. #মেঘের_বিপরীতে
পর্বঃ ১৯+২০(শেষ)
রেহাল এপার্টমেন্টের গেটের সামনে এসে হর্ন বাজালো। কেয়ারটেকার সালাম দিয়ে গেট খুলে দিলো। গাড়ি পার্ক করতে করতে রেহালের মনে হলো নন্দিতা ফিরে এসেছে। যদিও দোতলার ফ্ল্যাট অন্ধকার। নন্দিতা ফিরে আসলে বাতি জ্বলতো। গাড়ির চাবি পকেটে ভরে রেহাল ধীরেসুস্থে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। চাবি ঘুরিয়ে দরজা খোলার সাথে সাথে দেখতে পেলো ড্রইং রুম মোমবাতির আলোয় আলোকিত। সোফার সামনে রাখা টি টেবিলে একটি রেড ওয়াইনের বোতল। কিছু গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে রাখা আছে। রেহাল অবাক চোখে পুরো রুম ঘুরে দেখছে। এমন সময় নন্দিতার কন্ঠস্বর শোনা গেলো।
“আজ তুমি আধ ঘন্টা আগেই চলে এসেছো।”
রেহাল পেছন ফিরে তাঁকালো। কালো রঙের শাড়ি পড়েছে নন্দিতা। স্লিভলেস ব্লাউজ। আলো ছায়ার খেলায় তাকে ঠিক কতটা সুন্দর লাগছে রেহাল অনুমান করতে চাইলো। কিন্তু পারলো না। নারী সৌন্দর্য কখনো কখনো বিশ্লেষণ করা যায় না। সে শান্ত গলায় বললো,
“কেনো যেনো মনে হলো তুমি ঢাকা ফিরে এসেছো। তাই আগে চলে এসেছি।”
“এমনটা কেনো মনে হলো?”
“পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে।”
“কোন অভিজ্ঞতা?”
“আমার জন্মদিনে তুমি সবসময় স্পেশাল কোনো কিছু করার চেষ্টা করো। স্মরণীয় করে রাখতে চাও। এবারো করবে এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম।”
নন্দিতা এগিয়ে আসলো। তার চেহারা এতক্ষণ আবছা দেখা যাচ্ছিলো। এবার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
“অন্য সময় আমি বাবার বাড়ি থাকি না। এবার বাবার বাড়ি ছিলাম। তাদের ফেলে তোমার জন্মদিন পালন করতে চলে আসবো এটা কিভাবে নিশ্চিত হলে?”
রেহাল চুপ করে রইলো। নন্দিতা ভুল বলে নি। এর আগে তার জন্মদিনের সময় নন্দিতা ঢাকাতেই ছিলো। এবার ছিলো না। পার্থক্য আছে। পরিস্থিতি ভিন্ন।
“বিষয়টা আমি এভাবে ভেবে দেখি নি, নন্দিতা।”
“ভাবা উচিত ছিলো। ভেবে উত্তর দেওয়াটাও উচিত ছিলো। তুমি কি জানো তোমার বুদ্ধি দিন দিন কমে যাচ্ছে?”
“না। তুমি যখন বলছো হয়তো কমছে।”
“হ্যাঁ। কমছে। কয়েকদিন পর থেকে বুদ্ধিহীনতায় ভুগবে! সহজ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না।”
রেহাল এবারো চুপ করে রইলো।
নন্দিতা বললো,
“যাও হাত মুখ ধুয়ে জামা পালটে আসো। নতুন পাঞ্জাবির প্যাকেট বিছানার ওপর আছে।”
রেহাল মাথা নেড়ে ঘরে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে জামাকাপড় পালটে ফিরে এলো। নন্দিতা টেবিলে খাবার সাজিয়ে ফেলেছে। গরুর মাংসের স্টেক। ফিশ বারবিকিউ। রেহাল চেয়ার টেনে বসলো। নন্দিতা ওয়াইনের বোতল খুলে কাচের গ্লাসে রেড ওয়াইন ঢালতে লাগলো। মোমবাতির আলোয় মনে হলো গ্লাসে যেনো রক্ত ঢালা হচ্ছে। দুটো গ্লাস অর্ধপূর্ণ করে নন্দিতা রেহালের সামনের চেয়ারে বসলো। মুচকি হেসে বললো,
“চিয়ার্স ফর ইওর বার্থডে।”
কাচের গ্লাস দুটো হালকা স্পর্শে টুং করে শব্দ হলো। রেহাল গ্লাসে ছোট করে চুমুক দিয়ে বললো,
“আমি মনে হয় উত্তর খুঁজে পেয়েছি।”
“কিসের উত্তর?”
