#ময়ূখ
#পর্ব-২৪
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৭০.
হঠাৎ করেই মাথা ঘুরে মাটিতে ঢলে পড়ে মৌন। পাশের ইটে বাড়ি লেগে কপালের পাশটা কেটে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। লুবনা, ঝিনিয়া হকচকিয়ে মৌনকে ধরলো। নাম ধরে ডেকেও কোনো সাড়া নেই। বোতল থেকে হালকা পানি ছিটিয়ে দিতেই আবছা চোখ মেললো মৌন। তাড়াতাড়ি কিছু মানুষের সহায়তায় মৌনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে নিয়ে গেলো তারা। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে দুজনের। মাথা বেশি কাটেনি। সামান্য একটু কেটেছে কেবল। রক্ত পরিষ্কার করে ওয়ানটাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলেন ডাক্তার। ডাক্তার মিতালি মৌনের হাতের নার্ভস পরীক্ষা করলেন। মৌন ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে রাখা বেডে শুয়ে আছে। জ্ঞান থাকলেও আশপাশের পরিবেশ তার কাছে আবছা। মিতালি লুবনার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন,
‘পেশেন্টের নাম কি?’
‘মৌন।’
ডাক্তার মিতালি আস্তে আস্তে ডাকলেন,
‘মৌন, আপনি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছেন?’
‘জ্বি।’
‘আপনার শারীরিক গঠন এবং আপনার বান্ধবীদের কাছ থেকে শুনে যা বুঝলাম এগুলো গর্ভবতী হওয়ার লক্ষণ। আপনি কি বুঝতে পারছেন মৌন?’
‘জ্বি।’
‘আপনার কিছু পরীক্ষা করা প্রয়োজন। পরীক্ষা গুলো করিয়ে আমাকে রিপোর্ট দেখিয়ে যাবেন।’
কিছুটা সুস্থবোধ করছে মৌন। লুবনাকে ধরে ধরে হেঁটে বাইরে বেরিয়ে পরীক্ষা করে নিয়েছে। তবে রিপোর্ট আগামীকাল দিবে।
‘একা যেতে পারবি মৌন?’
লুবনার চিন্তিত কন্ঠস্বর। লুবনা, ঝিনিয়া দুজনেই রোকেয়া হলে থাকে। মৌনর সাথে সম্পর্কটা অনেক ভালো। মৌনকে রিকশায় তুলে দিয়েছে। তবুও তাদের চিন্তা থামেনা। মৌন মলিন হেসে বলে,
‘চিন্তা করিস না। আমি তো সুস্থ এখন। যেতে পারবো।’
‘আচ্ছা, সাবধানে যাস।’
__________________
‘মৌন, কপালে ব্যান্ডেজ কেন মা?’
মিরা উদ্বিগ্নচিত্তে প্রশ্ন করে এগিয়ে আসেন। মৌনকে সোফায় বসিয়ে বলেন,
‘কি হলো বল?’
‘এই একটু মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম।’
‘এইজন্যই বলি শরীরের যত্ন নিতে। একদম নিস না। আচ্ছা, একটা কথা বলতো কোনো সুসংবাদ আছে?’
মিরার প্রশ্নে মৌন লজ্জা পেয়েছে খুব। হলদে গালগুলো লাল রাঙা হয়ে আছে।
‘তেমন কিছুনা মা।’
মৌন আসলে নিশ্চিত না হয়ে ব্যাপারটা কাউকে জানাতে চাচ্ছেনা। আচ্ছা, ও যদি সত্যিই প্রেগন্যান্ট হয় তাহলে নিভৃতের প্রতিক্রিয়াটা কি হবে? খুব খুশি হবে কি? মুচকি হাসে মৌন। রাগ তো সব তাকে ঘিরে। বাবুর কথা শুনলে নিভৃত রাগ দেখাতেই পারবেনা। আবার লাজে রাঙা হয় মৌনর মুখ। মিরা আর বিষয়টা ঘাঁটলেন না। মেয়েটাকে লজ্জা দিতে চান না তিনি।
রাতে নিভৃতের সাথে কথা বলেনি মৌন। একটা চাপা অভিমান ছিলো তার। নিভৃত একবার জিজ্ঞেসও করেনি মাথায় ব্যান্ডেজ কেন। অভিমানটা গাঢ় হয় যেন। তবে এই অভিমান কি আদো কেউ বুঝে? মরুভূমির খা খা বালুগুলো যখন তৃষ্ণায় কাতর হয়ে সূর্যের সাথে অভিমান করে সূর্য কি আদোও সে অভিমান বুঝে? উল্টো নিজের তেজ বাড়ায় শতগুণ!
