মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৫৪
প্রিয়মের বলা কথা’টা মোনার কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই মোনা হতবাক হয়ে তাকায় প্রিয়মের দিকে।প্রিয়মের চোখ-মুখ শক্ত হয়ে আছে। মোনা ভুল কিছু শুনেছে যেন।মুখ থেকে আপন শক্তিতে মন্থর ভাবে বেরিয়ে আসলো,
– “কি বললেন?”
প্রিয়ম মোনার মুখোমুখি বসলো।প্রিয়মের কপালে চিন্তার ছাপ। মুখের ভঙ্গি অস্থির।মহাদুশ্চিন্তাগ্রস্থ গলায় পুনরায় বলল,
– “বাচ্চা এবরশন করে ফেলো।”
মোনা হৃৎপিণ্ড অস্বাভাবিক ভাবে লাফাচ্ছে।এবরশন শব্দ’টা মোনার মনে তীব্র ত্রাসের সৃষ্টি করছে। অচেনা এক প্রিয়মের সামনে যেন বসে আছে মোনা। প্রিয়ম’কে চিনতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। মোনার হাত-পা ঈষৎ কাঁপছে। শ্বাস ভিতর থেকে রুদ্ধ হয়ে আসছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
– “বাচ্চা কেন এবরশন করব?কি বলছেন আপনি? একবছর তো প্রায় হয়েই গেছে এবার বাসায় জানান আপনার।সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।”
কথা’টা বলে মোনা ঢোক গিলল। মোনার খুব পিপাসা পেয়েছে। শরীর খারাপ লাগছে। মাথার ভিতর ঝিমঝিম করে ওঠছে বার বার।চোখের দৃষ্টি অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।প্রিয়ম উত্তরের অপেক্ষায় থাকলো অনেকক্ষণ। প্রিয়ম উঠে দাঁড়ালো। প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে অন্যদিকে ফিরে বলল,
– “এক বছর হতে এখনো দুই মাস বাকি। আর এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা নিয়ে বুড়ো হয়ে থাকার মানে কি? তাছাড়া বাচ্চাকাচ্চা পালবে নাকি লেখাপড়া করবে?বিয়ের ব্যাপার কিভাবে বলব বুঝতে পারছি না আর সেখানে বাচ্চা!”
প্রিয়ম এইটুকু বলে থেমে মোনার চোখের দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বলল,
– “মোনা বাচ্চা নেওয়ার পারফেক্ট সময় নয় এটা আমাদের জন্য। বিয়ে হয়েছে মাত্র কত মাস হয়েছে?লাইফ ইনজয় বলতে একটা ব্যাপার আছে।বিয়ের কয় মাসের মাথায় বাচ্চা।থার্ড ক্লাস চিন্তা-ভাবনা। বুঝিনা এত ইমোশনাল হওয়ার কি আছে? বাচ্চা কি আর ভবিষ্যতে হবে না?”
মোনা প্রিয়মের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কি অদ্ভুত পরিবর্তন! কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে কথা বলছে প্রিয়ম,কথায় কোন আন্তরিকতা নেই। মোনা নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, অনুভূতি শূন্য চাহনি। ভিতর থেকে কথা বের হচ্ছে না। প্রিয়ম অস্থির ভাবে পায়চারি করছে। হ্যাঁ,বাচ্চা নেওয়ার উপযুক্ত সময় নয় এটা মোনার জন্য। উপযুক্ত-অনুপযুক্ত বিবেচনা করে বাচ্চা এবরশন করার মত বিবেকবর্জিত সিদ্ধান্ত নিবে?আর প্রিয়মের আচরণে মনে হচ্ছে বাচ্চা এবরশন বিষয়’টা নিতান্তই স্বাভাবিক। অথচ প্রিয়ম’ই বলত আমাদের টুইন বেবি হবে,চোখ দুটো গাঢ় নীল।সেসব কথা এখন দীর্ঘ নিঃশ্বাস হয়ে বুক চিঁড়ে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে। মোনার সকল চিন্তা ভাবনা রেখে নিস্তেজ গলায় বলল,
– “আমি এখন বাসায় যাবো আমার শরীর খুব খারাপ লাগছে।মাথার ভিতর কেমন যেন করছে। বাচ্চা নেওয়ার উপযুক্ত সময় না হলেও এবরশন করার কথা আমি ভাবছি না। আর আপনার হঠাৎ এমন আচরণ কেন?চিনতে পারছি না আমি আপনায়।”
প্রিয়মের অস্থিরতা আরো বেড়ে গেল মোনার কথায়। অধৈর্য ভাব চেহেরায়। মোনার প্রতি রাগে চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। প্রিয়ম রোষারক্ত চাহনি’তে মোনা মোটেও ভয় পাচ্ছে না। মোনার শরীর খুব বেশি ক্লান্ত, এখুনি যেন মূর্ছা যাবে। চোখ অনেক কষ্টে টেনে টেনে মেলছে। নিভু নিভু করছে চোখ দুটো। মোনার মনে হচ্ছে ও ঢলে পড়ে যাবে। চেয়ারের হাতল শক্ত করে ধরে বসে। মোনা শুধু এইটুকু উপলব্ধি করতে পারছে ওঁর সমানে একটা অমানুষ দাঁড়িয়ে আছে,যে ঠকিয়েছে ও’কে। ওঁর শরীরের জন্য এত ভালোবাসা,এত সাধনা করেছে।
– ” টিপিক্যাল মানুষের মত আচরণ কেন করছো? বাচ্চা কি আর কখনো হবে না?সহজ একটা হিসাব,এখন আমাদের বাচ্চা নেওয়ার উপযুক্ত সময় নয়! এতে এত আবেগী হওয়ার কি হলো?আমি সত্যি বুঝতে পারছি না।”
