#রঙধনুর_রঙ_কালো-৯(শেষ পর্ব)
****************************
হ্যালো মা, শুনতে পাচ্ছো? আমি মিলা,, মিলা ।
বললাম তো মিলা নামে আমার কোনো মেয়ে নাই । আমার দুই মেয়ে, তিনা আর ইলা ।
মা তুমি এভাবে কথা বলোনা আমার সাথে । আমি খুব কষ্টে আছি মা । প্লিজ তুমি একটু ভালোভাবে কথা বলো আমার সাথে । প্লিজ মা ।
আমিনা বেগম ফোন রেখে দেন । সাথে সাথে আবারও ফোন আসে ।
হ্যালো, আপনি কী বুঝতে পারছেন না কী বলছি ? কেন বিরক্ত করছেন বার বার?
মা, মাগো একটু নরম হও । আমার সাথে একটু কথা বল মা । মা, আমি মাফ চাই তোমাদের সবার কাছে । আমি সবার কাছে যেয়ে হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে নেবো তবু তুমি আমার সাথে কথা বল মা । এতো নিষ্ঠুর হয়ে যেও না ।
আমাকে নিষ্ঠুর বলিস! এতোবড় তোর সাহস? আমি তোর চেয়ে নিষ্ঠুর? তোর মতো কুলাঙ্গারের সাথে কথা বলতে আমার ঘেন্না হয় । তুই ফোন করবি না আমাকে খবরদার ।
আমি মাফ চাই মা । কথা বলার সুযোগ দাও একবার ।
তুই যার যার অপরাধী তাদের কাছে মাফ চা । তুই যাদের জীবন নরক বানিয়েছিস, যাদের রাতের ঘুম নষ্ট করেছিস, চরম অপমান করেছিস যাদের তাদের কাছে মাফ চা । আমাকে ফোন করবি না । তোর সাথে আমার কোনো কথা নাই ।
আজ তিনদিন হলো মিলা রাকা’র বাসায় উঠে এসেছে । রাকা তার স্কুল জীবনের বন্ধু। ওর স্বামী থাকে দেশের বাইরে । মা আর দুই বাচ্চা নিয়ে ও থাকে ঢাকায় । রাকাকে যখন ফোন করলো মিলা, রাকা তাকে প্রথমে কিছু কথা শুনিয়েছিলো কিন্তু মিলা অনেক কান্নাকাটি করায় তাকে বাসায় আসতে বলেছে। মিলা বাসায় এলে রাকা একচোট বকে নিয়েছে ওকে । তারপর আবার ঠিকই জড়িয়ে ধরেছে । মিলা’র মলিন চেহারাটা দেখে খুব কান্না পেলো রাকা’র । এই মিলা কী সেই মিলা! কতো উচ্ছ্বাস আর প্রানবন্ত ছিলো মিলা । আর মিলা-মামুনের প্রেম, সে কী ভোলা যায়? সেই প্রেমও একদিন ফিকে হয়ে যেতে পারে এটা ভেবেই কেমন শিউরে ওঠে রাকা । এ কেমন হিসাব জীবনের!
রাতে খুব হৈ হল্লা হয় রাকা’র বাড়িতে । রাকা কয়েকজন বন্ধুকে ডাকে ওর বাড়িতে তবে সবাইকে নিষেধ করে দেয় মিলাকে কেউ যেন ঐ বিষয়টা নিয়ে প্রশ্ন না করে । সবাই সবার স্মৃতির ঝাঁপি মেলে বসে । কত গল্প, কত কল্পনা ছিলো যেগুলো পূরণ হয়নি । অনেকদিন পর মনটা একটু ভালো হয় মিলা’র । মনে মনে ভীষন কৃতজ্ঞতা জানায় রাকাকে ।
মামুনের মোবাইলে ফোনটা আসে রাত একটায় । যদিও তার ঘুমাতে এতো রাতই হয় সবসময় তবুও ফোনের আওয়াজে ভ্রু কুঁচকে ওঠে । এমন সময়ে ফোন এলে মনটা উৎকন্ঠায় ভরে ওঠে । মনে হয় কোনো প্রিয়জনের বিপদ হলো না তো? মা আছে গ্রামের বাড়িতে । তারা ভাইবোন যতই জোরাজুরি করুক না কেন মা তাঁর বাড়ি থেকে নড়বেন ই না । মা’র কিছু হলো না তো! দুরুদুরু বুকে ফোনটা রিসিভ করে মামুন –
হ্যালো
………..