“তুমি কেনো ঢাকা ফিরে এসেছো এই প্রশ্নের উত্তর।”
“কেনো ফিরে এসেছি?”
“আমি প্রতি বছর তোমার জন্মদিন ভুলে যাই। এবছরও ভুলে গিয়েছি। তুমি কখনোই ভুলো না।”
“এর সাথে আমার ফিরে আসার সম্পর্ক কি?”
“পুরো ঘটনাটা থেকে এটা প্রমাণ হয় তুমি আমার যথেষ্ট কেয়ার করো, কিন্তু আমি করি না।”
“তুমি বলতে চাইছো, আমি এটা প্রমাণ করার জন্য ফিরে এসেছি?”
“হ্যাঁ।”
“তুমি কি আমার প্রতিদ্বন্দ্বী? কম্পেটিটর?”
“না।”
“তাহলে আমি কেনো এমন কিছু প্রমাণ করতে চাইবো?”
আরো একবার প্রশ্নের জালে আটকা পড়ে গেলো রেহাল। তার ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। নন্দিতা তাকে কথার প্যাচে ফেলছে। তার প্রশ্নের উত্তরে কোনো যুক্তিই সে দাঁড়া করাতে পারছে না। এমন কেনো হচ্ছে? রেহাল ভ্রুঁ কুঁচকে বললো,
“বাদ দাও। অন্য কথা বলো।”
“ঠিকাছে। আজকে সারাদিন কি করলে? অফিসের স্টাফরা কিভাবে তোমার বার্থডে সেলিব্রেট করলো?”
“নিলয় অফিস ডেকোরেট করেছিলো। কেক কাটার ব্যবস্থা করেছিলো। এই আর কি।”
“সব নিলয় করেছে?”
“হুঁ।”
নন্দিতা একটু সরু কন্ঠে বললো,
“আর তোমার পিএ? ও কিছু করে নি?”
রেহাল বললো,
“না।”
“সেকি! পিএ কিছুই করে নি?”
“অর্চিতা আজকে অফিসে আসে নি।”
“কেনো? ছুটি নিয়েছে কোনো কারণে?”
“না। অফিসের সামনে এসে রাস্তা থেকেই ঘুরে গেছে। অফিসে ঢোকে নি।”
নন্দিতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রেহালের দিকে তাঁকিয়ে বললো,
“তুমি কিভাবে জানলে?”
রেহাল হেসে বললো,
“আমার স্পাইয়ের অভাব আছে?”
“তুমি ওর পিছে স্পাই লাগিয়ে রেখেছো?”
“ওর পিছে লাগিয়ে রাখি নি। তবে অফিসের খবরাখবর রাখার জন্য বেশ কয়েকজন স্পাই আমার আছে।”
“আজকে অর্চিতার অফিসে না ঢোকার পিছে বিশেষ কোনো কারণ আছে?”
“আছে।”
“কি কারণ?”
“ও আমার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলার চেষ্টা করছে।”
“আমি তোমার কথা বুঝি নি।”
“আমি তো কঠিন কোনো কথা বলি নি। এটাও ভেঙ্গে বলতে হবে?”
নন্দিতা বললো,
“হবে।”
“শোনো তাহলে। মেয়েটা আমার সামনে কারণ ছাড়াই নার্ভাস হয়ে যায়। ঘেমে, হাত পা কেঁপে যাচ্ছেতাই অবস্থা!”
“আর?”
“আমি যখন কাজ করি ও একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাঁকিয়ে থাকে।”
“তারমানে তুমিও ওর দিকে তাঁকিয়ে থাকো। নাহলে জানলে কিভাবে কে তোমার দিকে তাঁকিয়ে আছে?”
রেহাল হেসে ফেললো।
“একদম বাচ্চাদের মতো প্রশ্ন করে ফেললে, নন্দিতা। কেউ তোমার দিকে তাঁকিয়ে থাকলে সেটা বোঝা যায়। চেষ্টা করে দেখবে?”
