#মুহূর্তে
পর্ব-৪৫
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
তাড়াহুড়ো করে বাসা চেঞ্জ করেছে অনু এবং কবিতা। কাব্যের অসুস্থতার পরে হাস্পাতাল থেকে বাসায় যেতেই অনুর ভাবি তাদের অনেক ভালো মন্দ কথা শোনাতে থাকে। অনু এটাও জানতে পারে যে কাব্যের এত অসুস্থ্য থাকা সত্ত্বেও তার ভাবী বাচ্চাটাকে এভাবে ফেলে রেখে আরামে টিভি দেখছিল। কথাটা শুনতেই অনুর মেজাজ বিগড়ে যায়। সে ভেবেছিল আগামী মাসেই বাসা চেঞ্জ করবে। কিন্তু এসব কান্ড দেখে সে নতুন বাসাতে উঠার চিন্তা করেই নিলো। তার অফিসের যাওয়ার রাস্তায় একটি নতুন বিল্ডিং হচ্ছে। যদিও কাজ এখনো শেষ হয় নি কিন্তু নিচে এক পরিবার থাকার মতো ব্যবস্থা হয়ে গেছে। বাড়িওয়ালাও এই বিল্ডিংয়েই থাকে। কয়েকদিনে বিল্ডিংয়ে অন্যান্য পরিবারও এসে পড়বে। এক সাপ্তাহের মাঝে এই জায়গাটাই খুঁজে পেল সে। সকাল থেকেই তার ঘর পরিবর্তনের কাজে ব্যস্ত। অনু বিকেলে জোর করে আইদকেও নিয়ে এসেছে তাদের সাহায্য করতে। যদিও সে বলেছে তাদের সাহায্যের জন্যই আইদের এখানে আনা। তবে কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আইদকে আনার একমাত্র কারণ হলো মৃণা। অনু চায় না আইদ সারাটাক্ষন মৃণাকে সামনে দেখে কষ্ট পাক। প্রতিদিন সে অফিসের কাজে বাহিরে থাকলেও সাপ্তাহিক ছুটির দিনে তো কারণ ছাড়াই বের হতে পারে না।
ঘর গুছানো প্রায় শেষ। আসবাবপত্র তেমন বেশি নেই বলে সময় কম লাগলো। কাজ শেষে অনু বিছানায় বসে হাফ ছাড়লো, “উফফ কাজ করতে করতে হয়রান হয়ে গেলাম।”
আইদ সে রুমেই দাঁড়িয়ে ছিলো। অনুর কথা শুনে সে চোখ দুটো বড় বড় করে বলল, “কি কাজ করলে তুমি শুনি? সব কাজ আমি এবং কবিতা আপুই করলাম। তুমি বসে শুধু খাচ্ছিলে এবং বাচ্চাদের সাথে খেলছিলে।”
কবিতা কুহুকে খিচুড়ি খাওয়াচ্ছিলো। আইদের কথা শুনে সে মৃদু হাসে।
অনু মুখ ফুলিয়ে বলে, “তোদের দিয়ে কাজ করানো একটা কাজ না? আর তুই কবিতাকে আপু ডাকলে আমাকে আপু ডাকিস না কেন? আমি কবিতা থেকে সম্পূর্ণ আড়াই মাস বড়।”
“আপু ডাকার মতো কোনো কাজ করেছ? সারাক্ষণ কানের নিচে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকো। আমি তো তাও তুমি করে ডাকি, তুমি তো আমাকে তুই-তারাকি ছাড়া কথায় বলো না। আর কবিতা আপুকে দেখো কত শান্ত।”
এই কথা শোনার সাথে সাথে অনু তাড়াহুড়ো করে উঠে গিয়ে দাঁড়ালো সামনে। চোখ দুটো এমনভাবে বের করে আইদের তাকাল যেন এমন আজব কথা আগে কখনো শুনিনি। গলায় জোর দিয়ে বলল, “এই মেয়ে আর শান্ত? আমি তোকে বলি, ছোটবেলা আমার মত শান্তশিষ্ট মেয়ে একটাও ছিলো না। এই মেয়েটাই আমাকে বদ বানিয়েছে। বদমাশি কাকে বলে, কত প্রকার, ও কি কি সব ওর থেকেই জানা যেত। বিয়ের পর ওই তীর্থের জন্যই না….” এতটুকু বলতে বলতে থেমে যায় অনু। শেষের বাক্য বলাটা বোকামি ছিলো তার। তীর্থের নাম শুনতেই পরিস্থিতিটা থমথমে হয়ে যায়। কবিতা এবং আইদ দুইজনের মাঝে অসস্তি ছড়িয়ে যায়। অনুর নিজের উপরই রাগ উঠছিলো। যে কোন দুঃখে বলতে গেল এই কথাটা?
কলিংবেল বাজল। অনু বলে, “আমি দেখছি।”
কবিতা থামায় তাকে। উঠে বলে,” কুহুকে খাওয়ানো শেষ। আমি এমনিতেই ওদিকে যাব। আমি দরজা খুলে দেখছি।”
কবিতা রান্নাঘরে প্লেট রেখে গিয়ে দরজা খুলে। দরজার বাহিরে কথনকে দেখে একটু চমকে যায় সে, “আপনি এখানে?”
“আসা মানা হলে আমি চলে যেতে পারি।”
“না না, আমি সেভাবে বলিনি। আপনার আজ এনগেজমেন্ট ছিলো। তাহলে আপনি তা ছেড়ে এখানে যে?”
কথন দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “এখন কিসমত খারাপ না আমার কী করার বলো? বিয়ে ঠিক হলেই মেয়ে ছেড়ে চলে যায়। প্রথমে তুমি ছ্যাঁকা দিয়ে চলে গেলে, এরপর আজ এনগেজমেন্টের দিন মেয়ে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে গেল।”
“বলেন কি?” চিন্তিত সুরে বলে কবিতা, “আপনি ঠিক আছেন তো?”
