মেঘে_ঢাকা_আকাশ পর্ব ৬+৭

#মেঘে_ঢাকা_আকাশ
#পর্ব-৬
#আমিনুর রহমান

স্পৃহা আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল,

“কি হয়েছে বলুন তো? আর এভাবেই বা তাকিয়ে আছেন কেন?”

তার মানে মিলিকে বলা কথাগুলো স্পৃহা শুনতে পায়নি। তাই আমিও ওই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বললাম।

“কিছু হয়নি তো। আপনার দিকে তাকানো যাবে না এরকম কোন রুলস আছে নাকি? থাকলে বলতে পারেন,আমি মেনে চলব।”

আমার এরকম টেরা কথা শুনে যে স্পৃহা খুব একটা খুশি হতে পারল না সেটা বুঝলাম আমি। সে কিছুটা মন খারাপ করে বলল।

“এমনিতেই আমার বয়ফ্রেন্ডের চিন্তায় মন সবসময় খারাপ থাকে। তার ওপর আবার আপনার এরকম কথা। আপনি একটু ভালোভাবে কথা বলতে পারেন না। আমি না হয় ডিপ্রেশনে আছি তাই এমন ব্যবহার করি আপনার সাথে। কিন্তু আপনি কেন আমার সাথে এমন করেন?”

আমি স্পৃহার কথার প্রতি উত্তরে বললাম।

“আমি ভাই সবসময় ডিপ্রেশনে থাকি। আমি ডিপ্রেশন থেকে দূরে থাকতে চাইলেও ডিপ্রেশন আমাকে ছাড়ে না। আপনার পেছনে এমনিতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে আমার। আর সম্ভব না। আমরা দুজন দুজনের রাস্তায় চলে গেলেই বেটার হবে। কেউ কারো যেহেতু প্রয়োজনে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই,সো আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো৷ আমার জীবনটা আপনার মতো এতো সুখের না,এতো বিলাসিতার না। আমার অতীত শুনে হয়তো আপনার হাসি পেয়েছে,তবে আমি জানি আমার অতীত কতটা কষ্টের।”

তখন স্পৃহা বলল।

“প্রয়োজন নেই মানে? আমি একটা মেয়ে হয়ে কিভাবে এই ব্যস্ত শহরে আমার বয়ফ্রেন্ডকে খুঁজব? ওর ফোন খোলা থাকলে তো কোন সমস্যাই হত না। আর আপনাকে তো আমি বলেছি,আপনি যেতে পারবেন না যতক্ষণ না পর্যন্ত আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে আমার দেখা হচ্ছে। আর টাকার কথা বলছেন? সব টাকা দিয়ে দিবো আপনাকে। আমি বাসা থেকে বের হওয়ার সময় অনেক দামি দামি জিনিস ব্যাগের ভিতর নিয়ে এসেছি। এগুলো বিক্রি করলে অনেক টাকা পাওয়া যাবে। আপনি হিসাব করে রাখেন সব দিয়ে দিব আমি।”

আমি কিছু বললাম না,দেখতে দেখতে ২৪ ঘন্টা পাড় হয়ে গেলো,বাট অবস্থার কোন পরিবর্তন হলো না। বাঁধ্য হয়ে আমাদেরকে একটা বাসা নিতে হবে। মেয়েটা কাবিন নামা সাথে করে নিয়ে এসেছিল। সে হয়তো জানতো এমন কিছু হবে,এটার দরকার হতে পারে। তাই ব্যাগে ভরে নিয়ে এসেছিল। আর সেটার কারণেই ঢাকা শহরের বুকে একটা বাসা ভাড়া পেলাম দুজন। আমি যে শুধু স্পৃহার জন্য বাসাটা নিয়েছি তা না৷ এখানে আমারও লাভ আছে। আমার থাকার জন্য একটা জায়গা দরকার ছিলো,এর থেকে ভালো জায়গা হয়তো আমি পেতাম না। তাই এটাকেই বেছে নিয়েছি। কারণ বেঁচে থাকার জন্য একটা চাকরি দরকার,অন্তত আমার মতো মানুষদের। কারণ আমার আগেপিছে কেউ নাই। আমার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আমাকেই করতে হতে। সকালে ঘুম থেকে উঠে বের হয়ে যেতাম চাকরির খোঁজে। অনেক পরিচিত বন্ধুদের কাছে বলেও রেখেছি একটা চাকরির কথা। কিন্তু কেউ সেরকম কোন ব্যবস্থা করে দিতে পারেনি। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। আজকাল অন্য কারো জন্য কেউ শ্রম দিতে চায় না,কারো কাছে অনুরোধ করে নিজের মর্যাদা কমাতে চায় না। আমার পরিচিত একজন মানুষ আছে সে যদি তাঁর ওপরের জনের কাছে শুধু একটা সুপারিশ করে,রিকুয়েষ্ট করে আমার চাকরির জন্য তাহলে হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা সে করবে না,এতে নাকি তাঁর মান কমে যাবে।

