মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৫
জানালার কাঁচ ভেদ করে সরু একখন্ড আলো এসে পরে মোনার মুখ বরাবর। জানালার পর্দা গুলো মৃদু বাতাসে উড়ছে। হালকা ঠান্ডা বাতাস আসছে। মোনার ঘুম ভেঙ্গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। কিন্তু চোখ মেলে তাকাতে ইচ্ছে করছে না। রাতে ঘুম হয় না ভালো। যার মস্তিষ্ক এত চিন্তাগ্রস্থ,তার চোখে ঘুমের অনুপস্থিতি স্বাভাবিক। সদ্য এইচএসসি করা মেয়ে মোনা অথচ পরিস্থিতি তাঁকে কত পরিপক্কতা লাভ করিয়ে দিয়েছে। মোনা আরমোড়া দিয়ে উঠে বসল। চুল গুলো এলেমেলো হয়ে আছে ভীষণ ভাবে। মোনা উঠে ওয়াশরুমে যায়। ফ্রেশ হয়ে এসে গায়ে চকলেট কালারের একটা সোয়েটার চাপায়।আজ প্রচন্ড শীত শীত করছে। ব্যাগ থেকে একটা চাদর বের করে নিশানের গায়ে দিয়ে দেয়। নিশান এখনো ঘুমাচ্ছে। মোনা আদুরে ভঙ্গিতে নিশানের মাথায় হাত বুলায়। এ বাসার কারোই ঘুম ভাঙেনি এখনো। প্রিয়ম আর এরিক কে দুপুর বেলা সদ্য ঘুম ভাঙা অবস্থায় ব্রাশ হাতে দেখা যায়।
মোনার শরীরটা খারাপ করেছে একটু। কিছুক্ষণ পর আবিষ্কার করলো গলার টনসিল ভীষণ ভাবে ফুলে উঠেছে। গরম কিছু খাওয়া দরকার।মোনা কিচেনে যায়। এক কাপ কফি বানায়। রুমে এসে গলায় মাফলার পেঁচিয়ে রাখে।
হাবিব সাহেবের গলা শুনা গেলো। প্রচন্ড চিৎকার, চেঁচামেচি করছে। খানিক বাদে লিলির গলার আওয়াজও শুনা গেল। মোনা চতিক হরিনের মত কান খাঁড়া করে রাখে। কিন্তু স্পষ্ট বুঝা গেলো না। মোনার কেন জানি মনে হচ্ছে ওঁদের কারণে হাবিব সাহেব লিলির সাথে চেঁচামেচি করছে। মোনা নিঃশব্দে রুমের কাছে যায়। বিশ্রী ভাবে গালি দিচ্ছে হাবিব সাহেব লিলিকে। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারে ঝগড়া কারণটা আসলেই ওঁরা। কষ্টে মোনা লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে। ছোট বেলায় খুব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কাঁদত মোনা, কিন্তু এখন ভীষণ কষ্টেও কাঁদতে পারে না। কেন জানি কান্না আসে না, সব কিছু সয়ে গেছে। সব কিছু এখন মোনার স্বাভাবিক মনে হয়।যেন এটাই হওয়ার ছিলো।
মোনা ওখানে আর না দাঁড়িয়ে ওর রুমে চলে যায়। গল্প, উপন্যাসের বই ঘাঁটাঘাঁটি করে কিন্তু মন বসে না। উদাসীনতা মোনার কাঁধে চেপে বসেছে যেন। এক সময় হাবিব সাহেব অফিসে চলে যায়। চেঁচামেচি বন্ধ হয়ে যায়। মোনা বিষন্ন মনে বসে থাকে।
হাতে একটা ব্রাশ, পড়নে প্রতিদিন কার মত একটা থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট, গলায় তোয়ালে ঝুলানো অবস্থায় প্রিয়ম এসে মোনার পাশে দাঁড়ায়। আচমকা কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে মোনা চমকে উঠে। পিছনে তাকিয়ে দেখে প্রিয়ম।ওইদিনের ঘটনার পর প্রিয়ম’কে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে মোনা। প্রচন্ড বিরক্ত লাগে প্রিয়ম’কে। মোনার বুঝতে পারে এঁরা সব সিক মেন্টালিটির। বিবেক বোধ, শুদ্ধ আবেগ, এঁদের ভিতর নেই। এঁরা সব যান্ত্রিক, অস্বাভাবিক, মানসিক ভাবে অসুস্থ। আন্তরিকতা নেই। মোনা বিরক্ত ভাব চাপিয়ে রেখে ম্লান হেসে বলে,
-“প্রিয়ম ভাই আপনি?”
