যেদিন তুমি এসেছিলে ২ পর্ব -২২+২৩

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_টু
#পর্ব_২২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
________________
অর্ষা দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। একটা মানুষকে মুখের ওপর না করা যায় কীভাবে? সে হাসফাস করছে। আহনাফের রাগ দৃষ্টি এড়ায় না হাসিবের। সে আহনাফের কাঁধে হাত রেখে আস্তে বলল,

“রিল্যাক্স!”

এরপর আহিলের উদ্দেশ্যে বলল,

“তুমি আহনাফকে নিয়ে যাও। আমি আসছি।”

আহিল কিছুই বুঝতে পারছে না। আহনাফের রাগ করার কারণ কী? তার বেশি টেনশন হচ্ছিল অর্ষার জন্য। এমন সিচুয়েশন কী করে সামলাবে ও? তাছাড়া অর্ষাও জিসান স্যারকে পছন্দ করে কি? জানা নেই তার। সে আহনাফকে বলল,

“চলুন স্যার।”

আহনাফ মনেপ্রাণে রাগ দমানোর চেষ্টা করছে। কোনো রকম সিনক্রিয়েট করতে চাইছে না বলেই হাসিবের কথা মেনে নিয়ে আহিলের সঙ্গে চলে যায়। হাসিব নিজেকে ফিটফাট করে গুছিয়ে অর্ষা এবং জিসানের কাছে গিয়ে সুন্দর করে হাসল। এক হাত বাড়িয়ে দিল জিসানের দিকে। হাসিমুখে বলল,

“হেই বার্থডে বয়! শুভ জন্মদিন।”

হাসিবের আগমনে জিসান কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও চট করেই আবার নিজেকে সামলে নিল। হ্যান্ডশেক করে বলল,

“থ্যাঙ্কিউ।”

“আমায় চিনতে পেরেছেন তো? আমি আহনাফের বন্ধু। আগেরবার দেখা হয়েছিল।”

জিসান সহাস্যে বলল,

“মনে আছে।”

হাসিব তার হাত-ঘড়ি দেখল। দেরি হয়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে বলল,

“শিট! সবাই অপেক্ষা করছে আপনার জন্য। চলুন, চলুন।”

এরপর হঠাৎ করেই অর্ষাকে দেখতে পেয়েছে এমনভাবে বলল,

“আপনি?”

উত্তরে জিসান বলল,

“আমাদের এমপ্লয়ি।”

“আই সী! আসুন, আসুন আপনিও আসুন।” বলে জিসানের হাত ধরে নিয়ে গেল হাসিব।

মনে মনে অর্ষা ভীষণ খুশি হলো এবং হাসিবকে মনে মনেই ধন্যবাদ জানাল। আপাতত বিষয়টা এড়ানো গেছে এতেই তার স্বস্তি। পরে না হয় ভেবে-চিন্তে গুছিয়ে জিসানকে না করে দেওয়া যাবে।

কেক কাটার সময় অর্ষা আর আহনাফ ছিল মুখোমুখি। তার রাগী দৃষ্টি তখনও অর্ষার দিকে স্থির। অর্ষা আহনাফের দিকে তাকিয়ে ভড়কে যায়। সে এভাবে রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছে কেন? তার দোষটা কোথায়? দৃষ্টি সরিয়ে নিল অর্ষা। কেক কাটা শেষ হলে খাওয়া-দাওয়া করে সবাই আবার সবার কাজে চলে যায়। স্মৃতি অর্ষাকে টেনে অন্যপাশে নিয়ে বলল,

“অ্যাই জিসান স্যার তোমাকে কী বলল?”

অর্ষা প্রলম্বিত শ্বাস নিয়ে বলল,

“প্রপোজ করেছে ভাই!”

“সত্যিই?”

“হ্যাঁ। তাও আবার বিয়ের।”

স্মৃতি চোখ দুটো গোল গোল করে বলল,

“বাপরে! তাহলে আর দেরি কেন? তুমি কী বলেছ তাকে?”

