মেঘের আড়ালে চাঁদ পর্ব ২৮

#মেঘের আড়ালে চাঁদ ❤
#Writer: মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ আটাশ

-” ওয়াও! তোকে তো দারুণ লাগছে।”

-” আর তোকে বুঝি পেত্নী লাগছে? তোকেও অনেক সুন্দর লাগছে মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড।” তুলতুল দিয়াকে বললো।

-” হ্যাঁ! হ্যাঁ বুঝেছি এবার চল। দেরি হয়ে যাচ্ছে।” দিয়া তাগাদা দিয়ে বললো।

আজকে কলেজে প্রথম বর্ষের জন্য নবীন বরন উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। সে উপলক্ষেই দুজন শাড়ি পড়েছে। তুলতুল পড়েছে গাঢ় নীল রঙের শাড়ি তার ওপর গোল্ডেন কালার কাজ করা, সাথে ফুল হাতা ব্লাউজ, কানে গোল্ডেন কালার ঝুমকো, গলায় লকেট, হাত ভর্তি নীল চুড়ি, চোখে কাজল দেয়া, লম্বা চুলগুলো একপাশে সিঁথি করে ছেড়ে দেওয়া। সবকিছু মিলিয়ে তাকে দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে, চেহারা মায়াবী হওয়ায় তাকে মায়াবতী লাগছে। দিয়া পড়েছে কমলার ওপর কালো পাড়ের শাড়ি, শাড়ির ওপরে আবার কালো রঙের সুতোর কাজ করা, সাথে লম্বা লানের দুল, হাতে লাল রঙের চুড়ি, চোখে গাঢ়ো কাজল, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, গলায় চিকন একটা চেন, চুলগুলো খোঁপা করা। তাকেও অনেক সুন্দর লাগছে। ফর্সা হওয়ার কারনে দিয়াকে সব রঙেই মানায়। দুজনের সাজই সিম্পল কোনো এক্সট্রা মেকাপ দেয়নি। কিন্তু তাদের রেডি হতেই সময় চলে যায় এজন্য দ্রুত কলেজে পৌছায়। কলেজে গিয়েই তাদের আনিস স্যারের সাথে দেখা হয়। যার জন্য তুলতুল এতোদিন কলেজে আসেনি আর আজকে কলেজে ঢুকেই তার সামনে পড়তে হলো। তুলতুল একটা হাসি দিয়ে স্যারকে সালাম দিল, সাথে দিয়াও দিল। স্যার গম্ভীর ভাবে সালামের উত্তর দিয়ে বললো

-” এতোদিন তোমরা কলেজে আসো নি কেন?”

-” ইয়ে মানে! স্যার আমি অসুস্থ ছিলাম তাই আসিনি।” তুলতুল ভয়ে ভয়ে বললো।

-” ও তাই? আজকে অসুখ সেরে গেছে? ভালো। তো তুমি নাহয় অসুস্থ ছিলে কিন্তু দিয়া আসো নি কেন?”

-“স্যার আমার পায়ে ব্যাথা পেয়েছিলাম। হাঁটতে পারছিলাম না তাই আসিনি।” দিয়া কোনোরকমে একটা অজুহাত দিল। তুলতুল আসেনি দেখে সেও আসেনি পা ভালো হওয়ার পরেও আসল কথা হলো এটা। কিন্তু স্যারকে তো আর তা বলা যাবে না।

-” এতোদিন তোমার পায়ে ব্যাথা ছিল? মিথ্যা কথা বলার জায়গা আর পাওনা। আজকে অনুষ্ঠানের বেশির ভাগ কাজ তোমরা দুজন করবে। কোনো কথা হবে না এতে। আমার সাথে আসো।” বলে স্যার চলে গেলেন। আর দিয়া আর তুলতুল হতাশ হয়ে তাকিয়ে রইল। কি দরকার ছিল সেজেগুজে আসার? এখানে এসেও কাজ করতে হবে এরথেকে কাজের বেটি সেজে আসতো তাহলেই ভালো হতো। খুব ভালো মতো ফেঁসেছে তারা। দুজনেই জানে স্যার সেদিনকার শোধ নিচ্ছেন। তারা অসহায় ভাবে হেলে দুলে স্যারের পেছনে রওনা দিল।