বাসা নেওয়ার পর একমাস চলে গেলো। এই একমাসে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। আপন মানুষগুলো পর হয়ে গিয়েছে,পর মানুষগুলো হয়তো কিছুটা হলেও আপন হয়েছে। সেদিন বাবাকে সাহস করে ফোন দিয়ে বললাম।

“কেমন আছ বাবা?”

বাবা আমাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা কেটে দিলো। কেটে দেওয়ার আগে শুধু বলল।

“ফোন দিয়েছিস কেনো? আজ আমার মেয়ের বিয়ে। ভুলেও তুই ফোন দিস না। আমরা তোকে ভুলে গিয়েছি। তুইও আমাদেরকে ভুলে যা। এটাই তোর জন্য ভালো হবে।”

বাবা ফোন রেখে দেওয়ার পর নিজের অজান্তেই কেঁদে দেই আমি। এমন কান্না আর কতদিন করতে হবে জানা নেই। আজ আমার আদরের বোনটার বিয়ে অথচ আমি তাঁর সামনে নেই। সেও কি তাহলে তাঁর ভাইয়ের কথা ভুল গেছে? ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। খারাপ মানুষকে কেউ মনে রাখে না,মনে রাখলেও ঘৃণা করার জন্য মনে রাখে। আমাকে তো আর আমার বোন ঘৃণা করতে পারবে না৷ তাই হয়তো ভুলে গিয়েছে। বাবা তো অনেক আগেই আমাকে ভুলে গিয়েছে কিন্তু মা কি করে আমাকে ভুলে গেলো? কোন মা কি তাঁর সন্তানকে কখনো ভুলতে পারে? আমার মা কিভাবে পারল? এসব কথা মনে হতেই কান্নাটা আরও বেড়ে যায়। আজ আমার কান্না করার দিন,আজ আমার দুঃখের দিন,আজ আমার একা হয়ে যাওয়ার দিন। আমার কান্না থামানোর কেউ নেই,আমার চোখের পানি মুছে দেওয়ার কেউ নাই।

স্পৃহা কি আমার চোখের পানি মুছে দিতে পারে না? এই একমাসে তো সে আমার অনেক কাছে এসেছে৷ আমাকে নিজ হাতে রান্না করে খাইয়েছে। আমি না আসলে আমার আসার জন্য অপেক্ষা করতে করতে অস্থির হয়ে যেত। তবে দিনশেষে তাঁর বয়ফ্রেন্ডের জন্য তাঁর মন খারাপ থাকত। তারপরেও তাঁর সাথে আমার সম্পর্কটার অনেক উন্নতি হয়েছে। সত্যি বলতে আমার ভালো থাকার জন্য একজন মানুষ প্রয়োজন। হোক সেটা ভালোবাসার মানুৃষ কিংবা ভালো লাগার মানুষ। এই পৃথিবীতে একা একা ভালো থাকা যায় না। ভালো থাকার জন্য কাউকে দরকার। কিন্তু আমার তো ভালো থাকার জন্য কেউ নেই। তাহলে আমি ভালো থাকব কিভাবে? এতকিছুর পরেও অন্য আট-দশটা মানুষের মত আমারও যে একটু ভালো থাকতে ইচ্ছে করে। আবার মনে হয় এই পৃথিবীতে সব মানুষের ভালো থাকা হয় না। কিছু মানুষ অকারণেই খারাপ থাকে৷ আমি হয়তো সেই খারাপ থাকা মানুষগুলোর মাঝে একজন।

