রংধনুর মিল পর্ব -০৪

#রংধনুর_মিল
#পর্বঃ০৪
#মাহিয়া_মুন

সময় পেরিয়ে যায় নিজ ছন্দে। সেই তালে বইতে থাকে মানুষের জীবনযাত্রা। ওইযে একটি গান আছে নাহ,
” এ কূল ভাঙে ওই কূল গড়ে, নদীর কি আসে যায়,,,,,,,,
যার ভিটা যায় সেইতো কান্দে, বইসা নদীর কিনারায়,,,”
ঠিক তাই। কারও জীবন মুড়িয়ে থাকে সুখে আবার কারও জীবন মুড়িয়ে থাকে দুঃখে। কেউ বা আবার নিজের অতীত ভুলে নিজেকে নতুন ভাবে রাঙানোর তাড়নায় থাকে।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে নিজেকে আপনমনে সাজিয়ে চলছে এক শ্যামাজ্ঞী রমণী। শরীরে জড়িয়ে আছে কালো শাড়ী, খোঁপায় আবৃত লাল গোলাপ। যার পায়ে শোভা পেয়েছে পায়েল। হাত নাড়ানোর ফলে রিনিঝিনি চুড়ির শব্দে মুখরিত হচ্ছে চারিপাশ। ঠিক চারিপাশ নয়, কারও মনের অন্দরমহল। সে যেনো ডুবে যাচ্ছে সামনে সাঁঝ রত রমণীর ওই মায়াবী চক্ষুদ্বয়ের অতল গহীনে। নিস্পলক তাকিয়ে রইলো কাজলে আবৃত চোখ গুলোর দিকে।
এভাবে ঠিক কত মুহূর্ত কেটেছে জানা নেই ছেলেটির। চোখের সামনে কারও চুটকি বাজানোর ফলে ধ্যান ভাঙে ছেলেটির। সামনে তাকাতেই দেখে তার রমণী টি ঠিক তার সামনেই কোমড়ে হাত দিয়ে সরু চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে তাকাতেই রমণী রেগে আগুন হয়ে বলে উঠলো,
“কখন থেকে ডাকছি তোকে। এভাবে বোকার মতো হা করে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছিস কেন?”
ছেলেটি মাথা চুলকে জোরপূর্বক হেসে বলে উঠলো,
“ওই,,,তো তুই ঠিক মত তৈরী হয়েছি কিনা সেটাই দেখছিলাম।”
রমণীটি মুচকি হেসে বলে উঠলো,
“আচ্ছা এখন বলতো সব ঠিকঠাক হয়েছে কিনা। কি যেন দেইনি মনে হচ্ছে। কিন্তু বুঝতে পারছি না। তুই একটু বলতো।”
ছেলেটি রমণী টিকে আপাদমস্তক ভালোভাবে দেখে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে কিছু একটা খুঁজে হাতে নিয়ে পুনরায় রমণীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রমনীর কপালে হাতে থাকা ছোটো কালো টিপ টি পরিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
“টিপ দিতেই মনে ছিলো নাহ ম্যাডাম আপনার।”
“ওহ্ হ্যা। দেখলি কিভাবে ভুলে গেলাম। ওই পে*ত্নী এখনও আসছে নাহ কেন।”
“ওর বাবা ওকে কলেজের সামনে নামিয়ে দিয়ে আসবে। তাই ওকে ছাড়াই আমাদের যেতে হবে।”
“ওহ্ আচ্ছা চল তাহলে বেড়িয়ে পরি। আমার তো খুব ভালো লাগছে, নবীন বরণ অনুষ্ঠান বলে কথা।”
ছেলেটি কড়া কণ্ঠে বলে উঠলো,
“দিন দিন হাতে পায়েই বড় হয়েছিস। শোন, আজ নবীন বরণে সিনিয়র ভাইয়ারা আমাদের ফুল দিবে। বিশেষ করে রাফির দল। যেটাকে কলেজে সবাই ডানপিঠে দল বলে। এরা অনেক কে র্যাগ করে। তৃতীয় বর্ষের ছাত্র তারা। আমরা এই সাতদিন তাদের পাই নি কারণ কোনও এক কাজে তারা কেউ ই কলেজে ছিলো নাহ্। যেটা আমাদের নবীন দের জন্যে খুব ভালো হয়েছে। তবে মনে হচ্ছে এখন থেকে তারা তাদের মিশন শুরু করে দিবে। তাই দয়া করে আমার সাথে সাথেই থাকিস। কলেজ গেলে তো তুই আর তাকিয়া হাওয়া হয়ে যাস।”
রমণী মুখ গোমড়া করে বলে উঠলো,
“তুই সবসময় আমাকে বকিস। আমি কিন্তু এখন ছোটো নই। অনার্স প্রথম বর্ষে এখন আমি।”
“হ্যা বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। বিয়ে করবি।”
“যাহ সর,,,,”
এই বলে রমণী রেগে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। ছেলেটি নিজেই নিজের কপাল চাপড়ে মেয়েটির পিছু নিলো।

ঠিক ধরেছেন। এরা দুজন আর কেউ নয়। আবিদ এবং নুজহাত। সময়ের তালে তালে পেড়িয়ে গেছে প্রায় চার চারটি বছর। তবে এদের তিন জনের বন্ধুত্ব রয়ে গেছে অটুট। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রেখেছে তিনজন।কিছুদিন আগেই তিন জন অনার্স প্রথম বর্ষে একই কলেজে চান্স পায়। অবশ্য তারা তিন জন আগে থেকেই নিশ্চিত ছিলো। ভরসা যে অনেক।