-” তুলু আমি আর পারতাম না। সেই কখন থেকে ছোটাছুটি করছি, একবার এতো তালায় ওঠো আবার নামো। আমি আর পারবো না। দজ্জাল স্যার আজকে সেই খাটিয়েছে।” বলে দিয়া ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লো। বিকাল হয়ে গিয়েছে, বাইরে অনুষ্ঠান হচ্ছে আর তারা এতোক্ষণ কাজ করেছে। অনুষ্ঠানের কিছুই দেখতে পারে নি। ফাইল গুলো ঠিক করে রাখা, গিফট র‍্যাপিং করা, রজনীগন্ধা আর গোলাপ একসাথে করে স্টিক করা, দরকারে এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করা আরো অনেক কাজ করতে হয়েছে সকাল থেকে তাদের, সব আনিস স্যারের জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যে সন্ধ্যাও হয়ে যাবে আর তারা কাজ করে মরছে।

-“আমার অবস্থাও খারাপ। দিয়া এককাজ কর তুই বাড়ি চলে যা আগে যাতে স্যার না দেখে এরপর আমি যাবো। যাতে তোর কথা বললে বলতে পারি অন্য কাজে গিয়েছিস। তারপর আমিও সুযোগ বুঝে চলে যাবো। নাহলে আজকে অনুষ্ঠানের পরেও যেই কাজ আছে ওগুলো আমাদের দিয়ে করাবে।” তুলতুল বললো

-” নায়ায়ায়া! আমি আর কিছু করবো না। কি খাটাশ স্যার অন্য স্যারদের কাছে বলেছে আমরা নিজে থেকে হেল্প করতে চাইছি। কি মিথ্যা কথা। আমরাতো তাও কিছুটা সত্যি বলেছি। আর উনি? হুহ।” দিয়া মুখ ভেংচি দিয়ে বললো। সে উঠে দাঁড়ালো, এখানে থাকা আর সম্ভব না। এসেছে কি করতে আর তারা কি করছে।

-” আমি যাওয়ার কিছুক্ষনের ভেতর তুই বের হবি ঠিক আছে? ” দিয়ার কথায় তুলতুল মাথা নাড়লো। আর দিয়া ওকে তাড়াতাড়ি বের হতে বলে চলে গেলো। তুলতুল হেলতে দুলতে মেয়েদের কমোন রুমে গিয়ে বেঞ্চে বসে পড়লো। এখাবে নিশ্চয়ই স্যার তাকে দেখবে না। একটুপর সেও দিয়ার মতো চলে যাবে, পরীক্ষার আগে আর কোনোমতে কলেজে আসবে না সে। তুলতুল ওঠে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। দেখে কাজল লেপ্টে গেছে। সে কাজল ঠিক করে, সেসময় বাইরে হইচই এর শব্দ পাওয়া যায়। তুলতুল বাইরে বের হয়ে কিছু দেখতে যাবে তার আগেই হুড়মুড় করে কয়েকটা মেয়ে ঢুকে যায়। তুলতুল তাদের দিকে তাকিয়ে বলে

-” বাইরে কি হয়েছে? এতো হইচই কিসের? আর তোমাদের এমন দেখাচ্ছে কেন?” মেয়েগুলো তুলতুলের কথার জবাব দিল না। তা দেখে তুলতুল ভ্রু কুচকে তাকিয়ে নিজেই বের হয়ে গেলো দেখার জন্য। বাইরে গিয়ে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সবাই এমন ছুটাছুটি করছে কেন? কি হয়েছে এদের? তুলতুল কৌতুহল নিয়ে সামনে আগায়। সামনে এগিয়ে একটা মেয়েকে ছুটতে দেখে তুলতুল তাকে জিজ্ঞেস করে

-” কি হয়েছে সবাই এমন ছুটছো কেন?”

