মোহ মেঘের আলাপন পর্ব – ১৮

❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[১৮]

-“এখন তুমি অতি ভদ্র ছেলের মতো আমাদের বিয়ের সাক্ষী হিসেবে ঝটপট সাইনটা করে দাও। নয়তো এত আদর যত্ন করবো জীবনেও ভুলতে পারবে না।”

একথা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই আমান হতবাক হয়ে গেল। সে কি বললো? বিয়ের সাক্ষী? কাদের বিয়ে? ওর আর মেধার? মেধাকে সে চিনলো কিভাবে ? তাছাড়া হঠাৎ বিয়ে বা কেন?
কী উদ্দেশ্যে এই ছেলের? নাকি কোনো ভাবে ভয় দেখাচ্ছে?
এতে ওর কী লাভ? তখন এসব ভাবতে ভাবতেই ওর চোখে ভেসে উঠলো আদিত্যের মুখ। তাতেই ওর বুক কেঁপে উঠলো অজানা ভয়ে। এখন যদি সত্যি সত্যি এদের বিয়ে হয়েই যায় তখন কী হবে? ফিরে গিয়ে আদিত্যকে কী জবাব দিবে? সে
মেনে নিতে পারবে এই কষ্টটা? নাকি দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাবে? ভাইকে এভাবে নিঃশেষ হতে দেখতেও পারবে না সে।
তাছাড়া চেনা নেই, জানা নেই, এমন ছেলের হাতে মেধাকেও তুলে দিতে পারবে না। আপন বোন না হলেও নিজের ছোট বোনের মতোই ভালোবাসে সে। আর বোনের জীবন এভাবে
ধ্বংস হতে দিবে না, কিছুতেই না। প্রয়োজন মার খেয়ে মরে যাবে তবুও সে সাইন করবে না। মেধা একমাত্র আদিত্যেরই।
আর ওদিকে হয়তো আদিত্য ব্যাকুল হয়ে ওদেরকে খুঁজছে।
না পেয়ে কী অবস্থা সবার কে জানে! তাছাড়া সীমা বেগম?
যদি উদয়কে আঁটকাতে না তবে উনাকে কীভাবে সামলাবে? উনার আদরের মেয়েটা অন্যের ঘরে চলে যাবে। বাসাও শূন্য হয়ে যাবে। সীমা বেগম মানতে পারবে তো? মনে মনে এসব ভেবে আমান জোরে জোরে ওর মাথা ঝাঁকাল। না, সে আর এসব ভাবতে পারছে না। মুক্তির পথ খুঁজে বের করতেই হবে তাকে। নয়তো সব এলোমেলো হয়ে যাবে, সব। এদিকে তার ভাই আর অন্যদিকে মা। এদের দু’জনের মুখে হাসি ফোটাতে তাকে কিছু একটা করতে হবে। আমান যখন মনে মনে এসব ভাবতে ব্যস্ত তখন তার কানে এসে লাগল স্বজোরে আরেক
থাপ্পড়ের শব্দ। উদয় পুনরায় মেধাকে মেরেছে। আমান ওর রাগ সামাতে না পেরে ছটপট করে ব্যর্থ হলো। তারপর ক্ষিপ্ত নজরে তাকিয়ে রইলো উদয়ের দিকে। মেধাকে কাঁদতে দেখে উদয় মেধাকে পুনরায় থাপ্পড় মেরেছে। কানের কাছে এভাবে ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না তার পছন্দ নয়। প্রচন্ড বিরক্ত লাগে।
থাপ্পড় মেরেও সে বিরক্ত নিয়ে মেধার দিকে তাকিয়ে আছে।
ভাবখানা এমন যেনো তৃতীয় থাপ্পড় দিলে বলে। মেধা গালে হাত দিয়ে এবার নিঃশব্দে কাঁদছে। তখন উদয় বললো,

-”আর একফোঁটা অশ্রুও যদি গড়িয়েছে তোমার ভাইয়ের শরীর থেকে আমি তার দ্বিগুন ফোঁটা র’ক্ত ঝরাবো। কথায় নয় এবার কাজে দেখাবো।”