৭১.
পেরিয়ে গিয়েছে দুইটা দিন। বিভিন্ন ঝামেলায় রিপোর্ট আনতে যেতে পারেনি মৌন। বাড়িতে রুহানির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এতিম খাওয়ানো হবে। বিভিন্ন ব্যস্ততায় কাটছে মৌনর দিনরাত। অহনা প্রতিদিন ভোরে ফজরের নামাজের পর অনেকটা সময় রুহানির কবরের পাশে বসে কাঁদেন। একদিন মৌন কথা বলতে চেয়েছিলো তবে তিনি এড়িয়ে গেছেন। এই পৃথিবীর প্রত্যেকটা দোষ কেবল মৌনর। সবাই তাকেই ভুল বুঝে। তার দোষ থাকুক কিংবা না থাকুক। শতকষ্টের মাঝেও গতকাল বিকালের কথা মনে করে মনটা ভালো হয়ে যায় মৌনর।
_________________
‘আপা আপা আপা।’
‘আরে পাগলি কি শুরু করলি ফোনে। কি হয়েছে?’
‘আপা রিপু ভাই কাল রাতে।’
লাজুক কন্ঠ রথির। মৌন মুচকি হাসে। হেসে ঠাট্টা করে বলে,
‘হুম। রিপু ভাই রাতে কি?’
‘তুমিও না আপা। খালি লজ্জা দাও।’
‘আমি আবার কি বললাম?’
‘উফফ, আপা তুমিও না।’
মৌন খুশি হয়। তার বোন সুখে আছে, রিপু ভাই ভালো আছে।
আজ রুহানির মৃত্যুবার্ষিকী। নিভৃত স্তব্ধ হয়ে বসে আছে রুহানির কবরের পাশে। বাড়ির সামনে প্যান্ডেল করা হয়েছে। ভিতরে কোরআন তেলওয়াত হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর সবাইকে খাওয়ানো হবে। নিভৃত এতো কাজের মাঝেও বসে আছে নিশ্চল হয়ে। অনুভূতিশূন্য সে। নিজেকে অপরাধী লাগে তার। গতকাল রাতে অহনা ডেকে নিয়ে তাকে বেশ কথা শুনিয়েছেন। আচ্ছা, নিভৃত কি সত্যিই স্বার্থপর! বিশ্বাসঘাতক! ভালোবাসার মান দিতে জানেনা!
হাসপাতাল থেকে ফোন আসায় মিরাকে জরুরি কাজের কথা বলে বেরিয়ে যায় মৌন। একটা উত্তেজনা কাজ করছে তার মাঝে। সত্যিই কি তার মাঝে বেড়ে উঠছে আরেকজন! উত্তেজনায় হাত পা কাঁপছে মৌনর। যদিও বাসায় এসে টেস্ট করেছিলো সময় পজিটিভ এসেছিলো রেজাল্ট। তবুও বিশ্বাস হয়না তার!
ডাক্তার মিতালি অভিজ্ঞচোখে রিপোর্ট দেখে বললেন,
‘আপনি গর্ভবতী মিসেস মৌন। সাত সপ্তাহ চলছে।’
মৌনর চোখ দুটো চিকচিক করে উঠে। এত স্নিগ্ধ কেনো এই অনুভূতি!
