মোনালিসা পর্ব ২৮

মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-২৮
চারদিকে ঘন অন্ধকারে আচ্ছন্ন।যেদিকে তাকায় দৃষ্টি ঘন অন্ধকারে হারিয়ে যায়।রাত দুইটা কি তিনটা হবে তখন। মোনার ঘুম ভেঙ্গে যায়। মোনার পাশেই শুয়ে আছে লিলি বেগম। নিমীলিত নেত্রে পিটপিট করে তাকায়। কয়েকদিন বিছানায় মুমূর্ষু রোগীর ন্যায় শুয়ে থাকতে থাকতে মোনা হাত-পায়ের সব শক্তি যেন হ্রাস পেয়েছে। মোনা স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছিল, দুই দিনের ব্যবধানে ভয় কেটে গেলেও মোনা দুশ্চিন্তা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেনি। মোনার অনিচ্ছাকৃত ভাবেও দুশ্চিন্তা, বিষন্নতা ,বিমর্ষতা মোনার স্কন্ধে চেপে বসেছিল। মোনার মাথায় সারাক্ষণ সেসব আন্দোলিত হতো আর মোনা বিষাদের আগুনে দগ্ধ হতো। মোনা ধীর পায়ে খাট থেকে নামে। মোনার হাত-পা ঈষৎ কাঁপছে,মাথার ভেতর চক্কর দিচ্ছে।‌ টানা কয়েকদিন বিছানায় থাকায় এমন হয়েছে। শক্তিহীন পায়ে এলোমেলো ভাবে পায়ে হেঁটে বারান্দায় গিয়ে বসে মোনা। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে,’সে রাতে কেন অত ভয় পেয়েছিল?’ এখন ভয় করছে না কেন?’ মোনার মাথা ঝিমঝিম করে। মোনার কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয়নি, মোনা সবার সব কথা শুনতো।‌ কিন্তু উত্তর দেয় নি, কি যেন হয়েছিল। মোনার মনে হয়েছে ভিতর থেকে কেউ একজন বাঁধা দিচ্ছে মোনা’কে কথা বলতে।
প্রিয়ম কয়েকবার মোনার কপালে চুমু খেয়েছে, মোনার চুলে হাত ডুবিয়ে বিলি কেটেছে, মোনার চুলে নাক ডুবিয়ে ঘ্রান নিয়েছে, মোনার হাত গভীর আবেগে চেপে ধরেছে। মোনার মাঝে মাঝে মনো হতো ওঁর চোখে-মুখে কারো গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পরছে। মোনার চোখ খুলে তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে হতো‌ না কে ওঁর পাশে, মোনা জানে প্রিয়ম। প্রিয়ম মোনার শয্যার পাশে বসে খুব কাছ থেকে দেখতো মোনা’কে।
মোনার চুল গুলো জট পাকিয়ে আছে, কতদিন আঁচড়ায় না চুল। মোনা সব চিন্তা ভাবনা থেকে বের হয়ে আসতে চায়, স্বাভাবিক হতে চায়। কিন্তু পারছে না কিছুতেই। মোনা বারান্দার মেঝেতে বসে থাকে। বার বার দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হয়ে আসছে। আর পাঁচ’টা মানুষের মত সুস্থ, স্বাভাবিক একটা জীবন কেন হলো না? মোনার চোখ বেয়ে বেদনা অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে।মোনা ঠিক করেছে কাল থেকে ভার্সিটি’তে যাবে,অফিসে যাবে।‌ বাকী রাত’টা বারান্দায়ই কাটিয়ে দেয়।
ভোরের আলো ফোটার আগেই আগেই লিলি বেগম উঠে ঘুম থেকে‌‌ নামাজে উদ্দেশ্য। পাশের বালিশ’টা খালি। মোনা’কে না দেখে মুহুর্তেই মনে ভিতর নানান শঙ্কার তৈরি হয়। অস্থির হয়ে ছুটে বাসার এদিক ওদিক তাকায়। মোনা’কে বারান্দায় দেখে খানিকটা রাগি গলায় বলে,
-“তুই এখানে কখন এসেছিস?এখানে কাজ কি?”
মোনা লিলি বেগমের দিকে চোখ তুলে তাকায়। মোনা চোখে হারালেই লিলি বেগমের মনে নানান শঙ্কার তৈরি হয় যেন। অস্থির হয়ে উঠে চিন্তায়।মোনা আস্তে করে বলে,
-“একটু আগে এসেছি খালা, নামাজের ওয়াক্ত যায়। তুমি নামাজ পড়ো।”
লিলি বেগম ওযু করে নামাজে দাঁড়ায়। মোনা বারান্দা থেকে উঠে কিচেনে যায়। কত দিন বাদে এসেছে কিচেনে! কত দিন বাদে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখেছে চারপাশ। মোনা রুটি বানায়। লিলি বেগম নামাজরত অবস্থায় শুনতে পায় কিচেনে শব্দ হচ্ছে। মোনা কিচেনে গিয়েছে? লিলি বেগম চমকালো মনে মনে। এসব ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে নামাজে মনোযোগী হয়।
লিলি বেগমের নামাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে মোনার নাস্তা বানানোও শেষ। লিলি বেগম কিচেনে এসে বিস্মিত চোখে তাকায় মোনার দিকে।
-“মোনা তুই ঠিক আছিস তো?তুই হঠাৎ কিচেনে?”
