মেঘের পালক পর্ব -০২

#মেঘের_পালক
পর্ব-২

অরিনকে আবেগী মেয়ে বলা যায়। ছোটোবেলা থেকেই সে স্বপ্ন দেখে এসেছে এক রাজকুরমারের, যে তাকে রানীর মতো রাখবে। আজকের আগ পর্যন্ত সেই রাজকুমারের দেখা সে পায়নি। কাউকেই তার ঠিক মনে ধরত না। খুঁতখুঁতে স্বভাবের কারনে নিজেই নিজের ওপর বিরক্ত ছিল সে। কিন্তু আজকের এই দিনটা বোধহয় তার জন্য সৌভাগ্য নিয়ে এসেছে। যে মানুষটাকে এক দেখায় পছন্দ হয়ে গিয়েছিল সে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। একেবারে স্বপ্নদৃশ্য যেন!

অরিন মুখে হাত চেপে কেঁদে ফেলল। বুঝতে পারছে হলঘরের সবাই হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চিৎকার, শোরগোল থেমে গেছে। শুধু ফুঁপিয়ে কাঁদছে অরিন।

প্লাবনকে বিভ্রান্ত দেখাল। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “কী হলো আপনার? আই অ্যাম সরি…আমি আসলে…”

অরিন কোনোমতে কান্না থামিয়ে ধরা গলায় বলল, “ফুলগুলো দিন।”

প্লাবন তোড়াটা অরিনের দিকে বাড়িয়ে ধরল। তোড়া হাতে নিয়ে চোখ মুছে অরিন বলল, “আই লাভ ইউ টু..”

বলে দ্রুত পায়ে নেমে গেল স্টেজ থেকে। তারপর এক দৌড়ে হলঘর পেরিয়ে বাড়ির বাইরে। সামনে একটা সিনএনজি পেয়ে সেটাতে চড়ে বসল সে। রওনা হলো বাড়ির দিকে। অসম্ভব ভালোলাগায় তার মনপ্রাণ আচ্ছন্ন হয়ে আছে।

বাড়ির প্রায় কাছাকাছি একটা ব্রীজের কাছে এসে সে সিনএনজি ছেড়ে দিল। ব্রীজের রেলিং ধরে দাঁড়াল। রাতের তারাভরা আকাশ আজ অন্যরকম লাগছে! ঠান্ডা বাতাস মন দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে! এখনো পার্টি শেষ হয়নি। কেক কাটা হয়নি। আমন্ত্রিতদের জন্য একটা সারপ্রাইজ দেবার কথা ছিল, সেটা কী জানা হয়নি৷ অরিনের তবু কোনো আক্ষেপ নেই। সে আজ নতুন কিছু খুঁজে পেয়েছে।

নদীর ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ তার কী একটা যেন মনে হলো। আচ্ছা, প্লাবন তাকে কেন প্রপোজ করল? এইযে এতটা সময় ছিল, বড়জোর দুই থেকে তিনবার তাদের চোখাচোখি হয়েছে। তাও কোনো ভাব বিনিময় হয়নি। শুধু শুরুর ওই জুস ফেলার সময়ই কথা হয়েছে। প্লাবনের দৃষ্টিতে আগ্রহের ছিটেফোঁটাও ছিল না। তাহলে হঠাৎ সে আই লাভ ইউ বলে বসবে কেন? আশ্চর্য তো!

অরিন মোবাইল বের করল। তার বুক ঢিপঢিপ করছে। কয়েকটা মিসড কল এসেছে অর্নব আর অন্যান্য বন্ধুদের থেকে। তার দুটো ভুল হয়েছে, প্রথমটা বোকার মতো প্লাবনকে ভালোবাসি বলা আর দ্বিতীয়টা এভাবে পালিয়ে আসা। প্লাবন নিশ্চয়ই মজা করে ঘটনাটা ঘটিয়েছে! আর সে সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছে! সবাই তাকে কী ভাবছে? গর্ধব? নাকি নির্লজ্জ! ছি ছি! এ কী কান্ড হলো!

সে মৌটুসীকে ফোন করল৷ মৌটুসী হলো ক্লাসের সবচেয়ে ধৈর্যশীল আর বুঝদার ভালো মেয়ে। হাসিমজা খুবই কম করে।

কয়েকবার কল করার পর মৌটুসী রিসিভ করল।

“অরিন! কোথায় তুই?”

“আমি চলে আসছি রে। এটা কী হলো বল তো?”

“তা তো আমিও বুঝতে পারছি না। সব ওলটপালট হয়ে গেছে!”

“কী ওলটপালট হয়েছে?”

“এখন বলতে পারব না। আগে সব বুঝে নেই, তারপর বলব। আমি বাসায় গিয়ে তোকে ফোন করব।”

“কিন্তু ততক্ষণ আমি থাকব কিভাবে?”

