্ত্বেও তার সাথে বিয়ে করতে রাজি। প্রতিটা মেয়ের নিজের বিয়ে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন থাকে, এভাবে সে কারও স্বপ্ন ভাঙতে পারবে না। এছাড়া জান্নাত তার ছোটবোনের শশুড়বাড়ির পক্ষ থেকে আত্নীয়। আজ যদি সে বিয়েটা ভাঙতে যায় তাহলে তার বোনের জন্যও অনেক সমস্যা হবে। আর তার মা, সে এত খুশি। কথন কিভাবে তাকে বলে সে বিয়ে করতে চায় না। কারণ কী দিবে? কবিতার বিয়ে ভাঙতে পারে তাই সে আরেকটি সুযোগ চাচ্ছে। ভাবতেই নিজের উপর ঘৃণা হলো কথনের। কবিতার এত করুণ সময়ে সে তাকে পাবার চিন্তা করছে? এই মুহূর্তে তার কেবল ঢাল হয়ে কবিতার পাশে থাকা উচিত।

কথন তার পাশে বিছানায় রাখা পাঞ্জাবির দিকে তাকাল। তার ছোট বোন রেখে গিয়েছিলো। জলদি করে তৈরি হতে বলল তাকে। কিছুক্ষণেই বের হবে তারা সকলে। বাগদানের উদ্দেশ্যে। অথচ কথন এখনো তৈরি হয় নি। তার মন চাইছে না উঠে রেডি হতে। এমন সময় প্রণয় ঢুকলো রুমেতে। সে এসে দেখে কথন তৈরি না হয়ে মাথা নামিয়ে বসে আছে। চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে। সে কথনকে বলে, “তুই এভাবে বসে আছিস কেন? সবাই অপেক্ষা করছে তোর জন্য।”
“আমি বুঝতে পারছি না কি করবো। কবিতা আমার সাথে এমন করতে গেল কেন বলতো? ও আমাকে সেদিন না বললে আমি বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলতাম না। আর না আজ এমন অসস্থিতে সময় কাটানো লাগতো। আমি বুঝতে পারছি না ও কেন আমাকে সেদিন বলে নি যে ওর আর তীর্থের…. উফফ আমার ভীষণ মেজাজ খারাপ হচ্ছে। রাগ লাগছে নিজের উপর, নিজের ভাগ্যের উপর। এখন আমার সারা জীবন এই আফসোসে কাটাতে হবে যে আমার হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা আমার এতটা কাছে আসা সত্ত্বেও আমি নিজ থেকে তাকে নিজের জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দিলাম। আমার ভাগ্য এমন কেন? আমি কার সাথে এতটা খারাপ করেছি যে ভাগ্য আমাকে এই পরিণতি দিচ্ছে?”

প্রণয় যেয়ে কথনের কাঁধে হাত রাখে। সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করিস না।”
“কিভাবে ঠিক হবে? আমি তো ঠিক হবার কোন রাস্তা দেখছি না।”
“তুই আন্টিকে যেয়ে কবিতার কথা বলে দিলেই পারিস।”
“আর কি বলবো আমি? যে কবিতাকে আমি এত বছর ধরে ভালবাসতাম তাই বিয়ে করতে চাই নি। আজ এত বছর পরে আমি কাউকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি কিন্তু আমি এখন জানলাম যে কবিতার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে। তাই আমি তোমাদের খুশি এবং জান্নাতের সম্মানের পরোয়া না করে এই বিয়েটা ভাঙতে চাই।”
কথনের কথা শুনে প্রণয় নিজেও দ্বিধায় পড়ে গেল। সে বসলো কথন এর পাশে। আমতা আমতা করে বলল, “এখন আর কি করবি? সব ভাগ্যের উপর ছেড়ে দে।”

