#রংধনুর_মিল
#পর্বঃ০৩
#মাহিয়া_মুন
“মাত্র পাঁচদিনের জন্য বাবার সাথে ঢাকা গেলাম আর এর মাঝে এতো কিছু হয়ে গেল। এখন এসে কিনা তোকে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা অবস্হায় দেখতে হচ্ছে। মোবাইল তো ছিলো, এরকম কিছু করার আগে অন্তত আমাকে এবং তাকিয়াকে জানাতে পারতি। বলতি নাহ কেন আমরা তোকে গা*ধী ডাকি, এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস।”
আবিদের কড়া কথায় নুজহাত ডুকরে কেঁদে উঠলো। আবিদের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নিজ মনে পুনরায় কাঁদতে লাগলো।
আবিদ নুজহাতের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। পূর্ণ এবং নুজহাতের প্রণয়ের তিন মাস শেষ হওয়ার দিন বিকেলেই সে তার বাবার সাথে ঢাকা গিয়েছিল। আরও কিছুদিন পরই আসার কথা ছিল। কিন্তু এর মাঝে নুজহাত এর সাথে পূর্নের সম্পর্কের কথা দু পরিবারেই জানাজানি হয়ে গেছে। যার ফলে নুজহাতের বাবা মা নুজহাত কে অনেক বকাবকি, মারধোর করেছিল। যা সইতে না পেরে গতকাল ফিনাইল খেয়ে ফেলেছে আবেগী মেয়েটা। এসকল ঘটনা আবিদ এবং তাকিয়ার পরিবারেও জানাজানি হয়ে যায়। ফলে দুজনকেই নানানরকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। গতকাল বিকেলে নুজহাত ফিনাইল খাওয়ার পর তার বাবা মা দেখে ফেলে। তারা দ্রুত হাসপাতাল নিয়ে আসার ফলে খুব একটা ক্ষতি হয় নি। এই ঘটনা আবিদের কানে যেতেই একাই ঢাকা থেকে বাড়িতে চলে আসে।
আবিদ নুজহাতের পাশে দাড়িয়ে পাশ থেকে নুজহাতকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। গতকাল খবরটা শুনা মাত্র খুবই ভয় পেয়েছে। এই প্রথম ঢাকা থেকে একা ফিরেছে। তবে সেই ভয় তাকে একদমই কাবু করতে পারে নি। করবেই বা কি করে, মনের মাঝে যে ছিলো নুজহাতকে নিয়ে ভয়। এই মুহুর্তে আবিদের ইচ্ছে করছে থাপড়ে নুজহাতের গাল লাল করে দিতে। ভয় কেটে এখন মাথায় রাগ চেপে বসেছে তার। ভাগ্য ভালো তাই খুব একটা ক্ষতি হয় নি, যদি হয়ে যেত।
আবিদের এখন নিজের উপরই রাগ লাগছে। নুজহাত নাহয় আবেগী, কিন্তু সেতো পারতো আটকাতে। এভাবে প্রশ্রয় দেয়াটা একদমই ঠিক হয় নি।
“তুই ভেবে দেখ তো নুজু, তুই ঠিক কতটা ভয়ংকর কাজ করেছিস। আল্লাহ্ বাঁচিয়েছে বলে। আমাদের ভালোবাসা কি কিছুই নাহ তোর কাছে। একটা ছেলের জন্যে আমাদের সবাইকে কষ্ট দিতে চেয়েছিলি।”
আবিদ শান্ত ভঙ্গিতে নুজহাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কথাগুলো বলে উঠলো।
নুজহাত কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো,
“আমি কি করতাম। এমনিতেই পূর্ণ আমাকে কতটা কষ্ট দিয়েছে। তার উপর আব্বু আম্মু আমাকে যা নয় তাই বলছিলো আমাকে।”
“আচ্ছা,আচ্ছা শান্ত হ। আমাকে প্রথম থেকে বল তো আমি যাওয়ার পর ঠিক কি কি হয়েছে। আমিতো সবটাই ঠিক আগের মতই দেখে গেলাম।”
নুজহাত কান্না থামিয়ে অতীতে ডুব দিল।
*************
সন্ধায় হালকা নাস্তা সেরে মাত্রই পড়তে বসেছে নুজহাত। পরিবারের সবাই ড্রয়িং রুমে বসে আছে। পাশের বাসার আন্টির সাথে গল্পে মশগুল।