“না। আর কি করে?”
“আর কিছু করে না।”
নন্দিতা খাওয়ায় মনযোগ দিলো। রেহাল জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু বললে না যা?”
“বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। উত্তর পেয়ে গেছি এটাই যথেষ্ট।”
“কথাগুলো শোনার পর কি তুমি আমাদের সম্পর্ক নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছো?”
নন্দিতা সহজ কন্ঠে উত্তর দিলো,
“না। কিন্তু মেয়েটার জন্য খারাপ লাগছে।”
“খারাপ লাগার কিছু নেই। সময়ের সাথে অনুভূতি বদলে যায়।”
নন্দিতা জোর দিয়ে বললো,
“ঠিক বলেছো। খাবার শেষ করো। স্টেক ঠান্ডা হয়ে যাবে। এমনেই ঘরে এসি চলছে।”
ডায়নিং এ নিরবতা ছেয়ে গেলো। নন্দিতা মাথা নিচু করে খাচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো রেহাল তার দিকে তাঁকিয়ে আছে। আঁড়চোখে তাকে দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। নন্দিতা একবার ভাবলো মাথা উঁচু করে ব্যাপারটা নিশ্চিত হয়ে নেয়া যাক। পরক্ষণেই সে মত পাল্টালো।
আকাশে মেঘ জমেছে। রেহাল বারান্দায় বসে সিগারেট টানছে। নন্দিতার দেওয়া হালকা আকাশি রঙের পাঞ্জাবি এখনো পরে আছে সে। পাঞ্জাবিটা রেহালের পচ্ছন্দ হয় নি। তবুও পরে আছে। সে জানে নন্দিতা ঘরে ঢুকেই তাকে জিজ্ঞেস করবে পাঞ্জাবি কেমন হয়েছে। রেহাল বলবে_ “সুন্দর হয়েছে।” নন্দিতা খুশি হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে মেয়েদের খুশি করতে মিথ্যা বলতে হয়। এতে ক্ষতি নেই। ফিল্টার পর্যন্ত সিগারেট টেনে রেহাল বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। বারান্দার জানালা খোলা। ঝড়ো হাওয়া প্রবেশ করছে। নন্দিতা হাতের কাজ শেষ করে ঘরে ঢুকলো। লাইট জ্বালালো। রেহাল চোখ বন্ধ রেখেই বললো,
“লাইট নিভিয়ে দাও। চোখে লাগছে।”
নন্দিতা লাইট নিভিয়ে দিয়ে রেহালের পায়ের কাছে বসলো। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,
“পাঞ্জাবি কেমন হয়েছে?”
“সুন্দর হয়েছে।”
নন্দিতা বললো,
“আমি জানতাম তোমার পচ্ছন্দ হবে। তুমি তো পাঞ্জাবি পরতে চাও না। তোমাকে কি সুন্দর যে লাগে পাঞ্জাবিতে! যদি বুঝতে তাহলে পাঞ্জাবি ছাড়া অন্য কিছু পরতে চাইতে না।”
“এখন থেকে পরবো।”
“পাশের ফ্ল্যাটে ফ্যামিলি উঠেছে।”
“শুনলাম।”
“ঘরে ঢোকার সময় দরজার কাছে দাঁড়িয়েই টুকটাক কথা হলো। পরে চা বানিয়ে খাওয়ালাম।”
“ভালো করেছো।”
“জানো? উনাদের বিয়ের আট বছর পর বাচ্চা হয়েছে। ফুটফুটে একটা মেয়ে। নাম নুফজা। মার নাম মিনু। বাবার নাম আফজাল। তাদের নামের অক্ষরের সাথে মিলিয়ে বাচ্চার নাম রেখেছে ‘নুফজা’। বিষয়টা খুব ভালো লেগেছে আমার। তোমার লাগেনি?”
রেহাল ছোট্ট করে উত্তর দিলো, “হুঁ।”
নন্দিতা বুঝলো রেহালের এসব শোনায় আগ্রহ নেই। নুফজার জন্য সে অন্য একটি নাম রেখেছে। মায়াবিনী। নামটার কথা কি সে রেহালকে বলবে?
“মেয়েটার নাম আমার পচ্ছন্দ হয় নি।”
“কেনো?”
