মোনালিসা পর্ব ২৭

মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-২৭
প্রিয়মের প্রশ্ন লিলি বেগম’কে খানিক ভাবালো। লিলি বেগম জানে ইমরুল চৌধুরী খুন হয়েছে। মোনা’কে জিজ্ঞেস করেছিল,’কিভাবে খুন হয়েছে?’। মোনা উত্তর দেয় নি, এড়িয়ে গেছে। লিলি বেগম মোনার শোক বাড়াতে চায়’নি। তাই জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করেনি।লিলি বেগম উদ্বেগপূর্ণ গলায় বলল,
-“আমি জানি না, শুধু জানি খুন হয়েছে।”
প্রিয়ম কিছু’টা অবাক হয়ে বলল,
-“এটা কেমন কথা?তুমি ও’কে জিজ্ঞেস করো নি?”
-“জিজ্ঞেস করেছি কিন্তু তত জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করে নি। তাছাড়া ওঁর বাবার সাথে ওঁদের সম্পর্ক ভালো ছিলো না, আর আমিও ইমরুল চৌধুরী’কে পছন্দ করতাম না। তাই জানার তেমন আগ্রহ জাগে নি।”
প্রিয়মের ফোন আসলো। বারান্দায় গিয়ে ফোনে কথা বলে রুমে আসলো। মোনা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। প্রিয়ম কয়েক বার তাকালো মোনার দিকে। লিলি বেগম কে বলল,
-“আম্মু ওঁর খেয়াল রেখো, আমার একটা জরুরী ফোন এসেছে।”
প্রিয়ম বের হয়ে যায়। লিলি বেগম গিয়ে মোনার শয্যার পাশে বসে। বার বার নিচু স্বরে মোনা, মোন বলে ডাকে। কয়েক বার ডাকার পর মোনা ক্ষীণ গলায় শুধু হুম বলল। লিলি বেগম বিরামহীন ভাবে প্রশ্ন করে যাচ্ছে। কোন প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেলো না। মোনার শরীরের সব শক্তি যেন ফুরিয়ে গেছে। অবশিষ্ট থাকা শক্তি টুকু জড়ো করে বলল,
-“খালা নিশানের দিকে খেয়াল রেখো।”
নিশান খাট থেকে দুই-তিন হাত দূরে রাখা সোফার উপর বসে আছে। নিশানের চোখে মুখে আতংকের ছাপ। শূন্য দৃষ্টিতে বার বার তাকাচ্ছে এদিক-ওদিক। মোনার অসুস্থতায় অসহায় হয়ে পড়ল নিশান। বার বার চোখের কোণে জমা পানি টুকু হাতের তালু দিয়ে মুছছে।
____
জ্যাক কয়েক দিনের জন্য সিঙ্গাপুর গিয়েছিলো। জ্যাক হুট করেই গেলো। তাই মোনা’কে যাওয়ার আগে বলা হয়ে ওঠে নি। সিঙ্গাপুর গিয়ে কয়েকবার কল দিয়েছে মোনার কাছে, ফোন অন অথচ রিসিভ করল না।‌ জ্যাকের খানিক’টা রাগ হলো। ব্যারিংটন ফিরে জ্যাক বাসায় গেলো। মোনা এই কয়েকদিনে একবারও ফোন দেয় নি, কোন যোগাযোগ করেনি জ্যাকের সাথে। এমন আগে কখনো হয়নি। জ্যাক বাসায় ফিরে ক্লান্ত হয়ে খাটে গা এলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ বাদে কাজের লোক’কে ডাকল। দরজার কাছে তাঁর উপস্থিতি বুঝতে পেরে দরজার দিকে না তাকিয়েই বলল,
-“আমি যাওয়ার পর মোনালিসা এসেছিলো একবারও?”
-“নো স্যার।”
জ্যাক হতাশ হলো। প্রিন্সেস’কে কোলে নিয়ে চুমু খাচ্ছে। প্রিন্সেস এখন আদো আদো গলায় ফাদার ডাকে। জ্যাকের মন প্রাণ প্রশান্তি’তে শীতল হয়ে যায়। জ্যাক প্রিন্সেসের দিকে তাকিয়ে আপন মনে বলল,
-“মোনালিসা তোমায় দেখতে একবারও আসলো না?”
