মৃত কাঠগোলাপ পর্ব -৩৩+৩৪

#মৃত_কাঠগোলাপ – ৩৩
লেখিকা-#আভা_ইসলাম_রাত্রি
_________________________________
‘ লাগেজ প্যাক করো। আমরা প্যারিস যাচ্ছি। ‘
ভোরের আলো ফুটতে এখনও বেশ দেরি। সারারাত কেঁদে মাত্রই ঘুমিয়েছে আয়েশী। আয়েশীর চোখে এখন প্রচুর ঘুম লেগে আছে। আয়েশী চোখ পিটপিট করে চাইল। ধ্রুব আয়েশীর দিকে ঝুঁকে। মুখ ভয়ংকর গম্ভীর! আয়েশীকে জেগে উঠতে দেখে ধ্রুব সরে গেল। আয়েশী কিছুক্ষণ থেমে বলল,
‘ এখন যাব, এত সকালে? ‘
‘ হ্যাঁ।’
ধ্রুব হেঁটে আলমারি থেকে জরুরি নথিপত্র বের করছে। আয়েশী ধ্রুবকে লক্ষ্য করল। সম্পূর্ণ তৈরি ধ্রুব। এবারেও ধ্রুব সাদা রঙের টিশার্ট পড়েছে। ধ্রুবর কি সাদা রঙ খুব পছন্দ? আয়েশী যখন দেখে ধ্রুব আপাদমস্তক সাদায় আচ্ছাদিত! সাদা রং ধ্রুবর উজ্জ্বল চেহারায় ফুটে উঠে বেশ! সাদা পরিহিত অবস্থায় ভীষন সুন্দর দেখায় ধ্রুবকে। আয়েশী যদি মৃদুলকে ভালো না বাসতো তবে ধ্রুবর এই সুন্দর চেহারা দেখে ঘৃনা করতে পারত না।
ধ্রুব একটি বিশাল আকারের নথি হাতে নিয়ে বিছানায় বসল। ভ্রু কুঁচকে নথির পৃষ্ঠা উল্টে পাল্টে দেখছে। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটের এক অংশ কামড়ে ধরে কিছু চিন্তা করছে।
আয়েশী হামি দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। এলোমেলো চুল হাতখোঁপা করে কাঁটা দিয়ে আটকে বিছানা ছেড়ে নামল। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে লাগেজ গোছাতে শুরু করল। মন খারাপ করছে আয়েশীর। মৃদুলের স্মৃতি থেকে পালাতে শহর ছাড়ছে। তবে পারবে কি মৃদুলের স্মৃতি মন থেকে চিরতরে মুছে ফেলতে। কিংবা মৃদুলের প্রতি ঘৃণার অনুভব থেকে মুক্ত হতে? পারবে কি? আয়েশী জানে না। তবুও আশা করছে। মানুষ আশার উপর বাঁচে, আশা আছে বলেই মানুষ জীবনের প্রতিটা মুহূর্তকে উপভোগ করে।
আয়েশী আলমারি থেকে কাপড় বের করছে। হঠাৎ চোখ পড়ল আলমারির ড্রয়ারে রাখা মৃদুল এবং আয়েশীর একটি সুন্দর ফটোফ্রেমের দিকে। আয়েশী কিয়ৎক্ষণ চেয়ে রইল ফটোটির পানে। আয়েশীর চোখ ভরে আসছে। আবার মন খারাপ করছে। আয়েশী হাত দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিল ছবিটিকে। অতঃপর কিছু একটা মনে পড়ায় ফটোটি নিয়ে লাগেজে পুড়ে নিল। ধ্রুব দেখল। তবে কিছু বলল না। নথিপত্র দেখতে মন দিয়ে বলল,
‘ শীতের কাপড় নিও। ‘
আয়েশী মন ভার করে বাকি কাপড় ব্যাগে পুড়ল।
