#ময়ূখ
#পর্ব-১২
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৩৪.
‘রিপু ভাই?’
রিপ্ত ঘাড়টা ফিরিয়ে পিছনে তাকিয়ে মায়াবী হাসি দেয়। কি প্রাণবন্ত, স্নিগ্ধ সে হাসি!
‘পাশে বসরে মৌনি।’
মৌন রিপ্তর পাশে সবুজ ঘাসে বসে। রিপ্তর একহাতে শাপলাফুল আর অপর হাতে শালুক। রিপ্ত শালুকগুলো এগিয়ে দেয় মৌনর হাতে। মৌন ছুঁলে খেতে খেতে বলে,
‘কি যেন বলবে বলেছিলে রিপু ভাই?’
রিপ্ত পাশ থেকে কয়েকটা ইটের কণা কুড়িয়ে জংলার পুকুরে একে একে ছুঁড়ে মারে। পুকুরের সামনে বিশাল মাঠ, দুইপাশে ধানক্ষেত। মাঠে ধান শুকাতে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া দুইটা গরু বাঁধা। তারা একটানা হাম্বা হাম্বা করে যাচ্ছে।
‘ও রিপু ভাই বলোনা?’
‘গল্প শুনবিরে মৌনি?’
‘কিসের গল্প রিপু ভাই?’
‘এক মন ভাঙা শালিক পাখির গল্প।’
‘শোনাও। কতদিন তোমার গল্প শুনিনা। আগে তো কত রাজা রাণীর গল্প শোনাতে।’
রিপ্ত আবার মলিন হাসে। মেয়েটা কি সেই অবুঝই রয়ে গেল!
‘ছোট একটা গাছের ডালে একটা ছেলে শালিক পাখি থাকতো । বাবা-মা নিয়ে বেশ ছিল সে। তার পাশের গাছের ডালে আরেকটা ফুটফুটে মেয়ে শালিকের জন্ম। ছেলে শালিকটা সেই ছোটবেলা থেকে ভালোবাসে মেয়ে শালিকটাকে। একটা নামও দিয়েছে জানিস?’
‘কি নাম রিপু ভাই?’
‘ছটফটে পিচ্চি। তবে এই নামটা কেউ জানেনা। হঠাৎ এক ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সব। ছেলে পাখিটা হারিয়ে ফেলে তার বাবা-মাকে। তবুও হাল ছাড়েনা সে। মেয়ে শালিকের বাবার কাছে সময় চায়। একসময় অনেক বড় হয়ে তার ঘরের বউ করে তুলবে তার ছটফটে পিচ্চিকে। তবে কি হয় জানিসরে মৌনি?’
‘কি রিপু ভাই?’
‘মেয়ে পাখিটার বাবা তার কথা রাখেনি। আরেক পাখির কাছে বিয়ে দিয়ে দেয় তার ছটফটে পিচ্চিকে। সেদিন যেন আকাশ ভেঙে মাথায় পড়ে তার। বুকটা ঝাঁঝরা হয়ে যায়। তার পাখি উড়ে গেছে বহু দূর। ত্রী সীমানার বাইরে।’
‘অনেক কষ্ট হচ্ছে আমার।’
‘কার জন্য?’
‘শালিক পাখিটার জন্য।’
রিপ্ত আবার হাসে। তাকে কি আজ হাসার রোগে ধরলো নাকি!
‘তুমি দেখো রিপু ভাই সেই ছেলে শালিক পাখিটাও সুখি হবে। তার জীবনেও সুখ আসবে। আমি দোয়া করি।’
রিপ্ত মনে মনে ভাবে,
‘তুই সেই বোকাই রয়ে গেলিরে মৌনি। বোকাই রয়ে গেলি। সবারবেলা তুই এতো বুঝিস? আমার বেলা কেনো বুঝিস না।’
মৌন সবই জানে। সবই বুঝে। মাঝেমাঝে যে রিপ্ত তাকে ছটফটে পিচ্চি ডাকতো তাও তার জানা। তবে তার হাতে যে কিছু নেই, কিছু ছিলোনা। আর রিপ্তকে সে সবসময় ভাইয়ের নজরেই দেখেছে। বাবার বিপদে যে সে নিজেকে বলিদান করেছে!
