রইলো তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব -১৭+১৮

#রইলো_তোমার_নিমন্ত্রণ।
[১৭]

কারো চিৎকারের আওয়াজ শুনে সব শিক্ষক-ই ক্লাস ছেড়ে বাহিরে বেড়িয়ে আসে। কোথা থেকে চিৎকারের আওয়াজ শুনা যাচ্ছে খুঁজতে সবাই এদিক ওদিক দেখতে থাকে। কলেজের পূর্বপাশে নতুন তৈরী হওয়া বিল্ডিং এর থেকে কারো চিৎকারের আওয়াজ শুনা গেলে সবাই সেইদিকে ছুটতে থাকে। নতুন বিল্ডিং তৈরী হচ্ছে সব জায়গায় রড সিমেন্ট কাঠ ফেলে রাখা, তার উপর দিয়ে হেটে যাচ্ছে সবাই। তিনতলায় আসতে একটা ছেলেকে বেহুস হয়ে পরে থাকতে দেখে আরাভ দ্রুত পায়ে সামনে এগিয়ে যায়। প্রিন্সিপ্যাল সহ বাকি স্যারেরা হতবাগ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বেহুস হয়ে পরে থাকা ছেলেটার পাশেই হাটুগেরে বসে আছে দিগন্ত। তার পাশেই পরে আছে তার রিভালবার। দিগন্তের চোখ মুখে হতাশার ছাপ স্পষ্ট। আরাভের দিকে করুন চোখে তাকালো। আরাভ দিগন্তের চাহনি উপেক্ষা করে বলল,
” আপনি এই ছেলেটাকে শ্যুট করে দিলেন ডিটেকটিভ?”

” আমি শ্যুট করিনি। ওর নিজের লোকই ওকে শ্যুট করেছে।”

” নিজের লোক মানে। কি বলতে চাইছেন ডিটেকটিভ বয়।” সব স্যারের মাঝখান থেকে মনিরুল ইসলাম এগিয়ে এসে বলল। দিগন্ত তখন সবার দিকে একপলক তাকিয়ে বলতে শুরু করলো,

” আমি যখন কলেজ থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছিলাম তখন দেখলাম একটা ছেলে কলেজের ভিতরে প্রবেশ করছে। আমার ছেলেটাকে সন্দেহ হলো তাই আমি তার পিছু করতে করতে এখানে চলে আসলাম। এখানে এসেই দেখলাম সেই ছেলেটা এই ছেলেটাকে কিছু দিচ্ছে। আমি ওদের দিকে বন্ধুক তাক করে বললাম, ” একপাও নড়বে না, না হলে শ্যুট করে দিবো।” ছেলেদুটো বিষ্ময় চোখে আমার দিকে তাকালো। আমি এক পা করে এগোচ্ছি তখনি ছেলেটা আমার পা বরাবর শ্যুট করে।আমি খেয়াল করতেই অন্যদিকে সরে যাই সেই সুযোগে ছেলেটা পালিয়ে যায়। তবে এই ছেলেটা পালাতে পারেনা। আমি তাকে ধরে ফেলি। এবং তাকে জেড়া করতেই সে কিছু বলতেই যাচ্ছিলো অমনি এই ছেলেটার ঘাড়ে এসে গুলি লাগে। আমি তাৎক্ষণিক আশেপাশে তাকাতেই কাউকে দেখতে পাইনি।”

কথাগুলো বলে থামে দিগন্ত। মনিরুল ইসলাম ছেলেটার নাকের নিচে হাত রাখে তারপর পার্লস চেক করে বলে,
” হি ইজ ডেড।”

দিগন্ত বলল,
” আমি পারছি না, এই ডেথ এর সাথে কিছুতেই পেরে উঠতে পারছিনা। আজ আরো একজন নির্দোষের প্রান গেলো।”

আরাভ এতক্ষণ চুপচাপ সবটা লক্ষ করছিলো। এবার বলল,
” এই ডেথ খুব চালাক। আমার মনে হয় আপনি এই ডেথ পর্যন্ত সহজে পৌঁছাতে পারবেন না ডিটেকটিভ। আপনাকে আরো অনেক পরিশ্রম করতে হবে।”