-“তোমাদের দুই ভাই বোনের জন্য একটা গিফট আছে। তোমরা চকলেট খাও তো?আমার তরফ থেকে না, তোমার খালার তরফ থেকে।”
মোনা মনে মনে বিদ্রুপ করছে। প্রিয়মের শুধু নীল চোখ মোনার ভালোলাগে, এছাড়া সব অসহ্য লাগে।মোনা কোন উত্তর দেয়না। প্রিয়ম বলে,
-“ওয়েট আসছি।”
প্রিয়ম ফ্রেশ হয় নেয়। তারপর একটা চকলেট বক্স হাতে নিয়ে মোনার রুমে আসে। মোনার হাতে বক্সটা ধরিয়ে দিলো। মোনা সৌজন্যমূলক ধন্যবাদ দেয়। প্রিয়ম উৎকন্ঠিত হয়ে বলল,
-“মোনা তুমি কিন্তু অসম্ভব রকমের সুন্দরী। আমার এক বন্ধু তোমায় দেখেছে ওইদিন। আমাদের বাসায় এসেছিল যে বন্ধুটা! তোমায় দেখে কি বলেছে জানো?”
মোনা সংশয় ভরা গলায় বলে,
-“কি।”
-“তুমি নাকি ভীষণ হট।”
মোনার মুখ চুপসে যায়। চেহেরা মলিন হয়ে যায়। কিঞ্চিত লজ্জাও পায়। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে রুম থেকে বের হয়ে যেতে উদ্যত হয়। প্রিয়ম মোনার হাত টেনে ধরে। বলে,
-“এ্যাই মেয়ে এই কথাও রাগ করলে?উফ তুমি কোন প্রজাতির মেয়ে বলো তো! এখানকার মেয়েদের এসব বললে খুশিতে গদগদ হয়ে যায়,আর তুমি?”
-“প্রিয়ম ভাই! হাত ছাড়ুন আমার লাগছে। আপনাদের বাসায় থাকি বলি যা ইচ্ছে তাই বলবেন?”
এতদিন অনেক কথা সহ্য করলেও আজ রাগের মাথায় কথার স্রোতে অনেক কিছু বলে ফেলল মোনা। প্রিয়ম মোনার বলা এসব কথাতেও যেন ভাবলেশহীন! মোনার হাত আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
-“আর একটু রাগ করে কথা বলো না মোনা! তোমার রাগী লুক, রাগী ভয়েস,আমার নীল রঙা চোখের মত সুন্দর।”
প্রিয়ম উচ্চস্বরে হেসে উঠে এসব বলে। মোনা বিস্মিত হয়ে যায় এত নির্লিপ্ততা দেখে। কোন কথাই যেন কর্ণপাত হয়না।মোনা হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে।
-“এত অস্থির হচ্ছো কেন? এমন অস্থির হলে, জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে স্থির করে দিবো।”
মোনার শরীরের শিরায় উপশিরায় লজ্জা মিশ্রিত বাতাস বয়ে গেলো যেন। এসব কথার সাথে একদম অভ্যস্ত নয় মোনা। মোনা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
-“আমার হাত ভেঙে যাবে,এমন করছেন কেন আপনি?ছাড়ুন! নয়ত আমি খালাকে ডাকব।”
এই বলে মোনা একবাক খালা বলে ডাকতে না ডাকতেই প্রিয়ম ওর মুখ চেপে ধরে। মোনা মুখ থেকে প্রিয়মের হাত ছাড়ানোর জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করছে। এবার আর কোন লজ্জা, সংকোচ , সংশয় নয়,রাগে মোনার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। মোনা এক জাটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
-“খুব দুর্বল মনে করেছেন?এত দুর্বল মোনা নয়!”
