মেঘদিঘির পাড়ে – ১০
মালিহা খান
১৯.
সায়ন চলে গেলো। বরফের ন্যায় ঠান্ডা শরীর নিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে, দু’হাতে বুক চেপে, ঘনঘন নি:শ্বাস নিয়ে দাড়িয়ে রইলো ইভা। এই কয়েকমূহুর্তের সাক্ষাত, ধারালো শাসন, নামমাত্র দুরত্ব আর ফিসফিসানি বাক্যে, নিরবে সমস্ত উথালপাথাল হয়ে গেলো। খানিকবাদে হতভম্বতা কাটিয়ে মৃদুপায়ে বিছানায় যেয়ে বসলো সে। চোখ বুজে, চাদর খামছে ধরে রইলো। মাথায় ভর করলো অর্থহীন সহস্র দুশ্চিন্তা। ঘুম এলোনা চোখের পাতায়। ভাবনাচ্ছেদ ঘটলো বাহাদুরের অস্পষ্ট ডাকে,”বুবু? আ্যাই বুবু? অন্ধকারে কই গেলে তুমি?”
ইভার ধ্যান ভাঙলো। নরম গলায় ‘এইতো, এইতো’ বলতে বলতে দ্রুত বাহাদুরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো সে।
২০.
দু’দিকে আলমারির পাল্লা মেলে ঝুলিয়ে রাখা পান্জাবির সারিতে হাত বাড়ালো তন্দ্রা। হ্যাঙ্গার সরিয়ে সরিয়ে বেশ মন দিয়ে দেখে মাঝ থেকে একটা নামিয়ে হাতে নিলো। পান্জাবির বুকের সুতোর কাজে এলোমেলো হাত বুলালো কতক্ষণ। মনটা খারাপ হয়ে আছে তার। ঠোঁটে হাসি নেই।
ঘরের নিরবতা কাটলো দরজা খেলার শব্দে। তন্দ্রা ঘাড় ফিরালো। সরফরাজের গায়ে স্যান্ডোগেন্জি। বাবার কাছে গিয়েছিলো কি কথা বলতে!
সরফরাজ ঢুকলো হনহন করে। হাতের কাগজগুলো বিছানায় রেখে ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
-বের করেছো তনু?”
তন্দ্রা মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে কাপড় বের করে না দিলে সরফরাজ পরেনা। আলমারি বন্ধ করে পেছনে ফিরে পান্জাবিটা এগিয়ে বললো,
-“এইযে, এটা পরুন।”
সরফরাজ ভ্রু কুঁচকালো। পান্জাবিটা তাড়াতাড়ি গায়ে চড়িয়ে বোতাম আটকাতে আটকাতে বললো,
-“মন খারাপ কেনো?”
তন্দ্রা একবার চাইলো। ধীরগতিতে দু”পাশে মাথা নাড়িয়ে বিছানায় বসলো।
সরফরাজ মলিন হাসে। তন্দ্রার নিচু করে রাখা গালটায় আহ্লাদ করে হাত রাখে। হাঁটুতে একহাত রেখে মুখ বরাবর ঝুঁকে বলে,
-“মন খারাপ করোনা তন্দ্রাবতী।”
তন্দ্রা মাথাটা আরো নামিয়ে নেয়। সরফরাজ নিচু স্বরে ডাকে,”তন্দ্রাবতী?”
তন্দ্রা ঠোঁট কাঁমড়ে ধরে। হঠাৎই ভরা চোখে চেয়ে বলে,
-“আপনি যেয়েন না।”
তার টলমলে আবদারে পরিপূর্ণ চাহনীতে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেলো সরফরাজ। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল,
-“এমন আবদার কেনো করো পাগলি? কাজ আছে তো।”
২১.
