মেঘের ওপারে মেঘ | আট
গত সপ্তাহে যখন শাশুড়ি জাহানারা বেগম বিয়ের কথা বললেন, সায়রা সব শুনে থ হয়ে গেল। শেষে কিনা মেহেদিকে বিয়ে করবে! সে কিনা তার বর সোহাগের ছোটো ভাই! সায়রা মুহূর্তেই তিন হাত দূরে সরে গেল।
এমনিতে মেহেদি খারাপ না, ভালোই। সুদর্শন, স্মার্ট, ভদ্র। তবে সায়রার থেকে বয়সে কম করে হলেও দু’-চার বছরের ছোটো হবে। আরও কারণ আছে। সবচে’ বড়ো কথা, সোহাগ তো এখনও মরেনি। বড়ো ভাই মরে গেলে ছোটো ভাই তার ভাবিকে বিয়ে করে। কিন্তু সোহাগ তো জীবিত। সে কথা সায়রা জানে। এবং এ-ও জানে, সোহাগ ইন্ডিয়ায় আছে। চারুশীলার কাছে। সায়রার সঙ্গে সোহাগের ডিভোর্স হয়ে গেলে হয়তো কিছু একটা হতে পারে। এই ভেবে সায়রা গিয়েছিল অনুর বাসায়। গিয়ে লাভ হলো না। অনু নিজেও এ ব্যাপারে কিছু জানে না। শুধু জানে, চলে যাবার আগে সোহাগ তার হাতে একটি চিঠি দিয়ে বলেছিল, চিঠিটা যেন সায়রার বালিশের নিচে রেখে আসে। সে কথা সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে।
সায়সা ফোনেও চেষ্টা করেছিল বহুবার। ফোন বন্ধ। হয়তো সিমকার্ড ভেঙে ফেলেছে। একবার ভেবেছিল, নিজেই ইন্ডিয়ায় যাবে। তারপর খুঁজে বের করবে সোহাগকে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, ইন্ডিয়া কি ছোটো দেশ? সে তো মস্ত বড়ো। সোহাগ হয়তো কলকাতায় নেই। চারুশীলাকে নিয়ে কোথায় পালাবে কে জানে! তাই কলকাতা যাওয়ার প্ল্যান এখানেই সমাপ্ত।
সায়রা না করেই দিলো। জাহানারা বেগমের মুখের উপর না করল। সে এ বিয়ে করবে না। কিন্তু জাহানারা বেগম নাছোড়বান্দা। তার মুখে অনুরোধ, চোখে জল, গলায় আকুতি। তিনি প্রায় পায়েই পড়ে যাচ্ছিলেন, ‘সায়রা মা, না করো না। তোমার মাঝে আমি আমার ছেলেকে খুঁজে পাই। তোমাকে আমি মরার আগ অবধি কাছে চাই। আর তাই, তোমাকে মেহেদির বউ হিসেবে দেখতে চাই।’
সায়রা অবশেষে মেহেদির কাছেই গেল। সেদিন সন্ধ্যার পর মেহেদি ছাদে দাঁড়িয়ে আনমনে আকাশ দেখছে। সায়রা নিঃশব্দে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, ‘বাড়িতে কী সব আলাপ আলোচনা হচ্ছে জানো?’
মেহেদি না তাকিয়েই বলল, ‘হুঁ।’
‘কিন্তু এ যে হবার নয়!’
‘আমিও তাই বলেছিলাম।’
‘বলেছিলে? এখন বলো না?’
‘বলি ভাবি। কিন্তু মা এসব শুনতে নারাজ। তার নাকি আপনাকেই লাগবে।’ বলে লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ল মেহেদি।
‘তুমি আমাকে বউ হিসেবে মেনে নিতে পারবে কখনো?’
‘পারব ভাবি। মা’র জন্য সব পারব।’
‘বিয়ের পরেও ভাবি বলেই ডাকবে?’ সায়রা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল।
‘তা কেন?’
‘তবে কী?’