-” নিজে বাঁচতে চাইলে লুকিয়ে পড়ো। নাহলে বাঁচবে না।” বলে মেয়েটি দৌড় লাগালো। তুলতুলের এখন রাগ উঠছে কেউ কি হয়েছে বলছে না। তুলতুল বিরক্তি নিয়ে কলেজ মাঠের দিকে যায় যেখানে অনুষ্ঠান হচ্ছে। কিন্তু যাওয়ার সময় কলেজ গেটের সামনে তাকায়, সে অবাক হয় এতো গাড়ি দেখে, কলেজের ভেতরও গাড়ি রেখেছে। হঠাৎ গুলির শব্দ কানে আসে তুলতুলের, সে মনে করে নিশ্চয়ই রাফসান এসেছে আর সেই এগুলো করছে। আজকে সে ভয় পাবে না একদম, যেয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করবে কেনো কলেজে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে? সে না সেদিন পড়াশোনার ব্যাপারে জ্ঞান দিয়ে গেলো তাহলে আজ কি হলো? তুলতুল দ্রুত পায়ে সামনে আগায় অনুষ্ঠানে এতো ছাত্র ছাত্রী যে তারা এখোনো দৌড়াদৌড়ি করছে। তুলতুল সেদিকে গিয়ে দাঁড়ালো কিন্তু কারো দিকে তাকানোর আগেই তার পেছনে কেউ আর্তনাদ করে উঠলো। তুলতুল পেছনে তাকায়, একটা মেয়ে তার এক হাতের বাহু আরেক হাত দিয়ে ধরে বসে রয়েছে। সেখান দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। তুলতুল দ্রুত গিয়ে মেয়েটাকে ধরলো। গুলি লেগেছে তার। তুলতুল আবার কারো চিৎকারে সামনে তাকায় কিন্তু সামনে তাকিয়ে থামকে যায়। শিক্ষকদের কয়েকজনকে বন্দী করে রেখেছে, তাদের মাথায় রিভলবার ঠেকানো। সবচেয়ে বড় কথা এরা রাফসানের লোক নয়, এমনকি রাফসান এখানে আসেনি, তুলতুলের মনে পড়লো রাফসানের আর তার লোকজনের গাড়ি কালো আর সাদা রঙের কিন্তু সে তখন মেরুন রঙের সব গাড়ি দেখেছিল। তারমানে রাফসান নয় অন্য কারো কাজ এগুলো। তুলতুলের ভয়ে গলা শুকিয়ে গেলো। সে তো রাফসান ভেবে বড় সাহস নিয়ে এদিকে এসেছিল, এখন তার কি হবে? তাকেও তো এখন গুলি করবে। পাশের মেয়েটির গোঙানির শব্দে তুলতুল তার দিকে তাকিয়ে তাকে ধরে উঠায় তাকে পালাতে হবে এখন নাহলে সেও মরবে। কেন ওই মেয়েটার কথা না শুনে এখানে আসলো? সাহস দেখাতে এসেছিল, কিন্তু এখন নিজেরই ভয়ে প্রানপাখি উড়ে যাওয়ার অবস্থা। তুলতুল মেয়েটিকে নিয়ে যেতে লাগে তার আগেই রিভলবার হাতে কারো নজর তুলতুলের ওপর পড়ে। তুলতুলের ভয়তে হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে কিন্তু বাইরে থেকে তা বোঝার উপায় নেই সে কাঠ হয়ে মেয়েটিকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

.

তিয়াস অফিস থেকে বের হয়। আজকে কাজ কম থাকায় তাড়াতাড়ি অফিস বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সে বাইকের চাবি হাতে নিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে বাইরে বের হয়। বাইকে উঠে স্টার্ট করতে যাবে তার আগেই কাউকে দেখে তার বুক ধক করে উঠে। একমুহূর্তের জন্য হৃদপিণ্ডের কাজ করা যেনো থেমে যায়। সে বাইক স্টার্ট না করে সেই মানুষটির দিকে এগিয়ে যায়। প্রত্যেক টা কদমে রয়েছে সংকোচ,অস্বস্তি থাকলেও তার মুখে রয়েছে রাগ, তাচ্ছিল্যতা। তিয়াস মুচকি হেসে মানুষটির সামনে দাঁড়ায়। আর সামনের মেয়েটির মুখে বিস্ময়! সে অস্ফুট শব্দে বলে

-” তিয়াস!”