‘মিসেস মৌন আপনার বয়সটা কম। তাই নিজের খেয়াল রাখবেন। বেশি টেনশন করবেন না আর খাওয়া দাওয়াটা ঠিক মতো করবেন। আপনার স্বামী কোথায়? আপনার সাথে আসেনি?’
‘আসলে উনি একটু ব্যস্ত।’
মিতালি অবাক হলেন। সচরাচর এমন পেশেন্টের সাথে স্বামীরা থাকে কিংবা তাদের কোনো প্রিয়জন। তবে মেয়েটা একেবারেই একা।
‘নিয়মিত চেক-আপ করে যাবেন।’
‘জ্বি, চেষ্টা করবো।’
রিপোর্টটা নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে বেরিয়ে আসে মৌন। সাদাকালো রিপোর্টটায় বলের মতো ছোট একটা অংশ। মিতালি দেখিয়ে বলেছিলেন এটা নাকি বাবুর বর্তমান অবস্থা। মৌনর চোখ দিয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। মাতৃত্বের অসীম সুখের সন্ধান পেয়েছে মেয়েটা।
৭২.
বিগত দু’দিন যাবত কথাটা বলবে বলবে করেও বলতে পারছেনা মৌন। কেমন একটা লজ্জা! আড়ষ্টতা! অহনা,রিজভী চলে গিয়েছেন। নিভৃত একেবারেই চুপ। কথা বলেনা, ঝগড়া করেনা। একেবারে নিশ্চল, স্তব্ধ। যেনো স্তব্ধতায় তার রাজত্ব। মৌন নিজের ধ্যানে আছে। সকল অভিমান ভুলে গিয়েছে তার অবুঝ মন। আজ মিরা বাড়িতে নেই। দিলারা, নাজমুল আছেন কেবল। মিরা ভাইয়ের বাড়িতে গিয়েছেন।
রাত বাড়ছে ক্রমশ। বাইরে শুক্লপক্ষের চাঁদ উঠেছে। বারান্দা ভেদ করে চাঁদের মিঠা আলো প্রবেশ করছে ঘরে। নিভৃত খাটে আধ শোয়া হয়ে ল্যাপটপে বসে কাজ করছে। পাশে মৌন বসে। নিভৃত একমনে কাজ করে যাচ্ছে। মৌনর হঠাৎ হঠাৎ কি হচ্ছে ও বুঝতে পারেছেনা। তবে অদ্ভুত অনুভূতি।
‘এই যে শুনুন?’
নিভৃত মৌনের কথায় কপাল কুঁচকে তাকায়। আজ প্রচন্ড বিরক্ত সে। অফিসে প্রচুর রাগ দেখিয়েছে। অহনার দগদগে কথাগুলো আরো মাথা নষ্ট করে দিচ্ছে তার। আরেকদিকে রুহানির স্মৃতি, অপরাধবোধ।
‘কি?’
‘আপনার বেবি কেমন লাগে। ছোট ছোট বেবিগুলো।’
মৌনর অহেতুক ফালতু কথায় নিভৃত বিরক্ত হয়। জরুরি কাজ ফেলে তাকে এসব শুনতে ডেকেছে মেয়েটা?
‘আমি কাজ করছি। বিরক্ত করোনা।’
মৌন থামেনা। বলে যায়,
‘আমাদের একটা বেবি হলে কেমন হয় নিভৃত?’
নিভৃত বিরক্ত কন্ঠে বলে,
‘আমি কি তোমাকে বলেছি আমার বাচ্চা লাগবে? আমাদের সম্পর্কটা কেমন তুমি জানোনা?’
‘আমার যে চাই নিভৃত। আমার যে একটা বেবি চাই।’
মৌন একা একাই বকবক করছে। নিভৃত ল্যাপটপটা পাশে ঠাস করে ফেলে গাল চেপে ধরে মৌনর। শক্ত কন্ঠে বলে,
‘বুঝিস না তুই। আমি বলছি আমার বাচ্চা লাগবে? তোর আর আমার বাচ্চা! এই আমাদের সম্পর্ক কেমন তুই জানিস না? বাচ্চার কথা ভাবলি কেমনে তুই?’
