ময়ূখ পর্ব -৩০+৩১

#ময়ূখ
#পর্ব-৩০
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৮৮.
মৌনকে কোলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো নিভৃত। পাগলের মতো চিৎকার করছে সে।।মৌনর রক্তে লেপ্টে যাচ্ছে তার শরীর। দুইজন নার্স আর একজন ডাক্তার এগিয়ে এলেন। ওটিতে নেওয়া হলো মৌনকে। নিভৃত বাইরে পায়চারী করছে। মিরা আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদছেন। হচ্ছে কি এসব! প্রথমে নাজমুল সাহেব প্যানিক এটাক করলেন এখন আবার মৌন। মিরা এগিয়ে গেলেন নিভৃতের দিকে। নিভৃত উদভ্রান্তের মতো আচরণ করছে। মিরা জড়িয়ে ধরলেন নিভৃতকে। নিভৃত কাঁদছে। চিৎকার করে কাঁদছে। ভেজা গলায় নিভৃত বললো,
‘আম্মু, আমার মৌন। আমার বাচ্চা। ওদের কিছু হলে আমি যে মরে যাবো আম্মু।’
‘হুস্। এসব বলেনা বাবুই। আল্লাহর কাছে চেয়ে দেখ। আল্লাহ নিরাশ করবেন না।’

ডাক্তার বেরিয়ে এসেছেন। নিভৃতকে ইশারা করলেন তার কেবিনে যেতে। নিভৃত দৌড়ে গেলো। ডাক্তার এমজাদ চেয়ারে বসলেন। নিভৃতকে বসতে ইশারা করলেন তিনি। নিভৃত চেয়ারে বসলো।
‘আমার স্ত্রী কেমন আছে ডক্টর? আমার সন্তান?’

উৎকন্ঠিত স্বর নিভৃতের। যেনো শ্বাস নিতে পারছেনা সে।
‘দুজনেই ভালো আছে।’

নিভৃতের চোখেমুখে ক্ষীণ হাসির রেখা দেখা গেলো। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলো সে।

‘আপনার স্ত্রী অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করেন এবং অতিরিক্ত চাপ ও পেটে আঘাতের ফলে রক্তপাত হয়েছে। তবে সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে আরো বড় কিছু ঘটতে পারতো।’

নিভৃতের কর্ণকুহরে কিছুই যাচ্ছেনা। সে ছটফট করছে কখন মৌনর কাছে যাবে। ডাক্তার এমজাদ আগে থেকেই নিভৃতকে চিনেন। তিনি গলার স্বরটা একটু গম্ভীর করে বললেন,
‘মি.নিভৃত।’
‘জ্বি।’
‘অনেক সময় আঘাত বা পানি বেশি থাকার কারণে প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল সময়ের আগেই জরায়ু থেকে সরে আসে। এটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়, যাকে বলে ‘প্লাসেন্টাল অ্যাবরাপশন’। যা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ একটি বিষয় বটে। এই সময় এসব রোগীকে আমরা হাই রিস্ক প্রেগন্যান্সির রোগী হিসেবে শনাক্ত করে চিকিৎসা করি।’
‘হাই রিস্ক মানে! আমার স্ত্রীর কিছু হবেনা তো ডক্টর!’
‘দেখুন সেটা তো আর আমি বলতে পারবোনা।’

নিভৃত দাঁড়িয়ে যায়। দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে,
‘বলতে পারেবেন না মানে কি! তাহলে আপনি ডক্টর হয়েছেন কেন?’