মুহূর্ত না গড়াতেই রুমে প্রবেশ করল জবা। তার মুখটা মলিন দেখাচ্ছে। অথচ সে এতক্ষণ ধরে সবচেয়ে বেশি উৎসুক ছিলো কথনের বাগদানে। তার সাথে রুমে মা এবং দুলাভাইও আসলো। সবাইকে গম্ভীর দেখাচ্ছে। কথন এবং প্রণয় দুইজনই অবাক হলো সবাইকে এমন ভাবে দেখে। কথন জিজ্ঞেস করল, “তোমাদের এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?”
কথনের মা উদাসীন গলায় বলল, “বাবা তুই কথাটা শুনে মন খারাপ করিস না।”
“তোমরা কি নিয়ে কথা বলছো?”
জবা দ্বিধাবোধ করে বলল, “জান্নাতের মায়ের কল এসেছিল। মেয়েটার না’কি আগে কোন ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিল। ছেলের সাথে ব্রেকআপ হওয়ায় রাগের চোটে না’কি ও তোর সাথে বিয়ের জন্য রাজি হয়েছিল। আজ ছেলেটা না’কি ওর কাছে এসে মাফ চেয়েছে। এখন ও এনগেজমেন্ট ছেড়ে পালিয়ে গেছে।”
“কী?” কথন খুশির চোটে দাঁড়িয়ে যায়। সবাই অনেকটা অবাক হয় তার এমন প্রতিক্রিয়ায়। প্রণয় সাথে সাথে তার হাত ধরে টেনে বসিয়ে দেয় তাকে। কানে কানে বলে, “ব্রো সবাইকে দেখানোর প্রয়োজন নেই তুই কত খুশি। দুঃখপ্রকাশ কর। যেন এরপর সহজে বিয়ের কথা না তুলে।”

কথনের প্রণয়ের বুদ্ধিটা ভালোই লাগে। সে সাথে সাথে নিজের ভাব পরিবর্তন করে বলে, “কী? কী বলছো তোমারা এসব? ওর আজকের দিনে এমন করা লাগলো? আমি কত আশা করে হ্যাঁ করেছিলাম বিয়ের জন্য।”
কথনের মা এসে তার মাথায় হাত রাখে, “বাবা মন খারাপ করিস না। এর থেকে ভালো মেয়ে দেখবো তোমার জন্য।”
“দয়া করে আমাকে একটু সময় দেও। দ্বিতীয়বার এমনটা হচ্ছে আমার সাথে। আমার আর ভালো লাগছে না এসব। আমার মাথা ধরে গেছে। ভালো লাগছে না। আমি একটু বাহির থেকে ঘুরে আসছি।”
কথন যাবার পরে সকলকে খুব চিন্তিত দেখাল।

প্রণয় বিড়বিড় করে বলল, “এক্টিং করতে বলেছিলাম আর উনি ওভার এক্টিংয়ের দোকান খুলে বসেছে। নিশ্চিত এই ছেলেটা এখন কবিতার কাছে যাবে।”
.
.
ধ্রুব তার ডেট ছেড়ে সোজা এলো তীর্থের বাসায়। সে ভালো করে জানে তাহিরা এমন কিছু করতে পারে না। এই কথাটা সে কল্পনাও করতে পারে না। তাহিরা ভীষণ নরম মনের মেয়ে। তার পক্ষে এসব কঠিন কাজ করা অসম্ভব। রুপার সাথে তার সম্পর্কের ব্যাপারে কেবল মৃণা এবং তীর্থ জানতো। মৃণার বাবার মৃত্যুর পর তার এমন অবস্থা নেই যে সে তার এবং রূপার ছবি তুলে এমন কান্ড ঘটাবে। এর উপর মৃণা তার বাসাও চিনে না। মৃণার পক্ষেও এমনটা করা সম্ভব নয়। বাকি রইলো কেবল তীর্থ। তার এখন এটাও মনে হতে থাকলো তাহিরাকে হোটেলের তথ্যও তীর্থ দিয়েছে।