হঠাৎ করে লক্ষ্য করলাম আমার পেছনে স্পৃহা দাঁড়িয়ে আছে। আমি চোখের পানিটা মুছে তাঁর দিকে তাকাতেই সে একটা হাসি দিলো। মনে হলো এই হাসিটার জন্য আমার খারাপ থাকাটা চলে গেলেও খুব বেশি অবাক হব না। আমি তাঁর হাসিটা মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকি। আমার মুগ্ধতার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। তাহলে সে তাঁর সিদ্ধান্ত বদলিয়েছে? বয়ফ্রেন্ডকে না পেয়ে পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে যাকে বিয়ে করেছে তাকেই ভালোবাসতে শুরু করেছে? এমন হলে খারাপ হয় না। আমার ভালো থাকার জন্য একজন মানুষ আমি পেয়ে গেছি। তাঁর জড়িয়ে ধরাতে কেমন যেন ভিতরটাতে “ভূমিকম্প” সৃষ্টি হলো। আমিও যখন তাকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম ঠিক তখনই সে আমার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কিছুটা পেছন দিকে সরে গেলো। তারপর বলল।

“জানেন আজ আমি অনেক খুশি। হয়তো পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষটাও আমি। ওর সাথে কথা হয়েছে আমার। একসপ্তাহ পরেই আমাদের দেখা হচ্ছে। ওর ফোনটা হারিয়ে গিয়েছিল,যার কারণে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। ছিনতাইকারীরা টাকা পয়সা,মোবাইল সব ওর কাছ থেকে নিয়ে গেছে। এসব নিয়ে যাওয়ার সময় ওকে আহত করেছিল। যার কারণে ও এতদিন হাসপাতালে ছিল। আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। আমি জানতাম আমার ভালোবাসার মানুষটা আমার সাথে এমনটা করতে পারে না। ওর প্রতি আমার অনেক বিশ্বাস ছিল,আজ সেটা সত্য হয়েছে। আর কেউ না জানুক আমি তো জানি ও আমাকে কতটা ভালোবাসে। একসপ্তাহ পর আপনি চলে যেতে পারবেন। তবে চলে যাওয়ার আগে ওর সাথে আপনাকে দেখা করাতে চাই। আপনি আমার জন্য অনেক করেছেন। আপনার প্রতি আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।”

স্পৃহার কথা শুনে খুব খারাপ লাগল। এই খারাপ লাগার কারণটা আমার কাছে জানা নেই। আমি অভিনয়ের হাসি হেসে বললাম।

“শুভকামনা আপনার জন্য। সবশেষে তাকে পেয়েই গেলেন। আপনাদের ভবিষ্যৎ জীবন সুখের হোক এটাই চাই।”

কথাগুলো বলেই আমি বারান্দায় চলে গেলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের মন খারাপের কথাটা আকাশকে বললাম কিন্তু কোন উত্তর পেলাম না। এমন সময় দেখলাম কে যেন ফোন দিয়েছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা ধরলাম। ওপাশ থেকে মেয়েলি কণ্ঠে কেউ বলল।

“স্যার,আমি অবনি। আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই। সেদিন আপনার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। আমি সব সত্য জেনে গিয়েছি। মা যে এমন একটা মিথ্যা অপবাদ আপনাকে দিতে পারে আমি ভাবিনি। আপনি একবার আমাদের বাড়িতে আসুন। মায়ের কঠিন একটা অসুখ বেঁধেছে। হয়তো এটা তাঁরই পাপের শাস্তি। মরার আগে সে একটাবার আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে চায়।”

আমার অবনিকে অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল না। শুধু বললাম।

“এখন এসব বলে কি লাভ? এসব বললেই তো আর সবার কাছে আমি আগের মত হব না। আমার নিজের,আমার পরিবারের যে অসম্মানটা হয়েছে সেটা তো আর ফিরে পাব না। সবাই আমাকে তো খারাপ ছেলে হিসেবেই জানে। এখন তো আমার নির্দোষ হওয়ার ইচ্ছা নেই। যদি সম্ভব হয় আমার বাবা মাকে সত্যটা জানিও। পৃথিবীর সবাই আমাকে খারাপ ভাবুক আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু অন্তত দুইটা মানুষ জানুক আমি এমন কাজ করি না,এমন কাজ করতে পারি না।”

