রইলো তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব -১৯+২০

#রইলো_তোমার_নিমন্ত্রণ।
[১৯]

আজ আর ফ্ল্যাটে যাওয়া হলোনা আরাভের। ক্লান্ত শরীরে নিজ বাড়িতে প্রবেশ করলো সে। অনিমা বেগম ড্রাইনিং পরিষ্কার করছিলেন এমন সময় কলিংবেলের শব্দ মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠে তার। ছেলের আগমনে উৎফুল্ল মন নিয়ে দরজা খুলে দেন তিনি। দরজার ওপাশে আরাভ দাঁড়িয়ে ছিলো। একহাত পকেটে অপর হাত দিয়ে কাধের উপর নিজের ব্লেজার ঝুলিয়ে রেখেছে। অনিমা বেগমকে দেখে আরাভ একগাল হেসে একহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে ভিতরে নিয়ে যায়। ড্রয়িংরুমে এসে অনিমা বেগমকে সুফায় বসিয়ে দিয়ে নিজে তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরে। অক্ষিদ্বয় বন্ধকরে বলে,
” মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাওনা মা, বড্ড ক্লান্ত লাগছে।

অনিমা বেগম হাসলেন। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন পরম যত্নে। মনে পরে সেই পুরনো দিনের কথা। আরাভ হুট করে মায়ের কোলে মাথা রেখে বলল, ” আমি আজ তোমার সাথে ঘুমাবো। তুমি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে গান শুনাবে।” অনিমা বেগম রাতভর ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে গান গেয়ে ঘুম পারাতো। আরাভের বাবা ছিলেন একজন নেভী অফিসার।কর্মসূত্রে তাকে দেশের নানা জায়গায় যেতে হতো। এমনকি দিনের পর দিন তিনি সাবমেরিনেও কাটিয়েছেন। তাই ছোটবেলা থেকে বাবার খুব একটা সঙ্গ পায়নি সে। ছোট্ট্ বেলা থেকা তারা মা-ই সুখ দুঃখের সাথী। অনিমা বেগম হাসলেন। তার ছেলেটা আজও বড় হলো না। এখনো ক্লান্তি অনুভব করলে মায়ের কোলে মাথা দিয়ে তাকে শুতেই বলে। অনিমা বেগম খেয়াল করলেন আরাভ এখানেই ঘুমিয়ে গেছে। শরীর অধিক ক্লান্ত থাকায় শোয়ার সাথে সাথে রাজ্যের ঘুম এসে ভর করেছে আরাভের দুচোখে।

পরেরদিন আরাভ কলেজে গেলেও ভূমির দেখা পেলো না। ভূমির নাম্বারে কল দিতেই তন্মর রিসিভ করে বলল,
” আপু আজ কলেজে যাবে না বলছে। আপুর নাকি মাথা ব্যাথা।”

” ঠিক আছে।” বলে কল কেটে দেয় আরাভ। ভূমি যে আজ কেন কলেজে আসেনি সেটা তার অজানা নয়। আসলে কালকের ব্যাপারটা নিয়ে সহজ হতে পারেনি। আরাভ পরপর নিজের ক্লাসগুলো করে বেড়িয়ে যাচ্ছিল, মনিরুল স্যারের কেবিনের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় একবার দাঁড়ালো সে। ঘাড় ঘুড়িয়ে ভিতরে দেখলো স্যার মনোযোগ দিয়ে লেপটপে কিছু একটা করছে। আজকাল মনিরুল স্যারের উপর তার বেশ সন্দেহ হয়।মনে মনে ভাবে, স্যার নিজেকে যতটা সহজ দেখায় আধোও কি সে ততটা সহজ সরল।” দাঁড়ায় না আরাভ। বাহিরের দিকে চলে যায়। মাঠ পেড়িয়ে যাওয়ার সময় দিগন্তকে দেখলো একটা ছেলের সাথে কথা বলছে। আরাভ ভ্রু কুঁচকে সে দিকে তাকালো। দিগন্ত দীর্ঘসময় ধরে ছেলেটার সাথে কথা বলে কলেজের ভিতরে চলে গেলো। আরাভ সবটা লক্ষ করলো কিন্তু কিছু বলল না। ততক্ষণ তুহিন তাকে একটা মেসেজ দিয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে ফ্ল্যাটে যেতে হবে। জরুলি তলপ না হলে তুহিন তাহমিদ সোহান তাকে ডাকে না তাই সে কোন দিক না ভেবে ফ্ল্যাটের দিকে রওনা দেয়।

