মোনালিসা পর্ব ৫০

মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৫০
সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর মোনা আবিষ্কার করে প্রিয়মের আলিঙ্গনে আবদ্ধ ও।মোনার ঘুম জড়ানো চোখ দুটো নিভু নিভু প্রদীপ। পিটপিট করে তাকায় প্রিয়মের দিকে। চেহেরা যেন লজ্জায় লাজরঞ্জিত বর্ণ ধারণ করেছে। ধরাধাম এর সমস্ত লজ্জা এসে উঁকি দিচ্ছে মোনার চিত্তে।মোনা নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। ধীরপ্রকৃতির হিমশীতল মারুত বারান্দা মাতিয়ে রেখেছে। চারদিকে বসন্তের ঘ্রান। মোনা চোখ বুঁজে অনুভব করে নিজেকে। মোনার মনের প্রেম প্রজাপতি আজ পাখনা মেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে নিজের ইচ্ছে মত।থেমে যাক সময়! পৃথিবী থেকে দূর হয়ে যাক সকল বিমর্ষতা।
প্রিয়ম নিঃশব্দে এসে দাঁড়ায় মোনার পাশে।মোনা টের পায় না।প্রিয়মও নিজের উপস্থিতির জানান দেয়। প্রিয়মের হাতে থাকা কফির মগ’টা রাখার সময় শব্দ হলো। এতক্ষণ উন্মনা হয়ে থাকার পর হঠাৎ কানে আসা শব্দে কিছু’টা হকচকিয়ে উঠে তাকায় মোনা। প্রিয়ম মিহি গলায় বলে,
– “গুড মর্নিং।”
মোনা মৃদু হেসে বলল,
– “গুড মর্নিং।”
তারপর কফির কাপের দিকে তাকিয়ে অবাক গলায় মোনা বলল,
– “কফি বানালো কে?”
প্রিয়ম কফির কাপ’টা মোনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
– “আমি বানিয়েছি মোনা পাখি।”
মোনা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে কিংবা তীব্র ভালোলাগা নিয়ে তাকিয়ে থাকে প্রিয়মের দিকে। মানুষ বদলায়। জীবনের অনেক মোড়েই বদলায়!মোনা কফির মগে চুমুক দেয়। মোনার দৃষ্টি প্রিয়মের দিকে আবদ্ধ। নিষ্পলক চাহনি! মাঝে মাঝে প্রিয় মানুষ গুলোর দিকে অকারণেই চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। অনেক সময় ধরে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। চোখ দুটো’তে মাঝে মাঝে নিদারূণ পিপাসা জাগে।
– “মোনা তোমার তো এখন জবের দরকার নেই। জব’টা ছেড়ে দাও।‌ ভার্সিটি শেষে তো ক্লান্ত হয়ে যাও।”
প্রচণ্ড বিষক্ত একটা তরঙ্গধ্বনি যেন মোনার কানে প্রবেশ করে।রাগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে হাতে থাকা কফির মগ’টা শব্দ করে বারান্দার রেলিং এর উপর রাখে।প্রিয়ম সেদিকে তাকালো,মগ’টা ভেঙে গেল কিনা সে আশঙ্কায় প্রিয়মের চোখে। মোনার মুখ’টা ছাই রঙা হয়ে গেল।শক্ত গলায় বলল,
– “আমার জব নিয়ে কখনো কিছু বলবেন না আর।”
মোনার এমন প্রতিক্রিয়ায় প্রিয়ম বিহ্বল হয়ে গেল যেন।মোনা নাক-মুখ কুঁচকে রেখেছে বিরক্তি’তে। প্রিয়ম মোনা’কে বুঝানোর চেষ্টা করে বলল,
– “জব তো মানুষ প্রয়োজনে করে।যেহেতু এখন আর প্রয়োজন নেই তাই বলেছিলাম।তোমার ভালো লাগলে করো।”
মোনার এমন আচরণে প্রিয়ম যেন মনক্ষুণ্ণ হলো। জব ছেড়ে দেওয়ার কথা বললে মোনার প্রচণ্ড রাগ হয়। রাগের রেশ কেটে গেলে মোনা একটু অনুতপ্ত হলো যেন।প্রিয়মের কাঁধে হাত দিয়ে বলল,
– “এই। স্যরি।”
প্রিয়ম রাগ দেখালো না বরং হাসলো। জিজ্ঞেস করল,
– “নিশান এখনো ঘুমাচ্ছে?আজকে কি ভার্সিটি’তে যাবে?”
