রংধনুর রঙ কালো পর্ব ২৯

#রংধনুর_রঙ_কালো
২৯.

“আপনি তো পুরো জাত হারামি হয়ে গেছেন মি. অন্বয়!”, সোফিয়ার ঠাট বাক্য শুনে অন্বয়ের মুখ কঠিন হয়ে এলো। সে ফোনটা ভালো মতো কানের সাথে চেপে ধরে কঠিনভাবে বলল,” আপনার চেয়ে হারামিগিরি আমি কম করেছি। ”
” তাই নাকি?” সোফিয়া গাঁ জ্বালানো হাসি দিচ্ছে। অন্বয়ের মেজাজ তিরিক্ষ হয়ে উঠল। খিটমিট করে সে বলল,” আপনি কি কাজটা করবেন? নয়তো আমি ফোন রাখলাম।”
” আহা, এতো দাম দেখাচ্ছেন কেন? সুন্দর করে বললেই তো হয়। আমি ছাড়া এখন আপনার অন্যকোনো উপায়ও নেই। অযথা দাম দেখিয়ে কি লাভ বলুন?”
” ঠিকাছে সুন্দর করেই বলছি। আমি চাই না মিসেস অরিন আর মি. মাহদী কখনও এক হোক। সেই ব্যবস্থাই আপনাকে করতে হবে। এতে শুধু আমার লাভ নেই। আপনার নিজেরও লাভ আছে। আপনিই তো চেয়েছিলেন যাতে মিসেস অরিন ইলহান মাহদীর জীবন থেকে চলে যায়। এটা তো আপনার জন্যই ভালো তাই না? ইনফ্যাক্ট আমাদের দু’জনের জন্যই ভালো। আমি মিসেস অরিনকে নিয়ে ফিরে যাবো বাংলাদেশে। আর আপনি এখানে মি. মাহদীকে নিয়ে হ্যাপি থাকবেন। ডিল?”
” খুব সুন্দর প্রস্তাব। আপনার বুদ্ধিও আমার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয় অরিন চলে গেলেও ইলহান ওর পিছু ছাড়বে না। যদি সে নিজেও বেংলাডেশে চলে যায়?”
” এটা নিয়ে আপনি ভাববেন না। চাইলেও ইলহান মাহদী আর কখনও অরিনকে খুঁজে পাবে না।”
” কথা দিচ্ছেন?”
” হ্যাঁ দিচ্ছি।”
” ঠিকাছে। তাহলে আপনিও নিশ্চিন্ত থাকুন। যা চাইছেন সেটাই হবে। কিন্তু অরিন কি এতো সহজে বোকা হবে?”
” এটা নিয়েও আপনি ভাববেন না৷ আমি যা বলবো মিসেস অরিন সেটাই বিশ্বাস করবেন। তিনি এখন নিজের চেয়েও বেশি আমাকে বিশ্বাস করেন কি-না!”
” এতো নিশ্চিত কিভাবে হচ্ছেন আপনি? যদি বুঝে ফেলে?”
” বললাম তো বুঝবে না। ইংরেজিতে সেই নীতিবাক্যটা শুনেছেন? স্ট্রাইক দ্যা আয়রন হোয়াইল ইট ইজ হট। মিসেস অরিন এখন ঠিক বিগলিত লোহার মতোই। তাকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই বোঝানো যায়।”
” বাহ, আপনি নিজেও কিন্তু বিশ্বাসঘাতক হয়ে যাচ্ছেন।”
” মাঝে মাঝে বিশ্বাসঘাতক হতে অন্যায় নেই৷ তাছাড়া কোন মনিষী যেনো কখন বলেছিল? এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লভ এন্ড ওয়ার।”
” তাহলে তো কথাটা আমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ”
” অবশ্যই।”
সোফিয়া খিলখিলিয়ে হাসছে। অন্বয় ফোন রেখে অরিনের ঘরে এলো। অরিন টেনশনে এপাশ-ওপাশ করছে। ঘরের এ মাথা থেকে ওই মাথা শুধু হেঁটে বেড়াচ্ছে। তাকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। অন্বয় বলল,” এতো টেনশন করবেন না মিসেস অরিন। ভালো কিছুই হবে ইনশাল্লাহ। আমার মন বলছে, সব আগের মতো ঠিক হয়ে যাবে।”