প্রিয়মের বলা কথা গুলো মোনার কানে অস্পষ্ট ভাবে বিদ্ধ হতে থাকে। মোনার চোখ গুলো আপনা-আপনি বুঁজে যাচ্ছে। শরীরের সব শক্তি যেন ফুরিয়ে গেল। চেয়ারের হাতল শক্ত ধরে রাখা হাত’টাও ছুটে গেল।
________________________________________________________
হুঁশ ফেরার পর মোনা নিজেকে বাসায় আবিষ্কার করে। চোখ খুলে দেখে প্রিয়ম একটু দূরে বসা।মোনা উঠে আধশোয়া অবস্থায় খাটে হেলান দেয়। প্রিয়মের দিকে তাকায়। খুব শান্ত ভঙ্গিতে বলে,
– “বিয়ের আগে আপনি বলেছেন যে বিয়ের এক বছরের মাথায় আপনি আমাদের নিয়ে আলাদা থাকবেন। এক বছর তো প্রায়’ই হয়ে গেল তো বাসায় জানাচ্ছেন না কেন?আর হ্যাঁ বাচ্চা নেওয়ার জন্য এটা উপযুক্ত সময় নয় সে আমিও বুঝি। কিন্তু আমি পারবো সব কিছু সামলাতে। সেখানে আপনার তো সমস্যা হওয়ার কথা না। মানুষ বাচ্চা,সংসার সামলিয়ে লেখাপড়া করে না? কিন্তু আপনার অস্থিরতা দেখে আমার মনে হচ্ছে না যে আপনি উপযুক্ত সময় কিংবা অনুপযুক্ত সময় এসব নিয়ে চিন্তিত!আমার তো মনে হচ্ছে আমার প্রেগন্যান্সির কারণে আপনি ফাঁসির দড়িতে ফেঁসে গেছেন। আপনি বাচ্চা এবরশন করিয়ে সেই ফাঁসির দড়ি থেকে মুক্ত হতে চাচ্ছেন। আপনার বদলে যাওয়া, আপনার এত প্রেম, আপনার এত ভালো আদর-যত্ন কোথায় গেছে এখন?”
এইটুকু বলে মোনা অস্বাভাবিক ভাবে হেসে ওঠে। হাসি থামাতে বেশ কিছুক্ষণ লাগে। উদভ্রান্তের মত দেখাচ্ছে মোনা’কে।পাগলের মত আচরণ করছে। মোনার কথার প্রত্যুত্তরে প্রিয়ম বলে,
– “আমি অনেকবার চেষ্টা করছি।বাসায় জানানোর সাহস হচ্ছে না আমার। আমি তো বলিনি যে বাসায় জানাবো না, জানাবো কিছুদিন পর। কিন্তু তোমাকে বাচ্চা এবরশন করতে হবে। নয়ত ঝামেলা বাড়বে মোনা।এই সহজ কথা’টা বুঝার চেষ্টা করো।”
মোনার চেহেরার অভিব্যক্তি নিতান্তই স্বাভাবিক। চোখে পানি নেই। চেহারায় কষ্ট কিংবা যন্ত্রনার ছাপ নেই। মোনার এমন আচরণ প্রিয়ম’কে ভাবাচ্ছে।মোনা বলল,
– “সোজাসাপ্টা একটা কথা বলেন।আপনি কি চাচ্ছেন? আপনি আমার শরীরের জন্য আমায় বিয়ে করেছেন। সম্পর্ক’টা এখন আর দীর্ঘায়িত করতে চাচ্ছেন না এমন কিছু?”
– “আমি এই মুহূর্তে শুধু চাচ্ছি তুমি বাচ্চা এবরশন করবে।”
মোনা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করে জানালার ফাঁক দিয়ে বাসার বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে অকারণে। মোনা বুঝে গিয়েছে প্রিয়মের সব সাধনা ছিলো মোনার শরীর। মোনার একটুও কাঁদতে হচ্ছে করছে না কিংবা কোন কষ্ট হচ্ছে না কেন জানি। অনুভূতিশূন্য হয়ে গেছে। পৃথিবী’টা এলোমেলো লাগছে বড্ড।এতসব ভালোবাসা, পাগলামি সব মিথ্যে সব! মোনা আবার অস্বাভাবিক ভাবে হেসে ওঠছে। গগন কাঁপানো হাসি! এতসব স্বপ্ন সব নিখুঁত মিথ্যা!মোনার হাসি থামছে না। ভয় করতো ভালোবাসা কে, বিশ্বাস করতে পারতো না সহজে কাউকে ঠকার ভয়ে। কিন্তু আজ পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য ঠকা ঠকেছে। প্রিয়ম, ইমরুল চৌধুরী কিংবা হাবিব সাহেবের মত নিকৃষ্ট মানুষ। ব্যতিক্রম কেউ না। শুধু আফসোস আর গ্লানি ছাড়া আজ কিছু রইল না। মোনা প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বলল,
– “আচ্ছা আপনি তো বলেছিলেন আপনি প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষ! তাহলে বাসায় বলতে কিসের ভয়?বিয়ের আগে এই ভয় কোথায় ছিলো?এখন কেন ভয়?”
– “পরিকল্পনা করা সহজ,পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করা কঠিন।”
মোনা প্রিয়মের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।এ কি রূপ দেখছে প্রিয়মের? শুধু শরীর ভোগ করার জন্য এত কিছু? নির্বুদ্ধি ভাবে তাকিয়ে রইল মোনা। সব মিথ্যে?সব অভিনয়? মোনার মস্তিষ্কে এই বাক্য দুই’টা ডাঙায় তুলে রাখা মাছের মত তাড়ফাচ্ছে। মোনা মূর্তির ন্যায় তাকিয়ে রইল,চোখের পলক পড়ছে না। শুধু দেখছে পৃথিবী’তে কত রূপের মানুষ!আধা ঘন্টা ওভাবে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল। আধা ঘন্টা পর অস্ফুট গলায় বলল,
– “সব মিথ্যে?”