মেহেদি এ কথার জবাব দিলো না। সায়রা কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে চলে এল। সে জানে, মেহেদির সাথে কথা বলে কোনো লাভ নেই। ছেলেটা একটু ভীতু প্রকৃতির। আর কাউকে ভয় পায় কি না জানা নেই। তবে সায়রাকে ভয় পায়। খুব ভয় পাই। সেই প্রথম দিন থেকেই। সেটা মুখে না বললেও সায়রা টের পায়।
বিয়েটা হয়ে গেল হুট করেই। কোনও আয়োজন নেই। আলোকসজ্জা নেই। দাওয়াত, খাওয়া-দাওয়া কিচ্ছু নেই। কেউ জানে না, এ বিয়ের কথা। আত্মীয়-স্বজন কেউ না। এমনকি পাড়া-প্রতিবেশীও না। শুধু জানে এ বাড়ির চারটি মানুষ এবং আরো পাঁচজন। সায়রার শাশুড়ি জাহানারা বেগম আজ বেজায় খুশি। বাসর ঘর সাজানো হয়েছে তার নির্দেশে। ফুলে ফুলে ভরে আছে ঘরটা। বাতাসে এয়ার ফ্রেশনারের ঘ্রাণ। এসবের কিছুই সায়রাকে স্পর্শ করছে না। সে মুখ ভার করে বিছানায় বসে আছে। কোনো রকম উদ্বেগ নেই। উৎকণ্ঠা নেই। ভয় নেই। মেহেদি-ইতো! সেই ভীতু ছেলেটা! যে কিনা আজ থেকে তার বর। এর বেশি সায়রা কিছু জানে না। জানে অন্যরা। কী সব নিয়ম কানুন করতে হয়েছে, সব অন্যরা জানে। সায়রা শুধু সাইন করেছে আর কবুল বলেছে। ব্যাস৷ বাকিটুকু তার মনেও নেই। মনে থাকার প্রয়োজন-ও নেই। মেহেদি তার বর, এটুকু মনে থাকলেই হবে।
সায়রা তার মা’কে ফোন করল।
‘মা!’
‘সায়রা, কী খবর?’
‘আমরা বিয়ে করেছি মা।’
জিন্নাতুন নুর একটু শক খেলেন কি? তিনি কাঁপা গলায় বললেন, ‘কী করেছিস?’
‘বিয়ে করেছি। আমি আর মেহেদি।’
‘তোর দেওর মেহেদির কথা বলছিস?’
‘হুঁ।’
‘কিন্তু তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন! তারা কি মেনে নেবে? তোর শাশুড়ি?’
‘তিনিই আমাদের বিয়ে করিয়েছেন।’
‘তুই সুখী হবি তো মা?’ জিন্নাতুন নুরের গলাটা একটু ধরে এল কি?
সায়রা প্রশ্নের জবাব দিলো না। ফোন রেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সুখ! সুখ কী জিনিস, সে কি তা জানে? আদৌ সুখ কি তার কপালে আছে? বিয়ের রাতেই যার স্বামী পালিয়ে যায়, তার মতো হতভাগ্য মানুষ দুনিয়ায় আছে? ভাবতে ভাবতে সায়রার বুক ভার হয়ে আসে। মনের আকাশে কালো মেঘ জমা হয়। চোখদু’টো টলটলে জলে ভরে যায়।
দরজায় আওয়াজ। মেহেদি এসেছে। সায়রা একটু কেঁপে উঠল কি? তার ভেতরে একটু একটু ভয় নাড়া দিলো কি? কিন্তু তার তো ভয় পাবার কথা নয়। মেহেদি তো এটুকু ছেলে। উল্টো সায়রাকে ভয় পায়। ভয়ে হাঁটু কাঁপে। এই ছেলের জন্য তার এত কীসের ভয়!
মেহেদি দরজা লাগিয়ে ধীর পায়ে বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল। সায়রা অপর পাশে পা দুলিয়ে বসে আছে। একবার ফিরেও তাকায়নি। তাকাবার আগ্রহও প্রকাশ করেনি। মেহেদি নিচু গলায় বলল, ‘বসব, ভাবি?’
সায়রা ফিকফিক করে হেসে ফেলত। অনেক কষ্ট হাসি আটকাল। কিন্তু মনে মনে হাসল ঠিকই। কী ছেলে রে বাবা! এখনও ভাবি ডাকছে! হাসির চোটে সায়রা অনেক্ষণ কথা বলতে পারল না। যখন একটু স্বাভাবিক হলো, গম্ভীর গলায় বলল, ‘বোসো।’
‘তুমি কি আমাকে ভাবি বলেই ডাকবে?’
‘না ভাবি।’
সায়রা আরো কিছুক্ষণ মুখ টিপে হাসল। তারপর গম্ভীর ভাবে বলল, ‘তা হলে?’
‘কী বলে ডাকলে আপনি খুশি হবেন?’
‘প্রথমত তুমি করে বলতে হবে। আর আমার নাম সায়রা। নাম ধরে ডাকলেই খুশি হব।’
‘আচ্ছা ভাবি।’
‘আমাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারছো না, না?’
‘ওরকম কিছু নয় তো।’
‘তা হলে ভাবি ভাবি করছো কেন?’