অরিন চোখ-মুখ লাল করে বলল,” আপনি সোফিয়ার সাথে কথা বলেছেন?”
” জ্বী বলেছি।”
” সে আমাদের সাহায্য করতে রাজি হয়েছে?”
” হ্যাঁ হয়েছে। আমি তাকে হুমকি দিয়ে রাজি করিয়েছি।”
” কিসের হুমকি দিয়েছেন?”
” সে যে আপনাকে খুন করার চেষ্টা করেছিল এটা ইলহান মাহদীকে জানিয়ে দেওয়া হবে। এভাবে হুমকি দিয়েছি।”
অরিন একটু থমকে বলল,
” কিন্তু ইলহান তো এই কথা আগে থেকেই জানে।”
” হ্যাঁ। কিন্তু ইলহান যে জানে সেটা তো সোফিয়া জানে না।”
অরিন জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল। ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে বলল,” জেনে গেলে কি হবে?”
” কিছুই হবে না। আপনি অতিমাত্রায় টেনশন করছেন। পানি খান।”
অন্বয় খাটের এডজাস্ট টেবিল থেকে পানি ঢেলে অরিনকে। অরিন পানি খাওয়ার আগেই ফোন আসলো। ইলহানের নাম্বার। অরিন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো অন্বয়ের দিকে। অন্বয় ইশারায় বলল ফোন ধরতে। অরিন কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,” হ্যালো।”
” তুমি বাসায় কবে আসবে অরিন?”
” বললাম না কাল আসবো?”
ইলহান কণ্ঠে কাতরতা ঢেলে বলল,” কালকেই কেনো? আজকে কেনো নয়? এক্ষুণি কেনো নয়?”
” আমার একটু সময় দরকার ইলহান।”
” তুমি কি এখনও দ্বিধাগ্রস্ত? এখনও কি মন থেকে আমাকে ক্ষমা করতে পারোনি?”
” সেরকম না। আসলে আমার এমনিতেও স্বাভাবিক হওয়ার জন্য একটু সময় লাগবে।”
” তুমি বাসায় চলে আসো৷ শুধু বাসায় আসো। আমি তোমাকে ডিস্টার্ব করবো না। তুমি তোমার মতো অন্য ঘরে থেকো। প্রয়োজনে আমরা বাসা দুইভাগ করবো। একভাগে তুমি থাকবে, অন্যভাগে আমি। তোমার সমস্যা হবে না অরিন। প্লিজ চলে এসো!”
” তোমার এতো তাড়া কিসের ইলহান? বলছি তো আমি কাল আসবো। এতোদিন অপেক্ষা করেছো আর একটা দিন অপেক্ষা করতে পারবে না? দেখো তুমি যদি আরেকবার ফোন করে আমাকে জ্বালাও তাহলে আমি আর কখনোই আসবো না।”
অরিন আচমকা ফোন কেটে দিল৷ তার গলা চড়ে গেছে। কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থেকে সে অন্বয়কে প্রশ্ন করল,” সোফিয়া কখন যাবে ইলহানের বাসায়?”
” আজকে রাত আটটায়।”
অরিন দেয়াল ঘড়িতে তাকালো। বিকাল চারটা বাজে। আরও চারঘণ্টা। সে কিভাবে অপেক্ষা করবে এতো উৎকণ্ঠা নিয়ে? আজকে ইলহানের চরিত্রের চূড়ান্ত পরীক্ষা হবে৷ সোফিয়াকে যদি ইলহান ছুঁয়ে ফেলে তাহলে অরিন আর কোনোদিন ইলহানের কাছে ফিরে যাবে না। কিন্তু যদি সে সোফিয়াকে তাড়িয়ে দেয় তাহলে হয়তো অরিনের আর কোনো দ্বিধা থাকবে না ইলহানকে আগের মতো ভালোবাসতে।