কলিংবেল কয়েকবার বাজাতে হলো। প্রায় দশমিনিট ধরে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকার পর দরজা খুলল তীর্থ। দরজা খোলার পর ধ্রুব দেখল তীর্থ এখনো আধোঘুমে আছে।
সে অবস্থাতেই এক ঘুষি মারে ধ্রুব। তীর্থ নিচে পড়ে যায়।
সে চোখ কচলে বলল, “কি’রে তুই আজ এখানে?”
তীর্থ এভাবে বলল যেন সে বুঝলোই না ধ্রুব তাকে মেরেছে। মদের গন্ধে ম ম করছে তার বাসা। ধ্রুব আরেকটু ভেতরে ঢুকেই দেখে প্রবেশপথ থেক শুরু করে ডাইনিং পর্যন্ত পিজ্জার প্যাকেট ও মদের বোতল ভরা। এই অবস্থা দেখেই সে চমকে উঠে। তার মেজাজ খারাপ ভুলেই যায় সে। তীর্থের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “হোয়াট দ্যা হেল ইজ দিস? তোর বাসার এ কি অবস্থা? তোর এ কি অবস্থা?”

তীর্থ খুব কষ্টে উঠে দাঁড়ায়। মনে হচ্ছে সে এখনো নেশায় আছে। ঠিক মতো দাঁড়াতেও পারছে না সে। ধ্রুব এসব দেখে মনে হচ্ছে তীর্থ এমনটা করতে পারে না। তারা এমন করার মতো অবস্থায় নেই। তাও সে জিজ্ঞেস করল, “তুই কি রুপার বয়ফ্রেন্ডকে কোন মেসেজ পাঠিয়েছিস?”
“রুপা, কে রুপা? ওহ তোর সাথে মেয়েটা। আমিতো ওকে ভালোমতো চিনিও না ওর বয়ফ্রেন্ডকে কিভাবে চিনবো? কি হয়েছে?”
ধ্রুব সংক্ষিপ্তভাবে সবটা বলল। এসব শুনে তীর্থ বিরক্ত হয়ে বলে, “আমার এত সময় নেই যে আমি তোর পিছনে ঘুরে প্রমাণ জোগাড় করে ওর বয়ফ্রেন্ডকে পাঠাবো।”
“তোর সময় নেই? তুই অফিসেও যাচ্ছিস না। কারবারের অবস্থা খারাপ। বাসা দেখে মনে হচ্ছে না তুই এ কয়দিনে একটাও কাজ করেছিস।”
“ভাই তোর সাথে এমন করে আমি কি পাবো? ক্ষতি তো আমারই। তোর সাথে খারাপ কিছু করলে তুই আমাকে আর কবিতাকে পেতে সাহায্য করবি?”
কথাটা যুক্তিসঙ্গত মনে হলো ধ্রুবর। সে বিরক্তি নিয়ে বলল, “ঠিকাছে। আমি দেখছি ব্যাপারটা। আর দয়া করে অফিসে যাওয়া শুরু কর। মনে রাখিস, আমার থেকে বেশি ক্ষতি তোর হচ্ছে। আমি মুনাফা টাকা দিয়ে বাড়ি, জায়গা জমি কিনে রেখেছি। আর আমার বাবার বাড়ি, জমি তো আছেই। কিন্তু তুই কারবারে সব টাকা লাগিয়েছিস। তোর এই এপার্টমেন্ট এবং গাড়ি ছাড়া আহামরি কিছু নেই। ব্যবসায়ের লাভ ক্ষতির দায়ভার সত্তর ভাগ তোর।লাভ হলে যেমন তোর বেশি হয়। ক্ষতি হলেও তোর বেশি হবে। আর আশা রাখিস না যে তোর সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলে আমি তোকে এক পয়সাও দিব।”
ধ্রুব চলে গেল। কিন্তু তীর্থ কথাগুলো কানে নিলো না। দরজা আটকে দিয়ে সে আবারও বেডরুমে যেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

ধ্রুব সেখান থেকে সোজা যায় নিজের বাসায়। তাহিরা তোকে সাড়ে সাতটার দিকে আসতে বলেছিলো। আজ বিশেষ কিছু আয়োজন করেছে সে। তাই তাহিরার কথামতো ঠিক আটটার দিকে ঘরের পৌঁছেছে সে। দরজা খুলতেই সে চমকে উঠে। দরজা থেকে শুরু করে ডাইনিরুম পর্যন্ত গোলাপের পাপড়ি দিয়ে সাজানো। দেয়ালে বেলুন লাগানো। সে খানিকটা অবাক হয়। তাহিরা জন্য এই দিনটি এতটা গুরুত্বপূর্ণ সে জানতো না, নাহলে উপহার হিসেবে সাধারণ একটি লকেটের পরিবর্তে আরও ভাল কিছু নিয়ে আসতো।