নিরবতা চারপাশে। দুজনেই কিছু বলছেনা। জংলা পুকুরটা স্থির হয়ে আছে। পানিগুলো হালকা রোদের আলোয় চিকচিক করছে। সাদা শাপলাগুলো সবুজ পাতার উপর আপন মনে বসে ভগ্ন হৃদয়ের প্রেমিকটাকে দেখছে। তাদেরও কষ্ট হচ্ছে কি!
৩৫.
ঘুম থেকে উঠেই বারান্দায় আসে নিভৃত। হঠাৎ তার নজর যায় দূরে পুকুরপাড়ে বসে থাকা দুইজন মানব-মানবীর দিকে। একজনের পাশ ঘেঁষে অপরজন বসা। হলুদরঙা শাড়ির আঁচলটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এটা সেই মেয়েটা না! পাশে বসা ছেলেটার মুখ আবছা। কি যেন দিচ্ছে মেয়েটার হাতে। নিভৃত বুঝতে পারছেনা তবে তার হাত মুঠ হয়ে আসছে। প্রচুর রাগ লাগছে। রাগে নিজের মোবাইলটা পাশে ছুঁড়ে ফেললো সে। পায়চারি করলো কতক্ষণ ঘরে। এমন লাগছে কেন? টেবিলের উপর রাখা ল্যাম্পটা একটা আছাড় মারলো মেঝেতে।
অতঃপর খাটে গিয়ে বসলো। মৌন ঘরে ঢুকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। মেঝেতে ল্যাম্পসেড ভেঙে পড়ে আছে। মৌনর মাথায় ঘুমটা নেই। কানে গুঁজে রেখেছে শাপলা ফুল।
‘কি হয়েছে আপনার?’
হঠাৎ মেয়েটার কন্ঠ শুনে নিভৃত তার দিকে তাকালো। চোখ দুটো লালচে ভয়ানক লাগছে। কানে গুঁজে রাখা ফুলটা দেখে তরতর করে রাগ বেড়ে গেলো নিভৃতের। খাট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো মৌনকে। ঘটনার আকস্মিকতায় মৌন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে কেবল। হঠাৎই নিভৃতের অধর ছুঁয়ে দিলো মৌনর অধর। নিভৃতের এমন আক্রমণে চোখের কোণা বেয়ে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো মৌনর। নিভৃত ক্রমশই হিংস্র হয়ে উঠছে। অনেক কষ্টে নিজেকে ছাঁড়ালো মৌন। সিক্ত কন্ঠে বললো,
‘এমন করছেন কেন আপনি?’
হুঁশ ফিরলো নিভৃতের। নিজের আচরণে অবাক হচ্ছে নিভৃত। সে এমন করছে কেন! তবে মৌনের কানে গুঁজে রাখা ফুলটা দেখে আবার এগিয়ে গেলো মৌনর দিকে। মৌন ভয়ে গুটিয়ে আছে। নিভৃত মৌনর কাছে গিয়ে গাল চেপে ধরে বললো,
‘কেন আমায় বিয়ে করলি তুই? তোকে ফোন করে মানা করেছিলাম না আমি। কেন এসেছিস আমার জীবনে। লোভী, ছোটলোক। তুই, তোর বাবা সবকটা ছোটলোকের দল।’
মৌনের মুখ চেপে ধরায় সে কিছু বলতেই পারছেনা। নিভৃত মৌনর কানে গুঁজে রাখা ফুলটা ছুঁড়ে ফেলে বললো,
‘সঙ সেজেছিস! কি ভাবিস? সঙ সাজলেই আমাকে পাবি? আমার রুহানির জায়গা নিবি?’
মৌন কিছু বলতে না পেরে কেবল চোখের পানি ফেলছে। এমন করছে কেন নিভৃত। হঠাৎ নিভৃত গর্জন করে বলে,
‘ছেলেটা কে ছিল তোর সাথে?’
মৌন অবাক হয়। কোন ছেলের কথা বলছে নিভৃত?রিপু ভাইয়ের?
‘কি চুপ কেন? কে ছিল পুকুরপাড়ে তোর সাথে?’
‘রিপ্তভাই। আমার চাচার ছেলে।’
রিপ্তর কথা শুনে মৌনকে ছেঁড়ে দেয় নিভৃত। রিপ্তকে তো সে চিনে। অনেকভালো একটা ছেলে। তবুও কেন জানি রাগ লাগছে তার। মৌনকে টেনে ঘরের বাইরে বের করে ব্যাগটা তার দিকে ছুঁড়ে ফেলে বলে,
‘একদম এই ঘরে ঢুকবিনা।’
৩৬.