৮৯.
ডাক্তার এমজাদ মোটেও রাগ করলেন না। তার ক্যারিয়ারে এমন অনেক পাগলাটে স্বামী, পরিবারের সদস্য তিনি দেখছেন। একদিন তো একজন তার কলার পর্যন্ত ধরেছিলো। এমজাদ মৃদুস্বরে বললেন,
‘মাথা ঠান্ডা করে বসুন মি.নিভৃত।’
‘আমার স্ত্রী, বাচ্চা বিপদের মুখে আর আপনি আমাকে মাথা ঠান্ডা করতে বলছেন ডক্টর!’
‘দেখুন মি.নিভৃত আপনি আমার কথাটা ঠিক বুঝতে পারেননি বোধহয়। জন্ম, মৃত্যু সবই তো আল্লাহর হাতে। আমরা কেবল চেষ্টা করতে পারি।’

হঠাৎ নিভৃত ধপাস করে বসে পড়ে চেয়ারে। দুইহাত দিয়ে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে দেয় সে। এতদিন পর পেয়েও কি সে আবার হারিয়ে ফেলবে! ডাক্তার এমজাদের বড়ই মায়া হচ্ছে। তিনি নরম স্বরে বললেন,
‘এভাবে ভেঙে পড়বেন না নিভৃত। আপনাকে শক্ত থাকতে হবে।’

নিভৃত নিজের চেক শার্টে চোখ মুছলো। ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘কোনো উপায় কি আছে ডক্টর?’
‘আপনার বাচ্চার সবে সাড়ে পাঁচমাস। ছয়মাস হলেও সিজার করা যেতো। এখন রক্তপাত অনেকটাই বন্ধ হয়েছে। আপনাদের ভাগ্য ভালো যে ‘প্লাসেন্টাল অ্যাবরাপশন’ খুবই অল্প পরিমাণে হয়েছে। তাই বাচ্চাকে মাতৃগর্ভে আরো কিছুদিন রাখা যাবে।’
‘আমার এখন কি করতে হবে ডক্টর?’
‘আপনার স্ত্রীকে পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে। ভারী কাজ করা যাবে না একদমই। দুশ্চিন্তামুক্ত ও সদা হাসিখুশি থাকতে হবে। আই রিপিট কোনো ক্রমেই রোগীকে মানসিক চাপ দেওয়া যাবেনা। তলপেটে আঘাত, চাপ লাগা বা এমন কোনো কাজ করা যাবে না। দূরবর্তী স্থানে বা ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণ করা যাবে না। সহবাস থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। নিয়মিত চেকআপ করাতে হবে। কি মেনে চলতে পারবেন তো মি.নিভৃত?’
‘ইয়েস, ডক্টর।’
‘গুড। আসলে সৃষ্টিকর্তা আপনার সহায় তাই আপনার স্ত্রীর থাইরয়েড, ডায়াবেটিস, ইনফেকশনজনিত কোনো সমস্যা নেই। থাকলে সমস্যা হতো।’
‘আমি ওকে কবে বাসায় নিয়ে যেতে পারবো?’
‘কালকেই নিয়ে যেতে পারবেন। তবে কথাগুলো মাথায় রাখবেন। আর খাবারের ব্যাপারে একটু সতর্কিত হতে হবে। উনি একদমই খাওয়া দাওয়া করেন না। শরীরে পানি জমার দরুন শরীর ফোলা দেখা যায়। তবে উনার শরীরে পুষ্টির অভাব রয়েছে। সেই সাথে প্রেসক্রাইভ করা মেডিসিনগুলো নিয়মিত খাওয়াবেন। আমি বারবার বলছি নিভৃত কোনো ক্রমেই উনাকে মানসিক চাপ দেওয়া যাবেনা।’
‘আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো ডক্টর।’
‘আপনার স্ত্রীকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। সকালে জ্ঞান ফিরবে। কেবিনে শিফট করে দিবে কিছুক্ষণ পর।’
‘আচ্ছা,ডক্টর। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’
‘এটা আমার কর্তব্য মি.নিভৃত।’
‘ডক্টর এমজাদ। আই এম সরি। আসলে…..
‘ইট’স ওকে মি.নিভৃত। আমি কিছু মনে করিনি। এসবের আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে।’
মুচকি হাসলেন ডাক্তার এমজাদ। নিভৃত লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলো। সে আসলেই লজ্জিত।
______________________

মিরা চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে ছিলেন বাইরে। নিভৃতকে বের হতে দেখে নিভৃতের কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি।
বিচলিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ডাক্তার কি বললো বাবুই?’
‘দুজনে ঠিক আছে আম্মু।’
‘আলহামদুলিল্লাহ।’