-”কি করেছি আমি? কেন এমন করছেন আমার সঙ্গে? ”

-”যাহ্ বাবা আমি আবার কি করলাম? এখনো কিছু করি নি বেইব, তাছাড়া কেবল তো শুরু।”

-”ছেড়ে দেন আমাদের, প্লিজ। আমি আপনার পায়ে পড়ছি আমাদের ছেড়ে দেন।”

-”আমার, হাত, পা, ঠোঁট, মুখ, যা ইচ্ছে ধরো তাও ছাড় পাবে না সোনাপাখি।”

-”আমি আদিত্যকে ভীষন ভালোবাসি। আমাকে ওর কাছে যেতে দিন। কথা দিচ্ছি আপনার কথা কাউকে বলবো না।”

-”ওর নাম মুখে এনো না জান। মেজাজ বিগড়ে গেলে খবর আছে তোমার। তুমি আমাকে ভালোবাসবা; শুধু আমাকে।”

যখন ওরা কথা বলায় ব্যস্ত তখন আমান উদয়কে ভালো করে লক্ষ্য করলো। বয়স আদিত্যের মতোই। সুদর্শনও বটে। আভিজাত্যপূর্ণ পোশাকে স্মার্টনেস বেশ ভালোভাবেই ফুটে উঠেছে। চোখে মুখে তীক্ষ্ণতার ছড়াছড়ি। ঠোঁটে লেপ্টে আছে তাচ্ছিল্যের হাসি। একথায় উদয় নজরকাড়া সুদর্শন। ছেলে হয়ে এটা মানতে সে অনুদারতা করবে না। তবে মেধার কথা শুনে মনে হচ্ছে সেও উদয়কে চেনে না। অথচ উদয় মেধাকে কিডন্যাপ করে বিয়ে প্রসঙ্গেও চলে এলো। এখন কথা হচ্ছে উদয় মেধাকে কীভাবে চেনে? নাকি ট্যাপে ফেলার জন্য তার নতুন চাল? তখন হঠাৎ উদয় কাউকে ডাকতেই দু’জন পুরুষ সেখানে উপস্থিত হলো। সম্ভবত উকিল উনারা। এসে একটা ফাইল এগিয়ে দিলো উদয়ের দিকে। উদয় সেটা দেখতে দেখতে আমানের মুখোমুখি দাঁড়ালো। তারপর ফাইলে দৃষ্টি নিবন্ধ করেই বললো,

-”আমার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিলে ভালো কিছু শুনবে না, সাইকো, পাষাণ, হৃদয়হীন, এসবই বলবে লোকে। যদিও এর একটাও মিথ্যে নয়। এই সমস্ত গুন আমার মধ্যে বিদ্যামান।
এখন কথা হচ্ছে, এসব জেনেই মেধাকে আমার হাতে তুলে দিবে তুমি। নাও সাইন করো এতে, সময় নেই আমার হাতে।”

একথা বলে আমানের হাত খুলতে ইশারা করে একজনকে।
সে লোক এসে হাত না খুলে বেধড়ক মারতে থাকতে তাকে। মার দেখে মেধা ওর নিকটে আসতে গেলে উদয় তাকে ধরে ফেলে। মেধা চিৎকার করে কেঁদে মারতে নিষেধ করলে সেই ব্যাক্তি শোনে না, বরং আরেকজন এসে যুক্ত হয়। মেধা নিজ চোখে দেখতে পারে না আমানের র’ ক্তা’ ক্ত দেহ। ওর পুরো শরীর কাঁপতে থাকে থরথর করে। ওর কাঁপুনি দেখে উদয় তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রেখে বললো,

-”আমি জানতাম তোমার ভাই হাত খুললেই আমার উপরে আক্রমণ চালাবে। তাই আগেভাগে থার্ড ডোজ কমপ্লিট করে নিচ্ছি। ঠিক করেছি না, তুমিই বলো? ইস, এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না তোমার। আর কেঁদে কেঁটে কি করেছো হুম?
এসব ঝামেলা মেটাতে আমি তো আছি নাকি?”