রিক্সা চলছে পুরোদমে। আবিদ এবং নুজহাত দুজন পাশাপাশি বসে আছে। আবিদ নুজহাতের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে এক মনে আঙুল নিয়ে খেলে যাচ্ছে। এই সুযোগটা সে খুব কমই পায়। এইভাবে পাশাপাশি রিক্সায় বসার সুযোগটা সে খুব কমই পায়। কারণ তাকিয়া এবং নুজহাত এক সাথে বসলে তাকে রিক্সাওয়ালা মামার পাশেই বসতে হয়।
নুজহাত কিছুক্ষন আবিদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো,
“এবার একটা রিলেশন কর। আমরাও একটা ভাবি পাই।”
আবিদ হঠাৎ দুষ্টু হেসে বলে উঠলো,
“বউ থাকতে আবার কিসের রিলেশন। ছি তুই এই কথা বলতে পারলি।”
নুজহাত আবিদের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে উঠলো,
“কিসের বউ, কই বউ?”
“এমা তুই জানিস নাহ। মেয়ে বন্ধু মানেই তো অর্ধেক বউ। তুই যদি কিছু মনে না করিস তাহলে পুরোপুরি ভাবে বউ বানাতে কিন্তু আমার কোনো আপত্তি নেই।”
নুজহাত আবিদের বাহুতে মারতে মারতে হেসে উঠলো।
হাসতে হাসতে এক পর্যায়ে হাসি মুখ বিলীন হয়ে গেলো। একটি ছেলের নজর যে সে বুঝেনা এখন তা কিন্তু নয়। আবিদ কে এখন তার অন্যরকম লাগে। মন বলে আবিদ তাকে অন্য নজরে দেখে। তবে এটা যে সম্ভব নয়। এমন না যে নুজহাত জীবনে আর কাউকে চাইছে নাহ। সে চায় পূনরায় তার জীবনে কেউ আসুক। তাকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে দিক। তবে সেই ব্যক্তির জায়গায় আবিদকে একদমই বসাতে পারে নাহ নুজহাত। আবিদকে একজন ভালো বন্ধু হিসেবেই সে দেখে এসেছে এবং বন্ধু হিসেবেই পাশে চায়। এর থেকে বেশি কিছু ভাবা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
রিক্সা কলেজের সামনে এসে থামতেই দুজন রিক্সা থেকে নেমে পরে। আবিদ ভাড়া মিটিয়ে নুজহাতকে নিয়ে এগোতেই দেখতে পেলো অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। নবীনদের ফুল দিয়ে বরণ করে নিচ্ছে ডানপিঠে দল অর্থাৎ রাফির দল। আশেপাশে তাকাতেই তাকিয়াকে নজরে আসলো।
তাকিয়া ওদের দেখতেই দ্রুত সামনে এসে দাঁড়ালো। কপট রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো,
“এই তোদের আসার সময় হয়েছে।”
নুজহাত দ্রুত বলে উঠলো,
“সব দোষ আবিদের।”
আবিদ সরু চোখে তাকালো নুজহাতের দিকে। কি সুন্দর তার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়েছে। এরকমটাই করে এসেছে সব সময়।
তাকিয়া মুখ বাকা করে বলে উঠলো,
“হুম জানিতো কে দোষ করেছে। এখন চল ওদের হাত থেকে ফুল নিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসি। তোদের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার পা ব্যাথা হয়ে গেছে।”
এই বলে তিনজন গেট দিয়ে ভীতরে ঢুকে সিনিয়র দের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। একে একে আবিদ এবং তাকিয়া ফুল নিয়ে সামনে এগোতেই নুজহাত ফুল নেওয়ার জন্যে হাত বাড়ায়। তবে কার হাত থেকে ফুলটি নিচ্ছে সেটা দেখার প্রয়োজন বোধ করে নাহ। ছেলেটি ফুল দিতে গিয়েও নিজের হাত গুটিয়ে ফেলে। এতে নুজহাত কিছুটা অবাক হয়। অবাক চোখে ছেলেটির মুখের দিকে তাকাতেই কিছুটা চমকায়। এই ছেলে, এই ছেলে এখানে কেন।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিও একই ভাবে অবাক চোখে নুজহাতের দিকে তাকিয়ে আছে। এ সে কাকে দেখছে। এই সেই মায়াবী চোখ। এই সেই মায়ায় নিংড়ানো মুখ। এই মেয়ে যে তার চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। এক সাগর মায়ায় ডুবিয়ে দিয়েছে এই মেয়ে তাকে। এভাবে দেখা পাবে কল্পনাতেও ভাবে নি।
ভাবনার মাঝেই ছেলেটির হাত থেকে গোলাপ টি নিচে পরে যায়। নুজহাত তা লক্ষ্য করে কিছুটা বিরক্ত হয়, সেই সাথে অপমানবোধ। তবে সিনিয়র ভেবে কিছু না বলে নিচে ঝুঁকে গোলাপটি নেওয়ার জন্য। ঠিক সেই মুহুর্তেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিও নিচে ঝুঁকে। যার ফলে দুজনেই দুজনের মাথায় বারি খায়। কপালে হাত দিয়ে বিরক্ত চোখে ছেলেটির দিকে তাকায় নুজহাত। ছেলেটি দ্রুত ফুলটি হাতে নিয়ে বলে উঠলো,
“সরি সরি আসলে আমি খেয়াল করি নি। ইস খুব কি বেশি লেগেছে। আচ্ছা দাঁড়াও আমি বরফ নিয়ে আসছি।”
“নাহ্ নাহ লাগবে নাহ। আমি ঠিক আছি।”
এই বলে নুজহাত ছেলেটির হাত থেকে জোরপূর্বক গোলাপ টি নিয়ে আবিদ দের কাছে চলে যায়।

*
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here