মৌনর গাল ছেড়ে অন্যদিকে ফিরে নিভৃত। মৌন থমকে গিয়েছে। তার সকল আশা, ভরসা শেষ হয়ে গিয়েছে একমুহূর্তে। রাগে গলা উঁচিয়ে সে বলে,
‘কেন? চাহিদা পূরণ করার সময় মনে থাকেনা বাচ্চা লাগবেনা?
নিভৃত গর্জে উঠে। গলা উঁচিয়ে বলে,
‘চুপ। আর একটা কথা না।’
মৌনর কি হলো সে জানেনা। অনেক মুড সুইং হচ্ছে তার। সেও গলা উঁচিয়ে বলে,
‘রুহানি, রুহানি, রুহানি। একটা মৃত মানুষের জন্য এতো ভালোবাসা! অথচ একটা জীবিত মানুষকে যে মৃত বানিয়ে দিচ্ছেন। মরার প্রতি এতো দরদ..
আর কথা বাড়াতে পারলোনা মৌন। একটা থাপ্পড় পড়লো তার গালে।
‘তুই এই কথাটা বলার সাহস পেলি কই। এই তোর বুক কাঁপলো না। তোরে যদি এখন আমি খুন করি।’
মৌন চিৎকার করে। চিৎকার করে বলে,
‘তো করুন খুন। কেন বাঁচিয়ে রেখেছেন আপনারা আমায়। আমি আর পারছিনা। আর সাহসের কথা বলছেন? আমি একশবার বলবো। কি করবেন আপনি।’
আরেকটা থাপ্পড় পড়ে তার গালে। নিভৃতের চোখ লাল হয়ে আছে। ক্ষিপ্র বাঘের মতো হিংস্র লাগছে তাকে। মৌন এবার ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায়। নিজেকে খাটের এককোণে গুটিয়ে নেয় সে। নিভৃত পাশ থেকে উঠে মৌনর একটা হাত ধরে টেনে দাঁড় করায় তাকে। আকস্মিক আক্রমণে পেটে একটু টান পড়ে তার। নিভৃত টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে দরজার দিকে। মৌনর বামহাতটা চলে যায় তার পেটে। বাবুটার কি কষ্ট হচ্ছে! তার পঁচা বাবার কারণে কি কষ্ট পাচ্ছে বাবুটা! বুক ফেটে যাচ্ছে মৌনর। একটা টান দিয়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয় সে।
‘আমাকে এভাবে বের করে দিতে হবেনা। আমি নিজেই বেরিয়ে যাচ্ছি।’
বলেই বেরিয়ে যায় মৌন। নিভৃত থমকে যায়। ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ে সে। মাথাটা চেপে ধরে রাখে। কি ছিল সেই কন্ঠে! এতটা বলিষ্ঠ কন্ঠ নিভৃত আগে তো শুনেনি! এতটা শক্ত কন্ঠ!
#ময়ূখ
#পর্ব-২৫
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৭৩.