তারপর একটু থেমে প্রিয়মের খানিকটা কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,
-“খুন চাপে মাঝেমাঝে আমার মাথায়। খুব বেশী বাড়াবাড়ি করছেন।”
প্রিয়ম মোনার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, প্রিয়মের মুখের অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছে মোনা কোন রোমান্টিক কথা বলেছে। প্রিয়ম আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রসিকতা করে বলে,
-“কি বলছো?খুন চাপে? তুমি তো ডেঞ্জারাসও বটে। রিয়েলি আই এম ইমপ্রেসড! মোনা আমি বোধ হয় তোমার প্রেমে পড়ে যাচ্ছি।”
এমন সিরিয়াস কথা এভাবে রসিকতায় উড়িয়ে দেওয়া! মোনা ভেবে পায়না কি বললে প্রিয়মের কর্ণপাত হবে। মোনার ভীষণভাবে রাগ হচ্ছে। মোনার হাতে প্রিয়মের আঙ্গুলে ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। হাতটা রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার বর্ন ধারন করেছে। যেন এক্ষুনি চামড়া ভেদ করে রক্ত বেরিয়ে আসবে।প্রিয়ম মোনার নাকটা আলতো ভাবে চেপে ধরে বলে,
-“রাগ করলে নাক চেপে রাখবে,নয়ত তোমার নাকের কাঁপুনি তে ভূমিধ্বস হবে।”
মোনা এক জাটকায় প্রিয়মের থেকে দূরে সরে গিয়ে রুমে ডুকে দরজাটা বিকট আওয়াজে বন্ধ করে দেয়।
চকলেটের বক্স থেকে কতগুলো চকলেট বের করে নিশান কে দেয়। প্রিয়মের উপর রাগ থেকে মোনার চকলেট খেতে ইচ্ছে করছে না। মোনার চোখে মুখে চাপা বিরক্তির ঝিলিক।
এরিক কে মোনার খুব বেশী অপছন্দ না। ছেলেটা শান্ত আছে। গলার স্বর একটু চিকন। চিকন গলায় মোনাপু,মোনাপু ডাকবে। সকালের হাবিব সাহেব আর লিলির ঝগড়ার বিষয়টা আবার মোনার মাথায় নাড়া দেয়।সকালের ঝগড়ার পর থেকে লিলি কে দেখছে না মোনা। রুম থেকে বের হয়নি বোধ হয়। লিলির রুমে যেতে মোনার সংকোচ হচ্ছে। ওঁদের জন্যই তো লিলি আর হাবিব সাহেবের মধ্যকার সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। তাই লিলির সামনে যেতে অস্বস্তি লাগে মোনার। মোনা জানালার ফাঁক দিয়ে দেখল এরিক,আর প্রিয়ম কার নিয়ে বের হচ্ছে। এখন নিশ্চিন্তে রুমের বাইরে যাওয়া যাবে। মোনা নিশান কে নিয়ে যায় লিলি বেগমের রুমে। লিলি বেগম খাটে শুয়ে আছে, চুল গুলো উস্কখুস্ক, মুখে ক্লান্তির ছাপ। মোনা আর নিশান কে দেখে, শোয়া থেকে উঠে বসলো। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
-“প্রিয়ম দিয়ে চকলেট দিয়ে এসেছিল?”
তারপর নিশানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-“নিশান চকলেট খেয়েছ?”
নিশান মাথা ঝাঁকায়। মোনা ঝগড়ার প্রসঙ্গটা তুলতে ইতস্তত বোধ করছে। সব অস্বস্তি যেন জেঁকে ধরেছে মোনা কে। মোনার চোখ মুখ দেখে বুঝা যায় যে মোনা কিছু বলতে চায়। লিলি বেগম বলল,
-“মোনালিসা কিছু বলবি?”
-“খালা, সকালে খালু তোমার সাথে ঝগড়া করেছে কেন? আমাদের জন্য না?”