ধ্রুবর কাজ শেষ হলে সে প্রয়োজনীয় নথিপত্র ব্যাগে পুড়ে আয়েশীর কাছে এল। আয়েশী কাপড় ভাঁজ করছে। ধ্রুব লাগেজের সামনে থেকে আয়েশীকে সরিয়ে লাগেজ খুঁজে মৃদুলের ছবির ফ্রেমটি বের করে মাটিতে শক্ত করে ছুঁড়ে ফেলল। কাঁচের ফ্রেমটি মাটিতে পড়ে কয়েক টুকরোয় বিভাজিত হল। সুন্দর ছবিটি সম্পূর্ণ নষ্ট হল। মৃদুলের মুখশ্রী ভাঙা কাঁচের আড়ালে ঢাকা পড়ল। আয়েশী হতভম্ব হল। মুখে হাত চেপে ফ্যালফ্যাল চোখে চাইল ভাঙা ছবির দিকে। চোখে জল এসে গেল তার। প্রিয় মানুষের স্মৃতি নিজের সামনে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে থাকতে দেখে রাগে মাথার নিউরন কেঁপে উঠল। আয়েশী ধ্রুবর দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে বলল,
‘ এটা কি করলেন আপনি? আমাদের ছবি ভেঙে ফেললেন কোন সাহসে? ‘
ধ্রুব নির্বিকার। মৃদু রেগে আয়েশী কোমড় চেপে নিজের দিকে টেনে নিল। আয়েশী রাগে তখন কাঁপছে। ভুলে গেছে মৃদুলের দেওয়া শত আঘাতের স্মৃতি। শুধু মনে রয়ে গেছে মৃদুলের দেওয়া প্রণয়ের সুন্দর মুহূর্তসমূহ। আয়েশী ধ্রুবর বুকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিল ছাড়া পাওয়ার জন্য। পারল না। ধ্রুব আয়েশীর কপালের চুল কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলল,
‘ আজ থেকে মৃদুল কে তা ভুলে যাও। আজ থেকে আমাদের অর্থ শুধু আমি-তুমি! ঘৃণার শহর থেকে পালাতে চাইছ, অথচ ঘৃণার স্মৃতি বয়ে নিয়ে যাচ্ছ দূর দেশে। এমন করলে হবে? মৃদুলকে ভুলতে চাইলে তার সকল স্মৃতিকে এভাবেই ভেঙে টুকরো টুকরো করতে হবে। বুঝেছ? ‘

আয়েশী মাথা নিচু করে নিল। সত্যি তো! যাকে ঘৃনা করে নিজের দেশ থেকে পালাচ্ছে, তার স্মৃতি এখনও বইছে কেন সে? আয়েশী মৃদু স্বরে বলল, ‘ আমার ছাড়ুন। ‘
ধ্রুব ভ্রু বাঁকিয়ে ছেড়ে দিল। মূলত দেখতে চাইছে, ধ্রুবর দেওয়া টোপে কাজ করেছে কিনা। আয়েশী মাটিতে ধপ করে বসে পড়ল। মৃদুলের ছবির উপর থেকে ওড়না দিয়ে কাঁচের টুকরো সরাল। অতঃপর মৃদুলের ছবি হাতে নিয়ে এক টানে ছবিটিকে ছিঁড়ে দু টুকরো করে ফেলল। অতঃপর তিন টুকরো, চার টুকরো, দশ টুকরো, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর।
আয়েশী ছবির টুকরো-গুলোকে বুকের সাথে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। মৃদুলের স্মৃতি মুছে ফেলা আয়েশীর কাছে ততটা সহজ না। আয়েশী পারবে না। পারছে না! মৃদুল আয়েশীর শিরা-উপশিরার সাথে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে গেছে। আয়েশী চাইলেও সেই স্মৃতি মুছে ফেলতে পারছে না।
ধ্রুবর রাগ হচ্ছে ভীষন। তবে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল। আয়েশীর পাশে বসে আলতো করে আয়েশীর চুলে হাত বুলিয়ে বলল, ‘ শান্ত হও, আয়েশী। ‘
আয়েশী শুনল না। ঝাঁপিয়ে পড়ল ধ্রুবর বুকের উপর। আচমকা আক্রমণে ধ্রুব পেছনে পড়ে যেতে যেতে সামলে নিল। স্তব্ধ চোখে চোখ নিচু করে আয়েশীর দিকে চাইল। আয়েশী ধ্রুবর বুকের শার্ট দুই আঙ্গুল দিয়ে খামচে ধরে উন্মাদের মত কাঁদছে। বারবার বলছে,
