মেঘবৃত্ত পর্ব ১৫

#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_১৫
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

পরের দিনের কথা। সকালের নাস্তার পর্ব শেষ করার পর মেঘা নিজের ঘরে বসে পড়ছিল। সিলেবাসের সমুদ্রে হাবুডুবু খেয়ে কপাল চাপড়াচ্ছে। সিলেবাসের অর্ধেক এখনো পড়া হয়নি। মেঘা রি মুহূর্তে চোখে সর্ষে ফুল দেখছে।
খানিক পর, মেঘার মা মেঘার ঘরে আসলেন। মেঘার পাশে দাঁড়িয়ে ডাক দিলেন,
— মেঘা?
মেঘা বই থেকে মুখ তুলে মায়ের দিকে তাকালো। জবাব দিলো,
— হুম, বলো।
— তোর বাবা রাজি হয়ে গেছেন।
কথাটা শুনে বড়সর একটা ঝটকা খেলো। বাবা এত তাড়াতাড়ি মেনে নিয়েছেন? বিশ্বাস হচ্ছে না মেঘার। মেঘা অবাক গলায় প্রশ্ন করলো,
— এটা কিভাবে সম্ভব?
— আমি রাজি করিয়েছি। আচ্ছা শোন। এখন বৃত্তকে প্রস্তাব নিয়ে আসতে বল। মনে হয়, তোর বাবা এবার আর মানা করবেন না।
মেঘা হেসে ফেললো। কেনো জানে না, এই মুহূর্তে তার অযথাই হাসি পাচ্ছে। খুশিটা ঠিক হৃদয়ে ধরে রাখতে পারছে না সে। হৃদয় নিংড়ে ঠোঁটে চোখে ফুটে উঠছে। মেঘা চেয়ার ছেড়ে উঠে মাকে জড়িয়ে ধরলো। খুব জোড়ে, শক্ত করে। মায়ের বুকের মাঝে নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারলে যেনো তার শান্তি। মেঘার মা হাসলেন। মেয়ের পিঠে হাত রেখে মৃদু সুরে বললেন,
— সুখী হ, মা। সুখী
________________________________
মা ঘর থেকে বেরুতেই মেঘা টেবিল ছেড়ে বিছানায় এসে বসলো। ফোন হাতে বৃত্তকে দুবার কল দিলো। কিন্তু দুবারই বিজি দেখাচ্ছে। আসলে, মেঘা আর বৃত্ত দুজনেই একই সময়ে কল দিচ্ছে। তাই নেটওয়ার্ক জ্যাম লেগে বিজি দেখাচ্ছে। মেঘা একসময় হাল ছেড়ে মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো। মাঝেমধ্যে মন চায় এই বৃত্তকে লবণ মরিচ ছাড়া কাঁচা চিবিয়ে খেতে ফেলতে। দরকারের সময় কখনো যদি একে পাওয়া যেত! মেঘা যখন বৃত্তের উপর ক্রমশ রাগের পাল্লা ভারী করছে, ঠিক তখনই মেঘার ফোনে কল এলো। মেঘা ফোনের স্ক্রিনে তাকালো। বৃত্তের নাম দেখেই হুড়মুড়িয়ে কল রিসিভ করলো সে। ফোন কানের পাশে ধরতেই বৃত্তের উচ্ছাস মিশ্রিত কণ্ঠ ভেসে আসলো। বৃত্ত বললো,
— মেঘ, মেঘ। বাবা রাজি হয়ে গেছেন রে মেঘ। বাবা রাজি হয়ে গেছেন।
মেঘার মনে হলো, সারা শরীর কেঁপে উঠলো তার। মনের মাঝে শীতল এক শিহরণ বয়ে গেলো। মেঘা যেনো জমে গেছে। কথা বলতে পারছে না সে। গলা কাঁপছে। একটু পর মেঘা লক্ষ্য করলো, তার সম্পূর্ণ শরীর মৃদু কাঁপছে। বৃত্ত আবারও বললো,
— সিরিয়াসলি মেঘ। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। বাবা রাজি হয়ে গেছেন?
মেঘার এবার বললো,
— কিভাবে রাজি করিয়েছিস?
— তিনদিন ধরে অনশন করে ছিলাম। বাসায় আসিনি এ তিনদিন। খাই নি কিছুই। একচুয়ালি, খেয়েছি। তবে, মায়ের আড়ালে। বাসায় ঢুকতাম বিদ্ধস্ত হয়ে। মা এসব আর নিতে পারেন নি। শেষ মুহূর্তে বাবাকে রাজি করিয়েছেন। মেঘা বুঝতে পারছিস, তোর এই ডাফার ফ্রেন্ডের কত বুদ্ধি। প্রাউড ফিল হচ্ছে তোর? ইটস ওকে। আমি তো এমনই। দ্য ইন্টেলিজেন্স মাস্টার।
বৃত্ত যেনো কথা বলতে পারছে না। কি সব আবোল তাবোল বলছে। মেঘা হেসে ফেললো। বৃত্তটা না এমনই। সারাক্ষণ পরিবেশ মাতিয়ে রাখার মত দারুন গুন তার মধ্যে ভরপুর। হয়তো এইজন্যেই মেঘার মত এক চুপচাপ মেয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড সে। মেঘা মুখ বাঁকালো। বললো,
— ইন্টেলিজেন্স না ছাই। মাথার মধ্যে গু ভরা তোর। হুঁ। আসছে, ইন্টেলিজেন্স মাস্টার!
বৃত্ত হাসলো। অতঃপর, নিরবতা। একে অপরের উষ্ণ নিঃশ্বাস কানে আসছে। হঠাৎ’ই বৃত্ত অত্যন্ত শান্ত সুরে প্রশ্ন করলো,
— তুই খুশি তো মেঘ?
বৃত্তের এমন শান্ত স্বর মেঘার ভেতরটা তোলপাড় করে দিল। মেঘা এলোমেলো হলো। আবারো বিন্যস্ত হলো। গলা ছেড়ে বলতে মন চাইলো, ‘ এই ‘তুই’ টাকে যদি আমি পেয়ে যাই, আমার জীবন খুশির সমুদ্রে ভেসে যাবে রে বৃত্ত। সেই খুশির সমুদ্রে আমি ডুবে যাবো। তবুও সাঁতরে পার হবো না। পাছে, খুশি খতম হয়ে যায়?’ তবে, মেঘা বলতে পারলো না। আস্তে করে উত্তর করলো,
— আমার আবার খুশি! বিয়ে হইলেই হয়। এতে এত খুশির কি আছে?
বৃত্ত হাসলো। তাইতো! একটা বাচ্চার জন্যেই তো ওরা বিয়ে করছে। এতে খুশি হয়ে মরে যাওয়ার তো কিছু হয়নি। মেঘা খুশি হবেই বা কেনো? সেও তো দায়িত্বের বেড়াজালে বন্দি। ধুর। মেঘা ঠিকই বলে। সে আসলেই একটা ডাফার!
— বৃত্ত, একটা কথা বলার ছিলো।
বৃত্তের ভাবনার সুতো কাটলো। গলা পরিষ্কার করে বললো,
— বল।
— বাবা রাজি হয়ে গেছেন। বলেছেন, প্রস্তাব নিয়ে আসতে।
বৃত্ত এবার অবাকের চরম সীমায় পৌছে গেল। হালকা চেঁচিয়ে বললো,
— সত্যি?
— হুম, সত্যি।
মেঘা হেসে উত্তর করলো। বৃত্ত দু ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। আজ দিনটা সত্যিই দারুন! দারুন, দারুন, দারুন!
____________________________
তারপরে কেটে গেলো আরো দুটো দিন। আজ বৃত্তদের পরিবার মেঘাকে দেখতে আসবেন। ওই কনে দেখা ধরনের। মেঘাকে শাড়ি পড়ানো হচ্ছে। বেগুনি রঙের চমৎকার রক শাড়ি। মেঘার চাচাতো বোন শিউলি শাড়ীর কুচি ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে বললো,
— আপু, এখন থেকে একটু কম খাওয়া চেষ্টা করো তো। তোমার পেট বেড়ে যাচ্ছে।
মেঘা ভয় পেয়ে গেল। সত্যিই তার পেট বেড়ে যাচ্ছে? মেঘা চকিতে নিজের পেটের দিকে তাকালো। পেট এক ইঞ্চি বেড়ে গেছে। ইয়া আল্লাহ! বিয়ে অব্দি সব যেনো ঠিকঠাক মিটে যায়। শিউলি কুচিতে সেফটিপিন লাগিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কাধে আঁচল তুলে সেটা ঠিক করতে করতে বললো,
— আপু, শেষ পর্যন্ত ছক্কা মারলে। তোমায় কতবার জিজ্ঞেস করলাম। বৃত্ত ভাইয়াকে তুমি পছন্দ করো কিনা। তখন কি বললে? ‘নাহ, ওহ শুধু আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আর কিছু না।’ আর এখন দেখো, ফ্রেন্ড থেকে ডাইরেক্ট বর। বাহ, আপু। তলে তলে ঠিকই টেম্পু চালিয়েছো!
শিউলি কথাটা বলে হু হা করে হাসতে লাগলো। মেঘা কি বলবে খুঁজে পেলো না। শিউলির হাসি দেখে একসময় নিজেই বোকার মত হেসে ফেললো।