কথাগুলো বলে ফোনটা রেখে দেই। কারণ এই মুহূর্তে কারো সাথে কথা বলতে আমার ভালো লাগছে না। এমনকি নিজেরই নিজেকে বড্ড বিরক্ত লাগছে।
#মেঘে_ঢাকা_আকাশ
#পর্ব-৭
#আমিনুর রহমান

এত কষ্টের পরেও কেন জানি বাঁচতে ইচ্ছে হয়। কখনো মনে হয় না মরে যাই। মনে হলেও সেটা খুব কম সময়ের জন্য। কিন্তু কার জন্য বাঁচতে ইচ্ছে করে সেটা আমার জানা নেই। হয়তো নিজের জন্য কিংবা অন্য কারো জন্য। অবনির ফোন কেটে দেওয়ার পরেও সে বারবার ফোন দিতে থাকে কিন্তু আমি তাঁর ফোন ধরি না। কারণ আমি ওই মহিলাটার সাথে দেখা করতে চাই না,যে মহিলাটা আমার জীবনটাকে কষ্টের আগুনে সিদ্ধ করেছে,আমার কাছের মানুষগুলো সব কেড়ে নিয়েছে। আমি বেঁচে থাকতে তাঁর মুখটা দেখতে চাই না। এমনকি মরার পরেও না। এতে যে যা ভাবুক আমার কিছু যায় আসে না। আমি জীবনে কাউকে ঘৃণা করি না কিন্তু যদি একবার কাউকে ঘৃণা করি তাহলে তাকে মন থেকেই করি এবং সারাজীবনের জন্যই করি।

আর সাতদিন পর হয়তো স্পৃহা আমাকে ছেড়ে চলে যাবে কারণ তাঁর ভালোবাসার মানুষটা তাকে নিতে আসবে। তারপর আবার আমি সেই আগের মতো একা হয়ে যাব। আমার পাশে কাউকে পাব না আমি। আমার অসুখে বিসুখে আমাকেই আমার পাশে থাকতে হবে। স্পৃহার কথা ভেবে মনটা খারাপই হচ্ছে। কিন্তু কিই বা করার আছে আমার? আমার কি আর স্পৃহাকে আটকিয়ে রাখার সাধ্য আছে? নেই,যদি থাকতো আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে তাকে আমার কাছে রেখে দিতাম। অনেকগুলো খারাপ খবরের মাঝেও একটা ভালো খবর পেলাম সেটা হলো একটা চাকরি হলো আমার। তবে মনটাকে ভালো করতে পারলাম না। স্পৃহার চলে যাওয়াটাই কি আমার মন খারাপের কারণ?

মানুষকে বলার মতো কোন চাকরি না। দুবেলা দুমুঠো খাবার খেয়ে বেঁচে থাকার মতো একটা চাকরি। আমার জন্য এটাই অনেক। কারণ আমি কখনো খুব আরাম আয়েশের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে পারিনি। তাই কম টাকার মধ্যেই যেকোন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার মতো অভিজ্ঞতা আমার আছে। না থাকলেও তো মানিয়ে নিতে হবে। এছাড়া কোন উপায় তো আর নেই। আমার চাকরি জীবনের প্রথমদিনটা খুব ভালো গেলো। অনেক অচেনা অজানা মানুষের সাথে পরিচয় হলো আমার। কাউকে ভালো লাগল কাউকে লাগল না। কেউ আমাকে দেখে বিরক্ত হলো কেউ বা আমার সাথে কথা বলে খুশি হল। তবে যখন অফিস থেকে বাসায় ফিরব ঠিক তখনই মনটা খারাপ হয়ে গেল। অথচ আমি ভেবেছিলাম এতদিন পর বুঝি একটু ভাল লাগার মতো কোনকিছু খুঁজে পেয়েছি। আজ আমার সমস্ত দুঃখ ভুলে যাওয়ার দিন। কারণ আজ আমার বোনের সাথে দেখা হয়েছে।