মনিরুল ইসলামের মুখ যেন উজ্জল হলো। নিজেই নিজেকে বাহবা দিতে লাগলো। আসলে নিজের নামে প্রশংসা শুনতে কার ভালো না লাগে। সে বলল,
” সত্যিই এ ডেথ এর ক্ষমতা আছে বলতে হবে। এর কাছে পৌঁছানো অনেক কঠিন।”

আরাভ ভ্রু কুঁচকে তাকালো মনিরুল ইসলামের দিকে। আরাভের কেন যেন মনে হলো মনিরুল ইসলাম ডেথ এর প্রশংসা করছে। কিছুক্ষণ মনিরুল ইসলামের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো। পাশ থেকে প্রিন্সিপ্যাল স্যার বললেন,
” আপনারা যে যার ক্লাসে যান। আমি পুলিশকে খবর দিচ্ছি।পুলিশ এসে ডেড বডি নিয়ে যাবে।”

আরাভ কিছু বলবে তার আগেই মনিরুল ইসলাম দিগন্তকে বলল,
” আমার এখন ক্লাস নেই। আপনি আসুন আমার সাথে ডিটেকটিভ বয়। আপনার এখন বিশ্রাম প্রয়োজন।”

দিগন্ত না করতেই যাচ্ছিল মনিরুল ইসলাম জোর করে তাকে নিয়ে চলে গেলো আরাভ বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মনিরুল ইসলামের চলে যাওয়ার দিকে। আজ স্যারকে একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে স্যার আজ বেশ খুশী।

দিগন্তকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে এক গ্লাস ঠন্ডা পানি দিলো পান করতে। দিগন্ত এক নিঃশ্বাসে পুরোটা শেষ করে। মনিরুল ইসলাম সামনের চেয়ারে বসলো। দিগন্ত উশখুশ করছে এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্যে। এখন তাকে ডিপার্টমেন্টে যেতে হবে।মনিরুল ইসলাম দিগন্তের সামনে এক প্যাক কেক রেখে বলল,
” আপনাকে দেখে ক্ষুধার্থ মনে হচ্ছে। কেকটা খেয়ে নিন। আমার এখানে আর কিছু নেই। আপাদত এটা দিয়েই ক্ষুধা নিবারণ করুন।”

দিগন্ত বলল,
” না না স্যার। তার কোন প্রয়োজন নেই। আমি এখন আসছি। আমাকে একটু ডিপার্টমেন্টে যেতে হবে।”

” আরে ডিটেকটিভ বয়। রিল্যাক্স। বসুন আপনি। কেকটা আমার নিজের হাতে বানানো। খেয়ে বলুন কেমন হচ্ছে। আর আপনার ডিপার্টমেন্টে আমিও যাচ্ছি।”

দিগন্ত এমনিতেই ক্ষুধার্থ।সকাল থেকে এ পর্যন্ত মাত্র এক কাপ কফি খেয়েছে। মনিরুল ইসলামের অনুরোধ রাখতে এক টুকরো কেক মুখে পুরে দেয়। কেকের উপর কামড় বসাতেই দিগন্ত চোখ বন্ধকরে ফেলে। তারপর বলে, “ওয়াও জাস্ট এম্মেজিং।” মনিরুল ইসলাম হাসলো। দিগন্ত কেক চিবুতে চিবুতে বলল,
” আপনি বোধহয় রান্নাটা অনেক ভালো করেন।”

“এটা আমার হবি।” মৃদু হেসে বলল মনিরুল ইসলাম।

তারা আরো কিছুক্ষণ কথা বলে দু’জনেই ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