প্রিন্সেস যেন জ্যাকের কথা বুঝতে পারলো। কেঁদে উঠলো প্রিন্সেস। জ্যাক উচ্চস্বরে হেসে দেয় প্রিন্সেসের কান্না দেখে, কি অদ্ভুত ব্যাপার! প্রিন্সেস মুখাবয়ব দেখে মনে হলো ও মানুষের কথা বুঝতে পারেন। প্রিন্সেস হয়ত অন্য কারণে কেঁদেছে। জ্যাক নিজের মত একটা ব্যাখ্যা খুঁজে নিলো।
জ্যাক কতক্ষণ ধরে মোনার দরজার কলিংবেল‌ বাজিয়ে যাচ্ছে ভিতর থেকে কোন সাড়া দিচ্ছে। ভিতরে মানুষ আছে অথচ সাড়া দিচ্ছে না। জ্যাকের কপালে ভাঁজ পড়লো বিরক্ত’তে। একটু পরে লিলি বেগম দরজা খুলে দিলো।‌ জ্যাক অস্থির গলায় বলল,
-“মোনা আছে বাসায়?”
এর থেকে বেশি কিছু লিলি বেগমের কাছে জিজ্ঞেস করতে পারলো না। লিলি বেগম কে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। কোন বিষয়ে গভীর ভাবে চিন্তিত মনে হচ্ছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর গলায় বলল,
-“আছে, ভিতরে আসো।”
লিলি বেগমের আচরণ, মোনার ফোন না ধরা, প্রিন্সেস’কে দেখতে না যাওয়া সব কিছু মিলিয়ে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে, স্বাভাবিক নিয়ম ভঙ্গ হয়েছে। এমন কখনো হয়না। এমন চিন্তা করতে করতে জ্যাক বাসার ভিতরে যায়।
মোনার চুল গুলো উস্কখুস্ক হয়ে আছে, চোখে মুখে তীব্র বিষাদের ছায়া। চোখের নিচে লেপ্টে কাজল দিয়েছে যেন। মুখ পাণ্ডুর আর শীর্ণ। চেহেরায় কোন লাবন্যতা নেই, যেন নিস্তেজ একটা শরীর বিছানায় মিশে আছে। জ্যাক চমকে উঠল।প্রবল ভাবে উদ্বিগ্ন, উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“মোনালিসা,কি হয়েছে আপনার?আপনি অসুস্থ?কি হলো আপনার হঠাৎ?”
জ্যাক আঁতকে উঠে ঢোক গিলে । পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“আপনি অসুস্থ আপনি হসপিটালে না গিয়ে বাসায় কেন? আমায় কেন বলেন নি এসব? আরে আপনার কি হাল হয়েছে!”
লিলি বেগমের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো জ্যাক। লিলি বেগম একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। জ্যাক উতলা হয়ে প্রশ্ন করল,
-“আপনারা উনাকে হসপিটালে কেন নেন নি?হোয়াট দ্যা হেল!”
