❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[১৩]
সীমা বেগমকে উসকে দিতে না পেরে মহিলা থোঁতা মুখে বসে রইলেন। তারপর পান খাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন।সীমা বেগম উনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। আজকাল মানুষ কেউ কারো ভালো সহ্য করতে পারে না। তখন মেধা দরজার আড়ালে থেকে বেরিয়ে নত মস্তকে দাঁড়ালো। তার চোখে পানি ছলছল করছে। মনে হচ্ছে পলক ফেলা মাত্র তা গড়িয়ে পড়বে। ডাগর ডাগর নেত্র জোড়ায় অশ্রু দেখে সীমা বেগম ভ্রুঁ কুঁচকালেন। হাতের খুন্তি রেখে উঠে এসে মেধার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। থুতনি ধরে ওর
মুখ তুললেই মেধার অশ্রুফোঁটা পড়ল সীমা বেগমের হাতের উপর। উনি এবার বিচলিত হয়ে পড়লেন। কি হয়েছে, কেউ কিছু বলেছে কী না, পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে কী না, পেটে সমস্যা নাকি মাথা ব্যথা? এমন নানান ধরনের প্রশ্ন করতেই থাকলেন একের পর এক। মেধা কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে অশ্রু ঝরাচ্ছে। বিগতদিনে এই মহিলাটা তাকে অনেক কথায় বলেছে। এমনকি মাকে নিয়েও আরো দু’জন মহিলার সঙ্গে কীসব বলে হাসাহাসি করছিলো। অপরিচিত মহিলা তাছাড়া বিয়ে বাড়ি বলে কিছু বলে নি। কিন্তু আদিত্য আর ওকে নিয়ে কীসব বলে বেড়াচ্ছেন। এসে থেকে মহিলা ওর পেছনে লেগেছে। এর কারণ ওর বোধগম্য হচ্ছে না। সে তো উনার কোনো ক্ষতি করে নি, তবে? মেধাকে নীরবে অশ্রু ঝরাতে দেখে সীমা বেগম বললেন,
-”আদিত্য বাজারে যাওয়ার আগে বলে গেছে তোকে যেনো দেখে শুনে নজরে নজরে রাখি। সে এসে যদি দেখি তার বউ কেঁদেছে তাহলে আমার কী হবে ভাবতে পারছিস?”
-”ওই মহিলা যা বলেছে…!”
-”উনার কথা বাদ দে। উনি উনার মেয়ের জন্য আদিত্যকে পছন্দ করেছে। আমাকে প্রস্তাবও দিয়েছিলো। আমি উল্টো কথা বলে ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছি। তাই তোকে আদিত্যের পাশে সহ্য করতে পারছে না।”
মেধা একথা শুনে দুই হাত দিয়ে চোখ মুছে নিলো। তারপর মামনিকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে মন খারাপ সুরে বলল,
-”রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তোমার ছেলে মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়েছিলো। আমি ওর পেছনে ছিলাম অন্য দিকে তাকিয়ে হাঁটছিলাম, দাঁড়িয়ে গেছে খোয়ালও করি নি আমি। তখনই ওর পিঠের সঙ্গে বারি খায় আর নাকে ব্যথা পায়। আর…!”
-”এই দাঁড়া দাঁড়া আমি কি এসব জানতে চেয়েছি? তোরা কী করেছিস না করেছিস এসব আমাকে আর বলতে আসবি না। আমি জানি আমার ছেলে মেয়ে কেমন। এখন যা সুন্দর করে মুখটা ধুয়ে চুলগুলো আঁচড়ে নে। দেখতে তো বান্দরনী লাগছে।”
মামনির এ কথা শুনে মেধা মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেল। ওর
যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সীমা বেগম হাসলেন। এই হাতে উনি খুব আদরে মেধাকে বড় করে তুলেছেন। আদরের বোনটার শেষ স্মৃতি হচ্ছে, মেধা। রোজোয়ান বিয়ে করলে সৎ মা তো মেধার যত্ন করবে না, ভালোবাসবে না। এই চিন্তা করে উনি মেধাকে নিয়ে নেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। কিন্তু উনার এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে রোজোয়ান ওয়াদা করেছিলেন, উনি আর কখনো বিয়ে করবেন না। মেধা মা’ই উনার প্রথম এবং
শেষ ভালোবাসা। সেই স্থান উনি আর কাউকে দিতে পারবে না। একথা শুনে সীমা বেগম স্বামীর সাহায্যে নিজের সংসার সামলেছেন, মেধার যত্নও নিয়েছেন। এমনও হয়েছে মেধার জন্য দুই ছেলের খেয়াল রাখতে পারেন নি। আর সেই অতি আদরে যত্নে বড় করা পুতুলকে উনি কীভাবে অন্যের বাসায় পাঠাবে? যদি সেখানে মেয়েটাকে কষ্ট দেয়, ভালো না বসে?
এসব ভেবেই সর্বপ্রথম আদিত্যের সঙ্গেই কথা বলেছিলেন।
ছেলে দুই হাত ধরে বিনয়ী ভাবে বলেছিলেন,
-”আব্বু, আমার একটা চাওয়া পূরণ করবে?”
-”কি লাগবে, আদেশ করো আম্মু।”
-”ওই পুতুলটাকে সারাজীবনের জন্য আমার কাছে রাখার ব্যবস্থা করে দিবে?”
-”কোন পুতুল? কার কথা বলছো তুমি?”