আমানের ততক্ষণে করুণ অবস্থা। সে মারের চোটে নিভুনিভু চোখে মেধার দিকে একবার তাকিয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। তখন উদয় মেধাকে নিয়ে চলে যায় পাশের রুমে। তারপর মেধাকে
আদিত্যকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে, আমানের লা/শ গুম করারও ভয় দেখায়। একটা সময় মেধা থম মেরে যায়। এটা বুঝে যায় উদয়ের হাত থেকে তার নিস্তার নেই। এই লোকটা কিছুতেই তাকে ছাড়বে না। সে আদিত্যকেও আর পাবে না।
চিরতরে হারিয়ে ফেলবে প্রিয় মানুষটাকে। উদয় তখন চলে যেতে উদ্যত হতে পা বাড়িয়ে বলে,

-”আর আধা ঘন্টা ওয়েট করো আদিত্যের লা/শ দেখে নাহয়
নিজেকে আমার জন্য প্রস্তুত কোরো। সব নষ্টের গোড়া ওই আদিত্য তাই না? ওকে ওর ব্যবস্থায় করছি আমি।”

-”ক কো কোথায় সাইন করতে হবে?”

একথা শুনে উদয় চট করে দাঁড়িয়ে যায়। মুখভর্তি হাসি নিয়ে ঘুরে তাকায় মেধার মুখপানে। তারপর সুন্দর করে দেখিয়ে দেয় কোথায় সাইন করতে হবে। মেধাও সাইন করে পাথরের ন্যায় বসে থাকে থম মেরে। উদয় নিজেও সাইন করে ঝটপট মেধার গালে একটা চুুমু খেয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায়। একটু পরে কাজি এসে শরীয়ত মোতাবেক বিয়েও পড়ায়। একবুক কষ্ট চেপে মেধাকে উদয় নামেই ‘কবুল’ উচ্চারণ করতে হয়। সেই সঙ্গে না চায়লেও উদয়কেই স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে হয়।
আর উদয় জ্ঞান হারানো অবস্থায় সাক্ষী হিসেবে নিয়ে নেয় আমানের আঙুলের টিপ ছাপ। তারপর মেধার নাকে রুমাল চেপে অজ্ঞান করে ফেলে চোখের পলকেই। মেধা কিছু বুঝে উঠার আগেই দ্রুত কোলে তুলে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে।
পরে আমানের জ্ঞান ফেরার পরে নিজেকে আবিষ্কার করে নির্জন এক জায়গায়। আদূরেই থাকে তার বাইক। মেধাকে আশেপাশে না দেখে সে সেই অবস্থায় ছুঁটে আসে ভাইয়ের কাছে। তারপর সবাইকে খুলে বলে তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এক একটা ঘটনা। সব শুনে আদিত্য টলটলে পায়ে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হয়। সবার ডাক উপেক্ষা করে দরজা আঁটকে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। তার চোখের কোণা বেয়ে গড়াতে থাকে হৃদয়ভাঙ্গার জল। বুকে শুরু হয় অসহ্য দ’হ’ ন। যে দহনে ঝলসাতে থাকে ওর বুকের বাঁ পাশ। ইস,
এত কষ্ট কেন হারানোর ব্যথায়?ধীরে ধীরে বুকটা কেন ছেঁয়ে যাচ্ছে এক বিশাল শূন্যতায়। কই তার মেধা? কই সে? আর কি আসবে না ওর কাছে? দেখাও কি আর পাবে না? সবার দৃষ্টি এড়িয়ে চঞ্চল পায়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলবে না, ‘দেখি দেখি সারাদিনের এনার্জিটুকু নিয়ে নি।’

দুষ্টুমি করে তাকে সরিয়ে দিলে রাগে নাক ফুলিয়ে পুনরায় জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে বলবে না,

-”এই যে মিস্টার শুনুন এই বুকটা শুধু আমার জন্যেই তৈরি।
এখান থেকে আমি প্রতিনিয়ত শান্তি লুফে নিবো।কেউ যেনো
কখনো এই স্থানটা পাওয়া তো দূরে স্পর্শ করতেও না পারে। এখানে শুধু আমি আছি আর আমিই থাকবো, বুঝলেন?”
___________________________________

