যখন তুমি এলে পর্ব ৭

#যখন_তুমি_এলে
#পর্ব- ০৭।

দিনগুলো কেমন দ্রুত কেটে যাচ্ছিল। সাচীর সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল শুরু হয়ে গেল। সারাবছর ফটোগ্রাফি, শর্টফিল্ম এসব নিয়েই পড়ে থাকে। তাই পরীক্ষার আগে আগে কোমড় বেঁধে লেগে পড়তে হয়। এরমাঝে তুহিনের সাথে যোগাযোগ টা একটু কমে গেছে। একটু রাগারাগিও হয়েছিল অবশ্য। কারন তুহিন বারবার ফোন দিচ্ছিল,আর সাচী ফোন সাইলেন্ট করে রেখে পড়তে বসেছিল। ফোন বিছানার কাছে রেখে,টেবিলে বসে পড়ছিল। বারোটায় শুতে গিয়ে দেখে অনেকগুলো কল। বুঝতে পারে যে রেগে যাবে,এবং সেটাই হলো। আর তাও সাচীর ভাবনার বাইরে রাগ দেখালো তুহিন। সাচী কোন কথা না বলে চুপচাপ ফোন কেটে দিলো। ভীষণ অভিমান হচ্ছিল তার। ভুল হতেই পারে,তার জন্য এতো রাগ দেখানোর কি আছে?
সাচীও রাগে ফোন অফ করে ঘুমিয়ে পড়ে। বেশ কয়েকদিন কেটে যায়। তুহিনও ফোন দেয় না,সাচীও দেয় না।
শেষ পরীক্ষার আগেরদিন সাচীর ভীষণ মন খারাপ হচ্ছিল। কারন সেদিন সাচীর জন্মদিন ছিলো। আর তুহিন ওর সাথে রাগ করে বসে আছে। সাচীও জেদ,অভিমান দেখিয়ে ফোন দিচ্ছে না। তুহিন ছেলেটাকে দেখে মনে হয় না এতোটা রাগী। এতো সুন্দর একটা মানুষের এতো রাগ থাকতে পারে,সাচী জাস্ট ভাবতে পারেনা। সারাক্ষণ কত মিষ্টি করে কথা বলে। অথচ রেগে গেলে সব পাল্টে যায় মুহুর্তেই।
টুকটাক রাগারাগি হয়েছে এরমধ্যে, তবে এতোটা সিরিয়াস না। সাচীই রাগ ভাঙ্গিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এবার সাচী আর ভাঙাবেনা। কষ্ট হলেও, সে এভাবেই থাকবে।
আজ একসপ্তাহ হয়ে গেছে, অথচ তুহিন ফোন দিচ্ছে না। সাচী মনমরা হয়েই পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিল।
শফিকুর বেশ কদিন ধরেই মেয়ের পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছিলেন। তবে ভেবেছেন হয়তো পড়াশোনা নিয়ে ব্যাস্ত,তাই আর এতোটা ভাবেননি। মেয়ের পছন্দই,উনার পছন্দ। তুহিনের সাথে পরবর্তীতে আবার দেখা হয়েছে,কথা হয়েছে। ছেলে ভালো,যেমন দেখতে,তেমন কর্মে। আর পরিবারও বেশ ভালো। তুহিন সাচীর পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর,এংগেজমেন্ট করে রাখতে চেয়েছিল। তারপর অনার্স শেষ হওয়ার পর,মানে দুইবছর পর উঠিয়ে নিবে। শফিকুর এতে মত দেন। ছেলেটাকে উনার বেশ পছন্দই হয়েছে। বেশ ঠান্ডা স্বভাবেরই মনে হয়েছে।
সাচীকে মুখ ভার করে বের হতে দেখে, শফিকুর এগিয়ে এলেন। মেয়েকে সোফায় বসিয়ে প্রশ্ন করলেন,
” পরীক্ষার প্রিপারেশন খারাপ?”
” সাচী দু’দিকে মাথা নাড়ালো। যার মানে শফিকুর ঠিক ধরতে পারলেন না। তাই আবার প্রশ্ন করলেন,
” তুহিনের সাথে কথা হয়?”
” আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে বাবা,আমি গেলাম। পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে,এমনিতে যে পরিমাণ জ্যাম। শফিকুর বুঝলেন,মেয়ে তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। তাই তিনিও আর কোন প্রশ্ন করলেন না। হয়তো কোন ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। সম্পর্কে এমন টুকটাক হয়ই। সেগুলোকে এতো গুরুত্ব দিতে নেই। মনে মনে ভাবলেন,মেয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসুক। তারপর না হয় কথা বলা যাবে এ নিয়ে।

অনেকদিন পর রোহানী আর রাদ ক্যাম্পাসে বসে ফুচকা খাচ্ছে।
যদিও রাদের এতো পছন্দ ছিলো না। কিন্তু রোহানী মুটির সাথে থেকে শিখে ফেলেছে। অবশ্য রোহানী পাঁচটা খেলে,সে একটা খায়। পুরো ক্যাম্পাস যেখানে গ্রুপিং করে চলে,সেখানে ওরা দুজন ওদের মতো থাকে। কারো সাতে পাঁচে জড়ায় না। অনেকে অবশ্য ওদেরকে টিটকারি মেরে কথা বলে। তবে সেসবে ওরা পাত্তা দেয় না। কারন নিজেদের মন যদি ফ্রেশ থাকে,তাহলে লোকের কথায় সেটা কখনোই কলুষিত হবে না। ফুচকা খেতে খেতে রোহানী বললো,
” হ্যা রে রাদ বস,তুই কি ভদ্র হয়ে গেছিস নাকি?”
” রাদ ফুচকাটা মুখে দিতে নিয়েও, থেমে গেল। হাতে রেখে বললো,আমি অভদ্র ছিলাম কবে রে রুই মাছ?”
” না,তুই তো ভদ্রই। শুধু একটু… অভদ্র ছিলি। রোহানী ভয়ে ভয়ে বললো। রাদ হাতের ফুচকাটা মুখে পুরে বললো,সে এরকম অভদ্র এই জগতের সবাই। কেউ প্রকাশ করে,কেউ করেনা। তা আমি কি অভদ্রতার কাজ করেছি,জানতে পারি মুটি ম্যাম?”
” দেখ কথায় কথায় মুটি বলবিনা। আমি গত দেড়মাসে দশ কেজি ওজন কমিয়েছি ডায়েট করে।”
” আরাদ হুঁট করে রোহানীর হাত থেকে ফুচকার প্লেটটা কেড়ে নিলো। রোহানী পুরো বোকা বনে গেল। হতাশ চোখে তাকিয়ে রইলো রাদের দিকে,আর ফুচকার প্লেটের দিকে। যেন ফুচকার প্লেটটা রোহানীকে অভিসম্পাত দিচ্ছে,এতোদিন তার থেকে দূরে থাকার জন্য। রাদ রোহানীর প্লেট থেকে একটা ফুচকা মুখে পুরে বললো,
” ফুচকা খেয়ে আবার কিসের ডায়েট করছিস তুই শুনি?”
” গত দেড় মাস ধরে যে কোন ফাস্টফুড খাই না, সেটা চোখে দেখলিনা। আজকে একটু খেতে নিলাম,আর ওমনি নিয়ে নিলি। তোরা সব আমার খাওয়ার শত্রু। রাদ ভ্রু কুঁচকে বললো,
” তোরা মানে, আর কে?”
” রোহানী লজ্জা পাওয়ার ভান করলো। রাদ বেশ অবাক হলো। মুখে লাজুক ভাব নিয়ে বললো,
” ঐ এক্সিডেন্ট ওয়ালার সাথে ফেসবুকে কথা হয় আমার। তোকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। সেই আমাকে বুঝালো যে,আমি নিয়মিত চেষ্টা করলে আমার ওজন কমতে পারে। প্রথমে রাগ হলেও,সে সম্পূর্ণ ঠান্ডা মাথায়ই বুঝালো বিষয়টা। এইযে বেশি স্থুলতা,সেটাতে তো আমারি কষ্ট হয়। সেও নাকি ছোট থেকে একটু বেশি মোটা ছিল। নিয়মিত চেষ্টা করে এখন সুন্দর স্বাভাবিক অবস্থায় আছে। তাই ভাবলাম চেষ্টা করে দেখি। সেই আমাকে সব টিপস দিলো। চার্ট করে দিলো। সেটাই ফলো করছি। আর দেখ,সত্যি অনেক হালকা লাগছে নিজেকে। রাদ একধ্যানে রোহানীর কথাগুলো শুনছিলো। এতোদিন এই একই কথা সে রোহানীকে বলে এসেছে,কিন্তু রোহানী শুনে নি। আর আজকে একজন অপরিচিত লোক ওকে বলার সাথে সাথেই,সে ডায়েট শুরু করে দিল। আমরা কত অদ্ভুত না!