‘ আমি পারবো না। যাকে এতটা বছর নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসেছি, তাকে ঘৃনা করতে পারবো না আমি। মরে যাব আমি। ম’রে যাব। ‘
আবার মৃদুল! আয়েশী তার’ই বুকের উপর পড়ে অন্য কাউকে ভালোবেসে চোখের জল ফেলছে, ভাবতেই ধ্রুবর র’ক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে। ধ্রুব চোখ বুজে রাগকে সামলে নিয়ে আয়েশীর দুই গাল নিজের মুঠোয় পুড়ে নিয়ে আয়েশীর মুখ নিজের দিকে উচুঁ করল। নরম কণ্ঠে বলল, ‘ এই আয়েশী, তাকাও আমার দিকে। ‘
আয়েশী কান্না থামিয়ে ধ্রুবর দিকে তাকাল। ধ্রুব বলল,
‘ যে তোমার ভালোবাসাকে অগ্রাহ্য করে অন্য কাউকে ভালোবেসে সুখী ছিল, তার জন্যে তুমি তোমার চোখের জল ফেলতে চাও? এত সস্তা তোমার চোখের জল? সে তোমাকে কখনোই ভালোবাসেনি, তাই তাকে ভালোবেসে কষ্ট পাওয়া উচিৎ না। তার ভালোবাসাকে গলা টিপে মেরে ফেল। কবর দিয়ে দাও এই মৃত অনুভূতিগুলোকে। আমি জানি তুমি পারবে? কি, পারবে না? ‘

আয়েশী মাথা নাড়ল। যার অর্থ পারবে সে।
ধ্রুব হাসল। তার বাঁকা হাসি আয়েশী দেখল না। দেখলে হয়তো বুঝতে পারত, ও হাসি হাসি নয়! বরং কাউকে পরাস্ত করে নোংরা বিজয়ের হাসি!
___________________________
আকাশের ভেসে বেড়াচ্ছে শুভ্র রঙের অজস্র মেঘেরা। প্লেন মেঘেদের বুক চিঁড়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আয়েশী জানলার পাশে বসেছে। জানালার পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আয়েশী। চারপাশে শুভ্র রং ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। চোখের মণি ঝাপসা হচ্ছে সাদার মায়ায়। আয়েশী জানালায় হাত রাখল। ধ্রুব বলেছে জানালা খোলা যাবে না। তাই সে জানালার কাঁচে হাত রেখে অদূরের মেঘ গুলো ছুঁতে চাইল। কাঁচও কি ঠান্ডা! মনে হচ্ছে আয়েশী সত্যি সত্যিই মেঘ ছুঁতে পেরেছে।
‘ কিছু খাবে? ‘
ধ্রুব পাশ থেকে প্রশ্ন করল। আয়েশী আনমনে বলে ফেলল,
‘ হ্যাঁ, মেঘ খাব!’
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে ফেলে। বিরক্ত হয়ে বলে,
‘ মেঘ খাওয়া যায়? ‘
আয়েশীর মন খুব ভালো লাগছে। মেঘের সাদা যেন আয়েশীর ভেতরের সকল মন খারাপ রাক্ষসের ন্যায় শুষে নিয়েছে। আয়েশী উচ্ছ্বাসের সহিত বলল,
‘ মেঘ খেতে পারলে অনেক ভালো লাগত। মুখে দিলেই হাওয়াই মিঠাইর ন্যায় মিলিয়ে যেত। ইশ, মেঘ যদি খাওয়া যেত! ‘
ধ্রুব আয়েশীর কথা শুনে ফুস করে এক নিঃশ্বাস ফেলল। মেয়েটা বোধহয় জীবনের প্রথম প্লেনে উঠেছে। তাই যা দেখছে তাই সুন্দর লাগছে। এটাই স্বাভাবিক! আকাশ দেখতে সবার ভালো লাগে। আর যদি সে আকাশ অতি সামান্য দূর থেকে দেখা যায়, তবে আমাদের মন ভালো হয়ে যায়, আমরা আকাশের সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে বাচ্চা হয়ে যাই। আয়েশীও তেমন!