‘আর হবে না।’
‘অবশ্য তোমার কোনো দোষ নেই। আমিই চলে যাওয়া উচিত ছিল…’
পুরো কথা বলার আগেই মেহেদি উঠে দাঁড়াল। সায়রার মুখেমুখি দাঁড়িয়ে দু’হাতে সায়রার কাঁধ স্পর্শ করে দাঁড় করাল। কোনো রকম কথা না বলেই সায়রার ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে নিল। তারপর কী হলো সায়রা জানে না। শুধু জানে, জীবনের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত কাটাল আজ। জীবনের সরচে’ সুখের, সবচে’ রোমাঞ্চকর মুহূর্ত কাটাল আজ।
‘স্যরি।’ বলে শুয়ে পড়ল মেহেদি। কিছুক্ষণের মধ্যেই নাক ডাকতে শুরু করল। সায়রা ঘুমাল না। জেগে রইল। বসে থাকল মেহেদির পাশে। কী করে ঘুমাচ্ছে লোকটা? সায়রার যে ঘুম আসছে না। একটু আগে ঘটে যাওয়া এক কিংবা দু’ মিনিটের চুম্বন যে তার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে! এই কথা মনে করে কত রাত সে ঘুমাতে পারবে না কে জানে!
সায়রা জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। উঁচু দেয়ালের বাউন্ডারির বাইরে সরু রাস্তার পরিসর। তারপর ভাঙা দেয়ালের ওপাশে ফাঁকা জমি। জমিতে পানি জমে আছে। রাস্তার পাশের বৈদ্যুতিক পিলারে ঝুলে থাকা বাতির টিমটিমে আলো সেই পানিতে পড়ে সোনালি বর্ণ ধারণ করেছে। সবকিছু উপেক্ষা করে সায়রার দৃষ্টি পড়ল সেই ভেঙে যাওয়া দেয়ালটায়। দেয়ালে আজ সেই উন্মাদটা নেই। সেদিনও ছিল না। যা ছিল, তা সায়রার মনের ভুল। আজ, এত বছর পর সে বুঝতে পেরেছে, অতি সামান্য একটি কুসংস্কার মানুষের সুন্দর জীবনের পথে ভয়াবহ দানব রূপে দাঁড়াতে পারে। যত দ্রুত সম্ভব, মন থেকে সেই দানবটাকে মুছে ফেলা প্রয়োজন। তবেই প্রকৃত সুখ আসবে। না হলে, পৃথিবীতেই অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। বেঁচে থেকেও মরতে হয় প্রতিটি মুহূর্ত। লড়াই করতে হয় নিজের সঙ্গে নিজেই।
কুসংস্কার একটি মাত্র শব্দ। তবে এই একটি শব্দই একসময় বিকট আকার ধারণ করে। মানুষের জীবনে আনে অশান্তি। আনে হতাশা। কুসংস্কার বিশ্বাস মানুষকে মেরুদণ্ডহীন করে তুলে। জীবনে চড়াই-উতরাই থাকবে, বাধা-বিপত্তি থাকবে, পাওয়া-না পাওয়া থাকবে। সমস্যা যেমন থাকবে, তার আড়ালে তার থেকেও ভালো সমাধান থাকবে। কুসংস্কার সেই সমাধান খুঁজতে তো দেয়-ই না, উল্টো মানুষকে বিভ্রান্ত করে। পাপের দিকে ঠেলে দেয়। জীবনে নিয়ে আসে অশান্তি। চলার পথে বাধার সৃষ্টি করে। ভালো কাজ থেকে দূরে রাখে। অহেতুক, মন্দ কাজের দিকে ধাবিত করে।
চেয়ারে বসে বসে রাত কাটিয়েছে সায়রা। ঘুমায়নি। সারা রাত জেগে ছিল। শেষ রাতের দিকে বোধহয় চোখ লেগেছিল। ফরজরের আজান শুনে তন্দ্রা ভাঙল। সায়রা হাই তুলে উঠতে যাচ্ছিল, তখনই দেখল, মাটিতে বসে সায়রার বাঁ হাতের উপর মুখ রেখে ঘুমিয়ে আছে মেহেদি। সায়রা ডাকল, ‘অ্যাই!’ মেহেদির ঘুম ভাঙল না। ফ্লোরে বসে বসে নাক ডাকছে সে। সায়রা একটু ঝাঁকুনি দিয়ে ডাকল, ‘অ্যাই!’
মেহেদি ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। সায়রা বলল, ‘এখানে কী?’
‘ঘুমাচ্ছিলাম, ভাবি।’
‘আবার ভাবি!’
‘স্যরি।’
‘আমার নাম কী?’
‘সায়রা।’
‘এভাবে না। কান ধরে বোলো।’
‘সায়রা।’
‘গুড। এবার বোলো, সায়রা তুমি খুব ভালো।’
‘সায়রা তুমি খুব ভয়ঙ্কর। রোমান্টিকও।’
‘কীঃ!’
‘স্যরি।’
‘হি-হি-হি!’
(সমাপ্ত)
মো. ইয়াছিন