– “কিছু মিথ্যে না।প্লীজ আগে বাচ্চা এবরশন করো।”
আরো একটা দিন কেটে যায়।প্রিয়ম শুধু একটা কথাই বলছে, “বাচ্চা এবরশন করো।” সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষ যেন প্রিয়ম। মোনার কিছু চিন্তা করতে পারছে না, কিছু ভাবতে পারছে না। চোখ খুলে যেদিকেই তাকায় সেদিকেই যেন শুধু হাহাকার। মোনার শুধু চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, “এত সবকিছু কিভাবে মিথ্যে হয়? কিভাবে অভিনয় হয়?”
মোনা বারান্দার ফ্লোরে বসে থাকে।প্রিয়ম এসে মোনার পাশে দাঁড়ায়। প্রিয়মের চোখ উগ্র রোষ। মোনার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ ধরে। চেঁচিয়ে বলে,
– “মোনা হসপিটালে যাবে চলো।”
মোনা উত্তর না দিয়ে বসে থাকে চুপচাপ।প্রিয়মের ক্রোধ যেন দ্বিগুন হয়ে যায়। গলার স্বর আরো বৃদ্ধি করে ক্রোধন্বিত হয়ে বলে,
– “বাচ্চা কেন এবরশন করবি না?ভালো কথা গায়ে লাগে না?বাচ্চা দিয়ে ফাঁসাতে চাচ্ছিস আমায়? ভালো লাগে না তোকে এখন আর আমার। আমি এই বিয়ে বিয়ে সম্পর্ক’টা রাখতে চাচ্ছি না। এক শরীর,এক মুখ আর কতদিন ভালো লাগবে?বিয়ের আগে যদি ফিজিকাল রিলেশনে যেতি তাহলে এতদূর এগুতো না সম্পর্ক’টা। তোর মত থার্ড ক্লাস মেয়ে আমার সোসাইটির সাথে যায়?”
কি শুনছে এসব মোনা? কি বলছে প্রিয়ম?মোনা মুখ তুলে তাকাতেই প্রিয়ম মোনার মুখ চেপে ধরে। প্রিয়মের অসুরে শক্তির কাছে মোনার ক্ষীণ দেহের বাঁধা তুচ্ছ কিছু। মোনার চোখ উল্টে যাচ্ছে। মায়ের মৃত্যুর সেই দৃশ্য মোনার চোখের সামনে ভাসছে। মায়ের মত’ই মৃত্যু হবে মোনার? মোনার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রিয়ম মোনা’কে জোর করে গাড়িতে তুলে হসপিটালের দিকে যাচ্ছে।
___________________________________________________________
মোনার হুঁশ ফিরতে নিজেকে হসপিটালে আবিষ্কার করে।হাত-পা নাড়াতে কষ্ট হচ্ছে। পুরো শরীর জুড়ে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। সবকিছু মনে পড়তেই মোনা উঠে বসার চেষ্টা করে। বাচ্চা এবরশন করা শেষ?মোনার ওঁর পেটের দিকে তাকায়। মোনা আচমকা চিৎকার করে ওঠে। তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে ওঠে। প্রিয়মের বলা শেষ কথা গুলো মনে পড়ে।মোনা শুধু পাগলের মত চিৎকার করছে। শুধু চিৎকার আর গ্লানি’তে আহাজারি।মোনার পুরো শরীর কাঁপছে। এসির ভিতরও ঘেমে যাচ্ছে। মোনা অস্বাভাবিক ভাবে হাঁপাচ্ছে। প্রাণ’টা যেন এখুনি চলে যাবে। মোনা বুকের ভিতর কেউ যেন ক্রমন্বয়ে ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করে যাচ্ছে।সে যন্ত্রনায় মোনা কাতরাচ্ছে।প্রিয়ম মোনার পাশে এসে দাঁড়ায়।মোনা সেদিকে তাকিয়ে পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে বলে,
– “শুধু একটু শারীরিক তৃপ্তির জন্য এমন করা’টা খুব বেশি দরকার ছিলো? জানোয়ার তুই! কুকুরের চেয়ে নিকৃষ্ট।”
মোনার গলা থেকে আর কথা বের হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কেউ একজন মোনার গলায় আস্ত হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে। প্রিয়ম খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল,
– “বাচ্চা’টা শুধু প্রমান ছিলো এই সম্পর্কের। এছাড়া আর কোন প্রমান নেই। কোন ভাবেই ফাঁসাতে পারবা না আমায়।এত কাঁদার কি আছে? দশ’টা মাস’ই তো মাত্র সংসার ছিলো। প্রতিদিন এক শরীর এক মুখ আমার বিরক্ত লাগে, আমার নতুনত্ব ভালো লাগে। বিভা’কে বিয়ে করব শীঘ্রই। বিভা বিভার মত জীবন ইনজয় করবে,আমি আমার মত। দিন শেষে আমরা হাজবেন্ড-ওয়াইফ। আর আমি এটাই পছন্দ করি। এবার তো বুঝলে তোমার ইগো,তোমার অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস তোমার ক্ষতি করেছে? তুমি আমায় গুরুত্ব দেওনি তাই তোমার পিছনে লেগে ছিলাম। কিন্তু এমন টিপিক্যাল,থার্ড ক্লাস মেয়ে নিয়ে প্রিয়ম লাইফ লিড করবে! আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা কিংবা আমায় সম্পর্ক রাখতে অনুরোধ করা এসব বৃথা সাধনা। ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিও।বিয়ের কোন প্রমাণ নেই তোমার কাছে। তাই ডিভোর্স’টা খুব বেশি জরুরি না আমার কাছে।”
কথা শেষ করে প্রিয়ম মোনার দিকে তাকালো। মোনাও কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল প্রিয়মের দিকে। মোনা নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে। এটা তো সেই পরিচিত মুখ! কিভাবে মুহুর্তেই সব শেষ হয়ে গেল? প্রিয়মের চোখ দুটোর দিকে তাকায়। এই তো সে চোখ যার চাহনিতে মোনা শিউরে উঠত। এটা তো সেই স্বর যে স্বর মোনা’কে স্বপ্ন দেখাতো,প্রেমের মহাকাব্য শুনাতো।সামনে দাঁড়ানো এই নিকৃষ্ট মানুষটার স্পর্শে মোনার চোখ বুঁজে আসতো, শিরায়-উপশিরায় শিহরণ জাগতো।
মোনা প্রিয়মের বলা কথা গুলোর উত্তরে খিন্ন গলায় বলল,
– “অদ্ভুত আমাদের জীবন।কখন কি হয় কিংবা হবে কেউ জানে না।”
প্রিয়ম মোনার এই অবান্তর কথার উত্তর খুঁজে পেলো না। খোঁজারও চেষ্টা করল না। হাঁটতে থাকলো নিজ গন্তব্যে।মোনা তাকিয়ে দেখছে প্রিয়মের চলে যাওয়া। আর কিছুই বলল না মোনা। মোনার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানিও পড়ছে না। আবেগ, অনুভূতি সব যেন চলে গেছে মোনার ভিতর থেকে। কি ঘটে গেল এসব?কি নির্মম ভাবে ঠকিয়েছে! সব মিথ্যে সব! কি নিকৃষ্ট মানুষ। এত যন্ত্রনা,এত যাতনা, সব নির্মমতা মোনার জন্য। মোনা হাঁপাতে হাঁপাতে পাগলের মত অস্ফুট স্বরে বিলাপ করতে করতে বলছে, “পৃথিবী এত নিষ্ঠুর কেন তুমি?” মোনার সুখ সুখ বলে চিৎকার দিতে ইচ্ছে করছে। কোথায় সুখ?
