মোহ মেঘের আলাপন পর্ব – ২৬

❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[২৬]

-“পৃথিবীর বুকে অন্যান্য বিধবা’রা যেভাবে বাঁচে।”

একথা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই মেধা অশ্রুসিদ্ধ নেত্রে তাকিয়ে রইল। মুখে রা শব্দ নেই। এই প্রথম আদিত্য এত কঠিন কথা শুনালো৷ যে কথা সে কল্পনাতেও আনে না। আচ্ছা, বিধবার কথা বলতে কী তার বিবেকে বাঁধল না? যতগুলো অভিযোগ আছে জানাতে পারতো, দু’ চার থাপ্পড় মেরে ওর ভুল ধরিয়ে দিতে পারতো। তাই বলে একথা বলবে? একবার ভাবলো না সে কষ্ট পাবে কী না? আদিত্য সামনে দৃষ্টি রেখে গাড়ি ড্রাইভ করছে। সে পূর্বের মতোই স্বাভাবিক, নিশ্চল। মেধা দৃষ্টি তুলে জবাবে কিছু বলতে পারল না। ওর নির্বোধ কান্না গলায় দলা পাকিয়ে কিছু উচ্চারণ করতেই দিলো না। শুধু অঝরে ঝরে গেল অশ্রুধারা। কিয়াৎকাল সেভাবেই থম মেরে বসে রইলো সে। তারপর আদুরে বিড়ালছানার মতো আদিত্যের দিকে সরে এসে বাহুতে মাথা ঠেকালো। পরক্ষণেই শব্দ করে কেঁদে উঠলো। এ কান্না হৃদয় পোড়া কান্না। আদিত্যের বাহুতে মুখ গুঁজে শব্দ করে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে।মেধাকে এভাবে কাঁদতে দেখে তখন আদিত্য বললো,

-”বিধবা হওয়ার কথা বলেছি হও নি তো এখনো। তার আগে এত কান্নাকাটি।”

মেধা নিশ্চুপ। সে কান্নাতে ব্যস্ত। আদিত্য তখন মোড় পেরিয়ে
তাদের বাসার সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বললো,

-”এসে গেছি, যাও তোমার মামনীর কাছে। ভালো থেকো।”

একথা বলে আদিত্য তাকে ছেড়ে দিলেও মেধা ছাড়লো না। বরং আরো শক্ত করে খামচে ধরলো আদিত্যের বুকের শার্ট। বারবার মাথা নাড়িয়ে বোঝাতে লাগল, সে যাবে না,কিছুতেই না। তবে কান্নার চোটে মুখ দিয়ে কথা বের হলো না। আদিত্য বাসার দিকে একবার তাকিয়ে মেধাকে বললো,

-”যেখানে তুমি ভালো থাকবে সেখানেই রেখে যাচ্ছি। তোমার তো আমাকে বাদে সবাইকে প্রয়োজন।”

-”না, আ আমার তোমাকেই লাগবে শুধু, তোমাকেই। প্রমিস,
আমি আর এমন করবো না। এবারের মতো মাফ করে দাও।
বিশ্বাস করো আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না, মরেই যাবো। তুমি ছাড়া আমার পুরো পৃথিবী অন্ধকার।”

-”ওহ আচ্ছা।”

-”সত্যি বলছি আমি ভালো বউ হয়ে দেখাবো। তোমার যোগ্য হয়ে উঠবো। প্লিজ আমাকে রেখে যেও না।”

-”লোক দেখানো কাজে স্বার্থকতা নেই।”

-”আদিত্য আর একবার সুযোগ দাও। সত্যি তোমাকে ছাড়া আমি শূন্য। বাবা মায়ের পর তুমি আর মামনী আমার ছায়া।
এখন তুমি যদি ছেড়ে যাও আমি একেবারে শেষ হয়ে যাবো, মরে যাবো।”

-”আগে মনে ছিল না?”

