মোহ মেঘের আলাপন পর্ব – ২৭ ও শেষ

❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[২৭] (অন্তিম পার্ট)

-”আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি মা, ভীষণ ভালোবাসি। প্রতিবছরের মতো এবারও চাইছি, আল্লাহ আমার আয়ুটুকু তোমাকে দিক। আর তুমি আমাদের সবার মা হয়ে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকো। ”

ছেলের মুখে একথা শুনে সীমা বেগম নীরবে অশ্রু ঝরাতে লাগলেন। না, এখন নিজেকে আবেগে ভাসানোর সময় নয়। আগে ছেলের জ্বর কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে৷ এত জ্বর!
একথা ভেবে উনি ডাক্তারের দিকে তাকালেন। ডাক্তার জ্বর মেপে আদিত্যকে ইনজেকশন পুশ করছে। মেধা আদিত্যের বাবার পাশে দাঁড়িয়ে ছলছল নেত্রে তাকিয়ে আছে। হেঁচকি তুলে কেঁদে একাকার অবস্থা। সীমা বেগম সেদিক পানে এক নজর তাকিয়ে মেধাকে কাছে ডাকলেন। পানিভর্তি মগ তার দিকে এগিয়ে দিয়ে উনি গেলেন কিছু রান্না করতে। সামান্য কিছু খেয়ে ওষুধ খেতে হবে। আর জ্বর এলে আদিত্য খাবার নিয়ে খুব ঝামেলা করে। নানান অজুহাত দেখায়। এমনিতেই জ্বর তার উপর খাওয়া দাওয়ারও বেহাল দশা। এসব ভাবতে ভাবতে উনি নুডলস রান্নার প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। একটুপর
ডাক্তার ওষুধ লিখে ভিজিট নিয়ে বিদায় নিলেন। আর বার বার বলে গেলেন পেশেন্টের খেয়াল রাখতে।যদিও জ্বর আর বাড়ার কথা না, তারপরেরও। মেধা কাঁদছে আর আদিত্যের মাথায় পানি ঢালতে।মেধাকে খেয়াল রাখতে বলে আদিত্যের বাবা ছুটলেন ওষুধ আনতে। রুম ফাঁকা দেখে সে আদিত্যের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। তখন আদিত্য বললো,

“জ্বর এসেছে, মারা তো যায় নি, কান্না কাটি বন্ধ করো।”

“জ্বর এসেছে তাও এভাবে কথা বলবে? আর মরা টরার কথা কী না বললেই নয়?”

“কেন বলবো না? সুস্থ থাকলে ভালো তো বাসোই না, একটু কাছেও আসতে চাও না। এখন অসুস্থ এজন্য কাছে বসে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছো। ”

”তাহলে কি করবো?”

“কিছু করতে হবে না, পাশে এসে ঘুমাও।”

মেধা একথার জবাব দিলো না। আপনমনে পানি ঢালতে থাকলো আদিত্যের মাথায়। তখন সীমা বেগম মেধার নাম ধরে ডাকলেন। মেধা চট করে উঠে দৌড়ে গেল রান্নাঘরের দিকে। সীমা বেগম তাকে দেখে বললেন, তোয়ালে ভিজিয়ে আদিত্যের শরীরটা মুছে দিতে। একথা শুনে মেধা বলল,

“পারব না তোমার ছেলে তুমিই যাও

“আমার ছেলে আর তোর কে? পারবি না মানে? এ আবার কেমন কথা?”

“যখন থেকে জ্বর এসেছে বার বার বলেও আমি জলপট্টি দিতে পারি নি। তার একই কথা, মাথায় পানিও ঢালবে না, ওষুধও খাবে না।”

“স্বামী মানে একান্ত নিজের ব্যক্তিগত মানুষ। তার উপরে জোর খাটানোর অধিকার তোর আছে। সে যদি তোকে একটা ধমক দেয় তুই দুইটা ধমক দিবি। বোঝা গেল? এবার যা।”

“তুমি যাও, আমি রান্না করছি।”

” সত্যিই যাবি না?”