আমার বোনের সাথে একটা ছেলেকে দেখলাম। তাহলে কি এই ছেলের সাথেই ওর বিয়ে হয়েছে। বাহ্ কি সুন্দর। পৃথিবীর সব ছেলেই বুঝি নিজের বোনটাকে এমন রাজপুত্র ছেলের সাথে দেখতে চায়। আমিও আমার বোনকে দেখে খুশি না হয়ে পারলাম না। কিন্তু আমার বোন যখন আমাকে দেখেও না চেনার ভান করে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো তখন যেন কেমন লাগল। মনে হলো এত খারাপ লাগা বুঝি এর আগে কখনো কোন মানুষের ভিতরে কাজ করেনি যতটা আমার ভিতরটাতে লাগছে। বুকের ভিতর এমন এক অসহ্য যন্ত্রণা হলো যেটা সহ্য করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা আমাকে দেন নাই। আমার বোনের আমাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা আমার কোনভাবেই সহ্য হচ্ছিল না। তাকে পেছন থেকে ডাকতে ইচ্ছে হলো। আবার মনে হলো বিয়ের সময় হয়তো আমার সম্পর্কে ছেলের পরিবারকে কিছু জানায়নি। তাই হয়তো আমার বোন এতদিন পরেও আমাকে দেখে কথা না বলে না চেনার ভান করে চলে যাচ্ছে। তাই আর আমি তাকে ডাক দিতে পারলাম না। বোনের সুখের জন্য এতটুকু তো করায় যায় না,তাই না? নিজের মনকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিলাম,আমার বোন পরিস্থিতির স্বীকার,সে তাঁর হাসবেন্ডকে জানাতে চায়নি তাঁর একটা ভাই আছে,যাকে এলাকার সবাই খারাপ মানুষ হিসেবেই জানে। তবে প্রশ্নটা থেকেই যাই। আমার সাথে কথা বললেই কি তাঁর হাসবেন্ডের সাথে সম্পর্কটা খারাপ হয়ে যেত? প্রশ্নগুলো না হয় পাঠকদের কাছেই রেখে গেলাম।

বাসায় এসে অনেক চেষ্টা করেও নিজের বিষন্ন মনটাকে ভালো করতে পারলাম না। আমার এমন মন খারাপ দেখে স্পৃহা জানতে চাইলো আমার কি হয়েছে। আমি তাকে হ্যাঁ না কিছুই বললাম না। সেও আর দ্বিতীয় বারের মতো জানার জন্য আমাকে জোর করল না। মন খারাপের প্রসঙ্গটা ভুলে যাওয়ার জন্য আমিই তাকে জিজ্ঞেস করলাম।

“আপনি তাহলে সামনের সপ্তাহে চলে যাচ্ছেন?”

আমার প্রশ্নের উত্তরে স্পৃহা বলল।

“হ্যাঁ,যেতে তো হবেই। আপনার সাথে তো আর সারাজীবন থাকতে পারব না। আর তাছাড়া এটার জন্যই বাসা থেকে পালিয়ে এসেছি। তবে কেন জানি যেতে মন টানছে না। মনে হচ্ছে আর কিছুটা দিন এভাবে স্বাধীন হয়ে ঘুরাফেরা করি। নিজের ভালো লাগার কাজগুলো করি। নিজের ভিতরটা কি চায় জানি।”

আমার স্পৃহাকে বলতে ইচ্ছে করল। যার সাথে বৈধ কোন সম্পর্ক নাই তাঁর সাথে সারাজীবন থাকা যায়। আমার সাথে তো আপনার পবিত্র কালেমা পড়ে বিয়ে হয়েছে। আমাদের সম্পর্কটা পবিত্র। তাহলে কেন আপনি আমার সাথে সারাজীবন থাকতে পারবেন না? কিন্তু বললাম না। কারণ কিছু কথা মনের ভিতরেই থাকা ভালো। প্রকাশ করলে এক পৃথিবী সমান দুঃখ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমি স্পৃহার দিকে তাকিয়ে কপালের ঘামটা মুছতে মুছতে বললাম।

“আপনার বয়ফ্রেন্ড কি করে, কোথায় থাকে কিছুই কিন্তু বললেন না আমাকে।”