______________________
পিসির সামনে মাথায় হেডফোন গুজে বসে আছে আরাভ। তার ডানপাশে তাহমিদ বা পাশে তুহিন আর পিছনে সোহান। তারা সবাই মিলে “স্টিবেন গোমস্” নামের একটা আইডি হ্যাক করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। স্টিবেন গোমস্’ গত হয়েছে প্রায় কুড়ি বছর আগে তবে তার আইডি এখনো চালাচ্ছে তার সহকারীরা। স্টিবেন গোমস্’ তিনি-ই একমাত্র ব্যাক্তি যে কিনা এই “দ্যা ফরবিডেন” ড্রা*গ সম্পর্কে সব তথ্য জানতেন। তিনি তার আইডিতে অত্যন্ত গোপন ভাবে সব তথ্য রেখে দিয়েছেন। এবং এগুলো রক্ষা এবং গবেষণার জন্যে অনেক সাইন্টিস্ট নিয়োজিত করেছেন। আরাভ এখন এই স্টিবেন গোমস্ এর আইডি হ্যাক করার চেষ্টা করছে। আর কিছুক্ষণ পরে হয়তো সফলও হবেন ঠিক এই সময়ে পিসির উপর একটা নাম ভেসে উঠে” ডেথ কলিং” সবাই আশ্চর্য হয়ে একে অপরের দিকে তাকায়। ডেথ কল করেছে কেন? তাহমিদ বলল, “ডেথ এর কল রিসিভ করা উচিৎ।” সোহান তাহমিদের কথায় তাল মিলিয়ে বলল,” আমারও তাই মনে হচ্ছে। মনে হয় ডেথ কিছু বলতে চায়।” আরাভ সবার মতামত নিয়ে হেড ফোন খুলে কলটা রিসিভ করে লাউডস্পিকার দেয়। তখন ওপাশ থেকে ডেথ বলে উঠে,

” তোমরা আমার ইনফোরমেশন বাহিরে টান্সফার করছো। ঠিক করোনি। এর দাম তোমাদের দিতে হবে। ডেথ কাউকে ছাড়ে না।”

আরাভ কিছু বলবে তার আগই কল ডিসকানেক্ট হয়ে যায়। তুহিন বলল,
” এই ডেথ এর মাথায় এখন চলছেটা কি?”

” খবর কোথাও না কোথাও থেকে লিংক হচ্ছে। আমাদের আরো সাবধানে চলতে হবে। আর হ্যাঁ এখন কোন তথ্যই বাহিরে লিংক করা যাবে না।” বেশ গম্ভীর হয়ে কথাগুলো বলল আরাভ।

আরাভের কথার গুরুত্ব বুঝিয় দিলো ওর গম্ভীরতা আর চোখের দৃঢ়তা। কেউ আর এই বিষয় নিয়ে কথা বলল না। সবাই আবার আগের কাজে মনোযোগ দিলো। কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেদের কাজে সফলও হলো তারা। তবে তারা দ্যা ফরবিডেন নিয়ে যে তথ্য পেলো সেটা অবিশ্বাস্য ছিলো। এমনও ড্রা*গ থাকতে পারে। এতটা ভয়ংকর কোন ড্রা*গ হতে পারে কি!”

এরপর কেটে গেছে সপ্তাহ খানেন। মনিরুল ইসলাম প্রতিমুহূর্ত একটা কথাই ভেবে যাচ্ছে, এই স্টার গ্রুপ কার হতে পারে। এই কলেজের কেউ হতো হতে পারেনা। এই কলেজে ওর চেয়ে ভালো কম্পিউটার শিক্ষা কেউ জানেনা। তাহলে কে হতে পারে। এসবের মাঝেও অভিকে বলছিলো দিগন্তের উপর নজর রাখতে। একদিক অভি এসে খবর দিলো এই শহরে দিগন্তের কেউ নেই। তবে সে একদিন ভূমিদের বাড়ি গিয়েছিল। ব্যাস, মনিরুল ইসলাম পেয়ে গেলো স্টার গ্রুপের লোক বের করার উপায়। মনে মনে বলল, সরি মিছ আমাইড়া হাসানাত ভূমি। এই দিগন্তের জন্যে তোমাকে রেফার করতে হবে।