-” মনে আছে তাহলে? আমার মতো চরিত্রহীন মানুষকেও কেউ মনে রাখে সেটা তো বড় ভাগ্যের ব্যাপার তাই না? আমি তো ভেবেছিলাম হয়তো ইন্টারভিউ দিতে হবে আমাকে তোমার কাছে, যতোই হোক স্পেশাল পার্সোন বলে কথা।” তিয়াস পাশের পিচ্চি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললো। মেয়েটি মৃদু হেসে বললো

-” কেমন আছো তিয়াস?”

-” অনেক ভালো আছি। সুপারব! তো পাশে পিচ্চি কে?”

-” আমার মেয়ে।”

-” ওহ আচ্ছা। তা তুমি কেমন আছো রুবা?” তিয়াস পিচ্চিটার গাল টেনে দিল।

-” এইতো আছি।” মেয়েটি আস্তে বললো।

-” এইতো আছি কেন? তোমার তো অনেক ভালো থাকার কথা, একজন চরিত্রবান, বন্ধু মানুষকে জীবনে পেয়েছো। তাহলে শুধু এইতো আছি বলছো কেন? কথাটা শুনে মনে হয় যে কোনরকমে পৃথিবীতে টিকে আছি।” তিয়াস মুখে হাসি নিয়ে বললো। অথচ তার ভেতরে কষ্ট হচ্ছে।

-“সে রকমই ধরো। কেন চলে গিয়েছিলে সেদিন কিছু না বলে?” রুবা তিয়াসের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো।

-” থেকেই বা কি লাভ হতো? একজন চরিত্রহীন মানুষের সবার থেকে দূরে চলে যাওয়া উচিত।” তিয়াস রুবার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো। তার ভেতরে আগুন জ্বললেও বাইরে সে কতটা স্বাভাবিক।

-” কেন বারবার নিজেকে চরিত্রহীন বলছো?” রুবা অসন্তোষ প্রকাশ করলো

-” কেনো মনে পড়ছে না? উপাধিটা কিন্তু তোমারই দেয়া।” তিয়াস তাচ্ছিল্যর স্বরে বললো।

-” ভুল করেছিলাম আমি। তোমাকে ভুল ভেবেছিলাম, কেন চলে গিয়েছিলে সেদিন কিছু না বলে?” রুবার কথায় অপরাধবোধ স্পষ্ট।

-” কেন খুঁজেছো আমাকে? তোমার তো ভালো থাকার কথা ছিল, তাহলে আমার খোঁজ কেন করেছো?” তিয়াস গম্ভীর ভাবে বললো।