____________________________________________________________
মোনা দুর্বল পায়ে হসপিটাল থেকে বের হয়। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। মোনা এখনো যেন বুঝে উঠতে পারছে না ওঁর সাথে কি হয়েছে? পথভ্রষ্ট মানুষের মত হাঁটছে এলোমেলো ভাবে পা ফেলে।প্রিয়মের বলা কথা গুলো কানে বাজছে শুধু আর মোনার ভিতর’টা হুহু করে উঠছে।কি থেকে কি হয়ে গেল?কি হতে গিয়ে কি হয়ে গেল? নিশান কোথায়?স্কুল থেকে ফিরেছে ও?কোথায় খেয়েছে কোথায় থেকেছে সারা’টা দিন?
ডাক্তারের এ্যাপ্রোন পরা জ্যাক হাসপাতালের দিকে এগিয়ে আসছে। ডাক্তারি’তে জয়েন করেছে বেশ কয়েকদিন হলো। দূর থেকে জ্যাকের তির্যক দৃষ্টি পড়ে মোনার দিকে। কেমন অস্বাভাবিক ভাবে হাঁটছে মোনা। জ্যাক দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসতে লাগলো। মোনার কাছাকাছি চলে আসলেও মোনার খেয়াল নেই সেদিকে।মোনা যেন এখুনি ঢলে রাস্তায় পড়ে যাবে। মোনার এমন অবস্থা দেখে জ্যাক হতবিহ্বল হয়ে যায়। জ্যাক গিয়ে মোনার সামনে দাঁড়িয়ে অস্থির গলায় বলল,
– “মোনালিসা?কি হয়েছে?কি হয়েছে আপনার?আপনি ঠিক আছেন?আরে একি অবস্থা? মোনালিসা!”
মোনার গা ছাড়া ভাব। ঠোঁট নেড়ে শুধু বলল,
– “জ্যাক আমি মারা যাচ্ছি বোধ হয়।”
মোনার কথা শুনে জ্যাক বিমুঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে।জ্যাক চিন্তান্বিত হয়ে বলে,
-“মোনালিসা কি বলছেন এসব?কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?”
জ্যাক হসপিটালের সামনে গাড়ি রেখে এসেছে।মোনা’কে চট করে ধরে ফেলে। মোনার নিস্তেজ শরীর’টা যেন ঢলে পড়ে যাবে। জ্যাক একটা গাড়ি ডাকে। মোনা’কে গাড়ি’তে তুলে। জ্যাক একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।মোনা চোখ বুঁজে আছে।মোনার সাথে খারাপ কিছু হয়েছে,কথা বলার ইচ্ছে নেই। জ্যাক আর কোন প্রশ্ন করে না।
গাড়ি এসে মোনার বাসার সামনে থাকে।জ্যাকের সাহায্যে মোনা উপরে ওঠে। মোনা ছটফট করছে,মনে হচ্ছে প্রাণ’টা বেরিয়ে যাবে। সবকিছু চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিতে ইচ্ছে করছে। মোনার মস্তিষ্কে শুধু একটা কথাই নাড়া দিচ্ছে, “কি হয়ে গেল?” এর বেশি কিছুই ভাবতে পারছে না।
নিশান স্কুল থেকে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই দুপুর থেকে। সারাদিন না খেয়ে আছে। মোনা আবছা আবছা দেখে নিশান’কে। কাউকে নিয়ে কিছু ভাবতে পারছে না মোনা। জ্যাক দরজা খুলে মোনা’কে খাটে শুইয়ে দেয়। আস্তে করে জিজ্ঞেস করে,
– “মোনালিসা শরীর খারাপ লাগছে আপনার?কি হয়েছে বলুন নয়ত বুঝবো কিভাবে?”
জ্যাক একটু থেমে আবার বলে,
– “প্রিয়ম জানে আপনার এই অবস্থা? প্রিয়ম’কে জানাবো?”
মোনা ইশারায় না করে। কোন কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মোনা অনেকক্ষণ চোখ বুঁজে শুয়ে থাকে। চোখের সামনে কত স্মৃতি! সব মিথ্যে? জ্যাক কিছু’টা দূরে বসে থাকে।
– “মোনালিসা হসপিটালে নিয়ে যাবো আপনায়?”
মোনা মাথা নাড়িয়ে না করে।অনেক সময় পর মোনা চোখ খুলে চিৎকার করে বলল,
– “জ্যাক সুখ কোথায় পাবো?জ্যাক, মানুষ গুলো এত নিকৃষ্ট কেন?”