এর মধ্যেই শুরু হলে কলেজে সেমিনার। রেজাউল করিম নামের এক বিজ্ঞানি আসবে কলেজে। রেজাউল করিম একজন নিউক্লিয়ার সাইন্টিস্ট। তিনি নতুন নতুন অস্ত্র নির্মানের কাজ করেন। যেগুলো বাহিরে শত্রুর হাত থেকে নিজ দেশ রক্ষার কাজে ব্যবহার করা হয়ে। এবার সেমিনারে তিনি তার নতুন স্পেশাল তৈরী করা অস্ত্র নিয়ে আলোচনা করবেন। রেজাউল করিম এসে সেমিনারে আলোচনা করলেন এবং এই কলেজের স্টুডেন্ট থেকে আরো অনেক কিছু শিখলেন তিনি। তার চলে যাওয়ার সময় হঠাৎ একটা বিকট শব্দ হয়। চারিদিকের লাইট অফ হয়ে। সবাই যখন নিজ নিজ মোবাইলে ফ্ল্যাশ জ্বালাতে ব্যাস্ত। ঠিক সেই সময় বড় পর্দায় আলোর দেখা মিলল এবং চারিদিকে আবার আলোকিত হলো। সবাই উৎসুক নিয়ে তাকালো পর্দার দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে পর্দার মধ্যে ফুটে উঠলো একটা মেয়ের ছবি। কয়েকটা ছেলে মেয়ের মুখ থেকে বেড়িয়ে আসলো, ভূমি। এটাতো ভূমির ছবি।” সবাই যখন পর্দার দিকে তাকিয়ে ভাবছে কি হতে চলেছে তখন পর্দায় ভেসে উঠলো আরাভ আর ভূমি কিছু ঘনিষ্ঠ ছবি। সেদিন রেস্টুরেন্ট আরাভ ভূমিকে জড়িয়ে ধরেছিলো সেই ছবি। তার কিছু মুহূর্ত পর ভূমির কয়েটা শর্ট ড্রেস পরা ছবি ভেসে উঠলো। চারিদিকে যখন ভূমিকে নিয়ে হায়হায় করছে। ভূমি নিজের কান্না চাপাতে মুখে হাত দিয়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে গেলো। আরাভ এতক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সব দেখছিলো। আসলে এমন কিছু হতে পারে সেটা তার ধারণার বাইরে ছিলো। আরাভ দ্রুত তার লেপটপ অপেন করলো। কিছুক্ষণ টাইপিং করার পর যেটা দেখলো সেটা তার রাগ হলো। ডেথ এমন একটা কাজ কি করে করতে পারলো। তারপর দ্রুত আবার টাইপিং করতে লাগলো। যে করেই হোক এই ছবি এখনি সড়াতে হবে। একি এত নরমাল কোড ব্যবহার করা। তারমানে এটা ডেথ এর প্ল্যান, স্টার গ্রুপকে সামনে আনার জন্যে এটা ডেথ এর প্ল্যান ছিলো। দু আঙ্গুল দিয়ে কপালে স্লাইড করতে লাগলো আরাভ। কি করবে এখন। এই মুহূর্তে ডেথ এর সামনে যাওয়া মানে নিজের কাজ অসম্পূর্ণ রাখা। কিছুক্ষণ ভেবে উঠে দাঁড়ালো আরাভ। যা হবে পরে দেখা যাবে এই মুহূর্তে ভূমির সম্মান আগে বাঁচাতে হবে। আরাভ দ্রুত হাত চালিয়ে ছবিগুলো বন্ধকরে দিলো। তারপর নিজের লেপটপ অফ করে দৌড়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে গেল। দূর থেকে মনিরুল ইসলাম আরাভকে দেখে মৃদু হেসে বলল,

” আরাভ, তারমানে ড্রা*গ গ্রুপ আরাভ লিড করে। আর ডিটেকটিভ বয়কে খরব লিংক আরাভ করে। এবার খেলা জমবে তাহলো।” মুখ থেকে মিচ শব্দ করে আফসোসের সূরে বলল, মাঝখান থেকে বেচারি ভূমির সম্মান নষ্ট হলো। তবে যাই হোক এই মেয়েটা আমার কাজ সহজ করে দিবে। ” ক্রুর হাসলো সে।

চলবে,,,,,,,,

#Mahfuza Afrin Shikha.#রইলো_তোমার_নিমন্ত্রণ।
[১৮]