– “আমি যতক্ষণ না ডাকবো নিশানের ঘুম ততক্ষণে ভাঙবে না। হ্যাঁ ভার্সিটি’তে যাবো,আপনিও অফিসে যাবেন।”
– “আজ না গেলে হয় না?বিয়ে উপলক্ষে ছুটি নেই?”
মোনা চোখ লাল করে তাকালো।প্রিয়ম বলল,
– “আচ্ছা,আচ্ছা সব তোমার ইচ্ছে।চলো নাস্তা রেডি করি। দুই জন এক সাথে রান্না করলে প্রেমময় রান্না হয়। রান্নার থেকে প্রেম প্রেম ঘ্রান আসে।”
মোনা হেসে ফেলে। কিছুক্ষণ পর চিন্তাগ্রস্থ হয়ে বলল,
– “আচ্ছা খালা-খালু যদি এখন সব জেনে যায়? আমাদের বিয়ে করা’টা ঠিক হয়নি। এক বছর পর করলেই হতো।”
– “আহা মোনা! সব সময় পজেটিভ চিন্তা করো। চলো তো।”
মোনা নাস্তা বানাচ্ছে। প্রিয়ম বার বার মোনা’কে হুটহাট জড়িয়ে ধরছে।মোনা চোখ রাঙিয়ে তাকালে কিছু’টা দূরত্ব রেখে তাকায় প্রিয়ম। মোনা কপট বিরক্তি দেখিয়ে বলে,
– “এভাবে ডিস্টার্ব করলে প্রেমময় নাস্তা হবে না,পোড়াময় নাস্তা হবে।”
প্রিয়ম হাসে।মোনার কথায় ভাবান্তর নেই। চোখে-মুখে নির্লিপ্ত ভাব। মোনা প্রিয়ম’কে ধাক্কা দিয়ে কিচেন থেকে বের করে দরজা’টা লাগিয়ে দিলো।প্রিয়ম জানালার কাছে দাঁড়িয়ে অসহায় দৃষ্টিতে মোনার দিকে তাকিয়ে বলল,
– “মোনা পাখি।প্লীজ দরজা’টা খোলো না।”
মোনা প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকায়।নাস্তা বানানো শেষে দরজা খুলে।
প্রিয়ম মোনা’কে ভার্সিটির সামনে নামিয়ে দিলো। মোনা প্রিয়মের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভার্সিটির দিকে পা বাড়ায়। কিছুদূর গেলেই প্রিয়ম মোনা’কে পিছন থেকে ডাকে।মোনা ফিরে তাকায়।প্রিয়ম কেন ডেকেছে?গাড়ি’তে কি কিছু রেখে এসেছে?এসব ভাবতে ভাবতে প্রিয়মের দিকে এগিয়ে যায়।
– “কি হলো আবার ডাকলেন কেন?”
প্রিয়ম মোনার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,
– “ভালোবাসি।”
প্রিয়মের ঠোঁটের ছোঁয়া মোনার কানে লাগলো। মোনা শিউরে উঠে প্রিয়মের থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়ায়। প্রিয় মানুষ গুলোর মুখ থেকে এমন হুটহাট ভালোবাসি শুনলে মনের ভিতর প্রশান্তিময় ভাব আসে যেন। ভালোবাসার অনুভূতি গুলো আরো গাঢ় হয়!