জ্যাক ভ্রু কুঁচকে তাকায় মোনার দিকে।কয়েক পা এগিয়ে মোনার কাছে এসে বলল,
– “প্রিয়মের সাথে কোন সমস্যা হয়েছে আপনার? মোনালিসা এত ভেঙে পড়ছেন কেন?”
মোনা কেঁপে কেঁপে উঠে অসহ্য কষ্টে। চোখ দুটো একদম শুষ্ক। জ্যাকের দিকে তাকিয়ে বলল,
– “জ্যাক, মানুষ চেনার উপায় কি? আমার সাথে কেন এত নিকৃষ্ট মানুষের দেখা হয়? জ্যাক বিশ্বাস করেন মানুষ গুলো যে কত নিকৃষ্ট তা কাউকে বুঝাতে পারব না।”
মোনার কথায় জ্যাকের কপালে ভাঁজ পড়ে। জ্যাক কিছুই বুঝতে পারছে না। জ্যাক জিজ্ঞেস করল,
– “মোনালিসা এসব কথা কেন বলছেন আপনি?কি হয়েছে সেটা একবার বলুন?”
মোনার আর্তনাদ গুলো আরো গাঢ় হয়।কি নিদারূণ ক্লেশ! প্রিয়মের প্রতি কি যে ঘৃণা! নিজের মায়ের মুখ’টা মোনার চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছে। সঠিক কাউকে পেতে চেয়ে জগতের সবচেয়ে হীনতর একটা অমানুষ’কে বিশ্বাস করেছে। একটুও কি মায়া জন্মে নি মোনার প্রতি?মোনা ক্ষীণ স্বরে বলল,
– “জ্যাক আপনি না বলেছেন আমি দারুন একজন লাইফ পার্টনার নির্বাচন করেছি?”
– “হ্যাঁ।তো কি হয়েছে?”
মোনা অস্ফুট স্বরে বলল,
– “আপনি ভুল বলেছেন।”
মোনার অস্পষ্ট ভাবে বলা কথা জ্যাক বুঝতে পারলো না। জ্যাক প্রশ্ন করল,
– “মোনা কি বললেন?স্পষ্ট ভাবে বলুন।প্রিয়মের সাথে কোন সমস্যা হয়েছে? আরে সংসার জীবনে একটু-আধটু সমস্যা থাকবেই। এত ভেঙে পড়লে চলবে?”
মোনার হঠাৎ অস্বাভাবিক ভাবে শ্বাস কষ্ট শুরু হয়। বুকের পাঁজর যেন ভেঙে যাবে। মোনা শ্বাস রুদ্ধ গলায় বলল,
– “জ্যাক একটু অক্সিজেন।আমি শ্বাস নিতে পারছিনা।”
জ্যাক ত্রাসিত হয়ে যায়।ভয় পেয়ে যায় প্রচণ্ড। হসপিটালে ফোন দেয়। দ্রুত মোনা’কে হসপিটালে নিয়ে যায়। নিশান ভয় পেয়ে চুপসে আছে, চোখে-মুখে আতঙ্ক।মোনা’কে অক্সিজেন দিয়ে রাখে। ট্রিটমেন্ট জ্যাক’ই করছে। জ্যাকের মাথায় শুধু একটাই প্রশ্ন, “কি হলো মোনালিসার?” প্রিয়মের ফোন নম্বর জ্যাকের কাছে আছে। জ্যাক কেবিন থেকে বের হয়ে প্রিয়মের নম্বরে ফোন দেয়। প্রিয়মের ফোন নম্বর অফ। জ্যাকের করার কিছুই থাকলো না।
জ্যাক বসে থাকে মোনার পাশে। মোনার ক্লান্ত চোখ দুটো বুঁজে আছে। জ্যাকের বুকের মাঝে চিনচিনে ব্যথা হয়। মোনালিসা কি ভালো নেই? জ্যাক চেয়েছে মোনা ভালো থাকুক। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হোক! কোন কষ্ট মোনা’কে স্পর্শ না করুক। সকল দুঃখ,কষ্টের উর্ধ্বে থাকুক মোনা। মোনার এই দুরাবস্থা জ্যাক’কে পীড়া দিচ্ছে।জ্যাক বুঝতে পারে মোনা ভালো নেই প্রিয়মের সাথে। জ্যাক চায় মোনা ভালোবাসার চাদরে আবৃত হয়ে থাকুক। ভালোবাসা জিনিস’টা ভালো করেই বুঝে জ্যাক। জ্যাক একজন’কে ভালোবেসেছে মন থেকে। সেই ভালোবাসা থেকেই জ্যাক সব’টা উপলব্ধি করতে পারে। ভালোবাসা মানে ভালোবাসার মানুষ গুলো ভালো থাকুক, যেখানেই থাক না কেন। ভালোবাসা মানে কাউকে পেতেই হবে এমন’টা নয়। পূর্ণতার মাঝেও ভালোবাসা বেঁচে থাকে, অপূর্ততার মাঝেও ভালোবাসা বেঁচে থাকে। জ্যাক কয়েক’টা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলছে।প্রিয়মের উপর ক্ষোভ হচ্ছে জ্যাকের, প্রচণ্ড ক্ষোভ।
________________________________________________________
মোনার একদিন পর কিছু’টা স্বাভাবিক হয়। জ্যাক আর নিশান মোনার পাশেই ছিলো। জ্যাক অনেকবার ফোন দিয়েছে প্রিয়মের নম্বরে। কন্টাক্ট করার চেষ্টা করেছে অনেক উপায়ে, কিন্তু কন্টাক্ট করতে না পেরে হতাশ হলো।মোনা জ্যাক’কে ইশারায় পাশে ডাকে। জ্যাক মোনার পাশে বসে। মোনা জ্যাকের দিকে তাকিয়ে বলল,
– “প্রেম-ভালোবাসা, বিয়ে-বাচ্চা সবটা’ই মিথ্যে ছিলো জ্যাক।কিছু কিছু মানুষ এত জঘন্য, কাউকে বলে বুঝানো যায় না। আমার সাথে সেই জন্মের পর থেকেই খারাপ’টা হয়ে আসছে। কেন এমন’টা হচ্ছে বলতে পারেন?”
