রংধনুর রং কালো পর্ব -০৭

#রঙধনুর_রঙ_কালো(৭)
***********************

ফ্ল্যটটা দারুণ পছন্দ হয়েছে মিলা’র । বেশ বড়সড় আর খোলামেলা । খুব সুন্দর করে সাজানো । সব দামী জিনিষ দিয়ে ঠেসে সাজানো । সাজানোর বেলায় রুচির চাইতে দামটাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে বেশী । তার আগের বাড়িতে কেমন একটা রবীন্দ্র আবহ ছিলো । একটা কোনায় শীতল পাটিতে বসার জায়গা, খুব সুন্দর ডিজাইনের কিছু বেতের আসবাব ছিলো ওখানে । কাঠের ফার্নিচার গুলোও কতো ঘুরে ঘুরে কিনেছে সে আর মামুন মিলে । আর এখানে সব গোল্ডেন কালার । চেয়ার, টেবিল, খাট, ডিভান সবকিছুতেই গোল্ডেন । কেমন একটা গরম গরম অনুভূতি চারিদিকে । খারাপ না, বরং এ ই ভালো । আগের বাড়ির চেয়ে একদম আলাদা । লাইফে চেঞ্জ দরকার ।

খুব বেড়ালো সে আর সাইফ । একসাথে তিন দেশ ঘুরে তবেই দেশে ফিরেছে । জীবন যে এতো উপভোগ্য, এতো উদ্দীপনা এখনো ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে ছিলো, সাইফ তার জীবনে না এলে জানতেই পারতো না । এবার আবার কাজে ডুবতে হবে । ফোন নাম্বারটা চেঞ্জ করতে হয়েছে । পরিচিতরা ফোন করে যা মুখে আসে তা শুনিয়েছে তাকে । এরা যে কেন বোঝে না, তারও অধিকার আছে নিজের মতো করে বাঁচার । যত্তসব ফালতু প্যাঁচাল । ছেলেমেয়েদের কথা মনে হয়েছে মাঝে মাঝে তবে মন খারাপ হয়নি, সত্যি । ওরা মামুনের সাথে ভালোই থাকে । এতোকিছু ধরতে গেলে লাইফ এনজয় করা যায় না । টিপিক্যাল সবকিছু তার ভালো লাগে না ।

কাল একটু শপিংয়ে বেরিয়েছিল, ওখানে যেয়ে তার খালাতো বোন নীলা’র সাথে দেখা হয়েছিলো । নীলা ওর চেয়ে তিন বছরের ছোট অথচ কী বড় বড় কথা শুনিয়ে দিয়ে গেলো –

কী খবর আপা খুব রঙ লেগেছে গায়ে তোর?

মিলা খুব খুশী হয়ে ছুটে এসেছিলো নীলাকে দেখে অথচ ওর কথা শুনে মেজাজটাই বিগড়ে গেলো । গম্ভীরমুখে বললো, কেমন আছিস?

আমরা তো সবাই ভালো আছি । তোর ভালো থাকা দেখছি । তুই যেভাবে উড়ছিস, খুব ভালো লাগছে দেখতে । দেখিস ডানা ভেঙে পরিস না যেন । জানে মারা যাবি ।

খুব বড় বড় কথা বলা শিখেছিস, তাই না?

বড় বড় মনে হচ্ছে! আচ্ছা যা বলবো না । তবে ভুলেও খালার সামনে পড়িস না । যদি পরিস তো বুঝবি মজা । কথা তো কথা, তোর জন্য ঝাড়ু নিয়ে বসে আছে খালা । বাড়ির সামনে যে নারকেল গাছটা আছে না, ওখান থেকে পাঁচটা ডাল কাটিয়েছে বেলালকে দিয়ে । বেলাল খুব যত্ন করে ইয়া লম্বা একটা ঝাড়ু বানিয়েছে । বলেই একচোট হেসে নেয় নীলা ।

ছোট বোন দেখে কিছু বললাম না, ছেড়ে দিলাম ।

কী বলবি তুই? তোর কিছু বলার আছে! আর ছেড়ে দেয়াটা যে তুই ভালোই পারিস তা তো আমরা দেখলামই । ঠিক আছে যা, যতোটুকু পারা যায় মাস্তি করে নে। যার সাথে আছিস তার আবার কখন মন ছুটে যায় কে জানে । যাই আপা, তোর সাথে দেখা হয়ে মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো ।