ধ্রুব এয়ারহোস্টেজকে দুটি স্যান্ডউইচ এবং দুটো ক্যান দিতে বলে আবার আয়েশীর দিকে চাইল। আয়েশী বাচ্চার ন্যায় আচরণ করছে। হাত বাড়িয়ে মেঘকে ছুঁতে চাইছে। পারছে না, তাই মন খারাপ করে মুখ ফুলাচ্ছে। আবার ছুঁতে চাইছে, আবার মন খারাপ করছে। ধ্রুবর আয়েশীর আচরণ দেখে হাসি পেল। মৃদু হেসে সে সেলফোন বের করে আয়েশীর সুখী মুহূর্তকে ক্যামেরাবন্দি করে নিল। ছবিটা সুন্দর এসেছে।
‘ স্যান্ডউইচ খাবে? ‘
আয়েশী তাকাল। স্যান্ডউইচ দেখে তার পেটের মধ্যে এতক্ষণ জমে থাকা ক্ষুধা যেন লাফিয়ে উঠল। আয়েশী ধ্রুবর থেকে স্যান্ডউইচ নিয়ে তাতে কামড় বসাল। ধ্রুব প্রশ্ন করল, ‘ ভালো লাগছে? ‘
আয়েশী মাথা নাড়ল। অর্থাৎ ভালো লাগছে তার। ধ্রুব স্বস্থির নিঃশ্বাস ছাড়ল। যাক, আয়েশীর মন ধীরে ধীরে ভালো হচ্ছে। এটাই মুক্ষোম সুযোগ! এই সফরেই আয়েশীর মন থেকে মৃদুলের স্মৃতি আজীবনের জন্য মুছে ফেলবে ধ্রুব! ধ্রুব মৃদু হাসল। আয়েশী স্যান্ডউইচ খেতে খেতে জানালার দিকে চাইল। আকাশের মেঘ কেটে যাচ্ছে। আয়েশীদের প্লেন ধীরে ধীরে প্যারিসের ভূমিতে নামছে।
#মৃত_কাঠগোলাপ -৩৪
লেখনীতে- #আভা_ইসলাম_রাত্রি
_________________________________
প্যারিসে সেদিন ভীষন ঠান্ডা! গা জমে বরফ হয়ে যাওয়ার মত কনকনে শীতে আয়েশীর অবস্থা করুন! আয়েশী দুহাতে কাঁধের অংশ ঢেকে শীতে কাঁপতে লাগল। দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে ‘ ঠকঠক’ শব্দে আয়েশী নিজে প্রচন্ড বিরক্ত! ধ্রুব পাসপোর্টের ঝামেলা মেটাচ্ছে। আয়েশীকে কাঁপতে দেখে ধ্রুব ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজের গায়ের জ্যাকেট খুলে আয়েশীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ এত পাতলা সুয়েটার এনেছ কেন? বলেছিলাম না, এখানে ঠান্ডা বেশি। ‘
শীতে আয়েশীর গলা জমে যাচ্ছে। কথা বলতে পারছে না। অন্যথায় আয়েশী ধ্রুবকে কতক কটু কথা শুনিয়ে নিত। আয়েশীর রাগ হল। ধ্রুবর জ্যাকেট ফিরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ ল-লা-গ-গবে না। ‘
ধ্রুব কিছু বলল না। চুপচাপ জ্যাকেট আবার গায়ে দিয়ে পাসপোর্ট দেখতে লাগল। আয়েশী মুখ বাঁকাল। জ্যাকেট দিয়ে আবার ফিরিয়ে নিল। খা’রাপ লোক!
