#রাজমহল
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৬
উনার অবস্থা দেখে আমি আর হাসিব দুজনেই বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। কারণ উনার সারামুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছিল। অদ্ভূত একটা ভয় উনার চেহারায় প্রকাশ পাচ্ছিল। আমাদেরকে ডেকে চেম্বারে আসতে বললেন। তাই আমরা দুজন ডাক্তার রাহনুমার সাথে চেম্বারে ঢুকলাম। চেম্বারে ঢুকে চেয়ারটা টেনে আমি আর হাসিব বসলাম। উনার অবস্থা এতটাই বিমর্ষ ছিল যে আমরা কেউ বুঝতে পারছিলাম না কি হয়েছে উনার। শুধু অপলক দৃষ্টিতে উনাকে দেখছিলাম।ডাক্তার রাহনুমা টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা নিয়ে গদগদ করে পানি খেল। তারপর হালকা নিঃশ্বাস ছেড়ে আমাদের দিকে তাকাল। উনার চোখ দেখে মনে হচ্ছে উনি বিশেষ কিছু বলবেন। আমরাও নিজেদের মধ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম সবটা শোনার জন্য। উনি উনার মুখের ঘামটা বক্সে রাখা টিস্যু টেনে নিয়ে মুছতে মুছতে বলল
– আপনাদের আমি যা বলতে যাব এটার যদিও কোনো ভিত্তি নেই বিজ্ঞানে। তবে আজকে তেমন কিছুরেই অস্তিত্ব পেয়েছি৷
আমি মনে মনে ধারণা করলাম নিশ্চয় সন্ধির ব্যাপারে কিছু বলবে ডাক্তার রাহনুমা। তাই চমকানোর কথা থাকলেও খুব একটা চমকালাম না। শান্ত আর মোলায়েম কন্ঠে বললাম
– আপনি বলুন কি হয়েছে।
ডাক্তার রাহনুমা পুনরায় একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিল। তারপর পরক্ষণেই নিঃশ্বাসটা ছেড়ে দিয়ে বলল
– আপনার বোন সন্ধিকে আমি গর্ভপাতের জন্য একটু আগে নিয়ে গেছিলাম সেটা তো জানেনেই।
– হ্যাঁ সেটা তো জানি কিন্তু কী হয়েছে?
ডাক্তার রাহনুমা ঘামটা মুছার পর ঘামযুক্ত টিস্যুটা টেবিলে রেখে বলল
– গর্ভপাতের জন্য স্বাভাবিক ভাবে তাকে অজ্ঞান করা হলো। তারপর গর্ভপাতের প্রয়োজনীয় সব জিনিস নিয়ে গর্ভপাত শুরু করতে চাচ্ছিলাম। তবে আশ্চর্য জনক হলেও এটাই সত্যি যে আমি যত বারেই সন্ধির গর্ভপাত শুরু করতে যাচ্ছিলাম ততবারই পেট থেকে এক অদ্ভুত আওয়াজ আসা শুরু করল। বিষয়টাকে আমি পাত্তা না দিয়ে পুনরায় কাজ করতে গেলাম। তবে পুনরায় সে আওয়াজ পেলাম। শুধু আমি না আমার সহকর্মীরাও একই আওয়াজ পেয়েছে। বাচ্চার কান্নার বিভৎস আওয়াজ। আমি বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করার জন্য সন্ধিকে নিয়ে গেলাম আল্ট্রা রুমে। সেখানে গিয়ে সন্ধির আল্ট্রা করে চমকে গেলাম। যেখানে আগের রিপোর্ট গুলো সাক্ষ্য দেয় যে সন্ধি জমজ বাচ্চার মা হবে সেখানে আজকের আল্ট্রাতে দেখাচ্ছে সন্ধির পেটে একটা বাচ্চা। বিষয়টা আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলে। সন্ধিকে