আজ সকালে সাইফের একটা কথায় খুব অবাক হয়েছে মিলা । বেড রুমে একটা কিম্ভূতকিমাকার পেইনটিং ঝুলছিলো দেয়ালে । মাথামুন্ডু কিছুই বোঝা যায় না । শুধু মনেহয় আগুনের গোলার মতে দুটো চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে । দেখলেই কেমন হিম হিম অনুভূতি বয়ে যায় ভেতরে । খুব অস্বস্তি হয় । ওটা নামিয়ে গেস্ট রুমে রেখে এসেছিলো সে । সাইফ প্রথমে খেয়াল করেনি । যখন দেখলো দেয়ালটা ফাঁকা তখন হুংকার দিয়ে উঠেছিলো –

এটা সরিয়েছে কে? তপন, মাহমুদা, কাজের লোকদের নাম ধরে চিৎকার করলো সাইফ ।

আরে চেচাঁমেচি করছো কেন? ওটা তো আমি সরিয়েছি । কী কিম্ভুত একটা জিনিষ রে বাবা!

কী? কিম্ভুত! তোমার মাথা ঠিক আছে? দাম জানো ওটার? তোমার ধারণার বাইরে ওটার দাম । কোথায় রেখেছো? এখনই নিয়ে এসো ।

তুমি এতো চেঁচাচ্ছো কেন সাইফ? কাজের লোকরা শুনতে পাচ্ছে । এমন কিছু তো হয়নি শুধু ওটা গেস্ট রুমে রেখে এসেছি ।

আজ প্রথম আর আজই শেষবারের মতো বলে দিচ্ছি, আমার পারমিশন ছাড়া এ বাড়িতে একটা পাতাও জায়গা থেকে নড়ে না । নিজের মাতুব্বরি যেখানে দেখানোর দেখিয়েছো । আমি মামুনের মতো ছাগল না, মনে থাকে যেন । এটা আমার বাড়ি ।

সাইফ চলে গেলে মাহমুদা এসে ফিক করে হেসে ফেললো, ম্যাডাম কিসুতে হাত দিয়েন না আর কইলাম । কয়দিনের জন্যে আইছেন, মজা কইরা যান, যা মন চায় খান । কোনো সমস্যা নাই কিন্তু নিজের ঘর ভাইবেন না ।

কাজের মেয়ের স্পর্ধা দেখে মিলা চমকে উঠলো । বলে কী এই মেয়ে? মিলা এতোটাই হতবাক হয়েছিলো যে মুখে কোনো কথা যোগাচ্ছিল না । কী হলো এটা তার সাথে!

মামুন তো কোনোদিনও এভাবে কথা বলেনি তার সাথে । সংসারটা একেবারেই তার নিজের মতো করে সাজিয়েছিল মিলা । মামুন কখনোই কোনো বিষয়ে প্রশ্ন তোলেনি । তার চাওয়াই যেন মামুনের চাওয়া । মিলা চুপচাপ হজম করলো কথাটা । বিয়েটা একবার হয়ে যাক শুধু, তারপর সে বোঝাবে মজা সাইফকে । সে অপেক্ষায় আছে । কয়েকবার বিয়ের কথা তুলেছে সাইফের সামনে কিন্তু সে কেমন এড়িয়ে যায় । ডিভোর্সের কাগজও হাতে চলে এসেছে অথচ সাইফের যেন কোনো তাড়া ই নেই । ব্যাপারটা নিয়ে ইদানিং একটু টেনশনে আছে মিলা ।

সে এখন পরিচিত লোকজনকে যতোটা পারে এড়িয়ে চলে কিন্তু ব্যাংকে যারা আছে তারা তাকে খোঁচাতেই থাকে । রিমা’র সাথে মামুনের বেশ ভাব ছিলো । রিমা তার ওপর একটু রাগ । বুঝতে দেয় না তবে আগের মতো নিজে থেকে এসে আর কথা বলে না । শারমীন আপা আছেন আরেকজন । সুযোগ পেলেই ঐ একই কথা তুলবেন –

কী খবর মিলা, নতুন সংসার কেমন চলছে?