“কিছুই বলিনি। কিছু বলার আগেই আহনাফ স্যারের বন্ধু এসে পড়েছে।”

“ধুর! আর সময় পেল না। বাই দ্য ওয়ে, কী উত্তর দেবে ভেবেছ কিছু?”

“অবশ্যই না করে দেবো।”

“কেন বলো তো? সে অফিসের উচ্চপদস্থ একজন স্যার। স্যালারী ভালো, দেখতেও সুদর্শন। তাহলে তোমার আপত্তিটা কোথায়?”

“কাউকে বিয়ে করার জন্য কি শুধু এসবই প্রয়োজন স্মৃতি?”

“ভালো থাকার জন্য এরচেয়ে আর বেশি কী দরকার?”

“ভালোবাসা দরকার। আমি তো তাকে ভালোবাসি না।”

“আমার কী মনে হচ্ছে জানো? তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো। কিন্তু আমার থেকে লুকাচ্ছ। সত্যি করে বলো তো কে সেই ব্যক্তি?”

অর্ষা রহস্য করে হাসল। এর মানে হচ্ছে সে এই ব্যাপারে এখন কিছুই বলবে না। স্মৃতি তবুও কিছুটা জেদ ধরে বলল,

“উহ্! ওভাবে হাসলে চলবে না। আমাকে বলতেই হবে।”

অর্ষা স্মৃতির হাত ধরে বলল,

“অবশ্যই বলব। অফিসে কলিগদের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় এবং কাছের মানুষটি হচ্ছ তুমি। তোমাকে বলব না তো কাকে বলব? তবে হ্যাঁ, এখনই নয়। সময় হলে আমি নিজে থেকেই তোমাকে বলব।”

“সত্যি তো?”

“তিন সত্যি।”

স্মৃতি বলল,

“ঠিক আছে। আমিও অপেক্ষায় রইলাম।”

আহনাফ জিদ্দে নেই। সে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বসে আছে। তার সামনে বসে আছে হাসিব। সে আহনাফকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,

“এত রেগে কেন যাচ্ছিস তুই?”

“যেই ভয়টা পাচ্ছিলাম সেটাই হয়েছে। রাগ করব না?”

“অর্ষা তো আর এক্সেপ্ট করেনি।”

“যদি করে?”

“করবে না।”

“তুই এতটা শিওর কীভাবে?”

“কারণ ও তোকে ভালোবাসে।”

“ছাই ভালোবাসে! আমাকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারছে ও। আমি শিওর, আমাকে জ্বালানোর জন্য ও রাজিও হয়ে যেতে পারে।”

“আরে ব্যাটা না! রিলেশনের জন্য প্রপোজ করলে না হয় ভাবা যেত। তাই বলে বিয়ের জন্য তো আর রাজি হবে না।”

“ভয়টা তো এখানেই। জিসান তো আর কোনোদিক থেকে কম না।”

“হ্যাঁ, কম না জানি। কিন্তু জিসান আহনাফ নয়। আর অর্ষা আহনাফকে ভালোবাসে।”

আহনাফ দিশেহারা হয়ে বলল,

“অর্ষা খুব জেদি দোস্ত! এখন আমার সত্যিই ভীষণ ভয় হচ্ছে। সেই সাথে রাগ তো হচ্ছে পাহাড় সমান। মনে চাচ্ছে ব্যাটাকে কয়েক ঘা দিয়ে আসি। শালা, প্রপোজ করার জন্য আর মেয়ে পেলি না! আমার কুইনের দিকেই নজর দিতে হলো?”

“রিল্যাক্স ব্রো। তোর কিংডমে তুই-ই কিং। কুইনও তোর-ই হবে। একটাবার শুধু অর্ষার ফ্রেন্ডদের সঙ্গে মিট হোক। ওদেরকে একবার কনভিন্স করে ফেলতে পারলে আর কোনো টেনশন নেই।”

“কাজটা কি এত সহজ হবে বলে মনে হয়?”

“সহজ করে নেব। আমি আছি তো।”

“এজন্যই তো ভয়।”

হাসিব ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,

“মানে কী?”

