ময়ূখ পর্ব -৩২ ও শেষ পর্ব

#ময়ূখ
#পর্ব-৩২
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৯৪.
মৌন পিৎজা খাচ্ছে আর আড়চোখে নিভৃতকে দেখছে। নিভৃত সারা ঢাকা ঘুরে ডাবল টাকা দিয়ে পিৎজা নিয়ে এসেছে। পিৎজা খেতে খেতে একসময় মৌন অনুধাবন করলো সে সুখী। অনেক সুখী।

_________________

এপেলো হাসপাতালের করিডোরের সামনে পায়চারি করছে নিভৃত। মৌনকে ওটিতে নেওয়া হয়েছে। ডাক্তার এমজাদ অপারেশন করছেন। কিছুক্ষণ আগে বলা হলো সি সেকশন করা লাগবে। নিভৃতের সাদা শার্ট ঘামে ভেজা। কপালের দুইপাশে ঘামের সূক্ষ্ম চিহ্ন। চুলগুলো এলোমেলো। উদভ্রান্তের মতো পায়চারি করছে সে। মিরা, নাজমুল চেয়ারে বসে আছেন। তারাও চিন্তায় মগ্ন।
মৌনর আটমাস চলছিলো। হঠাৎ করেই সকালে মৌন পেটে ধরে চিৎকার করছিলো। নিভৃত বাথরুমে ছিলো। চিৎকার শুনে বাইরে বের হতেই দেখে মৌন বিছানায় কাতরাচ্ছে।

হঠাৎ একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজে স্তম্ভিত ফিরে নিভৃতের। একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ! থমকে যায় নিভৃত। নার্স কোলে করে সাদা তোয়ালে পেঁচিয়ে একটা ছোট ফুটফুটে বাচ্চা নিয়ে আসেন। নিভৃত অবাক হয়ে দেখছে। বাবা হওয়ার অনুভূতি এতো মধুর! নিজেকে এতটা পূর্ণ লাগছে কেন? কেন মনে হচ্ছে এই পৃথিবীর সর্বসুখ এটা। নার্স হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
‘বাচ্চার বাবা কোথায়? মিষ্টি খাওয়াতে হবে। ছেলে হয়েছে।’

নাজমুল সাহেব এগিয়ে আসেন। নিভৃত তখনও হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে। কি করতে হবে, বলতে হবে সে বুঝতে পারছেনা। নাজমুল সাহেব নিভৃতের কাঁধে হাত রাখলেন। নিভৃত ছলছল চোখে তাকালো নাজমুল সাহেবের মুখপানে। নাজমুল সাহেব হাসিমুখে ইশারা করলেন ছেলেকে কোলে নিতে। নার্সের হাত থেকে কাঁপা কাঁপা হাতে নিভৃত কোলে নিলো তার ছেলেকে। এতো নরম, তুলতুলে! লাল-ফর্সা হয়েছে। অদ্ভুতভাবে বাবার কোলে চড়ে ছেলে ঠোঁট প্রসারিত করলো। কোথায় তার কান্না! নিভৃত উৎকন্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘আমার, আমার স্ত্রী কেমন আছে?’
‘উনি ভালো আছেন। একটুপর ওয়ার্ডে শিফট করা হবে।’

মিরাও নাতিকে কোলে নিলেন। নাকটা যেন পুরো নিভৃতের। মুচকি হাসলেন তিনি। এইতো সেদিন রহমান বাড়ির বউ হয়ে এসেছিলেন। কত ঝড়! কত কষ্ট! কত স্মৃতি। কোথায় গেলো সেই সময় । আজ তিনি দাদি হয়ে গেলেন। তার ছোট নিভৃত। আম্মু, আম্মু করে তার আঁচল ধরে ঘুরে বেড়াতো। আজ সে বাবা হয়েছে। তাকেও এই পুঁচকোটা বাবা ডাকবে।

____________________

৯৫.