আদিত্য জোর করে তার বুক থেকে মেধার মুখ তুলে চোখে চোখ রাখল। মেধার চোখ অশ্রুজলে টইটুম্বুর। তারপর শান্ত ভাবে বলতে থাকলো,

-“প্রিয়জনের মূল্য বুঝলে হলেও দূরত্বের প্রয়োজন। প্রিয় কারো অনুপস্থিতি যদি তোমাকে ভীষণভাবে পোড়ায়, বুকে দহন সৃষ্টি করে। তাহলে বুঝবে তুমি ভালোবাসতে শিখেছো।
তোমার হৃদয় অন্য কারো দখলে। শোনো, ভালোলাগা আর ভালোবাসা এক নয়। তুমি বোধহয় ভালো লাগাতেই আঁটকে আছো। ভালোলাগা ক্ষণিকের, যেটা অস্থায়ী। যদিও বিয়ের পর এসব কথা মোটেও শোভনীয় নয়। কিন্তু বর্তমানে আমার মনে হচ্ছে আমাদের আরো সময় নেওয়া উচিত ছিল।একথা কেন বলছি জানো, কারণ তুমি তোমার অনুভূতি নিয়ে নিজে সন্দিহান। নিজের মন কী চাই তুমি এখনো জানো না।বোঝো না প্রিয় মানুষটাকে। এমনকি তার চাওয়া পাওয়ার দাম নেই তোমার কাছে। তার প্রতি তোমার অনুভূতিও নিষ্প্রাণ।”

-”আমি তোমাকে ভালোবাসি আদিত্য।”

-”এজন্যই আমার মূল্য এত ঠুনকো তাই না?

-” এতকিছু জানি না, জানতেও চাই না। আমি তোমাকে কোথায় যেতে দিচ্ছি না, মানে দিচ্ছি না। এরপরেও যদি যাও, আমি সুইসাইড করবো, পাক্কা প্রমিস।”

-”আবেগ দিয়ে জীবন চলবে না মেধা। আর সবকিছুতে রাগ, জেদকে, প্রশ্রয় দিতে নেই। কারণ আবেগ আজ আছে কাল নেই। সময় তোমাকে আবেগের রুপ দেখিয়ে দিবে। এর চেয়ে তুমি সময় নিয়ে ভাবো তোমার মনকুঠুরিতে আমার অবস্থান ঠিক কোথায়।”

-”বাসায় চলো।”

-”এসেছিই তো, ভেতরে যাও তুমি।”

-”না, আমি আমার সংসারে ফিরতে চাই।”

-”সংসার তোমার সঙ্গে গড়তে চেয়েছিলাম। ভাগ্যে নেই, বাদ দাও। তবে সংসার সাজাতে হলে বিশ্বাস, দায়িত্বশীলতা আর ভালোবাসার প্রয়োজন। যেখানে আমাদের সম্পর্কে এসবের স্থান নেই সেখানে সুখী সংসারের কথা ভাবাও বোকামি।”

-”এভাবে কথা বলছো কেন তুমি? ওহ এখন আমাকে ভালো লাগছে না তাই না?”

-”তোমাকে বুঝতে আর বোঝাতে আমি এবার ক্লান্ত। আমার
অনুভূতি অনুভব করতে পারলে একথা বলতে পারতে না। ”

মেধা দৃষ্টি নত করে আদিত্যের বাহুতে মাথা ঠেকাল। এতবার বলেও তাকে নামানো গেল না৷ জোরপূর্বক নামানোর ইচ্ছেও আদিত্যের নেই। তাছাড়া বেলকণিতে ওর বাবা মা হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। হয়তো ভেবেছেন তারা ফিরে এসেছে। বাবা মায়ের প্রতি আদিত্যের অনেক অভিমান জমেছে, অনেক। সে বাসা ছেড়ে যাওয়ার সময় তার মা একবার নিষেধ করতে পারতো। প্রয়োজনে মেরে হলেও তাকে আঁটকাতে পারতেন। কিন্তু তা করে নি। উনি তো এটাও জানতেন আদিত্য উনাকে ছাড়া থাকতে পারে না। ছোট থেকেই সে খুব মা ভক্ত। বাইরে খাবারে তার পেটও ভরে না। যতক্ষণ না মায়ের হাতের রান্না পেটে পড়ে। অথচ ওর মা তার অভিমান তো বুঝলো না বরং উনিও অভিমান করে চুপ থাকলেন। বড় হয়ে গেছে বলে কী শাসন করতে পারতেন না? মনে মনে এসব ভেবে গাড়ি স্টার্ট করে সেখানে থেকে চলে এলো তারা। ওদেরকে যেতে দেখে সীমা বেগম আঁচলে চোখ মুছে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললেন,

-”আমার ছেলে মেয়েরা কত বড় হয়ে গেছে তাই না? আমার আদিত্যটা হয়তো ভুলেই গেছে আজ তার মায়ের জন্মদিন। প্রতি বছরের মতো এবারও আমার তিন ছেলে মেয়ের জন্য উপহার কিনে এনেছি। সেই সঙ্গে অপেক্ষা করছি তারা এসে কখন বলবে, ‘আম্মু আমরা তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। এ বার বোধহয় কেউ আসবে না আমার কাছে। মূল্যহীন হয়ে গেছি কী না!”