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো। নীল নীলিমায় কালোর আবরণ পড়লো। সারাবিকেলেও ঘরের দরজা খুললোনা ইভা। ছিঁটকিনি তুলে কাঁথামুড়িয়ে শুয়ে রইলো। বাহাদুর এসময় ঘরে থাকেনা। তাকে বিকেলে ঘুম পাড়ানো যায়না কখনো। খেলাধুলা করে, নয়তো বিভার কাছে পড়তে যায়। জাহানারা কিজন্য যেনো ডাকতে এসেছিলেন। ইভা জেগে থেকেও জবাব দেয়নি। মনে হচ্ছিলো, উনি নিশ্চিত দিঘির পাড়ে অপেক্ষা করছেন, বারান্দায় গেলেই দেখে ফেলবেন। ইভা ঘুমিয়ে আছে ভেবে জাহানারাও বারদুয়েক ডেকেই চলে গিয়েছেন।
ইভা চুপচাপ শুয়ে রইলো। বদ্ধ ঘরে। দুরুদুরু মনে।
তার কোনোকালেই এত সাহস হয়নি। এক অচেনা পুরুষ বললেই সে একা একা চলে যাবে। তার এতো সাহস নেই। কোনোকালেই ছিলোনা।
সন্ধ্যার পর আর শুয়ে থাকতে পারলোনা ইভা। উঠে বসলো। জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস টেনে নিজেকে সামলালো। ভয় পাওয়ার কি আছে?
দরজা খুললো কাঁপা কাঁপা হাতে। এদিক ওদিক চোখ না বুলিয়েই সোজা নেমে গেলো নিচে।
কেবলই মনে হলো এই বুঝি বারান্দার কোথাও দিয়ে সায়ন দেখে ফেললো তাকে। রক্তচোখে চেয়ে রইলো অপলক।
ইভা রান্নাঘরের দরজায় যেয়ে দাড়ায়। জমিলার মা চা বানাচ্ছে। ইভা মৃদুকন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
-“চাচি কোথায় খালা?”
জমিলার মা ফিরে তাকান। পান খাওয়া দাঁতগুলো বের করে হেসে বলেন,
-“হ্যায় তো বড় বউয়ের ঘরে গেলো।”
ইভা ‘ওহ’ বলে সরে আসে। জাহানারা কিজন্য ডাকতে এসেছিলেন জানা দরকার। তন্দ্রার ঘরে যেতে হলে আবার বারান্দা দিয়েই যেতে হবে। ইভার মন মিঁইয়ে আসে। চতুর্দিকে বারবার একটা কথাই ঘুরপাক খায়,
-“বিকেলে আপনাকে দিঘির পাড়ে না পেলে কাল সত্যি সত্যি অনর্থ হয়ে যাবে ইভা। মনে রেখেন।”
~চলবে~
[এত ছোট হবার জন্য সত্যি দু:খিত। খেলা দেখতে দেখতে লিখছিলাম। মাত্র যে এতোটুকু লিখেছি বুঝতেই পারিনি। কাল বিকেলেই এই পর্বের বর্ধিতাংশ দিয়ে দিব।]মেঘদিঘির পাড়ে – ১০
মালিহা খান
১৯.
সায়ন চলে গেলো। বরফের ন্যায় ঠান্ডা শরীর নিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে, দু’হাতে বুক চেপে, ঘনঘন নি:শ্বাস নিয়ে দাড়িয়ে রইলো ইভা। এই কয়েকমূহুর্তের সাক্ষাত, ধারালো শাসন, নামমাত্র দুরত্ব আর ফিসফিসানি বাক্যে, নিরবে সমস্ত উথালপাথাল হয়ে গেলো। খানিকবাদে হতভম্বতা কাটিয়ে মৃদুপায়ে বিছানায় যেয়ে বসলো সে। চোখ বুজে, চাদর খামছে ধরে রইলো। মাথায় ভর করলো অর্থহীন সহস্র দুশ্চিন্তা। ঘুম এলোনা চোখের পাতায়। ভাবনাচ্ছেদ ঘটলো বাহাদুরের অস্পষ্ট ডাকে,”বুবু? আ্যাই বুবু? অন্ধকারে কই গেলে তুমি?”
ইভার ধ্যান ভাঙলো। নরম গলায় ‘এইতো, এইতো’ বলতে বলতে দ্রুত বাহাদুরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো সে।
২০.
