রইলো তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব -০২

#রইলো_তোমার_নিমন্ত্রণ।
[০২]

বেলকনিতে দাঁড়িয়ে নিকোটিনের ধোয়া উড়াচ্ছে আরাভ। দু-আঙ্গুলের মাঝে সিগারেট নিয়ে কিছুক্ষণ পর পর সেটা ঠোঁটের মাঝে রেখে লম্বাটান দিচ্ছে। এখন আর আগের মতো সিগারেট খাওয়া হয়না। ওই দিনে একটা কিংবা দুটো। অথচ বছর খানেক আগেও দিনে পুরো এক প্যাকেট সিগারেট লাগতো তার। সিগারেটটা ফেলে দু-হাতে মাথা চেপে বেলকনির ইজি চেয়ারে বসে আরাভ। একটা ভুল, মাত্র একটা ভুলের জন্যে কত কিছু হয়ে গেল। চেয়ারে হেলান দিয়ে দুচোখ বন্ধ করে নেয় আরাভ। তখন ওর সামনে এসে দাঁড়ায় অনিমা বেগম। মায়ের আগমনে চোখ মেলে তাকায় আরাভ। মায়ের দিকে কিছুক্ষণ শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। অনিমা বেগম এখানে কেন এসেছে সেটা তার অজানা নয়। এখন হয়তো ভূমিকে নিয়ে কথা উঠবে, ভূমি অনেক ভালো মেয়ে, সুন্দরী শিক্ষিতা ভদ্র তাহলে কেন সে ভূমিকে বিয়ে করতে চায়না ব্লা ব্লা। এই কয়দিনে অনিমা বেগমের সাথে আরাভের যতবার কথা হয়েছে ততবারই ভূমিকে নিয়ে কথা বলেছেন অনিমা বেগম। মায়ের মুখের অঙ্গভঙ্গি দেখে উঠে দাঁড়ায় আরাভ। না এখন সে ভূমিকে নিয়ে কোন কথাই বলতে চায়না। এমনিতেই এই মেয়ে যখন তখন তার কল্পনায় চলে আসে। এই মেয়ে থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল। বিড়বিড় করে বলল আরাভ,

” ডেঞ্জারাস মেয়ে একটা।”

আরাভ চলেই যাচ্ছিল তখন অনিমা বেগম বলেন,

” কাল ভূমির সাথে তোর বাগদানটা সাড়িয়ে নিব। কাজের বাহানায় কোথাও যাবি না বলে দিলাম।”

থমকে দাঁড়ায় আরাভ। ভ্র দ্বয়ের মাঝে ভাজ ফেলে প্রশ্ন করে,

” বাগদান, মানে কি?”

” তুই এতটাও ছোট নস যে বাগদান মানে জানিস না।”

” কিন্তু মা,,,,

” কোন কিন্তু টিন্তু জানি না। কাল তোদের বাগদান হবে মানে হবে। আর বাগদান মানেই তো বিয়ে নয়। বিয়ের জন্যে তোরা অনেক সময় পাবি। এই সময়টা দুজন দুজনকে দে। একে অপরকে ভালো করে জান। ভূমি খুব লক্ষি মেয়ে। ওর মতো জিবনসঙ্গী তুই কোথাও পাবি না।”

আরাভ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনে মনে আওড়ায়,
” তুৃমি কেন বুঝতে চাইছো না আমি আমার এই অনিশ্চিত জিবনে কাউকে জড়াতে চাইছি না। আমি চাইছি না ভূমির জিবনটা নষ্ট করতে। কিন্তু মুখে বলল,

” ভূমি রাজি হয়েছে?”

” হুম।

” ঠিক আছে কাল যাব আমি তোমার সাথে।” কথাটা বলেই রুম থেকে বেড়িয়ে যায় আরাভ।

পরন্তু বিকালে ফুটপাতের দিকে হাটছে আরাভ। পরনে ব্লু প্যান্ট আর সাদা টি-শার্ট। দুই হাত পকেটে গুজে আনমনে হাটছে সে। পকেটে থাকা মোবাইলটা তখন থেকে বেজেই চলেছে ধরার নাম নেই। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই একটা ব্রিজ। আর ব্রিজের উপর কয়েকটা ছেলেকে দেখলো সে। যারা নিজেদের মাঝে কিছু নিয়ে হাসি ঠাট্টা করছে। আরাভ কিছুক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো সন্দেহের দৃষ্টিতে। তারপর আবার সামনের দিকে হাটতে শুরু করলো। প্রকৃতিকে জ্যোতির অলংকার পড়িয়ে নিবিড় পায়ে সন্ধা নামে পৃথিবীতে। চারিদিকে হালকা আধার নেমে আসে। সেই আধার গাঢ় থেকে গাঢ় হতে হতে অন্ধকারে তলিয়ে যায় পৃথিবী। কুলায় ফিরা পাখিরা নিজ নিজ ঘরে ফেরে। ব্যাস্ত নাগরী ব্যাস্ত মানুষ বাড়ি ফিরে তাদের ব্যাস্ততার অবসান ঘটিয়ে। আরাভ তার নিজের একান্ত ব্যাক্তিগত ফ্ল্যাটে এসে চেয়ারে গা এলিয়ে দেয়। ভাবনায় ডুবে যায় কিছুক্ষণের জন্যে। তারপর ডাকে,