হ্যালো, কথা বলছেন না কেন? হ্যালো…
লাইনটা কেটে যায় । এক মিনিট পরে আবারো ফোন, সেই একই নাম্বার ।
হ্যালো, হ্যালো, কথা না বললে ফোন করছেন কেন বার বার?
কেমন আছো?
কে বলছেন?
চিনতে পারছো না?
এবার চিনতে পারে মামুন । এ আওয়াজ তার চিরচেনা । কেন আবার তার ফোন? মিলা সাইফের বাড়ি ছেড়ে রাকা’র কাছে এসে উঠেছে এই খবর সে পেয়েছে । ভালমন্দ কোনো অনুভূতি কাজ করেনি খবরটা শুনে । তবে বার বার তার মনে হয়েছে মিলা ফোন করবে । শত ভাবনায় ছেদ পড়ে মিলা’র কথায় –
কেমন আছো?
ভালো ।
বাচ্চারা?
ভালো । আবার কিছুক্ষণ কোনো কথা নেই ।
তুমি জিজ্ঞেস করলে না আমি কেমন আছি?
এতো রাতে ফোন করলে কেন? কিছু বলবে?
সবাই কোথায়, বিনু কোথায়? কোনো সাড়াশব্দ নেই যে কারো?
রাত একটা বাজে । এই সময় এ বাড়িতে সবাই ঘুমায় । তুমি সেটা জানো ।
তুমি জেগে আছো যে?
এমনি ।
তুমি সত্যিই ভালো আছো মামুন?
তুমি কী কিছু বলার জন্য ফোন করেছিলে? আমি এখন শুয়ে পড়বো ।
না, এমনি । ঠিক আছে রাখছি ।
আর কোনো কথা বলে না মামুন, ফোন রেখে দেয় ।
ফোন রেখে মামুন নিজেই খুব অবাক হয়ে যায়! তার মধ্যে কোনো উত্তেজনা কাজ করছে না । এই যে এতোদিন পর মিলা ফোন করলো, তার একদমই কথা বলতে ইচ্ছে হলো না । এতো সহজেই কী মিলা মুছে গেছে তার মন থেকে!
ফোন রেখে মিলা চুপ করে বসে থাকে । যে কথা বলার জন্য ফোন করেছিলো তার কিছুই বলা হলো না । ভেবেছিলো মামুনের কাছে মাফ চাইবে, মামুন বকাঝকা করলে সে বলবে, তোমার যতো খুশী বকা দাও । আমি কিচ্ছু মনে করবো না । অথচ ফোনটা করেই কেমন নার্ভাস হয়ে গেলো সে । মামুনের নির্লিপ্ততা তাকে আরো বেশী নার্ভাস করে দিয়েছে । মামুন একবারও জানতে চাইল না সে কেমন আছে! এবার কাছে যেয়ে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইবে সে । মামুন ক্ষমা না করা পর্যন্ত হাত ধরে বসেই থাকবে । সে জানে, মামুনের মনটা ভীষন নরম । সে তাকে ক্ষমা না করে পারবেই না ।
একদিন পর আবারও ফোন করলো মিলা । সেদিনও রাত একটায় । ফোন ধরলো মামুন –
হ্যালো
আমি মিলা ।
হ্যাঁ বলো ।
তুমি ভালো আছো? সবাই কোথায়?
তুমি কেন ফোন করেছো বলো?
এবার সাহস করে বলে মিলা, আমি তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাই ।
হুম, বলো ।
না, ফোনে না ।
ফোনে না তো কোথায়!
আমরা কী দেখা করতে পারি?
মিলা, আমার মনে হয় না যে আমাদের দেখা করার মতো কিছু ঘটেছে ।
প্লিজ মামুন শুধু একবার দেখা করো, তারপর তুমি যা বলবে তাই হবে ।
আমার মনে হয় না কিছু বলা বা শোনার আছে । তুমি অযথা সময় নষ্ট করছো ।
একবার, প্লিজ, প্লিজ মামুন ।
না, আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই না। তোমার হয়ত বলার আছে তবে আমার আগ্রহ বা সময় কোনোটাই নেই । এভাবে বার বার ফোন কোরো না । অনেক রাত হয়েছে শুয়ে পড়ো । লাইন কেটে দেয় মামুন ।
ফোন রেখে মন খারাপের পাশাপাশি মিলা’র ভালোও লাগে । এখনো তার চিন্তা করে মামুন? এই যে রাত জাগতে নিষেধ করলো তাকে, এটাই তো মনের টান ।
এরপর যতোবার ফোন করেছে মিলা, মামুন কল রিসিভ করেনি । তারপর থেকে শুরু হলো ম্যাসেজ আসা । বার বার একই অনুরোধ, অনুনয়, বিনয় করতে লাগলো মিলা, একবার শুধু দেখা করতে চায় সে, মাত্র একবার । ম্যাসেজের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে শেষে মামুন ফোন দিলো –
হ্যালো, আমি জানতাম তুমি ফোন করবেই, বলে মিলা ।
বার বার এসএমএস পাঠাচ্ছো কেন? সমস্যা কী তোমার?