নিভৃত কথাটা বলেই বেরিয়ে যায়। ড্রয়িং রুমে গিয়ে মাকে বলে হনহনিয়ে গাড়িতে উঠে ঢাকার পথে রওনা দেয় সে। মিরা, নাজমুলও বুঝতে পারছেনা হয়েছেটা কি!
তারাও তৈরি হয়ে মৌনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। মৌন নিজেকে ঠিক করে কেবল স্তব্ধ হয়ে বসেছিল। তার জীবনটা এতো অদ্ভুত! এতো দুর্বিষহ কেন!
বাবা-মাকে ফোন করে একবার জানিয়েছে সে চলে যাচ্ছে। আসার পথে হঠাৎ দৌঁড়ে এসে গাড়ি থামায় রিপ্ত। মৌন দরজা খুলে বেরিয়ে এলে বলে,
‘চলে যাচ্ছিসরে মৌনি?’
‘হ্যাঁ, রিপু ভাই।’
রিপ্ত হাতের খাঁচাটা মৌনর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
‘নে আজ থেকে মিটি তোর।’
মৌন অবাক হয়ে বলে,
‘তোমার এতো শখের পায়রা আমায় দিয়ে দিলে রিপুভাই?’
‘আরে নে। খেয়াল রাখিস আমার মিটির।’
‘আচ্ছা, রিপুভাই।’
‘ভালো থাকিসরে মৌনি।’
বলেই পিছু ঘুরে রিপ্ত। সে তার চোখের জল মৌনকে দেখাতে চায়না। মৌন হালকা কন্ঠে বলে,
‘যে তোমার ভাগ্যে ছিলোনা তার জন্য কষ্ট পেয়োনা রিপু ভাই। তুমি অনেক ভালো। দেখো তোমার জীবনেও একদিন কেউ আসবে। যে তার ভালোবাসা দিয়ে তোমার সব ক্ষত মুছে দিবে।’
রিপ্ত অবাক হয়ে শুনে। পিছনে ফিরে কিছু বলবে তার আগেই কালো গাড়িটা অনেকদূর চলে গেছে। অনেক দূর।
_________________
মৌন বসে আছে গাড়ির পিছনের সিটে। সামনে বসে গাড়ি ড্রাইভ করছেন নাজমুল সাহেব আর পাশে বসে আছেন মিরা। দুজনেই ছেলের জন্য চিন্তিত। হঠাৎ কি হলো! মৌন একধ্যানে তাকিয়ে আছে বাইরে। পাশে বেতের খাচায় বন্দি মিটি বাকবাকুম বাকবাকুম করে ডাকছে। সাদা রংয়ের সুখী পায়রা মিটি। লেজের দিকে অনেকসুন্দর পাখাগুলো ছড়ানো। রিপ্ত কাউকে ধরতে দিতোনা মিটিকে। আর আজ তাকে দিয়ে দিলো। মৌন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে যেন রিপ্তর জীবনে এমন কেউ আসে যে তাকে হাসিতে খুশিতে ভরিয়ে রাখবে।
বাইরে শো শো বাতাস বইছে। মৌনর খুবই মন খারাপ লাগছে। আর কবে গ্রামে আসবে সেটাও তার জানা নেই। অন্যমনস্ক হয়ে হাত চলে যায় ঠোঁটে। দুয়েক জায়গায় কেটে গিয়েছে। ক্ষত ঢাকতে মৌন লিপস্টিক লাগিয়েছে। সাজের ভিতরে লুকিয়ে ফেলেছে নিজের কষ্ট, যন্ত্রণা।
কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থাকার পর মৌন হঠাৎই যেন একটা রহস্যের জট ছাড়ালো। নিভৃত কি রিপ্তর সাথে তাকে দেখে এমন আচরণ করেছে? তবে বাকি কথাগুলো! আর নিভৃত তো মৌনকে ভালোবাসেনা। তাহলে এমন আচরণের মানে কি!
মৌনর নিজেকে খুবই ছোট লাগে। নিভৃত কি সহজে বলে দিলো ছোটলোক। মৌনর বাবাকে কোন সাহসে ছোটলোক বললো সে। মৌনর বাবা তো কেবল টাকা চেয়েছিলো। নিভৃতের বাবা-মাই তো শর্ত দিয়ে তাকে বউ করে নিয়েছে। মৌন চুপচাপ বসে থাকে। বাড়িতে গেলে নিভৃত আবার কি করে তাই দেখার বিষয়।
#ময়ূখ
#পর্ব-১৩
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৩৭.