এটাই কি তবে ভালোবাসার জোর!
রাদ কিছুক্ষণের জন্য ভাবনার সাগরে ডুবে গিয়েছিল। রোহানীর ডাকে সংবিত ফিরে পেলো। ঠোঁটে হাসি ঝুঁলিয়ে বললো,” ভালোবেসে ফেলেছিস নাকি?”
রোহানী মাথা নিচু করে রইলো। রাদ যেটা বুঝার বুঝে গেল। তাই আবার প্রশ্ন করলো,সেও বাসে?”
” জানিনা। রোহানী এককথায় উত্তর দিলো।”
” তাহলে কোন ভরসায় আবেগে ভাসছিস? যেখানে ওদিক থেকে কোন ইশারা নেই? এতোটা বোকা মেয়ে তো তুই নয়।”
” আমার সাথে প্রতিদিন কথা হয়। আমার খোঁজখবর নেয় সবসময়। সেই আমাকে খুঁজে বের করে রিকুয়েস্ট দিয়েছে।
আমি ভেবেছি হয়তো!
” দেখ,এই বিষয়গুলো খুব সেনসেটিভ। এভাবে অনিশ্চয়তার মধ্যে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক না। হাওয়ায় ভেসে লাভ নেই,হুঁট করে পড়ে যাবি। জানি মনের উপর কোন জোর কাটেনা। ভালোবাসা,সেটাতো হয়ে যায়। তবে এতোটা আবেগে ভেসে গেলেও চলে না। একটু বাস্তবিক চিন্তাভাবনা করতে হয়। সে তোর কেয়ার করছে,তার মানে এই নয় ভালোবাসে। কেয়ার করা মানেই ভালোবাসা নয়। এমনও হতে পারে,সে দায়বদ্ধতা থেকে কেয়ার করছে। তবে হ্যা,সেটা নাও হতে পারে। আমি শুধু মুদ্রার যে দুটো পিঠ থাকে,সেটা বললাম। যাই হোক,পজেটিভ-নেগেটিভ দুটো ভেবে রাখলে,তাহলে যেকোন অবস্থায় শক্ত থাকতে পারবি। তাই অনুভূতি লাগাম ছাড়া হওয়ার আগেই,নিশ্চিত হয়ে নে। তাহলে সঠিক সময়েই অনুভূতিতে লাগাম টানতে পারবি। রোহানী চুপ করে মাথা নিচু করে বসে রইলো।
সেটা দেখে রাদ রোহানীর মুখে একটা ফুচকা দিয়ে বললো,আগে মুড ঠিক কর। তারপর ভাব। তোরতো আবার পেট ঠিক না থাকলে,দুনিয়া অন্ধকার। আর দুনিয়া অন্ধকার হলেতো,পরে এক্সিডেন্ট ওয়ালাকেও দেখতে পাবিনা। এটা বলে রাদ অট্রহাসিতে ফেটে পড়লো। রোহানী রাদকে একটা ঘুষি দিতে নিলে,রাদ দূরে সরে যায়। আর জোরে বলে,যা ঐ এক্সিডেন্ট ওয়ালাকে ঘুষি দে গিয়ে। আমার ছুটি এবার।
রোহানী ঠিক এ কারনেই এখনি রাদকে বলতে চায়নি। জানে এভাবেই পঁচাবে। তবে রাদের বলা কথাগুলো রোহানীকে ভাবাচ্ছে। আসলে অস্বাভাবিক মোটা হওয়ার কারনে, আজ পর্যন্ত কোন ছেলে প্রপোজ তো দূরে থাক,তানিম এর মতো কথাই বলেনি। তাই হয়তো রোহানী এতোটা গলে গেছে।
আমরা অধরা কোন কিছু সহসা পেলে,সেটা তৎক্ষনাৎ মুঠোয় বন্দি করে ফেলতে চায়। কোনকিছু না ভেবেই।
রোহানীকে গভীর ভাবনায় ডুবতে দেখে, রাদ খোঁচা দিলো। তখন রোহানী স্বাভাবিক ভাবেই ফুচকা খেতে লাগলো।
হঠাৎ রোহানীর চোখ দূরে আটকে গেল। সেখানে এতো লোক জড়ো হয়েছে কেন,ঠিক বুঝতে পারছেনা। কোন ঝামেলা হলো নাকি?