দু’দিকে আলমারির পাল্লা মেলে ঝুলিয়ে রাখা পান্জাবির সারিতে হাত বাড়ালো তন্দ্রা। হ্যাঙ্গার সরিয়ে সরিয়ে বেশ মন দিয়ে দেখে মাঝ থেকে একটা নামিয়ে হাতে নিলো। পান্জাবির বুকের সুতোর কাজে এলোমেলো হাত বুলালো কতক্ষণ। মনটা খারাপ হয়ে আছে তার। ঠোঁটে হাসি নেই।
ঘরের নিরবতা কাটলো দরজা খেলার শব্দে। তন্দ্রা ঘাড় ফিরালো। সরফরাজের গায়ে স্যান্ডোগেন্জি। বাবার কাছে গিয়েছিলো কি কথা বলতে!
সরফরাজ ঢুকলো হনহন করে। হাতের কাগজগুলো বিছানায় রেখে ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
-বের করেছো তনু?”
তন্দ্রা মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে কাপড় বের করে না দিলে সরফরাজ পরেনা। আলমারি বন্ধ করে পেছনে ফিরে পান্জাবিটা এগিয়ে বললো,
-“এইযে, এটা পরুন।”
সরফরাজ ভ্রু কুঁচকালো। পান্জাবিটা তাড়াতাড়ি গায়ে চড়িয়ে বোতাম আটকাতে আটকাতে বললো,
-“মন খারাপ কেনো?”
তন্দ্রা একবার চাইলো। ধীরগতিতে দু”পাশে মাথা নাড়িয়ে বিছানায় বসলো।
সরফরাজ মলিন হাসে। তন্দ্রার নিচু করে রাখা গালটায় আহ্লাদ করে হাত রাখে। হাঁটুতে একহাত রেখে মুখ বরাবর ঝুঁকে বলে,
-“মন খারাপ করোনা তন্দ্রাবতী।”
তন্দ্রা মাথাটা আরো নামিয়ে নেয়। সরফরাজ নিচু স্বরে ডাকে,”তন্দ্রাবতী?”
তন্দ্রা ঠোঁট কাঁমড়ে ধরে। হঠাৎই ভরা চোখে চেয়ে বলে,
-“আপনি যেয়েন না।”
তার টলমলে আবদারে পরিপূর্ণ চাহনীতে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেলো সরফরাজ। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল,
-“এমন আবদার কেনো করো পাগলি? কাজ আছে তো।”
২১.
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো। নীল নীলিমায় কালোর আবরণ পড়লো। সারাবিকেলেও ঘরের দরজা খুললোনা ইভা। ছিঁটকিনি তুলে কাঁথামুড়িয়ে শুয়ে রইলো। বাহাদুর এসময় ঘরে থাকেনা। তাকে বিকেলে ঘুম পাড়ানো যায়না কখনো। খেলাধুলা করে, নয়তো বিভার কাছে পড়তে যায়। জাহানারা কিজন্য যেনো ডাকতে এসেছিলেন। ইভা জেগে থেকেও জবাব দেয়নি। মনে হচ্ছিলো, উনি নিশ্চিত দিঘির পাড়ে অপেক্ষা করছেন, বারান্দায় গেলেই দেখে ফেলবেন। ইভা ঘুমিয়ে আছে ভেবে জাহানারাও বারদুয়েক ডেকেই চলে গিয়েছেন।
ইভা চুপচাপ শুয়ে রইলো। বদ্ধ ঘরে। দুরুদুরু মনে।
তার কোনোকালেই এত সাহস হয়নি। এক অচেনা পুরুষ বললেই সে একা একা চলে যাবে। তার এতো সাহস নেই। কোনোকালেই ছিলোনা।
সন্ধ্যার পর আর শুয়ে থাকতে পারলোনা ইভা। উঠে বসলো। জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস টেনে নিজেকে সামলালো। ভয় পাওয়ার কি আছে?
দরজা খুললো কাঁপা কাঁপা হাতে। এদিক ওদিক চোখ না বুলিয়েই সোজা নেমে গেলো নিচে।
কেবলই মনে হলো এই বুঝি বারান্দার কোথাও দিয়ে সায়ন দেখে ফেললো তাকে। রক্তচোখে চেয়ে রইলো অপলক।
ইভা রান্নাঘরের দরজায় যেয়ে দাড়ায়। জমিলার মা চা বানাচ্ছে। ইভা মৃদুকন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
-“চাচি কোথায় খালা?”