-” কারন ভালোবেসেছিলাম তোমাকে!” রুবার করুন ভাবে বললো।

-” ভালোই বেসেছিলে শুধু বিশ্বাস আর করোনি, ভালবাসলে যে তাকে বিশ্বাস করতে হয় সেটা বোধ হয় জানতে না বা জেনেও করোনি। যাইহোক, তোমাকে একনজর দেখার ইচ্ছা ছিল, কেমন আছো তুমি তা জানার জন্য, যাক ভালোই আছো। আর সব ভুলে যাও আমিও ভুলে গেছি।” তিয়াস আর কিছু না বলেই উল্টো ঘুরে বাইকের কাছে হাঁটা ধরলো। তার গলা কাঁপছিল, সে কারো সামনে ভেঙে পড়তে চায় না। তাও এমন কেউ যে তাকে বিশ্বাস করেনি। আর রুবা অশ্রুসিক্ত চোখে তিয়াসের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। আর রুবার ছোট মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের কান্নামাখা চেহারা তার ভালো লাগছে না এজন্য সে নিজেও কেঁদে দিল। রুবা মেয়েটিকে কোলে তুলে নিয়ে আবার তিয়াসের দিকে তাকায়, সে বাইক নিয়ে অনেকদূর চলে গেছে। সত্যিই অনেকদূর চলে গিয়েছে যা বলার বাইরে। অবশ্য তারই দোষ ছিল সবকিছুতে, সংসার জীবনে কোন কষ্ট না থাকলেও ভালোবাসার কষ্ট আছে। তিয়াসের মতো কখনোই তার স্বামী তাকে ভালোবাসে না। বন্ধুত্ব থাকলেও সেখানে ভালোবাসা নেই, মানুষ বলে ভালোবাসায় আগে বন্ধুত্ব দরকার, কিন্তু তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব, বোঝাপড়া ষোলো আনায় থাকলেও মনের টান নেই। কাছে থাকার পরও আপন মনে হয় না, মনের ভেতর এক শূন্যতা কাজ করে। জীবনে আগাতে হবে দেখে বোঝাপড়া করেই এগিয়ে গিয়েছে শুধু। তার জীবনটা আজ অন্যরকম হতো যদি সেদিন তিয়াসকে ভুল না বুঝতো। তিয়াস সত্যিই বলেছে সে ভালোবেসে ছিল অনেক, কিন্তু বিশ্বাস করেনি। রুবা চোখ মুছে মেয়েকে নিয়ে নিজের গন্তব্যে যেতে লাগলো।

তিয়াস বাইক খুব জোরে চালাচ্ছে। নিজেকে রুবার সামনে এতোক্ষণ সামলে রাখলেও এখন আর পারছে না। পুরনো কিছু জিনিস, কিছু স্মৃতি আবারো মনের ভেতর রক্তাক্ত করছে। চারবছর ধরে নিজের আগের অনুভূতি সব সামলে রেখেছে, এখন কি এতোগুলোর বছরের সবকিছু একেবারে সুনামি হয়ে বহিঃপ্রকাশ করতে চাইছে? তিয়াসের চিৎকার করতে মন চাচ্ছে এখন। কিন্তু সে চায় না নিজেকে দূর্বল করতে মনের ভেতর থেকে রাগ, জেদ চলে গেলে সে হেরে যাবে, মন আবার বেহায়া হয়ে উঠবে তিয়াস তা কখনো চায় না। তার চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। তিয়াস আরো বাড়িয়ে দিল বাইকের স্পিট। কিছুদূর গিয়ে একটা চেনা মুখের দেখা মিললো। কিন্তু আজ সে এই রুপে কেন? তিয়ার বাইক নিয়ে দিয়ার পাশে দাঁড় করায়।

-“বাইকে উঠ।”

-” বাইকে উঠবো মানে? আমার বাসা আরেকটু সামনে আমি বাইকে উঠবো কেন?” দিয়া হাবার মতো প্রশ্ন করলো। সে বুঝতে পারছে না হঠাৎ তিয়াস এসে কেনো তাকে বাইকে উঠতে বলছে?

-” বেশি বুঝিস? যা বলছি তাই কর।” তিয়াসের ধমকে দিয়া তাকে মনে মনে বকতে বকতে বাইকে উঠে বসে তিয়াসের কাঁধে হাত রাখলো।
-” শক্ত করে ধরে বস।”

-“বসেছি।” দিয়ার কথায় তিয়াস বাইক টান দিয়ে বলে

-” তুলতুল কোথায়?” দিয়া একটু ভাবলো, সে অনেক আগেই বের হয়েছে কলেজ থেকে একটু কাজ থাকায় বাড়ি যেতে দেরি হয়ে যায়। তুলতুলের তো ওর পরপরই বের হওয়ার কথা, এতোক্ষণে বোধহয় বাড়ি পৌঁছে গেছে। তাই সে তিয়াস কে বললো

-” বাড়ি চলে গেছে। কিন্তু আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আর আমাকেই বা কেন নিয়ে যাচ্ছেন?” দিয়ার কথার কোনো জবাবা না দিয়ে তিয়াস বাইক চালাতে লাগলো। আর দিয়া তিয়াসকে মনে মনে আরো কয়েকটা বকা দিয়ে মুখ ফুলিয়ে রইলো।