শুধু একবার দেখা করবো তোমার সাথে ।
ফোনে বলো । আমার সময় হবে না দেখা করার ।
শুধু একবার মামুন, বলেই মিলা কেঁদে ফেলে ।
কী যন্ত্রণায় পরলাম? মনে মনে ভাবে মামুন । এ যন্ত্রণার থেকে বাঁচার জন্যেই সে দেখা করতে রাজি হয় ।
সন্ধ্যা সাতটায় মামুনের আসার কথা কিন্তু যদি আগে চলে আসে, যদি এসে তাকে না পায় তাই মিলা ছ’টায় হাজির হয়ে যায় রেস্টুরেন্টে। বসে বসে অপেক্ষা করতে থাকে মামুনের জন্য । আজ অনেকদিন পর একটু সেজেছে মিলা । অপেক্ষা করতে ভীষন ভালো লাগছে তার । ঠিক প্রেমের দিন গুলোর মতো ।
সাতটার একটু পরে মামুন এসে ঢোকে রেস্টুরেন্টে । ঢুকেই মিলা’র সাথে চোখাচোখি হয়ে যায় । আজ এগারো মাস নয় দিন পর দেখা হলো মিলা’র সাথে । একটু বোধহয় মোটা হয়েছে আগের চেয়ে, তবে চেহারায় খুব ক্লান্তির ছাপ । ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সে মিলা’র টেবিলের দিকে । মিলা কথা বলে প্রথমে –
কেমন আছো?
ভালো ।
বাচ্চারা?
সবাই ভালো আছে । কী বলবে, বলো ।
চুপ করে বসে থাকে মিলা । কোনো কথা বলে না ।
বলো, কী বলার জন্য ডেকেছো । বাড়ি ফিরতে হবে আমার । বাচ্চারা অপেক্ষায় থাকবে ।
মিলা কিছুই বলে না, নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে মাথা নামিয়ে। চোখের জল পড়ছে মিলা’র হাতের ওপর । অপলক চেয়ে থাকে মামুন এবং খুবই অবাক হয়ে লক্ষ্য করে তার একটুও খারাপ লাগছে না । মিলাকে কাঁদতে দেখলে তার পৃথিবী এলোমেলো হয়ে যেতো অথচ মিলা’র কান্না আজ তাকে স্পর্শ করলো না । আর তাড়া দেয় না মামুন । অপেক্ষা করতে থাকে ।
কিছুক্ষন পর নিজেকে সামলে নিয়ে কথা বলে মিলা-
তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও । আমার ভীষন অন্যায় হয়েছে । আমাকে শাস্তি দাও তুমি ।
মামুন কোনো কথা বলে না ।
কিছু বলো, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে । প্লিজ তুমি আমাকে ক্ষমা করো, প্লিজ মামুন । মামুনের হাতটা ধরে অনুনয় করে মিলা ।
মামুন হাত সরিয়ে নেয় না । শুধু বলে, তোমাকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি ।
সত্যি ক্ষমা করেছো? কোনো রাগ নেই আমার ওপর? তুমি যা বলবে, যেভাবে বলবে আমি তাই করবো । আর কোনোদিন এমন ভুল হবে না ।
বললাম তো কোনো রাগ পুষে রাখিনি আমি । আমি ওগুলো ভুলে গেছি ।
তাহলে?
কী তাহলে?
আমি সবার কাছে যেয়ে ক্ষমা চাইবো, তুমি যাবে তো আমার সাথে?
ক্ষমা তুমি চাইতেই পারো কিন্তু আমি কেন যাবো তোমার সাথে?
এই যে তুমি বললে ক্ষমা করে দিয়েছো ।
তার সাথে এটার কী সম্পর্ক?
আমরা আবার নতুন করে শুরু করবো মামুন। আগের ভুলগুলো শুধরে নেবো সব । আমি, তুমি, আমাদের বাচ্চারা..
দাঁড়াও, দাঁড়াও, ঠিক বুঝলাম না কী বলতে চাও তুমি । আবার শুরুর কথা আসছে কেন?
তুমি আমাকে ক্ষমা করেছো..