জমিলার মা ফিরে তাকান। পান খাওয়া দাঁতগুলো বের করে হেসে বলেন,
-“হ্যায় তো বড় বউয়ের ঘরে গেলো।”
ইভা ‘ওহ’ বলে সরে আসে। জাহানারা কিজন্য ডাকতে এসেছিলেন জানা দরকার। তন্দ্রার ঘরে যেতে হলে আবার বারান্দা দিয়েই যেতে হবে। ইভার মন মিঁইয়ে আসে। চতুর্দিকে বারবার একটা কথাই ঘুরপাক খায়,
-“বিকেলে আপনাকে দিঘির পাড়ে না পেলে কাল সত্যি সত্যি অনর্থ হয়ে যাবে ইভা। মনে রেখেন।”
~চলবে~মেঘদিঘির পাড়ে – ১০
মালিহা খান
(বর্ধিতাংশ)
উপরের সিঁড়িতে উঠে কিছুক্ষণ চুপ করে দাড়িয়ে থাকে ইভা। অত:পর মাথা নিচু করে একপ্রকার দৌড়ের গতিতে হেঁটে বারান্দা অতিক্রম করে তন্দ্রার ঘরে ঢুকে। ধুম করে দরজা আটকায়। জাহানারা চমকে তাকান। তন্দ্রা অস্থিরচিত্তে চোখ বড় বড় করে বলে,
-“কি হয়েছে?”
ইভা অপ্রস্তুত বোধ করে। মুখে কথা খুঁজে পায়না। আমতা আমতা করে ফিকে হেসে বলে,
-“না, কিছুনা। ওই বাইরে একটা চামচিকা।”
তন্দ্রা ঠোঁট উল্টায়। মৃদু ধমক দেয়,”চামচিকা এতো ভয় পায় মানুষ? আয় বস।”
ঘড়ির কাঁটা ন’টা ছুঁইছুঁই। আকাশে চাঁদের সাক্ষাত নেই। অমাবস্যা নয়, মেঘের আড়ালে ঢাঁকা পড়েছে। দীর্ঘ গল্প শেষে তন্দ্রার ঘর থেকে বেরিয়ে ধীরপায়ে রেলিংয়ের কাছে গেলো ইভা। হাল্কা হলদে আলো জ্বালানো। আলো নিভালে গাঢ় অন্ধকার হয়ে যাবে এমন রাত হয়ে গেছে। তন্দ্রার ঘর থেকে আসার আগে ঘড়ি দেখে এসেছে। লোকটা নিশ্চয়ই এখনও দাড়িয়ে থাকবে না। ইভা একদৃষ্টিতে মেঘদিঘিতে তাকায়।
নাহ্, কেউ নেই অবশ্যই। ওখানেও অন্ধকার। এই অন্ধকারে কোনো পাগলও দাড়িয়ে থাকবে না। লোকটা নিশ্চয়ই পাগল না?
-“কি দেখিস?”
আচানক ডাকে ইভা ধরফর করে কেঁপে উঠে। এলোমেলো হয়ে পিছে ফিরে। বিভা কপাল কুঁচকায়,”ভয় পাচ্ছিস কেনো?” বলতে বলতে এগিয়ে গিয়ে ইভার পাশে যেয়ে দাড়ায়। রেলিংয়ে হাত রাখে।
ইভা হাঁফ ছাড়ে,
-“পিছন থেকে ডাকো কেনো? ভয় পাবো না?”
-“গাধী!” বিভা হাসলো। ইভা চট করে তাকালো তার রেলিংয়ে রাখা হাতের উপর। বিভার হাতে ব্যান্ডেজ।
ইভা এদিক ওদিক তাকায়, ফিসফিস করে বলে,
-“ইউসুফ ভাইয়ের সাথে তুমি এখনো রেগে আছো আপা?”