ধ্রুব যায় ডাইনিংরুমে। দেখে তাহিরার সামনে দাঁড়িয়ে কেক সাজাচ্ছে। তার পছন্দের নীল রঙের শাড়ি পরেছে সে। যখনই সে তাহিরাকে এই রঙে দেখে আবারও নতুন করে প্রেমে পড়ে সে।

ধ্রুব তাহিরার পিছনে যেয়ে দাঁড়ায়। লকেটটি গলায় পরিয়ে দেয়ার পূর্বে আলতো করে চুমু খায় তার কাঁধে। মৃদুস্বরে বলে, “আই লাভ ইউ।”
কেঁপে উঠে তাহিরা। ধ্রুবর আসার আভাস সে পায় নি। তাই একটু চমকে উঠে সে। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলে, “ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। তুই একটা পাগল।”
“ভয় পেলি কেন? আমাকে ছাড়া তোর কাছে আর কে আসবে শুনি? কারও এত সাহস নেই।”
ধ্রুব লকেট পরিয়ে দিয়ে তাহিরাকে নিজের দিকে ঘুরায়। তাক দেখে মুগ্ধ গলায় বলে, “তোর জন্য এই সাধারণ লকেটটির সৌন্দর্য হাজারোগুণ বেড়ে গেছে।”
“লকেটটাই অনেক বেশি সুন্দর। শুন ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি কেক ডেকোরেশন করে নিচ্ছি, তারপর একসাথে কাটব।”
ধ্রুব তাহিরার আর কোমর জড়িয়ে ধরে, “কোন পাগল তার এত সুন্দর বউকে ছেড়ে দূরে যেতে চাইবে?”
তাহিরা হাসে, “কেন আজ রুপার বিয়েতে যখন গিয়েছিস ওকে সুন্দর লাগে নি?”
ধ্রুব হতভম্ব হয়ে যায় তাহিরার কথা। সাথে সাথে ছেড়ে দেয় তাকে।

তাহিরা কেক ডেকোরেশনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আবারও জিজ্ঞেস করে, “কেমন মজা হলো সেখানে? বউ সাজে সুন্দর লাগছিলো রুপাকে? বিয়ে কি সুন্দর মতো সম্পূর্ণ হয়েছে না বর বিয়ে করতে মানা করে দিলো।”
ধ্রুব কিছু সবই স্তব্ধ হয়ে রইল। তার মানতে কষ্ট হচ্ছিল যে তাহিরা রুপার বিয়ে ভাঙার মতো কাজ করতে পারে। রাগে সে শক্ত করে তাহিরের বাহু ধরে নিজের দিকে ফিরালো। তাহিরা হাত লেগে তার সাজানো কেকটিও নিচে পড়ে যায়। তাহিরা মন খারাপ করে বলল, “এই কী করলি তুই? দিলি তো কেক নষ্ট করে। সে দুপুর থেকে বানাচ্ছিলাম।”
ধ্রুব তাহিরার দুই বাহু শক্ত করে ধরলো। দাঁতে দাঁত চেপে রুক্ষ গলায় জিজ্ঞেস করল, “তুই রুপার বিয়ে ভেঙেছিস?”
“হ্যাঁ। তো আর কে ভাঙতে পারে?” ভীষণ স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিলো তাহিরা।
“তুই পাগল? মেয়েটার জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। এমন কেন করলি তুই? তোর সমস্যা থাকলে তুই আমার সাথে কথা বলতি। তোর এতদিনের ব্যবহারে মনে হয়েছে সব ঠিক। তুই এমন কবের থেকে হয়ে গেলি তাহিরা। আমার তাহিরা তো কারও ক্ষতি করার কথা চিন্তাও করতে পারে না। আমি তো এই তাহিরাকে ভালোবাসি নি। কেন করলি তুই এমন?”
তাহিরার ঠোঁটের কোণে প্রশস্ত এক হাসি। অথচ চোখজোড়া নম্র হয়ে এলো তার।
“আমিও তো এমন কাউকে ভালোবাসতে চাই নি যে আমাকে ছাড়া অন্য সকল নারীর মাঝে নিজের শান্তি খুঁজে পায়।”