ভুল বুঝেছো তুমি মিলা । আমি বলেছি, আমার কোনো রাগ, অভিমান, অনুযোগ কিছুই নেই । নতুন করে শুরুর কিছু নেই তো ।
আমরা আবার একসাথে থাকবো না?
মিলা শোনো, মিলা নামের কেউ একজন কোনো একসময় আমার জীবনে ছিলো, এটা আমি মন থেকে মুছে ফেলেছি । এই নিয়ে তো নতুন করে বলার কিছু নেই । তোমার কথা শেষ হলে আমি উঠবো ।
মিলা মামুনের হাতটা চেপে ধরে রাখে । না তুমি উঠবে না । আমি তোমাকে যেতে দেবো না । আমাকে নিয়ে চল তোমার সাথে । বাচ্চাদের জন্য ভীষন কষ্ট হচ্ছে আমার । প্লিজ মামুন এভাবে চলে যেওনা । আমি মরেই যাবো ।
মরে যাওয়া এতো সোজা না মিলা । আমারও একসময় মনে হয়েছিলো, আমি মরে যাবো অথচ দেখো দিব্বি বেঁচে আছি । সময় সব যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেয় । চিন্তা কোরো না, সময় তোমার কষ্টগুলোও ভুলিয়ে দেবে একসময় ।
আমার বাচ্চাদের সাথে আমি থাকতে চাই । তুমি আমাকে এই সুখ থেকে বঞ্চিত কোরো না ।
তোমার বাচ্চাদের আমি তোমার কাছ থেকে কেড়ে নেই নি। তুমি তাদের ছেড়ে চলে গেছো ।
আমি আমার বাচ্চাদের ফেরত চাই । ওদের সাথে থাকতে চাই । এই সুযোগটুকু আমাকে দাও মামুন । মিলা কেঁদেই চলেছে ।
বাচ্চারা কী চায় ওটা বাচ্চাদের কাছ থেকে যেনে নিও । ওদের বলবো তোমার কথা । তবে তোমাকে একটা কথা স্পষ্টভাবে বলছি মিলা, মন দিয়ে শোনো, একসময় আমরা স্বামী-স্ত্রী ছিলাম। খুব বিশ্বাস আর ভালবাসার সম্পর্ক ছিলো আমাদের । অন্তত আমার দিক থেকে বিশ্বাস আর ভরসা ছিলো শতোভাগ । আমার মনে পড়ে না, আমি কখনো বিশ্বাস ভঙ্গের কোনো কাজ করেছি । তুমি যখন আমাকে ছেড়ে, আমাদের ছেড়ে চলে গেছো, আমার দোষটা বলে যাওনি । আমি বুঝতেই পারলাম না আজ পর্যন্ত কী ছিলো আমার দোষ । বিশ্বাসের জায়গাটা নড়ে গেলে আর কী ঠিক হয়? কী জানি, কারো হয়ত হয় কিন্তু আমার একটা সমস্যা আছে, কারো ওপর থেকে একবার বিশ্বাস চলে গেলে আর কখনোই সেটা ফিরে আসে না । তাই তোমার কাছে অনুরোধ, আর কখনো একসাথে পথচলার চিন্তা কোরো না ।
কিন্তু বাচ্চারা যদি আমাকে মাফ করে? ওরা যদি আবার একসাথে থাকতে চায়?
বাচ্চারা যদি তাদের মায়ের সাথে থাকতে চায় অবশ্যই থাকবে । তুমি তাদের মা হিসাবে থাকবে । তোমার কাছে রেখে যাবো ওদের ।
আর তুমি?
আমার পথ আমি সরিয়ে নিয়েছি অন্য কোনোখানে । সে পথের আমি একাই পথিক । সে পথে সবার প্রবেশের অনুমতি নেই । অনেক রাত হয়েছে । উঠতেই হবে এবার । বাচ্চারা অস্থির হয়ে যাচ্ছে । একা যেতে পারবে তো? এগিয়ে দিতে হবে?
অভিমান ভরা কন্ঠে মিলা বলে, যেতে পারবো । তুমি যাও ।
মামুন আর কথা বাড়ায় না । দ্রুত বেরিয়ে যায় ওখান থেকে ।
বছরের শুরু তাই লেখাপড়ার চাপ একটু কম । স্পোর্টস চলছে স্কুলে । সাথে কালচারাল উইক । অপূর্ব আর পূর্বা ক্যান্টিনে এলো একসাথে । বাবা বলেছে, মা আসবে আজকে তাদের সাথে দেখা করতে । মা কেন আসবে বুঝতে পারেনা তারা । ঢুকেই তারা মাকে দেখতে পায় । মা’র টেবিলের কাছে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো দু’জন । কারো মুখে কেনো কথা নেই । মিলা দেখলো, বাচ্চারা এই কয়েক মাসেই অনেকটুকু বড় হয়ে গেছে । মিলা’র ইচ্ছে করলো ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে ওদের কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে থামালো সে । হাত ধরে বসালো ওদের –
কেমন আছো তোমরা?