“মানে হচ্ছে তোর প্ল্যান বলেই ভয় পাচ্ছি। আগেরটা তো ফ্লপ হয়েছে। এবারও যদি হয়?”

“তুই শালা খালি নেগেটিভ-ই ভেবে যা।”

“আমি কিছু ভাবতে পারছি না। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে আমার। জিসানের কথাগুলো কানে ঘণ্টার মতো বাজছে।”

“পানি খা।”

আহনাফ ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি পান করল। নাহ্, রাগ কমছে না কিছুতেই। সে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করে বলল,

“ইয়া আল্লাহ্! সহায় হও প্লিজ, প্লিজ!”

বিকেলে অফিস ছুটির পর ফ্লোরের স্যার, বস এবং স্টাফদের নিয়ে অফিসের পাশে থাকা একটা রেস্টুরেন্টে এলো জিসান। আহনাফ প্রথমে ভেবেছিল আসবে না। জিসানের ট্রিট সে নেবে না। কিন্তু হাসিব যখন বলল,

“অর্ষাও তো যাবে। জিসান যদি তখন অর্ষাকে রাজি করিয়ে ফেলে কী করবি তখন? ওদেরকে চোখে চোখে রাখতে হবে।”

ব্যস, আহনাফকও রাজি হয়ে গেল আসার জন্য। জিসান অর্ষার পাশে বসেছে। অর্ষা যে উঠে যাবে সেটাও পারছে না। এতে করে সবার সামনে জিসানকে অপমান করা হবে। অর্ষার একপাশে জিসান এবং অন্যপাশে স্মৃতি। আহনাফ বসেছে অর্ষার মুখোমুখি চেয়ারে আহিল এবং হাসিবের মাঝখানে। ওদের চারপাশে অফিসের বাকিরা বসেছে। অর্ষাকে জিসানের পাশে দেখে চোয়াল শক্ত হয়ে যায় আহনাফের। সে জিদ্দে আহিলের শার্ট টেনে ধরে। আহিল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকায়। বোকার মতো জিজ্ঞেস করে,

“শার্ট-টা কি নেবেন স্যার?”

সম্বিৎ ফিরে পায় আহনাফ। সকলের দিকে তাকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে। আহিলের দিকে তাকিয়ে প্রসংশার সুরে বলে,

“এই শার্টে তোমাকে অনেক মানিয়েছে। কোত্থেকে কিনেছ?”

“নিউমার্কেট থেকে।”

“খুব সুন্দর, খুব সুন্দর।” বলে আহনাফ আড়চোখে জিসান এবং অর্ষার দিকে তাকাল। জিসান কিছু বলছে আর অর্ষা নিরব শ্রোতা হয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনছে। এত মনোযোগ দিয়ে ওর কথা শোনার কী আছে আহনাফ বুঝতে পারছে না।

আহনাফ হাসিবের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,

“হাসিব রে, ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে কিন্তু!”

হাসিব অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,

“কষ্ট করে হজম করে যা।”

আহনাফ গম্ভীর হয়ে বসে রইল। ওয়েটার এসে খাবার দিয়ে গেছে। সবাই খাওয়া শুরু করেছে কেবলমাত্র আহনাফ কাঁটাচামচ দিয়ে খাবার নাড়ছে আর দেখছে, জিসান অর্ষাকে খাবার সার্ভ করছে। দেখে মনে হচ্ছে তারা নব বিবাহিত দম্পতি। কেয়ার যেন উপচে উপচে পড়ছে! জিসানের এক্সট্রা কেয়ার বোধ হয় বাকিদেরও নজরে পড়েছে। সবাই মিটিমিটি হাসছিল। অর্ষা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। বাইরে হাসলেও মনে মনে জিসানের পিণ্ডি চটকাতে থাকে।

খাবার শেষ হওয়ার পর অর্ষা তড়িঘড়ি করে আহিলকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যায়। কারণ জিসান তখন বলেছে, আজকে সে বাড়ি পৌঁছে দেবে। জিসান বিল দেওয়ার সময় এই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছে অর্ষা। আহিল পিছু যেতে যেতে বলে,

“এত তাড়াহুড়ো করছিস কেন? কী হয়েছে?”

