ছ’মাস পর নিজের উধাও হওয়া স্বামীর আচানক দর্শন পেয়ে চমকাল তীরু! স্থির রূপে থাকাকালীন ও টের পেল নিজ দেহের অস্বাভাবিক কাঁপুনি। ক্ষীণ দূরে তার স্বামী উপাধি পাওয়া মানুষটা বসে। মিষ্টি হেঁসে কথা বলছে তো মাঝেমধ্যে অধরজোড়া সিক্ত করছে কোমলপানীয় দ্বারা। রেজিস্ট্রি হওয়ার দিন হতেই লাপাত্তা ছেলেটা। রেজিস্ট্রি পেপারে নিজের নামটা লিখার পরপরই সম্পূর্ণ উধাও। কোথাও তার চিহ্নটুকু খুঁজে পায়নি কেও।আজ তার লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার ছ’মাস পেরুলো। এতদিন পর লোকটার দর্শন তীরু পেল কোথায়?প্যারিসের এক কফিশপে।
সম্মুখে পা ফেলে এগোল তীরু। অনেক অনেক প্রশ্ন জমে রয়েছে, অনেক কিছুর হিসাব নেওয়ার আছে যে লোকটার থেকে। তীরুর সাথে সংসার যখন সে করবেই না তবে বিয়ে কেন? কেন বিয়ে করে তার জীবনটা এক গন্ডিতে থামিয়ে দিল এই ছেলে?
-” কেমন আছেন স্বামী সাহেব? ” তীরুর রক্তহিম করা কণ্ঠ। শান্ত চাহনি। অথচ অন্তরালে তার অনল জ্বলমান।
রাদিফ অতীব গুরুত্বপূর্ণ আলাপে মশগুল। মেয়েলী কন্ঠস্বর শুনে খানিকটা বিরক্তি নিয়েই পিছন ফিরে তাকাল ও৷ তীরুকে দেখে স্বভাবসুলভ হাসল। বলে উঠলো,
-” আরে তুমি? বসো। কফি খাবে? অর্ডার দিব?”
এবার যেন তীরুর আকাশ হতে ছিটকে পড়ার পালা। বিষ্ময়, নির্বাক চাহনি ওর। রাদিফ বলল কি মাত্র? কি অদ্ভুত ছেলেটার ব্যাবহার! যেন তীরু তার শত জনমের পরিচিত এক রমনী, প্রতিদিন তাদের মাঝে আলাপচারিতা হয়। তাদের চেনাজানা তো রয়েছে। তবে তা স্বাভাবিক কি? উঁহু! অস্বাভাবিক। তীরুকে ধোঁকা দিয়েছে রাদিফ। বিয়ে করে ফেলে এসেছে। কোনো খোঁজ খবর অব্দি নেয়নি। এখন রাদিফের উচিত তীরুকে দেখে বিচলিত হয়ে পড়া, ভীত হওয়া। অথচ ছেলেটার প্রতিক্রিয়া তো দেখো! কি সুন্দর কফি সাধছে, তার পাশে বসতে বলছে আবার চোখের দৃষ্টিও কি নিদারুণ শীতল। জল্পনা কল্পনার ইতি টেনে তীরু বসল। রাদিফের বা পাশে। মুঠোফোনটা শব্দ করে রাখল কাঁচের টেবিলে। পা দুলাতে দুলাতে শুধাল,
-” আমি কোনো কাপুরুষের অফার গ্রহণ করি না। এক্সট্রিমলি সরি, হুহ? বিয়ে করে যে দেশে বউ ফেলে এলেন, কেন শুনি তো। বউয়ের ভরনপোষণ চালাতে পারবেন না বলে? তাহলে বিয়ে করলেন কেন? নাকি অন্য ব্যাপার রয়েছে, গার্লফ্রেন্ড আছে আপনার? বিয়ে করে নিয়েছেন তাকে? নাকি লিভ ইন টুগেদারে আছেন? ”
রাদিফ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল তীরুকে। একগাদা প্রশ্ন করা শেষে তীরু তখন লম্বা দম ফেলল। তাকাল পাশে। পুনরায় বলল,
-” আমার প্রশ্নের উত্তর দিন, হারি আপ! ”
রাদিফ দৃষ্টি সরাল। সামনে বসে থাকা দু’জনকে দেখে জবাব দিল,
-” কি বলছিলে যেন? শুনিনি। আরেকবার বলা যাবে প্লিজ? ”
বিধাতা ‘ ধৈর্য ‘ জিনিসটা খুব কমই দিয়েছেন তীরুর মাঝে। ধৈর্যহীন মেয়ে ও। খুব অল্পতেই চেঁচিয়ে ওঠে, রাগারাগি করে। এ পর্যায়েও এমনটা হলো। চেঁচাল ও,
-” ট্রাস্ট মি! যদি এটা পাবলিক প্লেস না হতো না আমি আপনাকে মে রে হাড্ডি ভে ঙে ফেলতাম। নাটক করেন আপনি? বিয়ের পর ছয়টা মাস উধাও ছিলেন। আজ দেখা হওয়ার পর নাটক শুরু করেছেন। ”