তখন স্পৃহা হেসে বলল।

“আমি নিজেও তাঁর সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানি না। তাঁর সাথে আমার পরিচয়টা একটু ভিন্নভাবে হয়েছিল। তখন আমি কলেজে পড়তাম। আমার বান্ধবীকে কিছু ছেলে অনেক বিরক্ত করত,সাথে আমাকেও। যারা বিরক্ত করতো তারা অনেকটা বাজে ছিল তাই তাদেরকে কিছু বলার সাহস পেতাম না৷ বাড়িতে এসব কিছু বলে ঝামেলা বাড়াতে চাইনি। কারণ বাসায় জানতে পারলে অনেক বড় কিছু হয়ে যাবে। তাই বাড়িতে কিছু জানাইনি৷ এভাবেই ওই বাজে ছেলেগুলোর অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে একদিন দেখলাম সেই বাজে ছেলেগুলো আর আমাদের বিরক্ত করছে না। পরে জানতে পারলাম এটার কারণ আমার বয়ফ্রেন্ডই। ওই ওদেরকে শায়েস্তা করেছে। তারপর আমি নিজ থেকেই কেন জানি ওর প্রতি কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়লাম,ওর কাছে ওর ফোন নাম্বার চাইলাম। তারপর থেকেই আমাদের রিলেশন শুরু। তবে ও এখন একটা চাকরি করে। কি চাকরি করে সেটা কখনো জানতে চাইনি আমি। কেননা আমি জানি ও আমাকে কখনো কষ্ট দিবে না,সুখেই রাখবে। তাই কি চাকরি করে,কত টাকা ইনকাম করে এসব জানার ইচ্ছেটা কখনো হয়নি।”

আমি স্পৃহার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম। এত সিম্পল একটা কারণেও মেয়েরা কারো প্রেমে পড়তে পারে? কাউকে ভালোবাসতে পারে জানা ছিল না আমার। কলেজে থাকতে তো কত মেয়েকে কতভাবে সাহায্য করলাম। কই কেউ তো কখনো ভালোবাসি বলল না,প্রেম করতে চাইলো না,ফোন নাম্বার চাইলো না। তাহলে কি আমার ভাগ্যটাই এমন কেউ আমাকে বয়ফ্রেন্ড হিসেবে পারফেক্ট মনে করে না?

আমি স্পৃহাকে বললাম।

“এইসব কারণে কাউকে ভালোবাসা যায়? এমনও তো হতে পারে ওটা লোক দেখানো ছিলো৷ কিংবা আপনাকে বশে আনার জন্য সে নিজেই এমনটা করেছে। যদিও আমার ধারণাটা ভুলও হতে পারে। তবে সত্য হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ ছেলেরা মেয়েদেরকে পটানোর জন্য অনেক কিছুই করে থাকে। তার মাঝে অনেক বাজে কাজও করে থাকে মেয়েদের সামনে হিরো সাজার জন্য। যেগুলো মেয়েদের সবসময় অজানাই থেকে যায়।”

আমার কথা শুনে স্পৃহা রাগী কণ্ঠে আমার দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে বলল।

“ও এমন না,ওকে আমি চিনি। আর আপনি এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন কেন বলুন তো? প্রেমে ট্রেমে পড়লেন নাকি? আর যাই করেন না কেন আমার প্রেমে পইড়েন না তাহলে আপনাকে দুঃখের সাগরে ভাসতে হবে। আপনাকে নিয়ে আমার ভয় হচ্ছে। কবে জানি আবার সত্যি সত্যি আমাকে নিজের বউ দাবি করে বসেন।”

স্পৃহার মুখ থেকে এরকম তিতা কথা শুনতে হবে কখনো ভাবিনি। তাঁর কথাগুলো শুনে কেন জানি নিজেকে অনেক তুচ্ছ মনে হলো। আমি নিচের দিকে মাথা দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকার পরেও যখন আমি কোন কথা বললাম না তখন স্পৃহা বুঝতে পারল তাঁর এমন কথায় আমি ভীষণ রাগ করেছি। তাই হয়তো সে আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার মাথাটা নিজ হাতে উঁচু করে বলল।

“ওটা তো আমি এমনিতেই বলেছি। এটাতে কেউ রাগ করে এভাবে? আপনি তো জানেন আমার মজা করতে ভালো লাগে। আর সেটা যদি সিরিয়াস মুডে হয় তাহলে তো কোন কথায় নেই। তবুও আমি সরি। এভাবে আপনার মনটা খারাপ করে দেওয়ার জন্য। তবে বিশ্বাস করুন ওগুলো সব মজা করে বলেছি আমি। কারণ আমি জানি আপনি এমন মানুষ না। আপনি অনেক সহজ সরল মানুষ। আপনি কখনোই এসব নিয়ে ঝামেলা বাঁধাবেন না আমি জানি। সেটা বিয়ের রাতেই বুজেছি।”