“কথা পরে বলিস, আগে আয়।”

রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে অর্ষা কিছুদূর এগিয়ে পেছনে তাকায়। আহিল নেই কোথাও। সে একটু এগিয়ে গিয়ে ডাকতে থাকে,

“আহিল, আহিল।”

“আহিল নেই। আহনাফ আছে।”

অর্ষা পাশে তাকাল। অন্ধকার থেকে আহনাফ বেরিয়ে এসেছে।

“আহিল কোথায়?” জিজ্ঞেস করল অর্ষা।

“হাসিবের সঙ্গে আছে।”

“বেয়াদবটা আমাকে একা রেখে গেল!”

“না তো! আমি আছি।” এই বলে অর্ষার দিকে দু’পা এগিয়ে আসে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,

“সব রাগ কী শুধুমাত্র আমার ওপর প্রয়োগ করবে বলেই জমিয়ে রেখেছ?”

কপালে ভাঁজ পড়ে অর্ষার। শুধায়,

“মানে কী?”

“জিসান যখন প্রপোজ করল তখন সঙ্গে সঙ্গে না করে দাওনি কেন?”

“আমি কাকে না করব, কাকে হ্যাঁ বলব সেটা আমার ব্যাপার। আপনার এত মাথাব্যথা কেন?”

“গোটা মাথায় তল্পিতল্পা নিয়ে চেপে বসে আছো, আবার জিজ্ঞেস করছ আমার মাথাব্যথা কেন? লিসেন অর্ষা, তুমি আমাকে ইগনোর করো, রাগ দেখাও আমি সব মেনে নিয়েছি। তাই বলে যদি ভেবে থাকো, অন্য কোনো ছেলের সঙ্গেও তোমাকে সহ্য করব তাহলে তুমি ভুল। আমি দুজন নারীর ব্যাপারে ভীষণ সেনসিটিভ। এক. আমার মা আর দুই. তুমি। আমি কিন্তু একদম ছাড় দেবো না।”

অর্ষা থমকে যায়। জবাব দেওয়ার মতো উত্তর নেই তার কাছে। তবে একরাশ ভালোলাগা এসে ভর করেছে তার মাঝে। সে কিছু না বলেই উলটো ঘুরে মুচকি হাসে। চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই ওড়নায় টান পড়ে। পিছু ফিরে দেখে আহনাফের হাতের মুঠোয় তার ওড়নার অংশ। অর্ষা রাগীস্বরে বলে,

“এসব কী?”

আহনাফ উত্তর না দিয়ে অর্ষার ওড়নায় নিজের হাত বাঁধল তারপর বলল,

“এবার যেখানে খুশি সেখানে যাও। আমি নিজে থেকে তো আর যাচ্ছি না সাথে। তুমি আমায় নিয়ে যাবে।”

“ভালো হচ্ছে না কিন্তু!”

“আমি ভালো কিছু করিইনি! তাহলে ভালো হবে কীভাবে? এতদিন ভালো ছিলাম তোমার তো ভালো লাগল না।”

“আমি কিন্তু চিৎকার করব। লোক জড়ো করব।”

আহনাফ শব্দ করে হাসল। বলল,

“তাই? করো চিৎকার।”

অর্ষা দমে গেল। এই কাজ সে জীবনেও করতে পারবে না। আহনাফের গায়ে কেউ হাত তুলবে এটা তার সহ্য হবে? অর্ষার চুপসে যাওয়া মুখ দেখে আহনাফ কিছুটা এগিয়ে গেল। সোডিয়াম লাইটের হলদে আলোয় অর্ষার মুখপানে দৃষ্টিপাত করে মিহিস্বরে বলল,

“কী হলো? এখন চুপ করে আছো যে? করো চিৎকার। লোক জড়ো হোক। আমিও তখন চিৎকার করে বলব,’হে ধরণীর মানুষগণ, আপনারা সবাই শুনে রাখুন, আমি এই রাগী, মিষ্টি মেয়েটাকে ভালোবাসি। এই রাগিণী আমার, শুধু আমার।’ নাও, নাও এবার চিৎকার শুরু করো। দেরি কোরো না।”