কথন বুকের বাশ পাশে হাত রেখে বলল, “ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাঁকা হয়ে আছি। তাই সোজা হবার জন্য তোমাদের কাছে চলে এলাম।” কথন অনুমতি না নিয়ে বাসার ভিতরে ঢুকে গেল। আর সামনে বলতে থাকলো, “মেইনলি ঘরে সবাই সেন্টিমিন্টাল হয়ে আছে। সেখানে থাকলে সবাই অকারণে সান্ত্বনা দিয়ে দিয়ে আমার মাথা খারাপ করে দিতো। তাই তোমাদের সাথে গল্প করতে চলে আসলাম। বিশেষ করে কাব্যের সাথে খেলতে। প্রথমে গিয়েছিলাম অনুর বাসায়। সেখানে একটি মহিলা আমাকে দেখে যেমন করে মুখ বানালো যেন জীবনে মানুষ দেখে নি। তাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম যে তোমরা বাসা চেঞ্জ করেছ আজই। হাস্পাতালে যেয়ে অনুর নাম্বার পেলাম, তারপর অনুর থেকে ঠিকানা নিলাম। চিন্তা করো তোমাকে খুঁজতে কত কষ্ট করতে হয়েছে আমার।”
কবিতা দরজা বন্ধ করে প্রথমের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত সুরে আবারো জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি সত্যি ঠিক আছেন?”
“বেঠিক থাকার কি হলো? এমনিতেও জান্নাতের সাথে আমার বিয়ে করার কোন ইচ্ছা ছিলো না। মা’য়ের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের জন্য করতে হলো। এখন শান্তি আর শান্তি।”
কবিতা কিছুই বুঝতে পারছিলো না। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনার এনগেজমেন্ট ভেঙ্গে গেছে আপনার কিছুই আসে যায় না?”
“আসে যায় তো। এ-কারণেই তো কেক নিয়ে এসেছি। সবাই মিলে কেক খেয়ে উৎযাপন করবো। তোমাদের নতুন বাসায় উঠার উপলক্ষে মিষ্টিমুখও হয়ে যাবে। আসো।”
কবিতা বেকুবের মতো তাকিয়ে রইলো কথনের রুমে যাওয়ার দিকে। তার পিছু গেল সে। রুমে যেয়ে দেখে অনু কথনকে আইদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। পরিচয় করানোর পর আইদ বলে, “আপনার কথা বলেছিলো অনু।”
“তোমার কথা আমাকে বলে নি। তোমরা বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড না’কি?”
কথাটা শুনে হকচকিয়ে গেল আইদ। অনু স্বাভাবিক গলাতেই বলে, “ভাইয়া দশদিন হবে বন্ধুত্ব হয়েছে। উল্টাপাল্টা চিন্তা করেন না। আমাদের ফ্রেন্ডশিপও সেই লেভেলের ট্রাজিক ছিলো।”
“ট্রাজিক কীভাবে?”
অনুকে কিছু বলতে দেয় না কবিতা। ব্যাপারটা মহলটাকে আরও বিদঘুটে করে তুলবে। সে বলে, “এসব কথা পরে হোক। আগে বলুন কে কে চা খাবেন?”
সকলেই হ্যাঁ বলল। কবিতা রান্নাঘরে গেল চা বসাতে। সাথে নুডলস রান্না করার জন্য পানিও বসালো। কিছুক্ষণের মধ্যে কথনও সেখানে এসে হাজির, “একগ্লাস পানি হবে?”
কবিতা তাকে পানি দেয়। কথন রান্নাঘরের তাকে বসে পানি পান করে। গভীর নিঃশ্বাস ফেলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করে, “তুমি হঠাৎ তখন কথা ঘুরানোর চেষ্টা করলে কেন?”
কবিতা তার দিকে তাকাল না। নিজের কাজ করতে করতে বলল, “বিষয়টা কমপ্লিকেটেড। তীর্থ যে মেয়ের সাথে পরক্রিয়া করেছিল, সে মেয়ের সাথে এই আইদের বিয়ে হয়েছিলো। তখন মৃণা প্রেগন্যান্ট ছিলো বলে বিয়েটা খারিজ মানা হয়। কিন্তু বিয়ে খারিজ হলেই তো আর কষ্ট খারিজ হয়ে যায় না। তাহিরা আপুর কথানুযায়ী আইদ স্বভাবতই শান্ত ছেলে এবং খুবই ভালো। এমন লোকেরা সহজে নিজের কষ্ট প্রকাশ করে না। তাই আমিই বলেছিলাম অনুকে ওর খেয়াল রাখতে। যেহেতু ওরা একই অফিসে কাজ করে। ও আইদের সাথে বন্ধুত্ব করে ভালোই করলো।”
“তোমার এতে অস্বস্তি লাগে না? মানে আইদকে দেখলে।”
“আমার আজকাল জীবনের প্রতি মুহূর্তই অস্বস্তিকর লাগতে। এর মানে আমি নিজের জীবন তো শেষ করে দিতে পারি না। তাই না?”
কথাটা বলে কবিতা কথনের দিকে তাকিয়ে ছোট মিষ্টি এক হাসি দিলো।
কথাটা শুনে কথনের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠে। যতটা না কথা তাকে প্রভাবিত করে, এর থেকে বেশি এই ভেবে সে কষ্ট পায় যে সে কোনো ভাবেই কবিতার কষ্ট দূর করতে পারবে না। আজ কবিতার হাসিটাও তার হৃদয়ে সুঁইয়ের গাঁথার মতো ব্যাথা দিচ্ছে। তবে সে নিজের এই হতাশা প্রকাশ করল না৷ কবিতার কষ্ট সে না দূর করতে পারলেও কিছু মুহূর্তের জন্য তার ঠোঁটের কোণে হাসি তো আনতে পারবে।
কথন বলল, “তোমার আমাদের প্রথম দেখা মনে আছে? তোমার জন্য আমি শিল্পা ম্যামের কাছ থেকে প্রথমবার বকা খেয়েছিলাম। ”
কবিতা আপত্তিকর মনোভাব পোষণ করল, “একদম না। সব দোষ আপনার ছিলো।”
“দেখো কবিতা মিথ্যা বলবে না। তুমি লিটিলারি বিনা মগজের মেয়ে ছিলে সে সময়।”
“মুখ খুলাবেন না একদম। পাগলের মতো সকল কাজ আপনার ছিলো। আর আপনি আমাকে একবার আসলে পাগলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন আমি কখনো ভুলবো না।”
কথনের সেদিনের মনে করে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়া অবস্থা, “আমারও মনে আছে। ও বন্ধু ছিলো আমার। তোমার বকা শুনে পালিয়ে গিয়েছিলো আর আমার সাথে যোগাযোগ করে নি।”
কথার তালে কবিতা অমনোযোগী হয়ে গরম পাতিলে ধরতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে নিলো। সাথে সাথে হাত সরিয়ে নিলো সে। ফুঁ দিতে থাকলো।
কথন কবিতার এমন কান্ড দেখে আঁতকে উঠে। লাফ দিয়ে তাক থেকে নেমে কবিতার কাছে যায়। তার হাতটা ধরে বলে, “মাথা নষ্ট না’কি? খালি হাতে কেউ গরম পাতিল ধরে?”