সন্ধ্যা হওয়ার আগ মূহুর্ত, চারপাশের পরিবেশ সুন্দর লাগছে। বাতাসে দিয়ার সামনের কিছু কাটা চুল উড়ছে। ভালো লাগছে তিয়াসের সাথে থাকতে। যতোই বাইরে বলুক যাবে না, কিন্তু সে তো মনে মনে খুশি। তিয়াস যখন তাকে বলছিল বাইকে উঠার কথা তখন তার একটা লাফ দিতে ইচ্ছা হচ্ছিল। সে বাইকের সামনের মিররে তিয়াসের মুখ দেখলো, ভ্রু কুচকে সামনের দিকে তাকিয়ে একমনে বাইক চালাচ্ছে। দিয়ার ইচ্ছা হলো পেছন থেকে গাল ধরে একটু টেনে দিতে, কিন্তু সে নিজের ইচ্ছাকে দমিয়ে ফেললো। এই কাজ করলে নিশ্চয়ই তাকে একটা থাপ্পড় দিয়ে বাইক থেকে নামিয়ে দিয়ে চলে যাবে, তার থেকে নাহয় পাশেই বসে থাকলো।
.

বাইক থেমেছে অনেকক্ষণ আগে। একটা নির্জন জায়গায় বাইক থামিয়েছে তিয়াস, তারপর থেকে বাইকে হালকা হেলান দিয়ে হাত বুকে বেঁধে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। দিয়া এতক্ষণ ধরে অনেককিছুই জিজ্ঞেস করছে কিন্তু তার কোনো উওর দেয় নি তিয়াস। দিয়া বিরক্ত হলো, কোনো কিছু না বলে চুপচাপ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয়? চারপাশে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে, নিস্তব্ধতা ছেয়ে আছে পুরো এরিয়া জুড়ে। দিয়া এদিক সেদিক চোখ বুলালো তারপর তিয়াসকে বললো

-” আপনি কি এভাবে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য এখানে এসেছেন? তাহলে আমাকে কেন আনলেন? নিজে একাই আসতেন। শুধু শুধু আমি দাঁড়িয়ে থেকে মশার কামড় খাচ্ছি। উফফ!”

-” ধর তুই আমার গার্লফ্রেন্ড। আমাকে যদি ছবিতে কখনো কারো সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখিস তাহলে কি করবি?” তিয়াসের এমন কথায় দিয়া স্তব্ধ হয়ে গেলো। সে কি জিজ্ঞেস করলো আর তিয়াস কি বললো?আর এতোক্ষণ পড়ে এসব কি বলছে।

-“আপনি এসব কি বলছেন উল্টা পাল্টা? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আর কার সাথে ঘনিষ্ঠ দেখার কথা বলছেন?”

-” তখন কি তুই তোর বেস্ট ফ্রেন্ডকে বিয়ে করে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি গুলো আমার ওপর ছুঁড়ে মেরে বলবি যে, “বেঁচে গেছি আগেই তোর মতো চরিত্রহীনের হাত থেকে, এইযে দেখ আমি বিয়ে করে ফেলেছি এটাই তোর শাস্তি! আর যাকে বিয়ে করেছি সে তোর মতো লম্পট না সে অনেক চরিত্রবান বুঝেছিস? আমার সামনেও আর আসবি না কখনো” এছাড়াও আরো অনেক কিছু বলে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কি চলে যাবি? পাগলের মতো ভালবাসার পরেও বিশ্বাস না করে চলে যাবি?” তিয়াসের গলা কাঁপছে। চোখের কোণে জল জমা হয়েছে, যেনো এখনি গড়িয়ে পড়বে। আর দিয়া সে তো স্তব্ধ হয়ে তিয়াসের দিকে তাকিয়ে আছে। তার যা বোঝার তা বোঝা হয়ে গিয়েছে। তিয়াস অন্য কাউকে ভালোবাসে,সেজন্যই তাকে ভালোবাসে না? দিয়ার ভেতর চুরমার হয়ে যাচ্ছে, তিয়াস কেন তাকে ভালোবাসে না? কেন সে অন্য কাউকে ভালোবাসে? তার কি হবে এখন? সেও তো তিয়াসকে পাগলের মতো ভালোবাসে। তাহলে কি তার ভালবাসা পূর্নতা পাবে না? আর তিয়াস কিসের ছবির কথা বলছে? সে যতোদূর জানে তিয়াসে চরিত্র খারাপ নয়,যদি হতো তাহলে তার সাথে নিশ্চয়ই দিয়া এত রাতে ভরসার সাথে এখানে থাকতো না, বিশ্বাস করে সে তিয়াসকে। দিয়া তিয়াসের মুখের দিকে তাকায় তার উত্তরের অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু দিয়ার গলা দিয়ে যে কথা বের হচ্ছে না। সে এতদদিন শুধু শুধুই কি ভালোবেসে গেছে? হয়তো! ভেবেছিল একদিন না একদিন তিয়াস তাকে ভালোবাসবে কিন্তু.. তিয়াসের মনে যে অন্য কারো বসবাস। তিয়াস আবার দিয়াকে ঝাঁকি দিয়ে একই কথা জিজ্ঞেস করে। বুক ফেটে কান্না আসছে দিয়ার,সে চিৎকার করে তিয়াসের কলার ধরে ঝাঁকিয়ে বলে