নিয়ে পুনরায় গেলাম গর্ভপাতের জন্য। তবে এবার যখন গর্ভপাত করতে যাব এমন সময় সন্ধির পা টা আমার বুক বরাবর একটা লাথি মারে। আমি ছিটকে পড়ি। আমাকে আমার সহকর্মীরা কোনোরকমে তুলে বসায়। আমি উঠে সন্ধির কাছে গিয়ে খেয়াল করলাম সন্ধির জ্ঞান ফিরেনি এখনো। ভাবতে লাগলাম অজ্ঞান অবস্থায় একটা মানুষ কি করে লাথি মারতে পারে। তবে এটা বুঝতে পারলাম সন্ধির পেটের বাচ্চা কোনো স্বাভাবিক বাচ্চা না। আমি আমার সহকর্মীকে যেতে বলে আপনাদের কাছে আসলাম। আমার কাছে বিষয়টা স্বাভাববিক লাগছে না। যেহেতু আমার সাথে এমন ঘটনা ঘটেছে আশাকরি আপনাদের সাথে এমন কিছু ঘটেছে। যদি ঘটে থাকে তাহলে সত্যিটা বলুন।
আমি আর হাসিব দুজনেই ডাক্তার রাহনুমার কথায় নড়েচড়ে বসলাম।এবার আমাদের উভয়ের ভেতরে ভয়টা বেশি কাজ করতে লাগল। ভয়ে ভেতরটা কাঁপতে লাগল। ভয়ের প্রকাশটা যেন মুখ দিয়ে ঘাম বেয়ে বের হচ্ছে। মিনেট পাঁচেক দুজনেই বেশ নীরব ছিলাম। নীরবতা কাটিয়ে ডাক্তার রাহনুমাকে বললাম
– সত্যি বলতে সন্ধির প্র্যাগনেন্সির বিষয়টা নিয়ে আমরাও বেশ ভয়ে আছি। সন্ধি বিবাহিত না। এর আগে আপনার কাছে বিষয়টা লুকিয়েছি কারণ মানসম্মানের ভয়ে ছিলাম।সন্ধি কীভাবে প্র্যাগনেন্ট হয়েছে সেটা আমাদেরও জানার অন্তরায় রয়েছে।সন্ধির ভাষ্যমতে সে কোনো ছেলের সাথে এমন কিছু করেনি যে প্র্যাগনেন্ট হবে৷ আর সন্ধি পড়ে গার্লস স্কুলে।স্কুলে যায় আমার সাথে আসেও আমার সাথে। ওর কোনো মোবাইল নেই যে কোনো ছেলের সাথে প্রেম করবে। আর লুকিয়ে ব্যবহার করলে অবশ্যই আমার চক্ষুগোচর হত কারণ আমি সন্ধির সাথে ঘুমাই। ঐরকম কোনো আভাস পায়নি যে প্রেম করে। তবুও ভেবেছিলাম হয়তো আমাদের আড়ালে কিছু করেছে কিন্তু সে ভয়ে বলছে না কিছু।বারবার জিজ্ঞেস করার পরও সে তার কথায় অটল ছিল যে কারও সাথে কিছু করেনি। কি করব বুঝতে না পেরে গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নিলাম। পাশে বসে থাকা ছেলেটা আমার বয়ফ্রেন্ড হাসিব। সন্ধির বাচ্চার বাবা কে, সেটা জানি না তাই ওকে সন্ধির স্বামী সাজিয়ে আপনার কাছে নিয়ে আসি।
বুঝতে পারি নি কেন এমন হলো ওর। প্র্যাগনেন্সি কিট নিয়ে কৌতুহল বশত ওর টেস্ট করায় আর পজিটিভ আসে। সেদিনের রাত থেকেই এমন অদ্ভূত ঘটনাগুলো শুরু হয়। এখানে আসার আগেও অনেক অদ্ভূত ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চাইলেও পারিনি। বারবার মনের ভুল মনে হলেও সেটা মনের ভুল ছিল না হয়তো। আজকে আপনার কথায় নিশ্চিত হলাম এটা কোনো স্বাভাবিক বিষয় না অবশ্যই এ বিষয়টাতে গভীর রহস্য রয়েছে। তবে সেটা কি আমরা কেউ জানি না। একের পর এক কাহিনি রহস্যটাকে