প্রায় পনেরো মিনিট পর ফ্ল্যাটে এসে পৌঁছায় সে। তাদের স্পেশাল রুমের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখে তাহমিদ পিসির সামনে বসে আছে আর বাকি দুজন দুপাশ থেকে। তিনজনে মিলে কিছু দেখছে পিসি তে। আরাভ সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে তাহমিদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” এটা দেখ।”
আরাভ বসে পরলো তাহমিদের জাগায়। পিসিতে স্পষ্ট দৃশ্যমান প্রায় দশ মিনিট আগে ডেথ আর কিং এর কথোপকথন। সেখানে কিং লেখেছে,
” এই অফিসারটা বেশ ঝামেলা করছে। একে শেষ করতে হবে।” নিচে লেখা, KING.

ডেথ এর ওপাশ থেকে রিপ্লাই এলো,
” ডিটেকটিভ বয়ের থেকেও আরাভ বেশী ভয়ংকর, ওকে ফলো করো।” নিচে লেখা, DEATH.

“সরি মিস্টার ডেথ, আজ এই অফিসারের শেষ দিন হবে। আপনার কথা মানতে পারলাম না। আমি আজ একে প্রানে মেরে দিবো।” নিচে লেখা, KING.

আরাভ উঠে দাঁড়ালো। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ডিটেকটিভ বয় নামটা। এই নামটা সে কোথাও শুনেছে। কিন্তু কোথায় মনে পরছে না। অনেক্ষন ভেবেও যখন মনে করতে পারলো না। তখন আবার বসে পরলো। তাহমিদ বলল,
” এখন উপায় কি? ডিটেকটিভের প্রাণ সংশয়।”

ডেথ এর ভাবনায় দিগন্তের কথা ভুলেই গিয়েছিলো আরাভ। এই অভি যে আজ দিগন্তের সাথে ঝামেলা করবে এটা নিশ্চিত। মানুষের প্রান নেওয়াটা এদের কাছে খেলা বৈ কিছুই নয়। দিগন্তকে কল করে সাবধান করতে হবে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দিগন্তের নাম্বারে কল করলো কয়েকবার। কিন্তু দিগন্ত রিসিভ করলো না। তাই বাধ্যহয়ে আরাভ বেড়িয়ে পরে কলেজের উদ্দেশ্যে। যে করেই হোক দিগন্তের প্রান বাঁচাতেই হবে।

__________________________
এদিকে মনিরুল ইসলাম কাজ শেষ করে হাত ভাজ করে তার উপর চিবুক ঠেকিয়ে লেপটপের সামনে বসে আছে। অভিকে নিষেদ করার পরেও সে কোন কথা শুনলো না। অভি যে দিগন্তকে এ্যটাক করবে এটা নিশ্চিত সে। তবে যেই হোক দিগন্ত মরবে না হয় অভি। যার প্রাণ যাক তাতে তার কিছু যায় আসেনা। এমনিতেই কদিন পর তার কাজ শেষ হলে অভিকে ছুড়ে ফেলে দিত মনিরুল। আরাভ হয়তো তার সমন্ধে জেনেগেছে এতক্ষণ। এবার তার কাজ শেষ করতে হবে। তারপর সবাইকে নিজের গোলাম বানাবে। এই দেশের সরকার যাবে তার হাতের মুঠোয়। সে যা চাইবে তাই হবে। সকলকে দিয়ে তার গোলামি করাবে। নিজের উদ্দেশ্য সফলের কথা ভেসে শয়তানি হাসি হাসে মনিরুল ইসলাম।

দিগন্ত গাড়ি নিয়ে কলেজ থেকে কিছুদূর আসতেই অভি তার বাইক নিয়ে দিগন্তের গাড়ির সামনে দাঁড়ায়। দিগন্ত কিছু বুঝে উঠার আগেই অভি বাইক থেকে নেমে দিগন্তের দিকে রিভালবার তাক করে। ভ্রুকে কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে বিরক্ত সহকারে গাড়ি থেকে নামে দিগন্ত। নিজের রিভালবার অভির দিকে তাক করে বলে,
” সমস্যা কি তোমার? পথ আটকে দাঁড়িয়েছ কেন?”

” তোর প্রাণ নিবো তাই।”

” মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিসের পাগলামি করছো?”