ইলহান অনিচ্ছা সত্ত্বেও সোফিয়াকে বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছে। কারণ এসেই সোফিয়া ভীষণ কান্নাকাটি করছিল। আগে কখনও ইলহান তাকে কাঁদতে দেখেনি। দাড়োয়ানের সামনে মেয়েটার এমন আচরণে এক প্রকার বিব্রত হয়ে পড়েছিল সে। তাই তাকে ভেতরে এনে দরজা আটকে সবার প্রথমেই বলল,” কি বলতে চাও তারাতাড়ি বল। তারপর বিদায় হও। তোমার চেহারা আমি সহ্য করতে পারছি না।”
” কেন ইলহান? কেনো সহ্য করতে পারছো না আমাকে?”
এই কথা বলে সোফিয়া ইলহানের গালে হাত রাখলো। ইলহান তীব্র রাগে ফেটে উঠল। এক ঝটকায় সোফিয়ার হাত সরিয়ে বলল,
” কারণ তুমি ভালো করেই জানো। কি বলতে এসেছো ভালোয় ভালোয় বলে দ্রুত এখান থেকে বের হয়ে যাও। আমার মাথা গরম হওয়ার আগেই।”
” যদি না বের হই?”
” তোমাকে মেরে এখানেই পুঁতে রাখবো। কেউ জানতেই পারবে না মডেল সোফিয়া কিভাবে উধাও হলো।”
ইলহানের কণ্ঠে ভয়ংকর এক শীতলতা ছিল। সোফিয়ার গাঁ এক মুহুর্তের জন্য ছমছম করে উঠলো। ইলহান জীবনে কখনও মানুষ খুন করেনি। কিন্তু তার বাবা পিঁপড়ার মতো মানুষ মারতেন। সেই বৈশিষ্ট্য হঠাৎ ইলহানকেও পেয়ে বসবে না তার কি গ্যারান্টি আছে? সোফিয়া নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল। এখন ভয় পেলে চলবে না। সে এইখানে যে কাজের জন্য এসেছে সেই কাজটা তো করতেই হবে। সোফিয়া কোমলভাবে বলল,” ঠিকাছে, যদি এতোই ইচ্ছা থাকে মেরে ফেলার তাহলে মেরেই ফেলো। তোমার সাথে সারাজীবন বাঁচতে না পারলাম অন্তত তোমার হাতে মরতে চাই।”
ইলহানের ভীষণ মেজাজ খারাপ হলো।
” তুমি কি এইসব বলতেই এখানে এসেছো? জরুরী আলাপের বিষয়টা কি তাহলে মিথ্যে?”
সোফিয়া একটু সময় নিয়ে বলল,” অরিনকে ফোন করেছিলাম। সে বলল তোমাদের মধ্যে নাকি সব ঠিক হয়ে গেছে। অরিন নাকি কাল তোমার কাছে ফিরে আসছে। আবার নতুন করে তোমাদের সংসার শুরু হবে। তোমরা বেংলাডেশে ফিরে যাবে। আর কখনও কি অস্ট্রেলিয়া আসবে?”
” জানি না।”
“তোমাদের নতুন জীবনের জন্য আমার পক্ষ থেকে অভিনন্দন। ভালো থেকো তোমরা। আমি আর কখনও তোমাদের বিরক্ত করতে আসবো না।”
ইলহান মনে মনে অনেকটা চমকে গেল৷ সোফিয়ার মুখে এমন ধরণের কথা একেবারেই অবিশ্বাস্য। কিন্তু চেহারায় হতভম্ব ভাবটা প্রকাশ করতে চাইলো না ইলহান। গম্ভীর গলায় বলল,” থ্যাংকস। ”
সোফিয়া এবার ইলহানের একটু কাছে এসে বলল,” কিন্তু আমার একটা ইচ্ছে আছে। বলতে পারো তোমার কাছে শেষ আবদার।”
ইলহান কিছুটা উৎকণ্ঠা প্রকাশ করল,” কি?”
” আজকে রাতটা কি আমি এখানে থাকতে পারি? শেষবারের মতো? আর কখনও হয়তো চাইলেও দেখা হবে না। শুধু আজকে রাতের স্মৃতি নিয়ে আমি আমার পুরো জীবন এক নিঃশ্বাসে কাটিয়ে দিতে পারবো। বিশ্বাস করো।”
ইলহানের চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো। রাগে টগবগ করে উঠলো শরীরের রক্ত। এজন্যই তাহলে সোফিয়ার হঠাৎ পরিবর্তন? সে আসলে চাইছেটা কি?