নিভৃত হঠাৎ করেই মাকে জড়িয়ে ধরলো। মিরা ছেলের মাথায় হাত বুলালেন। নিভৃত কাঁদছে। কাঁদুক। কিছু কিছু সময় মানুষকে কাঁদতে দিতে হয়। তাতে তার মন হালকা হয়।

৯০.
সকালের স্নিগ্ধ হাওয়া বইছে বারান্দায়। ফিনাইল আর স্যাবলনের ভ্যাপসা একটা গন্ধ। রোগীদের আত্মীয় স্বজনরা বাইরে চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছেন। হয়তো তারা এখানেই রাত কাটিয়েছেন। এপেলো হাসপাতালে বিশাল বড় হলরুম। সেখানে সারি সারি নীল, হলুদ চেয়ার রাখা। অনেক গুছানো পরিবেশ। সরকারি হাসপাতাল থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যদিও সবই টাকার খেলা। মৌন বেডে শুয়ে আছে। ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষণ আগেই। প্রথমেই হাতটা চলে গিয়েছিলো পেটে। তবে পেটটা উঁচুই আছে। হাফ ছেড়ে বাঁচলো মৌন। বাচ্চাটাই যে তার একমাত্র অবলম্বন। মৌন পাশে তাকিয়ে দেখে নিভৃত মেঝেতে বসে তার বেডে মাথা দিয়ে ঘুমোচ্ছে। মৌন তাকিয়ে রইলো একটানা। এই নিষ্পাপ মুখটাকে হয়তো সে অনেক অনেক ভালোবাসে। সারাজীবন বেসে যাবে। হঠাৎ করেই চোখ খুলে ফেললো নিভৃত। মৌনর দিকে তাকিয়ে দু ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি প্রাণপাখি লুকিয়ে লুকিয়ে রাজপুত্রকে দেখা হচ্ছে বুঝি?’

মৌন ভেংচি কেটে অপর দিকে মুখ ঘুরালো। নিভৃতের সাথে কথা বলতে সে আগ্রহী নয়। মিরা হাসিমুখে কেবিনে ঢুকলেন। মৌনর মাথার কাছটায় বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘কি মা। এতো রাগ আপনার। গর্দভটার সাথে রাগ করে বাবা-মাকে ফেলে চলে গেলেন?’
‘আসলে মা…..
‘হুম, বুঝেছি আমি আর বলতে হবেনা। আর কোনোদিন এভাবে আমাদের রেখে যাবিনা মা।’
‘মা, বাবা কেমন আছেন?’
‘অনেকটা ভালো।’

নিভৃত বাইরে গিয়ে স্যুপ নিয়ে এসেছে। রাতের শার্টটা পরিবর্তন করে একটা টি-শার্ট পরেছে সে। নার্স স্যালাইন খুলে বলেছিলেন সকালে ঘুম ভাঙলে কিছু খাইয়ে ঔষধ খাওয়াতে। মিরা মৌনকে ধরে বাথরুমে নিয়ে গিয়েছেন। মৌন ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আবার বেডে শুয়ে পড়েছে। তলপেটে চিনচিন একটা ব্যথা হয়। যা দরুন হাঁটা খুবই কষ্ট। হাত নাড়াচাড়াও করা যায়না৷
নিভৃতকে ঢুকতে দেখে মিরা বেরিয়ে গেলেন। নিভৃত মুচকি হেসে বেডের পাশে চেয়ারটায় বসলো। হাতে গরম স্যুপের বাটি। মৌন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আছে। যদিও তার প্রচুর পরিমাণে ক্ষুধা লেগেছে।
‘জান, একটু খেয়ে নাও।’

মৌন অন্যদিকে ফিরেই বললো,
‘একদম এসব উদ্ভট নামে আমাকে ডাকবেন না।’
‘তাহলে কি ডাকি। আচ্ছা, আমার ময়না পাখি, আমার বাবুর আম্মু স্যুপটা খেয়ে নাও।’

মৌন কপাল কুঁচকে নিভৃতের দিকে তাকালো। নিভৃত হাসছে। মৌনর কপাল আরো কুঁচকে গেলো। বুড়া, ধামড়া ছেলের আবার ঢং! হুহ্!
#ময়ূখ
#পর্ব-৩১
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৯১.
মৌন আর কিছু বলেনি। খেয়ে নিয়েছে নিভৃতের হাতেই। সেই কখন থেকে নিভৃত একা একাই বকবক করে চলেছে। আর মৌন অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। মৌনর মতে নিভৃত অতিশয় বাঁচাল হয়ে গিয়েছে!