আছে আপা মোটামুটি ।

কেন? মোটামুটি কেন থাকবা? তুমি তো চরম থাকার জন্য আগেরটা ছাড়লা, তাই না? তো মোটামুটি থাকলে হবে?

গা জ্বলে যায় মিলা’র কিন্তু মুখে হাসিটা ধরে রাখে ।

বিয়ের কোনো খবরও পেলাম না, ঝাল-মিষ্টি ও কিছু খেলাম না । কী বিয়ে হলো তো নাকি? নাকি লিভিং টুগেদার জিন্দাবাদ?

খোঁচাটা খুব গায়ে লাগে মিলা’র । না আপা কী বলেন এইসব? করব খুব শিঘ্রীই ।

করলেই ভালো। দেখো আবার, মাথার জিনিষ পায়ে ঠেলেছো শেষে না তোমাকে কেউ পায়ে ঠেলে ।

মিলা খুব ব্যস্ততা দেখায় । শারমীন আপা নিজের ডেস্কে ফিরে যান ।

বিয়ে না করে এভাবে থাকাটা তার কাছেও খুব খারাপ লাগছে কিন্তু সাইফকে বিয়ের কথা বলতে গেলেই পিছলে যায় । আজ ভালো করে ধরতে হবে ।

কাজ নিয়ে চরম ব্যস্ততার মাঝে আছে মামুন । এরই মাঝে ফোন আসলো স্কুল থেকে । ইমারজেন্সি কল, এখনই যেতে হবে । কী করবে বুঝতে পারেনা সে । হাতের কাজটা খুব জরুরী । আবার টেনশনে কাজও করতে পারছে না । টিচার ব্যাপারটা বললেনই না । শুধু বললেন এখনই যেন মামুন চলে আসে । এভাবে কী বললেই যাওয়া যায়? ভাবতে ভাবতেই আবারো ফোন । কাজের টেনশন বাদ দিয়ে সে স্কুলে রওনা দেয় । যা হবে পরে দেখা যাবে ।

মাথার মধ্যে কত রকম চিন্তা কাজ করতে থাকে স্কুলে পৌঁছানো পর্যন্ত । খারাপ চিন্তা আসে মাথায় । স্কুলে পৌঁছে প্রিন্সিপালের রুমে ডাক পড়ে । রুমে ঢুকে তাজ্জব বনে যায় মামুন । অপূর্ব বসে আছে চেয়ারে, পাশের চেয়ারে আরেকটা ছেলে। দেখেই মনে হচ্ছে মারামারি করেছে । অপূর্ব’র চোখের নীচটা ফুলে আছে, শার্টের মধ্যে কাদার দাগ । ছেলেটার ঠোঁট ফুলে ঢোল । ঠোঁটের কোনায় রক্তের দাগ । সেই ছেলের মা বাবাও এসেছেন । টিচার প্রথমে সেই ছেলের কাছে জানতে চাইলেন ব্যাপারটা –

কীভাবে হলো এইসব?

স্যার ও একটা পাগল, একা একা কথা বলে । আমি বললাম, আমাদের সাথে খেলতে আয় । এটা শুনেই আমাকে মেরেছে স্যার । আমার কোনো দোষ নাই ।

তুমি কিছুই বলনি? মারোনি ওকে?

না স্যার, বিশ্বাস করেন । আমি কিচ্ছু করিনি ।

তুমি বলো অপূর্ব, কী হয়েছিল?