আরও পরিষ্কারের পরিবর্তে ঘোলাটে করে দিচ্ছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি বা পরিত্রাণের উপায় জানা নেই। ভেবেছিলাম সন্ধির গর্ভপাতের পর বিষয়টা স্বাভাবিক হবে তবে এখন বুঝতে পারছি সন্ধির গর্ভপাত করাটা সহজ হবে না। অলৌকিক কোনো শক্তি সবকিছুতে বাঁধা দিচ্ছে। হয়তো কোনো উদ্দেশ্য আছে তবে কি সেই উদ্দেশ্য জানা নেই। কি করলে জানতে পারব সেটাও জানি না। এখন আমরা নিরুপায়।
আমার কথা শোনে ডাক্তার রাহনুমা নির্বাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল বেশ কিছুক্ষণ হয়তো তারও জানা নেই কি করবে এসময়। বেশ কিছুক্ষণ নিস্তব আর নীরব ছিল চেম্বারটা। দরজার খটখট আওয়াজে নীরবতার অবসান ঘটে। ওপাশ থেকে হাসপাতালের কেউ একজন ডাক্তার রাহনুমাকে ডাকছে। দরজাটা খুলে আসতে বলল ডাক্তার রাহনুমা। লক্ষ্য করলাম একজন নার্স এসেছে। বয়স আনুমানিক ৪০-৪৫ হবে। মধ্য বয়স্কা মহিলা। কাঁচা চুলের ভিড়ে কয়েকটা পাকা চুলের ভাঁজের জন্যই মূলত এ বয়সটা অনুমান করতে পেরেছি। জানতে পারলাম নার্সের নাম আবিদা। আবিদা এসে হালকা কন্ঠে ডাক্তার রাহনুমাকে কিছু বলতে চাচ্ছিল। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে উনার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছিল না।মানে উনার মুখ নড়ছিল ঠিকেই তবে সে মুখ দিয়ে কথার আওয়াজটা আমাদের কান পর্যন্ত আসছে না।ডাক্তার রাহনুমা আবিদাকে পাশে থাকা টুলটা দেখিয়ে বলল
– আপনি আগে এ টুলটায় বসে দম নিন।তারপর বলুন কী হয়েছে। তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। এতে আপনার শারিরীক অবনতি হতে পারে। মুখে বলতে না পারলে লিখে বলুন। তবে শান্ত হয়ে নিন আগে।
আবিদা ডাক্তার রাহনুমার কথা শোনে হালকা দম নিতে লাগল বসে বসে। তারপর ডাক্তার রাহনুমার দিকে তাকিয়ে বলল
– ম্যাম আপনি একটু আগে যার গর্ভপাত করাতে চেয়েছিলাম।মেয়েটার নামটা যেন কি?
বলেই আটকে গেল আবিদা।হয়তো নামটা মনে করার চেষ্টা করছে। আবিদার প্রশ্নের জবাবে ডাক্তার রাহনুমা বলল
– আপনি কি সন্ধির কথা বলছেন?
ডাক্তার রাহনুমার কথা শোনে আবিদা চট করে উত্তর দিল
– হ্যাঁ সন্ধির কথা বলছি।
– কেন কী হয়েছে আবার।
– ম্যাম ঐ মেয়েটার সাথে কোনো অলৌকিক শক্তি আছে নিশ্চয়। কিছুক্ষণ আগে আপনার সাথে যা ঘটেছে সেটা তো জানেন।তবে মাত্র যা ঘটেছে সেটা দেখার পর থেকে আমি স্বাভাবিক হতে পারছি না। আমার ভেতরটা ভয়ে কেঁপে উঠছে আর বারবার ঐ দৃশ্যটা চোখে ভেসে আসছে।
ডাক্তার রাহনুমা কিছুটা অবাক হলো সেই সাথে আমি আর হাসিবও।ডাক্তার রাহনুমা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল
– কেন আবার কী হয়েছে?