দ্রুত পায়ে হাটছে আর চোখের পানি মুছছে ভূমি। কান্না করতে কারতে চোখ নাক লাল হয়ে গেছে। এবার সে হেচকি তুলে কান্না করছে। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই ছবিগুলো। এভাবে কেউ কাউকে নিয়ে কি করে মজা করতে পারে। এখন তো সবাই তার চরিত্রের দিকে আঙ্গুল তুলবে। আরাভকে নিয়ে সবাই তাকে নানা কথা শুনাবে।কিন্তু সবাই তো আর তাদের সম্পর্কের কথা জানেনা, তাছাড়া তারা বিবাহিতও নয়। কি করে মুখ দেখাবে সে কলেজে। সবাই একটাই কথা বলবে, ছাত্রী হয়ে শিক্ষকের সাথে নোংরামি করে বেড়ায়। আরাভ নিয়ে সবাই বাজে কথা বলবে। না ভূমি পারবে না এসব সহ্য করতে আর এই মুখও কাউকে দেখাতে পারবে না সে। এলোমেলো পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আর মনে মনে হাজারো কথা ভাবছে ভূমি। একটা ব্রিজের কাছে এসে পা থামিয়ে দেয় ভূমি। চারিদিকে একবার দেখে ব্রিজের কিনারায় এসে দাঁড়ায়। ব্রিজের নিচে পানি ঢেও খেলছে তার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নৌকা। মাঝিরা নদী থেকে ঝাল তুলছে। ভূমি গভীর দৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর ধীর পায়ে ব্রিজের উপর উঠে দাঁড়ায়। আর তখনি ওর পাশে এসে দাঁড়ায় আরাভ আর দিগন্ত। আরাভের পা থমকে গেছে। মাথা শূন্য, কাজ করা বন্ধকরে দিয়েছে। শুধু ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে ভূমির দিকে। দিগন্তের ও একই হাল। ওরা দু’জনেই ভূমিকে খুঁজতে বেড়িয়ে ছিলো। দারোয়ানকে জিগ্যেস করে এদিকে চলে আসে। ভূমি তার চোখ বন্ধকরে এক পা সামনের দিকে বাড়িয়ে দিলো আর তখনি আরাভ ওকে টান দিয়ে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। আকস্মিক ঘটনায় চমকে উঠে ভূমি। চোখ খুলে নিজেকে এক সুঠাম দেহের সাথে নিজেকে আবিষ্কার করে। ভূমির বুঝতে বাকি নেই এটা কে হতে পারে। ভূমি দু-হাতে আরাভকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পরে। আরাভ ভূমির মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে। ততক্ষণ দিগন্ত গাড়ি থেকে একটা পানির বোতল এনে আরাভের হাতে দেয়। আরাভ ভূমিকে ছাড়িয়ে ওকে একটু পানি খাইয়ে দেয়। ভূমির কান্না থেমে গেছে তবে মাঝে মাঝে হেচকি তুলছে। আরাভ দিগন্তের হাতে পানির বোতল দেয়। তারপর ভূমির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,

” পালিয়ে এলে কেন? তুমি কি কোন ভূল করেছো? তাহলে পালিয়ে এলে কেন?”

দিগন্ত বলল,
” এখন থাকনা। এমনিতেই অনেক কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা। এখন আবার আপনি বকবেন নাকি?”

আরাভ দিগন্তের দিকে একবার তাকিয়ে ভূমির কাঁধে হাত রাখলো। ভূমির চোখ থেকে অঝোর ধারায় আবার জল গড়াতে লাগলো। আকস্মিক আরাভের বুকের উপর খামচে ধরে বলতে থাকে,
” কেন বাঁচালে তুমি আমায়। এই মুখ আমি কাউকে দেখাতে পারবো না। সবাই তোমাকে আমাকে নিয়ে নোংড়া কথা বলবে। না, আমি এসব সহ্য করতে পারবো না। আমি আর বাচতে চাইনা। মরে যাব আমি। মরে যাব।”

ভূমি আবার ব্রিজের উপর উঠতে যাবে তখন আরাভ ওর দু কাঁধে হাত রেখে চিৎকার করে বলতে থাকে,
” কি বললি তুই মরে যাবি। তুই মরে গেলে সবটা সমাধান হবে। তখন সবাই তোকে নিয়ে আরো বাজে কথা বলবে। তুইতো কোন ভুল করিসনি, সব দোষ করেছে ওই ডেথ। তাহলে তুই কেন নিজের প্রান প্রান দিবি।”

ভূমি চমকে আরাভের দিকে তাকালো। আরাভ ওর সাথে তুই তুকারি করছে। কথা বলার ভাষা হাড়িয়ে ফেলল সে। আরাভ ভূমির হাত ধরে বলল,
” চল,,,,

” কো-কোথায়?”