”নাহ্।”

“যেতে হবে না তোকে। আমি আমার ছেলের আবার বিয়ে দিবো। বাধ্য একটা মেয়েকে বউ করে আনবো। ”

”একদিকে ছেলের অত্যাচার অন্যদিকে মায়ের। আমার হয়েছে যত জ্বালা। আর ভাল্লাগেনা, আমিই চলে যাবো যেদিক দু চোখ যায়।”

একথা বলতে বলতে মেধা পুনরায় রুমে ফিরে গেল। দরজা আঁটকে আদিত্যের কাছে গিয়ে টি শার্ট খুলতে উদ্যত হতেই আদিত্য বাঁধা দিলো। মেধা আদিত্যের গাল চেপে ধরে রাগী স্বরে বললে,

“মেয়ে মানুষের মতো ঢং করা বাদ দেন। এখন নিশ্চয়ই এটা বলবে না, আমার সামনে টি শার্ট খুলতে লজ্জা লাগছে।”

“শীত লাগছে রে বাবা।”

“আমি তোমার বাবা? একটা বাবা দিয়ে তোমার হচ্ছে না? তুমি বউকে বাবা ডাকতে শুরু করে দিলে?”

আদিত্য এবার বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। মাথা ব্যথায় কাহিল সে। এরিমধ্যেই এই মেয়েটা ভীষণ জ্বালাচ্ছে।
আদিত্য বিরক্ত হয়ে উঠে বসে টি শার্ট খুলে ফেললো। মেধা
তোয়ালে ভিজিয়ে শরীর মুছে দিয়ে মাথাও ভালো করে মুছে দিলো। অতঃপর আদিত্যকে শুতে বলে তোয়ালে মেলে দিয়ে দরজা খুলে আদিত্যর কপাল টিপে দিতে থাকল।তখন সীমা
বেগম নুডলস আর এক কাপ চা করে আনলো। আদিত্যকে খেতে বলে মেধাকেও তুলে দিলেন একবাটি নুডলস।আদিত্য
খেয়ে ওষুধ শুয়ে পড়লো।তখন সীমা বেগম ভালো মন্দ বেশ
কয়েকটা কথা বললেন তাদের দু’জনকে।ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে মান অভিমানের পালাও ভাঙলেন। চারদিকে তখন ফরজের আজান দিচ্ছে। তারপর মেধাকে আদিত্যের দিকে খেয়াল রাখতে বলে উনারা বাসায় চলে গেলেন। আমানের খোঁজ নাই তার উপরে এতবড় বাসা ফাঁকা। না জানি কখন কোন বিপদ ঘটে যায়। উনারা চলে যেতেই মেধা আদিত্যের বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। আদিত্যও জড়িয়ে ধরে নেত্র জোড়া বুজে নিলো। এখন ভালো লাগছে, মনে হচ্ছে জীবন সুন্দর, ভালোবাসা সুন্দর।
________________________________