-“কেন ভালোবাসেন নি আামাকে কেন? কেন অন্য কাউকে ভালোবেসেছেন? যদি ভালো না বাসতেন তাহলে আজ কষ্ট পেতেন না। কেন একটুও আমাকে ভালোবাসেন না? আমি কি একটুও যোগ্য না আপনার ভালোবাসার? অবস্থা দেখুন আপনিও কষ্ট পাচ্ছেন আর আমিও পাচ্ছি। আপনি কষ্ট পাচ্ছেন ভালোবাসা পেয়েও হারিয়ে ফেলায় আর আমি! আমি ভালোবাসা না পেয়ে। না ভুল বললাম আপনি হারান নি, যাকে ভালোবেসেছিলেন সে আপনাকে হারিয়েছে। তবুও আমি আপনাকে ভালোবাসি তা জানা সত্ত্বেও কেন অন্য কাউকে ভালোবাসলেন বলুন? আর উত্তর চাই তো আপনার? আমি কখনো এই কাজ করতাম না, আগে আপনাকে জিজ্ঞেস করতাম, যথেষ্ট বিশ্বাস করি আপনাকে আমি” বলে দিয়া কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে পড়লো। তার কিশোরী মন কিছুতেই মানতে পারছে না যে তিয়াস অন্য কাউকে ভালোবাসে। তাই সে সহ্য না করতে পেরে চিৎকার করে উঠেছে। কিন্তু দিয়া তো জানে না সে সব ঘটনা অতীত চারবছর আগের কথা তা। যা আজকে মনে পড়ায় তিয়াসকে ক্ষতবিক্ষত আর দূর্বল করে দিয়েছে। সে নিজের কষ্ট কমাতে এমন কাউকে নিজের অতীতের কথাগুলো বলেছে যে তাকে প্রচন্ড ভাবে ভালোবাসে। এতে তার হৃদয় যে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে তিয়াস তা বুঝতে পারছে। সে কিছুক্ষন কান্নারত দিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে তাকে টেনে তুলে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। আর দিয়া তিয়াসের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য তাকে ধাক্কা দিচ্ছে। কিন্তু তিয়াস তাতে আরো জোরে তাকে জড়িয়ে ধরে। দিয়া ফুপিয়ে কেঁদে উঠে বলে

-” কেনো ধরেছেন আমায় ছাড়ুন। ভালো যখন বাসেন না তখন আমাকে ধরবেন না ছাড়ুন। চলে যাবো আমি আর আপনার সামনে আসবো না” তিয়াস দিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো

-” হুঁশশ পিচ্চি কাঁদে না। আমি মজা করে তোকে বলেছি।”

-” আমি জানি আপনি মজা করেন নি। তাই মিথ্যা বলবেন না।” দিয়া নাক টেনে বললো। তিয়াস আর কিছু না বলে দিয়াকে ধরে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকলো।

চলবে…

ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here