মোনা নিজের কাজে ব্যস্ত থেকে লিলি বেগমের দিকে না তাকিয়েই স্বাভাবিক গলায় প্রত্যুত্তর করল,
-“কেন কিচিনে আসলে কি?”এইটুকু বলে থেমে একটু দম ফেলে বলল,
-“খালুর সাথে এখানে থাকা নিয়ে তোমার তো তুমোল তুলকালাম কাণ্ড।বাসায় চলো যাও।”
লিলি বেগম অবিশ্বাস্যর সুরে বলল,
-“এই মোনা হঠাৎ কি হলো তোর বল তো আমায়?তোর আচরণ তো স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।”
মোনা একটু বিরক্ত বোধ করল যেন এত প্রশ্নে। উত্তর না করে চুলার আগুনের দিকে অকারণে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে। লিলি বেগম ফের একই প্রশ্ন করলো। মোনা তাৎক্ষণিক উত্তর না দিয়ে, আগের মত গম্ভীর হয়ে আছে। খানিক বাদে ভারি গলায় বলল,
-“আহা খালা আমি অসুস্থ ছিলাম, এখন সুস্থ।আর তুমি কি সারা বছর আমার বাসায় থাকবে? তোমার তো সংসার আছে।”
লিলি বেগম সরু চোখে তাকালো। ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে বলল,
-“তুই হঠাৎ সুস্থ হয়ে গেলি?তাহলে জ্যাক’ই ঠিক বলেছে।”
মোনা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায়।কপালে ভাঁজ পড়ে।
-“কি বলেছে জ্যাক?”
-“তোর সুস্থ হওয়া তোর উপর নির্ভর করে। তুই তোর মন’কে স্ট্রং করতেই পারলেই সেরে উঠবি।”
মোনা বিরক্ত’তে মুখ কুঁচকায়।লিলি বেগমের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
-“খালা জ্যাক মানসিক ভাবে অসুস্থ কয়েক বছর ধরে। বলতে পারো আধ পাগল। কিন্তু কেউ বুঝতে পারে না। জ্যাক বাসায় আসলে পরবর্তী’তে আড্ডা জমাতে যেয়ো না। মাঝে মাঝে কিন্তু পাগলাটে হয়ে যায়। মানুষের গায়ে হাতও তুলে।”
জ্যাকের সম্পর্কে এমন চঞ্চলকর তথ্যে লিলি বেগম হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। যেন বিশ্বাস করতে পারে না। জ্যাকের সম্পর্কে এতদিনের সব ধারণা মিছে হয়ে যাওয়ার খানিক দুঃখ পেলো যেন। রাজ্যের বিস্ময় গলায় এনে বলে,
-“বলছিস কি তুই?আমি তো এতদিনে বুঝতে পারি নি। তুই আগে কেন বলিস নি।”
মোনা উত্তর না দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মনে মনে প্রচণ্ডভাবে হাসছে মোনা, কিন্তু বাহিরে গুরুগম্ভীর। কত বছর পর জোকস করেছে।
____
মোনার স্বাভাবিক আচরণ দেখে লিলি বেগম বাসায় চলে যায়। কয়েকদিন ধরে আগের তুলনায় অনেক খারাপ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে হাবিব সাহেবের সাথে। লিলি বেগম ওসব পাত্তা দেয় না, কয়েক বছরে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু মাঝে মাঝে কোন অবকাশে বুক চিঁড়ে বিষাদের সুর বেরিয়ে আসতে চায়।
মোনা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। পাক্কা আধা ঘন্টা লেগেছে। চুলের জট খুলতে গিয়ে চিরুনি ভরে চুল উঠে এসেছে। মোনা গোসল সারে। নিশান’কে ঘুম থেকে তুলে। ভারি গলায় বলল,
-“অনেক স্কুল ফাঁকি দিয়েছো।এবার উঠো।”
নিশান’কে টেনেহিঁচড়ে ঘুম থেকে তুলে। ঘুম ঘুম চোখে নিশান মোনার দিকে তাকিয়ে থাকে! নিশান’কে আগের মত নাস্তা খাইয়ে,রেডি করিয়ে স্কুলে পৌঁছে দেয়।‌‌‌‌ নিশানের স্কুল থেকে কিছুদূর আসতেই একটা কার এসে মোনার পাশে থামে।মোনা ফিরে তাকায়। কার থেকে প্রিয়ম নেমে প্রবল অবিশ্বাস্যর দৃষ্টিতে তাকায়। প্রিয়মের চোখ-মুখ উপচে বিস্ময়ের রশ্মি নির্গত হচ্ছে যেন।
-“মোনা তুমি?তুমি ভার্সিটি তে যাচ্ছো? তুমি সুস্থ হয়ে গেছো।”
মোনা ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল,
-“এত প্রশ্ন করলে কোন’টার জবাব দিবো?” এই বলে থেমে আবার বলে,
-“হ্যাঁ আমি মোনা,আমি ভার্সিটি’তে যাচ্ছি, আমি সুস্থ হয়ে গেছি। কাল আমি অসুস্থ ছিলাম বলে আজ আমি সুস্থ হতে পারবো না?”