বৃত্তদের পরিবার এসে গেছে। বাইরে অনেক শোরগোল শোনা যাচ্ছে। বড়দের কথাবার্তা কানে আসছে। মেঘা নিজের ঘরে গাপটি মেরে বসে আছে। ভয়ে বুকের ভেতরটা ধুকপুক, ধুকপুক করছে। গলা শুকিয়ে খা। মেঘা অস্ফুট সুরে পাশে বসে থাকা একজন চাচীকে বললো,
— চাচী, পানি খাবো।
চাচী মুচকি হেসে পানি এনে মেঘাকে দিলেন। মেঘা এক ঢোকে সমস্ত পানি খেয়ে ফেললো। পানি টেবিলের উপর রেখে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ভয়ে মনে হচ্ছে, সে মারা যাচ্ছে। কেনো এতো ভয় পাচ্ছে, সে জানে না।
— কি রে! ভয় লাগছে?
পাশ থেকে চাচী প্রশ্ন করলেন। মেঘা অসহায়ের মত মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললো। চাচী হাসলেন। মেঘার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— এই সময়ে সবার এমনি হয়। ভয় পাস না। আর তুই ভয় পাবিই কেনো? তোর বন্ধুর সঙ্গেই ত বিয়ে। এত ভয়ের কি আছে?
তবুও মেঘার ভয় কমলো না। বরং, সময়ের সাথে সাথেও বাড়তেই লাগলো।

খানিক পর, মেঘার মা ঘরে আসলেন। মেঘার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,
— মেঘা? চল।
মেঘা মায়ের কথামত বিছানা ছেড়ে নামলো। শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে নিল। অতঃপর, মাথা নত করে মায়ের সাথে পা মেলালো।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here