অতঃপর তীরুর সেই আকাঙ্খিত রূপ, রাদিফের বিচলতা দেখা গেল। হাসঁফাসঁ করে উঠল রাদিফ। আশপাশে তাকিয়ে নিচু গলায় অনুরোধ করল,
-” তীরু প্লিজ চেঁচিও না। পাবলিক প্লেস এটা। চলো আমরা বাহিরে গিয়ে কথা বলি? তোমার ভুল হচ্ছে একচুয়েলি। ”
তীরু তেড়ে এলো, ” কি ভুল হচ্ছে হ্যা? কোনো ভুল হচ্ছে না আমার। ভুল আপনার হয়েছে। এখন সেই ভুল করার শাস্তি পাবেন। ”
ক্যাফেটেরিয়া থমথমে। ব্যাস্ত মানুষজনের মাঝে গুঞ্জন উঠেছে। আবার কেও কেও নিজেদের মতো রয়েছে। রাদিফ, তীরুর সামনে বসে থাকা ভীনদেশী দুই তরুণ, তরুণী তখন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে। ভাষা বুঝতে না পেরে বোকার মতো তাকিয়ে আছে কেবল। রাদিফ এবার তাদের পানে তাকাল। আদেশ করে বলল,
-” ইউ গায়েজ লিভ ট্যুডে’স। দ্য মিটিং এন্ড হেয়ার।”
দু’জন উঠে দাঁড়িয়ে বিদায় জানাল। প্রস্থান করবে তৎক্ষনাৎ তীরু চটপট কন্ঠে চেঁচাল,
-” কেন ওরা যাবে? ওদের উচিত আপনার আসল রূপ দেখা। ওদের যেতে নিষেধ করুন এক্ষুণি। ”
তীরুর বাম হাত চেপে ধরে রাদিফ। হাতের ইশারা চলে যেতে বলে দু’জনকে। তারা প্রস্থান করতেই রাদিফ থমথমে কন্ঠে বলল,
-” তীরু তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। তুমি যাকে ভাবছো আমি সে নই। আমি তার কাজিন রাদিফ। তোমার বিয়ে হয়েছিল সাদিফের সঙ্গে। একবার আমায় ভালো করে দেখো তো আমি সে কিনা যার সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়েছিল। ”
ছটফটে তীরু স্থির হলো। জহুরী চোখে পরখ করতে লাগল রাদিফের মুখোশ্রী। আচানক থমকাল সে। কি আশ্চর্য! এটা কে? এতো মিল চেহারার! এতক্ষণ বাদে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে পরখ করতেই বোঝা যাচ্ছে মূল পার্থক্য। সাদিফের গায়ের রঙ বাদামী বর্ণের আর সেখানে রাদিফ ধবধবে ফর্সা। চোখ, চেহারার গড়ন একইরকম দেখতে হলেও পার্থক্য লুকিয়ে রয়েছে অধরের মাঝে। অধরের গড়ন কিয়ৎ ভিন্ন।
রাদিফ তীরুর স্তব্ধতা দেখে শুধাল,
-” তোমার মতো ভুল অনেকেরই হয়, হচ্ছে। কিন্তু একটু খেয়াল করে দেখলেই বোঝা যায় আমরা দু’জন সম্পূর্ণ আলাদা দু’টি মানুষ। আমার খালাতো ভাই হয় সাদিফ। ”
দু’জন দুই নারীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেও কিভাবে চেহারার গড়নের এতোটা মিল নিয়ে জন্মেছে তার হিসাব মেলাতে পারছেনা তীরু। এটা কি আদও সম্ভব? মাথা ঝাঁকাল ও। জিজ্ঞেস করল,
-” আপনার ভাই, সে কোথায়? আমায় বিয়ে করে কোথায় পালিয়েছে সে? যদি উধাও হতেই হতো তবে বিয়ে কেন করলো আমায়? ”
রাদিফের মুখাবয়বে চিন্তার লেশ! সে ভাবছে কিছু। ভাবনার অন্তে থাকাকালীন বলে উঠলো,
-” সাদিফ প্যারিসেই আছে ছয় মাস যাবৎ। ”
চোখমুখ শক্ত হলো তীরুর, ” আমি তার সাথে দেখা করতে চাই। এক্ষুণি আমায় তার কাছে নিয়ে চলুন। যদি না নিয়ে যান তাহলে আমি আপনাদের দুই ভাইয়ের নামে প্যারিসেই মামলা করে বসবো কিন্তু। ”
রাদিফ খানিকটা হাসার চেষ্টা করল, ” রিলেক্স! নিয়ে যাচ্ছি তোমায়। এতোটা হাইপার হওয়ার কিছু নেই। বাট আই থিংক কোথাও ভুল হচ্ছে তোমার। যেদিন তোমাদের রেজিস্ট্রি হলো সেসময়ের পর কি কোনো লেটার পাওনি?”