তীব্র মাথা যন্ত্রণায় কাতর নিভৃত। তিনটা ঘুমের বড়ি খেয়ে পাড়ি জমালো ঘুমের দেশে। এই দুষ্কর দুনিয়ায় নিজেকে নিজের কাছে গোলকধাঁধার ন্যায় মনে হয় তার। মস্তিষ্ক আর মনের এ এক অসীম দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বে বারবার পিষ্ট হচ্ছে নিভৃত।
পূর্ব দিগন্তে রক্তিম সূর্য উঁকি দিয়েছে। চড়ুই, কাকের ডাক ভেসে আসছে কানে। মৌন মাথায় কাপড় দিয়ে নিভৃতের ঘরের দরজাটা আস্তে করে খুলে ঘরে ঢুকে। ফজরের নামাজের পর আর ঘুমায়নি সে। নিভৃত খাটে ঘুমে বিভোর। মৌন আলমাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। চোখদুটো তার লালবর্ণ। সারাটা রাত কেঁদেছে। চোখের পানিও বোধহয় শুকিয়ে গিয়েছে এখন। আলমাড়ি খুলে নিজের কালো রঙা ডায়েরিটা বের করে মৌন। ডায়েরির শেষের পাতায় কিছু লাইন লিখে। আলট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট টা খুলে ডায়েরির শেষ পাতায় সেফটিপিনের সহায়তায় লাগিয়ে দেয়। সযত্নে ডায়েরিটা আলমাড়ির ভিতর কাপড়ের ভাঁজে রেখে দুইটা কাপড় ব্যাগে ঢুকায় মৌন। গত চারমাসে তিনটা টিউশনি করিয়ে প্রায় পঁচিশ হাজার টাকা জমিয়েছিলো তা তুলে নেয় ব্যাগে। কালো রঙের বোরকাটা পরে নিভৃতের মুখপানে চায় মৌন। ভালোবাসার মানুষকে কখনো ঘৃণা করা যায়না। নয়তো মৌন করতো। নিভৃত নামক মানুষটাকে মনের সবটা দিয়ে ঘৃণা করতো। চোখের কোণায় জমা হয় বেহায়া নোনাজল। মৌন মুছে নেয়। পেটে বাম হাতটা রেখে বিরবির করে,
‘তোমার কি বাবার খুব প্রয়োজন? তোমার মা যদি তোমার বাবার ভূমিকা পালন করে তুমি কি খুব কষ্ট পাবে?’
উত্তর আসেনা। দুইমাসের বাচ্চা কি বুঝে মায়ের দগ্ধ মনের কষ্টে বলা বিক্ষিপ্ত কথারমালা!
___________________
দুপুর দুইটা বাজে। মিরা নিভৃতের ঘরে প্রবেশ করেছেন। নিভৃতকে ঘুমে দেখে অবাক হোন তিনি। নিভৃতের শিয়রে বসে ডাকেন,
‘বাবুই। বাবুই উঠ্।’
নিভৃত আস্তে আস্তে চোখ মেলে। ঘুমের ঘোর এখনো যায়নি তার। নিজেকে ধাতস্থ করতে অনেকটা সময় কেটে যায়।
‘আজ এতোবেলা করে ঘুমুচ্ছিস যে? শরীর খারাপ।’
মিরা হাত বাড়িয়ে নিভৃতের কপাল ছুঁয়ে দেখেন। তবে জ্বর নেই। তিনি কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি ফিরেছেন। সকালে মৌন ফোন করে বলেছিল বাড়ি যাচ্ছে জরুরি কাজে। তিনি গাড়ি নিয়ে যেতে বলেছিলেন। তবে মেয়েটা গাড়ি নেয়নি।
‘আম্মু, একটা ব্ল্যাক কফি দিতে বলোতো।’
মিরা কাঁথা ভাজ করছিলেন। কাঁথাটা জায়গামতো রেখে তিনি বললেন,
‘তুই ফ্রেশ হয়ে নে। আমি নিয়ে আসছি।’
‘আচ্ছা।’
নিভৃত ফ্রেশ হয়ে বাইরে বের হতেই অফিস থেকে জরুরি কল আসে। না খেয়েই বেরিয়ে যায় নিভৃত। জরুরি কাজের চিন্তায় কাল রাতের ঘটনা এখনো মস্তিষ্ক স্মরণ করেনি। তাই সব ভুলে বসে আছে সে।
____________________
বারোটা নাগাদ ফরিদপুর পৌঁছেছে মৌন। মর্জিনা মুখটা মলিন করে রেখেছেন। নিতু ছয়মাসের গর্ভবতী। শশুর বাড়িতে একটা মোটর সাইকেলের জন্য এখনো অত্যাচার করা হয় তাকে। ভারী ভারী কাজ করানো হয়। তাই নিতুকে বাড়িতে নিয়ে এসেছেন মর্জিনা। রিপ্ত বাড়িতে নেই। ধানের ব্যবসা দিয়েছে নতুন। সেই সুবাদে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছে। আলম সাহেব এখন বেশি চলাচল করতে পারেন না। শরীর নরম হয়ে এসেছে। পরিবারের খরচ এখন রিপ্তের ঘাড়ে। মৌন একটা মোড়া নিয়ে মিঠা রোদের মাঝে বসে আছে। পিছনে বিস্তৃত ধানক্ষেতের শো শো বাতাস। পুষ্পসহ গ্রামের কয়েকটা মেয়ে গোল্লাছুট খেলছে। মৌন একধ্যানে তাদের দেখছে। পাশে গরুর গোবর দিয়ে ঘুঁটে তৈরী করছে রথি। কোমড়ে শাড়ির আঁচল গুঁজা তার। মেয়েটা এখন পাক্কা সংসারী।
৭৪.