___________________________

ভার্সিটি শেষে কোন পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই মোনা জ্যাকের বাসার উদ্দেশ্যে ট্যাক্সি নেয়।প্রিন্সেস’কে দেখেছে বেশ কয়েকদিন হয়েছে। বাসায় ঢুকে দেখে জ্যাক সোফায় বসে আছে। সাথে চার-পাঁচ জন ভদ্রলোক। ব্যবসা সংক্রান্ত আলোচনা হয়ত! জ্যাকের মুখে গম্ভীর ভাব, কপালে চিন্তার ছাপ। খুব আম্ভরিক গলায় কথা বলছে সামনে বসে থাকা মানুষ গুলোর সাথে। জ্যাকের কথা বলার ভঙ্গি অমায়িক! জ্যাক মোনার দিকে একবার তাকিয়ে কর্মচারী’কে ইশারা করল। জ্যাকের কর্মচারী মোনা’কে প্রিন্সেসের রুমে যেতে বলল। মোনা নিঃশব্দে প্রিন্সেসের রুমে গেল। প্রিন্সেস খাটের মাঝ বরাবর বসে আসে। আর সারা খাটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানান রকমের পুতুল,খেলনার সরনঞ্জাম। ফ্লোরেও অনাদৃত ভাবে পড়ে আছে কতগুলো খেলনা। মোনার চোখ কপালে। নিঃশব্দে গিয়ে প্রিন্সেসে পাশে বসে। সুললিত কণ্ঠে ডাকে,
– “মাদার।”
ডাক দেওয়ার সাথে সাথে প্রিন্সেস তাকায়। ওঁর বাচ্চা চোখ দুটো’তে বিস্ময়। শব্দ করে হেসে উঠে প্রিন্সেস। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ওঁর নরম-কোমল পা দুটো দিয়ে মোনার দিকে এগিয়ে এসে,মোনার গলা ধরে উৎফুল্ল হয়ে বলে,
– “মাদার।”
মোনা হেসে জড়িয়ে ধরে প্রিন্সেস’কে।কালো ফ্রক পড়া প্রিন্সেস’কে দেখে মনে হচ্ছে মোগল হেরেমের সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের কন্যা। এ যেন সত্যিকারের রাজকন্যা। মোনা জিজ্ঞেস করে,
– “হাউ আর ইয়্যু মাদার?”
– “ফাইন।”
মোনা প্রিন্সেস’কে কোলে তুলে অবাক গলায় বলল,
– “বাব্বাহ! প্রিন্সেস এত কথা শিখে গেছে!”
– “প্রিন্সেস কি এখনো ছোট আছে?সময় যাচ্ছে, সেই ছোট প্রিন্সেস বড় হচ্ছে।”
জ্যাক সোফায় বসে আবার বলল,
– “আমার কি মনে চায় জানেন মোনালিসা?”
মোনা বলে,
– “কি?”
– “আমার মনে চায় প্রিন্সেস এইটুকু’ই থাকুক।”
– “আসলেই এই বয়স’টা তে বাচ্চা গুলো আদুরে টাইপ থাকে।”
– “আপনার সব ঠিকঠাক চলছে তো? কোন রকম সমস্যা হচ্ছে না তো?”
মোনা না সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ায়।
– “ডায়েরির কাজ কতদূর?আপনায় আমি ঝামেলায় ফেলে দিতাম।”
– “আরে না,না। কিসের ঝামেলা? একটু সময় লাগবে আর কি!”
উত্তরে জ্যাক যেন কি বলল। মোনা খেয়াল করল না। প্রিন্সেসের দিকে মনোযোগী হয়ে ছিলো। জ্যাকের বলা সেই কথা গুলো আজও মোনার মনে অস্বস্তির সৃষ্টি করে। কোথায়ও জড়তা রয়ে গেছে,চাইলেও আগের মত সহজ হতে পারেনা।
– “জ্যাক আমি বিয়ে করে ফেলেছি।”
জ্যাক যেন ভুল শুনলো।মুখো ব্যঁজন দেখে মনে হচ্ছে ভুল শুনেছে কি না তাই নিয়ে দ্বিধান্বিত।কপালে ভাঁজ পড়লো। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– “মোনালিসা কি বললেন?”