অর্ষা গোমড়ামুখে ওড়না থেকে আহনাফের হাত মুক্ত করতে গেলে আহনাফ বাঁধা দেয়। হাতের বাঁধন খুলতে দেয় না। উলটো অর্ষার ডান হাতের আঙুলের মাঝে নিজের বামহাতের আঙুল মিশিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে। ফিসফিস করে বলে,

“এই হাত ছাড়ার জন্য ধরিনি বাটারফ্লাই। চলো হাঁটি। সুন্দর রাত্রীকে সাক্ষী রেখে পথচলা আরম্ভ করি।”

চলবে…#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_টু
#পর্ব_২৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
সারা রাস্তা আহনাফ অর্ষার হাত ছাড়েনি। রিকশায় বসেও না। অর্ষা জানে জোরজবরদস্তিতে সে পারবে না আহনাফের সঙ্গে। তাই সেই বৃথা চেষ্টাও করেনি। বাড়ির সামনে এসে আহনাফ বলে,

“একসাথে দুজনের এটাই যেন শেষ পথচলা না হয়। এরপরের প্রতিটা পথচলা একসাথে হোক এটাই চাই।”

অর্ষা দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনল। তবে কিছু বলল না। অন্ধকারেই মৃদু হেসে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। মেইন দরজা লাগিয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখল সকাল বারান্দায় বসে আছে।

“কিরে লাইট অফ করে এখানে বসে আছিস কেন?” এগিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল অর্ষা।

সকাল দৌঁড়ে এসে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে। পাগলের মতো কাঁদছে সে। অর্ষা বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। সকালকে ছাড়িয়ে দু’গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে,

“কী হয়েছে সোনা? কাঁদছিস কেন তুই?”

সকাল কান্নার দমকে কথা বলতে পারছে না। তার শরীর কাঁপছে। ভেতরে ভেতরে অর্ষাও ভীষণ ভয় পাচ্ছিল। সে সকালকে ধরে নিয়ে বারান্দায় বসাল। দৌঁড়ে গিয়ে ভেতর থেকে এক গ্লাস পানি এনে সকালকে খাইয়ে দিল। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“কাঁদে না লক্ষী! বল আমায় কী হয়েছে? আব্বা, মা কোথায়?”

সকাল তখনও ফোঁপাচ্ছিল। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়েই বলল,

“বাবার অবস্থা অনেক খারাপ আপু। আবারও র’ক্তবমি করেছে। তোকে কতবার ফোন করেছি আমরা। কেন রিসিভ করিসনি?”

অর্ষার যেন পাগল পাগল অবস্থা। বাবার চিন্তায় জীবন বেরিয়ে যাচ্ছে তার। তড়িঘড়ি করে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে সে। কাজের জন্য বেশিরভাগ সময় অফিসে ফোন ভাইব্রেট করে রাখে সে। আজ কোন পাগলে ধরেছিল যে সাইলেন্ট করে রেখেছে! নাকি তাড়াহুড়ায় ভাইব্রেট করতে গিয়ে সাইলেন্ট করে ফেলেছে! আননোন নাম্বার থেকেও অনেকগুলো কল এসেছে। ফোনটা আবার ব্যাগে ভরে অর্ষা বলল,

“আব্বা, মা এখন কোথায়?”

“হাসপাতালে। তোফায়েল ভাইয়া এসেছিল। সে-ই নিয়ে গেছে। আমি তোর জন্য থেকে গেছি।”

“হাসপাতালের ঠিকানা জানিস?”

সকাল মাথা ঝাঁকাল। অর্ষা চটজলদি ঘরে তালা দিয়ে সকালকে নিয়ে তক্ষুনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। মনে মনে নিজেকে সে অসংখ্য গালি দিচ্ছে। কাঁদতে চেয়েও কাঁদতে পারছে না। কেন তার বাবার সঙ্গেই বারবার এমন হয়!