কথাটা শুনতেই হুঁশ আসে ধ্রুবর। তার মনে পড়ে সে কি করেছে তাহিরার সাথে। এরপর তাহিরা তাকে ক্ষমা করেছে এই বেশি। রুপা অথবা অন্যকারোর জন্য তার তাহিরার সাথে রাগ করা উচিত হবে না। সে সাথে সাথে সে ছেড়ে দেয় তাহিরার বাহু। তাহিরা নিচে বসে মেঝেতে পড়ে থাকা কেক প্লেটে নিতে নিতে বলে, “যে মেয়ে আমার সংসার ভাঙতে দ্বিধাবোধ করে নি তার প্রতি দয়া আমি কেন দেখাব? এছাড়া আমি চাই নি আমি যে কষ্ট ভোগ করেছি তা অন্যকেউ সহ্য করুক। ছেলেটা ওর অতীত জানা সত্ত্বেও ওকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। তাও মেয়েটার এই ভালোবাসা সহ্য হলো না।” তাহিরা চোখ তুলে তাকায় ধ্রুবর দিকে, ” কিছু মানুষকে সুযোগ দিয়ে লাভ নেই। তারা সহজে ভালোবাসার মানুষকে ফিরে পেয়ে তার মূল্য ভুলে যায়। আচ্ছা ধ্রুব বলতো লালসার কাছে কি ভালোবাসাও হার মানায়?”

ধ্রুব এক ঢোক গিলে। তার ভয় ধরে যায় তাহিরার কথায়। সে চেয়েও আর কিছু বলতে পারে না। একগুচ্ছ শব্দ যেন তার গলায় আটকে গেছে। তাহিরা উঠে দাঁড়িয়ে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে হেসে ধ্রুবর গাল টেনে বলে, “আরে তোর মুখ এমন লটকে গেল কেন? স্বাভাবিকভাবে বলছিলাম। ইশশ আমার হাত কেক লেগে ছিলো। তোর গালে লেগে গেল। দাঁড়া আমি মুছে দিচ্ছি।”
তাহিরা তার শাড়ির আঁচল দিয়ে ধ্রুবর গাল মুছে দিচ্ছিলো। ধ্রুব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তাহিরার দিকে। ছট করে তাহিরার হাত ধরে নিলো সে। ভয়ার্ত গলায় বলল, “তোকে আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে। তুই আমার উপর রাগ থাকলে আমাকে বকা দে, তাও এমন ব্যবহার করিস না।”
“তোর উপর রাগ থাকবো কেন? আমি তোকে এত ভালোবাসি যে তোর জন্য নিজের সব অনুভূতির বিসর্জন দিতে পারি। সামান্য দুঃখ কি জিনিস।” তাহিরা আবার খিলখিলিয়ে হেসে বলল, “তুইও না আমায় কথায় ব্যস্ত করে দিলি। আজ আমাদের বিশেষ দিন। কেক তো তুই নষ্ট করে দিয়েছিস। অন্যান্য আয়োজন মাটি করবি না। আমি হাত ধুঁয়ে আসি।”

তাহিরা হাত ধুঁয়ে এসে ধ্রুবকে নিয়ে গেল বেডরুমে। স্লো মিউজিক লাগিয়ে ধ্রুবর কাছে গেল। ধ্রুবর হাত তার কোমরে রেখে সে গলা জড়িয়ে ধরে তার। তার বুকে মাথা রেখে কতক্ষণ দুলতে থাকে সে। কিন্তু এত সুন্দর মুহূর্তটাও ধ্রুব অনুভব করতে পারে না। তার মনের ভেতর কু ডাকছে। কিন্তু সে এই ব্যাপারে কিছুই করতে পারছে না। তার মা মারা যাবার পর আজ প্রথম এত অসহায় লাগছে তার। তাও অকারণে।