” কোন পাগলামি না অফিসার। সেদিন তুই আমার ভাইয়ের পায়ে গুলি করেছিস। আজ আবার তার পিছু নিয়েছিস। তোর জন্যে কোন কাজ করতে পারছিন।”

” ওও আচ্ছা, তাহলে তুইও ডেথ এর গোলাম। নে শ্যুট কর। দেখি তোর কত দম।”

দিগন্ত অভির পা বরাবর শ্যুট করে। অভি শ্যুট করবে এমন সময় পিছন থেকে আরাভ এসে অভির গলা চেপে ধরে যার ফলে অভি লক্ষভ্রুষ্ট হয়। আর গুলি লাগে গাড়িতে। আরাভ অভির নাক মুখ বরাবর কয়েকটা ঘুসি দিতেই দিগন্ত এসে অভিকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,

” আরাভ কন্ট্রোল। এদের শাস্তি আইন দিবে।”

আরাভ বলে,
” ঠিক বলেছেন ডিটেকটিভ, এই নরকের কিটের উপর হাত দিয়ে নিজের হাত নোংরা করাটা একদম বোকামি।”

দিগন্ত পুলিশকে কল করে। কিছুক্ষণ পর পুলিশ ভ্যান এসে অভিকে নিয়ে যায়। আর আরাভ দিগন্তের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
” বের হতে লেট করলেন যে?”

” মনিরুল ইসলাম স্যারের সাথে কথা বলছিলাম।”

মনিরুল ইসলাম নামটা শুনতেই আরাভের মনে পরলো উনার ডাক, ডিটেকটিভ বয়। আরাভের ভ্রু কুঁচকে এলো। তার সন্দেহ সোজা মনিরুল ইসলামের দিকে। আচ্ছা আরাভ নিজে ভুল নয়তো। এভাবে কোন প্রমান ছাড়া মনিরুল ইসলামকে সন্দেহ করাটা কি ঠিক হচ্ছে। দিগন্তের কথায় ঘোর কাটলো আরাভের।
” আপনি কি সবটা জানতেন?”

আরাভ প্রসন্ন হাসলো। তারপর বলল,
” ভুলে যাচ্ছেন ডিটেকটিভ, আমি হ্যাকিং গ্রুপ লিড করি।”

” ধন্যবাদ, আমার প্রান বাচানোর জন্যে।”

আরাভ হাসলো কোন জবাব দিলোনা। তারপর দুজন দুজনকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো।

_______________________
ঘড়ির কাটা বারোটা ছুঁইছুঁই। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোয়া উড়াচ্ছে আরাভ। দু আঙ্গুলের ফাকে সিগারেট রেখে সেটা মাঝে মাঝে নিজের অধোরে ছুয়াচ্ছে আর ভূমির কথা ভেবে চলেছে। আজ সারাদিনে একবারও ভূমির সাথে দেখা কিংবা কথা হয়নি তার। অথচ এমন ফিল হচ্ছে যেন কত জনম ধরে তাদের দেখা হয় না।বুকের বা পাশটা চাপা ব্যাথায় আর্তনাদ করছে। চিনচিন ব্যাথা করছে বেশ অনেক্ষন ধরে। দূর আকাশে মিটিমিটি জ্বলতে থাকা তারার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো আরাভ। তারপর বলল,

” আজ আমার মনের অব্যক্ত কথাগুলো আমি তোমার কাছে দিলাম আমার নিলাদ্রিতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে। আমরা তো একই আকাশের নিচে আছি তাহলে সে নিশ্চয় বুঝবে এই নিগাঢ় কালো অন্ধকারের কাছে নিরবে বলা আমার অনুভূতি গুলো।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরাভ। মনটা বড্ড ছটফট করছে। একবার, শুধু একবার যদি তার নীলাদ্রিতার কন্ঠশ্বর শুনতে পেতো তাহলে হয়তো একটু শান্তি পেতো। কিন্তু এত রাতে তাকে কল করে কথা বলাটাও সম্ভব না। তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে। বেলকনি ছেড়ে রুমে আসলো আরাভ। বিছানা হাতরে মোবাইলটা হাতে নিলো। এখন ভূমিকে কল করে বলতে ইচ্ছে করছে,
” আচ্ছা নীলাদ্রিতা, তুমি কি আকাশে আমার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাও? শুনতে কি পাও আকাশের কাছে বলা আমার অব্যক্ত কথাগুলো। অনুভব করতে পারো আমার হৃদয়ের আর্তনাদ।”