মোনার এতগুলো কথার মাঝে জ্যাকের কানে একটা শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। বাচ্চা?কার বাচ্চা? জ্যাক কয়েক মুহূর্ত পর জিজ্ঞেস করল,
– “কার বাচ্চা মোনালিসা?কি মিথ্যে?”
– “জ্যাক আমি প্রেগন্যান্ট ছিলাম।প্রিয়ম আমায় জোর করে বাচ্চা এবরশন করিয়েছে। সবকিছু নাকি মিথ্যে ছিলো।”
জ্যাক নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মোনা কি অসুস্থ শরীর উল্টাপাল্টা বকছে? জ্যাক মোনার শরীরের তাপমাত্রা চেক করে। তাপমাত্রা নরমাল। মোনার ব্রেনে কি কোন সমস্যা হয়েছে? জ্যাক বিস্ময় ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
– “মোনালিসা আর ইয়্যু ওকে?”
মোনা চিৎকার করে বলে,
– “জ্যাক সব’টা অভিনয় ছিলো।শরীর পাওয়ার জন্য অভিনয়।”
জ্যাক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বলল,
– “কি সব বলছেন মোনালিসা?আর ইয়্যু ওকে?”
– “জ্যাক আমি ঠিক আছি। বলেন তো একটা মানুষ এত নিকৃষ্ট কিভাবে হয়? আমি কিছু ভাবতে পারছি না, আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব লন্ডভন্ড হয়ে গেল।আমি ভালোবাসায় বড্ড ভয় পেতাম।”
এসব কথা বিশ্বাস করতে জ্যাকের বেগ পেতে হলো। এতক্ষণ বিস্মিত হলেও এখন ক্রোধে কাঁপছে। প্রিয়মের উপর ক্রোধ। প্রিয়ম’কে এই মুহূর্তে সামনে পেলে মেরে রক্তাক্ত করে দিতো। মোনা’কে কি বলবে?কি বলে সান্ত্বনা দিবে জ্যাক বুঝে উঠতে পারছে না। এত’টা আঘাত প্রাপ্ত মানুষ’কে কি বলে সান্ত্বনা দেওয়া যায়? কিভাবে সহানুভূতি প্রকাশ করা যায়? মোনার এই যন্ত্রনায়,জ্যাকের প্রচণ্ড যন্ত্রনা হচ্ছে। জ্যাক কখনো চায় নি মোনা ওঁর ভালোবাসার মানুষ থেকে আলাদা হয়ে যাক। জ্যাক শুধু ভাবছে এসব জ্যাকের দেখা স্বপ্ন হয়ে যাক। ওঁদের সম্পর্ক’টা ঠিক থাকুক।
জ্যাক শুধু মোনার হাত ধরে বলল,
– “মোনালিসা বি স্ট্রং।”
মোনা তাকিয়ে আছে উদাস মনে।জ্যাকের কথার প্রত্যুত্তর করল না।
দুইদিন পর মোনা বাসায় গেল।মোনার ঘুম হয়নি এই কয়দিনে এক ফোঁটাও। জ্যাক বার বার যেতে না করেছে। মোনার ভালো লাগছে না হসপিটালে। জীবনের খেই হারিয়ে ফেলছে,জীবন নামক কবিতার ছন্দ হারিয়ে গেছে যেন। জ্যাক মোনার সাথে মোনা’কে পৌঁছে দিতে বাসায় আসে। বরাবরের মতই জ্যাকের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মোনার চোখ ছলছল করে ওঠে। হঠাৎ একদিন যদি জ্যাকও বদলে যায়? মানুষের নিশ্চয়তা কোথায়? মোনা বাসায় এসে ফোন হাতে নেয়। লিলি বেগম কল দিয়েছে ম্যাসেজ দিয়েছে কয়েকবার। মোনা সিম কার্ড’টা চেঞ্জ করে ফেলে। জ্যাকের দিকে তাকিয়ে বলল,
– “জ্যাক এই বাসা’টা চেঞ্জ করে ফেলবো।”
মোনার আচরণ কেন জানি জ্যাকের কাছে একদম অস্বাভাবিক লাগছে। মোনা এত বড় একটা দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে,অথচ একটু কাঁদে নি। হয়ত অতি শোকে পাথর হয়ে গেছে। কিন্তু এখন মোনা’কে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। মোনার কোথায়ও শোক কিংবা দুঃখের ছায়া নেই। মোনার এত স্বাভাবিক আচরণ জ্যাকের কাছে অস্বাভাবিক লাগছে। মোনা জ্যাকের দিকে তাকিয়ে বলল,
– “জ্যাক কফি খাবেন?”
জ্যাকের বিস্ময়ের পাল্লা আরো ভারি হয়ে গেল যেন। বিস্ময় ভরা গলায় জিজ্ঞেস করল,
– “মোনালিসা আপনি ঠিক আছেন?”