হঠাৎ করে তাহিরা উঠে যায় তার বুক থেকে। সে বলে, “মাত্র মনে পড়লো। তুই আমায় উপহার দিয়েছিস, আমার পক্ষ থেকে উপহার নিবি না?”
“কিসের উপহার।”
“ওয়েট।”
তাহিরা আলমারি থেকে একটি খাম নিয়ে এলো। তা ধ্রুবর দিয়ে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, “তোর জীবনের সবচেয়ে সুন্দর উপহার হবে।”
ধ্রুব প্রথম খানিকটা অবাক হয়। তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর উপহার কী হতে পারে?
খামে একটি কাগজ পায় সে। মেডিক্যাল রিপোর্ট দেখে উৎসুক হয়ে যায় সে। এটা কী তাহিরার প্রেগ্ন্যাসির রিপোর্ট? ধ্রুব একযুগ ধরে স্বপ্ন ছিল তাহিরার সাথে একটি সুখী পরিবারের। তার এবং তাহিরার ভালোবাসার অংশ পৃথিবীতে আসবে, এর থেকে বেশি খুশির খবর আর কিছু হতে পারে না। হয়তো এই কারণেই তাহিরা তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। নতুন জীবন শুরু করতে চাইছে। ধ্রুবর খুশির সীমানা হয় না। সে দ্রুত রিপোর্টটা খুলে। রিপোর্টে চোখ বুলাতেই ঠোঁটের হাসি ম্লান হয়ে যায়। বিস্ময়ে চোখদুটো যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। তার হাত থেকে কাগজটা পড়ে যায়।যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে তার উপর।

তাহিরা তখনও হাসিমুখে বলে, “তোকে এত সুন্দর উপহার দিলাম। তবুও তুই খুশি না?”
ধ্রুব কাঁপানো গলায় বলে, “এ…এটা কী?”
“মাত্র তো পড়লি। আমার ক্যান্সারের রিপোর্ট। খুব দ্রুত আমি তোর জীবন থেকে চলে যাচ্ছি। এরপর তুই স্বাধীন। না, কোনো বাঁধা আর না কোনো লুকোচুরি। তোর যা ইচ্ছা তুই তাই করতে পারবি।”
ধ্রুব দ্রুত এসে তাহিরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কাঁপছে সে। কিন্তু তাহিরা তাকে ফিরে আঁকড়ে ধরে না। ঠাই দাঁড়িয়ে রয়।

ধ্রুব তাকে ছেড়ে দুই গালে হাত রেখে কান্নাভেজা গলায় বলে, “তুই মজা করছিস তাই না? এটা মিথ্যা। আমি জানি এসব মিথ্যা। তুই আমাকে শাস্তি দেবার জন্য এসব করছিস?”
ধ্রুব তাহিরা এক হাত ধরে নিজের গালে মারতে থাকে।
“আমাকে মার, আমাকে যে শাস্তি দেবার দে তবুও এই মজা করা বন্ধ কর।”
তাহিরা ভেজা চোখ নিয়ে একগাল হাসে। ধ্রুব চোখের জল মুছে বল, “পাগল কাঁদছিস কেন? তোর খুশি হবার কথা না? আমি মরে গেলে তোর জীবনটা কত সুন্দর হয়ে যাবে।”
“চুপ কর। চুপ, একদম চুপ।” আর্তনাদ করে উঠে ধ্রুব। “মরার কথা মুখেও আনবি না। আমি… আমি তোকে সবচেয়ে ভালো ডাক্তার দেখবো। কিছু হবে না তোর। হ্যাঁ কিছু হবে না।” উন্মাদের মতো আচরণ শুরু করে ধ্রুব। সে তাহিরাকে বিছানায় বসিয়ে বলে, “আমি তোর খেয়াল রাখব। তুই একদম সুস্থ হয়ে যাবি। এখন তো সেকেন্ড স্টেজে। সময় আছে তো আমাদের কাছে। তুই ঠিক হয়ে যাবি।”
তাহিরা ধ্রুবর গালে হাত রাখে। শান্ত গলায় বলে, “এই রিপোর্ট প্রায় চার মাস আগের। অনেকদিন শরীর খারাপ লাগছিলো। কিন্তু তোকে চিন্তায় রাখতে চাই নি আমি তাই একাই গেলাম ডাক্তারের কাছে। রিপোর্ট পেয়ে যেন আকাশ ভেঙে পড়েছিল আমার মাথায়। তখন সবার আগে তোর কথা মাথায় এলো। আমি ভাবলাম, আমাকে ছাড়া কীভাবে থাকবি তুই? কে খেয়াল রাখবে তোর? এইসব চিন্তা নিয়ে বাসায় এলাম সেদিন জলদি। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। বাসায় এসে কি দেখেছি জানিস? তুই রুপার সাথে এক বিছানায়। তোদেরকে….” কাঁপা-কাঁপা এক নিশ্বাস ফেলে তাহিরা। “তোদেরকে সে অবস্থায় দেখে আমার মনে হচ্ছিলো আমি সে মুহূর্তেই মরে যাই। আমার মরার জন্য এত সময় অপেক্ষা করতে হবে কেন? আমি যে মৃত্যুর খবর দুঃখের ভাবছিলাম তা আমাকে এত খুশি করবে আমার জানা ছিলো না। আমি কত খুশি তোকে বুঝাতেও পারবো না। আমি এতমাস ধরে কেন অপেক্ষা করেছি জানিস? আজকের দিনটার জন্য। যেদিন আমাদের প্রথম ভালোবাসার স্বীকারোক্তি হয়েছিলো। যেদিন প্রথম আমাদের ভালোবাসার গল্পের সূচনা হয়েছিলো সেদিনই আমি এই ভালোবাসার গল্পের সমাপ্তি চেয়েছি।”
“না, না তাহু তুই এমন বলিস না প্লিজ। তুই আমাকে যে শাস্তি দেবার দে। তাও এমন বলিস না। তোকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।”