-”মেধার কথা বলছি আমি।”
আদিত্য ওর মায়ের এই কথা শুনে ভ্রুজোড়া কুঁচকে নিলো।
চট করে বুঝেও ফেললো মায়ের কথার মানে। মেধাকে নিয়ে তেমন ফিলিংস নেই ওর মনে। আর পাঁচটা কাজিনের মতোই দেখে সে মেধাকে। ছেলের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে সীমা বেগমই কথা তুললেন,
-”তোমার সঙ্গে মেধার বিয়ে দিতে চাই আমি। আমার চোখের সামনে রাখতে চায় ওই চঞ্চল প্রান্তবন্ত পাখিটাকে। আম্মুর এই আবদারখানা রাখো আব্বু। আর বলছি না এখনই বিয়ে করতে হবে। সেও আরো বুঝতে শিখুক, তুমিও সময় নাও।
তবে বেলাশেষে আমি তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর রুপে একসঙ্গে দেখতে চাই। এটাই আমার শেষ চাওয়া। তাছাড়া আজ তার প্রতি তোমার ফিলিংস নেই, কালও যে ফিলিংস তৈরি হবে না তা তো না। বাবা তুমি সময় নিয়ে নাহয় জানিও আমাকে।
তখনো যদি তোমার সিদ্ধান্ত একই থাকে তাহলে আর জোর করবো না।”
সেদিন আদিত্য শুধু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়েছিল। তারপর
থেকে সে মেধাকে বিশেষ ভাবে নজরে রাখতো। আর মেধা কেন জানি আদিত্যের পেছনেই লেগে থাকতো। এই যেমন,
আদিত্যের জিনিসপত্র ঘাটাঘাটি করা, এটা-ওটা নষ্ট করা,
কারণে অকারণে ঝগড়া করা। এভাবেই দু’টো বছর পেরিয়ে গেছে। আদিত্যকেও আলাদা করে মুখে ফুটে বলতে হয় নি, বিয়ের কথা।উনি মা হয়ে ছেলের মনের খোঁজ বুঝে নিয়েছে।
সেই সঙ্গে এটাও বুঝেছে আদিত্য আর মেধা দুজন দুজনকে খুব পছন্দ করে। তারা একে অপরের খুব করে চায়। উনিও ভেবে রেখেছে মেধার বাবা আসলে বিয়েটা সেরে ফেলবেন। কারণ মেধার বাবার শরীরে অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। মূলত এজন্যই রোজোয়ান দেশের বাইরে গেছে। উনার হৃদপিন্ডে সমস্যা দেখা দিয়েছে। যদিও একথা রোজোয়ান উনি আর আদিত্য ছাড়া কেউ জানে না। এসব ভেবে উনি রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন। বেলা গড়িয়ে অনেক সময় কেটে গেল।
বাসা এখন মেহমানে গিজগিজ করছে। আদিত্য বাজারের কাজ সেরে আবার কোথাও বেরিয়েছে। বলে গেছে ফিরতে দেরি হবে৷ ওদিকে বিকাল থেকেই সূচিকে সাজানোর কাজ শুরু হয়েছে।পার্লার থেকে মেয়ে এসেছে তাকে সাজাতে। সব কাজিনরা তাকে ঘিরে ধরে বসে আছে৷ সূচির হলে তারাও সাজগোছ করবে। মেধা মুখ গোমড়া করে বসে আছে। তার মন ভীষণ খারাপ। আদিত্যকে সে যা যা আনতে দিয়েছিলো একটাও আনে নি। বরং লিস্টটাই নাকি হারিয়ে ফেলেছে। এ সহ্য করা যায়! খানিকক্ষণ পরেই সীমা বেগম ওকে ডেকে শাড়ি নিয়ে আদিত্যের রুমে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলো
-”মেধাকে কোনটাতে মানাবে বেশি চুজ করো তো,আব্বু।”
-”এই শাড়ি টাড়ির কিছু বুঝি না আমি। তোমার যেটা পছন্দ হয় সেটাই পরতে দাও।”
একথা বলে আদিত্য মেধার দিকে তাকিয়েই নুডলস খেতে
লাগল। তা দেখে মেধার মনে হলো, নুডলস নয় সে মেধাকে মুখে পুরছে। তখন সীমা বেগম খুব বিরক্ত হয়ে বললেন,
-”এটা কেমন কথা আদিত্য? যা জিজ্ঞাসা করছি বলো।”
-” কি আশ্চর্য, কি বলবো? তোমার মেয়ে তো দিনের বেলায় সাধারণ ড্রেস পরেই হোঁচট খায়। সে নাকি পরবে শাড়ি তাও রাতের বেলা।”
একথা শুনে মেধা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। রাগী চোখে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। মনে হলো এখানে দাঁড়িয়ে থাকা অনর্থন। তাই চলে যেতে পা বাড়াতেই সীমা বেগম বললেন,
-”ওমা চলে যাচ্ছিস কেন, দাঁড়া শাড়িটা চুজ করি আগে।”
-”আমি পরবো না শাড়ি। তুমি তোমাকে ছেলে পরিয়েই বসে রাখো।”
একথা বলে মেধা দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো। আদিত্য ততক্ষণে খাওয়া শেষ করে ফেলেছে। সীমা বেগমও বিরক্ত হয়ে পা বাড়াতেই আদিত্য একটা শপিং ব্যাগ ধরিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। এখন সে গোসল সেরে বাইরে যাবে, কাজ আছে। এত রাগ দেখার সময় তারও নেই। তাছাড়া সে ভুল বলে নি, মেধা একবার শাড়ি পরা অবস্থায় ড্রেনে পড়ে কপাল কাটার ঘটনা ঘটিয়েছে। তিনটে সেলাইও পড়েছিলো কপালে। তবুও তার শাড়ি পরার শখ মিটে নি।
To be continue……..!!