হাসপাতালে গিয়ে রিসিপশনে তোফায়েলের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় ওদের। অর্ষা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

“বাবা কোথায়?”

“ভেতরে আছে। তুমি টেনশন কোরো না। এখন তিনি ঠিক আছেন।”

অর্ষা সকালকে নিয়ে ভেতরে গেল। সেলিনা বেগম প্যাসেজ ওয়েতে বসে আছেন। অর্ষাকে দেখেই তিনি গুমড়ে কেঁদে ওঠেন। মাকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দেয় অর্ষা। জীবন যুদ্ধে সে নিজেও হাঁপিয়ে পড়ছে। দুই ঘণ্টা পর অর্ষা ওমর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে যায়। বাবার মলিন মুখ দেখে বুক কেঁপে ওঠে তার। পাশের টুলে বসে বাবার হাতের ওপর হাত রেখে শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“এখন কেমন লাগছে?”

তিনি মিহিস্বরে বললেন,

“ভালো, মা। তোর মুখটা এমন লাগছে কেন? অফিস থেকে এসে খাসনি?”

এতটুকু কথা বলতেই যেন হাঁপিয়ে উঠলেন ওমর রহমান। বড়ো করে শ্বাস নিলেন। অর্ষা বাবার বুকে হাত বুলিয়ে বলল,

“কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে? তাহলে কথা বোলো না।”

সেলিনা বেগম তখনও স্বামীর মাথার কাছে বসে কেঁদে চলেছেন। সকাল বসে আছে বাবার পায়ের কাছে বেডে। বাবা মৃদু হেসে অর্ষার হাতের ওপর হাত রাখলেন। বিমর্ষস্বরে বললেন,

“রুহুলকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।”

অর্ষা হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সেলিনা বেগম কেঁদে বলেন,

“আর রাগ করিস না মা! ওকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিয়ে আয়।”

“ধরে নে শেষবারের মতো কিছু চাইছি তোর কাছে।” বললেন ওমর রহমান।

অর্ষা বলল,

“এভাবে কেন বলছ বাবা? আর তুমি এত কথা বোলো না তো! কষ্ট হচ্ছে তোমার। আর আমি যাব ভাইয়ার কাছে। নিয়ে আসব।”

ওমর রহমানের মলিন মুখ উজ্জ্বল হলো। তিনি মহানন্দে বললেন,

“কাল সকালেই আনবি মা?”

“হ্যাঁ। এখন ঘুমাও তুমি।”

অর্ষা কেবিন থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। রুহুলকে সে ভালোবাসে। তার রক্তের কেউ থাকলে রুহুলই তো আছে। তার ভাই! কিন্তু সে মানুষ হিসেবে অর্ষার একদমই পছন্দ নয়। যারা এত কষ্ট করে ছোটো থেকে বড়ো করেছে তাদের থেকে কী করে রুহুল মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে? মানুষ দুটো বিনাস্বার্থে পাগলের মতো ভালোবাসে। অথচ সে এসবের যোগ্যই না। বিতৃষ্ণায় মুখ তেঁতো হয়ে আসে অর্ষার। রাতটা পার হলেই সে রুহুলের কাছে যাবে। তোফায়েলের থেকে ঠিকানা নিতে হবে তার আগে।

সেই রাতে কেউই ওরা বাসায় যায়নি। সকাল ন’টা নাগাদ তোফায়েলের বলা ঠিকানায় যাওয়ার জন্য বের হয় অর্ষা। অফিসে মিজানকে ফোন করে তার বাবার অসুস্থতার কথা জানিয়ে দিয়েছে। কয়েকদিন যেতে পারবে না অফিসে এটাও জানিয়েছে। মিজান কোনো দ্বিমত করেনি কিংবা আপত্তিও করেনি। বাবার খেয়াল রাখতে বলেছে।
.
.
অনেকদিন পর অর্ষাকে দেখে খুশি হলো রুহুল। সে এখন মাস্তান বনে গেছে। রাজনীতিও করে। অর্ষাকে বসিয়ে সাঙ্গপাঙ্গকে খাবার আনতে পাঠায়। খুব তোড়জোড় করে জানতে চায়,

“কী খাবি বল?”