কথন সাথে সাথে ট্যাপ কল ছেড়ে ঠান্ডা পানির নিচে তার হাত রাখে। আবারও বকা দেয় কবিতাকে, “কাজ করার সময় দেখে করতে পারো না? ইশশ কতখানি পুড়ে গেছে।”
কবিতা হাত সরানোর চেষ্টা করে বলল, “অসুবিধা নেই। আমি ঠিক আছি।”
কথন আরও রেগে যায়। ক্রোধিত দৃষ্টিতে তাকায় কবিতার দিকে। আবারও কবিতার হাত পানির নিচে রেখে জিজ্ঞেস করে, “সত্যি বলতো বেশি ব্যথা করছে না তো?” বলে আবারো তাকায় কবিতার দিকে। চোখে চোখ মিলে। হয় কিছু মুহূর্তের নয়ন বন্ধন। তীব্র গতিতে বাহির থেকে হাওয়া এসে এলোমেলো করে দিয়ে যায় কবিতা কৃষ্ণ কেশ।
কথন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে কবিতার দিকে। এত বছর কবিতা দেখতে অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। কিন্তু পরিবর্তন হয়নি তো তার মুখের মায়া। সে হাত বাড়িয়ে কবিতার চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজতে নিলেই কবিতা পিছিয়ে যায়। খানিকটা অস্বস্তি তার মুখে ভেসে উঠেছে। সম্ভবত তার ছোঁয়াটা কবিতার পছন্দ হয় নি।
কথন নিজেকেই সংযত করে নেয়। সে কবিতাকে বলে, “তোমার রান্না করার প্রয়োজন নেই, আমি করছি।”
“আপনি?” অনেকটা অবাক হয়ে বলে কবিতা।
“কেন আমি করতে পারি না? তোমার থেকে মজা করে রান্না করে দেখাব। যাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।”
“না না, প্রয়োজন নেই।”
“আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি মনে মনে ভাবছ আমি রান্না করলে কেউ খেতেই পারবে না। এখন তো আমিই রান্না করে দেখাব।”
কথন কবিতা একপাশে দাঁড় করিয়ে বলল, “এখানে দাঁড়াও এবং আমাকে মাস্টারশেফের মতো খাবার রান্না করতে দেখ।”
কথন নিজে রান্না করছিলো। খানিক সময় পর অনুও এসে তাকে সাহায্য করে। কবিতা চলে যায় বেডরুমে কুহুর খেয়াল রাখতে।
হঠাৎ করেই অনু জিজ্ঞেস করে, “ভাইয়া আপনি কী কবিতাকে এখনো পছন্দ করেন?”
কথন সবজি কাটছিলো। অনুর কথা শুনে খানিকটা হকচকিয়ে যায় সে। অনু আবারও বলে, “আমি আট বছর আগে থেকেই জানি যে আপনি কবিতাকে পছন্দ করেন। আপনার ওর প্রতি সকল যত্ন দেখেই তা স্পষ্ট বুঝা যায়। কবিতা এমন মেয়ে না যে কোনো ছেল তাকে পছন্দ করবে কিন্তু সে বুঝবে না। কিন্তু আপনার বেলাতেই ও কি করে যে বুঝেতে নি তা আমার মাথায় ঢুকে না।”
“ওর দোষ নেই। আমি এমন একজন মানুষ যে মনের কথা বলতে সংকোচবোধ করে না। তবে কবিতার ক্ষেত্রে বিপরীত হলো। আমি ওকে কিছুতেই নিজের মনের কথা জানতে দিতে চাই নি। এর কারণটা আমি জানি না। কিন্তু খুব সংকোচবোধ হতো। অবশ্য না বলে ভালোই করলাম, তখন কবিতা তীর্থের সাথে সম্পর্ক ছিলো।”
“আর এই কথা কে বলল আপনাকে? বিয়ের একমাস আগে দুইজনে সম্পর্কে জড়িয়েছে। আমার যতটুকু মনে হয় কবিতা সে সময়েই তীর্থকে গভীরভাবে ভালোবাসা শুরু করেছিলো। প্রথম যখন তীর্থ তার ভালোবাসা প্রকাশ করে তখন কবিতা নিজেও কনফিউজড ছিলো। কারণ ও নিজের অনুভূতি নিজেই জানতো না। কিন্তু তার প্রতি তীর্থের ভালোবাসা…সরি মিথ্যে ভালোবাসা দেখে সে মুগ্ধ হয়েছিলো। আপনি আপনার ভালোবাসা প্রকাশ করলে সম্ভবত ওর ভালোবাসার মানুষ হতে পারতেন।”
অনুর কথা শুনে খুবই হতাশ হয় কথন। এই কারণে যে সে কবিতাকে পেতে পারতো, বরং এই কারণে যে অতীতে সে তার অনুভূতি প্রকাশ করলে হয়তো আজ কবিতাকে এত কষ্টের সম্মুখীন হতে হতো না।
অনু আরও বলে, “কী আজব কান্ড তাই না? সেসময় তীর্থ চুপচাপ ব্যক্তি ছিলো যে কখনো নিজের অনুভূতির প্রকাশ করতো না, কিন্তু সে কবিতার কাছে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে একটুখানিও দ্বিধা বোধ করলো না। অন্যদিকে আপনি, সব সময় নিজের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করেন অথচ কবিতার বেলায় আপনার অনুভূতিগুলো অপ্রকাশিতই থেকে গেল। আচ্ছা একটি প্রশ্নের উওর দিবেন? আপনি কবিতাকে ভালোবাসেন বলেই কি আজও অন্যকাওকে বিয়ে করেন নি?”