” যোগ্য জবাব দিতে।” তারপর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বলল, “গাড়ি ঘোরান ডিটেকটিভ।”

ভূমি নিজের হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বলল,
” আমি যাব না। ওখানে সবাই তোমাকে নিয়ে নোংরা কথা বলবে। আমি এটা শুনতে পারবো না।”

” ভালোবাসি তোকে আমি।”

” ছাত্রী হয়ে শিক্ষকের সাথে প্রেম করছি সবাই এটাই বলবে। ভালোবাসাটা কেউ দেখবে না।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরাভ। তারপর ভূমির গালে হাত রেখে কোমল কন্ঠে বলে,
” তোমাকে ভালোবেসে তোমার সমস্ত সুখের দায়িত্ব নিয়েছি আমি। তোমার সম্মান রক্ষার দায়িত্বও আমার। চলো এবার।”

ভূমি কিছু বলতেই যাচ্ছিল, আরাভ ভূমির ওষ্টে নিজের তর্জনী বসিয়ে ওকে চুপ করিয়ে দেয়। তারপর হাত ধরে টেনে গাড়ির পিছন সিটে বসিয়ে দিয়ে নিজে তার পাশে বসে। দিগন্ত ড্রাইভ করছে। কিছুক্ষণের মধ্যে কলেজ ক্যাম্পাসে উপস্থিত হয় আরাভ ভূমি দিগন্ত।চারিদিকে সবাই আরাভ আর ভূমিকে হায়হায় করছে। সেসবে পাত্তা দিলো না আরাভ। আরাভ ভূমির হাত ধরে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে আর দিগন্ত পিছন পিছন যাচ্ছে। আরাভ ভূমিকে নিয়ে সোজা স্টিজের উপর উঠে যায়। ভূমিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে মাইক্রোফোন হাতে নেয়। সবার দৃষ্টি আরাভ আর ভূমির উপর। আরাভ বলতে শুরু করলো,

” সাইলেন্স, সাইলেন্স এভরিওয়ান। আমি প্রথমেই আমার আর ভূমির সম্পর্ক নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।”

অন্য ডিপার্টমেন্টের একজন স্টুডেন্ট বলে উঠলো,
” আপনার আর কি বলার আছে। শিক্ষক হয়ে ছাত্রীর সাথে নোংরামি করেন। আমরা আপনার কোন কথাই শুনবো না।”

আরাভ হাসলো। শব্দকরে হাসলো। তারপর বলল,
” নোংরামি, কোনটাকে বলছো নোংরামি। ভালোবেসে একদিন প্রিয়মানুষটাকে নিয়ে ডিনারে যাওয়া যদি নোংরামি হয়। তাহলে দিনের পর দিন হোটেলে মেয়েদের নিয়ে রাত কাটানোটাকে কি বলে।” ছেলেটার মুখ চুপসে গেল। সে আমতা আমতা করে কিছু বলতে চাইলো। আরাভ আবার বলতে শুরু করল,