‘আপা, দুলাভাই কখন আসবো?’
রথির প্রশ্নে তার দিকে ফিরে মৌন। মলিন হেসে বলে,
‘কেন? তোর আপা কি একা থাকতে আসতে পারেনা?’
‘তা না। এমনি বললাম।’
রথি আবার কাজে মন দেয়। হঠাৎ করেই রথির অদ্ভুত লাগছে। এভাবে মৌনর বাড়িতে আসার মানে কি। তাও শশুর বাড়ি না গিয়ে বাবার বাড়ি এলো! রথির মনে ভয় ঢুকে যায়। রিপ্ত অনেক কষ্টে ওঁর হয়েছে। আবার যদি রিপ্তর মন ঘুরে যায়! শিউরে উঠে রথি। মৌন উদাস ভঙ্গিতে মেয়েদের গোল্লাছুট খেলা দেখছে। রথি অনুধাবন করে তার আপাকে তার বিরক্ত লাগছে। বড্ড বেশি বিরক্ত লাগছে!
মর্জিনা রান্নাঘরে লতি কাটছেন। নিতু বলেছিলো শুটকি দিয়ে লতি তরকারি খাবে। তাই এই আয়োজন। পাশে বসে নিতু আচার খাচ্ছে। মৌন মায়ের সাথে কথা বলতে এসেছিলো। নিতুর আচার খাওয়া দেখে তারও বড্ড ইচ্ছে করছে আচার খেতে। মর্জিনার কাছে গিয়ে পাশে পিঁড়িতে বসে মৌন। চুলার পাড়ে আচারের বয়াম দেখে বলে,
‘মা, একটু আচার দাওনা।’
মর্জিনা কপাল কুঁচকে তাকান। এমনিতেই নিতুর চিন্তা। আলম অসুস্থ,রিপ্ত বাড়ি নেই। ঘরে তাদের যথেষ্ট চাল রয়েছে। তবে মৌনর জন্য আবার বাড়তি রাঁধতে হবে। এতো বড় শশুর বাড়ি ফেলে বাবা-মায়ের অভাবের সংসারে আসার কোনো মানে হয়! সকালে মাত্র এসেছে। তাই তিনি কিছু বলতেও পারছেন না।
‘কেন? তুই কি পোয়াতি?’
মায়ের প্রশ্নে থতমত খায় মৌন। কি বলা উচিত এখন তার!
‘না, মানে।’
‘মৌন যা তো এক কলসি পানি নিয়ায় কলপাড় থেকে। কাজ করতাছি বিরক্ত করিসনা।’
মৌন সত্যিই অবাক হয়। মায়ের আচরণ, রথির আচরণ এতো অচেনা কেন লাগছে তার!
‘মা, তুমি পুষ্পরে বলো। আমার একটু সমস্যা আছে।’
মৌন কথাটা বলে উঠে যায়। মর্জিনা বিরক্তিসহ তাকিয়ে পুষ্পকে হাঁক ছাড়েন।
শাপলাবিল থেকে মাগরিবের আজানের মায়াবী সুর শুনে বাড়ি ফিরে মৌন। কি অদ্ভুত! কেউ তার খুঁজ করেনি। এমন কি পুষ্পও না।
আলমের সাথে খানিকটা সময় কাটিয়ে খাবার খেয়ে নিজের ঘরে শুয়ে পড়ে মৌন। মা কি সুন্দর বড় আপাকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছিলেন। মৌনর ইচ্ছে জেগেছিলো মায়ের হাতে ভাত খাবে। কিসের যেন একটা বাঁধা। মা,বোনের অদ্ভুত ব্যবহার কি সেই বাঁধা!