কথনের বুক চিরে হতাশার নিশ্বাস বের হয়। সে তার কাজে ধ্যান দেয়। মৃদু হেসে উওর দেয়, “সম্ভবত।”
অনু খানিকটা দ্বিধাবোধ করে আবারও জিজ্ঞেস করে, “কবিতা ডিভোর্সের জন্য আমার সাথে পরামর্শ করছিলো দু’দিন আগে। উকিলের সাথে কথা বলতে বলেছে আপনি কি….” অনুর কথার শেষ হবার পূর্বেই কথন তার কথা ধরে নেয়। বলে, “না, আপাতত আমার ওকে পাওয়ার মতো কোনো ইচ্ছা নেই। আমি কেবল ওর সাথে থাকতে চাই। একটা বন্ধু হিসেবে। আমি চাই না আমার অনুভূতি প্রকাশ করে এই খারাপ সময় পাশে থাকার সুযোগ দাও আমি হারিয়ে ফেলি। এছাড়া এখন ওর নিজেকে চেনার সময়, নিজেকে গড়ে তোলার সময়। আমি এই সময় ওকে কোনো বাঁধনে আবদ্ধ করতে পারি না। আর আমি জানি ও তা দিবেও না। ও অনেক বড় ঠোকর খেয়েছে। এরপর ও কাউকে সহজে ভালোবাসতে পারবে না। আমি এক বন্ধু হয়ে ওর পাশে থেকেও ওকে ভালোবাসতে পারি, ওর জন্য অপেক্ষা করতে পারি। কিন্তু ওর এই লড়াইয়ে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারি না।”
কথনের উওরে ভীষণ সন্তুষ্ট দেখায় অনুকে।
অনু এবং কথন চা, নুডুলস রান্না করে ভিতরে নিয়ে যায়। সকলে খাবার পর কথন নিজেই নিজের প্রশংসা করে, “আহ কি রান্না করলাম আমি। একদম মাস্টারশেফ লেভেলের।”
অনু বলে, “ভাইয়া আমি আপনার হেল্প করেছি কিন্তু।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ বোন। আমি হেড শেফ আর তুই সু-শেফ। আমার মনে হয় আমাদের এই ডাক্তারি এবং অফিসের কাজ ছেড়ে বড় কোনো রেস্টুরেন্টে শেফ হিসেবে কাজ করা উচিত।”
“মনের কথা বলছেন ভাইয়া।”
আইদ হতদম্ব হয়ে একবার তাদের দিকে তাকায়,আবার তাকায় নুডুলসের দিকে, “এটা কেবল ম্যাগি নুডুলস। ম্যাগি নুডিলস রান্না করে শেফ হওয়া যায় না।”
অনু কাঁটা চামচ আইদের মুখের সামনে ধরে বলে, “দেখ বেশি কথা বলিস না। এই রান্নার সাথে আমাদের ইমোশন জড়িত। খেয়ে এখনই বলবি যে শেফমার্কা রান্না হয়েছে।”
“শেফমার্কা আবার কী?”
কবিতা হাসতে হাসতে উওর দেয়, “অর্থাৎ শেফ রান্না করেছে এমন।”
আইদ কিছু বলতে নেয় এর পূর্বেই তার ফোন বেজে ওঠে। সে ফোন পকেট থেকে মৃণার কল দেখেই তার চোখেমুখে উদাসীনতা ছড়িয়ে যায়। এই হাসি ঠাট্টার মহলটা বিদঘুটে লেগে উঠে তার। অনু তার মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় হারিয়ে গেলি তুই? কে কল করছে?”
কবিতা মৃণার নাম নিয়ে কারও খুশি নষ্ট করতে চায় নি। তাই বলল, “একটা এলাকার বন্ধু কল দিয়েছে। আমি কথা বলে আসি।”
আইদ উঠে বারান্দায় গেল। কল ধরে কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করল, “কল দিচ্ছো কেন?”
“কোথায় তুমি? এখনো বাসায় আসছো না কেন?”
“আর তোমাকে আমার উওর দিতে হবে কেন?”
ফোনের ওপাশ থেকে মৃণা কঠিন গলায় বলে, “আমি জিজ্ঞেস করছি তাই উওর দিতে হবে।”
“কে তুমি শুনি?”
“আমি তোমার….” সামনে বলতে পারে না মৃণা। থেমে যায় সেখানেই।
“তুমি আমার কেউ না। দেখো মৃণা তোমাকে আমার বাসায় কেবল এইজন্য থাকতে দিয়েছি কারণ আংকেলের মৃত্যুর পর আন্টির অবস্থা খারাপ। তোমার কুকর্ম আমি তাকে এই মুহূর্তে শোনাতে চাই না। তুমি ক’দিনের মেহমান মাত্র সে ঘরে। তাই নিজের সীমানা থেকে কথা বলো। আর তা না পারলে নিজের আশিকের কাছে যেয়ে হক জমাও। ওহ সরি, আমিও কি বলছি সেদিন তো সে তোমায় ধাক্কা মেরে ঘর থেকে বাহির করে দিয়েছিলো।”
ওপাশ থেকে মৃণার কোনো উওরই শুনতেই পারছিলো না আইদ। এমন সময় অনু দরজার কাছে এসে বলল, “কি’রে আর কতক্ষণ লাগবে তোর? চা ঠান্ডা হয়ে গেল।”
“তুমি যাও, আমি আসছি।”
এবার মৃণার কন্ঠও শোনা গেল, “তোমার সাথে কোনো মেয়ে আছে?” তার কন্ঠ ক্ষোভে ভরা।
“নন অফ ইউর বিজনেস।”
“উওর দেও আইদ।”
“তোমাকে জবাব দেবার প্রয়োজন আমি বোধ করি না। আর একবার কল দিলে তোমার জন্য অনেক খারাপ হবে।”
কল কেটে দেবার পূর্বে মৃণা আবার বলল, “তোমার সাথে যে মেয়ে আছে সে আমাকে নিয়ে তোমার কান ভরছে তাই না? তুমি কখনো এমন ছিলে না আইদ। তুমি আমার সাথে এমন ব্যবহার কেন করছ?”