ধ্রুব পাসপোর্টের ঝামেলা মিটিয়ে আয়েশীর কাঁধ ধরে হাঁটতে লাগল। এখন হোটেলে উঠবে তারা। ধ্রুবর স্পর্শে আয়েশীর ভীষন অস্বস্তি হল। হাসফাঁস করে উঠল সর্বাঙ্গ! ধ্রুব জানে, আয়েশীর ধ্রুবর এমন স্পর্শ পছন্দ নয়। তবুও সে ক্ষণে ক্ষণে আয়েশীকে নানাভাবে স্পর্শ করবে। কবে শুধরাবে এই খা’রাপ লোক? আয়েশী কাঁধ সংকোচিত করে নিভু কণ্ঠে বলল, ‘ ছাড়ুন। ‘
ধ্রুব যেন শুনেও শুনল না। ওসমানকে লাগেজ আনতে বলে সামনে এগিয়ে গেল। ওসমান পিছু পিছু হেটে আয়েশী ও ধ্রুবর কাণ্ড দেখছে। আয়েশীর ছটফট করা, ধ্রুবর শীতল কণ্ঠের রাগ, চোখ রাঙানি দেখে ওসমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করল, ‘ এত ভালো মেয়েটা শেষে কিনা এই হিংস্র মানুষের জালে ফেঁসে গেল। হায়রে নিয়তি! ‘

‘ হ্যালো ইয়াং ম্যান! ‘
ধ্রুবকে দেখে একজন ফরাসি লোক দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন। আচমকা আক্রমণে ধ্রুব কিছুটা হতভম্ব হল। লোকটা ধ্রুবকে ছেড়ে দিয়ে ফরাসি ভাষায় কিছু একটা বলল। ধ্রুব এবার একটু হাসল। হয়ত চিনতে পেরেছে ফরাসি লোককে। ধ্রুব ফরাসি ভাষায় লোকটার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলল। আয়েশী ফ্যালফ্যাল চোখে তাদের দুজনের কথা শুনে গেল। তাদের কথোপকথনের কিছুই আয়েশীর বোধগম্য হল না। ধ্রুব একসময় আয়েশীর কাঁধে হাত রেখে ফরাসি লোককে কিছু বলল। আয়েশী বুঝতে পারল, ধ্রুব লোককে আয়েশীর সাথে পরিচয় করাচ্ছে। আয়েশী মৃদু হেসে ‘ হ্যালো’ বলল। ফরাসি লোক আয়েশীর সাথে বকবক করে কিছুক্ষণ ফরাসি ভাষায় কথা বলল। আয়েশীর কান ভনভন করতে লাগল ফরাসি ভাষা শুনে। লোকটার বলা একটা কথাও আয়েশী বুঝতে পারল না। শুধু বোকার মত চেয়ে রইল। ধ্রুব সেটা বুঝতে পারল। লোকটার কাঁধে হাত রেখে শুধরে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
‘ ম্যান, শি ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড ফ্রেঞ্চ ল্যাঙ্গুয়েজ। ‘
লোকটার মুখ চুপসে গেল। এতক্ষণ তাহলে সে অযথাই বকবক করে গেল। কতগুল কথা জলে ভেসে গেল। লোকটার বোধহয় আফসোস হল একটু। লোকটা আয়েশীকে ক্ষীণ কণ্ঠে সরি বলে ধ্রুবর সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে চলে গেল। লোকটা চলে গেলে ধ্রুব ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছেড়ে বিরক্তি নিয়ে বলে, ‘ কোথা থেকে আসে এসব পাগল! রাবিশ! ‘
আয়েশী অবাক হল। লোকটার সাথে যখন কথা বলছিল ধ্রুবকে একটুও বিরক্ত দেখাচ্ছিল না, অথচ এখন বলছে সে বিরক্ত হয়েছে। ধ্রুব কিন্তু দারুণ অভিনয় করতে পারে!