রাত দশটা। নিভৃত ক্লান্তচিত্তে বাড়ি ফিরে। ফ্রেশ হয়ে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে সে।
কেটে গিয়েছে দুইদিন। নিভৃত এখন পাগলপ্রায়। মেয়েটা কোথায়? বাড়িতে আছে কি? তার সামনে আসেনা কেন?
‘আম্মু?’
‘কিছু বলবি বাবুই।’
‘আম্মু, ও কোথায়?’
‘কে?’
‘তোমার বউমা।’
‘মৌনর কথা বলছিস?’
‘হ্যাঁ।’
‘মৌন তো গ্রামে গেছে।’
নিভৃত অবাক হয়ে। অবাক কন্ঠে বলে,
‘কবে?’
‘গত পরশু।’
এরমানে মেয়েটা সেই ঘটনার পরেরদিনই বাবার বাড়ি চলে গিয়েছে। আর নিভৃত ভেবেছে রাগে হয়তো সামনে আসেনা।
‘আম্মু, আমি ফরিদপুর যাচ্ছি।’
‘এখন?’
নিভৃত কোনো কথা শুনলোনা। নিজের সাদা রঙা মার্সিডিজ নিয়ে ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো সে।
৭৫.
সবাই খেতে বসেছে দুপুরে। মর্জিনা নিতুকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছেন। রথি, পুষ্প পাশে বসে খাচ্ছে। আলম আগেই খেয়ে উঠেছেন। মৌন রুইমাসের তরকারি নিতে যাবে তখনই মর্জিনা বলেন,
‘আর বলিস না মৌন। রুই মাছ এতো দাম! জব্বার জেইল্লা তে মাছ কিননেরই কথা না। একটা মাছ নাকি তিনশ টাকা। বাপরে বাপ।’
মৌন মাথাটা নিচু করে পাশে রাখা বাটিতে ডাল থেকে দুই চামচ ডাল নেয়। হায়! যাদের সুখের জন্য নিজে বলি হলো আজ তারা তাকে মাছের দাম শুনাচ্ছে! জীবনটা সত্যিই অদ্ভুত!
রিপ্ত এখনো ফিরেনি। রিপ্তের সাথে কথা বলছিলো রথি। রিপ্ত এখন অনেকটাই ভালো ব্যবহার করে তার সাথে। রথি কি জানে রিপ্তের ভালো ব্যবহারের পিছনে মৌনর অবদান ঠিক কতোটা!
‘রথি, বোন।’
মৌনর কণ্ঠ শুনে তড়িঘড়ি করে কলটা কেটে দেয় রথি। শক্ত কন্ঠে বলে,
‘কিছু বলবা আপা।’
‘তুই কি আমার সাথে রাগ করেছিস বোন?’
‘না।’
‘তো কথা বলিস না কেন?’
‘আমি কি আজাইরা বাপের বাড়ি থাকি? ঘর আছে, সংসার আছে। ধান সিদ্ধ করা আরো কত কাজ। তোমার সাথে গল্প করি কখন।’
মৌন রথির কথায় খুবই কষ্ট পেয়েছে। সত্যিই কি সে বাবার বাড়ি অহেতুক পড়ে আছে? কতটা যন্ত্রণায় এসেছে সেই তো জানে। স্বামী গাঁয়ে হাত তুলে, পেটে একটা বেড়ে উঠছে। এদিকে স্বামী নাকি বাচ্চা চায়না। কোথায় যাবে মৌন। সে তো অকুল পাথারে পড়েছে।
নিজের ঘরে ঢুকে মৌন। মোবাইল ঘেঁটে কাঙ্খিত নাম্বারটা খুঁজে। যদি সে ব্যাক্তিটা একটু আশ্রয় দেয়।
(চলবে)……
(চলবে)……