অর্ষা চারদিকে তাকিয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিল। রুহুলের প্রশ্ন শুনে গম্ভীর হয়ে বলল,

“কিছু খাব না।”

“কিছু খাবি না মানে? তুই আমার কাছে এসেছিস এতদিন পর। আমি তোকে না খাইয়ে রাখব?”

“এতদিনে তো একটাবারও খোঁজ নিয়ে দেখোনি আমি খেয়ে আছি নাকি না খেয়ে ম’রে গেছি।”

রুহুল কিছুটা দমে গেল। পরক্ষণেই বলল,

“তোর তো ফুসকা পছন্দ। ফুসকা আনতে বলি।”

বলেই সে ছেলেগুলোকে বলল,

“নাস্তা আনবি আর ফুসকা আনবি যা।”

দুজন চলে গেল নাস্তা আনতে। এখনও ভেতরে পাঁচজন আছে। রুহুল ওদেরকেও বলল,

“তোরা নিচে গিয়ে অপেক্ষা কর।”

ওরা চলে গেল। রুহুল এবার অর্ষাকে বলল,

“এতদিন পর ভাইয়ের কথা মনে হলো?”

অর্ষা কোনোরকম ভনিতা না করেই বলল,

“আমি তোমাকে নিতে এসেছি।”

রুহুল অবাক হয়ে বলল,

“কোথায়? বাসায়?”

“হ্যাঁ। বাবার শরীরটা ভালো না। অসুস্থ খুব। এখন হাসপাতালে আছে।”

“জানি।”

“জানার পরও একটাবার গেলে না? এতটা নিষ্ঠুর তুমি!”

রুহুল সিগারেট ধরাতে গিয়েও অর্ষার জন্য ধরাল না। অর্ষার প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বলল,

”ঠিক আছে, যাব। তবে এক শর্তে।”

”কী শর্ত?”

”বলছি। তার আগে বল, আগের তুলনায় আমায় এখন কেমন দেখলি?”

”ভালো কিছুই দেখলাম না। বরং খারাপটাই নজরে এলো। পার্থক্য যদি বলতে হয় তাহলে বলা লাগে, শুধু বেকারত্ব আর ভবঘুরে স্বভাবটাই নেই। রাজনীতি করে, নেতাদের গোলামী করে ইতিমধ্যে মাস্তান বনেও গেছ।”

অর্ষার স্পষ্ট অপমানেও রুহুল হাসল। আগের মতো রাগারাগি করল না। অনেকদিন পর সে বোনকে কাছে পেয়েছে। নিজে থেকে এসেছে বাড়িতে। ভুল করেও বোনকে সে এখন আঘাত দিতে চায় না। মুচকি হেসে বলল,

”তা অবশ্য ঠিক বলেছিস। কিন্তু যেটাই হোক, এই অবস্থানটা কিন্তু এমনি এমনি হয়নি। বেকারত্ব বলিস, ভবঘুরে স্বভাব বলিস সেটাও এমনি এমনি দূর হয়নি। আগে মানুষজন আমাকে পাত্তা দিত না। কিন্তু এখন আমার আন্ডারেই কত ছেলেপুলে রয়েছে। ওরা আমার কথায় উঠে, বসে। এসবকিছুর পেছনে আমার বন্ধু তোফায়েলের অবদান রয়েছে।”

”ওহ আচ্ছা! পেছন থেকে তাহলে কলকাঠি সে নেড়েছে।”

”তোফায়েল আমার বন্ধু হলেও আমার মতো নয় অর্ষা। ও অনেক ভালো একটা ছেলে। ওর জন্যই আজ আমি খেয়ে, পড়ে ভালো আছি।”

”তাই? বাবা-মায়ের কোনো অবদান নেই তোমার জীবনে?”