” আজ যেটা ভূমির সাথে হয়েছে কাল সেটা আপনাদের যে কারো সাথে হাতে পারে। তাই বলছি আগেই কেউ কোন মন্তব্য করবেন না।, দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো আরাভ। আবার বলতে শুরু করলো, ” ভূমি আমার ফিওন্সে। আজ থেকে প্রায় তিন মাস আগে আমাদের এইনগেজমেন্ট হয়েছে। তারপরেই আমরা ভালোবাসার সম্পর্কে বাধা পরি। আমার ডিপার্টমেন্টের প্রায় সবাই এটা জানে। এখন কথা হলো, ভালোবেসে আমি আমার বাগদত্তাকে নিয়ে ডিনারে যাব, লং ড্রাইভে যাবো, তাকে জড়িয়ে ধরলো আদর করবো নাকি চুমু খাবো সেটা সম্পূর্ণ আমাদের ব্যাক্তিগত ব্যাপার। কিছুক্ষণ আগে পর্দায় আমার আর ভূমির যে ছবি ছিলো সেটা আমাদের প্রথম ডেট এর। আচ্ছা এখানে এমন কেউ আছেন, যে তার ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে একটু স্পেশাল সময় কটাতে চাননা। সবাই চায়, আমিও চেয়েছি। আমাদের কি কোন প্রাইভেসি নেই, আমার ব্যাক্তিগত ভালোবাসার মুহূর্তগুলো কেন সবার সামনে তুলে ধরা হলো। আর সেই ছবি দেখে আপনারা বলছেন আমরা নোংরামি করছি। আরে নোংরামি তো তখন হত যখন আমরা আমাদের একান্ত ব্যাক্তিগত সময় সবার সাথে শেয়ার করতাম। যে মানুষটা তার কু-রুচি নিয়ে আমাদের প্রাইভেসি নষ্ট করলো তাকে ঘৃনা না করে আমাদের ঘৃনা করছেন। একটা মানুষ কতটা অমানবিক, মনুষ্যত্বহীন বিকৃতমস্তিষ্কের মানুষ এবং কু-রুচি সম্পন্ন হলে এভাবে কারো প্রাইভেসি নষ্ট করতে পারে।কই একবারও তো তার কথা জানতে চাইলেন না। আচ্ছা এই ঘটনা তো আপনাদের সাথেও ঘটতে পারতো। আপনাদের আর কি দোষ বলুন, সময়টাই এখন এমন। একটা ইস্যু পেলেই হলো। আগাগোড়া কিছু না জেনে সেটা টেনে লম্বা করাই আমাদের কাজ।”

এটুকু বলেই থামলো আরাভ। অন্য আরেকজন বলে উঠলো,
” বুঝলাম মেয়েটা আপনার ফিয়ন্সে। কিন্তু ওই ছবিগুলো?”
” ওগুলো সব ফেইক। এডিটিং করা।”

উপস্থিত সকলে কানাঘুষা শুরু করলো। এক পর্যারে তাদের নিয়ে আর কেউ বাজে মন্তব্য করলো না। সবাই ওদের আগামি জিবনের জন্যে শুভকামনা জানতে লাগলো। তখন আরেকজন বলল,
” কিন্তু এই ঘটনা তো মেয়েটার মনে সাইড ইফেক্ট তৈরী হবে। মেয়েটা কি ভুলতে পারবে।”

আরাভ ভূমিকে আরো শক্তকরে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। তারপর বলে,
” পারবে। ভুলতে পারবে। একটা ঘটনা ভুলার জন্যে অন্য একটা ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই পারে।”

এই বলে আরাভ ভূমির সামনে হাটুগেরে বসে নিজের হাতটা বাড়িয়ে। আর বলে,
” নীলাদ্রিতা,
মাছরাঙার নীল ছুঁয়ে নীল শাড়িতে তুমি,
তোমার চপল চোখের রক্তিম ঠোঁটের হাসিতে ঝরে পরে দুস্পাপ্য নীল জোছনা। নীল বসনে তুমি, নীলে ভরা সুন্দর।তুমি মরক্কোর নীল শহরে, নীলের রাজত্বে পূর্নিমার নীল চাঁদ।তুমি বসন্তের নীলমনি লতা, তুমি গ্রীষ্মকালের নীলচে ‘লোবেলিয়া’।তুমি নীল তাপসী, নীল মনিহার, নীল আকাশের নীলাঞ্জনা।তোমার নীলিম শাড়ির আঁচলের ভাঁজেলুকানো কবির নীল কবিতা। আই লাভ ইউ নীলাদ্রিতা।”

ভূমি আরাভের হাতের উপর নিজের হাত রেখে হাটুগেরে বসে পরলো। আরাভ ভূমির হাতের নিজের অধোর ছুইয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর ভূমির কপালে নিজের অধোর ছুঁইয়ে ভূমিকে ভূমিকে জড়িয়ে ধরলো। আর চারিদিক থেকে ভেসে আসলো করতালির আওয়াজ।