ভালো, অপূর্ব বললো । পূর্বা তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে । কথা বলছে না ।
মা’র কথা মনে পড়েছে তোমাদের?
বাচ্চারা দু’জন দু’জনার দিকে তাকায়, উত্তর দেয় না ।
কী, কথা বলবে না মা’র সাথে ?
আমাদের স্পোর্টস আছে, যেতে হবে । অধৈর্য হয়ে বলে অপূর্ব ।
ঠিক আছে যাও । মা এখানে অপেক্ষা করবো ।
না, অপেক্ষা করবে না । জোরে বলে ওঠে অপূর্ব।
আচ্ছা অপেক্ষা করবো না । মা শুধু একটা কথা বলতে এসেছি, মা একটা ভুল করেছিলো । মা সেটার জন্যে খুব সরি । তোমরা মাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ ।
এই পূর্বা চল, পূর্বার হাত ধরে টানে অপূর্ব ।
মিলা অপূর্ব’র হাতটা ধরে, বাবা তোমরা আমাকে ক্ষমা করবে না? কেউ যদি মন থেকে ক্ষমা চায় তখন তাকে মাফ করে দিতে হয় । এটা আমরা পড়েছি না বইতে?
হুম, বইতে পড়েছি আর তোমাকে ক্ষমা করেছি । এবার আমরা যাবো ।
মা বলে ডাকলে না তো একবারও? পূর্বা তুমি তো কোনো কথাই বললে না মা’র সাথে ।
আমরা এখন যাবো । চল ভাইয়া । অপূর্ব’র হাত ধরে বেরিয়ে যায় পূর্বা । পিছে ফিরে তাকায় না একবারও ।
মিলা একটু অবাক হয় । বাচ্চারা তাকে দেখে খুশী বা রাগ কোনোটাই হলো না । আবার কথা বলতে হবে ওদের সাথে । ধীরে ধীরে মান ভাঙাতে হবে ওদের ।
আজ আবার দেখা হবে বাচ্চাদের সাথে । আজ ওরা রেস্টুরেন্টে আসবে । মিলা সব কথা গুছিয়ে রাখলো । আজ ওদের রাগ ভাঙাবেই সে । যেভাবেই হোক । বাচ্চারা ক্ষমা করলেই সে আবার তার সংসার ফিরে পাবে । তারপর ধীরে ধীরে মামুনের অভিমানও ভুলিয়ে দেবে সে ।
বাচ্চাদের জন্য অনেক চকলেট কিনলো মিলা । আজও অনেকক্ষণ আগে চলে এসেছে সে । একসময় দেখলো মামুনের গাড়ি এসে থামলো রেস্টুরেন্টের দরজার সামনে । বাচ্চাদের গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেলো মামুন । ওরা এসে ঢুকলো ভেতরে । ছেলেটা বড় হচ্ছে আর মামুনের মতোই হচ্ছে দেখতে । ওদের দেখে ভালো লাগলো মিলা’র –
এসো, এসো । উঠে গিয়ে ওদের নিয়ে এলো সে । দুই ভাইবোন পাশাপাশি বসলো । কী খাবে, জানতে চাইলো মিলা ।
কিছু খাবো না ।
কিছু তো খেতেই হবে । বাচ্চাদের পছন্দের খাবার অর্ডার করে মিলা । বাবা আসলো না তোমাদের সাথে?
না, বাবার কাজ আছে । বাবা বলেছে কথা শেষ হলে ফোন করতে, নিতে আসবে আমাদের ।
কিছুক্ষন সবাই চুপ । মিলা কথা শুরু করে –
তোমারা কিছু ভাবলে? মাকে ক্ষমা করেছো?
সেদিন বলেছি তো ।
না, মানে মা আবার তোমার সবার সাথে থাকতে চাই । আগের মতো, ভীষন মজা হবে ।
আগের মতো? অপূর্ব বলে ।
হুম সবাই মিলে খুব আনন্দ করবো আবার ।
অপলক কিছুক্ষন মিলা’র মুখের দিকে তাকিয়ে অপূর্ব বলে ওঠে, আবার যদি তোমার কাউকে ভালো লাগে? আবার যদি তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যাও?