“মেয়েটার নাম হওয়া উচিত ছিলো মায়াবিনী।”
“এই নামকরণের পিছে বিশেষ কোনো কারণ আছে?”
এই নামকরণের পিছে অবশ্যই কারণ আছে। কিন্তু নন্দিতা সেটা রেহালকে বলবে না। মেয়েটা প্রতিবন্ধী এটাও তার বলতে ইচ্ছা করছে না। সে বললো,
“না। নেই।”
বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। রেহাল জানালা দিয়ে বাইরে তাঁকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“তোমাকে অনেকদিন ধাঁধা ধরি না। আজকে একটা ধরি?”
রেহালের ধাঁধা ধরার বিশেষ কারণ থাকে। নন্দিতা কখনোই তার ধাঁধার সঠিক উত্তর দিতে পারে না। রেহাল সুযোগটা কাজে লাগায়। নন্দিতা বললো,
“ধরো।”
“বেড়ে যদি যায় একবার, কোনোভাবেই কমে না আর_ জিনিসটা কি?”
নন্দিতা চিন্তার ছিপ ফেললো। তার ছিপে ধাঁধার উত্তর ধরা পড়লো না।
সে শুকনো গলায় বললো,
“জানি না। উত্তর কি?”
“মানুষের বয়স। একবার বাড়লে কোনোভাবেই কমে না। দেখতে দেখতে আমার তেত্রিশ বছর বয়স হয়ে গেলো!”
নন্দিতা কিছু বললো না। রেহাল শান্ত গলায় বললো,
“হেরে গেলে।”
নন্দিতা গম্ভীর গলায় বললো,
“সবসময়ই হেরে যাই।”
“হেরে যখন গিয়েছো তাহলে আমি যা বলবো এখন তাই করতে হবে।”
নন্দিতা মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো। বউয়ের হাবভাব দেখে রেহাল উচ্চস্বরে হেসে ফেললো।
“সারারাত পায়ের কাছেই বসে থাকবে? পাশে এসে বসো।”
নন্দিতার লজ্জা লাগছে। তাও রেহালের পাশে গিয়ে বসলো। রেহাল নন্দিতার হাতের ওপর নিজের হাত রাখলো। নন্দিতা হালকা কেঁপে উঠলো। মানুষটার স্পর্শ সবসময় তার কাছে নতুন বলে মনে হয়। ঠিক বিয়ের প্রথম রাতের মতো।
(চলবে….)
. #মেঘের_বিপরীতে
শেষ পর্ব
মাস দুয়েক পরের কথা। অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। সকালে জানালার ওপার থাকে কুয়াশাচ্ছন্ন। থাই গ্লাস ঘেমে থাকে। মনে হয় আকাশের মেঘ গুলো যেনো সব নিচে নেমে এসেছে। গাছে কোনো সবুজ পাতা নেই। শুকনো পাতায় ছেয়ে গেছে মাটি। গাছগুলো নেড়া মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। শাহরিনের বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ের দিন জিসান এসেছিলো। মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায়। ভরা কমিউনিটি সেন্টারে সবার সামনে শাহরিনকে সেকি কুৎসিত গালি গালাজ করলো! বিয়ে ভেস্তে যায় যায় অবস্থা। শাহরিনের বাবা পুলিশ এনে তারপর জিসানকে ধরিয়ে দিয়েছে।
অর্চিতা অফিসে চাকরির অব্যাহতি পত্র জমা দিয়েছে। রিজাইন লেটারের সাথে রেহাল আরেকটি চিঠি সে হাতে পেয়েছে। কিন্তু চিঠিটা সে পড়ে নি। অফিসের ড্রয়ারে যত্ন করে রেখে দিয়েছে। অন্য কোনো সময় পড়বে।
নন্দিতার দিন আজকাল ভালোই যাচ্ছে। রেহালের মাঝে বিশেষ কোনো পরিবর্তন না আসলেও তাকে নিয়ে নন্দিতা সুখেই আছে। কিছু কিছু বাস্তবতা মেনে নিয়ে সুখী থাকতে শিখতে হয়।
নাইফ পাত্রী দেখতে গিয়েছিলো। কিন্তু মেয়েটিকে সে বিয়ে করবে কিনা এই বিষয়ে কিছু জানা যায় নি। নন্দিতা জানার চেষ্টাও করে নি। তার জীবন থেকে খারাপ স্মৃতিগুলো সে মুছে ফেলতে চায়। খারাপ লাগাগুলোকে মুক্ত পাখির মতো খোলা আকাশে ছেড়ে দিতে চায়। কিন্তু মানুষের খারাপ লাগাগুলো পোষা পাখির মতো। ছেড়ে দিলেও বারবার আপন নীড়ে ফিরে আসে। খাচায় বন্দি থাকতে চায়।
আজ সকালে রেহাল নন্দিতার জন্য ব্রেকফাস্টের আয়োজন করেছে। টোস্ট আর ডিম অমলেট। রেহাল যে নিজের ইচ্ছায় খাবারগুলো বানিয়েছে তা নয়। গতকাল রাতে সে নন্দিতাকে ধাঁধা ধরেছিলো। নন্দিতা সঠিক উত্তর দিতে পেরেছে।
“বলতো নন্দিতা, কোন জিনিসটি জন্মের সময় চার পায়ে, মধ্য বয়সে দুই পায়ে এবং শেষ বয়সে তিন পায়ে হাঁটে?”