সেদিনের পর থেকে সত্যি সত্যি মেধার মধ্যে পরিবর্তন দেখা গেল। আদিত্যের প্রতিটা ব্যাপারে সে এখন ভীষণ সিরিয়াস।
এখন রোজ সকালে কাজের মেয়ের সাহায্যে নাস্তা বানিয়ে খেয়ে দু’জন এক সঙ্গে বাসা থেকে বের হয়। আদিত্য তাকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে অফিসে চলে যায়। মেধা কলেজ শেষ করে কখনো বাসায় ফিরে, কখনো আদিত্যকে চমকে দিতে অফিসে চলে যায়। আবার কখনো সীমা বেগমকে জ্বালাতে সেখানে উপস্থিত হয়। এক কথায় পড়াশোনা, স্বামী- সংসার,
শশুড় শাশুড়ী নিয়ে ভালোই দিনকাল কাটছিল। এরিমধ্যেই, অবাক করা একটা ব্যাপার ঘটেছে। সেদিন রাতের পর, এত খুঁজেও আমানের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। দিন যায়, মাস যায়, তবুও সে ফিরে না। ছেলের অপেক্ষায় সীমা বেগম খুব কাঁদেন, দোয়া করেন। ছোট ভাই নিঁখোজ, বাসা ফাঁকা, মাও সবসময় কাঁদে দেখে আদিত্য বাসায় ফিরে এলো। ওর ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে দিলো। আমানের নিঁখোজের যখন ছয়মাস আট দিন পার হলো তখন খবর এলো, আমান বেঁচে আছে। আর সে স্বেচ্ছায় রিহ্যাবে গেছে বর্তমানে সেখানেই আছে। লড়াই করছে নেশা থেকে মুক্ত হতে। প্রিয় মানুষদের সঙ্গে সুস্থভাবে
বেঁচে থাকতে। একথা শুনে সবাই অশ্রু ঝরালো, ভীষণ খুশি হলো। তারপর সবাই দেখা করতে। ছয় মাসে আমানের মধ্যে
অনেক পরিবর্তন এসে়ছে। স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে। চেহারাতে
সুখ সুখ ভাব ফুটে উঠেছে। সবার সঙ্গে কথা বলে আমানের দৃষ্টি পড়লো আদিত্যের দিকে। আদিত্য তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমান দৃষ্টি নত করে মাথা নুইয়ে ফেলল। অশ্রু ঝরে
যেতে লাগলো তার দু’চোখ বেয়ে। অপরাধবোধ তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় প্রতিনিয়ত। আমানের মন পড়তে পেরে আদিত্যই বলল,

“কথা বলবি না আমার সাথে?”

একথা কর্ণকুহুরে পৌঁছাতে আমান দৃষ্টি তুলে তাকালো। ওর
চোখ অশ্রুতে টইটম্বুর। ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আঁটকানোর বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে। আদিত্য তখন মুখভর্তি হাাসি আমানের সঙ্গে কথা বললো, সুবিধা অসুবিধা নিয়েও কথা হলো। কথা শেষ করে যখন সবাই চলে যাবে তখন আমান মেধাকে বলে উঠলো,

“বনু এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। তোর আর আমার কথা হয়ে ছিলো, আম্মুকে জ্বালিয়ে মাছ ভাজা করে দিবি। তুই কী আজকাল জ্বালাচ্ছিস না ঠিক মতো? জ্বালালে তো আম্মুকে এত সুখী সুখী লাগল না। তোর দ্বারা এসব হবে না বুঝলি, তুই এককাজ কর বাসায় একটা জুনিয়রকে নিয়ে আয়। আর তাকে আম্মুর পেছনে লেঁলিয়ে দে। তারপর বাকিটা সে করে নিবে।”

আমানের কথা শুনে তখন মেধা গালভর্তি হেসে বললো,

” তুমি চিন্তা কোরো না ভাইয়া আজকে থেকেই কার্যক্রম শুরু করে দিবো। নয়মাস পর রেজাল্ট পেয়ে যাবে।”

ওর কথা শুনে আদিত্য ভ্রুজোড়া কুঁচকে তাকিয়ে রইল আর বাকিরা শব্দ করে হেসে উঠলো।তারপর আমানকে সাবধানে থাকতে বলে মেধারা চলে গেল। আর আমান কয়েকটা বছর এখানেই থাকতে চায়। নেশার আসক্তি পুরোপুরি কাটিয়ে না ওঠা অবধি। কষ্ট যখন করছে আর একটু করুক।বেলাশেষে
একদিন সফল হবেই হবে। এসব ভেবে আমান হেসে ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,

“কে বলে আমি অসুখী? ওই যে আমার সুখপাখিরা। যাদের হাসিতে আমার সুখ লুকিয়ে। আমি ফিরবো ,সুস্থ হয়ে, পূর্বের আমান হয়ে। কারণ আমার সুখ কুড়ানো এখনো অনেক বাকি।”

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here