মেধার যখন চোখ খুলে তাকায় তখন দুপুর। জানালার পর্দা মেলে দেওয়ায় আবহাওয়াটা বোঝা যাচ্ছে না। এসি চলছে।
এজন্য শীত লাগছে বোধহয়। সে আশেপাশে দৃষ্টি ঘুরাতেই নজর পড়ে উদয়ের ফটোফ্রেমের দিকে। তার মনে পড়ে যায় ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। হারানোর কষ্টে ভারি হয়ে থাকে বক্ষপাশ। চোখ ফেটে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। বুকেও শুরু হয় নিষ্ঠুর তোলপাড়। অতি প্রিয় মানুষটার মুখটা ভেসে ওঠে চোখের পাতায়। সেই সঙ্গে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে একটা অতি প্রিয় শব্দ ‘আ আ আদি ত্য।’
তখন সুসজ্জিত রুমের দরজা ঠেলে কেউ প্রবেশ করে। শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখে উদয়। ওর পরনে কালো টি শার্টের সঙ্গে কালো টাউজার। কানে ইয়ারফোন গুঁজে রাখা। হাতে আধ খাওয়া আপেল। মুখে মিটিমিটি হাসি। উদয় জানালার পর্দা
সরিয়ে মেধাকে বললো,

-”আমার রাজ্যে তোমাকে সু-স্বাগতম মাই লাভ।”

এই কথাটা বলতে বলতেই উদয় এগিয়ে মেধাকে একটানে দাঁড় করিয়ে জানালার পাশে চলে গেল। থাই গ্লাস ভেদ করে দৃষ্টি গেল বাইরের দিকে। মেঘলা আকাশ। তখন উদয় থাই
গ্লাস সরাতেই চোখ পড়লো অনেক বড় বড় বিল্ডিং। দেশের
আকাশে বাতাসে কেমন অচেনা টান অনুভব করলো মেধা।
অদ্ভুত ঠেকলো তার কাছে। মস্তিষ্কেও খেলে গেল কিছু প্রশ্ন।
তখন তার চঞ্চল দৃষ্টি দেখে উদয় ঝাপটে ধরলো বাহুডোরে।
অতঃপর হাতের বাঁধন শক্ত করে ফিসফিস করে বলল,

-”আমরা আছি তোমার আদিত্যের ধরা ছোঁয়ারও বাইরে। এই সেই সুদূর আমেরিকা।”

-”আদিত্যের ভয়ে এখানে এসেছেন বুঝি?”

-”হা হা হা, আদিত্যকে ভয়? তাও আবার আমি? জোক্সটা কিন্তু দারুণ।”

ওর হাসি মেধার সহ্য হলো না। আচমকা উদয়ের কলার ধরে
ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো,

-”কেন করলেন এমন? কি অপরাধ আমার? কোন অপরাধে
আমাকে এত বড় শাস্তি দিলেন? বলুন, বলুন, বলছি।”

-”বেশ করেছি।”

একথা শুনে মেধার রাগ তুঙ্গে। সে আর ভাবনা চিন্তা না করে থাপ্পড় দিতে হাত তুললেই উদয় তা ধরে ফেললো। মুখের ভাবভঙ্গি মুহূর্তেই পাল্টে গেছে তার। মুখে ফুটে উঠেছে চাপা ক্রোধ। হটাৎ সে মেধার হাত পেছনে মুচড়ে ধরে বাঁ গালে ওষ্ঠ ছুঁয়ে বললো,

-”জান, তুমি যত দুঃসাহস দেখাবে আমি আমার আদরের মাত্রা তত বাড়বো। বাকিটা তোমার ইচ্ছে। ”

-”আপনাকে আমি ঘৃণা করি, ছাড়ুন আমায়। আপনার স্পর্শে আমার শরীর গুলিয়ে যাচ্ছে, বমি পাচ্ছে আমার।”

-”মজার ব্যাপার কি জানো? নিষিদ্ধ কাজে আমি আকৃষ্ট হই বেশি। কেউ কিছু বারণ করলে আমি সেটাই না করা অবধি শান্তি পাই না। সরি বউ তোমার এই কথাও রাখতে পারলাম না।”

To be continue……!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here