তাহিরা ধ্রুবর এমন অঝোরে কান্না দেখে তার গালে হাত রেখে তার কপালে ভালোবাসার চুমু আঁকলো। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল, “কিছু করার নেই রে। ক’মাস পর হলেও আমার ভাগ্যে মৃত্যু লিখিত হয়ে গেছে। যত জলদি মরবো ততই জলদি আমার হৃদয় ঠান্ডা হবে। সকল দুঃখ থেকে রক্ষা পাব আমি। ধ্রুব শুন, আমি তো আর বাঁচবো না। আমার শেষ দুটো ইচ্ছা পূরণ করবি তুই? আমার মৃত্যুর আঁক পর্যন্ত নিজের দেখা দিবি না আমায়।”
কথাটা শুনে সাথে সাথে ধ্রুব সরে যায়। বুকের ভিতর কামড়ে উঠে তার। সে নিথর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কাঁপানো গলায় বলে, “তাহু আমি মরে যাব।”
“আমার দ্বিতীয় ইচ্ছা, তুই কখনো নিজের কোনো ক্ষতি করবি না।”
ধ্রুব সাথে সাথে তাহিরার কাছ থেকে দূরে সরে চিৎকার করে উঠে, “তুই কি চাস আমার কাছ থেকে?”
তাহিরা এখনো হেসে উওর দেয়, “তোর খুশি।”
“মিথ্যা কথা। তুই আমার কাছ থেকে প্রতিশোধ নিচ্ছিস। তুই যত কষ্ট পেয়েছিস তার থেকেও হাজারোগুণ বেশি কষ্ট আমাকে দিতে চাচ্ছিস তুই। তুই ভালো করে জানিস তুই ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই। কেউ না। তবুও তুই…তুই আমাকে ছেড়ে যাচ্ছিস। তুই আমাকে বাঁচতেও দিতে চাচ্ছিস না, না মরতে বলছিস। আমি একা কীভাবে বাঁচবো? তোকে ছাড়া কীভাবে বাঁচবো আমি? তোর শেষ মুহূর্তগুলো তোর সাথে না কাটিয়ে থাকবো কীভাবে আমি? তুই আমাকে সারাজীবন আফসোস করাতে চাচ্ছিস। আমাকে আধমরা করে বাঁচতে বলছিস।”