সহধর্মিণীর কথা শুনে আদিত্যের বাবা এবার মুখ খুললেন,

-”সেদিন আদিত্যকে না নিজে আঁটকালে আর না আমাকে আঁটকাতে দিলে। এটা কী ঠিক হয়েছে? আমাদের ছেলেটা এখন বড় হয়েছে সীমা, তার নিজস্ব সুখ-দুঃখ মান অভিমান আছে। আর আমান যা করেছে রাগ করা কী স্বাভাবিক নয়? তাছাড়া আমাদের কী উচিত ছিলো না আদিত্যকে যেভাবেই হোক আঁটকানো। আমরা তো জানতাম রাগের বশে যাচ্ছে সে। সেদিন আঁটকালে এই ঘটনা এতদূর অবধি গড়াতো না।”

-“মেধার বয়স কম। বুদ্ধিই বা কতটুকু বলো? তারা আলাদা হয়েছে একপক্ষে ভালোই হয়েছে। দু’জন একসঙ্গে থাকবে, একে অপরের বুঝতে শিখবে৷ একে অন্যের চাওয়াকে গুরুত্ব
দিবে। আর সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে গেলে বোঝাপড়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একটা সম্পর্কের খুঁটিই হচ্ছে বোঝাপড়া। এই সুযোগে ওদের সম্পর্কের ভীতটা আরো মজবুত হোক।”

-”ভেবে চিন্তে যখন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছো তাহলে এখন কষ্ট পাচ্ছো যে?”

জবাবে সীমা বেগম শুধু হাসলেন। এই উত্তরটা উনার জানা নেই।তারপর উনারা নীরবে অশ্রু ঝরিয়ে রুমে চলে গেলেন।
সেদিন রাতে আমান বাসাতেই ফিরলো না। কিন্তু আদিত্যের মাঝরাত থেকে ভীষণ জ্বর এলো। জ্বর কমছে না দেখে মেধা দিশাহারা হয়ে ব্যাঁকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে সীমা বেগমকে কল করলো। সীমা বেগম তখনো অপেক্ষায় ছিলেন উনার ছেলে মেয়েদের।উনার মন বলছিলো, কেউ উয়িশ করুক বা না আদিত্য উনাকে যেভাবেই হোক উয়িশ করবেই করবে।
মাঝরাতে যখন ফোনে রিংটোন বেজে উঠলো তখন উনার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। মেধার নাম্বার দেখে হাসি দীর্ঘ হলো।
কিন্তু কল রিসিভ করতেই শুনতে পেলে মেধার কান্নার শব্দ। ক্ষণিকেই উনার হাসি মিলিয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো। তখন মেধা জানালো আদিত্যের জ্বরের কথা। উনি একথা শুনেই চট করে আদিত্যের বাবাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। যথাসময়ে তারা আদিত্যের ফ্ল্যাটে পৌঁছালেন একজন মাঝ বয়সী ডাক্তারকে নিয়ে। ডাক্তার বলার আগেই সীমা বেগম বালতিভর্তি পানি এনে মাথায় ঢালতে থাকলেন। বার বার ডাকতে থাকলেন ছেলের নাম ধরে। সহজে আদিত্যের জ্বর
আসে না, আর আসলে ভীষণভাবে ভুগতে হয়। মায়ের ডাক শুনে আদিত্য অনেক কষ্টে একবার তাকিয়ে দেখলো। মাকে দেখে শুকনো ঠোঁটে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা দেখা দিলো। সেই সঙ্গে চোখ ফেটে গড়িয়ে গেল অশ্রুকণা। সীমা বেগম নিজে
মুছে দিলেন সেই নোনাজল। উনি বুঝতেও পারলেন ছেলের কষ্টটা। তখন আদিত্য মায়ের হাতটা বুকে চেপে ধরে বিরবির করে বললো,

-”আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি মা, ভীষণ ভালোবাসি। প্রতিবছরের মতো এবারও চাইছি, আল্লাহ আমার আয়ুটুকু তোমাকে দিকে। আর তুমি আমাদের সবার মা হয়ে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকো। ”

To be continue………!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here