‘রুহানি, আমি আর পারছিনা। আমার নিজের উপর আমার নিয়ন্ত্রণ নেই। আমি কেন এতো অদ্ভুত আচরণ করছি রুহানি?’
‘এই একটু জবাব দেওনা।’
‘আমার যে তোমাকে ভিষণ প্রয়োজন রুহানি।’
সাদা টাইলসে আবৃত কবরটার সামনে দাঁড়িয়ে অব্যক্ত কথাগুলো বলে যাচ্ছে নিভৃত। তবে কোনো জবাব আসেনা। পাশের স্বর্ণচাঁপা গাছটায় বসে কিচিরমিচির আওয়াজ তুলছে একটা ছোট চড়ুই। সেই পাখির আওয়াজ ভেসে আসে। কাঙ্খিত মানুষটার গলার সুর কেন আসেনা? একটু! কেবল একটু আওয়াজ, একটু সুর। মৃত্যুগুলো এতো নিষ্ঠুর কেন? প্রিয়জনদের ছিনিয়ে নিয়ে কি মজা পায় তারা?
নিভৃত চলে আসে তার ঘরে। রুহানির উপর রাগ হয়। কেন চলে গেলো তাকে ফেলে? এই অদ্ভুত পৃথিবীতে সে যে বড়ই একা।
____________________
মৌন ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে প্রবেশ করেছে। নিভৃত মাথা চেপে ধরে বসেছিল ডিভানে। মৌনকে দেখে কোনো প্রতিক্রিয়া করেনি। মৌনও অভিমানে চুপ।
রাতের আকাশে হাজারো তারার হাতছানি। বারান্দায় বসে একধ্যানে মৌন তাকিয়ে আছে তারাগুলোর দিকে। কুচকুচে কালো আকাশে ঝলমলে তারার মেলা। শুক্লপক্ষের চাঁদের হালকা আলোয় চারপাশ আবছা দেখা যায়। কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা পেরিয়ে আজ আবার এসেছে শুক্লপক্ষ। আচ্ছা, মৌনর জীবনটা কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যার মতো কেন? প্রকৃতির আকাশে তো কৃষ্ণপক্ষের ঘুটঘুটে আঁধার পেরিয়ে ঝলমলে শুক্লপক্ষ আসে। তার জীবনে আসেনা কেন? একটু বাঁকা চাঁদের ঝলমলে কিরণে অন্ধকার ছাপিয়ে আলোর দিশা কেন দেখা যায় না?
এসব কথা ভেবেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার। এক অদ্ভুত খেলায় বন্দী সে। এই খেলার পরিণতিটা কি!
আজ সারাদিন কোনো কথা হয়নি নিভৃতের সাথে। নিভৃত তাকে এড়িয়ে গেছে। সেও অভিমানে নিজের নামের মতোই মৌন থেকেছে।
__________________
ধরণীর অন্ধকার ছাপিয়ে আবার এসেছে নতুন ভোর। একটা নতুন উদ্যমে আবার শুরু হবে মানুষের জীবনযাত্রা। ফজরের নামাজ পড়ে লাল গোলাপের বাগানে এসেছে মৌন। গোলাপের সুভাসে মনটা আকস্মিক ভালো হয়ে গেলো তার। মন ভরে ঘ্রাণ নিলো সে। লাল রঙের স্নিগ্ধ গোলাপের নরম পাপড়ি ক্ষানিক সময়ের জন্য ; জাগতিক মায়া কাটিয়ে তাকে নিয়ে গেলো অভূতপূর্ব এক জগতে। সেই জগত থেকে মৌন বের হলো মিরার ডাকে।
‘মৌন চা খাবি?’