“মানুষ।”
নন্দিতা আগের থেকে ধাঁধাটির উত্তর জানতো।মানুষ জন্মের পর হামাগুড়ি দিয়ে চলে। শেষ বয়সে দুই পায়ের সাথে লাঠিও যুক্ত হয়। এই ধাঁধার উত্তর নন্দিতা জানতে পেরেছিলো বই পড়ে। এই ধাঁধার একটি নামও আছে। স্ফিংক্সের ধাঁধা। স্ফিংক্স হলো প্রাচীণ পৌরাণিক দানব। এই দানবের শারীরিক গঠনও অদ্ভুত আকৃতির! নারীমুখ অথচ শরীর সিংহের দেহ নিয়ে সৃষ্টি। এই দানবটি ছিলো থিবেস শহরের দ্বাররক্ষক। স্ফিংক্সের ধাঁধার বিষয়টি ‘ইডিপাস দ্যা কিং’ বইয়ে উল্লেখ করা আছে। থিবেস শহরে প্রবেশ করার সময় সবাইকে স্ফিংক্স এই ধাঁধাটি ধরতো। সঠিক উত্তরদাতা পেতো শহরে প্রবেশের সুযোগ। যেহেতু নন্দিতা উত্তর দিতে পেরেছে তাই তার কথামতো রেহাল আজ সকালের নাস্তা বানিয়েছে। কিন্ত ডিমের গন্ধ নন্দিতার নাকে এতটাই বাজে ভাবে গিয়ে লাগে, মুহুর্তের মধ্যে তার গা গুলিয়ে উঠে। সে দৌঁড়ে বাথরুমে দরজার সামনে দাঁড়িয়েই হড়হড় করে বমি করে দেয়। রেহাল দৌঁড়ে এসে তাকে ধরলো।
“তুমি ঠিক আছো তো? কি হয়েছে তোমার?”
নন্দিতা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
“জানি না। ডিমের গন্ধটা কেমন যেনো নাকে লাগলো। গা ঘিনঘিন করে উঠলো।”
“তাহলে বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে দেই?”
“না। আমি কিছু খাবো না। শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। তুমি খেয়ে রেডি হয়ে নাও। তোমার লেট হয়ে যাবে।”
“কিন্তু তোমাকে রেখে এই অবস্থায় যাবো?”
“মর্জিনা এসে পড়বে একটু পরেই। একা থাকবো কোথায়? তুমি যাও।”
রেহাল নন্দিতাকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তৈরি হতে গেলো। নন্দিতা আস্তে করে তার পেটে হাত দিলো। খুব মনোযোগ দিয়ে হাতের প্রতিটি কড় গুণে গুণে হিসাব করতে লাগলো। হঠাৎ তার শরীরে যেনো বিদ্যুৎ খেলে গেলো। নিশ্বাস ভারী হয়ে আসতে লাগলো। বেশ কয়েকদিন ধরে তার খাওয়া দাওয়ায় অরুচি। শরীর বেশ দুর্বল। নন্দিতার চোখে মুখে আশার আলো। সে উচ্চস্বরে ডাকলো,
“রেহাল।”
রেহাল গলায় টাই বাঁধতে বাঁধতে বললো,
“কি হয়েছে?”