প্রিয়ম ভারি গলায় বিড়বিড় করে বলল,
-“অদ্ভুত ব্যাপার তো।”
মোনা হেসে উঠে। এভাবে হাসতে মোনা’কে খুব কম দেখেছে। মোনা রসহ্যময় ভঙ্গিতে বলল,
-“সুস্থ হওয়ার জন্য মনোবল’ই যথেষ্ট।”
-“আচ্ছা..আচ্ছা বুঝেছি,চলো ভার্সিটি’তে পৌঁছে দিই।”
মোনার মুখের হাস্যউজ্জ্বল ভাব গায়েব হয়ে গেলো। কঠিন স্বরে বলল,
-“আমি একা যেতে পারবো আপনি যান।”
প্রিয়ম এমন আচরণ আশা করেনি। ভেবেছে মোনার সাথে সম্পর্ক কিছু’টা হলেও উন্নত হয়েছে। প্রিয়ম বজ্রাহত হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। তারপরও কয়েক বার সাধলো মোনা’কে। একই প্রত্যুত্তর করলো মোনা।প্রিয়ম জোর করল না। আগে জোর করা’টা মানাতো, প্রিয়মের মনে হয় এখন জোর করা বেমানান।

জ্যাক দিনে কয়েকবার ফোন দিয়ে মোনার খোঁজ নেয়। মোনার সুস্থতা জ্যাক’কে প্রশান্তি দিলো যেন।
প্রিয়ম ভেবেছিল সুস্থ হয়ে ওঠার পর হয়ত সম্পর্ক’টা কিছু’টা হলেও উন্নতি হবে কিন্তু তা কিছুই হলো না। প্রিয়ম হতাশ হলো। প্রিয়ম একদিন খুব সকালে মোনার বাসায় আসলো। মোনা তখন ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হচ্ছে।
-“তুমি আমার ফোন কেন রিসিভ করছো না মোনা?”এই টুকু বলে থেমে আবার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলল,
-“আচ্ছা কি করলে তুমি আমায় ভালোবাসবে বলবা? আমার প্রতি সামান্য সহানুভূতি জাগে না?”
মোনা সহজ গলায় বলল,
-“জাগে মাঝে মাঝে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় আপনায় ভালোবাসি কিন্তু আমার ভিতরে এক সত্ত্বা আছে, যে প্রেম-ভালোবাসার বিরুদ্ধে। যে কারো মায়াজালে আবদ্ধ হওয়ার পক্ষে না।”
মোনা এক অভাবনীয় উত্তর দিলো। কোন ভনিতা করলো না। কিছুক্ষণ পর আবার বলল,
-“ভালোবাসার প্রতিদানে সবারই ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু আমার ইচ্ছে যে নিয়ন্ত্রণ করে সে ভালোবাসা বিদ্বেষী।”
প্রিয়ম অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। এত সহজ স্বীকারোক্তি প্রিয়ম আশা করে নি। প্রিয়ম অসহায় গলায় বলল,
-“আমি প্রতিনিয়ত কোন শূন্যতায় ভুগছি। অসহ্য যন্ত্রণা আমায় তাড়া করছে। মোনা আমায় এসব থেকে মুক্তি দেও। একতরফা ভালোবাসা যে কত তীক্ষ্ণ যন্ত্রনার তা তুমি বুঝো?”
-“আমি বুঝতে চাই না। আপনি চলে যান এখন।”
হঠাৎ কি যেন হয়ে গেলো প্রিয়মের। প্রিয়মের চোখ টলমল করছে।‌ এত চেষ্টা করে ও ব্যর্থতা,এত অবজ্ঞা যেন চোখের জল হয়ে টলমল করছে। মোনা তাকালো নির্বাক দৃষ্টিতে একবার সেদিকে। সকল বাধা উপেক্ষা করে নির্লজ্জের মতো দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।
মোনা বজ্রাহত হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে। এই চোখের পানি যেন স্বচ্ছ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। মোনার ভিতরে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। মোনার চোখের দৃষ্টি প্রিয়মের গাল বেয়ে পড়া পানি দুই ফোঁটার দিকে নিবদ্ধ।
মুহূর্তের ব্যবধানে মোনার কি যেন হয়ে গেলো। ভালোবাসা বিদ্বেষী ভাব’টা যেন পরাজিত হয়ে গেলো। কি হবে কি না হবে ভেবে মোনা ছুটে গিয়ে প্রিয়ম’কে জড়িয়ে ধরলো।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here