পড়ার মাঝেই হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই ভ্রু কুঁচকে গেল নুজহাতের। কারণ স্ক্রিনে পূর্নের নাম দেখা যাচ্ছে। এই সময়ে কখনোই পূর্ণ ফোন দেয় নাহ। কারন এই সময়ে সেও বাসায় থাকে। তাদের সম্পর্কের কথা পূর্নের বাড়িতেও কেউ জানে না।
ভাবনার গভীরে না গিয়ে একবার ড্রয়িং রুমে উকি দিয়ে ফোন রিসিভ করে কানে ধরলো।
“কি হলো পূর্ণ, এই অসময়ে হঠাৎ ফোন দিলে।”
“কিছু কথা ছিল যা এখনই বলতে হতো।”
“আজ সকালেই তো আমরা দেখা করলাম। তখনও বলতে পারতে। যাই হোক, তাড়াতাড়ি বলো। আম্মু যে কোনো সময়ে রুমে চলে আসবে।”
“আসলে, আসলে আমি আর তোমার সাথে সম্পর্ক টা রাখতে পারবো নাহ।”
নুজহাত চমকালো, ভীষণ ভাবে চমকালো। কি বলছে এই ছেলে।
“এই জন্যে তুমি এসময় ফোন দিছো। দেখো আমি একদমই মজা করার মুডে নেই।”
“আমি মজা করছি নাহ নুজহাত। আমি সত্যিই বলছি। আমার তোমার সাথে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া আর সম্ভব নয়।”
পুর্নের কথা শুনে নুজহাতেরও মনে হলো না যে পূর্ণ মজা করছে। সবকিছু খাপছাড়া লাগছে যেন হঠাৎ।
“মানে, তোমার মাথা ঠিক আছে। কি বলছো এসব। আচ্ছা এটা বলো, আমি কি কোনও অন্যায় করেছি। তোমার অপছন্দনীয় কোনো কাজ করেছি। আমায় বলো আমি শুধরে নিবো। সম্পর্ক রাখা যাবে নাহ মানি। প্রতিদিনের মতোই আজ সকালেও আমরা দেখা করে এসেছি। আজ সম্পর্কের তিন মাস পূর্ণ হয়েছে বলে আমরা কতো জায়গায় ঘুরলাম। আর এখন তুমি বলছো সম্পর্ক রাখা যাবে নাহ।”
“হ্যা রাখা যাবে নাহ। যেটা সঠিক সেটাই বলছি। আজ তোমার সাথে আমাকে বাবা দেখে নিয়েছে। বাসায় এসে অনেক বকাবকি করেছে, মেরেছে। সেই সাথে আমাকে সবটা বুঝিয়েছে। আমি ভেবে দেখলাম যে তারা ঠিকই বলেছে। এই বয়সে আমাদের কোনরকম সম্পর্কে জড়ানো একদমই ঠিক নয়। আমাদের এখনও আবেগের বয়স। আবেগের বশবর্তী হয়ে পরে না আবার পস্তাতে হয়। এখনও পুরো জীবনটাই পরে আছে। তাই সিদ্বান্ত নিয়েছি আর এসবের মধ্যে নিজেকে জড়াচ্ছি না। তুমিও আমাকে ভুলে যাও। মাত্রই তো তিন মাস। এটা এমন কিছু নাহ্।”
“মানে, এটা কি ছেলেখেলা নাকি। তোমার ইচ্ছে হলো আমার জীবনে আসলে আবার ইচ্ছে হচ্ছে চলে যাচ্ছো। যখন আমার পিছনে পিছনে ছুটেছিলে তখন এসব কথা মাথায় আসে নি। আর আমি একজন মেয়ে হয়ে পরিবারের চোখ ফাঁকি দিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে পারি তাহলে তুমি কেন পারবে নাহ।”
“পরিবারের কথা আসছে কেন এখানে। তোমাকে তো বললাম যে আমি নিজেই চাইছি নাহ্ সম্পর্ক টা এগিয়ে নিতে।”
“দেখো তুমি এরকম করতে পারো না আমার সাথে। আচ্ছা ঠিক আছে। আমরা নাহয় আগের তুলনায় কম দেখা সাক্ষাৎ করি। পড়ালেখার প্রতি আরো বেশি মনোযোগী হই। ”
“তোমাকে এক কথা কতবার বলবো। যাই হোক, আর আমায় ফোন, মেসেজ দিও না। যত ভুলে থাকতে পারি ততোই ভালো।”