মনে হলো ঠাস করে কেউ চড় মারলো তার মুখে । মিলা অপ্রস্তুত হয়ে যায় ছেলের কথায় । আমি বার বার মাফ চেয়েছি বাবা । আমার ভীষন অন্যায় হয়েছে ।
মা, তুমি কী জানো তুমি আমাদের কতো বিপদে ফেলে চলে গিয়েছিলে? মা তুমি কী জানো কত রাত আমাদের কেঁদে পার করতে হয়েছে? তুমি কী জানো মা, সবাই আমাদের কতো নোংরা কথা বলেছে, কতো গালি দিয়েছে? তুমি কী জানো লজ্জায় আমার কতোবার মরে যেতে ইচ্ছে করেছে? তুমি কী এগুলো জানো মা? স্কুলে, রাস্তায়, কারো বাসায় যেখানেই আমরা গিয়েছি, সবাই হাসাহাসি করেছে আর আমরা বাসায় ফিরে অনেক কেঁদেছি । অনেক কষ্টে আমরা নিজেদের মন ঠিক করেছি । আমরা আর কাঁদতে চাই না, একদম না । বাবা যদি তোমার সাথে থাকতে চায় থাকবে । আমরা তোমার সাথে থাকতে চাই না । আমরা নানির কাছে চলে যাবো ।
মিলা পাথরের মতো বসে থাকে । কী কঠিনভাবেই না কথাগুলো বললো তার ছেলে । এতোটুকু স্বর কাঁপলো না! মিলা শেষ ভরসা হিসেবে তাকায় মেয়ের দিকে । মেয়েটাও কী এভাবে বলবে তাকে? পূর্বা, খুব আদর নিয়ে ডেকে মেয়ের গায়ে হাত বুলিয়ে দেয় মিলা ।
মা এখানে একটা কাগজ আছে, আমি চলে যাওয়ার পরে কিন্তু খুলবে এটা । আগে কিন্তু খোলা যাবে না ।
মিলা খুব আগ্রহ নিয়ে হাত বাড়ায় । পূর্বা প্যাকেটটা দেয় । বাবাকে ফোন কর, আসতে বল । আমরা বাসায় যাবো ।
কিছুই তো খেলে না তোমরা? একটু খেয়ে নাও ।
না, খাবো না । আমরা যাবো এখন ।
আরেকটু থাকবে না মা’র কাছে?
না, আমাদের পড়া আছে । অস্থির হয়ে ওরা ।
চকলেট গুলো নাও, মিলা চকলেট বাড়িয়ে দেয় পূর্বার দিকে । পূর্বা ভাইয়ের দিকে তাকায় । ইশারায় কী কথা হয় বোঝে না মিলা কিন্তু পূর্বা চকলেটের বক্সগুলো নেয় ।
বাচ্চারা চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ বসে থাকে মিলা । মনে মনে এখনো ক্ষীণ একটা আশা রাখে সে, সবাই সব ভুলে যাবে । আবার সে ফিরে পাবে সংসার । পূর্বার কাগজটার কথা মনে হতেই প্যাকেটটা খোলে মিলা । কতোগুলো চকলেট, কয়েকটা ড্রইং আর একটা চিঠি । ড্রইংগুলো দেখে মিলা । একটা ছবিতে পিকনিকের দৃশ্য আঁকা । বাবা, মা আর দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে পিকনিক । খুব ভালো লাগে ছবিটা দেখে । আরেকটা ছবিতে গাছের পেছনে পাহাড় । সূর্যটা অল্প একটু উঁকি দিচ্ছে কিন্তু আলো ছড়িয়ে পড়েছে অনেকদূর পর্যন্ত । কী যে সুন্দর ছবি আঁকে মেয়েটা । এবার যেয়ে ওদের একটু যত্ন নিতে হবে, সময় দিতে হবে বাচ্চাদের । এটা কী ছবি! পূর্বা রঙধনু আঁকতে খুব পছন্দ করতো । কাগজ আর রঙ পেলেই যখন তখন যেখানে সেখানে রঙধনু আঁকতো । কিন্তু এই রঙধনুটা এমন কেন! সাতটা রঙই কালো । হালকা ধূসর থেকে শুরু করে সাতটা শেডের মাধ্যমে গাঢ় কালো পর্যন্ত রঙ আছে রঙধনুটাতে । প্রতিটা শেড ই আলাদা করে বোঝা যাচ্ছে । ওর কী রঙ শেষ? ইশ,,, কী ভুল হয়ে গেলো তার । একবার ভেবেছিলো রঙ আনবে তারপর কী মনে করে আর নিলো না । খুব আফসোস হচ্ছে এখন । আবার ছবিটার দিকে তাকায় সে । কালো হলেও রঙধনুটা খুব সুন্দর লাগছে দেখতে । এমনটা তো কখনো তার ভাবনাতেই আসেনি । চিঠিটা খোলে মিলা-