মোনা হেসে ওঠে। হাসির গাঢ় উচ্ছ্বাস মোনার ঠোঁটে। জ্যাক ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। মোনা কিছুক্ষণ পর উত্তর দেয়,
– “জ্যাক কার জন্য কষ্ট পাবো বলেন তো? একজন প্রতারক, জঘন্য মানুষের জন্য কি কষ্ট পাওয়া উচিত বলুন।”
– “তা তো উচিত নয়। কিন্তু কষ্ট কি উচিত-অনুচিত বুঝে? কষ্ট তো আপন নিয়মে মানুষ’কে দগ্ধ করে। আপনি এত তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিতে পেরেছেন সত্যি আমি অবাক হচ্ছি।”
মোনা কিচেনে গিয়ে এক মগ কফি নিয়ে আসে জ্যাকের জন্য। জ্যাক’কে চিন্তিত দেখাচ্ছে বেশ। মোনার এমন অদ্ভুত আচরণে চিন্তিত। মোনা জ্যাকের মুখোমুখি বসল, নিশান মোনার শরীর ঘেঁষে বসে আছে। মোনা বলতে শুরু করল,
– “জীবনে এত বেশি কষ্ট পেয়েছি অতি কষ্টে এখন অনুভূতি শূন্য হয়ে পড়েছি। আমি সারা জীবনে এত’টা সুখের সন্ধান করেছি কখনো পাইনি।”
মোনা একটু থেমে তাচ্ছিল্য ভরা গলায় বলে,
– “সুখ আমার জন্য না কিভাবে পাবো বলেন? আমার বুকের ভিতর’টা একদম ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে। আমি এখন আর কষ্ট প্রকাশ করতে পারি না।”
মোনার বলা কথায় কি ছিলো জ্যাক জানে না কিন্তু জ্যাকের বুকের ভিতর’টাতে ভীষণ যন্ত্রনা হচ্ছে। জ্যাক তাকিয়ে আছে মোনার দিকে। এত কষ্ট কেন মোনালিসার? কি অদ্ভুত জীবন! জ্যাক খুব যতনে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করল। মোনার বলা কথা গুলো জ্যাকের মর্মদেশে মহাতরঙ্গময় যন্ত্রনার সৃষ্টি করেছে।
জ্যাকের জরুরি পেশেন্ট আসে। হসপিটাল থেকে ফোন দেয়। জ্যাক চলে যায় হসপিটালে। মোনা বসে থাকে ফ্লোরে। বিষাক্ত এই জীবন নিয়ে মোনা হাঁপিয়ে গেছে। প্রিয়ম বিয়ে করবে, বিভা’কে নিয়ে সুখে থাকবে? মোনার বাঁধ ভাঙা হাসি। মোনার এমন অহেতুক হাসি দেখে নিশান ভয় পায়। মোনা কাঠের তৈরি পুতুলের মত এক ভঙ্গিতে অনেকক্ষণ বসে থাকে। মোনার সমস্ত কষ্ট জিদ,ক্রোধ,ক্ষোভ, আর আক্ষেপে পরিণত হচ্ছে ক্রমশ। ক্রোধে মোনার চোখ দুটো ধিকধিক করে জ্বলছে।
________________________________________________________
রাত হয়। চারদিকে অন্ধকার নামে। মোনা নিশাচর প্রাণীর মত দাঁড়িয়ে থাক বারান্দায়। সব কিছু মোনার চোখের সামনে ভাসছে। কি অদ্ভুত! একটু পানি পড়ছে না চোখ থেকে। চারদিকে কষ্ট গুলো ভেসে বেড়াচ্ছে যেন। মোনার মনে আবার প্রশ্ন জাগে, “সব মিথ্যে? কি থেকে কি হয়ে গেল?”
ঠকার ভয়ে প্রেম-ভালোবাসা থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছে। ভাগ্যের কি পরিহাস! জীবন নামের রঙমঞ্চে শেষ পর্যন্ত ভালোবাসার মানুষ দ্বারাই প্রতারিত হলো মোনা। প্রিয়মের মুখ’টা চোখের সামনে ভাসছে শুধু। অমানুষ গুলো দেখতে একদম মানুষের মত কেন হয়? বিছানায় শুয়ে ছটফট করে আবার উঠে হাঁটে সারা রুমে। আবার এসে শুয়ে এপাশ-ওপাশ করে। রাত’টা এভাবেই কেটে যায়।
ভোর বেলায় লিলি বেগম আসে।মোনা খাটের সাথে হেলান দিয়ে আছে। মোনার চেহেরা দেখে লিলি বেগম ভয়াবহ রকমে আঁতকে ওঠে। লিলি বেগম বলেছিল, “খারাপের সাথে খারাপই টিকে থাকে।” লিলি বেগমের বলা সেদিনের কথা গুলো নতুন করে মনে পড়ল। লিলি বেগম আতংকিত হয়ে বলল,
– “মোনা এই অবস্থা কেন তোর?কি হয়েছে?”
মোনা জড় পদার্থের মত হয়ে থাকে। কোন নড়াচড়া করছে না। লিলি বেগম মোনার কাঁধে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,
– “এই মোনা।”
– “অসুস্থ ছিলাম কয়দিন ধরে খালা।”
লিলি বেগম আফসোস করতে লাগলো মোনার অবস্থা দেখে। কিছুক্ষণ পর বলল,
– “তোর ফোন বন্ধ কেন ছিলো?আমি ব্যস্ত ছিলাম এসে খোঁজও নিতে পারিনি।”
– “ফোন’টায় ডিস্টার্ব দেখা দিয়েছে।”
মোনার গলা একদম নিস্তেজ আর হিমশীতল। চোখ গুলো লালচে হয়ে আছে। মুমূর্ষু রোগীর মত চেহেরা। লিলি বেগম উৎসুক হয়ে বলল,
– “মোনা শোন একটা ভালো খবর আছে।”
মোনা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।লিলি বেগম মোনার দৃষ্টির বিপরীতে বলে,
– “প্রিয়ম বলেছিল এক বছর পর বিয়ে করবে। হুট করে ওইদিন বলল তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চায়।পরশু ওঁদের বিয়ে। বিভা,বিহি তোর নানা বাড়ির সকল আত্মীয়,আমার শ্বশুড় বাড়ির সবাই এসেছে। এরিক’কে পাঠিয়েছিলাম তোকে নেওয়ার জন্য তা তোকে বাসায় পায়নি।তুই এখন চল, মানুষের ভিতর থাকলে রোগ ভালো হয়ে যাবে।”
মোনার তাকিয়ে আছে লিলি বেগমের দিকে। নির্বাক দৃষ্টি। মোনার জগৎ জুড়ে তোলপাড়। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে অমানুষ,প্রতারক, পিশাচ।মোনা স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করে,
– “বিয়ে পরশু দিন কয়’টায়?”