ভূমির নাম্বারে ডায়াল করেও কেটে দিলো। মোবাইলটা বিছানায় রেখে মাত্র বিছানায় গা এলিয়েছে অমনি সোহানের হাক পরলো। আকস্মিক এমন ডাকে চমকে উঠে আরাভ। দ্রু বিছানা ছেড়ে চলে আসে তাদের তৈরী করা স্পেশাল রুমে। সামনে পিসির দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো, পিসিতে জ্বলজ্বল করছে, ডেথ কলিং।
আরাভ হেডফোন কানে নিয়ে পিসির সামনে বসে পরলো। কল রিসিভ করে হ্যালো ডেথ বলতেই ওপাশ থেকে ডেথ বলল,
” কেমন সারপ্রাইজ দিলাম জুহায়িন আহমেদ আরাভ।”

আরাভের মুখের অভিব্যক্তির কোন পরিবর্তন হলো না। সে জনতো ডেথ তার পরিচয় জানে। আরাভ বলল,
” কেন এমন মৃত্যর খেলা খেলছো ডেথ?”
” ডেথ এর কাজই হলো মানুষের প্রান নিয়ে খেলা।”
” কি চাই তোমার? কেন নষ্ট করছো তরুন সমাজ। কি ক্ষতি করেছে তোমায় এই মানুষগুলো। তুমি অনেক ট্যালেন্ট ডেথ। তোমার এই প্রতিভা তুমি ভালো কাজে ব্যবহার করো দেখবে সবাই তোমায় মাথায় করে রাখবে। ছেরে দাও এই মৃত্যু খেলা।”
ডেথ হাসলো।শব্দ করে হাসলো। তারপর বলল,
“আমার যেটা চাই সেটা তো আমি নিবোই আরাভ। আর মাত্র দুটো দিন।”
” কি করবে তুমি? আতঙ্কিত কন্ঠে বলল আরাভ।
” গোলাম বানাবো। এই দেশের সবাইকে আমার গোলাম বানাবো। তুমি কিচ্ছু করতে পারবে না আরাভ।”
” এত রাগ তোমার এই দেশের প্রতি। যে দেশ তোমায় আলো দিয়ে ছায়া দিয়ে বড় করেছে সেই দেশকে তোমার গোলাম বানাবে। এতটা অকৃতজ্ঞ তুমি ডেথ।”
ডেথ হাসলো ব্যাঙ্গাত্বক হাসি তার।চোখমুখ শক্তকরে বলল,
” কৃতজ্ঞতা! কোন দেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের কথা বলছো তুমি আরাভ। যে দেশে সত্যি বলার জন্যে জিবন দিতে হয়। ক্ষুদার তাড়নায় দুটো বাচ্চাকে চুরি করতে হয়। এই দেশের মানুষ বাড়ির কুকুরকে ভালোভালো খাবার দেয় অথচ একটা ক্ষুধার্ত বাচ্চার দিকে তারা ফিরেও তাকায় না। এই দেশের প্রতি তুমি কৃতজ্ঞতা থাকার কথা বলছো।”

আরাভ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। ডেথ যে তার ব্যাক্তিগত ক্ষোপ থেকে এমন ভুল করছে সেটা বুঝতে বাকি রইলো না তার। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
” তোমার ব্যক্তিগত ক্ষোভের কারনে এতগুলো মানুষের প্রান নিয়ে খেলবে তুমি। এই মানুষগুলো তোমার কি ক্ষতি করেছে?”
” দেশের মানুষ! যতদিন না দেশের মানুষের উন্নতির হচ্ছে ততদিনে দেশের উন্নত সম্ভব নয়। একটা দেশ তখনি উন্নতির শিখরে পৌঁছাবে যখন দেশের মানুষের মনের উন্নতি হবে।”
আরাভ ভেবে পায়না এমন সুশিক্ষিত মানুষ কি করে এমন জঘন্য কাজ করতে পারে। আরাভের ভাবনার মাঝে ডেথ বলল,
” একটা গল্প শুনবে আরাভ। গ্রামের এক স্কুল শিক্ষক ও তার ছেলের গল্প। শুনবে?”