আবিদা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল
– আমি আপনার কথায় মেয়েটাকে কেবিনে নিয়ে যাই।ঐখানে শুইয়ে বের হওয়ার জন্য কেবিনের দরজার সামনে আসতেই একটা ছায়া খেয়াল করলাম। মনে হলো কেবিনে ঐ মেয়েটা ব্যতীত আরও কেউ আছে।তাই আমি পেছনে ফিরলাম। কিন্তু সেখানে কেউ ছিল না। আমি আবার সামনে ফিরলে একই ছায়া লক্ষ্য করলাম।এবারও পেছনে ফিরে দেখলাম কেউ নেই। আমি আবার সামনে ফিরে পুনরায় ছায়াটা দেখলাম।তবে এবার আর পেছন ফিরলাম না। মনে হলো এবার পেছন ফিরলে দেখব পেছনটায় শূন্যতা বিরাজ করছে। তাই আমি বের হওয়ার জন্য এক পা বাড়াতেই বিকট একটা আওয়াজ কানে আসলো। আমি আওয়াজটার উৎস খুঁজতে গেলে মনে হলো আওয়াজটা পেছন থেকে এসেছে। ভেতরে ভেতরে হালকা ভয়ে নিয়ে পেছনে তাকাতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল আমার।কারণ সন্ধি মেয়েটার পেটা টা ফাঁটতে শুরু করল।ফাঁটা চৌচির পেট থেকে গড়গড়িয়ে রক্ত পড়তে লাগল।
তারপর সে পেট থেকে একটি নবজাতক শিশু বের হলো। নবজাতক ছেলে নাকি মেয়ে আমি বুঝতে পারি নি। কারন সারা শরীর পুড়ে ছিল। বিচ্ছিরি মরা পঁচা গন্ধ নাকে আসতে লাগল। মরা গন্ধে আমার পেটটা ফুলে ফেঁপে যাচ্ছিল মনে হচ্ছিল। নবজাতক শিশুটি প্রথমে পেটের উপর বসে ছিল আর খিলখিল করে হাসছিল৷ বিভৎস হয়ে হাসছিল। আমার হার্টবিট যেন এটা দেখার পর ক্রমে ক্রমে দ্রূত হচ্ছিল। দৌঁড়ে আসতে চেয়েছিলাম তবে পারছিলাম না। পা টা যেন মেঝেতে আটকে গেল। খিলখিল করে বাচ্চাটা হেসে বলল আমাকে আসার পথে বাঁধা দিলে সেটা কারও জন্য হিতকর হবে না। আমি আসব আবার আসব। বলেই বাচ্চাটা আবার পেটে ভেতর ঢুকে গেল। আর পেটটাও স্বাভাবিক আগের মতো হয়ে গেল। মনে মনে ভাবতে লাগলাম এটা আমি কি দেখলাম স্বপ্ন নাকি বাস্তব।ভয়ে ভয়ে সন্ধির কাছে গেলাম। সন্ধি অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিল। ভাবতে ভাবতে এটা আমার কাল্পনিক চিন্তা। তাই নিজেকে সামলিয়ে আসতে লাগলাম। তবে আমার চোখ গেল সন্ধির পেটে রক্তের লাল দাগে। আমি পেটের কাছে যেতেই খেয়াল করলাম সন্ধির পেটের দিকে জামাটায় রক্তের লাল দাগ লেগে আছে। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে জামাটা উপরে তুলে আরও অবাক হলাম কারণ জামাটায় লাল দাগ থাকলেও পেটে কোনো ক্ষত ছিল না। তবে আমি বুঝতে পারছিলাম এতে কোনো গোলমেল আছে। তাই সন্ধিকে ঐভাবে শুইয়ে রেখে সরাসরি চলে আসলাম আপনার কাছে।
কথাটা শোনার পর আমার যেন দম বন্ধ বন্ধ লাগছে। হালকা শ্বাসকষ্ট অনুভব করতে লাগলাম। হাসিব আমাকে শক্ত করে ধরে বলল
– শান্ত করো নিজেকে।
হাসিবের কথায় নিজের মধ্যে একটা ভরসা পেলাম। নিজেকে শান্ত করে নিলাম। এর মধ্যে ডাক্তার রাহনুমা আবিদাকে বলল
– চলো তো আমার সাথে দেখে আসি ব্যাপারটা।
বলেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার থেকে। তারপর আমাদের নিয়ে এগুতে লাগলেন সন্ধির কেবিনের দিকে। এগুতে এগুতে আমরা সন্ধির কেবিনে পৌঁছালাম। সন্ধির কেবিনে ঢুকে সবাই আতঙ্কিত হয়ে গেলাম।
কপি করা নিষেধ