বিভা একপলক তাকালো। বলতে চাইলো,”উনার উপর আমার রাগ থাকেনা ইভা।” কিন্তু বললো না। মুখ ফিরিয়ে কৃষ্ণ আকাশের দিকে সোজাসাপ্টা উওর দিলো,”জানিনা।”
ইভা নিরব হয়ে যায়। বিভার মন খারাপ হলে সে বুঝতে পারে। তার নিজেরও মন খারাপ লাগে। হয়তো জমজ বলে। বিভা একধ্যানে আকাশে চেয়ে থাকে। বিষাদিনী দৃষ্টিতে হাসি খুঁজে বেড়ায়। কালো আকাশের সাদা মেঘেরা সরে সরে যায়। হাসি মেলেনা। মন আরো খারাপ হয়।
ইভা শান্ত হয়ে দাড়িয়ে থাকে পাশে। শান্তমন শান্ত থাকেনা বেশিক্ষণ। নিশ্চল দেহ আলোড়িত হতে সময় লাগেনা। ঘুটঘুটে অন্ধকার কাটিয়ে দিঘির পাড়ে গাড়ির হেডলাইটের তেজী আলো চোখে পড়তেই গা শিঁউরে উঠে। লোম দাড়িয়ে যায়। ইভা স্তব্দ হয়ে যায়। প্রণয়ের তীব্রতায় অন্তর কেঁপে উঠে।
২২.
ঘরে আলো জ্বালানো। সবুজ আলোর বদলে আজ নীল আলো। ইভার চোখে ঘুম নেই। ছোট বাল্বের নীলরঙা বাতিটা নতুন লাগানো হয়েছে। ইউসুফ লাগিয়ে দিয়ে গিয়েছে ঘুমানোর আগে। খাবার টেবিলে বাহাদুর ফট করে বলে দিয়েছে ঘরের বাতি নষ্ট। এ নিয়েও কি বিচ্ছিরি অবস্থা। সে মাঝপথেই খাবার রেখে বাহানা দিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে এলো। টেবিলের উপর দাড়িয়ে ভালো লাইটটা খুলে মেঝেতে উল্টোপাল্টা বারি মেরে নষ্ট করলো। কাঁচ ফাঁটা লাইটটা আবার টেবিলের উঠে লাগিয়ে দিলো। কাঁচগুলো এখনো টেবিলের ড্রয়ারে। ইউসুফ এসে লাইট দেখে কপাল কুঁচকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। বিরবির করে বললো,”একেবারে কাঁচ ফেঁটে গেলো রে?”
সব ওই লোকটার জন্য। এতো এতো ঝামেলায় তার এই জন্মে পড়তে হয়নি।
বাহাদুর বিভোর। সারা বিকেল দুরন্ত ছোটাছোটি করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে। পা ব্যাথা করছে নাকি। ইভা চোখ বুজলো। কিছুক্ষণ পর আবার মেললো। আবার বুজলো। ঘুমের সমস্যা তার কোনোদিন হয়নি।
-“ইভা? ঘুমাচ্ছেন আপনি! উঠুন। দরজা আটকান জলদি।” সায়ন ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে। ডানবাহুতে বামহাত চেপে মাথা নিচু করে রয়।
ইভা ধরফরিয়ে উঠে বসলো। সায়ন তার পায়ের কাছে বসা। এদিকে পিঠ। বিদ্যুতের গতিতে বিছানা ছেড়ে নেমে যায় ইভা। উনি কখন এলো? শব্দও তো পেলোনা। কাঁপা গলায় বলে,
-“আপনি…।”
সায়ন কথা শেষ করতে দেয়না তাকে। চাপা গলায় বলে,
-“দরজা আটকান, বাইরে আপনার ভাই।”
ইভার মাথা এলোমেলো হয়ে পড়ে। বাইরে ভাই? সরফরাজ ভাইজান? উনাকে দেখে ফেলেছে? নাহ্! দেখলেতো আর উনি ঘর অবধি আসতে পারতেন না।
দ্রুতপায়ে যেয়ে দরজার ছিটকিনি তুলে দেয় ইভা। শব্দ হয় হাল্কা। সায়ন তপ্ত শ্বাস ফেলে। একবার পিছে তাকিয়ে বাহাদুরকে দেখে। একটু সরে ইভার জায়গায় পিঠ এলিয়ে দেয়। বিমূঢ়তা আঁকড়ে ধরে ইভাকে। মৃদুপায়ে সায়নের কাছে যেয়ে আরো হতভম্ব হয়ে পড়ে সে। অফ হোয়াইট শার্টের বাহু রক্তে ভিজে চুপচুপে। ইভা আৎকে উঠে,
-“আপনি…আপনার হাত! হায় আল্লাহ!”