__________________
আরাভ আর দিগন্ত দুজনে ভূমিকে বাড়ি পৌছে দেয়। তারপর আবার দুজনে একই গাড়ি করে ফেরার পথে রওনা দেয়। আরাভ ড্রাইভ করছে আর দিগন্ত পাশের সিটে বসে আছে। আরাভ ড্রাইভ করলেও ওর মাথায় ঘুরছে নানা ভাবনা। দিগন্ত এতক্ষণ নিজের চিন্তায় মশগুল থাকলেও এবার খেয়াল করলো আরাভের দিকে। আরাভের ড্রাইভিং এ মন নেই সেটা সহজেই সে বুঝতে পারলো। ভ্রু কুচকালো দিগন্ত। সামনে তাকিয়ে আতকে উঠলো।দ্রুত স্টিয়ারিং ঘুড়িয়ে দিলো। চমকে উঠলো আরাভ।পাশ ফিরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল আর একটু হলেই হতে পারতো বড় কোন এক্সিডেন্ট। ভাগ্যিস দিগন্ত ঠিক সময় খেয়াল করছিলো। আরাভ স্টিয়ারিং ধরে বড় বড় করে শ্বাত নিতে চলল। কি হলো তার, এমন খামখেয়ালি তো সে কখনোই করে না। আর একটু হলেই বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেত। দিগন্তের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলো। তবে দিগন্ত সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আরাভের দিকে। কিছুক্ষণ পর দিগন্ত বলল,

” কি এত ভাবছেন?”
” তেমন কিছু না।”
” কেইস সম্পর্কে কিছু হলে আমায় বলতে পারেন। যদি আমি আপনায় কোন সাহায্য করতে পারি।
দিগন্ত এক হাসে কপালে স্লাইড করলো। তারপর বলল,
” আচ্ছা একটা কথা বলুন তো ডিটেকটিভ।”
“হ্যাঁ বলুন।”
” দ্যা ডেথ এলিমেন্ট” নিয়ে আপনি কারো সাথে আলোচনা করেছেন।”
” হ্যাঁ, আমার ডিপার্টমেন্টে।”
” ডিপার্টমেন্টের বাইরে।”
দিগন্ত কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
” মনিরুল ইসলাম স্যার। তিনি আমাদের সাথে আমাদের ডিপার্টমেন্টে কাজ করেন। অনেক সাহায্য করেছেন তিনি তাই তাকে বলেছিলাম।”
আরাভ চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ পর বলল,
” আচ্ছা এই কলেজে আসার পর কি আপনার সাথে এমন কিছু হয়েছে, যেমন কেউ কোন কিছু দিয়েছে আপনাকে? চকলেট আইসক্রিম লজেন্স সিগারেট জাতীয় এমন কিছু।”
দিগন্ত কিছুক্ষণ ভাবলো তারপর বলল,
” একবার একজনের কাছ থেকে একটা চকলেট খেয়েছিলাম আর একবার মনিরুল ইসলাম আমায় কেক খাইয়েছিলো। কেকটা দারুন ছিলো। স্যারের হাতের বানানো।”
” হোম মেইড কেক?”
” হ্যাঁ, তবে কেকের স্বাদটা অন্যরকম ছিলো। দারুন।”
আরাভ গাড়ি থামিয়ে দিলো। দিগন্তের মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
” একটা কথা বলবো?”
” হ্যাঁ, বলুন।”
” আমাদের মাঝে কি কথা হবে সেটা কাউকে বলবেন না।কাউকে মানে কাউকে না। মনিরুল স্যারকেও নয়। বুঝতেই তো পারছেন প্রাইভেসির দরকার আছে।”
” আপনি কি তাকে সন্দেহ করছেন?”
“যতক্ষণ যা আসল অপরাধী ধরা পরছে ততক্ষণ ভিক্টিম সবাই। আপনি শুধু আমার এই কথাটা রাখেন।”
” আপনি আমায় ভরসা করতে পারেন।”
” ধন্যবাদ ডিটেকটিভ।”
দিগন্ত মৃদু হাসলো। আরাভ আবার গাড়ি স্টার্ট দিলো। সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করতে করতে বিড়বিড়াল,
” এই মনিরুল ইসলাম স্যার হয়তো এক্কেবারে ভালো। না হয় খুব খারাপ, একদম জঘন্য খারাপ।”

“চলবে,,,,,,,,,,,,,

#Mahfuza Afrin Shikha,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here