”বাবা-মায়ের অবদান আমি অস্বীকার করছি না। একটা সময় পর্যন্ত তারা আমায় দেখেছে, লালন-পালন করেছে এ সবটাই আমি মানি। স্বীকার করি। তবে তারা আমার প্রয়োজন পূরণ করতে পারেনি, যেটা তোফায়েল করেছে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর ও-ই আমাকে জায়গা দিয়েছে। ওর বাবাকে বলিয়ে রাজনীতিতে নাম দিয়েছে। সুন্দর একটা জীবন পেয়েছি আমি।”

অর্ষা তাচ্ছিল্য করে হাসল। বলল,

”বেশ। ভালো লাগল শুনে। এখন আমি তোমার কাছে এসেছি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বাবা-মায়ের কান্নাকাটি আর সহ্য করা যাচ্ছে না।”

”বললাম তো যাব। তোর কথা রাখব যদি তুই আমার শর্ত মানিস।”

”নিজের বাড়িতে ফিরে যাবে এর জন্য আবার বোনকে শর্তও দিচ্ছ? না, না ঘাবড়ানোর কিছু নেই। তোমার কাছ থেকে এসব আশা করা যেতেই পারে। বলো শুনি এবার শর্ত কী?”

”শর্তটা হচ্ছে তোফায়েলকে তোর বিয়ে করতে হবে।”

”মানে!”

”হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছিস। তোফায়েল তোকে অনেক বেশি পছন্দ করে। তোকে বিয়ে করতে চায়। কথাটা অনেক আগেই আমায় বলেছিল, কিন্তু তখন তোর সাথে আমার সম্পর্ক ভালো ছিল না। তুই আমার কথা শুনতি না বলে তোকে বলাও হয়নি।”

অর্ষা শ্লেষাত্মক কণ্ঠে বলল,

”তাই এখন সুযোগ পেয়ে সুযোগের সদ্ব্যবহার করছ?”

”খারাপ কিছু তো করছি না অর্ষা। তোফায়েল ভালো একটা ছেলে। শিক্ষিত, সুদর্শন। ও যে তোকে বিয়ে করতে চেয়েছে এটা তোর ভাগ্য।”

”তুমি যে নিজ স্বার্থ হাসিল করার জন্য বোনকে কু’র’বা’নি দিতে প্রস্তুত এটা আমার দুর্ভাগ্য!”

“আমি তোর খারাপ চাই না। তোফায়েল যথেষ্ট ভালো। তোকে সুখে রাখবে।”

“আমার ভালো চাইছ নাকি বন্ধুর ঋণ শোধ করতে চাইছ?”

রুহুল নিরুত্তর। অর্ষা নিজেই বলল,

“আমি যদি তোমার শর্ত না মানি, তাহলে তুমি ফিরবে না?”

”না।”

অর্ষা অনেকক্ষণ যাবৎ নিরব রইল। এই মুহূর্তে তার আহনাফের কথাই কেন সবার আগে মনে পড়ছে? কেন তার মুখটাই চোখের সামনে ভেসে উঠছে? উহ্! বুকের ভেতরটায়ও অসহ্য চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়েছে। এত কেন কষ্ট হচ্ছে তার? পরক্ষণেই বাবার অসুস্থ মুখটা চোখের দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে। মায়ের কান্নার সুর কানে বাজছে। অর্ষা বড়ো করে শ্বাস নিল। দু’হাতে চুলগুলো ঠিক করে নড়েচড়ে বসে বলল,

”বেশ! তুমি নিমকহারাম হতে পারো কিন্তু আমি নই! আমি বাবা-মাকে ভালোবাসি। শুধুমাত্র তাদের কথা ভেবেই আমি নিজেকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। তোমার শর্তে আমি রাজি।”

খুশিতে চোখ-মুখ চকচক করে ওঠে রুহুলের। সে অর্ষার এক হাত ধরে বলে,

”সত্যি বলছিস? আমি ভীষণ খুশি হয়েছি কলিজা। এখন হয়তো তুই আমাকে ভুল বুঝছিস। কিন্তু বিয়ের পর বুঝবি ভাইয়া তোর খারাপ চাইনি।”

অর্ষা তাচ্ছিল্য করে হাসল। রুহুলের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,

”তখন তোমায় যেন আফসোস না করতে হয়!”

চলবে…

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here