সায়ন চোখ মেলে। উঠে বসে। ধীরগলায় বলে,
-“আস্তে শব্দ করেন, ও উঠে যাবে।”
ইভা ধ্যান দেয়না। আলমারি খুলে আবছা আলোতে কোনোরকমে ওষুধের বাক্স বের করে ফিরে আসে। ইততস্ত কন্ঠে বলে,”আপনি এটা খুলেন। রক্ত পড়ছে।”
সায়ন চোখ মেলে। কয়েকবার পরপর পলক ফেলে স্পষ্ট করে তাকায়। আড়চোখে ওষুধের বাক্স দেখে। ঠান্ডা স্বরে বলে,”না ঠিকাছে, লাগবেনা।”
ইভা অনুনয় করে উঠে,
-“দয়া করে খুলুন। আপনি তাকাতেও পারছেন না ব্যাথায়।”
ইভার কথা ফেলতে পারেনা সায়ন। শার্ট খুলে পাশে রাখে। ঘচ করে কাঁচ ঢুকে আবার বেরিয়েছে। রক্তের চোটে সুবিধা করতে পারছেনা ইভা। তুলার পর তুলা ভিজে যাচ্ছে।
-“এভাবে কিকরে কাটলো? আপনি কেনো আসতে গেলেন?”
-“আপনার ভাই এতরাতে আপনাদের উঠোনে কি করছিলো ইভা? পাগল নাকি?”
ইভা রেগে যায়,
-“খবরদার ভাইজানকে নিয়ে উল্টোপাল্টা বলবেন না।”
সায়ন আবার বাহাদুরকে ইশারা করে,
-“আস্তে, ও উঠে যাবে। আপনার কাছেই ঘুমায় রোজ?”
ইভা মাথা নাড়ায়। নিচু গলায় বলে,
-“উঠবেনা, ও গভীর ঘুম। আমি জানি।”
সায়ন হাসে। তারপর হঠাৎই হাসি নিভিয়ে বলে,
-“আপনি আসলেন না কেনো ইভা?”
ইভা চুপ করে থাকে। রক্তেভেজা তুলা রেখে নতুন পরিষ্কার তুলা নেয়। স্যাভলন দিয়ে ভিজিয়ে ক্ষত জায়গায় ছুঁইয়ে মিনমিন করে বলে,
-“আমি ‘আসব’ বলিনি।”
-“আমি আসতে বলেছিলাম।”
ইভার হাত থেমে যায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
-“আপনি কোন অধিকারে আমাকে যেতে বলেছেন? আমি কেনো যাবো?”
সায়ন বিস্মিত চোখে চেয়ে থাকে। মুখ থমথমে। প্রত্যুওর করেনা।
ইভা হঠাৎই ফুঁপিয়ে উঠে। ফোঁপানো ফোঁপাতেই বলে,”কি করেছেন জায়গাটা!” তার চোখে স্পষ্ট জল। গাল বেয়ে গড়াচ্ছে।
সায়ন নিরবে চেয়ে থাকে। নীলাভ আলোয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ইভার কান্না দেখে। তারপর প্রচন্ড রুষ্ট স্বরে বলে,
-“আপনি কাঁদছেন কোন অধিকারে? আমার জন্য কাঁদার অধিকার আপনার নেই। কান্না থামান।”
ইভা থামায় না। বরং আওয়াজ বাড়িয়ে হুহু করে কেঁদে বলে,
-“আপনি জানেন? ভাইজান আপনাকে দেখে ফেললে কি হবে? মেরেই ফেলবে আপনাকে।”
সায়ন হঠাৎই হেসে ফেলে। হাসতে হাসতেই বলে,
-“আমাকে মারা এতো সহজ?”
~চলবে~
[