ছেলেকে বুকে নিয়ে মৌন সকল ক্লান্তি, কষ্ট, দুঃখ ভুলে গেলো। এতোটা মায়াময় মা হওয়ার সুখ। নিভৃত মৌনর কপালে চুমু এঁকে দেয়। নরম, ভেজা গলায় ছেলের পানে চেয়ে বলে,
‘আমাকে পরিপূর্ণ করার জন্য ধন্যবাদ প্রেয়সী।’

মৌন মিরার সাথে রান্নাঘরে কাজ করছে। কিছুদিন আগে মাত্র তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষ হলো। মাঝে গ্যাপ পড়ায় ইয়ার লস গিয়েছিলো মৌনর। এখন অনেকটা সময় হাতে পেয়েছে মৌন৷ তাইতো শাশুড়ীর কাছ থেকে নতুন নতুন খাবার বানানো শিখছে সে। নিহান আর মিটিকে নিয়ে বাগানে ঘুরাঘুরি করছে নিভৃত। মৌন বুঝে পায়না মিটির সাথে এতো মিল হলো কি করে নিভৃতের! এই মিটি আর আর তার ছেলে দুইটা নিভৃত বলতে পাগল। বেচারির মাঝে মাঝে হিংসে হয়।

নিহানের এখন দুইবছর। এতো দুরন্ত ছেলে। মিরা যেন ছোট নিভৃতকে পেয়েছেন। নাজমুল সাহেবের অনেক ভালো হয়েছে। তিনি একজন দাবা খেলার সাথী পেয়েছেন। যদিও তার সাথী খেলার খ ও বুঝে কিনা সন্দেহ। নিহান তার বাবার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। নিহানের দেখাদেখি মিটিও তাকিয়ে আছে। সে নিহানকে অনুকরণ করতে পছন্দ করে। নিভৃত রুহানির কবরের সামনে দাঁড়িয়ে বলছে,
‘আমি সুখে আছি রুহানি। তোমার নিভৃত সুখে আছে। বুকের বাঁ পাশটায় জায়গা দিয়েছি তাকে। সে আমাকে পরিপূর্ণ করেছে রুহানি।’

হঠাৎ কে যেন ফিসফিসিয়ে বললো,
‘সুখি হও বাবুইপাখি।’

নিভৃত আশেপাশে তাকালো। না, কেউ নেই! কি অদ্ভুত! ছোটবেলার প্রেয়সীর গলা যেনো শুনতে পেলো নিভৃত! সেই কন্ঠ!

‘বাপবা, কাত সাতে কতা বতো?’

মিটিও নিহানের দেখাদেখি বললো,
‘বাকবাকুম, বাকবাকুম।’

অর্থাৎ তারও একই প্রশ্ন। নিভৃত নিহানকে কোলে তুলে নিয়ে টুপ করে একটা চুমু খেলো গালে। মিটিও কাঁধে বসে পা দিয়ে চাপ দিচ্ছে। অর্থাৎ তারও একটা চাই। নিভৃত তাকেও একটা চুমু দিলো। একেবারে চেপে ধরে টুপ করে। হেসে নিভৃত বললো,
‘কি রে মিটি তুই তো তোর বুবুর মতোই হিংসুটে।’

মিটি কি বুঝলো কে জানে। চুপচাপ নিভৃতের কাঁধে বসে রইলো।

সকালে ব্রেকফাস্ট করতে বসেছে সবাই। নাজমুল সাহেব, মিরা, নিহান, মৌন আর নিভৃত। মিরা টেবিলে সকলের মুখপানে তাকিয়ে আছেন। আজ শাশুড়ীর অনুপস্থিতিটা কষ্ট দিচ্ছে তাকে। দিলারা নামক মানুষটার অনুপস্থিতি বড্ড দুঃখ দিচ্ছে হৃদয়ে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন মিরা। মৌন নিহানকে খাবার খাইয়ে দিচ্ছিলো।
‘বাপ, একটু খা।’
নিহান খাচ্ছেই না। মিটির সাথে দুষ্টুমি করছে। হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলছে,
‘মাম্মা, নিহান খাবেনা। খাবেনা।’

মিরা মৌনর অসহায় মুখটা দেখে কোলে তুলে নেন নিহানকে। গল্প বলে বলে খাবার খাইয়ে দেন। মিরার অবাক লাগে এই পুতুলটা নাকি তার ছোট নিভৃত পুতুলের।

পায়ে বারেবারে খোঁচা দিচ্ছে নিভৃত। শ্বশুর, শাশুড়ির সামনে মৌন কিছু বলতেও পারছেনা। চোখ রাঙালো মৌন। নিভৃত নিচে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। এতো সুন্দর করে খাবার খাচ্ছে। যেন সে অনেক নিষ্পাপ!
‘আম্মু!’