সুমি মৌনর সাথে দেখা করে বাড়ি ফিরে গিয়েছে। সুমি নামক মেয়েটার কাছে মৌন অনেক কৃতজ্ঞ।
_____________________

মৌন ‘একগুচ্ছ সুখ’ নামক বাড়িতে আবার এলো। ভাগ্যের জুড়ে একদিন বউ হয়ে এসেছিলো। তবে আজ স্বামীর হৃদয়ের প্রেয়সী হয়ে এসেছে। নাজমুল অসুস্থ, মিরাও চিন্তায় বিভিন্ন রোগের বাসা বাঁধিয়েছেন শরীরে। মৌন মিরার অসহায় চেহারা দেখে আর মানা করতে পারেনি। যদিও নিভৃতের সাথে কথা বলবেনা বলেই ঠিক করেছে সে।

একসপ্তাহ কেটে গেলো দেখতে দেখতে। মিটিকে নিয়ে মৌন বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে। গোলাপের বাগান থেকে সুন্দর একটা সুঘ্রাণ ভেসে আসছে। মন প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে যেনো।

‘আপা?’

হঠাৎ করেই রথির ডাকে পিছনে ফিরে মৌন। রথি, মর্জিনা দাঁড়িয়ে আছেন। রথি কেঁদে জড়িয়ে ধরলো মৌনকে। মৌন স্থির হয়ে বসে রইলো কেবল। রথি মৌনকে ছেড়ে মৌনর পায়ে ধরলো। ভেজা গলায় বললো,
‘আমাকে ক্ষমা করে দাও আপা। আমার অনেক বড় ভুল হইছে। আপাগো আমি দোষী। তুমি আমারে মারো, কাটো তবুও রাগ কইরা থাইকোনা।’

মৌন রথিকে টেনে তুলে। পাশে দাঁড় করিয়ে বলে,
‘আমি এতটা স্বার্থপর নই রথি। আগেই বলেছি এখনো বলছি তোদের আমি ভালোবাসি। তাই হয়তো কখনো রাগ করে থাকতে পারবোনা। তবে কি জানিস রথি? বুকটায় না একটা ক্ষত হয়েছে। যা হয়তো কোনোদিন মুছতে পারবোনা।’
‘আপা! আল্লাহর দোহায় লাগে আপা এমন বইলোনা।’
‘এমন নারে রথি। বিপদের সময় প্রিয়জনের খারাপ ব্যবহার বুকে ভিষণ লাগে। তুই কাঁদিস না। আমি তো তোর উপর রাগ করে নেই বোকা মেয়ে।’

মর্জিনা এগিয়ে এলেন মৌনর দিকে। নরম গলায় ডাকলেন,
‘আম্মা। আমারে মাফ কইরা দিও।’
‘ছিঃ, মা। এসব বইলোনা। আমি কারো উপরেই রেগে নেই।’

মৌন বেশি হাঁটতে পারেনা। নিচতলায় একটা ঘরেই নিভৃত কিছুদিন থাকবে বলে মনস্থির করেছে। মৌন আস্তে আস্তে সোফার ঘরে এসে দাঁড়ালো। সোফায় রিপ্ত বসে। মৌনকে দেখে থমকে গেলো সে। পর স্ত্রীর দিকে তাকানো হারাম জেনেও বেহায়া চোখ বারবার আটকে যায় তার মাঝে। মিরা মৌনকে ধরে সোফায় বসালেন। মর্জিনাও এসে বসেছেন পাশে। রথি দাঁড়িয়ে আছে। রিপ্ত মাথা নিচু করে বসে আছে। মৌন ডাকলো,
‘রিপু ভাই?’