লিলি একটু হাসলো। একটা দীর্ঘশ্বাস নিঃশ্বাস ফেলে মোনার হাত ধরে বলল,
-“শোন মোনা কিছু কথা বলি।”
-“বলো।”
-“তোদের তো এখন দূর্বিষহ সময় যাচ্ছে । খারাপ সময়ে দাঁত কামড়ে থাকতে হয় বুঝলি? অপমানজনক কথায় অপমান বোধ করতে নেই, তীব্র কষ্ট পাওয়ার মত কথায়ও কষ্ট পেতে নেই।”
মোনার বুক চিঁড়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হয়ে আসতে চায়। মোনা খুব গোপনে একটা ক্ষীণ নিঃশ্বাস ফেলল। পাণ্ডুবর্ণ হয়ে যায় মুখ। অপরাধ বোধ কাজ করছে কেন জানি।
____
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেলো।রাত হলেই মোনা যেন অসহায় হয়ে পড়ে। রাতের অন্ধকারে নিজের কাছে নিজে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। জীবনের হিসেব মিলাতে মিলাতে অর্ধেক রাত পেরুয়ে যায়। মোনা শুধু এপাশ ওপাশ করে। মোনার রুমের দরজায় টোকা পড়ে। এত রাতে কে? সেদিনের মত প্রিয়ম নয় তো? মোনা দরজা খুলে না। দরজা অনবরত নক করছে। মোনা ধীরে ধীরে খাট থেকে নেমে দরজার কাছে যায়। নিচু স্বরে বলল,
-“কে?”
জবাব না দিয়ে দরজা নক করেই যাচ্ছে। মোনা শেষে বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে দেখে প্রিয়ম দাঁড়ানো। মোনা ভীত হয়ে পিছনে সরে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। আজকেও কি নেশা করে এসেছে? প্রিয়মও মোনার দিকে এগুচ্ছে। মোনা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
-“প্রিয়ম ভাই।”
আবছা অন্ধকারে প্রিয়মের মুখাবয়ব স্পষ্ট বুঝা যায় না। তবে গলার স্বর শুনে মনে হয় , ঠোঁটর হাসি রয়েছে। প্রিয়ম চাপা গলায় বলল,
-“মাথায় খুন চাপা সাহসী মেয়েটা এত ভয় পাচ্ছে কেন?”
মোনা অপ্রতিভ ভাবে বলল,
-“আপনি এখানে কেন?”
প্রিয়ম এই আবছা অন্ধকারেও অকারণে মোনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কয়েক।সেকেন্ড। সহজ গলায় বলল,
-“নাইট ক্লাবে যাবে?চলো।
মোনা কপালে ভাঁজ পড়ে। মনে হলো ও ভুল কিছু শুনেছে। প্রিয়মের কথা উপেক্ষা করে বলল,
-“প্রিয়ম ভাই রুম থেকে যান। ঘুমাবো আমি।”
-“উঁহু না তুমি এখন আমার সাথে ক্লাবে যাবে।”
প্রিয়ম সিরিয়াসলি এসব বলছে নাকি মজা করছে মোনা বুঝে উঠতে পারলো না। মোনা ভ্রু কুঁচকে এই আবছা অন্ধকারে প্রিয়মের দিকে তাকালো কয়েক বার। প্রিয়ম মোনার হাত ধরে বলল,
-“চলো।”
প্রিয়মের ভাবভঙ্গি দেখে মোটেও মনে হলোনা যে ও মজা করছে। মোনা হতভম্ব হয়ে কিছু’টা আতঙ্কিত গলায় বলল,
-“হোয়াইট দ্যা হেল!আমি কেন নাইট ক্লাবে যাবো।”
-“আমি বলছি তাই যাবে। অনেক মাস্তি হবে। একদিন গেলে প্রতিদিন যেতে চাইবে।”
মোনা নির্বুদ্ধি হয়ে গেল যেন। কিছু বলতে উদ্যত হলে হুট করে মোনা কে পাঁজাকোলে তুলে নেয় প্রিয়ম। মোনা হাত পা ছুড়তে থাকে, জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
-“প্লীজ ছাড়ুন আমায়।আমি খালাকে ডাকবো।”
প্রিয়ম মোনার মুখ চেপে ধরে। মোনার মনে হচ্ছে ও স্বপ্নে দেখছে। প্রিয়ম মোনা কে গাড়ীতে তুলে বলল,
-“আরে একটু লাইফটা কে ইনজয় করতে শিখো। এত নার্ভাস হচ্ছো কেন?”