” তাহমিদ,,,,

পাশের রুম থেকে দ্রুত পায় তাহমিদ বেড়িয়ে আসে। আরাভের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

” তোকে এক অস্থির কেন লাগছে? সব ঠিকঠাক আছে তো?”

” না কিচ্ছু ঠিক নেই। মা আজকাল যা শুরু করে দিয়েছে তাতে আমার আর ভালো লাগছে না।”

” আন্টি আবার কি করলো?”

” এতদিন শুধু বিয়ের জন্যে চাপ দিয়েছে। আর এখন সোজা এনগেজমেন্ট। কাল নাকি আমার এনগেজমেন্ট? আমাকে ও বাড়িতে যেতে হবে।” বিরক্তিতে চ উচ্চারণ করে আরাভ। দু-হাতে মাথা চেপে ধরে। পরক্ষনেই বলে,

” এই ভূমি মেয়েটা তোর পরিচিত তাইনা। মেয়েটার নাম্বার জোগাড় করে দিতে পারবি?”

তাহমিদের মুখটা মলিন হয়ে যায়। বিষণ্ণমুখে পকেট থেকে মোবাইল বের করে দিয়াকে কল করে। তারপর দিয়ার কাছ থেকে ভূমির নাম্বার নিয়ে আরাভকে দেয়। আরাভ মোবাইলে নাম্বার উঠিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তাহমিদের কাঁধে হাত রেখে বলে,

” মন খারাপ করিসনা দোস্ত। সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখবি একদিন ওই,,,,, আচ্ছা বাকিরা কোথায় রে??” বলেই সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

____________________
কফির মগ নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ভূমি। গরম কফির মগ থেকে ধোয়া উড়ে সেটা মিলিয়ে যাচ্ছে বায়ুর সাথে। ভূমি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে কফির মগের দিকে। ক্যাফেইন জাতীয় খাবার খাওয়া তার নিষিদ্ধ। তবে আজকাল এই নিষিদ্ধ কাজগুলো করতেই ওর বেশ ভালো লাগে। এতে যেন আনন্দ পায় সে। এই যেমন কাল ওর ইনগেজমেন্ট হবে তাও আবার তারই শিক্ষকের সাথে যাকে কিনা কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিলো। এটা নিয়ে যেন ভূমির কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। অথচ কদিন আগেও আরাভকে বিয়ে করা নিয়ে তার মাঝে ছিলো কত সংশয়। ছাত্রী হয়ে কি করে শিক্ষককে বিয়ে করবে সে। মা-কে সে অনেক বুঝিয়েছে। স্যারকে বিয়ে করলে কলেজের সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। সে কারো হাসির পাত্র হতে চায়না। এত বুঝানোর পরেও তার মায়ের এক কথা। আরাভ ভালো ছেলে। হ্যাঁ মাঝে ভুল করে একটা কাজ করেছে তাই বলে ছেলে হিসাবে খারাপ নয়। তার পরিবারও ভালো। যেহেতু তারা চাচ্ছে আরাভের সাথে ভূমির বিয়ে হোক তাহলে তাই হবে। ভূমির ভাবনার মাঝেই ওর মোবাইলটা বেজে উঠে। আননোন নাম্বার। ভূমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে মোবাইলের দিকে। কপালে তার সুক্ষ্ম ভাজ। দুবার রিং হতেই কল রিসিভ করে ভূমি।

” আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?”

” ওয়ালাইকুম আসসালামু। আমি আরাভ। জুহায়িন আহমেদ আরাভ।”

” ওহ স্যার আপনি। হ্যাঁ বলুন,,,,

আরাভ কিছুক্ষণ চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর বলে,
” তুমিতো জানো,,, ওহ সরি তুমি করে বলে ফেললাম।”

” ঠিক আছে স্যার। তুমি করেই বলুন।”

” আমাকে বিয়ে করতে তোমার কোন আপত্তি নেই তো। দেখো কাল আমাদের এনগেইজমেন্ট। তুমি কি চাও এই এনগেইজমেন্টটা হোক?”