ভ্রু’দ্বয়ের মাঝে সরু ভাজ ফেলল তীরু। প্রশ্ন ছুড়ল,
-” কিসের লেটার? ”
-” সেই লেটার, যেখানে রয়েছে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর। যাইহোক আমার মনে হচ্ছে কোথাও একটা গন্ডগোল হয়েছে। সাদিফ তোমাকে বুঝিয়ে বলবে। চলো তবে। ”
প্যারিসে চলমান শীতের তান্ডব। শুভ্র বরফে ঢাকা সড়ক থেকে শুরু করে বাড়িঘর। রাস্তায় গুটিকয়েক মানুষ। সরকার হতে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে সবাইকে বিধায় অত্যান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাহিরে নেই কেওই। রাদিফ পার্কিং লটে এসে গাড়িতে বসল। ধুপধাপ দরজা খুলে লাগিয়ে রাদিফের পাশে বসল তীরুও। কিয়ৎ বিরক্ত হলো রাদিফ! মেয়েটা একটু বেশিই করছে না? রাগ হলে রাগ ঝাড়বে সাদিফের ওপর। কেন তার ওপর এতোটা রেগে এই মেয়ে আশ্চর্য!
গাড়ি চলছে মৃদু গতীতে। পৌঁছাতে বেশিক্ষণ লাগল না। মাত্র পনের মিনিটের পথ।বাসায় প্রবেশ করতেই তীরু ছটফটিয়ে উঠল,
-” কোথায় সাদিফ? কোথায় আপনার ভাই? জলদি ডাকুন তাকে। ”
রাদিফ ধীরেসুস্থে বলল, ” বসুন। ও এখন বাসায় থাকে না। আসছেই হয়ত। ”
জায়গাটা ছেড়ে চলে গেল রাদিফ। চঞ্চল তীরুকে দ্বিতীয়বার কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ অব্দি দিল না। তীরু বসে রইল সেখানটাতেই। ভাবল অতীত। বিয়ে হওয়ার পর যখন সাদিফ উধাও হলো তখন প্রায় দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল তীরু। কি থেকে কি হলো বুঝে উঠতেই পারল না। এরমধ্যে সাদিফের পরিবার বলতে শুধুমাত্র তার দাদী ব্যাতীত আর কেও নেই। সাদিফ উধাও হওয়ার পাঁচদিন পরই তিনি মা রা যান। তারপর সবকিছু কেমন অবিন্যস্ত হলো! তীরু পেল না সাদিফের খোজঁ – খবর। ছেলেটার খোঁজ নিবে তার কোনো মাধ্যমই রইল না৷
আশপাশ দেখার মাঝে হটাৎ তার নজরে এলো সামনে পড়ে থাকা ফলের মাঝে রাখা ছু রি টা। সে উঠে দাঁড়িয়ে হাতে নিল ছু রি টা। চট করে ব্যাগে পুরে নিল। কোনো রকম বিপদ দেখলেই কাজে লাগানো যাবে ভেবে নিজের কাছে রাখা। সাদিফকে তো আর ঠিক মতোন চেনা নেই তার। লোকটা যদি তার ক্ষতি করতে চায়? ভীতুর মতো পালিয়ে যাওয়ার মেয়ে নয় সে। তার এতোদিনের জমে থাকা প্রশ্নের জবাব না নিয়ে ও একদমই নড়বে না এখান হতে।
বিকট শব্দ হলো! গাড়ির হর্ণের প্রখর শব্দে কান ঝা ঝা করে উঠল তার। তার ক্ষীণ সময় বাদে সদর দরজা দিয়ে ছায়া পড়ল এক সৌম্যমানবের। আলো নেই দরজার কাছটায়। তাই ছায়া ব্যাতীত আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। আগন্তুক যতোটা এগিয়ে আসছে ততই তার শরীর অবয়ব স্পষ্টত হচ্ছে। খানিক বাদে নজরে এলো তীরুর আকাঙ্ক্ষিত সেই মুখোশ্রী। ঐ তো বাদামী বর্ণের সুঠাম দেহের পুরুষটা, সাদিফ।
চলবে~
#যেখানে_পথচলা_শুরু |০১|
#সাদিয়া_মেহরুজ
| রেসপন্স করবেন। |