মৌটুসী একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “তুই কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো কাজ করবি কেন? ছেলেটাকে চিনিস? আন্দাজে আই লাভ ইউ টু বলে দিলি! বোকা মেয়ে! রেস্ট কর তুই। অত ভাবিস না। আমি দেখছি।”

অরিন কাতর মুখে নদীর পানির দিকে তাকাল। বাড়িতে একটু পর গেলেও হবে। বলে এসেছে পার্টি রাত নয়টা পর্যন্ত। অর্নব নিজেদের গাড়িতে করে সবাইকে বাড়ি পৌঁছে দেবে।

এই পার্টিতে যাওয়ার জন্য মা বাবাকে রাজি করাতে কত যে হুজ্জত হয়েছে তা সে-ই জানে! বাবা তো কিছুতেই যেতে দেবেন না। একে তো এত রাত পর্যন্ত থাকবে, তাও কোনো ছেলের জন্মদিনের পার্টি! শেষ পর্যন্ত তারা রাজি হয়েছেন মৌটুসীর কথায়। মৌটুসী হচ্ছে সেই মার্ক করা ভালো মেয়ে যার ওপর বান্ধবীদের বাবা মা চোখ বুজে বিশ্বাস করে। “মৌটুসী যাচ্ছে, আচ্ছা তাহলে যেতে পারিস” এমন ভাবভঙ্গি।

অরিনের সময় আর কাটতে চাইছে না৷ সে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরল। বাড়ি পৌঁছে গোসল করে নিল। এসি থেকে বের হয়ে শরীর ঘেমে চটচটে হয়ে আছে। ক্ষুধাও লেগেছে। প্লাবনেট চক্করে বলতে গেলে কিছুই খেতে পারেনি সে। কত ভালো ভালো খাবার ছিল! সেসবের কথা ভেবে ক্ষিদে আরও বেড়ে গেল। আবার সেই সাথে ওদিকে কী হয়েছে সেটা ভেবে পেট গুড়গুড় করছে। লজ্জায় কুঁকড়ে যেতে ইচ্ছে করছে। বারবার ফোন হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছে মৌটুসীর ফোনের।

এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে সে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। যা হয়েছে হয়েছে! এখন খেয়ে আগে পেট ঠান্ডা করা যাক।

মা ভাত বাড়ছে। অরিন টেবিলে গিয়ে বসল।

মা অবাক হয়ে বললেন, “তুই খেয়ে আসিস নাই? তোর জন্য তো রান্না করি নাই।”

“মা মিষ্টি জিনিস অনেক খেয়ে ফেলছি৷ এখন একটু ভাত খেলে ভালো লাগত। না রান্না করলে আর কী করার!”

“উঠিস না বোস। ভাত এমনিতেও বেশি হবে। অনিকের নাকি জ্বর জ্বর লাগতেছে, ও খেল না।”

অরিন প্লেটে ভাত নিয়ে খেতে শুরু করল। আনমনে খেতে খেতে বেশ অনেকটা খেয়ে ফেলল। উঠে যাওয়ার সময় খেয়াল করল মা তার দিকে অদ্ভূত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

রাত ঠিক সাড়ে এগারোটায় মৌটুসীর ফোন এলো।

অরিন অস্থির গলায় বলল, “তাড়তাড়ি বল কী হয়েছে।”

মৌটুসী একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “কেন প্লাবন তোকে হঠাৎ প্রপোজ করল সেটা বুঝিনি৷ ওরা বন্ধুরা খুব হাসি তামাশা করছিল। এর মাঝে এক ছেলে ঘোষণা করল, প্লাবন নাকি অরিনকে প্রপোজ করবে। আমরা ভেবেছি ডেয়ার হয়তো। আমার খুব রাগ লাগছিল। প্লাবনও সুড়সুড় করে গিয়ে তোকে প্রপোজ করে ফেলল। আর তুইও একসেপ্ট করলি! তারপর পালিয়ে গেলি। ভেবেছিলাম তখন সবাই হেসে উঠবে, বলে দেবে কী হয়েছিল। কিন্তু সবাই খুব অবাক হয়ে গেছে দেখলাম। আর প্লাবন গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। ওর বন্ধুরা কেউ কেউ আজেবাজে কথা বলছিল, কিন্তু প্লাবন ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছে। বাকি পার্টিতে এই ঘটনা নিয়ে আর তেমন কথা হয়নি। শেষ পর্যন্ত ঠিকঠাক বুঝলাম না কী হলো।”

অরিন নিজেও কিছু ভেবে পেল না। বলল, “শোন না, প্লাবনের পরিচয়টা বল তো?”

“তুই পরিচয়ও জানিস না!” অরিন যেন ফোনের ভেতর দিয়ে মৌটুসীর হা হওয়া মুখটা দেখতে পেল।

“না জানি না।”

“ও অর্নবের খালাতো ভাই।”

“ওহ।”

“অর্নবদের মতো বড়লোক না, আমাদের মতোই বলা যায়। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।”

“ভালো।”

“আচ্ছা রাখি। খুব ক্লান্ত লাগছে রে।”

“আচ্ছা।”

ক্লান্ত অরিনেরও লাগছিল। মাথায় প্রশ্নের জট নিয়ে সে ঘুমাতে গেল। বোধহয় দশ মিনিট ঘুমিয়েছে, তখন ফোনটা এলো। অচেনা নাম্বার। ঘুমের ঘোরেই রিসিভ করল সে।

ওপাশ থেকে পুরুষকন্ঠ ভেসে এলো, “অরিন বলছেন?”

অরিন শোওয়া থেকে লাফিয়ে উঠে বসল। বুক কাঁপছে! এটা কি সে?

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here