মৃণার কোনো কথা শোনার রুচি তার হলো না। এ-কারণে কল কেটে দিলো সে।
#মুহূর্তে
পর্ব-৪৬
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
রোজ রোববার। কবিতা ইন্টারভিউ দিতে এসেছে অনুর অফিসে। বড় ম্যাডাম ডেকেছে তাকে। যদিও কবিতা চায় নি যে কেউ তাকে অসহায় মনে করে এভাবে কাজ দিক, তবুও তার কাছে কোনো উপায় নেই। সে যেখানেই যায় সেখানেই তাকে রিজেক্ট করা হয়। এমনকি দুই জায়গায় তাকে বাছাই করার পরও বাদ দেওয়া হয়েছে। এমনকি সে শোরুমে যেয়ে সেলসগার্লের জন্যও ইন্টারভিউ দিয়েছে। সেখানেও তাকে নেওয়া হয় নি। এখন সে অনুর আর বোঝা হতে চায় না। এভাবে সে সারা জীবন কাটাতে পারবে না। তাই বাধ্য হয়ে তার এখানে আসতে হলো। কাব্যকে স্কুলে দিয়ে কুহুকেও সাথে নিয়ে এসেছে। এই তার আরেক চিন্তা। সে কিছুক্ষণের জন্য বাহিরে গেলে কাব্যই কুহুকে সামলায়। কিন্তু কাব্যেরও স্কুল আছে। সে হাফ টাইম কাজ করলেও কুহুকে কীভাবে সামলাবে সে?
আপাতত তার মাথায় কিছু কুলাচ্ছে না। আগে এখানে ইন্টারভিউ দেওয়া হোক, তারপর দেখবে।
কুহুকে আনার সাথে সাথে সবাই তাকেই ঘিরে আছে। অনুর কোলে ছিল সে, বাচ্চা দেখে অন্য ডিপার্টমেন্টের সবাই তার সাথে খেলা শুরু করেছে।
কবিতার ডাক পড়লো। হঠাৎ করেই তার অস্থিরতা বাড়তে শুরু করে। বুকের ভিতর ধুক ধুক করতে থাকে। বড় ম্যাডাম না’কি সহজে কারও সাথে দেখা করে না। অন্যকারো ইন্টারভিউ ম্যাডাম নেয় না, ডিপার্টমেন্টের হেড নেয়। তাই তার কাছে ইন্টারভিউ দিতে যাওয়াটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার বটে।
“মে আই কান ইন ম্যাম?” কবিতা দরজার কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করে।
বড় ম্যামের অফিস সবার উপরের তলায়। উপরের তলায় কেবল দুইটা মিটিং রুম, একটা সাধারণ রুম এবং মেডামের কেবিন। তাই এই তলাটা সম্পূর্ণ খালি বললেই চলে। বাহিরে দুইজন সিকিউরিটি গার্ড এবং পিয়ন ছাড়া কেউ নেই।
“কাম ইন।”
অনুমতি পেয়ে ভিতরে ঢুকে কবিতা। কেবিন দেখে অবাক হয়ে যায়। তার সম্পূর্ণ ফ্ল্যাটের সমান হবে এই ক্যাবিন। সেখানে সোফা থেকে শুরু করে বুকশেলফ, কফি মেশিন, মিনি ফ্রিজ, খাবারের আলাদা আয়োজন সবই আছে। এত কিছু দেখে কবিতা অবাক না হয়ে পারে না।
সে দেখলো সোফায় একটি মেয়েও বসা। বয়স হবে ষোল সতেরো। অসম্ভব সুন্দরী মেয়েটি। দেখতে অসম্ভব মিষ্টি। মেয়েটি প্যাজাল দিয়ে খেলছিলো। সে একপলক চোখ তুলে তাকাল কবিতার দিকে। কবিতা মিষ্টি হাসলো।৷ কিন্তু মেয়েটির কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল না। সে হাসলও না। আবার চোখ নামিয়ে নিজের কাজ করতে শুরু করলো।
“ও আমার মেয়ে।” রুমের অন্যপাশ থেকে কন্ঠ শোনা যায়। কবিতা তাকিয়ে থাকে একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা টেবিলে বসে আছেন। মহিলাটি এই বয়সে দেখতেও ভীষণ সুন্দর। চশমা পরা। চুলগুলো কিছুটা সাদা হয়ে গেছে। তিনিই বড় ম্যাডাম। অনু ঠিক এমনই বর্ণনা দিয়েছিল তার। তিনি আবারও বললেন, “তুমি কবিতা তাই না? আসো, এখানে বসো।”
টেবিলের অন্যপাশে ইশারা করলেন তিনি। কবিতা বাধ্য মেয়ের মতো সেখানে যেয়ে বসলো। কবিতার সব ফাইল সে দেখে বলল, “সত্যি বলছি তোমার ফাইল এতটা ইম্প্রেসিভ না। তোমার বোর্ডের রেজাল্টও এত ভালো না। এর উপর তুমি পড়াশোনাও কমপ্লিট করো না। কেন করো নি জানতে পারি?”
কবিতা অনেকটা সংকোচ বোধ করল। বলল, “আ..আমার স্বামীর অবস্থা তখন ভালো ছিলো না। আমি প্রেগনেন্টও হয়ে গিয়েছিলাম।”
“তোমার সে স্বামী যে অনুকে এবং আইদকে চাকরি থেকে বের করতে বলেছিলেন?”
কবিতা মাথা নামিয়ে নেয়। লজ্জা পায় সে। অস্বস্তি নিয়ে বলে, “জ্বি।”
বড় ম্যাডাম দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে, “তোমার সম্পর্কে অনু আমাকে অনেক কিছু বলেছে। এখানে তোমার লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। যে তোমার সাথে এসব করেছে তার লজ্জা পাওয়া উচিত, তোমার না। আমাদের সমাজে কিছু মানুষ আছে যারা কেবল নিজের কথা চিন্তা করতে জানে। নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে অন্যকে নিচু করে রাখতে চায়। তোমার স্বামীও এমন। কিন্তু আমি তোমার ব্যাপারে জেনে অনেক খুশি হয়েছি। তুমি এত কিছুর পরও তার কাছে ফিরে যাও নি। আমি জানি সিঙ্গেল মাদার হওয়া কতটা কষ্টকর।”
কবিতা একটু অবাক দৃষ্টিতে তাকায় বড় ম্যাডামের দিকে।
বড় ম্যাডাম এমন প্রতিক্রিয়া দেখে নিজে আবার বললেন, “তবে আমার পরিস্থিতি তোমার মতো ছিলো না। তবে এতটুকু বলবো আমার থেকে এমন মেয়ের অবস্থা বেশি খারাপ ছিলো। আমার এবং আমার স্বামীর মাঝে ঝামেলাটার প্রভাব সবচেয়ে বেশি আমাদের মেয়ের উপর পড়েছে।”
কবিতা একবার পেছনে ফিরে তার মেয়ের দিকে তাকায়। বড় ম্যাডাম বললেন, “আমার মেয়ের নাম স্বর্ণালি। ও ছোটবেলায় অনেক দুষ্টু এবং স্বভাবের ছিলো। কিন্তু এখন কারো সাথে কথা বলে না ঠিকমতো। এমনকি আমারও খুব কম কথা হয় ওর সাথে।”
“এমনটা কেন?”