-“জ্যাক ওঁর হসপিটালে নেওয়ার মত অসুখ হয়নি। ওঁর বাবার মৃত্যুর সময় ও ভয় পেয়েছে, সেই ভয় নতুন করে নাড়া দিয়েছে। মোনা মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”
-“তাহলে সাইকিয়াট্রিস্ট ডাকুন। মোনালিসা কেমন হয়ে গেছে! কথা বলছে না।’
সাইকিয়াট্রিস্টের কথা শুনে মোনার নিস্তেজ শরীরে যেন রাগের হুতাশনের সৃষ্টি হলো। মোনার স্তব্ধ হয়ে যাওয়া গলায় যেন তেজ ফিরে এলো। মোনার ক্ষীণ হওয়া গলায় যেন তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। কঠিন স্বরে বলল,
-“সাইকিয়াট্রিস্টের কোন দরকার নেই, দ্বিতীয় বার এ কথা বললে খারাপ হবে খালা।”
মোনা শুদ্ধ বাংলায় বলল। লিলি বেগম বুঝলেও, জ্যাক নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মোনা কথা বলেছে ভেবে খুশি হলো জ্যাক, কিন্তু কি বলেছে তা বুঝতে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো লিলি বেগমের দিকে। লিলি বেগম ইংরেজি’তে বলে বুঝালো জ্যাক’কে। জ্যাক বলল,
-“মোনালিসা আপনি কি বলছেন এসব নির্বোধের মত? প্লীজ আপনি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করুন।”
মোনা আর কোন কথা বলল না। মোনা চোখ মেলেই তাকায় না। চোখ মেলে তাকালেই ইমরুল চৌধুরী’কে দেখে। ক্ষত -বিক্ষত লাশ’টা দেখে। গলার ভয়ঙ্কর আঘাত’টা হাঁ করে আছে যেন। জ্যাক পুনরায় বলল,
-“মোনালিসা আমি জ্যাক, চোখ খুলুন।”
মোনার কর্ণপাত হয় না। জ্যাকের কোন কথাই যেন শুনতে পারছে না, কোন প্রতিক্রিয়া নেই। কথার বিপরীতে মুখের অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়’না। মুখ’টা আগের ন্যায় বিষদময়’ই থাকে। জ্যাক লিলি বেগমের দিকে তাকিয়ে আবার বলল,
-“আমি সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে কথা বলব শীঘ্রই।”
মোনা রাগে চিৎকার দিয়ে উঠে। আর্তনাদ করে বলে,
-“আমার কানের কাছে বসে কথা বলেন না, আমার বিরক্ত লাগছে। আমায় একটা থাকতে দেন। আমি আপনা-আপনি সেরে উঠবো।”
জ্যাক বুঝতে পারে মোনা মানসিক ভাবে প্রচণ্ড বিপর্যস্ত। মোনার কথায় জ্যাকের তাই রাগ হয় না। বরংচ সহানুভূতি প্রকাশ পায়। জ্যাক অনেকক্ষন ধরে বসে থাকে। কয়েক ঘণ্টা বসে রইলো। বাসার ভিতরে পিনপতন নীরবতা। বাসার পরিবেশ’টা কেমন ভারি হয়ে ওঠে। জ্যাক গভীর মনোযোগে মোনা’কে নিরীক্ষণ করছে। গাঢ় এই নিঃশব্দ’তা ভেঙে জ্যাক বলে বলল,
-“মোনালিসা ভয় পেয়েছে সত্যি, কিন্তু ভয়ের চেয়ে কয়েক গুন বেশি ডিপ্রেসনে ভুগছে।‌‌‌‌‌উনার ভয় কেটে গেছে। উনার জীবনে এমন কিছু একটা ঘটেছে যা উনা’কে প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায়। উনার জন্য সাইকিয়াট্রিস্টের দরকার নেই। মোনালিসার সুস্থতা উনার নিজের উপর নির্ভর করছে, উনি উনার মন’কে স্ট্রং করতে পারলেই সেরে উঠবে। সাহস জোগাতে হবে‌ শুধু।”
জ্যাকের কথা গুলো দুর্বোধ্য মনে হলো লিলি বেগমের কাছে। ভ্রু কুঁচকে তাকালো জ্যাকের দিকে। মোনার কিসের ডিপ্রেসন?বাবা খুন হওয়ার পরের দিন যে মেয়ে আমেরিকা চলে আসতে পারে, ডিপ্রেসন কথা’টা যেন তাঁর সাথে বেমানান।‌‌‌‌‌‌ তাছাড়া এত গুলো দিন পর কেন এত ডিপ্রেসনে ভুগবে নতুন করে? লিলি বেগম বলল,
-“না, না জ্যাক। তুমি ভুল ভাবছো।”
জ্যাক জোর গলায় বলল,
-“আমি সঠিক ভাবছি। আমি সাইকিয়াট্রিস্ট না হলেও, একজন ডাক্তার। ডাক্তারি ছেড়ে ব্যবসা ধরেছি। তাই বলে অভিজ্ঞতার খাতা শূণ্য হয়ে যায়নি। আপনি মোনার কাছে জিজ্ঞেস করুন।”