আয়েশী প্রশ্ন করল,
‘ আপনি ফ্রেঞ্চ জানেন? ‘
ধ্রুব গাড়িতে উঠে আয়েশীর পাশে বসল। চোখের সানগ্লাস খুলে শার্টে ঝুলিয়ে বলল,’ হ্যাঁ। ‘
‘ আপনি মোট কয়টা ভাষা জানেন? ‘
ধ্রুব ভ্রুতে ভাজ ফেলে কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর বলল,
‘ আনুমানিক পঁচিশটা। ‘
আয়েশী ভীষন বিস্মিত হল। এতটা ভাষা জানে সে? সে মানুষ নাকি রোবট? আয়েশী বাংলা, ইংরেজি ছাড়া আর কোনো ভাষা জানে না। আর সে পঁচিশটা ভাষা কি সুন্দর বুঝে। আয়েশী নিজের কোমড়ে শীতল হাতের স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠল খানিক। চকিতে নিজের কোমড়ের দিকে চেয়ে দেখল। ধ্রুব আয়েশীর কোমড়ে হাত রেখে এক হাতে ফোন দেখছে। আয়েশী হাফ ছাড়ল। এমনিতে শীতে মরে যাচ্ছে, তারমধ্যে ধ্রুবর ঠান্ডা হাত আয়েশীর সারা গায়ে যেন জ্বর তুলে দিচ্ছে। আয়েশী জোরপূর্বক ধ্রুবর হাত নিজের কোমড় থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। পারল না। এবার দু হাত ব্যবহার করল। তবুও পারল না। আয়েশী রাগ হল। হাত না দানব! এত জোর তার হাতে? নিজের কাজে বিঘ্ন ঘটায় ধ্রুব বিরক্ত নিয়ে তাকাল। ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘ কি হয়েছে? এত নড়ছ কেন? ‘
আয়েশী তেতো কণ্ঠে বলল, ‘ হাত সরান। আমার শীত লাগছে। ‘
ধ্রুবর ঠোঁট হেসে উঠল। বাঁকা হাসিতে মুহূর্তেই ধ্রুবর সম্পূর্ণ মুখে ছড়িয়ে গেল। আয়েশী জানে, এ হাসি কেমন? একদম দুষ্টু, খারাপ হাসি। আয়েশী ভ্রু কুঁচকে চাইল ধ্রুবর দিকে। এখন নিশ্চয়ই ধ্রুব কয়েকটা বেফাঁস কথা বলে আয়েশীর কান জ্বালা করে দিবে। আয়েশী অস্বস্থিতে ভুগতে দেখে তার ভালো লাগে কি না!
ধ্রুব তাই করল। ধ্রুব আয়েশীর কানের কাছে ঠোঁট এনে মৃদু স্বরে বলল, ‘ ডোন্ট ওয়ারি! আমি আছি না? ছুঁয়ে-ছুঁয়ে একদম গরম করে দেব। ‘
আয়েশী থতমত খেয়ে গেল। পেটের ভেতর গুড়ুম গুড়ুম করে উঠল। কান থেকে আগুন বের হওয়ার মত বোধ হল। হাঁসফাঁস করে ধ্রুবর দিকে রাগী নয়নে চাইল। অতঃপর ধ্রুবকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে নিল। ধ্রুব হাসছে। আয়েশী রেগে বলল, ‘ মুখ সামলে কথা বলুন। ‘
ধ্রুব হেসে আয়েশীর নিজের দিকে টেনে নিল। আয়েশী ছুটার জন্যে ছটফট করে। ধ্রুব বলে, ‘ অনেক সামলে থেকেছি। আর না! প্রেমের শহরে এসেছি আমরা। তাই সামলে থাকার দিন শেষ। এখন যা হবে, সব নির্লজ্জ, বেসামাল! রক্তজবা, এবার থেকে তো তোমাকে আমি লজ্জা দিয়েই মেরে ফেলব! হা হা হা! ‘
আয়েশী হতভম্ব হয়ে পড়ল। ছিঃ, কথার কি ছিরি! মৃদুল আয়েশীর প্রেমিক হওয়া সত্ত্বেও এত অসভ্য কথা বলত না। কিন্তু এই ধ্রুব? অসভ্যতার সকল সীমা পেরিয়ে গেছে। আয়েশী রাগে ধ্রুবর গলায় নখ দিয়ে খামচে ধরল। ধ্রুব ব্যথা পেল। অথচ মুখে কোনোরূপ আর্তনাদ করল না। বরং বলল, ‘ তোমার ছোঁয়া আমাকে উন্মাদ করে দেয়, রক্তজবা! হোক না সেটা কোনো ব্যাথাতুর আঘাত! ‘
আয়েশী হার মানল। ধ্রুবকে পরাস্ত করা আয়েশীর কাছে অসম্ভব ঠেকেছে। ধ্রুব সকলকে যেমন ব্যথায় ঝাঁজরা করে ফেলতে পারে, তেমন নিজেও সহস্র ধারালো ব্যথা মুখ বুজে সহ্য করতে পারে। আয়েশী অবাক হয়। এমন লোকও হয় বুঝি?