তাহিরা উঠে ধ্রুবর সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। তার কাঁপা-কাঁপা হাত ধরে পা’য়ের পাতা উঁচু করে কপালে চুমু খায়। মুগ্ধ নয়নে তাকায় ধ্রুবর দিকে, “তুই জানিস আমি যখন পনেরো বছরের কিশোরী তখন থেকে তোকে ভালোবাসি। তারপর দু’জনে প্রেম করলাম, বিয়ে করলাম অথচ কখনো ‘ভালোবাসি’ শব্দটা বলা হয় নি তোকে। ধ্রুব শুন, আমি খুব খুব খুব ভালোবাসি তোকে। তোর মতো এই পৃথিবীতে কাওকে ভালোবাসি নি। আর না বাসবো। কিন্তু আমি যাবার পর তুই অন্যকাওকে ভালোবাসিস। আমার থেকেও বেশি। কিন্তু তাকে কষ্ট দিস না। সবাই তো তাহিরা না যে তার ধ্রুবর দেওয়া সকল দুঃখের জন্য ক্ষমা করে দিবে।”
ধ্রুব আর সামলাতে পারে না নিজেক। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে মেঝেতে। তার শান্ত দৃষ্টি মেঝের দিকে, “ক্ষমা করে দিলে এভাবে আমাকে ছেড়ে যাচ্ছিস কেন?”
“আমি তোকে দিনরাত প্রতিনিয়ত কষ্টে ভুগতে দেখতে পারবো না যে। আমার মৃত্যুর অপেক্ষা প্রতিনিয়ত তোকে মরতে দেখতে পারবো না। আমাদের প্রথম দেখাটা আমার আজও মনে আছে। দাদী’মা তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো আমায়। তুই দুষ্টু ছিলি খুব। আমার বেণুণি টেনে দৌড়ে ভেগে গিয়েছিলি। এই শেষ দেখাটাও আমার মৃত্যুর আঁক পর্যন্ত মনে থাকবে।”
তাহিরা যেতে নিলেই ধ্রুব তার হাত ধরে নিলো, “তুই মা’কে ওয়াদা করেছিলি, কখনো আমাকে ছেড়ে যাবি না। তুই তো ওয়াদা ভঙ্গ করিস না।”
“একবার নাহয় করলাম। যদি ওই দুনিয়ায় ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ থাকে তাহলে ক্ষমা চেয়ে নিব আন্টির কাছ থেকে।”
তাহিরা নিজের হাত ছাড়িয়ে বিছানার নিচ থেকে লাগেজ বের করে আনে। যাবার পূর্বে একটিবার ধ্রুবর সামনে বসে তার বুকে মাথা রেখে বলে, “তোর এই বুকে আমি কত শান্তি পেয়েছি আমি বুঝাতে পারবো না। ধন্যবাদ ধ্রুব, আমাকে ভালোবাসার জন্য।”
ধ্রুব আর পারলো না। সে তাহিরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে। যেন এখনই পালিয়ে যাবে তাহিরা তার কাছ থেকে। হাহাকার ছড়িয়ে পরে চারপাশে।

ধ্রুবর এই অবস্থায় তাহিরা নিজেও বেসামাল হয়ে পড়ে। তার চোখের জলও অবাধ্য হয়। তবুও সে নিজের মনকে সামলায়। ধ্রুবর বাহুডোর থেকে নিজেকে মুক্ত করে। শেষ চুমু খায় ধ্রুবর কপালে। আর বলে, “ভালোবাসি ধ্রুব। এই জীবন তোকে ভালোবাসেই কাটিয়ে দিলাম।”
তাহিরা উঠে যেতে নিলেই ধ্রুব তার হাত ধরে আকুতি বিনুতি করতে থাকে, “তাহু… তাহু দয়া করে আমাকে ছেড়ে যাস না। তাহু প্লিজ। অন্তত নিজের মৃত্যুর অনুমতি দিয়ে যা।”
সেদিন কোথা থেকে যেন তাহিরার নরম মনটা এত শক্ত হয়ে এলো। সে ধ্রুবকে সেই অবস্থায় রেখে রওনা দিলো। চলে যেতে চাইলো এই স্মৃতি ভরা ঘর থেকে দূরে, ধ্রুবর কাছ থেকে বহুদূরে।

চলবে…

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here