চিৎকার করে দাঁড়িয়ে গেলো নিভৃত। মৌন তার পায়ে নখ বিঁধিয়ে দিয়ে মজা করে রুটি খাচ্ছে।

‘কি হলো বাবুই?’

নিহিনও মিরার দেখাদেখি বললো,
‘কি হতো বাবুই?’

সেই দেখাদেখি মিটিও কোথ থেকে উড়ে এসে বললো,
‘বাকবাকুম, বাকবাকুম।’

নিভৃত সবার পানে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। মৌন হাসছে। বেশ হয়েছে।

‘আরে কি হলো বাবুই?’
‘আতে কি হতো বাবুই?’
‘বাকবাকুম, বাকবাকুম?’

নিভৃত অসহায় কন্ঠে বললো,
‘কিছুনা।’

৯৬.

মৌন একটু আগে মাত্র কথা বললো রথির সাথে। রথি তিনমাসের প্রেগন্যান্ট। রিপ্ত বেশ খেয়াল রাখে তার। মৌন বোনের জন্য এবং তার রিপু ভাইয়ের জন্য অনেক খুশি।

বাইরে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। আলোর ছড়াছড়ি চারপাশে। স্নিগ্ধ আলোর আবেশে গা ভাসাতে ইচ্ছে হয় যেন। নিহানকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে নিভৃত। বাবার কোলে না চড়ে ঘুমায় না নিহান। নিভৃত ছেলেকে কাঁধে নিয়ে পায়চারি করছে, গল্প শোনাচ্ছে। মৌন একটানা নিহানের বাবা নামক মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলো। বাবা হিসেবে নিভৃত অনেক ভালো। মৌন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। তার নীল রঙা উড়নাটা বাতাসে উড়ছে। দৃষ্টি দূরে। হঠাৎ পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো প্রিয়মানুষটা। তার রাজপুত্র। মৌন আবেশে চোখ বুজে জিজ্ঞেস করলো,
‘নিহান ঘুমিয়েছে?’

নিভৃত মৌনর খোলা চুলে মুখ ডুবিয়ে বললো,
‘হুম।’

হঠাৎ করেই মৌনকে কোলে তুলে নিলো নিভৃত। মৌন ফিসফিসিয়ে বললো,
‘আরে কি করছেন?’

নিভৃত কোনো জবাব না দিয়ে বাইরে নিয়ে এলো তাকে। বাড়ির সামনে চলে এলো নিভৃত। গোলাপ বাগানের বিপরীত পাশে বাড়ির বামদিকে ছোট একটা মাঠের মতো জায়গা। সবুজ ঘাসে আবৃত। মৌনকে নিয়ে সেই ঘাসের উপর শুয়ে পড়লো নিভৃত। মৌনকে নিজের পাশে শুয়ালো সে।
‘কি পাগলামি করছেন?’
‘হুস। অনুভব করো।’

মাথার উপর সুবিশাল আকাশ। হাজারো তারার মেলা। চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে সবুজ ঘাসগুলো। মৌন নিভৃতের বুকের বাঁ পাশটায় মাথা রেখে অনুভব করলো এই অনুভূতি অদ্ভুত। এর কোনো নাম নেই, ভাষা নেই। কেবল মনে হয় এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটা মৌন। নিভৃত মৌনর কপালে ঠোঁট ছুঁয়ালো। কানে কানে বললো,

‘আমার ঘুটঘুটে তিমিরের ন্যায় হৃদয়ে
একফোঁটা ময়ূখ হয়ে আসলে তুমি।
পাথরের ন্যায় মনটাকে গলিয়ে করলে
ভালোবাসার মরুভূমি।
ভালোবাসি প্রিয়।
খুব ভালোবাসি।’

‘আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি রাজপুত্র।’
বলেই নিভৃতের বুকের বাঁ পাশটায় ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো মৌন।

(সমাপ্ত)……….

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here