চলবে,,,,,,,,,

#Mahfuza Afrin Shikha.#রইলো_তোমার_নিমন্ত্রণ।
[২০]

প্রাইমারি স্কুলের অংকের শিক্ষক ছিলো এক বাবা। মা ছিলো গৃহিণী। বাবা যেমন সৎ ন্যায়পরায়ণ ছিলো তেমন ছিলো স্পষ্টভাষি। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে দু’বার ভাবতো না সে। সব সময় সত্যের পথে চলেছে অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নত করতো না সেই বাবা। বাবার আদর্শ মেনে বড় হতে লাগলো তার দুই সন্তান। ছেলে যে বছর ক্লাস ফাইভে আর মেয়ে থ্রিতে সে বছর গ্রামের কলেরা রোগ আসে। গ্রামের প্রায় অর্ধেক মানুষ কলেরায় মারা যায় সেই সাথে মারা যায় সেই আদর্শবান বাবা মা’। রেখে যায় তাদের দুই সন্তান। চাচা চাচি সন্তান দুটোর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো সাথে নিলো গ্রামবাসী। একবেলা খাবারের জন্যে গ্রামের সকলের ধারে ধারে ঘুরলো ছেলেটা। ছেলেটা না হয় বড়, বোন। বোনটা তো ছোট ছিলো। পেটের জ্বালায় মেয়েটা কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে যেত। দু’দিন পর চাচা চাচি ক্ষুদার্থ দুই বাচ্চাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। কারন, ছেলেটা তার চাচির হাড়ি থেকে ভাত চুরি করে বোনকে খাইয়েছিলো। সেদিন সন্তানদুটো বাবা মায়ের কবরের পাশে বসে কান্না করলো। গ্রামের একজন মানুষও তাদের দিকে ফিরে তাকায়নি। অন্নতুলে দেয়নি। ক্ষুধার গ্রামের এক বাড়িতে রাখলের কাজ করলো ছেলেটা। রাতের বেলা দুই ভাইবোনকে এক প্লেট ভাত দিলো। দু’জনেই সেই ভাত খেয়ে রাতে মাটিতে ঘুমিয়ে যায়। তিনদিন সেই বাড়িতে রাখালের কাজ করার পর তারাও কাজ থেকে তাড়িয়ে। অসহায় হয়ে পরে ছেলেটা। ছোট্র বোনটাকে নিয়ে কোথায় কার কাছে দাঁড়াবে সে। গ্রাম ছেড়ে চলে আসে তারা। তারপর তারা দু’জনেই অনাথ আশ্রমে আশ্রয় পেলো। ছয়মাস পর শহরের এক ধনী ব্যবসায়ী আসে অনাথ আশ্রমে। যার কোন সন্তান ছিলোনা। একটা বচ্চার জন্যে তিনি অনাথ আশ্রমে আসেন আর সেখানে ব্যবসায়ী লোকটার বউ মেয়েটাকে পছন্দ করে। মেয়েটাকে তারা নিয়ে যেতে চাইলে মেয়েটা যেতে চায়না। তারা মেয়েটাকে ভালো খাবার ভালো পোষাক আর ভালো স্কুলের লোভ দেখায় তাতেও রাজি করাতে পারেনা। মেয়েটার এক কথা সে তার ভাইকে ছাড়া যাবে না। কিন্তু ওই লোকগুলো তো একটা বাচ্চা নিতে এসেছিল সেখানে দুজন তারা নিবে না। মেয়েটাকে একা নিবে। মেয়েটা একা যাবে না। অবশেষে মেয়েটার জেদের কাছে হার মেনে তারা ছেলেটাকেও সাথে নেয়। তারপরের সময়গুলো ভালোই কাটছিলো। একবছর, একবছর পর থেকে তাদের পালিত বাবা বদলে যেতে লাগে। দু ভাইবোনকে অপমান করতো। এটা নিয়ে তাদের পালিত মায়ের সাথে খুব ঝগড়া হলো। তারা মাঝে মাঝেই ঝগড়া করতো। ওরা দু ভাইবোন দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনতো আর ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে থাকতো। তাদের পালিত বাবা আর তাদের মানতে চাইতো না।তাদের আশ্রমে ফিরিতে দিতে চাইতো। তাখন তাদের পালিত মা আর তার মধ্যে খুব ঝগড়া হয়। এতটাই ঝগড়া হয় যে তাদের পালিত বাবা তার উপর হাত তুলে। এভাবেই চলে ছয় সাত মাস। তারপর একদিন রাতে ঘুম থেকে উঠে ছেলেটা দেখে বাড়ি ভর্তি মানুষ। বাড়িতে এত মানুষের কারন বুঝতে পারলো না। তাই সামনে এগিয়ে যায় সে। বসার ঘরে আসতেই দেখে তাদের পালিত মা মেঝেতে পরে আছে। হ্যাঁ রাতেই স্ট্রোক করে সে মারা গিয়েছিলো। সেদিন খুব রেগে গিয়েছিল তাদের পালিত বাবা আর দুভাইবোনকে পরে খুব মেরেছিলো।”