প্রিয় মা,
প্রিয় কথাটা কেটে দিয়েছে পূর্বা, তুমি কেমন আছো? আমরা ভালো আছি । জানো মা তোমাকে দেখে অনেক কথা বলতে ইচ্ছে হয়েছে কিন্তু আমি বলতে পারিনি । আমি কথাগুলো গোছাতে পারিনি । সবগুলো ভুলে যাচ্ছিলাম । আচ্ছা মা, তুমি কেন চলে গেলে? আমরা কী খুব বিরক্ত করতাম তোমাকে? আমরা তো সব কথা শুনতাম মা । তাহলে আমাদের কেন শাস্তি দিলে? মা জানো, স্কুলে মাকে নিয়ে রচনা লিখতে বলেছিলো । তূর্ণা আমাকে বলেছে, তোর মা’র পালিয়ে যাওয়ার কথা লেখ । আমার খুব কষ্ট লেগেছে তখন । আচ্ছা মা, সব মা তো বাচ্চাদের অনেক ভালবাসে, তাহলে আমরা কী অনেক খারাপ বাচ্চা যে তুমি আমাদের ভালোবাসোনি? মা তুমি চকলেট খেয়ো। ওগুলো তোমার প্রিয় চকলেট, তাই না মা? দেখেছো আমার ঠিক মনে আছে ।
ওখানে তিনটা ছবি এঁকেছি আমি, তোমার জন্য । একটা ছবি হ্যাপি ফ্যামিলির । একটা রঙধনু এঁকেছি । দেখতে পচা তাই না? তুমি যখন আমাদের ফেলে চলে গেলে তখন আমাদের জীবনের সব রঙ চলে গেলো । সব মজা শেষ । সবার পচা কথা শুনে আমরা ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থাকতাম । আমাদের খুব লজ্জা লাগতো । তাই আমাদের রঙধনুটা কালো হয়ে গেলো । আরেকটা ছবি আছে না? ওটা কী বলতো? ওটা হলো সূর্যটা আবার উঠছে । মানে আমরা আবার হাসছি । ছবিটা সুন্দর হয়েছে না? এই সুন্দর ছবিটাকে তুমি আবার অন্ধকার করে দিও না মা ।
ইতি
বাবার মেয়ে পূর্বা ।
মিলা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে । নড়াচড়ার শক্তি নেই যেন । চোখের জল যেন আজ বাঁধভাঙা প্লাবন । ওয়েটার এসে হাত নেড়ে নেড়ে কী বলছে কিছুর শুনতে পাচ্ছে না সে । তার কেবলই মনে হতে থাকে, স্বর্গের দরজার চাবিটা যেন তার হাত ফসকে পড়ে গেলো ।
মামুন ছেলেমেয়ের সামনে বসে আছে। মিলা’র সাথে কথা বলার পর থেকেই ওদের মন ভালো । মামুন মনে মনে ধরেই নিলো যে বাচ্চারা হয়ত চায় মা বাবার সাথে একসাথে থাকতে । সেটা ওরা চাইতেই পারে । ছোট মানুষগুলো এরমধ্যেই অনেক কষ্ট সহ্য করেছে । এই বয়সেই তারা মানুষের নোংরা চেহারাটা দেখে ফেলেছে । তার বাচ্চাদের চোখের জল যেন রক্ত হয়ে গড়িয়েছে । সে আর কখনো মিলাকে বিশ্বাস করতে, ভালবাসতে পারবে কিনা জানে না তবে শুধুমাত্র বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে নিজের রাগ, ঘৃণাকে দমিয়ে রাখবে সে । মিলার কাছে বাচ্চাদের দিয়ে দুরে সরে যাবে প্রয়োজন হলে । তবু তার বাচ্চারা ভালো থাক ।
বাবা দেখো মা কত চকলেট দিয়েছে, পূর্বা বললো ।
তোমরা মা’র সাথে কথা বলেছো?
হুম ।
খুশী তোমরা?
হুম ।
তাহলে এখন আমরা কী করব?
বাবা, একটা কথা বলবে?
কী বলো?
তুমি কী চাও মা আবার আমাদের সাথে থাকুক?
আমি শুধু চাই তোমরা ভালো থাকো । আমার অন্য কোনো চাওয়া নেই ।
বাবা, আমরা কী তোমাকে অনেক বিরক্ত করি?