রাত আটটা বাজতে বেশি সময় নেই। সোফিয়া নিশ্চয়ই বেরিয়ে পড়েছে এতোক্ষণে। অরিনের এই অবস্থায় খুবই ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে সে কোনো আসামী। এই মুহুর্তে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। এখনি সিদ্ধান্ত জানানো হবে তার ফাসি হচ্ছে নাকি যাবজ্জীবন? অরিন শুকনো গলায় ঢোক গিলে চোখেমুখে মালিশ করতে করতে বলল,
” আচ্ছা অন্বয় সাহেব, সোফিয়া যদি ধোঁকা দেয়? যদি কোনো ছলচাতুরী করে? ওকে তো আপনি চেনেন।”
” কিরকম ছলচাতুরীর কথা বলছেন? এখানে ছলচাতুরী করার কোনো চান্সই নেই। আপনি নিজের চোখে সবকিছু দেখতে পাবেন। সোফিয়া ওই বাড়িতে প্রবেশ করার সাথে সাথেই তার লকেটে যুক্ত ডিজিটাল ক্যামেরার মাধ্যমে ল্যাপটপের স্ক্রিনে ভেসে উঠবে সেখানকার দৃশ্য।”
অরিন ল্যাপটপের পর্দায় তাকালো। যে কোনো পরিস্থিতি সহ্য করার জন্য নিজের মনকে প্রস্তুত করে নিল। একটু পরেই ল্যাপটপে ভেসে উঠলো ইলহানের মুখ। সোফিয়াকেও দেখা যাচ্ছে। সে হয়তো তার লকেট এমন কোনো জায়গায় রেখেছে যাতে রুমের পুরো দৃশ্যটা ঠিকঠাক চোখে পড়ে। জায়গাটা ইলহানের বেডরুম। সিন সরাসরি বেডরুম থেকেই কেনো শুরু হলো? কথা ছিল সোফিয়া বাড়ির সম্মুখ দরজার কাছাকাছি আসতেই ওরা সবকিছু দেখতে পাবে। অরিন এই বিষয়ে অন্বয়কে প্রশ্ন করতে চেয়েও করল না। অন্বয় ওর পাশে নেই। এই ঘর থেকে অনেক আগেই বেরিয়ে গেছে সে। এখন যে দৃশ্য শুরু হবে সেটা অন্বয়ের দেখা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। অরিনের আত্মা ভেতর থেকে দ্রিম দ্রিম শব্দ করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কিছু হতে পারে না। সোফিয়া এখন ইলহানের সামনে পুরোপুরি উন্মুক্ত। ইলহানকে দেখে একটুও মনে হচ্ছে না যে সে মোহবিষ্ট। অরিনের কেনো যেনো ভেতর থেকে একটা অপ্রতিরোধ্য বিশ্বাস চলে আসলো যে ইলহান এবার সোফিয়াকে প্রত্যাখ্যান করবে। কিন্তু অরিনকে অবাকের চূড়ান্ত সীমায় পতিত করে সে সোফিয়ার আহবানে সাড়া দিল! অরিনের মস্তিষ্কের সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছিল। হৃদ দরিয়ায় শুরু হলো জলোচ্ছ্বাস। এক ধাক্কায় টেবিলের ল্যাপটপ ভেঙে ফেলল সে। দিলো একটা বিকট চিৎকার। দরজার বাহিরে থেকে অন্বয় স্পষ্ট শুনতে পেল অরিনের আহাজারি। তার ঠোঁটে ফুটল তৃপ্তির এক ঝলক হাসি। সোফিয়া সফল হয়েছে!

চলবে

– Sidratul Muntaz

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here