রাদকে দেখাতেই সে বললো,
” দেখ গিয়ে কোন ড্রামাবাজ হয়তো তার ড্রামাকুইনকে অপেন প্রপোজ করছে। আজকাল তো এসবই চলে। মেয়েরা এসব ছেলেদেরই বেশি পছন্দ করে,যারা বুক ফুলিয়ে মানুষের সামনে প্রপোজ করতে পারে। আর সেখানে উৎসুক জনতা হা করে দেখবে,আর হাততালি দিবে। কেউ কেউ আবার আরো একধাপ এগিয়ে।সেই প্রপোজের ভিডিও করে, সোশ্যাইল সাইটে ছাড়বে। সিম্পল। রোহানী বিষয়টা খতিয়ে দেখার জন্য এগিয়ে যেতে নিলো। রাদও ফুচকার বিল মিটিয়ে পেছন পেছন আসতে লাগলো।
সামনেই একটা ছেলের সাথে দেখা হওয়াতে রোহানী ঘটনা কি জানতে চাইলো। হুম,রাদ যেটা অনুমান করেছিল,সেটাই ঘটছে ঐখানে। রোহানী ভিড় ঠেলে কাপলটা কে সেটা দেখতে গেল। তবে মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগছে। ছেলেটাকে পেছন থেকে দেখে চেনা যাচ্ছে না। রাদ রোহানীর মাথায় ঠোকা দিয়ে বললো, এসব মেলোড্রামা তো রোজই হয়,দেখার কি আছে?
রোহানী হুঁট করে বলে বসলো,
” এদের ব্রেকআপ করাতে পারবি? পারলে তোকে ব্রেকআপ স্পেশালিষ্ট মেনে নিবো,প্রমিজ।”
” রাদ ভ্রু কুঁচকে রোহানীর দিকে তাকালো। তারমানে তুই কি বুঝাতে চাইছিস?”
” নাহ,তেমন কিছুনা। ওদেরকে দেখে কেমন একটা স্ট্রং ফিলিং হচ্ছে। তাই বললাম আর কি। ”
” তুই যখন বলছিস,একটা ট্রাই তো করতেই হয়। আফটার অল নামের মানটা তো রাখতে হবে। আর অনেকদিন ধরে কোথাও গিট্টু লাগায় না। সবাই যদি ভালো হয়ে যায়,তবে কেমন দেখা যায় না। তাহলে মন্দ মানুষ দেখার জন্য,মানুষকে জাদুঘরে ছুটতে হবে। আর দেখি তোর অনুমান কেমন,আর আমি কতটা স্পেশালিষ্ট। ঠিক ঐ মুহুর্তেই তুমুল হাততালিতে চারদিক প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। রাদ বিরক্ত নিয়ে চলে যেতে নিলে,তখন রোহানী জোরে বলে উঠে আরে,এটা তো আরজে তুহিন! এজন্যই বোধহয় অন্যদিনের চেয়ে, দর্শনার্থী বেশি। ইসরে…আজকের পর তো তুহিনের ‘শো’ এর লিসেনার হ্রাস পেয়ে যাবে। কত মেয়ের ক্রাশ সে! এখানেও নিশ্চিত ডজনখানেক ক্রাশ খাওয়া পাবলিক উপস্থিত। তারা নিশ্চিত আজকে শোক দিবস পালন করবে। ক্রাশ চোখের সামনে অন্য কোন মেয়েকে প্রপোজ করছে,মানা যায় নাকি সেটা। আরে মেয়েটা ঐদিন যে তোর মুখে ফুল ছুঁড়ে মেরেছিল,সেই মেয়েটা। এজন্যই ঐদিন ঐ বেচারাকে রিফিউজ করেছিলো, বুঝতে পেরেছি। বিজ্ঞের মত ভান করলো রোহানী। তারপর নিজে নিজে বলতে লাগলো,সামনে এমন টসটসা আপেল রেখে,কে যাবে চিকনা শশা খেতে। কি কিউট কাপল রে। দুজনকে যা লাগছে না। জাস্ট মেইড ফর ইচ আদার।
রাদ থমকে দাঁড়ালো। ঐদিকে না তাকিয়েই রোহানীকে বললো, খুব শীঘ্রই এদের ব্রেকআপ হচ্ছে! জাস্ট কাউন্ট ডাউন।

#চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here