অতঃপর সম্পূর্ণ পথ ধ্রুব আয়েশীকে তার নির্লজ্জ্ব কথা দ্বারা জ্বালিয়ে গেল। হোটেলের সামনে যখন গাড়ি থামল, আয়েশী ঝটপট গাড়ি থেকে নেমে হাফ ছাড়ল। তার কান এখনও ধপধপ করছে। গাল লাল হয়ে গেছে। মাথা ভনভন করছে। ধ্রুব আয়েশীর এহেন করুন অবস্থা দেখে মৃদু হাসল। তার লজ্জাবতী লতিকা!
হোটেলের সবচেয়ে ব্যয়বহুল কক্ষ ধ্রুব নিজেদের জন্য বুক করল। আয়েশী-ধ্রুব ক্লান্ত পায়ে কক্ষে প্রবেশ করল। কক্ষটা পর্যবেক্ষণ করে আয়েশীর চোখ কপালে উঠল। কক্ষটা হানিমুনে আসা কাপলদের জন্যে সাজানো হয়েছে। বিছানা ভালোবাসার আকারের, চারদিকে গোলাপের পাঁপড়ি ছড়ানো, মোমবাতির আলো জ্বলজ্বল করে চারদিকে আলো ছড়াচ্ছে। আয়েশী এসব সাজ দেখে রেগেমেগে আগুন হল। ধ্রুবর দিকে চেয়ে বলল, ‘ এসব কি কক্ষ নিয়েছেন? ‘
ধ্রুব হাতঘড়ি খুলে টেবিলে রাখল। হিটারের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিল। জ্যাকেট খুলে বলল, ‘হানিমুনের! ‘
‘ হানিমুন? আমরা কি হানিমুনে এসেছি? ‘
‘ হ্যাঁ! ‘
‘ মানে? দেখুন আমার এসব সাজ অসহ্য লাগছে। শীঘ্রই কক্ষ বদলান। নাহলে আমি এই কক্ষে থাকব না। ‘
‘ থেকো না। বেরিয়ে যেতে চাইলে বেরিয়ে যাও। ‘
আয়েশী হতভম্ব হল। ধ্রুব তাকে বেরিয়ে যেতে বলেছে? হ্যাঁ, বলবেই তো। হাতি কাদায় পড়লে চামচিকাও লা’থি মারে। আয়েশী এই শহরের কিছু চেনে না, আয়েশী বেরিয়ে যেতে চাইলে বেরিয়ে যেতে পারবে না। হারিয়ে যাবে এই বিশাল শহরের ভিড়ে! ধ্রুব এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে। আয়েশী পা দিয়ে মাটিতে লা’থি দিল। তারপর হনহনিয়ে বাথরুমে চলে গেল। ধ্রুব পেছনে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসল। আয়েশীকে রাগতে দেখে ধ্রুবর ভীষন ভালো লাগে। আয়েশী রাগলে, মুখ রক্তিম হয়ে যায়। নাকের ডগা কাঁপে। ধ্রুবর তখন ইচ্ছে হয়, আয়েশীর নাক কামড়ে লাল করে দিতে। আয়েশীর ঠোঁট স্পর্শ করতে। আফসোস, ধ্রুব এখন তার শেষ অদম্য ইচ্ছা পূরণ করতে পারছে না। তবে পারবে। একদিন পারবে! ধ্রুব সেদিন আয়েশীকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিবে। আয়েশীর সাথে কিছু সুন্দর মুহূর্ত কাটাবে। সেদিন হবে ধ্রুবর জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন! সে দিন আসবে! খুব শীগ্রই আসবে!

#চলবে ( শব্দসংখ্যা – ১১০০+ )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here