নরম আবেগ জড়ানো কন্ঠে কথাগুলো বলল ডেথ। ডেথ এর চোখ জ্বলজ্বল করছে।গলায় কথাগুলো আটকে গেছে।আর কোন কথা সে বলতে পারছে না। আরাভ বলল,
” গ্রামের লোকগুলো তোমার সাথে যা করেছে সেটা অন্যায়। তাই বলে তুমি নিরিহ মানুষের সাথে যা করছো সেটা কি ঠিক। কেন এতগুলো মানুষের প্রান নিলে তুমি। কি দোষ করেছিল ইশান মিমি দিয়া ইমাদ। গ্রামের ওই মানুষগুলোর সাথে তোমার পার্থক্য রইলো কই? আর ভূমি? তার অপরাধ কি ছিলো। কেন সকলের সামনে ওর সম্মান নষ্ট করলে। তুমি যানো এটা রিতিমতো সে*ক্সওয়াল হ্যারেজমেন্ট।”

আরাভের কথাশুনে শব্দকরে হাসলো ডেথ। ফোনের অপর পাশ থেকে সেই হাসি বিদঘুটে শুনালো। ডেথ তার গলার স্বর করো কঠিন করে বলল,
” যে ছেলেটা মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তার পালিত বাবার যৌ*ন চাহিদার শিকার হয়েছে তাকে তুমি সে*ওয়াল হ্যারেজমেন্ট শেখাচ্ছো। ।”

” মানে? কি বলতে চাইছো তুমি?”

” আগে পুরো গল্পটা তো শুনো। মাঝখানে এত প্রশ্ন করলে হয় নাকি। ছেলেটার পালিত মায়ের মৃত্যর পর ওই নরপিশাচটা ছেলেটাকে দিয়ে তার শারীরিক চাহিদা মিটিয়েছে। যন্ত্রনায় ছটফট করেছে ছেলেটা। কত চিৎকার করেছে তার চিৎকার শুনার মতো কেউ ছিলো। তখন শুধু চিৎকার করে ছেলেটা তার মৃত্যু চাইতো। মেয়েটার কথা মনে হতেই পারেনি সে নিজের জিবন শেষ করতে। ছেলেটা না থাকলে যে মেয়েটাও এই নরপিশাচের শিকার হবে। শেষ রক্ষা আর হলো না। একদিন বাজারে গিয়েছিলো ছেলেটা , বাড়ি ফিরে দেখে তার বোনের রক্তাক্ত দেহ। ওই নরপিশাচ মেয়েটাকেও ছাড়েনি। মদ খেয়ে বারো বছরের একটা মেয়েকে রে*ব করে। বোনের রক্তাক্ত দেহ দেখার পর ছেলেটা ঠিক ঠিক করলো ওই নরপিশাচকে নিজ হাতে খুন করবে। করলও সেটাই। সেদিন, সেই মুহূর্তে ছেলেটার হাতে খুন হলো তার পালিত বাবা । আর বোনকে নরেন কাকার সাহায্যে হাসপাতালে নেয় । বাড়িতে সবাই যখন ছেলেটার পালিত বাবার মৃত্যর কারন জানতে চাইলো তখন ছেলেটা অনায়াসে মিথ্যে বলে দিলো, বাড়িতে ডাকাত এসেছিল, ডাকাতের দল তার পালিত বাবাকে খুন কর সব নিয়ে পালিয়েছে।” বিশ্বাস করো আরাভ, সেদিন সেই মিথ্যে শুনে সবাই ছেলেটার প্রতি সহানুভূতি দেখালো কতজন ছেলেটাী মাথায় হাত রেখে তাদের জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করলো। ছেলেটা সেদিন-ই বুঝেছিল, এই পৃথীবিতে বাচতে হলে, ভালো নয় খারাপ কাজ করে মিথ্যারে আশ্রয়ে বাচতে হবে।” একটা মিথ্যে ছেলেটাকে সবার সামনে ভালোমানুষ বানিয়ে দিলো। আর ছেলেটার ভিতরের থাকা খুনি মানুষটাকে কেউ জানতেই চাইলোনা। তারপর থেকেই ছেলেটা প্রতিজ্ঞা করলো, বাচতে হলে খারাপ মানুষ হয়ে বাচবে আর সবাইকে তার হাতের মুঠোয় নিয়ে নাচাবে।

” তোমার বোন এখন কোথায়?”