অপূর্ব মাথা নিচু করে বসে থাকে, কথা বলে না ।

অন্য বাচ্চার মা বলে ওঠে, ও কী বলবে স্যার? অন্যায় করলে তো মাথা নিচু করেই বসে থাকতে হয় । এইসব ব্রোকেন ফ্যমিলির ছেলেমেয়েরা এমনই হয় । এরা বাড়িতে বাপমাকে মারামারি করতে দেখে । এদের বাড়িতে তো কোনো শান্তি নাই তাই বাইরে এসে গুন্ডামি করে ।

ছেলেটির বাবা ধমক দিয়ে মাকে থামিয়ে দেন । অপূর্ব’র ক্লাস টিচার এসে কথা বলেন এবার, কোনো কারণ ছাড়া মারামারি করার ছেলে অপূর্ব না । ওকে আমি এতো বছর ধরে দেখছি । অপূর্ব বল কী হয়েছিলো, বল বাবা? টিচার অপূর্ব’র মাথায় হাত রাখেন ।

মামুন যেয়ে ছেলের কাঁধে হাত রাখে । যা হয়েছে, সত্যটা বল বাবা ।

অপূর্ব এবার কথা বলে, বাবা ওদের একটা দল আছে । ওরা সবসময়ই ক্লাসে সবাইকে বিরক্ত করে । আমাকে সবসময় নষ্ট মায়ের ছেলে বলে ডাকে । আমি কখনো কিছু বলিনা বাবা । কিছু বলিনা দেখে আরো খারাপ কথা বলে । আজকেও আমাকে টিফিনের সময়ে খুব নোংরা কথা বলেছে । আমি উত্তর দেইনি দেখে পেছন থেকে জোরে ধাক্কা দিয়েছে আমাকে । তখন চোখের নিচে ব্যাথা পেয়েছি আমি । এরপর আমি ওকে ঘুষি মেরেছি বাবা ।

কথাবার্তা শেষে সবাই সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে বেরিয়ে এলো প্রিন্সিপাল স্যারের রুম থেকে । টিচারের পারমিশন নিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে স্কুল থেকে বের হলো মামুন । ওদের বাড়ি পৌঁছে তারপর কাজে যাবে । আজ যেন হঠাৎ ভীষন অভিমান হলো নিজের ওপর । মনে হলো সব কাজ ছেড়ে, দায়িত্বের বোঝা ঘাড় থেকে নামিয়ে দুরে কোথায় চলে যেতে পারলে খুব ভালো হতো । বাচ্চাদের কখনো বকাবকি করে না মামুন কিন্তু আজ ছেলের ওপরও রাগ হলো তার –

এগুলো না করলে কী হয় শুনি? দিন দিন কী হচ্ছে এসব? কেন তুমি মারামারি করতে গেলে?

বাবা, আমি মারামারি করতে যাইনি । ও আগে মেরেছে আমাকে । বাবার বকুনি খেয়ে খুব অভিমান হয় অপূর্ব’র ।

ঐ একই হলো । দিন দিন সবাই মিলে কঠিন করে দিচ্ছো আমার জীবনটা । তুমি টিচারকে বলতে পারতে ।

তুমি আমার সাথে রাগ করছো কেন বাবা? আমার কী দোষ!

কারো কোনো দোষ নেই, সব দোষ আমার ।

ব্যাংকে এসে মামুনের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো । ছেলেটার সাথে এভাবে কথা বলা উচিৎ হয়নি তার । এই বয়সের অভিমান খুব খারাপ জিনিষ । ভেতর ভেতর গুমড়ে কেঁদে মরবে তবু মুখে কিছু বলবে না । তার ছেলেটা এমনিতেই ভীষন মুখচোরা । অতটুকু বাচ্চা অনেক কষ্ট হজম করে ফেলে, একবারও বুঝতেই দেয় না তার কষ্টটা । খুব মন খারাপ করেছে বাচ্চাদুটো । আজ ওদের নিয়ে বেড়াতে যাবে কাজ থেকে ফিরে । অপূর্ব’র পছন্দের জায়গায় যাবে, ওর পছন্দের খাবার খাবে ।

বাসায় ফিরে অপূর্ব’র ভীষন কান্না পেলো । এর আগে অনেকদিন কাঁদেনি সে । যখন মা চলে গেছে তখন না, যখন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেখেছে, বাবা মন খারাপ করে বারান্দায় বসে আছে তখনো তার কান্না আসেনি । বাবা কেন তাকে বকা দিলো আজকে? বাবা কী জানে না কতো কষ্ট হয় তার? বাবা তো জানে না সবাই যখন তার মাকে নিয়ে হাসাহাসি করে, তখন তার খুব মরে যেতে ইচ্ছে করে…………..
/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here