রিপ্ত মাথা তুলে তাকালো। মৌন হেসে বললো,
‘কেমন আছো রিপু ভাই?’

রিপ্ত জবাব না দিয়ে আবার মাথা নিচু করলো। আসলেই তো সে কেমন আছে? মিরা রান্নাঘরের দিকে গেলেন। মৌন আস্তে করে বললো,
‘রাগলে তোমার মাথা ঠিক থাকেনা আমি জানি রিপু ভাই। এবারের মতো ওকে মাফ করে দাও। ছোট মানুষ বুঝেনি। তোমাকে ভিষণ ভালোবাসে রিপু ভাই।’
‘এতটা ছোটও না।’
‘আমি ভালো আছি তো। আমার কিছু হয়নি। তুমি ওকে ক্ষমা করে দাও রিপু ভাই। নয়তো পুঁচকো রাগ করবে কিন্তু!’

বলেই খিলখিল করে হেসে উঠে মৌন। রিপ্ত তাকিয়ে থাকে। কি অপূর্ব সে হাসি। রথিকে হয়তো সে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবেনা। সংসার করে যাবে সারাজীবন। একসময় হয়তো হৃদয়ের কোণে রথিও জায়গা করে নিবে।

৯২.

মৌনর সাতমাস চলছে। শরীরটা বড়ই দুর্বল তার। নিভৃত অযথাই পাগলামি করে। অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। সারাটা সময় মৌনর সাথে আঠার মতো লেগে থাকে। মৌন এতো কথা শোনায় তবুও কিছু মনে করেনা নিভৃত। হাসি মুখে সব সয়ে যায়। এই তো সেদিন,

‘বাবুর আম্মু। ও বাবুর আম্মু।’
‘একদম এসব আহ্লাদ করবেন না নিভৃত। আমার এসব পছন্দ না।’
‘আচ্ছা, তুমি আমাকে এটা বলো একটা বাচ্চার পরিবারে সবচেয়ে আপন কে থাকে?’
‘তার বাবা-মা।’
‘তুমি মানো এটা?’
‘কেন, মানবোনা কেন?’
‘তাহলে এটাও মানো বাবুর উপর বাবা-মা দুজনেরই অধিকার আছে?’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই আছে।’
‘তাহলে আমার বাবুর উপরও আমার আছে?’
‘হ্যাঁ, এই না, না।’
‘উঁহু, এখন তো না করলে হবেনা জান। একবার বলে ফেলেছো। দেখি হাতটা সরাও আমার বেবি আমার সাথে কথা বলবে।’

বলেই মৌনর পেটে কান পাতলো নিভৃত। মৌন শুধু অবাক হচ্ছে। এই লোক তো মহা চালাক!

‘এই সরেন তো আপনি। খালি ছুঁয়ার ধান্দা। সরেন।’

নিভৃত সরেনা। ভালোবাসার পরশে ভরিয়ে দেয় মৌনকে।

_________________

সন্ধ্যায় একটু শুয়েছিলো মৌন। হঠাৎ পায়ে চিনচিন ব্যথায় ঘুম ভেঙে যায় তার। পায়ে পানি নামার দরুন পা ভারী হয়ে গিয়েছে তার। মনে হচ্ছে দুপায়ে কেউ লোহার বস্তু রেখেছে। এপাশ ওপাশ করছে মৌন। পেটটা অনেক উঁচু হয়েছে আগের তুলনায়। পুঁচকোটা তো মনে হয় ফুটবল খেলে ভিতরে। এতো দুরন্ত! অবশ্য যার বাবা এতো দুষ্টু তার সন্তান তো এমন হবেই! মিরার মুখে নিভৃতের ছেলেবেলার সব শুনেছে মৌন। এতো কষ্টের মাঝেও হাসি পায় মৌনের। নিভৃত পাশে শুয়ে আছে। মৌন তাকিয়ে থাকে সেদিকে। তবে পায়ের ব্যথা আরো বাড়ায় চিৎকার করে উঠে সে। নিভৃত হকচকিয়ে উঠে বসে।
‘কি হয়েছে? কোথায় ব্যথা হচ্ছে? পেটে ব্যথা হচ্ছে? বাবু লাথি দিয়েছে? এই বলো। আরে বলোনা মেয়ে।’