স্পৃহার এরকম নীরব আত্মসমর্পণে আমি কিছুটা অবাক হলাম। এই মেয়েও যে এভাবে কারো সামান্য অভিমান ভাঙানোর জন্য নিজেকে এভাবে নিজের কাছে আত্মসমর্পণ করে দিবে এটা বোঝা যায় না। আমাকে চুপ থাকতে দেখে স্পৃহা আমার গালে হাত রেখে বলল।

“এই যে মিস্টার গোমড়ামুখো,কি হয়েছে আপনার বলুন তো? আমি তো সরি বললাম,তারপরেও আমার ওপর রাগ করে আছেন? আচ্ছা বলেন আমি কি করলে আপনার রাগ কমবে। আপনি একটু হাসবেন।”

আমি না চাইতেও আমার মুখে হাসির চিহ্ন ফুটে উঠল। কেউ একজন এতটা দিন পর এভাবে আমার অভিমান ভাঙাবে এটা ভাবিনি আমি। মাঝে মাঝে মনে হত কত শত অভিমান জমা হয়ে গেছে,এই জমে থাকা অভিমান গুলো ভাঙানোর জন্য হলেও একজন তুমি প্রয়োজন। কিন্তু আজ সেই একজন তুমি ছাড়াই কেউ আমার অভিমান ভাঙালো। এটা যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি হওয়ার মতো। আমি যখন আমার ভাবনার সপ্তম মহাকাশে বিরাজ করছিলাম ঠিক তখন স্পৃহার কথায় নিজেকে বাস্তবে প্রতিস্থাপন করি আমি।

স্পৃহা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল।

“আমার বিশ বছরের জীবনে প্রথমবার কারো অভিমান ভাঙালাম আমি। আমি এভাবে আমার বয়ফ্রেন্ডের অভিমানও কখনো ভাঙাইনি। কিন্তু আপনাকে এমন অবস্থায় দেখতে ইচ্ছে করছিল না আমার। কেন এমন হচ্ছিল সেটাও জানি না। কালদিন পর আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যেতে হবে। আপনাকেও সাথে যেতে হবে। ওকে এই বাসাতে আসতে বলেছিলাম বাট ও আসবে না। তাই রেস্টুরেন্টে যেতে হবে৷”

আমি স্পৃহার এমন কথা শুনে বললাম।

“আপনি আপনার বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাবেন। আমাকে কেন যেতে হবে? আপনাদের মধুর মিলনের মাঝে আমি শুধু শুধু দর্শক হতে চাই না।”

তখন স্পৃহা ধমকের সুরে বলল।

“যেতে হবে আপনাকে,দরকার আছে।”

তাঁর কথার প্রতি উত্তরে তাকে বলতে চাইলাম।

“কে আপনি? আমার কে হন? এভাবে আমাকে ধমক দেওয়ার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে?”

কিন্তু বলতে পারলাম না। কারণ সে তখন চলে গিয়েছে।

পরের দিন রেস্টুরেন্টে দেখা করতে গিয়ে যা দেখলাম সেটা যেন বিশ্বাসই করতে পারলাম না। এই ছেলে কি তাহলে স্পৃহার বয়ফ্রেন্ড? আমি তো এই ছেলেটাকে চিনি। হাইস্কুল জীবনে পাঁচ পাঁচটা বছর একসাথে পড়েছি। আজ প্রায় সাত বছর পরে তাকে দেখলাম আমি। তবে এতদিন পরে দেখলেও চিনতে কোন কষ্ট হয়নি। সে কি আমার অতীতের বদনাম গুলোর কথা জানে? তাহলে কি আবার আমি এই দুজনের মানুষের কাছে খারাপ মানুষ হিসেবে নতুন করে পরিচিত হব? নাকি এতদিন পর আমাকে আমার বন্ধুটা চিনতেই পারবে না।

চলবে…………
চলবে…………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here