“আমি তোমাকে একটা গল্প শুনাই। গল্পটা তোমার জীবনের সাথে কোন অংশটি মিল না থাকলেও আশা করি গল্পটা শোনার পর তুমি নিজের জীবনের লড়াই নিজে করতে পারবে। আমার এবং আমার স্বামীর অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হয়েছিলো। সে বিয়ের আগের থকেই অন্যকাওকে ভালোবাসতো। এইকথা জানি আমি বিয়ের তিনবছর পর। তখনও মেয়েটার সাথে তার যোগাযোগ ছিলো। সে সময় আমি অনেক ঝগড়া করলেও তাকে ছেড়ে যায় নি। কেননা আমার কোলে ছিলো স্বর্ণালি। সে বাচ্চার জন্যই থেকে গেছি আমি তার সাথে। কিন্তু তার প্রতি ক্ষোভ মন থেকে বের করতে পারি নি। প্রায়ই ঝগড়া হতো আমাদের। রাগে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করতাম। সেও আমার উপর হাত তুলতো। তবুও তার সাথে থাকতাম। এর একমাত্র কারণ, আমি স্বর্ণালিকে বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করতে চাই নি। মিথ্যা বলব না, সে নিজেও খুব ভালোবাসতো স্বর্ণালিকে।আমরা দুইজনই একসাথে বাধ্য হয়ে থাকতাম কেবল স্বর্ণালির জন্য। অথচ কখনো ভাবি নি আমাদের এত ঝগড়ার জন্য এতটুকু বাচ্চার মানসিক কত চাপ পড়ছে। ধীরে ধীরে ও চুপ থাকতে শুরু করে। পড়ালেখায় আগে ভালো থাকলেও দিনদিন পড়াশোনায় মন উঠে যায় তার। তারপর একদিন আসে সে দিন আসে যার কল্পনাও কখনো করি নি। স্বর্ণালিকে স্কুল থেকে আনতে যেয়ে তাকে কোথাও পাই নি। সে না’কি সেদিন স্কুলেই যায় নি। অথচ ড্রাইভার নিজে তাকে স্কুলের সামনে নামিয়ে দিয়ে এসেছিলো।”
কবিতা আগ্রহ নিয়ে কথাগুলো শুনছিল। সে জিজ্ঞেস করে, “স্কুলের সামনে নামিয়ে দিলে কোথায় গিয়েছিলো?”
“সেদিন সকালে আমি এবং আমার বাবা ঝগড়া করেছিলাম। খুবই সামান্য ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া। তখন আমাদের ঝগড়াগুলো বিষয় ভীষণ সামান্য ছিলো, অথচ পরিণতি ভয়ংকর। এসব আর সহ্য করতে না পেরে আমাদের মেয়ে স্কুলে গেইট থেকেই কোথায় চলে যেন গেল।”
“তারপর?”
“তারপর ওর বাবাকে জানাই। পুলিশে রিপোর্ট লেখাই। আশেপাশে খোঁজ নেওয়ার পরে একটি মেয়ের দেহ পাওয়া যায়। ধর্ষিত হওয়া দেহ।”
কথাটা শুনে কবিতা চমকে ওঠে। হাতের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যায়।
বড় ম্যাডামের গলা কেঁপে উঠে, “তখন ওর বয়স সবে এগারো বছর। ওর এমন মর্মান্তিক অবস্থা দেখার জন্য আমরা কেউ উপস্থিত ছিলাম না।
ওকে বাঁচানোটা কঠিন হয়ে যায় এত খারাপ অবস্থা ছিলো। ওকে বাঁচানোর পরও যেন মৃতদেহ পড়ে ছিল আমাদের সামনে। কোনো কথা বলতো না, কাঁদতো না, খাবারও খেত না। কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখাতো না। ও প্রথম প্রতিক্রিয়া তখন দেখালো যখন ওর বাবার ওর সামনে এসেছিলো। উন্মাদের মতো ব্যবহার করেছিল তখন। এমনকি পুরুষ ডাক্তারকে দেখেও। কোনো পুরুষ ওর আশেপাশে এলে সহ্য করতে পারতো না ও। নিজের বাবাকেও না। নিজের বাবার খুব আদরের ছিলো স্বর্ণালী। ওর এমন ব্যবহারে খুব কাঁদতে দেখে উনাকে। সে কঠিন সময় প্রথমবার আমরা একে অপরের সাথে ভালোভাবে কথা বলেছি। কতবছর পর তা হয়েছে আমার জানা নেই। অপরাধীকে ধরা হয়েছে। তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু এ শাস্তির পরিবর্তে আমার মেয়েকে স্বাভাবিক জীবন ব্যয় করতে পারে নি। পড়াশোনা বাদ দিয়ে দিতে হলো ওর। আশেপাশে আজও কোনো পুরুষ আসতে দেওয়া হয় না। দোষটা কেবল সে অপরাধীর না, আমাদেরও। আমরা আমাদের মেয়ের জন্য কেবল একসাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু আমাদের একে অপরের প্রতি ব্যবহারে ওর উপর কি প্রভাব পড়বে তা কখনো ভাবেনি। হয়তো আমরা আলাদা হয়ে গেলে মেয়েটার জীবন আরেকটু ভালো হতে পাড়তো। হয়তো। এরপর আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রেশার আসতে থাকে আরেকটা বাচ্চা নেওয়ার। সবাই জানায় আমার মেয়েরা এখন আর কোনো ভবিষ্যত নেই। তাই আমাদের অন্য বাচ্চার উপর উচিত। প্রথমে না মানা সত্ত্বেও তিনমাস বাবা রাজি হয়ে যায়। আমি তাকে দোষ দিবো না। সন্তানের ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার তার আছে। কিন্তু স্বর্ণালির সেই অবস্থা নেই। কিন্তু একজন মা হয়ে তো আমি এমনটা করতে পারিনা। আমার সব ধ্যান কেবল স্বর্ণালির উপর রাখতে হতো। তার প্রতি ধ্যান কমলে আমরা তাকে হারাতেও পারতাম। তারপর আমাদের তালাক হয়। আমি এরপর সব সময় আমার মেয়ে এবং বাবার ব্যবসার উপর দেই। আজ সাত বছর পর সে ছোট ব্যবসার ঢাকার সবচেয়ে বড় ব্যবসাটা পরিবর্তন করি। তোমাকে আমি এত কথা কেন শোনাচ্ছি জানো?”