মৌন বিছানায় হেলান দিয়ে উঠে বসে কটমট করে তাকায় নিভৃতের পানে। দাঁত কিড়িমিড়িয়ে বলে,
‘আমাকে বলতে দিবেন?’
‘সরি, সরি জান। কোথায় ব্যথা হচ্ছে?’
‘পায়ে।’

নিভৃত পায়ের দিকে হাত বাড়ায়। মৌন পা গুটিয়ে নিতে চাইলেও পারেনা।
‘এই কি করছেন আপনি?’
‘হুস্, কথা বলেনা।’

নিভৃত আস্তে আস্তে মৌনর পা টিপে দিচ্ছে। মৌন অবাক হয়ে দেখছে কেবল। এই নিভৃত বড়ই অচেনা। একসময় ঘুমিয়ে পড়ে মৌন।

৯৩.

দিন এভাবেই কাটছে। আর কিছুদিন পরেই মৌনের ডেলিভারি ডেট। মৌন হাই রিস্ক পেসেন্ট। তাই তার প্রতি ডাক্তার একটু বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। সেই সাথে নিভৃতের পাগলামিতে মৌন অনেকটা সুস্থ।

রাত প্রায় ২ টা বেজে ২৫ মিনিট। মৌন উঠে বসে আছে। তার প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে। নিভৃত কিছুক্ষণ আগেই মাত্র ঘুমিয়েছিলো। তবে নিভৃতকে এতোটা শান্তিতে ঘুমাতে দেখে গা জ্বলছে মৌনর। উঁহু, একে এতো শান্তিতে ঘুমুতে দেওয়া যাবেনা। প্রচুর জ্বালিয়েছে তাকে। এবার নিজে জ্বলুক। মৌন আস্তে করে পেটে হাত রাখে। ফিসফিসিয়ে বলে,
‘তোমার বাবাকে এতো শান্তিতে ঘুমাতে দিতে পারি আমরা! একদম না। একদম না।’

মৌন নিভৃতকে ডাকে,
‘এই যে শুনছেন? এই?’

নিভৃত হকচকিয়ে উঠে বসে। কিছু বলবে তার আগেই মৌন বলে,
‘আপনার বাবু নাকি পিৎজা আর কেক খাবে। যান নিয়ে আসেন।’

নিভৃত অসহায় ভঙ্গিতে ঘড়ির দিকে তাকালো। এতো রাতে পিৎজা বেচারা কোথায় পাবে। নিভৃত অসহায় গলায় মৌনর পেটের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘বাপ, সকালে পিৎজা খাওয়াই। এখন শুধু কেক খাও।’
‘না, আপনার বাপ আপনার কথা মানেনি। সে এই মুহূর্তে পিৎজা খাবে।’

নিভৃত বেশ বুঝতে পারছে। বাবু না বাবুর আম্মু খেতে চায়। তাই আস্তে করে মৌনর হাতটা ধরে বললো,
‘জান, সকালে একবস্তা পিৎজা এনে দিবো। এখন শুধু ফ্রিজে কেক আছে। এনে দেই?’

মৌন এক ঝটকায় হাতটা সরিয়ে দিলো। গম্ভীর গলায় বললো,
‘খাবোনা কেক। সারাদিন আমার বাবু আমার বাচ্চা করেন। অথচ কাজের বেলায় নাই। আপনি ঘুমান তো নিভৃত। আপনি শান্তিমতো ঘুমান। যত্তসব।’

নিভৃতকে বড্ড অসহায় দেখালো। বেচারা কি করবে এখন! ফ্রিজ থেকে দুই পিস কেক মৌনকে দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো নিভৃত। মৌন মিটিমিটি হাসছে। বেশ হয়েছে! আহারে বেচারা!

(চলবে)….

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here