মোনা প্রিন্সেসের সাথে ব্যস্ত থাকতে থাকতে বলল,
– “আমি বিয়ে করেছি। আমার সেই কাজিন!ওই যে যাকে হসপিটালে দেখতে গিয়েছিলাম।বিয়ে হয়েছে বেশ কয়েক দিন। আপনার কাছে না বলে শান্তি পাচ্ছিলাম না।”
এবার আর জ্যাকের কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকল না। নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বিষয়’টা হজম করতে বেশ কিছুক্ষণ লাগলো।এই সময়টুকু তে মোনার অস্বস্তি আরো বেড়ে গেল। জ্যাক কিছু মুহূর্ত পর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
– “অভিনন্দন! খুশির খবর মোনালিসা। আমি সত্যি কষ্ট পেলাম যে আপনি এতদিন পর আমায় বলার প্রয়োজন বোধ করলেন।”
মোনা কোন কথা খুঁজে না পেয়ে অরব হয়ে থাকলো।জ্যাকও কিছুক্ষণ চুপ থাকল। মুখের অভিব্যক্তি স্বাভাবিক হলেও মনের ভিতর’টা হয়ত দগ্ধ হচ্ছে হুতাশনে। জ্যাক আক্ষেপ করে বলল,
– “মোনালিসা আপনার কাছ থেকে এটা আশা করিনি। বিয়ের এতদিন পর বললেন আমায়।”
– “আপনার কাছে বলতে——-”
– “হয়েছে থাক।”
জ্যাক উঠে দাঁড়ালো।রুম থেকে বের হয়ে গেল।জ্যাকের মনে কি চলছে মোনা বুঝতে চেষ্টা করল।জ্যাক রুম থেকে বের হয়ে গেল কেন? মিনিট পাঁচেক পর জ্যাক আসে। হাতে একটা নেকলেসের বাক্স। হীরের নেকলেস! কারো কাছ থেকে গিফট নেওয়া’টা মোনার কখনো পছন্দ ছিলো না।সেটা যত দামী’ই হোক না কেন।মোনা নিতে কিছুতেই রাজি হলো না। জ্যাক শেষে বিরক্ত হয়ে গেল।
– “মোনালিসা, গিফট কারো তরফ থেকে দেওয়া খণ্ড খণ্ড ভালোবাসা।নিতে না চাওয়া কেমন যেন বিষয়’টা। আর আপনার বিয়ে! সামান্য একটা হীরের হার ছাড়া কিই বা দিলাম?”
জ্যাকের কথায় মোনার টনক নড়লো। হাত বাড়িয়ে বাক্স’টা নিয়ে জ্যাক’কে থ্যাংক্স জানালো। জ্যাক যতই নিজের কষ্ট লুকাতে চাক না কেন,মুখে কষ্টের চিহ্ন ফুটে ওঠছে। হয়ত মুখে ফুটে ওঠা কষ্টের তীব্রতা কম। জ্যাক কষ্ট পেয়েছে?মোনার মাথায় বার বার এ প্রশ্ন’টা ঘোরপাক খাচ্ছে। মোনা আরো কিছুক্ষণ থেকে বেরিয়ে আসলো জ্যাকের বাসা থেকে।
_____________________________________________
বাসায় ফেরার পথে মোনা একটা ডায়েরি কিনে নিলো। প্রেম কিংবা বিবাহিত জীবনের অধ্যায় সব ডায়েরির ভাঁজে রেখে দিবে। মোনা বাসায় ফিরে পড়তে বসলো। পড়া শেষে জ্যাকের ডায়েরি নিয়ে ঘাঁটতে শুরু করল। এই ডায়েরি’তে লেখা প্রতিটি শব্দই যেন ভালোবাসায় টুইটম্বুর।জ্যাকের দেওয়া নেকলেস’টা যত্ন করে রেখে দিলো। প্রিয়ম ফোন করে জানালো আজ মোনার বাসায় আসবে না, বাসায় যাবে জরুরি কাজ আছে।
ফোন রেখে মোনা ডায়েরি নিয়ে আবার বসলো।লেখার মাঝে মাঝে মোনা কল্পনায় হারিয়ে যায়। নানা রকমের কল্পনা দিগ্বিগিক মাতিয়ে তুলে। গাঢ় রঙ্গিন‌ স্বপ্ন।প্রিয়মের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত,প্রিয়মের স্পর্শ,প্রিয়মের চাহনি চোখ বুঁজে সে সব নতুন করে অনুভব করছে। ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে আছে। নিজেকে আজকাল খুব সুখি মানুষ মনে হয় মোনার। মাঝে মাঝে আশঙ্কা জাগে,’এ সুখ কি থাকবে?’
(চলবে)
~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here