” সেই ঘটনার চারদিন পর বোন হসপিটালেই মারা যায়।”

আরাভের এখন কি বলা উচিৎ বুঝতে পারলো না। তাই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো সে। ডেথ এর সাথে যেটা ঘটেছে সত্যিই খুব খারাপ হয়েছে। এটা ওর প্রাপ্য ছিলো না। ডেথ ও বাকি সবার মতো পরিবার নিয়ে ভালো থাকতে পারতো। আরাভ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
” তোমার সাথে যেটা হয়েছে সেটা সত্যিই অন্যায়। তাই বলে তুমিও কি তোমার গ্রামের ওই পঙ্চাতের লোকেদের মতো করবে। এতগুলো মানুষের প্রান নিয়েও কি তোমার এই প্রতিশোধ পূর্ণ হলো না। আর ভূমির সাথে যেটা করেছো তাতে তো তোমার আর তোমার পালিত বাবার মাঝে কোন পার্থক্য দেখছি না আমি। ডেথ একখনো সময় আছে আইনের কাছে নিজেকে সমর্পণ করো, তহলে হয়তো তোমার শাস্তি কিছু কম হবে। না হলে মৃত্যু যেদিন তোমায় দু হাতে ডাকবে সেদিন কোন নিস্তার নেই।আর সেই দিনটা খুব তাড়াতাড়ি আসবে।”

” ওসব নীতিকথা আমাকে শুনিয়ে লাভ নেই আরাভ। আমি অকারনে কারো প্রান নেইনি। একটু ভালো কিছুর জন্যে তো জিবন দিতেই হবে। স্বপ্ন দেখার বয়সে স্বপ্নকেই হাড়িয়েছি আমি। তাহলে অন্যকে স্বপ্ন দেখতে দিবো কেন? তোমাকে চব্বিশঘন্টা সময় দিলাম। পারলে নিজের দেশকে বাঁচিয়ে নাও।”

কথাগুলো বলেই কল ডিসকানেক্ট করে দিলো ডেথ। আরাভ হেডফোন খুলে বাকি সবার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর সবাইকে ডেথ এর কথাগুলো বলল। সব শুনে তাহমিদ বলল,
” তাহলে মিমির মৃত্যুটা,,,,
” এক্সপেরিমেন্ট। আসলে একটা মানুষকে কি পরিমাণ দ্যা ফরবিডেন ড্রা*গ দেওয়া যাবে তার এক্সপেরিমেন্ট করেছিলো ডেথ। তাই এ ডেথ এটাকে ভালো কাজ বলেছিলো।”

তুহিন বলল,
” দ্যা ফরবিডেনের পরিমাপ তাইতো।”

” হ্যাঁ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে “দ্যা ফরবিডেন” ড্রা*গ এর প্রচলন ছিলো। তারা এই ড্রা*গ ব্যাবহার করে শত্রু নিধন করতো। সামাজিক ধন্ধ এক দেশের সাথে আরেক দেশের ধন্ধ, এসব কারনে তারা এই ড্রা*গ ব্যাবহার করতো। তখন প্রায় দু লক্ষ মানুষের প্রাণহানি হয় এই ড্রা*গের কারনে। আসলে তারা জানতো না এই ড্রা*গ কি পরিমান ব্যাবহার করা যেতে পারে। তাই এত মানুষের মৃত্যু। পরে যখন এই ড্রা*গ নিয়ে গবেষনা করা হলো তখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই ড্রা*গ ব্যাবহার নিষিদ্ধ করা হলো। এবং এই তথ্য গোপন করা হলো। কারন এই ড্রা*গ সামান্য পরিমান ব্যবহারের ফলেই মানুষ তার ভারসাম্য হাড়িয়ে ফেলে। সে আর নিজের মধ্যে থাকে না। যন্ত্রে চালিত মানব হয়ে যায়। তাকে দিয়ে যে কোন কাজ করানো সম্ভব নয়। মানে রোবটের মতো আর কি। আর পরিমানের বেশী ব্যবহারের ফল ততক্ষণিৎ মৃত্যু। তখনকার সময় মানুষ নিজের কাজ হাসিল করার জন্যে এই ড্রা*গ অন্যের উপর প্রয়োগ করতো। যার ফলে মারামারি কাটাকাটি গেলেই থাকতো। তাই মাত্র দু মাসের মধ্যে এই ড্রা*গ কে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়। ইশান মিমি আর কুড়িজন ছেলের মেয়ের মাধ্যমে ডেথ এই ড্রা*গের এক্সপেরিমেন্ট করেছে।”