মোনার চোখ বুঁজে জ্যাকের বলা প্রতি’টা কথা শুনছে। জ্যাকের বলা কথা গুলো সত্যি। এই সত্যি মোনা কারো কাছে স্বীকার করবে না,কখনো না।
জ্যাক মোনার হাত চেপে ধরল, আবেগে কিংবা অনুরাগে নয়। আশ্বাস,ভরসা দিতে।
-“বি স্ট্রং মোনালিসা। আমি সর্বদা তোমার পাশে থাকব।”
মোনা ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
-“থ্যাংক্স জ্যাক।”
জ্যাক একটু হাসলো। লিলি বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“মোনালিসা প্রথমে ভয় পেয়েছে, ভয় থেকে ডিপ্রেসন।”
জ্যাক কিছুক্ষণ বাদে চলে গেলো।জ্যাক’কে নিয়ে নানান প্রশ্ন জাগছে লিলি বেগমের মনে। লিলি বেগমের মনে হলো জ্যাক’ই একমাত্র মানুষ যে মোনা’কে শতভাগ বুঝে। জ্যাক আর মোনার মাঝে সম্পর্ক নিয়েও লিলি বেগম দ্বিধান্বিত।

মোনা এখন দিনের বেলায় ভয় পায় না। চিৎকার করে উঠে না। নিশান সব সময় মোনার একটা হাত ধরে পাশে বসে থাকে। মোনা চিন্তিত ভঙ্গিতে শুধু শুয়ে থাকে। লিলি বেগম খাবার নিয়ে এসে মোনার পাশে বসে। মোনার মুখে একবার তুলে দিচ্ছে খাবার, আরেকবার নিশানের মুখে। এর ভিতর লিলি বেগমের ফোন বেজে ওঠে। হাবিব সাহেব ফোন দিয়েছে। লিলি বেগম ফোন রিসিভ করে। ওপাশ থেকে কর্কশ গলায় বলে,
-“আমার সংসার করার ইচ্ছে আছে তোমার? যদি ইচ্ছে থাকে বাসায় আসো এখুনি। আমি প্রয়োজনীয় কাগজ পাচ্ছি না। সব কিছু তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম।”
হাবিব সাহেবের চিৎকারে লিলি বেগমের কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হলো। শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে কথা গুলো বলছে হাবিব সাহেব। লিলি বেগম একটা ক্ষীণ শ্বাস ফেলে নিচু গলায় বলল,
-“আসছি আমি।”
মোনার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আমার বাসায় যেতে হবে, আবার আসবো।”
লিলি বেগম চলে যাওয়ার পর নিশান খাবার প্লেট হাতে নিয়ে মোনার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে। মোনার চোখ ভিজে এলো কেন জানি। এর থেকে সুন্দর দৃশ্য বুঝি হয় না আর।
_____
বিকালের দিকে প্রিয়ম আসে। নিশান দরজা খুলে দেয়। প্রিয়ম মোনার পাশে বসে। মোনার একটা হাত আলতো করে ধরল। মোনা হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল না।
-“বেটার ফিল হচ্ছে আগের থেকে?”
মোনা মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলে। প্রিয়ম গভীর চিন্তিত মুখে বলল,
-“মোনা তুমি কি নিয়ে চিন্তিত এত?কিসের জন্য এত ভয় পাচ্ছো?”
মোনার কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। প্রিয়ম পুনরায় জিজ্ঞেস করল। মোনা বিরক্ত হয়ে বলল,
-“আমি এখন সুস্থ।”
-“তুমি যখনই আমার সাথে খারাপ বিহেভ করবে , আমি তখনই বুঝবো তুমি সুস্থ হয়েছে। তুমি এখন অসুস্থ বলে আমায় কিছু বলছো না।”
মোনা প্রিয়মের দিকে তাকায়। প্রিয়মের কথায় প্রথমে খানিক’টা বিরক্ত হলেও পরে কি ভেবে যেন হেসে দিলো। প্রিয়ম মোনা কাছে বসা,খুব বেশী দূরত্বে না। মোনার হাত আঁকড়ে ধরে আছে। মোনার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মোনা অস্বস্তি বোধ করে, কেন জানি মোনার শ্বাস রুদ্ধ অবস্থা হয়েছে। বুকের ভিতর হাতুড়ি পেটা করছে যেন কেউ, দুরুদুরু করতে থাকে বুকের মাঝে।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here