– “বিয়ে রাত দশটায়।তা দিয়ে তোর কি দরকার?তুই এখন চল।”
– “বিয়ের দিন যাবো খালা।আমার শরীর খুব বেশি খারাপ।বিয়ে বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়া একটা ঝামেলা না বলো? ঝামেলা বাড়বে।”
লিলি বেগম মোনার কথায় দমলো না। বার বার সাধতে থাকল। ঘন্টা দুয়েক ধরে লিলি বেগম মোনার তোষামোদ করতে লাগল।মোনা উন্মনা হয়ে বলল,
– “বিয়ের দিন যাবো খালা প্রমিস।”
শেষ পর্যন্ত লিলি বেগম’কে একাই ফিরতে হলো। লিলি বেগম চলে যাওয়ার পর মোনার শরীর থেকে যেন গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। মোনা ছুটে ওয়াশরুমে যায়। গায়ে পানি দিতে থাকে। মাথা
পানি’তে ভিজিয়ে রাখে। ছয় ঘন্টা ধরে গায়ে পানি দিয়েছে।
_________________________________________________________
প্রিয়মের বিয়ে আজ। রাত দশটায় বিয়ে। মোনা ছয়টার দিকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে। প্রিয়মের দেওয়া সেই ফিনফিনে কালো জর্জেট শাড়ি’টা পড়ে। গলায় জ্যাকের দেওয়া নেকলেস’টা। হাতে প্রিয়মের দেওয়া রিং। জীবনের প্রথম এত বেশি সেজেছে মোনা। নিশান আগে থেকেই রেডি হয়ে ছিলো। মোনা’কে দেখলে যে কারো দৃষ্টি আটকে যাবে।
মোনা নিশান’কে নিয়ে বের হয় প্রিয়মের বাসার উদ্দেশ্যে। বাসা ভর্তি লোকজন। তেমন কাউকেই মোনা চেনে না। মোনা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। লিলি বেগম কাজে ব্যস্ত, মোনার সাথে একটু কথা বলেই নিজের কাজে মন দিলো।
মোনার চোখ আটকে যায় বিভা’কে দেখে। লাল বেনারসী’তে মিষ্টি লাগছে খুব। মোনা এগিয়ে যায় সেদিকে। মোনা’কে দেখে বিভা জড়িয়ে ধরল। বলল,
– “আমার থেকে তোমায় বেশি সুন্দর লাগছে মোনা।”
প্রত্যুত্তরে মোনা হাসলো। কোত্থেকে যেন হঠাৎ প্রিয়ম এসে দাঁড়ালো বিভার পাশে। বিভার কানে কানে যেন কি বলল। মোনা’কে খেয়াল করেনি। বিভার সাথে কথা বলার পরই প্রিয়মের চোখ যায় মোনার দিকে।প্রিয়ম বজ্রাহত হয়ে তাকিয়ে থাকে। নিজের চোখ’কে বিশ্বাস করতে পারছে না। চোখে- মুখে অবিশ্বাসের ছাপ। মোনা এসেছে? হাস্যেজ্জ্বল মোনার মুখ। প্রিয়ম এত বেশি অবাক আর কখনো হয়নি।
মোনা প্রিয়ম’কে লক্ষ্য করতে লাগল। প্রিয়মের সাথে আড়ালে কথা বলতে হবে। হঠাৎ প্রিয়ম’কে একা পেয়ে মোনা ডাকলো। প্রিয়মের বিস্ময়ের পাল্লা আরো ভারি হলো। বিস্ময় কাটিয়ে বলল,
– “তুমি কেন এসেছো মোনা?”
মোনা খুব সহজ গলায় বলল,
– “আপনার সাথে আমার একটু জরুরি কথা আছে।আমি আপনাদের মাঝে কোন ঝামেলা করব না। কথা’টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ আপনার জন্য।”
প্রিয়ম কি যেন ভাবলো। মোনার এমন সহজ আচরণ অস্বাভাবিক লাগলো। প্রিয়ম বলল,
– “যা বলার এখানে বলো।”
মোনা সাবধানী হয়ে বলল,
– “যে কেউ শুনে ফেলতে পারে। আপনাদের বাসার পিছনে একটা নির্জন জায়গা আছে না?ওখানে যান। আমিও আসছি। আপনা’কে আর আমাকে এক সাথে যেতে দেখলে সন্দেহ করবে। আপনি আগে যান। আমিও লুকিয়ে লুকিয়ে আসছি।”
প্রিয়ম যেন গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। মোনা আবার বলল,
– “কথা’টা আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমার জন্য নয়।একটা কথা আপনার জীবনের মোড় পাল্টে দিবে।”
প্রিয়ম ঠোঁট কামড়ে কি যেন ভেবে বলল,
– “আচ্ছা যাচ্ছি।”
প্রিয়ম যাওয়ার মিনিট পাঁচেক পর মোনাও সবার চোখের আড়াল দিয়ে বের হলো। সেখানে যেতে মিনিট পাঁচেক লাগবে। মৃদু হাওয়ায় মোনার চুল গুলো উড়ছে। মোনা পা ফেলে এগুচ্ছে সামনের দিকে। প্রিয়ম পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। মোনা’কে দেখে বলল,
– “কি বলবে বলো?”
প্রিয়মের গলার স্বরে তীব্র বিরক্ত।মোনা প্রিয়মের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। হাতের ব্যাগ থেকে খুব সাবধানে ধারালো ছুরি’টা বের করে। প্রিয়ম কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছুরির একটা আঘাত পড়ে প্রিয়মের পিঠ বরাবর। প্রিয়ম শুধু একটু শব্দ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তীব্র যন্ত্রনায় চিৎকার করছে,চাপা চিৎকার। জোরে চিৎকার করার মত শক্তি নেই। দ্বিতীয় আঘাত’টা প্রিয়মের গলায়। প্রিয়ম শুধু বলে ওঠে, “মোনা”। ক্রমাগত ছুরির আঘাতে প্রিয়মের মাথা’টা দেহ থেকে আলাদা হয়ে যায়।
(চলবে)