একদমে কথাগুলো বলে থামলো আরাভ। মাথার চুলগুলো উপরের দিকে ঠেলে লম্বা শ্বাস নিলো। সোহান বলল,
” ডেথ তো চব্বিশঘন্টা সময় দিলো। আচ্ছা এই ডেথ করতে চাইছে কি?”

তাহমিদ বলল,
” ইচ্ছে করছে একে এখুনি গলা টিপে হত্যা করি।

তুহিন আরাভের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
” কি ভাবছিস? এখনো পযন্ত এই ডেথকে শনাক্ত করতে পারলাম না। ওর মাথায় কি চলছে সেটা জানবো তো দূর।”

আরাভ উঠে দাঁড়াল। সবার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
” কাল সকালের মধ্যে হয়তো ডেথ এর পরিচয় পাবো। এবার তোরা যায় ঘুমিয়ে পর। এত টেনশন করিস না। কাল অনেক কাজ করতে হবে।”

আরাভ টেবিল থেকে চাবি নিয়ে বলল,
” আমার বের হচ্ছি। আজ আর ফিরবো না।”

আরাভ বেড়িয়ে যায়। বাকি সবাই ওর চলে যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঘুমাতে যায়।

_________________________
ঘড়ির কাটা রাতের দুটো বাজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। আরাভের বাইক এসে থামলো ভূমির বাড়ির সামনে। ভূমির বেলকনি বরাবর দাঁড়িয়ে কল করলো ভূমির নাম্বারে। ভূমি তখন গভীর ঘুমে নিমগ্ন। বিছানায় কম্পনের ফলে ঘুম ভাঙে তার। ঘুম ঘুম মোবাইল হাতরে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শুনতে পেল,
” আমি ক্লান্ত, বড্ড তৃষ্ণার্থ। একটু তোমার সঙ্গ চাই। নীলাদ্রিতা, তোমার প্রেমের পরশে আমার ক্লান্ত মনটাকে একটু শান্ত করে দিবে। আমি অপেক্ষা করছি। প্লিজ নিচে এসো।”

কল কেটে দেয় আরাভ। ভূমি মোবাইল হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে। আসলে ঘুমের ঘোরে আরাভের কথাগুলো বুঝতে পারেনি। আর যখন বুঝতে পারলো তখন উঠে তাড়াতাড়ি বেলকনিতে চলে যায়। রাস্তার পাশে বাইকের উপর বসা যুবকটাকে তার চিনতে অসুবিধা হলো না। রুমে এসে একটা উড়না গলায় জড়িয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়।

ভূমি আরাভের কাছে এসে দাঁড়াতেই আরাভ বাইক থেকে নেমে ভূমির কোমড় জড়িয়ে ওকে কাছে টেনে নেয়। ঠোঁটে আলতো চুমু খেয়ে বলে,
” অনেক কেঁদেছো?

ভূমি কথা বলল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আরাভ ভূমির চিবুক ধরে মুখটা উচু করে বলল,
” মাথা নিচু করে উঁচু করে দাঁড়াও। তুমি কোন ভুল করোনি নিলাদ্রিতা। আর আমার সামনে কখনো মাথা নিচু করে দাঁড়াবে না। তোমার সামনে মাথা নত করবো আমি। এবার উঠতো। বাইকে বস।”

আরাভ ভূমিকে ছেড়ে বাইকে গিয়ে বসলো। ভূমি বলল,
” কোথায় যাবো?”
” জানিনা। দু’চোখ যেদিকে যা চলে যাবো। আমি আমরা মুক্ত পাখি ন্যায় ডানা জাপ্টাবো। চলে যাব দূর থেকে বহু দূরে।”

চলবে,,,,,,,,,,,
#Mahfuza Afrin Shikha.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here