“তুমি একটু ফার্মেসি যেতে পারবে?”
“কোনো ওষুধ কিনতে হবে?”
“না।”
“তাহলে?”
“আমার দুটো প্রেগনেন্সি কিট লাগবে।”
রেহাল টাই ধরে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নন্দিতা মুচকি মুচকি হাসছে। তার চোখে মুখে লজ্জার ছাপ দৃশ্যমান। রেহালের কি মনে হলো কে জানে? আচমকা সে ছুটে গিয়ে তার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরলো। নন্দিতা কাঁদছে। রেহাল লক্ষ্য করলো তার চোখের কার্নিশও জলে টইটুম্বুর। গড়িয়ে পরবে পরবে ভাব!
অফিসে গিয়ে রেহাল কাজে মন বসাতে পারলো না। ছটফট করতে লাগলো। প্রেগনেন্সি কিট কিনে সে ড্রাইভারকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। নন্দিতাকে ফোন করে কি একবার জিজ্ঞেস করবে? প্রেগনেন্সি টেস্ট করেছে কিনা? না থাক। টেস্ট করলে নন্দিতা তাকে অবশ্যই টেলিফোন করে জানাতো। যদি এমন হয় নন্দিতার ধারনা ভুল ছিলো? সে প্রেগনেন্ট নয়। তাহলেও কি সে ফোন করে রেহালকে জানাবে?
নানা ধরনের প্রশ্ন রেহালের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। চাতক পাখির মতো অফিস আওয়ার শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলো সে। ঘড়িতে আটটা বাজতেই সে আর এক মুহূর্তও দেরী করলো না। বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
ডোরবেল বাজতেই নন্দিতা দরজা খুলে দিলো। তার চোখ মুখ দেখে কিছু আন্দাজ করা যাচ্ছে না টেস্টের রেজাল্ট কি হতে পারে। রেহাল কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলো না। নন্দিতাও তাকে কিছু বললো না। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর নন্দিতা ধীর পায়ে রেহালের পাশে গিয়ে বসলো। তার হাতে একটি বাদামী রঙের প্যাকেট। সেই প্যাকেটটি রেহালের দিকে এগিয়ে দিলো। রেহাল একটু হাসার চেষ্টা করে বললো,
“কি এটা?”
নন্দিতা বললো,
“প্যাকেট খুলে দেখো।”
রেহাল একটু নড়েচড়ে বসলো। প্যাকেটে ব্যবহৃত প্রেগনেন্সি কিট। রেহাল নন্দিতার দিকে একবার দেখে কিট বের করলো। গাঢ় দুটো সমান্তরাল লাল দাগ পাশাপাশি উঠে আছে। রেহাল বাকশক্তি হারিয়ে ফেললো। সে বিস্মৃত চোখে নন্দিতার দিকে তাঁকালো। নন্দিতা তাকে ইশারায় আশ্বস্ত করলো। রেহাল অনেক চেষ্টা করছে নিজেকে সামলানোর। গলা ভেঙ্গে আসছে তার। কেঁদে ফেললে খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তার ব্যক্তিত্বের সাথে চোখের পানি একদম বেমানান। অধিক উৎসাহী হওয়াটাও চোখে পড়ার মতো। কিন্তু কেনো জানি আজ ব্যক্তিত্বের পরোয়া করতে ইচ্ছে করছে না রেহালের। তার চেষ্টা বিফলে গেলো। চোখ ভিজে উঠেছে।
“তার মানে আমরা? আমাদের?”
নন্দিতা ধরা গলায় বললো,
“হ্যাঁ।”
“আমি কতটা খুশি হয়েছি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না নন্দিতা!”
“আমি জানি।”
রেহাল নন্দিতাকে বুকে টেনে নিলো। নন্দিতার চোখের জলে রেহালের টি শার্ট ভিজে যাচ্ছে। কারেন্ট চলে গিয়েছে। জেনারেটর এখনো চালু করা হয় নি। অন্ধকারের মধ্যে ঝাপসা চোখে রেহাল দেখলো দরজার কাছে এক বছরের একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক হাত বাড়িয়ে রেহালকে ডাকছে।
মেয়েটাকে দেখতে একদম জীবন্ত পুতুলের মতো!
✍আতিয়া আদিবা
———————————————————–💘সমাপ্ত