গাড়ী স্টার্ট করে প্রিয়ম। মোনা এবার কেঁদে ফেলে। অনুনয় করতে থাকে প্রিয়মের কাছে। মোনা বুঝতে পারেনি এমন একটা পরিস্থিতিতে ওর পরতে হবে। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর। প্রিয়ম স্বাভাবিক গলায় বলল,
-“এভাবে কাঁদলে মানুষ কি ভাববে? কান্না থামাও।”
মোনা হঠাৎ কান্না থামিয়ে চুপচাপ বসে থাকে বিমর্ষ মুখে। প্রিয়মের উপর তীব্র ক্ষোভে মোনার কান্না থেমে গেছে। নাইট ক্লাব সম্পর্কে ধারণা নেই মোনার! শুধু জানে বিদেশি নাইট ক্লাব ভালো না! তাও আবার আমেরিকান।
নাইট ক্লাবের দৃশ্য দেখে মোনা হাত দিয়ে চোখ ডেকে ফেলে। লজ্জায় নিজেকে লুকাতে চাচ্ছে! এত নোংরা, এত অশ্লীলতা। মোনা চারদিকে তাকাচ্ছে না। প্রিয়ম এসেই মেয়েদের সাথে ড্যান্স শুরু করলো, প্রতিটা মেয়েই প্রায় অর্ধনগ্ন। প্রিয়ম চুমু খাচ্ছে মেয়েদের, আর মেয়ে গুলোও যা ইচ্ছা তাই করছে।
এর ভিতর এক জন এসে মোনার হাত ধরে টান দেয়। লোকটা মাতাল, মোনা ভয়ে ই
ঈষৎ কাঁপতে থাকে। লোকটা কথা জড়িয়ে আসছে। নেশা জড়ানো গলায় বলল,
-“লেট’স ইনজয় বেবি।”
এর ভিতর প্রিয়ম মাতাল অবস্থায় এলোমেলো পায়ে হেঁটে এসে এক গ্লাস মদ মোনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
-“টেইক ইট।”
মোনা গ্লাসটা সরিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ প্রিয়ম মোনা কে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমু খায়। মোনা গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রিয়মকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দৌড় দেয়। মোনার হাত পা সব কাঁপছে বাজে ভাবে। মোনা ক্লাব থেকে বেড়িয়ে আরো জোরে জোরে দৌড়াতে লাগে। অনেকক্ষণ পথ পেরিয়ে এসে নিচে ঝুঁকে হাঁটুতে হাত দিয়ে হাপাতে থাকে। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। এত রাতে যাবে কোথায়?রাস্তাটা নির্জন। বাসা তো চিনে না। অপরিচিত দেশ। এখন যদি খারাপ কিছু ঘটে যায়? মোনা আতঙ্ক,শঙ্কায় হতবিহ্বল হয়ে যায় । কিছু ভাবতে পারছে না। এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি দৌড়াবে? মোনার মাথায় কিছু কাজ করছে না। মোনা আবার দৌড়াতে শুরু করলো। ক্লান্ত হয়ে রাস্তায় বসে পড়লো। হঠাৎ একটা কার এসে মোনার কাছে থামে ,মোনা আঁতকে উঠে। কার থেকে এক ভদ্রলোক নামে, কোলে ছোট একটা বাচ্চা। ইংরেজি তে মোনা কে বলে,
-“আর ইউ ওকে?”
মোনা কান্না ভেজা গলায় বলল,
-“আমায় একটু বাসায় পৌঁছে দিতে পারবেন?”
লোকটা বলল,
-“কিহ?”
মোনা যেন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। এই আমেরিকান লোক’কে বাংলা সারাদিন বললেও কিছু বুঝবে না। মোনা নিজেকে সামলে ইংরেজি তে বলে,
-“আমায় বাসায় পৌঁছে দিতে পারবেন?আমি ভীষণ রকমের বিপদে পড়েছি।”
-“শান্ত হন, শান্ত হন। বাসার ঠিকানা দেন।”
এই লোক টা কে বিশ্বাস করা কি ঠিক হবে? নাকি এখান থেকে দৌড়ে চলে যাবে?দৌড়েও বা কোথায় যাবে? ঝুঁকি না নিয়ে কোন উপায় নেই।মোনা বলে,
-“আমি এদেশে নতুন। খালার বাসায় এসেছি।পথ হারিয়ে ফেলেছি। এড্রেস জানি না।”
লোকটা হতাশ গলায় বলল,
-“তাহলে কিভাবে সাহায্য করব?”
ভদ্রলোকের কোলে থাকা বাবুটা অনাবরত কেঁদে যাচ্ছে। লোকটা বলছে,
-“ও মাই প্রিন্সেস!ডোন্ট ক্রাই,ডোন্ট ক্রাই।”
(চলবে)