একথা কেন বলছো অপূর্ব?
বাবা তুমি পারবে না একা একা আমাদের বড় করতে? আমরা তোমাকে একদম বিরক্ত করবো না বাবা । সব কথা শুনবো ।
অপূর্ব’র সাথে পূর্বাও সুর মেলায়, সত্যি বাবা একদম বিরক্ত করবো না । হোমওয়ার্ক করে ফেলবো সময়মত তারপর ভেজিটেবল খাবো । সময়মতো ঘুমাতে যাবো । সত্যি বলছি বাবা ।
মা তোমাদের সাথে থাকবে না?
আমরা শুধু তোমার সাথে থাকতে চাই বাবা । তুমি কখনো আমাদের ছেড়ে কোথাও যাবে না তো বাবা? ছেড়ে চলে গেলে অনেক কষ্ট হয় জানো বাবা । অনেক কান্নার পরও কষ্টগুলো কমে না । আমরা আর কষ্ট পেতে চাই না বাবা ।
মামুন খেয়াল করলো, তিনজনের চোখেই অশ্রুধারা । সে জড়িয়ে ধরলো বাচ্চাদের । বাচ্চারাও তাকে আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো । এই জড়িয়ে ধরার মধ্যে আনন্দ, ভালবাসার অনুভূতিগুলো ওরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিলো যেন । সেই ভালোলাগার অনুরণন চলতে লাগলো অনেকক্ষণ, অনেকটা ক্ষণ ।
💖 💖 💖
———————————————————————
# মন জিনিষটা বড়ই জটিল । মনের অতলে কেউ পৌঁছাতে পেরেছে কখনো? শুধুমাত্র মন আছে, বিবেক আছে বলেই তো মানুষ অন্য সব প্রানীর চেয়ে আলাদা । এই মনের যে কতো রুপ- এই মনের ভেতর জমে থাকে সীমাহীন ভালোবাসা, এই মনই কিন্তু আবার অসীম ঘৃণা লালন করে । লোভী মন, কবি মন, প্রেমিক মন, চাতূর্য্যে ভরা মন, কুটিল মন, সরল মন । যতো রকম মানুষ তত রকম মন । তবে মন চাইলেই কী সব কাজ করা যায়, না করা উচিৎ? মনের খেয়ালে, ক্ষনিকের ভুলে আমরা অনেক সময় এমন এমন কাজ করে ফেলি যার মাশুল দিয়ে যেতে হয় সারাজীবন। ক্ষনিকের মোহ আর লোভ সামলাতে না পারলে আমরা আর মানুষ কেন? কেউ যখন ভুল করে এবং ভুল বুঝতে পেরে শোধরানোর চেষ্টা করে, তাকে একটা সুযোগ দেয়া উচিৎ। কিন্তু কেউ যখন জেনেশুনে ভুল করে তখন? যাদের সাথে এ অন্যায় আচরণ করা হয়, তাদের সীমাহীন দুঃখ, কষ্ট, ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাওয়াটা কী আমরা অনুভব করতে পারি?
ইদানিং আমরা সবাই যেন ভীষন অস্থির। কেউ কাউকে এক বিন্দু ছাড় দিতে রাজি না । ইদানিং একটা কথা খুব শুনি, “বাচ্চা আছে বলেই কী মুখ বুঁজে সব সহ্য করতে হবে নাকি? ” হ্যাঁ, বাচ্চা আছে বলেই সব সহ্য করতে হবে । কারণ ঐ নিস্পাপ প্রাণটাকে আমি নিজ দায়িত্বে দুনিয়ায় এনেছি । মানুষের জীবন কোনো খামখেয়ালির বিষয় না । ছোট শিশুটির জীবনটাকে অনিশ্চয়তার দোলাচালে ঠেলে দেয়ার অধিকার আমাদের দেয়া হয়নি । মা-বাবা হওয়া পরম সৌভাগ্যের বিষয় । আমরা যারা বাবা মা, তাদের দায়িত্ব অনেক । ছোট বাচ্চাগুলো আমাদের চোখ দিয়েই দুনিয়া দেখে । আমাদের বুকে মাথা রেখেই নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যায় ওরা । তারা জানে, যতই বিপদ আসুক না কেন বাবা মা তার পাশে আছে । ওরা কিন্তু দুজনার হাত ধরেই পথ চলতে চায় । সেই বিশ্বাসের, সেই ভরসার হাতটা যখন ছুটে যায়, তাদের পৃথিবীতে আঁধার নেমে আসে ।
The End
Farzana Islam