‘তোমার হাতের চা মিস দেওয়া যায় মা।’
বাগানে করা সিমেন্টের পাটাতনে বসে চা খেলো শাশুড়ী, বউ মিলে। গল্পে গল্পে অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে। হঠাৎ মিরা বললেন,
‘জানিস মৌন আমার ছেলেটা কিন্তু অনেক সাধনার পরে হয়েছে।’
মৌন জিঘাংসু দৃষ্টিতে তাকলো। মিরা হেসে বললেন,
‘সবার জীবনেই উত্থান-পতন থাকে। আমারো ছিলো। আমি ছিলাম রহমান পরিবারে সবচেয়ে শিক্ষিত বউ। ইডেন কলেজে শিক্ষকতা করছি। ক্যারিয়ারে আমি সফল। তবে আমার সাংসারিক জীবনে সফল ছিলাম না। তোর শ্বশুর সব সময়ই খামখেয়ালি। ব্যবসা নিয়ে সে ব্যস্ত। শাশুড়ী মা আমাদের সাথে ঢাকায় থাকতেন। তিনি আমার চাকুরি পছন্দ করতেন না। বারেবারে চাপ দিতেন বাচ্চার জন্য। বিয়ের দ্বিতীয় বছরে প্রথম গর্ভধারণ করলাম। একটা মেয়ে হলো। কত খুশি চারপাশে। আমাদের ফাঁকি দিয়ে মেয়েটা চলে গেলো ছয়বছর বয়সে। খুব ভেঙে পড়েছিলাম। আমার দ্বিতীয় মা যেন আমায় ফাঁকি দিয়েছেরে মৌন।’
৩৮.
নিজের চোখের কোণে পানিটা নীল রঙা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে মিরা আবার বললেন,
‘দ্বিতীয়বার মা হলাম। সেই মেয়েও দুইমাসে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। চারপাশে ছড়িয়ে পড়লো আমি অলক্ষী, অপয়া। মানুষ মুখের উপর কোনো অনুষ্ঠানে যেতে মানা করে দিতো। চাকুরি ছেড়ে নিজেকে ঘরবন্দী করলাম। শাশুড়ী মায়ের কটুকথায় একবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম। ভাগ্যের জুড়ে বেঁচে যাই। আমার খামখেয়ালি স্বামীটা আমাকে কখনো ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবেনি। মায়ের কথা শুনেও দ্বিতীয়বার বিয়ে করেনি। মুখে কিছু না বললেও বুঝতাম আমার একজন আছে। যে আমাকে কখনো ছেড়ে যাবেনা। একটা কাঁধ আছে যেখানে আমি মাথা রাখতে পারবো। বিয়ের দশবছরে কোনো সন্তান নেই। ডাক্তার, কবিরাজ ধরেও কাজ হচ্ছেনা। তখন ছুটে গেলাম সৌদি আরব। আল্লাহর কাছে হাত দুইটা মেলে কেঁদে একটা সন্তান চাইলাম। আল্লাহ আমার ডাক শুনলো। সৌদি থেকে ওমরাহ করে ফেরার তিনমাসের মাথায় জানতে পারি আমি মা হবো। অবশেষে আমার জীবনে এলো আমার মানিক রতন। পূর্ণ হলো আমার জীবন। ছেলেটাকে কখনো কোনো কষ্ট পেতে দেইনি। যা চেয়েছে তাই দিয়েছি।’
মৌনর চোখে জল। মাথা নিচু করে শুনছে কেবল। এই পৃথিবীতে প্রত্যেকটা মানুষেরই একটা গল্প থাকে। কষ্টের গল্প।
‘মিতু আমার মেয়ে না।’
কথাটা শুনে অবাক চোখে মিরার দিকে তাকালো মৌন। মিরা মলিন হেসে বললেন,
‘একদিন প্রচুর ঝড় বৃষ্টির রাতে গাড়ি নিয়ে মিরপুর থেকে ফিরছি আমি আর নাজমুল। হঠাৎ দেখি একটা জীর্ণ শীর্ণ পাগলি রাস্তার পাশে পড়ে আছে। আর তার বুকে হামাগুড়ি খাচ্ছে একটা ফুটফুটে শিশু। ল্যাম্পপোস্টের হালকা আলোয় এ এক করুণ দৃশ্য। আমি গাড়ি থামাতে বললাম। নেমে দেখি গাছের ডাল পড়ে পাগলীটার মুখ থেতলে গেছে। বৃষ্টির পানি ধুঁয়ে নিচ্ছে তার রক্ত। বাচ্চাটা কাঁদছে। আদো আদো বুলিতে মা মা করছে। মায়ের বুকে মুখ গুঁজে মায়ের দুধ খেতে চাচ্ছে। আমার সহ্য হলো সে কষ্ট। নিভৃত তখন দেড়বছরের। নিজের বুকের দুধ দিয়ে পেট ভরালাম বাচ্চাটার। পাগলিটাকে হসপিটালে নিয়ে গেলাম। তবে পাগলি অনেক আগেই মারা গেছে। তার জটপাকানো চুলগুলো রক্তে লাল হয়েছিল। সে দৃশ্য আজো ভুলিনি আমি। দত্তক নিলাম বাচ্চাটাকে। সেই থেকে আমার দুইসন্তান। মিতু আর নিভৃত।’
মৌনের খুবই অবাক লাগছে। একটা বাড়ির দেয়ালের আড়ালে কত গল্প লুকিয়ে থাকে। সে বাড়ির মানুষগুলো সে কাহিনী না বললে তা গোপনই থেকে যায়।
‘তোকে কথাগুলো কেন বললাম জানিস মৌন?’