কবিতা মাথা নাড়ায়। সে জানে না। মুখে উত্তর দিতে পারে না সে। এতোটুকু বাচ্চার সাথে এত বড় নির্মম ঘটনা ঘটেছে তা শোনার পর গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না তার।
বড় ম্যাডাম জানায়, “যেন তুমি বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নেও। যদি তুমি নিজের বাচ্চাদের জন্য তার কাছে ফিরে যেতে চাও তাহলে এতটুকু জেনে রেখো তাদের মানসিক শান্তির দায়িত্ব তোমার। তবে কি জানো, তুমি আমার থেকে অনেক বেশি সাহসী। আমি তাকে ছাড়ার অনেক বছর পর বুঝতে পেরেছি আমি নিজে কখনো নিজের সম্মান করতে জানি নি। তাই সে কখনো আমার সম্মান করে নি। তাইতো উনার এত মারধরের এবং অন্যনারীর সাথে কথা বলার পরেও তার সাথে থেকেছি। যে মানুষ নিজের সম্মান রাখতে জানে না অন্যেরাও তাদের সম্মান করে না। আমি আশা রাখি তুমি নিজের সম্মান এভাবেই বজায় রাখবে। তাই তোমাকে এই চাকরিটা দিলাম। তুমি আমার আসার পূর্বে আমার সব কাজ গুছিয়ে রাখবে। আমার সব ফাইল তুমি সামলে এবং দেখে রাখবে। আমাকে মিটিং থাকলে তা মনে করিয়ে দিবে। আমি স্বর্ণালির জন্য সকল কাজ নিজে দেখতে পারি না কিন্তু আমি জানতে পেরেছি আমার নাকের নিচে অনেক অন্যায় কাজ করা হয় এই কোম্পানিতে। তাই আমি চাই যখন আমি থাকব না তুমি স্বর্ণালির খেয়াল রাখবে। আমি বিকেল চারটার মধ্যেই ঘরে চলে যাই। তখন তুমিও চলে যেতে পারো।”
“থ্যাঙ্কিউ ম্যাম। আমার ছেলেরও স্কুল ছুটি এই সময়ের আশেপাশেই হয়। ওকে কোচিং এ দিলে ছুটি হতে হতে এই সময়ই লাগবে।”
“তোমার না’কি একটা মেয়েও আছে? ইচ্ছা হলে এখানে আনতে পারো। এই তলায় এক্সট্রা একটা রুমও আছে। স্বর্ণালিরও বাচ্চা অনেক পছন্দ। আর ডোন্ট ওয়ারি, ও মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক না হলেও ও কারও ক্ষতি করে না। ক্ষতি করে না বলতে, কোনো নারী, মেয়ে এবং বাচ্চাদের ক্ষতি করে না। আমি অনেকবছর ধরে ওর সামনে কোনো পুরুষ আনি নি।”
“অনেক ধন্যবাদ ম্যাম।”
তিনি একটি কাগজ কবিতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এইখানে তোমার সকল কাজ, বেতন, বোনাসের তথ্য দেওয়া। এখন তুমি আসতে পারো। তুমি আগামীকাল থেকে জয়েন করতে পারবে।”
কবিতা উঠে দাঁড়ায়। নম্র গলায় বলে, “ধন্যবাদ ম্যাম।” আবার সে স্বর্ণালির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আমি কি ওর সাথে একটু কথা বলতে পারি?”
“পারো।”
অনুমতি পেয়ে কবিতা স্বর্ণালির সামনে যায়, “হাই স্বর্ণালি।”
স্বর্ণালি তার দিকে তাকিয়েও চোখ নামিয়ে নেয়। কোনো উওর দেয় না। কবিতা বুঝতে পারে তার সঙ্কা। তাই বেশি কিছু বলে না আর। উঠে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায়। বেরিয়ে দেখে আরেক কান্ড। সবাই কুহুকে নিয়ে খেলতে ব্যস্ত। মানুষ এখন আরও বেশি। অনু কবিতাকে দেখে এসে জিজ্ঞেস করল, “চাকরি হয়েছে?”
“হয়েছে।”
উওর শোনার সাথে সাথে সে লাফিয়ে উঠে জড়িয়ে ধরে কবিতাকে। তারপর বলে, “আমি জানতাম তোর জীবনে আস্তে-ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। জানিস এর মধ্যে কি হয়েছে? আমার ফোনে একজন কুহুর ছবি দেখছিলো। কুহুর সাথে তোর একটি ছবি ছিলো না সাদা শাড়ি পরা। ওই তাহিরা আপুর বিয়ের?”
“হুঁ”
“ওটা দেখে আমাকে জিজ্ঞেস করে এটা কোথা থেকে কিনেছিলো। আমিও বললাম আমার বান্ধবী এত গুণবতী যে নিজের হাতেই বানিয়েছে। ও তো আমাকে ধরে অনুরোধ করতে শুরু করল যেন তোকে বলে যেন ওর জন্যও একটা বানিয়ে দেওয়ার জন্য। ও খরচসহ মুনাফাও দিবে।”
“আমার এসবের ইচ্ছা নাই রে। শুন কুহুকে নিয়ে বাসায় যাই। সেখানে কাজ সেরে কাব্যকে স্কুলে নিতে যাব।”
“কুহু কিছুক্ষণ এখানেই থাক। সবাই অনেক আদর করছে ওকে। আমি সন্ধ্যায় বাসায় দিয়ে যাব।”
“তোর কাজে সমস্যা হবে না?”
“আরে ধুর কিসের সমস্যা?”
“আচ্ছা, তাহলে আমি যাই।”
কবিতা যাওয়ার পূর্বে অনু থামায় তাকে, “দাঁড়া আরেকটা কথা আছে। তাহিরা আপুর কিছু হয়েছে বলে জানিস?”
“আপুর? না-তো। হঠাৎ এ প্রশ্ন করছিস যে?”