এই বলে পূর্ণ কল কেটে দিলো। নুজহাত অবাক পানে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে রইলো। মাত্র কিছু সময়ের মধ্যে কি থেকে কি হয়ে গেল কিছুই যেন মাথায় ঢুকছে নাহ। বোধ হতেই পূনরায় পূর্নের নম্বর এ কল দিল। কল দিতেই যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো। কারণ পূর্ণ তাকে এই কিছু সময়ের ব্যবধানে ব্লকও করে দিয়েছে। চুল খামচে ধরে বিছানায় বসে পড়লো। বুক ফেটে কান্না আসছে। তবে তা যেন গলায় বেঁধে যাচ্ছে। ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে। জীবনের প্রথম ভালোবাসা, প্রথম আবেগ। আজ বিকেলেও দুজন চ্যাটিং করেছিল। সকালটা কতটা রঙিন কেটেছিল। সবটা এতো সহজে শেষ হয়ে গেল।
আবিদকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। আবিদ মলিন মুখে তাকিয়ে রইলো নুজহাতের কান্না মাখা মুখের দিকে।
কিছুক্ষন এভাবে যেতেই আবিদ বলে উঠলো,
“তারপর কি হয়েছে। আন্টি আংকেল কীভাবে জানলো এসব।”
নুজহাত চোখের পানি মুছে বলে উঠলো,
“তুই তো জানিস পূর্ণ আমায় বাসা পর্যন্ত সবসময় এগিয়ে দিয়ে আসতো। একদিন রান্না ঘর থেকে আম্মু দেখে ফেলে। আমায় জিজ্ঞেস করতেই আমি বলেছিলাম আমি ছেলেটাকে চিনি নাহ। আম্মু যে বিশ্বাস করে নি তা বেশ বুঝেছিলাম। কারণ পূর্নের দিকে তাকিয়ে আমায় হাসতে দেখেছিল। আমিও আর বেশি কিছু বলি নি আম্মুকে। পূর্নের সাথে সম্পর্ক ভাঙার তিন দিন পর পূর্ণ আমায় মেসেজ দিয়েছিলো। তখন বাবাও বাসায় ছিল। আমি নিজেকে দমিয়ে রাখতে না পেরে পূর্নের সাথে মেসেজ করতে ওয়াশ রুমে ঢুকে পরি। ভুলে ফোন সাইলেন্ট করতেও মনে ছিলো নাহ। ওয়াশ রুমে ঢুকতেই পূর্ণ কল দেয়। যার সাউন্ড বাবার কানেও যায়। আর এভাবেই ধরা পড়ে যাই। সেদিন বাবা খুব মেরেছিল। আর তার পর থেকেই আম্মু যা নয় তাই বলে যাচ্ছে আমায়। সামনে দেখলেই নানান রকম কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। তাই গতকাল সন্ধ্যায় রেগে ফিনাইল খেয়ে ফেলেছি। মরে গেলেই ভালো হতো।”
আবিদ দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
“আচ্ছা এত মরার সখ। ফিনাইল খাওয়ার আগে আমায় বলতে পারতি। আমি একদম ভেজাল হীন ইঁদুর মারার ওষুধ নিয়ে আসতাম ঢাকা থেকে। যেহেতু প্রতিবারই ঢাকা গেলে কিছু না কিছু আনতে হয় তোর জন্যে।”
“এভাবে বলছিস কেন, জানিস আমার কতো কষ্ট হয়েছে।”
“উলে খুকু লে, খাওয়ার আগে খেয়াল ছিলো না বুঝি। ইচ্ছে তো করছে মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলি তোকে। তোর জন্যে বাসায় কতরকম কথা শুনতে হয়েছে আমাকে আর তাকু কে জানিস। আমরা নাকি তোকে প্রশ্রয় দিয়েছি। তারা তো আর জানে নাহ তুই যে কতো বড় গা*ধী। এর পর আর ওই পূর্নের নাম মুখে নিস। জিহ্বা কেটে ফেলব তোর।”
আবিদ কে রেগে যেতে দেখে নুজহাত আর কিছু বললো নাহ্। চুপকরে শুয়ে পড়ল।
নুজহাত কে রাগ দেখালেও কিছুটা খুশিই লাগছে আবিদের কাছে। কারণ এখন আর পূর্ণ কে নুজহাতের সাথে দেখতে হবে নাহ্। নুজহাত কে মনের কথা না বললেই বা কি, নিজের মন কে তো সান্তনা দিতে পারবে যে তার নুজহাত তারই আছে।
*
*
*
#চলবে