ভূমি নিরউত্তর। ভালো শ্রোতার ন্যায় আরাভের কথা শুনছে। কিন্ত প্রতিউত্তরে কিছু বলছে না। ভূমিকে চুপ দেখে আরাভ আবার বলল,

” দেখো, বিয়ে কোন ছেলেখেলা নয়। দুটো মানুষের সারাজীবনের ব্যাপার। আর কারো জিবন নিয়ে ছেলেখেলা করার সাধ্যি কারো নেই। তুমি জানো আমি ড্রাগ এডেক্ট। যার কারনে আমি কলেজ থেকে বহিষ্কার হয়েছি। রিহ্যাবেও থেকেছি। আচ্ছা এগুলো নিয়ে তোমার কোন আপত্তি নেই?”

এবার মুখ খুলল ভূমি। গলার স্বার নিচু করে বলল,
” একজন শিক্ষক হিসাবে আপনি বেষ্ট। ছেলে হিসাবেও তাই। তাহলে জীবনসঙ্গী হিসাবেও আপনি বেষ্ট হবেন। একটা মেয়ে হিসাবে এটাই আমার জন্যে যথেষ্ট। আর আপনি এক সময় ড্রাগ এডেক্ট ছিলেন। এখন তো নেই।”

” তাহলে বলছো এই বিয়ে নিয়ে তোমার কোন আপত্তি নেই।”

” আমার সময় চাই।”

” কাল তাহলে এইনগেজমেন্ট হচ্ছে?”

কোন জবাব না দিয়ে কল কেটে দেয় ভূমি। মোবাইলের দিকে একপলক তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলে,

” সরি স্যার, জানি আপনি আমাকে বেহায়া ভাবছেন। আমি যে নিরুপায়।

_______________________
লিভিং রুমে বসে টেলিভিশনে খেলা দেখছে তাহমিদ সোহান রেদওয়ান আর তুহিন। বাংলাদেশ নেদারল্যান্ডের লাইভ লেখা হচ্ছে। সামনে টেলিভিশনে লাইভ খেলা চললেও লিভিং রুম দেখে মনে হচ্চে এখানে ছোটখাটো টর্নেডো হয়ে গেছে। পুরো রুমজুরে টিপস্ পপকন আর সিগারেটের প্যাকেটের ছুড়াছুড়ি। আরাভ লিভিং রুমে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপকরে দাঁড়িয়ে থাকে। বরাবর পরিপাটি থাকা এই ছেলেটা বন্ধুমহলে এলে পুরো এলোমেলো হয়ে যায়। রুমে চোখ বুলিয়ে তাহমিদের পাশে গিয়ে বসলো আরাভ। তাহমিদ ওর আধো খাওয়া সিগারেট আরাভের দিকে বাড়িয়ে দিলো। আরাভ সিগারেটের দিকে তাকিয়ে বলল, ” মুড নেই।” সোহান টোন কেটে বলল,

” তা তোর পাত্রী কি এমন বলল যে, সিগারেটের নেশাও উরে গেলো।”

তুহিন বলল,
” হ্যাঁরে কি বলল ভূমি। বিয়েতে না করে দিয়েছে তো। আমি জানতাম এমনটাই হবে।”

আরাভ তুহিনের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
“ম্যাডাম বিয়েতে রাজি।”

ম্যাডাম, টোন কেটে বলল, রেদওয়ান। বাহ্ ছাত্রী থেকে পাত্রী। এখন আবার মেডাম। প্রেমে পড়েগেলে নাকি ব্রো।

” প্রেম।” অধোর চেপে বলল আরাভ। এটাও সম্ভব।”
” অসম্ভবের তোর কিছু নেই।”

আরাভ কিছু বলল না। কুশন বুকে জড়িয়ে খেলা দেখায় মনোযোগ দিলো। পাশ থেকে তাহমিদ বলল,
” রাতে এখানেই থাকবি আজ।”
” আছি।” বলেই চোখ বন্ধকরে নেয় আরাভ। আর তখনি চোখের সামনে ভেসে উঠে মিষ্টি কালার সেলোয়ার কামিজ পরিহিত এক যুবতী। মেয়েটা আরাভের সাথে কথা বলছে কিন্ত আরাভ মেয়েটার কোন কথাই শুনতে পাচ্ছে না। আরাভের চোখ স্থির হয়ে আছে আছে যুবতী মেয়েটার চোখে। গভীর কালো চোখের মনিতে আরাভ থমকে গেছে। অধোর ফুটে উঠে মৃদু হাসি। পাশে থাকা সবাই সন্দিহান চোখে তাকিয়ে আছে আরাভের হাসিমাখা মুখের দিকে।

চলবে,,,,,,
Mahfuza Afrin Shikha.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here