‘কেন মা?’
‘আমার মানিক রতন। আমার বাবুই রুহানিকে হারিয়ে পাগলপ্রায়। এভাবে ছেলেটার নিঃশেষ হয়ে যাওয়া আমি মা হয়ে কোনোমতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। বিশ্বাস কর মৌন তোকে সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি। কি যেন ছিল! কেন যেন আমার মনে হলো আমার ছেলেটাকে সুখে রাখতে এই পুতুলটাকে যে আমার বড্ড প্রয়োজন। তুই কি এখনো অভিমান চেপে রেখেছিস?’
‘না, মা।’
মিথ্যা বললো মৌন। যে ছেলেকে খেলনার পুতুল এনে দেওয়া হয়েছে। সে তো পুতুলটাকে দূরে ছুঁড়ে মেরেছে।
৩৯.
দুপুর পেরিয়ে বিকেল। মৌন ফুলকপির বড়া তৈরি করছে রান্নাঘরে। জুলেখা তাকে সাহায্য করছে। শরিফা ছাদে কাপড় আনতে গেছে।
কলিংবেল বাজতেই দরজা খুললেন মিরা।তিনি ড্রয়িংরুমে বসে বই পড়ছিলেন। রুনা, মহিন আর জিল্লুর সাহেব দাঁড়িয়ে। মিরার হঠাৎ মনে পড়লো রবিবারে বিকেলে তো তাদের আসার কথা ছিলো।
‘আসেন ভাবি।’
সোফায় বসে রুনা দুনিয়ার গল্প জুড়ে দিলেন।মিরা যারপরনাই বিরক্ত। মহিন শুধু চোখ দিয়ে কি যেন খুঁজছে আর জিল্লুর সাহেব নিরীহভাবে বসে আছেন। তার ভাবখানা এমন যেন বেচারাকে ধরে বেঁধে এখানে আনা হয়েছে। আহারে! শ্যামলা মুখটা এমন যেন দুধের উপর অপাংক্তেয় মাছিটা। মিরার খুবই মায়া হলো। তিনি নিজেই রুনার ক্ষণিকের বকবকে বিরক্ত। বেচারা তো রোজ শুনে।
‘ভাবি এই হলো কাহিনী। দিলরুবা অবশেষে ভেগে বিয়ে করলো কামরুলকে।’
আরে কে কামরুল, কে দিলরুবা। এদের কাহিনী শুনে মিরা কি করবেন! অদ্ভুদ! মিরা একটু বিরতি নেওয়ার তাগিদে হাঁক ছেড়ে বললেন,
‘জুলেখা চা, নাস্তা নিয়ে আয়।’
মহিন বুঝলো নতুন মেয়েটার নাম বুঝি জুলেখা। তবে নামটা বেমানান লাগলো তার। এতো সুন্দর মেয়ের নাম জুলেখা! ইতিমধ্যে নিভৃত ঘুম থেকে উঠে নিচে নামছে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় বেচারা ভরকে গেলো। মুখে হাই তুলতে যাচ্ছিল তবে সেটা মুখেই আটকে গেলো। রুনা নামক মহিলাটাকে সে সর্বদা এড়িয়ে চলে। কিন্তু এরা গোষ্ঠীশুদ্ধ তাদের বাড়ি এলো কেন?
এদিকে মহিন লাজুক হেসে রুনাকে কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
‘ওমা জুলেখাকে আমার চাই। ওই তোমার বউমা হবে কিন্তু!’
মিরা আরো অবাক হচ্ছেন! এঁরা ফিসফিসিয়ে বলে কি! কি শুরু হলো এসব!
(চলবে)…….
(চলবে)…..