“আপু না’কি চাকরি ছেড়ে দিয়েছে।”
“কী!” চমকে ওঠে কবিতা।
“হ্যাঁ, গতমাসে ছেড়েছে। আইদ জানতে এসেছে। আজ না আসায় ওর বিভাগে তা বলা হয়েছে।”
“আচ্ছা, আমি আপুর সাথে কথা বলে দেখব।”
কবিতা অফিস থেকে সোজা কাব্যের স্কুলে গেল। ছুটি হওয়ার পর্যন্ত সেখানে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলো সে।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল কবিতা। সকলের ছুটি হয়ে গেছে। তবুও আশেপাশে কোথাও কাব্যকে দেখতে পেল না। না পেয়ে ভিতর যেয়ে খোঁজ নিল। কাব্যের ক্লাসটিচার জানায় তার বাবা এসে তাকে সেকেন্ড পিরিয়ডেই নিয়ে গেছে। বুকের ভেতর কামড়ে ধরে তার।
তীর্থ!
আবার সে কেন? কী চায় সে? সে কী কখনো তাকে কিছু মুহূর্তের শান্তি দিতে পারে না?
কবিতা কিছু না বলেই বেরিয়ে যায় স্কুল থেকে। কল দেয় তীর্থকে। মুহূর্তও লাগে না তীর্থের কল ধরতে। যেন সে এই কলেরই অপেক্ষায় ছিলো।
“হ্যালো জান।”
“আমার ছেলে কোথায়?” কবিতা কঠিন গলায় প্রশ্ন করে। ফোনের ওপাশ থেকে তীর্থ হেসে বলে, “মানে আমাদের ছেলে।”
“যে মানুষ ওর জীবন মরণের সময় নিজের স্বার্থ নিয়ে ভেবেছে তাকে আমার ছেলের বাবা হিসেবে মান্য করি না।”
“তোমার মানা, না মানায় সত্য পালটে যায় না সুইটহার্ট।”
কবিতার প্রচন্ড রাগ উঠা সত্ত্বেও সে নিজেকে সামলায়। জিজ্ঞেস করে, “আমার ছেলে কোথায় তীর্থ?”
“আমার সাথে। ওকে নিতে হলে তোমার বাসায় আসা লাগবে।”
কবিতা সাথে সাথে ফোন কেটে দিলো। রওনা দিলো বাসার উদ্দেশ্যে।
বারবার কলিংবেল বাজাচ্ছে কবিতা। কেউ দরজা খুলছে না। তার মোবাইলে মেসেজ আসে, “দরজা খোলা।”
কবিতা ভেতরে ঢুকে কাব্যকে ডাকতে থাকে। সে কাব্যের রুমে খুঁজেও তাকে পায়। ড্রইংরুম, ডাইনিংরুম কোথাও নেই সে। তাকে না পেয়ে সে যায় বেডরুমে। সেখানে যেয়ে সে কেবল পায় তীর্থকে। সে কালো স্যুট পরে বসে আছে বিছানায়। তার একহাতে জ্বলন্ত সিগারেট, অন্যহাতে মদ ভর্তি এক গ্লাস। দৃশ্যটা দেখে চমকে উঠে উঠে কবিতা। পরের মুহূর্তে সিগারেটের ধোঁয়ায় কাশতে শুরু করে। সিগারেটের গন্ধ তার সহ্য হয় না।
তীর্থ উঠে দাঁড়ায়। তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে, “তুমি বলেছিলে আমাকে কালো স্যুটে অনেক হ্যান্ডসাম দেখায়। দেখো তোমার অপেক্ষায় আমি হ্যান্ডসাম সেজে বসে আছি।”
তীর্থ কাছে আসতে আসতে তার একদম কাছে এসে পড়ে। কবিতা দূরে সরে সোজা প্রশ্ন করে, “কাব্য কোথায়?”
“কাব্য? ওকে রহমতের সাথে আইস্ক্রিম খাওয়ার জন্য পাঠিয়েছে। এখন ওর মা এবং আমি একটু একা সময় কাটাব। এখানে ওর কী কাজ?”
কবিতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তীর্থর দিকে। এরপর কিছু না বলে চলেছে তো নিলেই তীর্থ তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।
“এটা কোন ধরনের বেয়াদবি?” কবিতা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে। কিন্তু পারে না। তীর্থে শক্তির সাথে পেরে উঠে না। তীর্থ চুমু খায় তার কাঁধে। তার কাঁধে নাক ঘেঁষে গভীর নিশ্বাস ফেলে বলে, “তোমার এই সুরভিকে আমি খুব মিস করেছি। তোমাকেও। তোমার কাছে মদের নেশাও তুচ্ছ।”
ঘৃণা লাগে কবিতা। তীর্থের প্রতিটি স্পর্শে তার শরীর ঘিনঘিন করে উঠছে। তার বলা কথাগুলো আরও বাজে লাগতে শুরু করে তার। সে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টায় অনুভব করে তীর্থ তার পোশাকের নিচে হাত দিচ্ছি। তার পেটের কাছে হাত নিতেই কবিতা আরও বেশি নড়াচড়া করতে শুরু করে। বারবার ছাড়তে বলে তীর্থকে। তীর্থ তাকে ছাড়ে না। উল্টো বলে, “সুইটহার্ট এত নড়াচড়া করছ কেন? এমন তো না যে আমি তোমাকে এই প্রথমবার স্পর্শ করছি। আমি তোমাকে অসংখ্যকবার ছুঁয়েছি। তোমার মনে আছে আমার স্পর্শে কেমন দিশেহারা হয়ে যেতে তুমি। লজ্জায় মেখে যেতে। কী সুন্দর দেখাতো তোমার লজ্জামাখা মুখখানি।”
“এখন তোমার স্পর্শে আমার ঘৃণা ছাড়া কোনো অনুভূতি হয় না। তোমায় দেখলে, তোমার কন্ঠ শুনলে, তুমি ছুঁলে আমার কেবল ঘৃণা হয়। কেবল ঘৃণা।”
কথাটুকু শেষ হতে না হতেই তীর্থ তার হাতের জ্বলন্ত সিগারেট তার উন্মুক্ত পেটে লাগিয়ে দিলো। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে সে। চিৎকার করে উঠে। তার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে।
তীর্থ আবারও তার কানের কাছে মুখ এনে রাগান্বিত স্বরে বলে, “তাহলে কার স্পর্শ ভালো লাগে? সে কথনের? যার সাথে আমাকে ছেড়ে যাবার পরদিন তুমি ঘুরে বেড়াচ্ছিলে?”
চলবে…
[